#আঁধারে_আলোর_হাতছানি
#লেখনীতে_মাহমুদা_মায়া
৪র্থ পর্ব
আলো ভয়ে কয়েক মুহুর্ত নিজের চোখ বন্ধ করে রাখে। চারদিকে নিরবতা বিরাজ করছে বলে সে এক চোখ খুলে তাকায়৷ সকলে এলিয়েন দেখার মতো করে নিজেদের স্থানে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। আলোর যখন খেয়াল হয় সে একটি পুরুষ হাত ধরে রেখেছে তখন সে সামনের দিকে তাকায়৷ ভয়ে দ্রুত হাত ছেড়ে দিয়ে ঠিকমতো দাঁড়ায়। তাদের সামনে আঁধার, আতিফ ও হায়দার দাঁড়িয়ে আছে। নিজের হাত অন্য একটি মেয়ে স্পর্শ করায় আঁধার হতবাক হওয়ার সাথে কিছুটা রাগান্বিতও হয়, যা তার চেহারায় স্পষ্ট উদয় হয়েছে৷ আলো আঁধারকে চিনতে পারে না। চিনবেই বা কিভাবে! সেদিন তো হেলমেট দিয়ে নিজের চেহারা ঢেকে রেখেছিল আঁধার। কিন্তু আঁধার ঠিকই চিনতে পারে। আলো তাকে চিনছে না দেখে সে আর কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় নি।
“দুঃখিত। ক্ষমা করবেন, আমি ভেবেছিলাম আপনি আয়াশ ভাইকে মারার জন্য হাত তুলেছেন। সরি, হ্যাঁ!”
ভয়ের কারণে আলোর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে৷ কথা বলার সময় বারবার চোখের পলক ফেলেছে সে। কথা শেষ হতেই তিশা ও শায়েলাকে ইশারা করে আয়াশের হাত ধরে ভার্সিটির ভেতর প্রবেশের জন্য অগ্রসর হয়। কিন্তু আঁধার আয়াশের বুকে হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়৷ অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আয়াশের উদ্দেশ্যে সে বলে,
“একটা দিয়ে চলে না? তিন তিনটা লাগে? আগে মেয়েদের উত্যক্ত করতি আর এখন হয়েছিস মেয়েবাজ!”
“কি বলছিস ভেবে, জেনে পরে বল আঁধার। কথার হিসাব কিন্তু মৃত্যুর পর দিতে হবে,” আয়াশ শান্ত হয়েই বলে।
আলো দাঁড়িয়ে ঘটনা বুঝার চেষ্টা করছে। তিশা ও শায়েলা আলোর এক হাত ধরে তাকে টানছে এখান থেকে চলে যেতে। আলো বিরক্ত হয়ে তিশা ও শায়েলার হাতে চড় দিয়ে ইশারায় ধমক দিয়ে চুপ থাকতে বলে। তিশা ও শায়েলা অভিমান করে হাত ঢলতে থাকে। গভীরভাবে একবার আয়াশ তো একবার আঁধারের দিকে তাকাচ্ছে আলো। আয়াশের উত্তরে আঁধার হেসে উঠে। সে বলে,
“ভূতের মুখে রাম রাম। মুখের কথার হিসাব দিতে হবে তা জানিস, চরিত্রের হিসাব দিতে হবে জানিস না?”
“দেখ আঁধা,,” আয়াশ আঁধারের নামটুকুও উচ্চারণ করতে পারে না। আলো মাঝ থেকে বলে উঠে,
“দেখুন, মিস্টার। আপনার ভুল হচ্ছে কোথাও। আয়াশ ভাই অনেক পরিবর্তন হয়েছে৷ সঠিক পথে আসার চেষ্টা করছে সে। আর আমরা তার গার্লফ্রেন্ড নই বরং তার বোন। আপনাকে হয়তো কেউ ভুল তথ্য দিয়ে উস্কে দিয়েছে।”
“মেয়ে হয়ে ছেলেদের মাঝে কথা বলতে এসেছ, সাহস তো মন্দ নয় দেখছি,” আঁধার গম্ভীরভাবে বলে উঠে।
“কেন মনে ভয় থাকবে? আমি আল্লাহ ভীরু। এছাড়া অন্য কাউকে কেন ভয় পাব। আর আপনাকে তো মোটেও না। ভুল করছেন, তাই বলছি আমি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বলা হয়েছে আমাদের আল কুরআনে,” আলো বলল।
“এই মেয়ে চুপ! তোমাকে হাদিস শুনিয়ে ওয়াজ করতে বলেছি? যাও নিজের ক্লাসে যাও,” আঁধার ধমক দিয়ে বলল।
“আমি ক্লাসে যাব। একটা কথা জেনে। আপনি বিগত কতদিন যাবত ক্যাম্পাসে আসেন নি?” আলোর প্রশ্নে আঁধার কিছু মনে করতে থাকে। আঁধার উত্তরে বলে,
“বিগত দুইমাস। কেন?”
“মানুষের মাঝে তখনই পরিবর্তন আসে, যখন তার মন ও মস্তিষ্ক পরিবর্তন হয়। এই দুই পরিবর্তন হতে কখনও বছর, কখনও মাস, কখনও দিন তো কখনও কয়েক মিনিটের প্রয়োজন হয়। এবার বাকিটুকু নিজেই বুঝে নিন। তারপর আয়াশ ভাইকে খুঁজবেন। আনার ভাইকে দিয়ে দরকার আছে,” আলো কথাগুলো বলে আয়াশকে ইশারা করে। আয়াশ আঁধারকে অবাক করে দিয়ে সুন্দরমতো সালাম দিয়ে আলোর সাথে চলে যায়।
আলোর কথায় চিন্তিত আঁধার আতিফের দিকে তাকায়। আঁধারকে আস্বস্ত করতে তার এক সহপাঠী এগিয়ে আসে। সে বলে,
“আঁধার, সত্যি তুমি ভুল তথ্য পেয়েছ। আয়াশ এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে।”
আঁধার রাগান্বিত দৃষ্টি নিয়ে আতিফের দিকে তাকায়। অপরাধীর মতো একটু একটু করে তাকাচ্ছে আতিফ। আঁধার কিছু বলার আগেই আতিফ বলে উঠে,
“ভাই, আমি অনেক আগে শুনেছিলাম৷ সেটাই বলেছি।”
“সত্য কথা বল,” হাতের দস্তানাগুলো পরতে পরতে আঁধার বলল।
“আসলে, তোর পরিবার নিয়ে কথা বলছিলাম। সেটাকে ধামাচাপা দিতেই,,” জড়তা নিয়ে বলতে থাকা আতিফের কথা সম্পূর্ণ হয় না। তার ভেতর থেকে যেনো কথা বের হতে চাইছে না। আঁধার বলে,
“বন্ধু না হলে এখানেই তোকে মেরে হাত ভেঙে দিতাম।”
আঁধার আর কিছু না বলে পার্কিং-এর দিকে চলে যায়। বাইকে উঠে বসে দ্রুত গতিতে বাইক চালিয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। আতিফ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল৷
ক্লাসে বসে সহপাঠীর থেকে একটি প্রশ্ন বুঝে নিচ্ছিল আলো। হঠাৎ আয়াশ এসে তাকে ডাকে। তিশাও আয়াশের দিকে তাকায়। তা দেখে আয়াশ অন্য দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তিশা কপাল কুঁচকে আবার প্রশ্নে মন দেয়। নিজ আসন ছেড়ে আলো আয়াশের কাছে আসে। সে জিজ্ঞাসা করে,
“কোন সমস্যা, আয়াশ ভাই?”
“না, কোন সমস্যা নয়। বরং সমাধান পেয়েছি,” আয়াশ উত্তরে বলল।
“কি সমধান? কোন সমস্যার সমাধান?” আলো বুঝতে না পেরে আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে।
“তোর প্রাইভেট টিউটর।”
“সত্যি!” আনন্দিত আলো।
“হুম। আজ সকালে যেই ছেলের সাথে তর্ক করলি না, আঁধার নামের?” আয়াশ জিজ্ঞাসা করল।
“হ্যাঁ, কেন? তার সাথে প্রাইভেট টিউটরের কি সম্পর্ক?” আলো প্রশ্ন করে।
“আমাদের ক্যাম্পাসের বর্তমান বর্ষগুলোর মাঝে আঁধার ম্যাথম্যাটিকসে ভালো। তাকে দিয়ে চেষ্টা করতে পারিস। যতটুকু মনে হয়, রাজী করাতে পারলে মাসিক বেতনটাও নিবে না। কারণ তার বাবা-মায়ের টাকা উড়িয়েই সে কূল পায় না।”
আয়াশের কথা বলার পর আলোএ দিকে তাকায়। আলো এমনভাবে আয়াশের দিকে তাকায়, যেন সে জঘন্য কিছু বলে ফেলেছে। আলো বলল,
“আর কাউকে পেলে না? ওই গোন্ডাটাকে? অইরকম ছেলে আবার ম্যাথম্যাটিকসে বেস্ট?!”
“তুই তো বলেছিলি, আল্লাহ তায়ালা কার মাঝে কোন জ্ঞান, কোন মেধা দিয়েছেন তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং নিজে জানেন ও সেই ব্যক্তির পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তবে আঁধার কেন ভালো হতে পারবে না!”
“বাহ! আমার কথা দিয়ে আমায়’ই বুঝ দেওয়া হচ্ছে? তা এমন বুঝ তিশাকে কবে দিচ্ছেন?” আলো একবার পিছু ফিরে তিশাকে দেখিয়ে বলে।
“কিসের বুঝ? আমার ক্লাস শুরু হবে৷ যাচ্ছি,” আয়াশ দুই পা এগিয়ে গেলে আলো তাকে ডাকে। পিছু ফিরে তাকালে আলো বলে,
” যাকে ভালোবাসো, তাকে বিয়ে করে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নিজের করে নেও। প্রতিষ্ঠিত পরেও হতে পারবে।”
আলোর কথায় আয়াশ মাথা চুলকে মুচকি হেসে চলে যায়। আলো ক্লাসে ফিরে এসে প্রশ্ন বুঝায় মন দেয়।
সন্ধ্যাবেলা,
ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে বাড়ি না ফিরে সোজা টিউশনিতে যায় আলো। ফিরতে তার কিছুটা রাত’ই হচ্ছে বলা যায়, কেননা এখনও অনেকটা পথ বাকি আছে। চারদিকে ঘন অন্ধকার নেমে আসছে। আয়াতুল কুরসি পড়ে আল্লাহ তায়ালার নাম নিয়ে ছাত্রের বাসা থেকে বেরিয়েছে আলো। বাড়ি ফিরতে রাত হলে এমনটাই করে সে। রক্ষা করার মালিক সৃষ্টিকর্তা। তিনি চাইলে আলো গভীর রাতেও একা নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাতে পারবে বলে বিশ্বাস করে আলো।
এক গলি পেরিয়ে অন্য গলিতে যেতেই এক ঘটনা আলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বেশ অবাক হয়ে যায় আলো। কোন কথা না বলে আলো তৎক্ষনাৎ ছবি তুলে মুঠোবন্দি করে নেয় ঘটনাটি। পরক্ষণে আবার বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করে।
বাড়িতে থেকে কিছুটা দূরে , এমনসময় পেছন থেকে কেউ আলোকে তার ডেকে উঠে। আলো পিছু ঘুরে তাকায় এবং কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। আঁধার তার দিকে এগিয়ে আসছে। ঠোঁটের ভাঁজে তার সিগারেট। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে সিগারেটের ধোয়া উড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। একবার অন্ধকার তো একবার আলোতে হেঁটে এগিয়ে আসছে আঁধার। আলো ভয় পেলেও তার সমস্ত চিন্তা একটি মাত্র প্রশ্নে এসে ভীড় জমিয়েছে। তা হলো, আঁধার তার নাম জানে কিভাবে? আলোর থেকে কয়েক কদম দূরত্ব বজায় রেখে আঁধার হাতের সিগারেট মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলে। সে বলে উঠে,
“আজকের ঘটনার জন্য, আমার ভুল ভেঙে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। অন্য আরেক ঘটনার জন্য দুঃখিত। ”
“অন্য আরেক ঘটনা?!” আলো অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। কারণ তার মতে আঁধারের সাথে তার আজই প্রথম দেখা হয়েছিল। আঁধার আলোর হাতের দিকে ইশারা করে বলে,
“আপনার হাতের আঘাতের জন্য আমি দায়ী।”
আলোর হঠাৎ মনে পরে তার এক্সিডেন্টের কথা। আলো মুখ হা করে, অগ্নি দৃষ্টিতে আঁধারের দিকে তাকায়।
চলবে,,,,,,, See les