আকাশী পর্ব ২৫

“আকাশী”
পর্ব ২৫.

গলির পর গলি, যানবাহনের কমতি নেই। কলেজ শেষে খাওয়া-দাওয়া সেরে রোজ টিউশানি করতে বেরুনো শুরুতে ভালো অবশ্য লাগত। পরবর্তিতে বিরক্তিকর লাগতে শুরু করেছে। একটি মানুষকে এই ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রাস্তার একপাশে বেঞ্চে বসিয়ে যদি বলা হয় সারাদিন এই যানবাহনের যাতায়াত দেখতে হবে, ঘণ্টা দু’এক পর মানুষটার যে মরিয়া অবস্থা হবে, আকাশীর তদ্রূপ অবস্থা। সকাল নিজের কোচিং করা, তারপর কলেজে যাওয়া, এসে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে কিছুক্ষণ রেস্ট করে তিনটা না বাজতেই আবার দৌড় শুরু। সন্ধ্যা ছয়টায় বাসায় ফেরে যাবতীয় কাজ সেরে নিজের পড়া নিয়ে সে বসে। তার পাশাপাশি মামাতো বোনকে পড়াতে হয়। আটটার দিকে বিল্ডিং-এর দুটো স্টুডেন্টকে পড়াতে হয়। সবই নিজেকে ব্যস্ত রাখার ধান্দা। আসলে এখানে নীরব কোনো জায়গাই নেই। বাসায় থাকলে একঘেয়েমি ভার করে। সম্বল হিসেবে আছে একমাত্র একখণ্ড আকাশ। আর তার বুকের মিটিমিটি তারা। মামাদের বিল্ডিং এর তৃতীয় তলা থেকে বেরিয়ে নিচে নামলে রাস্তা। যতদূর চোখ যায়, বিল্ডিংই দেখা যায়। অগত্যা ওখানে বসেই ওপরের খোলা আকাশ দেখে। সামনের এইটুকু রাস্তায় তৃপ্তি নেই। গেইটের বাইরে একটি বৈঠকখানা মতো আছে। দারোয়ান কাকার কাছে অনেক অনুরোধের বিনিময়ে রাতের বেলায় গেইটের বাইরে কিছুক্ষণ বসা যায়। এই ব্যতীত আর কোনো ফুরসত নেই। নিজ বাড়ি থেকে এসেছে আজ ছয়মাসেরও বেশি। তার দৈনন্দিন কাজে কেবল ছিল পড়াশোনা আর টিউশানি। এ নিয়ে একটি রুটিন হয়ে গিয়েছে। পাশে কোথাও তার বাড়ির আরও কিছু আত্মীয় আছে। তারা কোথায় থাকে তা তার জানা নেই। গ্রামে এদিক-ওদিক ঘুরার মতো সে ঘুরতে পারে না। দিনের বেলায়ও ভয় হয়, কোন সময় কোন গলির ভেতর থেকে বদলোক বেরিয়ে আসে, আর তাকে তোলে নিয়ে যায়। কেউ বুঝতেও পারবে না। গ্রামে এমন ছিল না। রাতে বাইরে অন্তত অনেক পরিচিত মানুষ থাকত আর তাকেও অনেকে চিনত। সেদিন সঙ্কোচের কারণেই সালমাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, সে আর অপূর্ব কোন কোন জায়গায় থাকে। তাদের বিল্ডিং-এ যাওয়ার মতো বিশেষ কোনো প্রয়োজনও বোধ হয়নি। তবে ছোটচাচির কথা মাঝে মাঝেই তার মনে পড়ে যায়। তিনি এখানেই কোথাও আছেন।
তাঁরা গ্রামে থাকতে আকাশীর প্রায়ই তাঁদের বাসায় যাতায়াত ছিল। সে চাচির একাজ-ওকাজে সাহায্য করে দিত। চাচিও নিঃসঙ্কোচে তার সাথে কাজে ভাগাভাগি করতেন। তিনি সবজি কাটলে সে অন্য তরকারিতে লবণ-মসলা দিয়ে দিত। এরপর চোখের পলক না পড়তেই এতটা বছর কেটে গেছে। অথচ কত কত অধ্যায় না ছিল এই নয়টা বছরে।
সেই স্মৃতি তাকে গ্রামের দিকে টানছে। অবশেষে তার বাসনা পূরণ হয়ে যায়। রোকসানা ফোন দিয়ে বললেন, ছোটচাচারা গ্রামে যাওয়ার পর দাওয়াতের ব্যবস্থা করেছেন। এই উপলক্ষে তার বাড়ি যাওয়াও হবে। আকাশী উত্তেজিত মনে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। একা ভ্রমণে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। মামিদের বিদায় দিয়ে সে একাই বেরিয়ে পড়ে। তিন-চার জায়গায় নেমে ভিন্ন ভিন্ন গাড়িতে ওঠে সে অবশেষে বাড়ির রাস্তা ধরল। সে যখন ইউনিয়নের ইন্টারসেকশনে আসে, তার মনে হয় সে যেন বহু বছর পর এই জায়গায় এসেছে। অথচ এক সময় এই জায়গা দিয়ে সে কলেজে যেত। দূরে একটা ছোট রেস্টুরেন্ট দেখে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার কথা মনে পড়ে যায়। গাড়ি যখন স্কুল প্রাঙ্গণের কিছুটা আগে এসে নামে সে তড়িঘড়ি নেমে ভাড়া চুকিয়ে থমকে দাঁড়ায়। ক্লান্ত শরীর এককাপ গরম চায়ের উষ্ণতা পেলে মনটা যেমন আহ্লাদিত হয়, তার তাই বোধ হচ্ছে। কখন চোখের কোণে জল জমে এসেছে বুঝতেই পারেনি। আগে এদিকটা পিছঢালা ছিল না। এখান থেকে যতদূর চোখ যায় ইটের রাস্তা চোখে পড়েই না। সে ধীরপায়ে হেঁটে স্কুল প্রাঙ্গণে এলো। তার হাইস্কুল। একসময় এখানে সে লেখাপড়া করেছিল। কিছু পুরনো শিক্ষক বারান্দায় হাঁটছেন। সে তাঁদের সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে। সে অফিসের জানালার ওপারে মৃত্যুঞ্জয় স্যারকে দেখে নিজেকে আর থামাতে পারল না। স্যারের সাথে দেখা করে তার মন অনেক হালকা আর সতেজ হয়।
আকাশী বেরিয়ে সেই বহু প্রত্যাশিত নির্জন রাস্তাটা ধরল। সকলে যেন তার সাথে কুশলাদি বিনিময় করছে। সে তালগাছের সারির নিচে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। একটি গাড়ি শা করে পাশ কাটিয়ে গেলে তার ভ্রম ভেঙে যায়। ওঠে সে কিছুদূরের খামারের সামনের ছোট পুকুরটার পাড়ে বসে। পুকুর শুকিয়ে আছে। সম্ভবত পানি সেঁচা হয়েছে। সে ওখানে কিছুক্ষণ বসে মন জুড়িয়ে ক্ষেতের মাঝের রাস্তায় হাঁটা ধরলো। ক্ষেতের একপ্রান্ত দেখে তাসফিয়ার কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটি মৃত্যু দিবসে তার সাথে এখানেই শেষবারের মতো কথা বলেছিল। আজ যদি সে তাকে দেখত, তবে তাসফিয়া অনেক খুশি হতো। নিজের দোরগোড়ায় যাওয়ার আগে যতকিছুই তার চোখে পড়ল, সবই একেকটা অধ্যায় হয়ে তার স্মৃতিতে উঁকি দেয়। বাড়ির চারিদিকে প্যান্ডেল লাগানো। সম্ভবত অনেক বড় করে আয়োজন করা হবে। আসার পথে যেসকল প্রতিবেশীর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, তাদের মাধ্যমে এই জেনেছে, রাস্তার কাজ শেষ করার উপলক্ষেই ছোটচাচু এই আয়োজন করেছেন।
অবশেষে সে গিয়ে মাকে সালাম করল। বৃদ্ধা নানু বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। সে চলে যাওয়ার সময় তাঁর অবস্থা করুণ ছিল। তবে এতটা নয়। সে দিব্যি বুঝেছে, মামার অবহেলা। মামি নানুকে আর সামলাতে পারছিলেন না। এই কয়টি বছর সামলাতে পেরেছে। কিন্তু এখন তাঁর বয়স বাড়ার সাথে সাথে আবদারও বাড়ছে। অতিরিক্ত পাগলামি করছেন। কাউকেই পছন্দ করেন না। মামাকে নাকি দু’চোখে দেখতেই পারেন না। তাই তিনি নানুকে মায়ের কাছে দিয়ে গিয়েছিলেন। মায়ের শরীর আজীবন সজীব ছিল। বাবার যাওয়ার পর তাঁর মনের উপর দিয়ে অনেক ধকল যাওয়ায় তিনি কিছুটা রোগা হয়ে পড়েছিলেন। সেই রোগা শরীরে আজকে আরও অবসাদ জন্মানোয় মাকে অতিরিক্ত রোগা দেখাচ্ছে, দেখলেই মায়া জাগে। নানুকে সামলাতে সম্ভবত হিমশিম খেয়ে গেছেন।
আকাশী নানুর পা ধরে সালাম করতে গেলে তিনি তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু একবারও চোখ তোলে তাকালেন না কে এসেছে। সে সারা দুপুর শাড়ি পরে ইচ্ছামতো বেড়ায়। অনিকদের বাড়ির সামনে এলে অকস্মাৎ তার দেখা সালমার সাথে হয়ে যায়। এই জায়গার যেন একটা নিয়ম হয়ে গিয়েছে। যারা বাইরে থাকে, তারা কোনো উপলক্ষ হলেই একসাথে আসে এবং দারুণভাবে সময় কাটিয়ে যায়। আকাশীর আজ একেকটা মানুষকে দেখে অনেক খুশি হচ্ছে। সালমার সাথে কথা বলার সময় তার মনে পড়ে যায়, দাওয়াতের আয়োজন উপলক্ষে ছোটচাচির হয়তো সাহায্যের প্রয়োজন হবে। তার কাছে যাওয়া উচিত। আকাশীর সাথে সালমাও যোগ দেয়। তারা ছোটচাচুদের বাসার সামনে এলে জয়ের সাথে দেখা হয়ে যায়। জয় কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে কিন্তু কিন্তু করে বলল, ‘কেমন আছ আকাশী?’
‘ভালো। আপনি ভালো তো?’
জয় মৃদুভাবে মাথা দোলায়। আকাশী তার সাথে সালমার পরিচয় করিয়ে দেয়। সালমাকে সে চিনেছে। কিন্তু কে তা ধরতে পারেনি, তাকে খুব ছোট থাকতে দেখায়। তারা অন্দরে গিয়ে সানজিদা আর কাজের লোকদের সাহায্য করে অতিথির আপ্যায়নে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত শুরু হলে বাহিরে লোকের সমাগম শুরু হয়। সে শেষবারের মতো এমন আয়োজন যেদিন দেখেছিল, সেদিন ছিল তার জন্য অনেক বড় একটি স্মরণীয় দিন। সেদিন এই বাড়ির নামকরণ তার নামেই করা হয়েছিল। এখন যে কেউ গেইট দিয়ে প্রবেশ করলে ওপরের প্লেটে দেখতে পায়, বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘আকাশী বাড়ি।’ ঘটনার ভিত্তিতে অনেক বাড়ির নামকরণ করা হয়। কিন্তু এই বাড়ির নামকরণ করা হয়েছিল কারো কর্মের ভিত্তিতে। ভাবলে বুক ফুলে উঠে। এই সৌভাগ্য কার কার জুটে!
আকাশী তিনদিন থাকার পরিকল্পনা করে এসেছে। যাওয়ার দিনের আগে রাতে সে তার ফেলে যাওয়া প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে গিয়ে একটি বাক্সের দিকে নজর আটকায়। সেই সাথে গা বেয়ে শিহরণ বয়ে যায় সেই স্পর্শকাতর রাতের কথা ভেবে। সে অপূর্বের কাছাকাছি ছিল। তার নিশ্বাস অনুভব করে আকাশীর শরীরের প্রতিটি লোম খাঁড়া হয়ে গিয়েছিল। মুহূর্তটার কথা মাথা থেকে তৎক্ষণাৎ ঝেড়ে নূপুরের বাক্সটা সে হাতে নেয়। অপূর্বের সঙ্গে এরপর থেকে আর দেখা হয়নি। তিনি হয়তো আর আকাশীর মুখ দেখতেও চান না। তবে তার দেওয়া উপহার রেখে কি লাভ! এগুলো ফেরত দিতে হবে। তার কোনো জিনিস রাখার অধিকার আকাশীর নেই। সে তখন মাহমুদের বাসায় যায়। দুইদিন আগে এখানে ঝকমকে একটা পরিবেশ ছিল। বড়চাচু ছোটচাচু দুজনই আছেন। কিন্তু এখন কোনোদিকে বিন্দুমাত্র আওয়াজ নেই। যান্ত্রিক শহরে বসবাসরত মানুষের অবস্থা হয়তো এভাবেই নিস্তব্ধতার বনে যায়। ছোটচাচিকে রান্নার কাজে আকাশীর সাহায্য করে দিতে হলো না। বড়চাচি তার সাথে আছেন। তবে ছোটচাচি তাকে প্রতিবারের মতোই ঘরদোর গুছাতে বললেন। নিচের রুমগুলো গুছাতে গিয়ে সে জয়ের রুমে এসে পড়ে। তার রুমের চারিদিকটা পরিপাটি, গুছানো, বেশ ছিমছাম। রুমের গুছালো ভাব দেখে জয়কে বড় দায়িত্ববান ছেলে হিসেবে ধরা যায়। আকাশী দরজা থেকে ফিরে যাওয়ার সময় জয় ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। আকাশী সিঁড়ি বেয়ে ওঠতে গেলে সে পেছনে এসে দাঁড়ায়।
আকাশী ফিরলে সে বলল, ‘কিছু কি বলার ছিল?’
‘না তো!’
‘তবে এভাবে দরজার কাছে এসে চলে যাচ্ছ কেন?’
‘আমি গুছাচ্ছিলাম। আপনার রুমে এসে দেখলাম তার প্রয়োজন নেই।’
‘ওহ্।’ জয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার নিশপিশ দেখে বোধ হলো, সে কথা বলতে চাইছে।
আকাশী বলল, ‘এতক্ষণ কী করছিলেন?’
‘গেইমস.. গেইমস খেলছিলাম।’
‘টাইম পাস হচ্ছে না বুঝি?’
‘হুঁ। শহরে তো বন্ধুদের সঙ্গে রাতের বেলায় ঘুরতে পারি।’
‘ওহ্। আমি একটু উপরের দিকে যাই। ফিরে এলে দেখা হবে।’
‘ঠিক আছে অপেক্ষা করব। কথা বলার জন্য মানুষের বড় অভাব।’ জয় মিষ্টি একটা হাসি দিলো।
আকাশী সিঁড়ি বেয়ে অপূর্বের রুমে উঁকি দিয়ে দেখল সে নেই। এই সুযোগই সে চেয়েছে। ভেতরে পা রাখতেই একরাশ বিরক্তি তার মনে ছেয়ে গেল। লোকটি সারাদিন করে কী? নিজের রুমটা গুছাতে পারে না? অপরদিকে জয়ভাইকে দেখ, কত ভদ্রতা তার রুমে ছড়িয়ে আছে। দায়িত্ববোধ বলতে কিছুই নেই। আকাশী প্রথমে নূপুরের বাক্সটা রেখে দিলো। এমন জায়গায় রেখেছে, সহজেই অপূর্বের চোখে পড়বে। রুমের চারিদিক পরিষ্কার করে সে বিছানায় এসে ছড়ানো কাপড় ভাঁজ করার জন্য বসে। অপূর্বের শার্ট ধরতেই তার হাত কাঁপল। আগে সে অনেকবার এসব কাজ করেছে। অপূর্ব তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়েও কত করিয়েছে। কিন্তু আজ কেন এমন হচ্ছে? ভাবনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে সে গুছাতে লাগল। পরক্ষণে কী ভেবে সে ধোয়া শার্টের ঘ্রাণ নেয়। ঠিক এই ঘ্রাণই তার সবচেয়ে বেশি পরিচিত। সেদিন যদি সে অপূর্বকে গ্রহণ করে নিত, তবে আজ তার সবকিছুতেই আকাশীর অধিকার থাকত। এই ঘ্রাণে, এই শার্টে, এই বিছানায়।
আকাশীর কেন যেন খারাপ লাগা কাজ করছে। তার মন, তার জীবন এখন শূন্য। অথচ হতে পারত এতে কারো ভালোবাসার ছোঁয়া। আজ অন্তত মনটা তো শূন্যতা বোধ করত না! সে নীরবে কিছুক্ষণ বসে রইল। সে জানে জয়ের বন্ধু না থাকলেও এখানে অপূর্বের অনেক বাল্যবন্ধু আছে। সে নয়টার আগে ফিরবে না। অপূর্বের নিস্তব্ধ রুমে বসে কেমন এক অদ্ভুত ভাবনায় কিছুক্ষণ সে ডুবে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। জয় রুমেই পায়চারি করে ফোনে কথা বলছে। আকাশীকে দেখে তৎক্ষণাৎ ফোন রেখে দেয়। সে ভেতরে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে। জয় কিছুদূরের একটা টুলে বসতে বসতে বলল, ‘কী হয়েছে? হঠাৎ এতো উদাসীন কেন দেখাচ্ছে তোমাকে?’
‘জানি না।’
‘জানো না নাকি বলতে চাচ্ছ না?’
‘সত্যিই জানি না।’
‘অপূর্বের সাথে দেখা হয়েছে? ও এসেছে?’
‘না।’
‘তোমাদের মাঝে….সবকিছু ঠিক আছে তো?’
আকাশী ভেবে না পেয়ে অস্ফুটভাবে বলল, ‘হুঁ।’
‘ঠিক থাকলেই ভালো। তা পড়াশোনা কেমন চলছে তোমার?’
‘যেমন চলা উচিত।’
‘কিছু ভাবছ লাইফের গোল নিয়ে?’
‘না। সবার নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য থাকলেও আমার নেই। পানি যেদিকে গড়তে চায়, গড়িয়ে পড়ে। আমারও ঠিক ওই অবস্থা।’
‘ওরকম ভালো না। কিছু একটা ভাবতেই হয় ভবিষ্যতের জন্য।’
লক্ষ্যের কথা নিয়ে তাদের মাঝে কিছু কথা কাটাকাটি চলে। জয় ওকালতির দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। আকাশীর কোনো লক্ষ্য না থাকায় তাকে কোনোদিক দিয়ে শাসানো ছাড়ছে না। সর্বশেষে আকাশী বলল, ‘আমি বড় কিছু হতে চাই না। তবে লাইফটা মিনিংফুল বানাতে চাই। এজন্যই স্ট্রাগল করি। এরচেয়ে বেশিকিছুর জন্য প্রস্তুতি নিই না। নেওয়ার ইচ্ছাও নেই। সবসময় স্বাধীন আর নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলার প্রত্যাশা রাখি।’
তাদের কথা থেমে যায় দরজায় অপূর্বকে টোকা দিতে দেখে। জয় আসতে বললে সে আকাশীর সামনের টেবিলে একটি বাক্স রেখে বলল, ‘যে জিনিস যে জায়গার জন্য তৈরি, তা সে জায়গায় থাকলেই বেশি শোভা পায়।’ বলে এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে অপূর্ব যেমন নিঃশব্দে এসেছে, তেমন করেই চলে যায়।
জয় বলল, ‘ওতে কী?’
আকাশী জবাব না দিয়ে অপলক নূপুরের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে রইল। একসময় সেটা হাতে নিয়ে জয়কে একদম কিছু না বলেই বেরিয়ে যায়। জয় হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইল।
বাসায় ফিরে বাক্সটা চেপে ধরে সে থমকে বসে রইল। অপূর্ব নিজ হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে এবং এগুলো তাকে রাখতে বলেছে। তবে তার কি আর আকাশীর ওপর রাগ নেই? যদি থাকত, তবে সে নিশ্চিত ওই নূপুর কোনো একদিকে ফেলে রাখত, আকাশীকে এর যোগ্য না ভেবে। তবে কি অপূর্বের মনে কোনো রাগ নেই? ভেবে মনে প্রশান্তি ছেয়ে গেল। ওই নূপুরজোড়া জড়িয়ে ধরে সে শুয়ে রয়। এখনই ইচ্ছে হচ্ছে, গিয়ে অপূর্বের কাছে ক্ষমা চায়। ওই রাতে তাকে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে কান্না করে। ওই রাতটা এখনও তাকে খোঁচা দেয়। এতো কাছে এসেছিল তারা, হঠাৎ করেই দূরত্ব তৈরি করে ফেলা মোটেই উচিত হয়নি। যদি তা না হতো, তবে আজ হয়তো তার জীবনে অপূর্ব থাকত।
তার মনের ভেতর খচখচ করছে। সে ওঠে বসে ছটফট করতে লাগল। মন কী চাইছে তা বুঝে উঠতে পারছে না। মায়ের ডাক পড়লে সে ওই অবস্থা থেকে উদ্ধার হয়। নানুর অবস্থা খারাপ হচ্ছে। সে মায়ের সাথে নানুকে ধরে তুলে পিঠ মেজে দেয়। তাঁর তীব্র হাঁপানি কোনোভাবে কমছেই না। আকাশী তড়িঘড়ি করে একগ্লাস পানি এনে খাইয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর নানু শান্ত হলেন। মা তাঁকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিলেন। নানুর অবস্থা আর মায়ের কষ্ট দেখে কেবল তিনদিন থাকার পরিকল্পনা আকাশীর বাতিল করতে হলো। মা হয়তো রীতিমতো একা হাঁপিয়ে উঠছেন নানুকে সামলাতে গিয়ে। নানু উঠার শক্তিও জোগাতে পারেন না। পানি খাওয়ালেও মুখের একপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। এমন দুরবস্থায় মাকে একা ফেলে যাওয়া মোটেও ঠিক নয়।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here