অশ্রুমালা পর্ব ২৭+২৮

#অশ্রুমালা
part–27
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

সূর্যের মিস্টি আলো রোদেলার গায়ে পড়তেই সে সজাগ হয়। ঘুমু ঘুমু চোখে উঠে বসে। তার দুই পাশে আবেগ-সমুদ্র ঘুমিয়ে আছে। রোদেলা মুচকি হাসল। সে সমুদ্রের দিকে তাকালো তারপর আবেগের দিকে তাকালো। দুজনের চেহারার মাঝে কোন মিল নেই। অথচ কোথায় যেন একটা অদৃশ্য মিল খুজে পায় রোদেলা সমুদ্র আর আবেগের মধ্যে! কি সেই মিল? বা কোন জায়গায় মিল আছে তা জানে না কিন্তু রোদেলার মনে হয় ওদের মাঝে একটা মিল আছে!

সমুদ্রের চেহারা ফুটতে শুরু করেছে। প্রথম এক মাস তো নবজাতক ছিল। এখন দুই মাসের বেশি। তিন মাস হতে চলল। তাই একটু একটু চেহারা ফুটতে শুরু করেছে। তাতে যা বোঝা যায় তাহলো সমুদ্র অনেকটাই রোদেলার মতো দিকে দেখতে হয়েছে!

রোদেলা মনে মনে বলে, ইশ!যদি সমুদ্র সত্যি সত্যি আবেগের ছেলে হত!।

সে উদাস মুখেই বের হলো রুম থেকে বের হলো।

রোদেলার মা রান্নাঘরে রান্না বসিয়েছেন। রোদেলা পিছনে থেকে তার মাকে জড়িয়ে ধরে।

তার মা কিঞ্চিৎ চমকে উঠে বলে, সে কি রে? এতো বড় হয়েও এই স্বভাব গেল না?

রোদেলা হেসে বলে, না, যাবে না এই স্বভাব।

রোদেলার মা রোদেলার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, পিঠা বানাচ্ছি। ভাপা, চিতই আর তেলভাজা পিঠা। আমাকে একটু সাহায্য কর তো।

রোদেলা অবাক হয়ে বলে, হুট করে পিঠার আয়োজন কেন?

–তোরা আজকে যাবি জানলে কালকেই বানাতাম পিঠা। আমি কি জানতাম তোরা তিন দিন ও থাকবি না৷

রোদেলা জানত না তারা আজকেই চলে যাবে। মায়ের কথায় আন্দাজ করতে পারছে নিশ্চয়ই আবেগ কর্নফাম করে দিয়েছে তাই কথা আর বাড়ায় না সে।

রোদেলা তার মাকে জিজ্ঞেস করে,চিতই যে বানাবে, তুমি জানো না? আমি শুটকি ভর্তা ছাড়া চিতই পিঠা খাই না।

–শুটকি ভর্তা করে রাখছি। সেই সাথে ধনেয়া পাতা ভর্তা আর মরিচ ভর্তাও আছে। আচ্ছা শুন?

রোদেলা ততোক্ষনে ভাপা বানাতে লেগে গেছে। কাজ করতে করতে সে উত্তর দেয়, কি?

–আবেগ তো ঝাল খায় না। ওর জন্য চিতই দুধে ভিজিয়ে দিই?

–দাও। সঙ্গে নারিকেল বাটাও দুধে দিও।

–আচ্ছা।

সকালে খেতে বসে আবেগ দেখল তিন রকমের পিঠা৷ ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, তেল ভাজা পিঠা।একে একে সবার আগে তার পাতে সব পিঠা তুলে দেওয়া হলো। আবেগ খেতে লাগলো ভাপা পিঠা তার খুব পছন্দ। আর এই পিঠায় গুড়ের পরিমাণ অনেক বেশি সাথে নারিকেলের ফ্লেভার স্বাদকে বহু গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। এরপর দুধ চিতই, তেলভাজা পিঠা খেল।

তখনি রোদেলা হাতে করে পায়েসের বাটি আনল। আবেগের পায়েস খুব পছন্দ। তার ফুফু খুব ভালো পায়েস বানায়। ফুফু পায়েসে কিছু একটা দেয় যার জন্য টেস্টটা একদম অন্যরকম হয়।

রোদেলা আরেকটা বাটিতে পায়েস বেড়ে আবেগকে দিল এবং নিজে ও খেতে বসল।

রোদেলার মিস্টি তেমন একটা পছন্দ না। কিন্তু ঝাল! খুব বেশি পছন্দ। সবসময় ফুচকায় বোম্বে মরিচের টক খায়। নাগা বার্গার খায়।তাই আজকেও সে চিতই পিঠা ভর্তা দিয়ে খেতে লাগলো। চিতই পিঠা শুটকি ভর্তা দিয়ে খেতে জাস্ট আমেজিং লাগে রোদেলার কাছে। রোদেলা খুব মজা করে খাচ্ছে। তাকে দেখে আবেগের ও চিতই পিঠা ভর্তাল দিয়ে খেতে মন চাচ্ছে৷ কিন্তু কিভাবে সে মুখ ফুটে বলবে একথা?

তার যে ভীষণ লজ্জা লাগে! নিজের বাসাতেই কোন দিন সে তরকারি তুলে নেয় না লজ্জার কারনে। মা প্লেটে তুলে দেয়৷ আর এখন রোদেলা কে সে মরে গেলেও বলবে না, আমাকে একটা পিঠা দাও শুটকি ভর্তা দিয়ে খাব।

তার জায়গায় অন্য কেউ হলে নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারত কিন্তু সে পারবে না।

রোদেলা খেতে খেতে বলল, শুটকি ভর্তা দিয়ে পিঠা খেয়ে দেখ না একবার! খুব মজা। ঝাল বেশি কিন্তু কম করে নিও। দেই?

আবেগ খুশি মনেই বলে, দাও৷

রোদেলা ও খুশি মনে পিঠা দিল আবেগকে। আবেগ খেয়ে বুঝল রোদেলার কথা একটু ভুল। এই খাবার টা শুধু মজা না খুব খুব মজা খেতে!

খাওয়া শেষ করে উঠানে গিয়ে বসে আবেগ৷হাতে চায়ের কাপ। খাটি গরুর দুধের চা।

শীত পোহাতে দারুন লাগছে। শীতের শুরু কেবল! আরো কয়েকদিন থাকতে পারলে ভালো হত। কিন্তু জীবিকার তাগিদে আর থাকা হবে না৷ পড়শু দিন ই তাকে হাসপাতালে প্রেজেন্ট থাকতে হবে।

পাশেই তালুকদার সাহেব বসে পেপার পড়ছেন। ফুফা সাহেব এমন এক লোক যে পৃথিবী ধ্বংস হলেও উনি ওনার মতো শান্ত হয়ে বসে খবরের কাগজ পড়বেন। জগতে কিছু মানুষ এমন থাকে।

উঠানের আরেক পাশে রোদেলা আর ফুফু বসে সমুদ্রের গায়ে তেল মালিশ করছে আর গুটুর গুটুর করে গল্প করছে মা-মেয়ে। ভালোই লাগছে দেখতে দৃশ্যটা। আবেগ চায়ে চুমুক দিল। সত্যি ঢাকার গুড়া দুধের চায়ের তুলনায় ফুফুর বানানো গরুর দুধের চা খুব মজা। অন্যরকম স্বাদ। চায়ের কাপে দুধের সর ভেসে বেড়াচ্ছে।আবেগ দুধের ছানা পছন্দ করে জন্য নাকি ফুফু ছানা বানাচ্ছেন এমনটাই শুনেছে সে।

হুট করে গ্রামের এক বুড়ি মহিলা এলো তাদের উঠানের সামনে। আবেগ আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখতে থাকে।

রোদেলা তাকে দেখে সালাম দিল৷ মহিলা দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে লাগলো। কিছুক্ষন পর তার পুটলি থেকে কাঁথা বের করল। যে সে কাঁথা না নকশিকাঁথা।

খুবই সুন্দর কাজ। হাতের নিখুঁত কাজ করা। লাল-নীল-সাদা-কমলা সুতা দিয়ে বানানো। চমৎকার দেখতে। এককথায় মনোমুগ্ধকর!

রোদেলা নেড়েচেড়ে কাঁথা দেখছে৷ ভাব-সাব দেখে মন হচ্ছে রোদেলা নকশিকাঁথা কেনার জন্য ই মহিলাকে ডেকে এনেছে।

এতোক্ষণ নকশিকাঁথার দিকে চোখ থাকলেও এখন আবেগের চোখ রোদেলার দিকে। সেকি!

রোদেলার রুপ তো নকশিকাঁথার চেয়েও বেশি!

এবার আবেগ নকশিকাঁথার দিকে তাকালো। সত্যি বলতে এখন আর তার নকশিকাঁথা দেখতে প্রথমবারের মতো সুন্দর লাগছে না! ব্যাপার টা অদ্ভুত তো!

রোদেলা আবেগকে উদ্দেশ্য করে বলে, কোনটা নিব?

আবেগ নিলিপ্ত গলায় বলে, সব গুলোই নাও।

রোদেলা অবাক হয়ে বলে, এখানে পাঁচটা আছে। এতো গুলো নিব?

–হুম।

–আচ্ছা।

আবেগ মহিলাটাকে উদ্দেশ্য করে বলে, কত পড়বে?

–সাত শ।

–আচ্ছা।

নকশিকাঁথা কেনার পর্ব শেষ করে শুরু হলো প্যাকেটিং পর্ব।

ফুপা আর ফুফু অনেক কিছু সঙ্গে দিল। খেজুরের গুড়, নারিকেল,গরুর দুধ। দেশী মুরগির ডিম, পিঠা, খই।

দুপুরের দিকে রোদেলা গোসল করতে গেল। তার সব শাড়িই মেলে দেওয়া। একটা বাদে যেটা সে বিকেলে পড়বে। অগত্যা পুরোনো একটা সালোয়ার কামিজ পড়তে হলো তাকে। অনেক আগের এই কামিজ। হাত কাটা। এই শীতে হাত কাটা জামা পড়া অনেক হাস্যকর কিন্তু তবুও নিরুপায় হয়ে পড়তে হয় তাকে। রোদেলা মনে মনে ঠিক করেই নেয়, বাথরুম থেকে বের হয়েই রুমে গিয়ে শাল জড়াবে৷ কারন ডান হাতের উপরের অংশে কালো পোড়া দাগ আছে৷

রোদেলা বাথরুম থেকে বের হয়েই দেখে আবেগ তার সামনে দাড়িয়ে আছে। আবেগ কে দেখে এক প্রকার অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে রোদেলা।

মনে মনে বলে, ও এখানে কি করে?

রোদেলা মুখে বলল, কিছু লাগবে?

আবেগ মাথা নাড়ল অর্থ তার কিছু লাগবে।

রোদেলা বলল, কি?

আবেগ রোদেলার সামনে এসে তার হাতের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলে, এটা কিসের দাগ? কিভাবে লেগেছে?

রোদেলা তোতলানো শুরু করে।সে বলে উঠে, আ,,,জন্ম দাগ এটা!

–আমাকে তুমি দাগ চেনা শেখাও? এটা পুড়ে যাওয়ার দাগ। কিভাবে হয়েছে?

রোদেলা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে, রিশাদ ছাড়া এতো বড় ক্ষতি আর কে করবে?

আবেগের বুকটা দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগে। এদিকে রোদেলাও কেদে যাচ্ছে।

হুট করে আবেগ রোদেলাকে জড়িয়ে নেয়। এতে লাভ তো হলো না বরং ক্ষতিই হলো। রোদেলার কান্না এবার হাউমাউ কান্নায় রুপান্তর হলো আর আবেগ আরো অশান্ত হয়ে পড়ে৷
#অশ্রুমালা
part–28
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

–কান্না থামাও, রোদলা। স্টপ ক্রায়িং।

রোদেলা তবুও আবেগের অবাধ্য হয়ে কেদেই চলল।

আবেগ রোদেলাকে শক্ত করে ধরে রেখে বলে, পোড়ার দাগ তো বেশ আগের। এখন তো আর ব্যথা নেই। তাহলে অযথা কান্না করার দরকার নেই তো! (শান্ত ভাবে)

রোদেলা কান্না মিশ্রিত গলায় বলে, কিছু কিছু পীড়া ব্যথা পশমিত হওয়ার পর ও এর যন্ত্রণা মনের ভেতর তাড়না করে বেড়ায়।

আবেগ এই কঠিন জবাবের বিপরীতে কোন কথা ছুড়ল না৷

শুধু বলল, রুমে যাও।

ব্যস রোদেলাও গুটি পায়ে সামনের দিকে আগালো।

আবেগ রোদেলার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবতে লাগলো, রিশাদ কি রোদেলার উপর অনেক অত্যাচার করত? তার কি উচিত রোদেলাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা?

পরমূর্হুতে মত পাল্টালো আবেগ৷ সে মনে মনে বলে, নাহ থাক। আমার কিছু ই জানার নেই রোদেলার কাছ থেকে৷ ওর অতীত জানতে চাই না।

বাকি সময় টা রোদেলা গোমড়া মুখেই থাকল। সে ঢাকা যাওয়ার আগ পর্যন্ত সমুদ্র কে কোলে নিয়েই ছিল। একবারো কোল থেকে সরায় নি সমুদ্র কে রোদেলা। কেন যেন সমুদ্র কে কোলে নিলে, বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরলে বুকটা ঠান্ডা হয়ে আসে রোদেলার।

রোদেলা সমুদ্র কে কোলে নিয়ে বাড়ির চারপাশে ঘুরছে আর একটা অদ্ভুত কথা ভাবছে, সমুদ্র যখন অনেক বড় হবে। অনেক মানে অনেক বড়। কথা বলা শেখা না ডিরেক ডাক্তার হওয়ার পর যখন সমুদ্র বিয়ে করবে সেই সময়কার কথা কল্পনা করছে রোদেলা।

বিয়ের পর যদি সমুদ্র বলে সে তার বউ নিয়ে আলাদা থাকবে? তখন রোদেলা কি করবে? কিভাবে তার ছেলে ছাড়া থাকবে? এসব ভাবতে ই তার চোখ আবছা হতে লাগলো। অযথা কাদা যেন রোদেলার নিত্যদিনের স্বভাব হয়ে গেছে। রোদেলা ভাবল, এবার তার উচিত মজার কিছু ভাবা। যেমন–যেদিন সমুদ্র ডাক্তারি পাশ করবে সেদিনটা কেমন হবে? সে কি বুড়ি হয়ে যাবে?
চুল পেকে সাদা হয়ে যাবে।

সমুদ্র এপ্রোন পড়ে আসবে তার মায়ের কাছে৷ স্টেথোস্কোপ হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকবে মায়ের সামনে। তারপর?

তারপর এক গাল হেসে বলবে, অবশেষে মা আমি ব্যাচেলর অফ মেডিসিন এন্ড ব্যাচেলর অফ সার্জারির উপর ডিগ্রি নিয়েছি নাকি সহজ বাংলায় বলবে,মা আমি ডাক্তার হয়ে গেছি। এখন থেকে তোমার চিকিৎসা আমি করব!তোমার অপূর্ণ ইচ্ছা আমি পূরন করে দিলাম!

রোদেলার চোখ চিকচিক করছে। তার খুব শখ সমুদ্রের গায়ে হলুদে,তাকে কে নীল রঙের পাঞ্জাবি পড়াবে৷ একদম ওসেন ব্লু রঙের পাঞ্জাবি পড়বে সমুদ্র! ইশ! কি অমায়িক সুন্দর দিন হবে! এই দিন গুলো স্বচোখে দেখার সৌভাগ্য কি তার হবে? আল্লাহ পাক কি তাকে ওই দিন দেখার সুযোগ দিবে?

সমুদ্র বিয়ের দিন কি করবে? লজ্জা পাবে? না আজ-কালের ছেলেদের মতো বউ নিয়ে স্টেজে দাড়িয়ে নাচবে? নাকি আবেগের মতো মুখ কঠিন করে বসে থাকবে? কে জানে অদূর ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে।

টাইম ট্রাভেল করা গেলে অবশ্যই অবশ্য ই সে সবার আগে দেখবে সমুদ্র ডাক্তার হতে পারে কিনা? নামের আগে কি পারবে ডা. বসাতে?
নেইম প্লেটে কি লেখা রইবে “Dr. Somudro?”

আবেগ রোদেলাকে খুজতে খুজতে উঠানে আসল। মেয়ে টা সমুদ্র কে কোলে নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুব দিয়েছে। এবং একা একা হাসছে যা দেখে আবেগের মাথা ঘুরে গেল।

আবেগ হতভম্ব হলো। তারা আর আধ ঘন্টা পর বের হবে। অথচ! রোদেলা এখনো রেডি হয় নি? কি এতো ভাবছে?

সে রোদেলার সামনে গিয়ে দাড়ালো এবং তাকে ডাক দিল।

রোদেলার ধ্যান ভেঙে গেল। সে হচকচিয়ে উঠে।

–কি হয়েছে তোমার? আমি তোমার মধ্যে অস্বাভাবিকতা দেখতে পাচ্ছি রোদেলা। ইউ নিড ট্রিটমেন্ট।

রোদেলা মাথা নিচু করে বলে, কিছু হয়নি আমার।

আবেগ কথা বাড়ালো না। সে যখন উঠানে আসল, তখন রোদেলাকে একা একা হাসতে দেখেছে৷ এটা ভাল লক্ষণ না। এমনি রোদেলা র উপর অনেক কিছু গিয়েছে। না জানি এর সাইড এফেক্ট কিছু হয় কিনা? এস এ ডক্টর তার ডাউট হচ্ছে। যথাসম্ভব রোদেলার সাথে ভালো বিহেইভ করতে হবে। হাসি-খুশি রাখতে হবে রোদেলা কে।

আবেগ রোদেলা কে সঙ্গে এনে রেডি হতে বলে। রোদেলা রেডি হলে তারা বেরুনোর জন্য প্রস্তুতি নেয়। বিদায় বেলা রোদেলা আরেকদফা কান্না করল। বাবাকে জড়িয়ে ধরে তো মাকে জড়িয়ে ধরে তার কান্না চালিয়ে গেল।

এদিকে আবেগ সমুদ্র কে কোলে কান্নার দৃশ্য দেখতে থাকে। তার কান্নার দৃশ্য একদম ভালো লাগে না। মানুষ কাদলে বিভৎস দেখায়। কিন্তু রোদেলাকে মোটেও বিভৎস লাগে না। বরং তার চেহারার সাথে অশ্রুমালা একদম মিশে গেছে৷ একটা মানুষের যেমন নাক থাকবে। আর না থাকলে যেমন অস্বাভাবিক দেখায়, তেমনি রোদেলার চোখে অশ্রু না থাকাই এবনরনাল!

আবেগ ঠিক করল আজকে থেকে রোদেলার নিক নেইম অশ্রুমালা। সে চাইলে অশ্রু রাখতে পারত কিন্তু রোদেলা যখন কাদে তখন একবারে অনেক গুলো চোখের জল ফেলতে থাকে তাই আজ থেকে নাম তার অশ্রুমালা। ইন ইংলিশ, টিয়ারস!

বিদায় শেষে রওনা হলো বাসস্টান্ড। আজ রিকশা করেই স্ট্যান্ডে গেল। আজকে ও আকাশে পাখি উড়াউড়ি করছে৷ কিন্তু আজকে রোদেলার খুব খারাপ লাগছে৷ মনের মধ্যে এক চাপা কষ্ট বিঁধে আছে। পাখি গুলো কি তাকে বিদাই জানাচ্ছে? জানাতে পারে সম্ভবত। রোদেলার মুখ কালো হয়েই আছে। সে খুটিয়ে খুটিয়ে চারপাশ দেখে নিচ্ছে। চোখ দিয়ে দেখেই তৃষ্ণা মিটাচ্ছে। আর কবে দেখা মিলে? আর যদি কোনদিন না দেখতে পায় প্রিয় গ্রাম টা তাই চোখের পিপাসা মিটিয়ে নিচ্ছে। চোখের পাতায় স্মৃতি পুজি করে নিচ্ছে প্রিয় গ্রামটাকে।

আবেগ আড়চোখে তাকে দেখে যাচ্ছে। সে নিচু গলায় বলে, নেক্সট বার হাতে আরো সময় নিয়ে আসব।

–হু।

–মন খারাপ তোমার?

–উহু।

–গুড।

তখন পড়ন্ত বিকেল। সূর্য টকটকে কমলা হয়ে এসেছে। চাইলেই সূর্যের দিকে তাকানো যাচ্ছে। তেজ পড়ে গেছে তার। মাটির কাচা রাস্তা পেড়িয়ে ভালো রাস্তায় উঠে পড়ে তারা।

চারপাশে লাল আভা ছড়িয়ে গেছে। সবুজ গাছ গুলো মৃদ্যু বাতাসে দুলছে। খেজুর গাছ গুলোও পাড় হয়ে গেল তারা। সত্যি বলতে যতো সামনে আগাচ্ছে ততো কষ্ট লাগছে রোদেলার। আসার সময় এই দৃশ্য দেখে রোদেলার মন নেচে উঠেছিল অথচ আজ তার কষ্ট লাগছে একই দৃশ্য দেখে। মানব জীবন বড়ই বৈচিত্র‍্যময়!

বাসে উঠে সব ব্যাগ-পত্র ঠিক ভাবে রেখে, রোদেলাকে বসিয়ে রেখে আবেগ বাস থেকে কিছু না বলে নেমে গেল। আবেগের এহেন কান্ডে রোদেলা ঘাবড়ে গেল। আবেগ হুটহাট কিছু না বলে কই গেল? বাস তো আর কয়েক মিনিট পর ছেড়ে দিবে। তাকে ফেলে রেখে কোথায় গেল? রোদেলা ঘামতে লাগল।

বাস ছাড়বে ছাড়বে ভাব। সে আবেগের ফোনে কল লাগায় কিন্তু ফোন বন্ধ কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না রোদেলা৷

হেল্পারকে কি বাস ছাড়তে মানা করবে?

বাস ছেড়ে দিবে তার এক সেকেন্ড আগে আবেগ বাসে উঠল। হাত ভর্তি খাবার৷

বাম হাতে দুই কাপ গরম গরম মালাই চা। বাস স্ট্যান্ডের পাশের চা ঘরের চা এটা। আসার দিন যে চা ঘরটা বন্ধ ছিল সেই চা ঘরের চা আর ডান হাতে এক প্যাকেট ক্রিমওয়ালা বিস্কুট আর লাল-কমলা লজেন্স। যেগুলোর কথা রোদেলা তাকে বলেছিল। সেই সাথে এক ধরনের প্লেইন কেক ও কিনে নিয়ে বাসে উঠে আবেগ। আবেগকে দেখে স্বস্তি পায় রোদেলা। পরক্ষনে তার ছোটবেলার প্রিয় খাবার দেখে সত্যি অনেক বেশি খুশি হয় রোদেলা।

চা খাওয়া শুরু করতেই বাস ও চলা শুরু করে। নিজ গন্তব্যে পৌছানোর তাড়া আবেগের না থাকলেও ড্রাইভারের বহুত তাড়া। তাই তো ৮০-৯০ এর বেশি স্পিডে গাড়ি চালানো শুরু করল। ফাকা রাস্তা। শো শো করে বাস চলছে। বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা, দোকান সব পিছনে ফেলে সামনে যাচ্ছে তারা। উদ্দেশ্য ভোরের আগে ঢাকা পৌছানো।

রোদেলার মন খুব দ্রুত পাল্টাতে শুরু করল। প্রথমে গোমড়া থাকলেও সে এখন অনেক খুশি। আর এই খুশি ভাব সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। তার দুইহাতে দুটি প্যাকেট। ঠিক আগে বাবা কিনে দিলে যেমন খুশি হত আজকেও তেমনি খুশি লাগছে তার। আরো একটা বিষয় ভাবতেই তার মন নেচে উঠছে তাহলোঃ আবেগের মনে ছিল তার বলা কথা? দেটস মিন হি কেয়ারস ফর রোদেলা!

★★★

ঘুমিয়ে গিয়েছিল অথৈ৷ বাবার রুম থেকে এক বুক অভিমান নিয়ে রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়েছিল। কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল মনে নেই তার।

উঠে বসতেই খেয়াল করে, বালিশ ভেজা। সে কি কেদেছিল? কি জানি? আজ-কাল তার কি যেন হয়েছে, কখন কাদে কখন হাসে সে নিজেই বুঝে না। কান্না করেছিল বোধহয়।

অথৈয়ের নাকে পোলায়ের গন্ধ এলো। সে ভ্রু কুচকে ফেলে। হুট করে রাতে পোলাও কেন? দুপুরে তো ভাত খেয়েছে। তার জানা মতে কেউ আসবেনা আজকে। তাহলে পোলাও কেন?

হোক পোলাও রান্না তার কি? তবে সে যদি এখন ষোড়শীর কিশোরী হত তবে অবশ্যই মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করত কেন এখন পোলাও রান্না করছে?

অথৈ শুয়ে পড়ল। তার মন ভালো নেই। বাবা ও চায় না বোধহয় সে জব করুক। তাহলে আর কি করার বাধ্য মেয়ের মতো জয়েন করবে না।

সব স্বপ্ন তো আগেই মুচড়ে গেছে। তাই খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না তার। কিংবা কষ্ট পাওয়ার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে তার।

অথৈ কি মনে করে রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে গেল। মা রান্না করছে।

অথৈ মাকে জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ পোলাও কেন?

তার মা রান্না করতে করতে বলে, কি জানি? তোর বাবা করতে বললো। বাসায় পোলায়ের চাল ও ছিল না। উনি গিয়ে বাজার করে আনলেন। মিস্টি-দই ও কিনে এনেছেন।

অথৈ ভ্রু কুচকে বলে, কেন? কেউ আসবে?

–প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম কেউ আসবে। পরে বুঝেছি আজকে আমাদের বাসায় কারো নিমন্ত্রণ নেই।

–তাহলে আয়োজন কিসের?

তার মা রহস্যময় হাসি হেসে বলে, তুই নিজেই ভাব। বলে অন্যদিকে চলে গেলেন।

অথৈ অনেক ভেবেও কিছু ই বের করতে পারল না। তার বুদ্ধি এমনি একটু কম তাই হয়তোবা বুঝল না কেন বাসায় হুট করে পোলাও রান্না হচ্ছে বা বাবা মিস্টি কিনে এনেছেন।

কেউ যদি এই প্রশ্নের উত্তর জানে আর তাকেও জানাত তবে উত্তম হত অথৈয়ের জন্য।

★★★

রোদেলা আগ্রহ নিয়ে লজেন্স খাচ্ছে। লাল লজেন্স। আগের মতোই টেস্ট আছে। কোন পরিবর্তন আসে নি। সে খেতে খেতে আবেগের দিকে তাকিয়ে প্যাকেট টা আবেগের দিকে দিল৷

আবেগ টিটকারি মেরে বলে, আমি এসব বাচ্চাদের চকলেট খাই না। এগুলো আর কিছু দিন পর সমুদ্র খাবে। অথচ তুমি খাচ্ছো এসব৷ লজ্জা লাগা উচিত তোমার রোদেলা।

রোদেলা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, তুমি নিজেই কিন্তু কিনে এনেছো। আমি আনতে বলি নি৷

–তাও ঠিক।

–হুম। আর থ্যাংকস।

আবেগ ভ্রু কুচকে বলে, থ্যাংকস কিসের জন্য?

–এগুলো কিনে এনে আমার আবদার পূরণ করার জন্য।

–আমার কাজই তো তোমার আবদার পূরণ করা।

–কেন?।

আবেগ মুখ ফসকে বলে ফেলল, আমি তোমার হ্যাসবেন্ড না তাই তোমার সব আবদার তো আমিই ফুলফিল করব!

রোদেলা আশ্চর্যের দৃষ্টিতে আবেগের দিকে তাকালো। সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷

চলবে৷

[ আজকের পার্ট পড়ে কেউ কি বলতে পারবেন কেন অথৈদের বাসায় পোলাও রান্না হচ্ছে? ]
চলবে।

[ দিন দিন রেসপন্স কমেই যাচ্ছে। কারো কি ভালো লাগছে না গল্পটা? ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here