আগাছা পর্ব ৫

#আগাছা
#Khadija_Akter
#পর্ব_০৫

আমি হাত থেকে পানির গ্লাসটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে,তরীর রুমের দিকে ধীর পায়ে শব্দ না করে চুপি চুপি এগুতে লাগলাম।

দরজার কাছাকাছি গিয়ে ওর রুমে উঁকি দিলাম…..।

চারদিকে ভালো করে চেয়ে দেখলাম,কোথাও তরী নেই।
এবার রুমে ঢুকে ভালো করে খুঁজলাম।বাথরুমেও দেখলাম,বারান্দায়ও নেই।

এতো রাতে কোথায় যেতে পারে!সম্পূর্ণ বাসায় আমি জাস্ট একা।
এদিকে অনিকেরও কোনো খবর নেই।আমার জাস্ট নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।

ঠিক তখনি কলিং বেল বেজে উঠলো।নিশ্চয়ই অনিক এসেছে।দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম।
দেখি তরী দাঁড়িয়ে আছে,হাতে ফোন নিয়ে।

আমি বেশ কঠিন কন্ঠে জানতে চাইলাম,
–এতো রাতে কোথায় গিয়েছিলে?

–ছাদে।

–ছাদে কি?

–আমি তা তোমার কাছে বলার প্রয়োজন মনে করছি না।
তবুও বলছি,তোমার অপমানের বদলা নিতে হবে তো আমার মিসেস মেহেরীমা অনিক!
সেটারই বন্দোবস্ত করে এলাম।কিন্তু যার বাসায় থাকছি তার বাসায় বসেই কিভাবেই তার বিরুদ্ধে প্ল্যান করি বলো তো?তাই ছাদে চলে গেছিলাম।
হাহাহা

হাতের ফোনটা ঘুরাতে ঘুরাতে হেলতে দুলতে রুমে চলে যাচ্ছিল তরী,আবারও ফিরে এলো।

–আচ্ছা অনিক আসেনি?দেখছি না যে আজ!

–প্রথমত অনিক তোমার দুলাভাই হয়,সম্মান দিয়ে কথা বলবা। দ্বিতীয়ত ও আসুক বা না আসুক তোমার কি তাতে!তৃতীয়ত্ব যেটা তোমায় আগেও বলেছি আর এখনো বলছি,আমাদের থেকে দূর থাকো,বিশেষ করে অনিকের কাছ থেকে।আমাদের মাঝখানে এসো না,এটাই তোমার জন্য মঙ্গল।

–তুমি আমার মঙ্গল বাদ দিয়ে নিজেরটা নিয়ে ভাবো।

চিবিয়ে চিবিয়ে কথাটা বলে তরী হনহন করে রুমে চলে গেল।তারপর ঘাড় বাঁকিয়ে মেহেরীমার দিকে একবার চোখ কটমট করে ফিরে চেয়ে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিল।

এদ্দুর একটা মেয়ের এহেন আচরণ দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম।দিন দিন ওর যেনো ওর আরও বেশি করে প্রতাপ বাড়ছে।
নাহ্,কাল সকালেই ওকে বাসা ছাড়াবো যেকোনো মূল্যে।

রুমে এসে যেই না দাঁড়িয়েছি।তখনি আবার কলিংবেল বাজলো।
দরজা কীহোলে চোখ রেখে দেখলাম ৪০/৪৫ বছর বয়সী একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।
লোকটাকে আমি চিনি।সে অনিকের অফিসের পিয়ন।
এর আগেও বিভিন্ন কাজে এসেছিল আমাদের বাসায় কয়েকবার।
কিন্তু আজ এতো রাতে কেন!অনিকের কিছু হয়নি তো!
দুরুদুরু মনে ঝটপট দরজা খুললাম।

— আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম

–ওয়ালাইকুম আসসালাম।আপনি! এতো রাতে?
সবকিছু ঠিক আছে তো?

–জ্বী জ্বী ম্যাডাম।
অনিক স্যারের একটা চিঠি দিতে এসেছি আপনাকে।
আসলে চিঠিটা আপনাকে রাতের আগেই পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু আমি একটা ভীষণ জরুরি কাজে আটকে পড়েছিলাম।গাফলতির জন্য ক্ষমা চাইছি ম্যাডাম।

— ঠিক আছে,সমস্যা নেই।আসুন ভিতরে এসে বসুন।

–না ম্যাডাম আজ নয়।অনেক রাত হয়েছে।আজ আসি।

–আচ্ছা ঠিক আছে।ধন্যবাদ।

–জ্বী ম্যাডাম।আসসালামু আলাইকুম।
–ওয়ালাইকুম আসসালাম।

লোকটা চলে যেতেই তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে রুমের দিকে পা বাড়ালাম।কি আছে এই চিঠিতে এখনি দেখতে হবে।আর অনিক চিঠি পাঠালো কেন?ফোনই তো করতে পারতো।আর ও এখন আছেই বা কোথায়।

রুমে আসার সময় দেখলাম তরী ওর রুমের দরজা একটুখানি খুলে মুখ বের করে আমার হাতের চিঠিখানার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আমি রুমে এসে দরজা আটকে দিয়ে দ্রুত খামটা খুললাম।বড় একটা পৃষ্ঠায় গোটা কয়েক লাইন লিখা,

“মেহের,
আমি আমার অফিসের জরুরী কাজে ইন্ডিয়া যাচ্ছি।তুমি যখন চিঠিটা পড়ছো,তখন হয়তো আমি ইন্ডিয়ায় বসে আছি।
ফিরব ৩ দিন পর।

তোমার মনে যে সন্দেহ আর ঘৃণার জন্ম নিয়েছে সেটা উপেক্ষা করেও তুমি আমার জন্য চিন্তা করতে কিনা জানি না।তবে স্বামী হিসেবে আমার দায়িত্ব তোমাকে জানিয়ে দেওয়া।

খবরটা তোমাকে ফোনেও দিতে পারতাম কিন্তু কেন যেনো তোমার সাথে কথা বলতে একদম ইচ্ছে হচ্ছে না।তাই আজকের এই যুগেও তোমাকে কলমে লিখে বার্তা জানালাম।
আল্লাহ হাফেজ। ”

চিঠিটা পড়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
৩দিনের জন্য দেশের বাহিরে চলে গেল অথচ আমি এই মাত্র জানতে পারলাম।আমাকে একটাবার ফোন করে বললে কি এমন হয়ে যেত।
বাহ ওর এখন আমার সাথে ফোনে কথা বলতেও ইচ্ছে করে না!

যাইহোক,ওর ব্যাপারে জানার পর এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে।

বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।শুয়ে শুয়ে ভাবছি,
কাল রাতে অনিক বলেছিল তরীর প্রতি ওর এক্সট্রা একটা আগ্রহ আছে।কত সহজেই এই কঠিন কথাটা আমার মুখের উপর বলে দিয়েছিল।বুকের ভিতরটা চিনচিনে ব্যাথা করতে লাগলো।

বেড সুইচ দিয়ে লাইটটা অফ করে,পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

———————।

সকালে ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো।
ফোনে ভেসে উঠা নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হলাম।
এটা তো আমার চাচীর নাম্বার,বাংলাদেশী নাম্বার!
তারমানে চাচা-চাচী কি এখনো দেশেই আছে?গত একসপ্তাহ আগেই তো তাদের কানাডা চলে যাওয়া কথা ছিল একেবারের জন্য সিহাব ভাই অর্থাৎ তাদের বড় ছেলের কাছে।

তারমানে তারা এখনো যায়নি?কিন্তু কেন?

ধরতে ধরতেই ফোনটা কেটে গেল।
আবারও কল আসলো,এবার সাথে সাথেই রিসিভ করলাম।

ফোনটা রিসিভ করতেই ঐ পাশ থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম।
চাচী কাঁদছে!

–মেহু ও মেহু।তুই কবে আর আমাগো পিছ ছাড়বি ক তো?ছোডবেলায় তোর বাপ-মা মইরা যাওয়ার পর থেইকা তুই আমাগো গলায় ঝুলছোস।
তোরে নিজোগো মাইয়ার মতো কইরা আমি আর তোর চাচায় বড় করছি,টেকা -পয়সা খরচা কইরা বিয়াশাদী দিছি।ভাবছি এবার তুই তোর মতো থাকবি আর আমরা আমাগো মতন।

কত কষ্ট কইরা বড় পোলাডারে মানাইয়া ঐ দেশে যাইবার সব কিছু ঠিকও করছি।
আর শেষে আইসা কিনা তোর জন্য আমরা মরতে বসেছি রে মেহু!

কথাগুলো বলতে বলতে চাচী ডুকরে কেঁদে উঠলো।

আমি চাচীর কোনো কথাই বুঝতে পারছিলাম না।
এখানে বসে থেকে আমি আবার কি করলাম!আমার জন্য কেন তারা মরবে!

আমি অস্থির হয়ে বললাম,
–চাচী কান্না থামাও।থামাও বলছি।
–……….

–এবার বলো তোমার কি হয়েছে?কাঁদছো কেন?আর আমি কি করেছি?আমি তোমার কথার কিছুই বুঝতেছি না!
বিস্তারিত খুলে না বললে আমি বুঝবো কিভাবে?

–ঐ যে তোগো বাসাত জায়গা দিছত মাইয়াডারে, কি জানি নাম তোড়া নাকি….

আমি চমকে উঠলাম!
তরী কথা বলছে কেন?
নিশ্চয়ই তরীই কোনো গন্ডগোল পাকিয়েছে।কাল বিকালে তো ও আমায় শাসিয়েছিল!

আমি তাড়াতাড়ি বললাম,

–হুম হুম তরী,তরী নাম মেয়েটার।তারপর কি হয়েছে?কি করেছে তরী বলো।

–অর ভাই আর বাপ দুইজন মিল্লা আমাগো বাড়িত্তে গুন্ডাপান্ডা নিয়া হামলা করছে।আমাগো জানে মাইরা ফেলার হুমকি দিতাছে।
কয় আমাগো মাইয়া নাকি অগো মাইয়ারে মানি তুই তোড়ারে শান্তিতে থাকতে দিতাছস না। এল্লাইগা ওরাও আমারে আর তোর চাচারে শান্তিতে থাকতে দিব না।

আমরা তো এহন দরজা আটকাইয়া বইসা আছি।
দরজা না খুল্লে দরজা ভাইঙ্গা আমাগো বার করবো কইতাছে।

ও মেহু মেহুরে তোর লাইগা আমাগো জীবনডা যাইবো রে এহন….যে কইরাই হোক আমাগো বাঁচা।

চাচী গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করলো।

আর এদিকে সকাল সকালই এমন একটা খবর পেয়ে আমার মাথাও ঝিমঝিম করছে।

তরীরা আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হওয়ায় তত একটা আসা যাওয়া না থাকলেও,এইটুকু জানতাম যে গ্রামে বিশাল এলাকা জুড়ে ওর বাবার প্রভাব।
ওর ভাই একজন নামকরা আসামী।গুন্ডামি-মাস্তানী করে বেড়ায় এলাকায়।তাই ওদের কেউ কখনো ঘাটায় না।

তাহলে কাল রাতে তরী ফোন নিয়ে ছাদে গিয়ে কথা বলছিল তার বাপ-ভাইয়ের সাথে!

আমাকে জব্দ করার প্ল্যানই করছিল!আমি শুনে ফেললে তো চাচাকে সাবধান করে দিতাম,তাই সে বাসায় বসে কথা বলেনি!

তবে যত যাই হোক না কেন তরী যে আমার উপর বদলা নিতে ঠিক এই পন্থাটা অবলম্বন করবে তা আমি কল্পনাতেও আনিনি। আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।কি করবো আমি এখন?

ঐপাশ থেকে আবারও চাচীর কন্ঠ শোনা গেল,

–হ্যালো হ্যালো মেহু।

–চাচী আমি এখন ফোনটা রাখছি।তোমরা যেভাবে আছো,ঐভাবেই থাকো।দরজা খুলো না।
আমি তরীর সাথে কথা বলে আসি।

ফোন রেখেই দৌড়ে রুম থেকে বের হলাম,
দেখি তরী সোফায় বসে পা নাচাচ্ছে আর ফোন চাপছে।আমি চিৎকার করে বললাম,

–তরী!এসব কি হচ্ছে?কেন করছো তুমি এসব?

তরী মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তারপর চোখ নাচিয়ে বললো,

–কোনসব মিসেস মেহেরীমা অনিক!

–তুমি বুঝতে পারছো না আমি কোনসবের কথা বলছি?

–কই না তো!

–দেখো তরী,বেশি সময় নেই।ন্যাকামি ছাড়ো।তোমার বাপ-ভাইকে আমি একদমই বিশ্বাস করি না।
তাদের এক্ষুনি ফোন করে বলো আমার চাচার বাড়ি থেকে যেনো তারা সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে চলে যায়।

–কেন বলবো আমি এটা?কেন বলবো বলো?

–কেন বলবা মানে?তোমার যদি আক্রোশ থাকে তাহলে সেটা আমার উপর।তো তুমি আমার সাথে লড়ো।আমার চাচা-চাচী কি দোষ করেছে!

–নাহ্ তারা তো কোনো দোষ করেনি।কিন্তু তোমার কারণে এখন তারা শাস্তি পাবে।
ইশশ চুহ্ চুহ্ চুহ্…

তরী আফসোসের শব্দ করলো জিহবা দিয়ে।

আমি এক মুহুর্ত ভাবলাম।তারপর কন্ঠ কিছুটা নমনীয় করে বললাম,।

–তরী তুমি চাইছোটা কি এখন আমার কাছ থেকে?

কালকে রাগের মাথায় তোমার সাথে একটু কঠিন ব্যবহার করে ফেলেছি।আর এর জন্য স্যরি বলাতে চাইছো আমাকে দিয়ে,তাইতো?

–হ্যাঁ,তা তো অবশ্যই।

–……. ওকে,আই’ম সরি তরী।তোমার সাথে খারাপ আচরণ করা আমার ঠিক হয়নি।
এবার ফোন করো তোমার ভাইকে আর বলো চাচার বাড়ি থেকে চলে যেতে।

–হাহাহা!এতো অস্থির হলে কি আর হয় সুইট আপু!

একটা স্যরি দিয়ে তরীর কি হবে!স্যরি ধুয়ে কি আমি পানি খাব?
আমি ভাইকে ফোন করে চলে যেতে বলতে পারি কিন্তু আমার কিছু ২টি শর্ত আছে।

–শর্ত!কি শর্ত?কিসের শর্ত?

–বলছি তার আগে আমাকে বলো,অনিক কোথায়?কালরাতে বাসায় ফিরেনি কেন?ওর ফোন বন্ধ কেন?রাতে কে এসেছিল বাসায়?কিসের খাম ছিল তোমার হাতে?

আমার হাতে বেশি সময় নেই।না জানি চাচা চাচী কোন অবস্থায় আছে!তাই তাড়াতাড়ি ওর আওব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলাম।
তারপর বললাম,

–এবার বলো তোমার কি শর্ত আছে?

–প্রথম শর্ত হলো আমি যতদিন ইচ্ছে এ বাসায় থাকবো।আমার যেদিন ইচ্ছে হবে আমি চলে যাব।তুমি আমাকে তাড়াতে পারবে না।

–অসম্ভব!তোমার মতো মেয়েকে আমি আর একদিনও আমার বাসায় রাখতে চাই না।

–ওকে ফাইন।তাহলে তোমার আদরের চাচা-চাচী মরুক।

আমি চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।তারপর আস্তে করে বললাম,

–আর দ্বিতীয় শর্ত?

–আর দ্বিতীয় শর্ত হলো,আমার যখন ইচ্ছা আমি অনিকের সাথে কথা বলবো,টিভি দেখবো,ছাদের ঘুরতে যাবো,এক সাথে কফি খাবো কিন্তু তুমি আর আগের মতো কাজের বাহানা দিয়ে অনিককে আমার সামনের থেকে নিয়ে যেতে পারবে না।

ওর দ্বিতীয় শর্তটা শুনে আমার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো। বলছে কি এগুলো অসভ্য মেয়েটা!আমি নাকি আমার স্বামী কে ওর হাতে এমনি এমনি ছেড়ে দিব!

আর একটাও কথা না বলে,ওর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

তরী পিছন থেকে উচ্চ সুরে বলে উঠলো,
–শর্ত মঞ্জুর হলে জানিয়ে দিও কিন্তু।নাহয় আবার তোমার চাচা-চাচী…… চুহ্ চুহ্ চুহ্ !

আজকের মতো এতো অসহায় আমি হইনি কখনো।
একদিকে আমার সংসার আর অন্যদিকে আমার চাচা-চাচী!

ছোটবেলায় বাবা-মা লঞ্চ দূর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর চাচা-চাচীই একমাত্র ছিল আমার পাশে।তারা আমাকে মানুষ করেছে।আমার পিছুটান বলতে শুধু তারাই।
আর সেটা বুঝেই মোক্ষম চাল চেলেছে তরী।

ফোনটা হাতে নিয়ে কল দিলাম চাচীর কাছে।
এবার চাচা ফোন ধরলো,
–হ্যালো মা!কিছু করতে পারলি?বাইরের লোকগুলা তো আমাগো দরজা ভাঙতে শুরু কইরা দিছে রে মা।

চাচার এমন কাঁপা কাঁপা কন্ঠ আমি কখনো শুনিনি।
চাচী আমার সাথে যেমন ব্যবহারই করুক না কেন,চাচা সবসময় আমায় মাথায় তুলে রেখেছে।আর আজ আমার কারণেই সেই বৃদ্ধ চাচার এমন ভীত সন্ত্রস্ত কন্ঠ শুনে আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম,

–চাচা!আমি কিছুই করতে পারিনি।তরী যে শর্ত দিয়েছে তা মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব।

তারপর সংক্ষেপে যা যা বলা যায়,সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম চাচাকে।সব শুনে চাচা বললো,

— সাংঘাতিক বড় ভুল করছোস রে মা এমন মাইয়ারে ঘরে জায়গা দিয়া।তোর সংসার তো ছাড়খার কইরা তারপর থামবো।
আমাগো যা হবার হইবো,তুই কিন্তু অর শর্ত ভুলেও মানবি না।

চাচার কথা শুনে আমার আরও বেশি কান্না চলে আসলো।কান্না সামলে চাচাকে বললাম,

–আচ্ছা চাচা!তোমাদের তো গত সপ্তাহেই কানাডা চলে যাওয়ার কথা ছিল।কিন্তু তোমরা এখনো দেশে!

–হ রে মা।ফ্লাইট ২ সপ্তাহ পিছায় গেছে আমাগো।আগামী সপ্তাহে যামু গা।

আগামী সপ্তাহে!তারমানে আর মাত্র ৬ দিন।
‌আমার মাথায় চকিতে একটা বুদ্ধি খেলে গেল।আমি চাচাকে বললাম,

‌–আচ্ছা চাচা শুনো,আমি আপাততঃ তরীর শর্ত মেনে নেই।৬ দিন পর তোমরা দেশ ছেড়ে চলে গেলে আমাকে আর তরী কোনো কিছু দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে পারবে না।

ওকে তখন আমি ঠিকই বাসা থেকে বের করে ছাড়বো।

‌চাচারও মনে ধরলো আমার বুদ্ধিটা।এটাই ফাইনাল রইলো।

‌ফোন রেখে ড্রয়িং রুমে গিয়ে তরীকে বললাম,
‌–আমি তোমার শর্তে রাজী।

তরী একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
–আমি জানতাম তুমি রাজী হবেই।এছাড়া যে আর কোনো পথে নেই তোমার।হাহাহা!

–ফোন করো এবার তোমার ভাইকে।

–আচ্ছা করবো।

–না,এখনি করো আর সেটা আমার সামনেই।

তরী ওর বাবাকে ফোন দিল আর বললো, “আমাদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি মিটে গেছে বাবা।তোমরা এখন বাসায় যেতে পারো।

এইটুকু শুনেই আমি সেখান থেকে চলে আসলাম।
রুমে এসে চাচাকে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হলাম যে তারা চলে গিয়েছে কিনা।
তারপর হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

বারান্দায় এসে একটা বড় করে নিঃশ্বাস নিলাম।এই মুহুর্তে অনিকের কথা খুব মনে পড়ছে।ইচ্ছে করছে ওর বুকে মাথা রেখে খুব করে কাঁদি।
কিন্তু ইচ্ছেটা মনের মধ্যেই ধামাচাপা দিয়ে দিলাম।

————

দুপুরে খেয়েদেয়ে শুয়ে আছি।ফোনটা হাতে নিয়ে একবার ভাবলাম অনিককে ফোন দেই।
নাম্বার তো বন্ধ পাবো জানি।কিন্তু ইন্টারনেটে তো যোগাযোগ করতেই পারি।
হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে গেলাম।দেখি মাত্র ২মিনিট আগে অনিক এক্টিভ ছিল।
অনিক এক্টিভ ছিল,তবুও আমাকে নক করেনি।
ওর কি একটুও মনে পড়ছে না আমার কথা!আগে তো অফিসের কাজে বাহিরে গেলে দিনে ১৫বার করে ফোন দিত!

সেদিন রাতে আমার গায়ে হাত তুললো।
আর কিছু না হোক একবার স্যরি বললেও তো পারতো।কিন্তু ও এখন পর্যন্ত একদম নিশ্চুপ হয়ে রইলো যে!

আমার ৭বছরের ভালোবাসা ১ রাতেই কি ভুলে গেল ও!

এগুলো ভাবতে ভাবতে চোখের কোণ বেয়ে পানি পরছে।
অনিককে আর ফোন দেওয়া হলো না।ফোনটা বুকে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম।

সকালের ঘটনাটা কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছি না।এখন তো তুলি লাইসেন্স পেয়ে গেছে আমার কাছ থেকে,এই বাসায় থাকার আর অনিকের সাথেও সময় কাটানোর।

চোখের পানিতে বালিশ ভিজে যাচ্ছে আমার।

এমন সময় শাশুড়ীর কল আসলো ফোনে।
চোখ মুছে হ্যালো বললাম।

আম্মা আমার কণ্ঠ শুনেই নরম গলায় জানতে চাইলো,আমার কিছু হয়েছে কিনা?শরীর অসুস্থ কিনা?কাঁদছি কিনা।

যাক কেউ তো আছে যে কিনা আমার কথা মনে রাখে!আমার জন্য চিন্তা করে।
আমি আম্মার কন্ঠ আর আদুরে কথা শুনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না।হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলাম।

–আমার খুব একা লাগছে আম্মা।খুব একা।আমার কিছুই ভালো লাগে না।আমার মনে কোনো শান্তি নেই।আমার পাশে একজকে এখন খুব প্রয়োজন আম্ম।আমার ভিতরে অনেক কথা জমা হয়ে আছে।আপনার ছেলে আর আমার নেই আম্মা।আমার জন্য কোনো ভালোবাসা নেই তার মনে।আমার কোনো খবর নেয় না।
অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার। অনেক বেশি…

বলতে বলতে কান্নায় আমার কন্ঠ রোধ হয়ে আসে।

ঐ পাশ থেকে শাশুড়ির অস্থিরতা টের পাওয়া যাচ্ছে বেশ।তিনি উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন,

–কি হয়েছে মা?কি হলো আজ তোমার?আমাকে বলো?অনিকের সাথে ঝগড়া হয়েছে?অনিক কোথায়?ওর ফোন বন্ধ কেন?ওকে ফোনটা দাও তো।আচ্ছা মতোন বকে দেই ওকে।কত্ত সাহস আমার মেয়েকে কাঁদায়।

–ও ওখানে নেই মা।৩ দিনের জন্য ইন্ডিয়া গেছে।আগামী পরশুদিন দেশে আসবে।

শাশুড়ি বউ-মার মধ্যে আরও কিছুক্ষণ কথোপকথন
চলতে থাকলো..।

———–

ছেলের বউয়ের সাথে কথা বলার পর থেকেই রহিমা বেগমের মনট কেমন আনচান করছে।

মেহেরীমা তো এতো সহজে তো কাঁদার মেয়ে নয়।চাপা স্বভাবের এই মেয়েটাকে এরকম ভেঙে পড়তে সে দেখেনি গত ৪বছরেও।সবসময় কত হাসিখুশি থাকে ও।
আর থাকবে না-ই বা কেনো ও যেমন অনিককে ভালোবাসে আমার ছেলেটাও ওকে তেমনি সুখে রাখে।
কি এমন হয়ে গেল যে ওর মনে অনিকের বিরুদ্ধে এতো ক্ষোভ জমা হয়ে গেছে।
বারবার বলছিল, “আপনার ছেলে আর আমার নাই।”
এই কথার মানে কি?কোনো অশুভ ছায়া পড়েনি তো আবার ওদের সাজানো গোছানো সংসারে!

মেহেরীমাকে তিনি কখনোই ছেলের বউয়ের চোখে দেখেনি,দেখেছেন নিজের মেয়ে হিসেবে।

একটা মেয়ের খুব শখ ছিল তার।আল্লাহ তার কোল আলো করে একজন মেয়ে সন্তান দিয়েছিলেনও।

কিন্তু কেড়েও নিয়েছেন আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে……
আহ্!মনে করতে চাইছেন না তিনি,সেই দুর্বিষহ ঘটনার কথা।

সন্ধ্যাবেলায় রহিমা বেগমের স্বামী ঘরে আসতেই সে স্বামীর সাথে কিছু আলাপ-আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।

——————-

পরদিন সকাল- ৬ঃ৩০

অনেক্ষন ধরে কলিংবেল বাজছে।

এতো সকালে আবার কে এলো।
ঘুম থেকে উঠে একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ ডলতে ডলতে দরজার কাছে এলাম।
দরজার কী-হোলে চোখ রেখেই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

শাশুড়ি মা!দরজার বাহিরে আমার শাশুড়ী মা দাঁড়িয়ে আছেন!

আমি দরজা খুলেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে আম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম।

–আম্মা আপনি আসবেন আগে কেনো বলেননি?একাই এসেছেন?আব্বা কোথায়?আসেনি কেন।

–ওরে বাবা!আসতে না আসতেই এতো প্রশ্ন!
আগে তো ভিতরে ঢুকতে দাও।একটু বসি তারপর সব বলি নাকি?

আমি লাজুক হেসে বললাম,

–জ্বী আম্মা।

দরজাটা বন্ধ করে,ব্যাগগুলো নিয়ে আম্মার পিছু পিছু গেস্টরুম পর্যন্ত এলাম।
–আম্মা আপনি ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে আসেন। আমি চা বানাচ্ছি।

–আচ্ছা মা যাও।

চা রেডি করে ড্রয়িং রুমে এসে বসলাম।

আমার মনটা খুব ভালো লাগছে আজ।গত কয়েকদিনে এই একটাই ভালো লাগার মুহুর্ত আসলো আমার কাছে।মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার।

আম্মা আসাতে অন্যরকম একটা ভরসা পাচ্ছি।একা থাকতে থাকতে আর কারো সাথে কথা বলতে না পেরে এই কিছুদিন আমার ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছিল।

আম্মা ফ্রেশ হয়ে আসতেই আমি উনাকে চা দিলাম।
আম্মা হাতে চা নিতে নিতে বললেন,

–ফোনে কয়েকবার বলেছিলে যে তোমার একটা কাজিন নাকি থাকে তোমাদের সাথে এখানে?দেখছি না যে?চলে গেছে নাকি?

তরীর কথা উঠতেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল।আমি আস্তে করে জবাব দিলাম,
–না,আম্মা যায়নি।ও আরও কিছুদিন থাকবে।ওর কোচিং এখনো শেষ হয়নি।

কাজিনের কথা বলায় বউমা কেমন যেনো চুপসে গেল,চোখ এড়ালো না সেটা রহিমা বেগমের।
তাই তিনি আর এই ব্যাপারে আর কোনো কথা বললেন না।

–জানো,কাল তোমার সাথে কথা বলার পর থেকেই আমি আর এক মুহুর্তও শান্তি পাইনি।এমনিতেই কতদিন দেখি না তোমাদের তার উপর তোমার কান্না।
আমি তো তোমার শ্বশুরকে বললাম,তুমি গেলে আসো,আর না গেলে নাই।
কিন্তু আমাকে রাতের ট্রেনের টিকেট এনে দাও যে করেই হোক।
রাতটা পোহালেই যেনো আমি আমার চোখের সামনে বউমাকে দেখতে পাই।
আর দেখো ঠিকই এখন তুমি আমার সামনে!

–আব্বাকেও নিয়ে আসতেন। এসে নাহয় ২দিন থেকে চলে যেত?

–চেষ্টা তো অনেক করেছে আসার জন্য কিন্তু জানোই তো এই মৌসুমে কত ব্যস্ততা থাকে তোমার শ্বশুরের।আসতে আর পারলো কই।
আচ্ছা অনিকের কি খবর?কেন গেল ইন্ডিয়া?আর কবে আসবে?…..

আম্মা হয়তো আরও কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু তখনি তরী দরজা খুলে বের হয়ে এলো।

আমি জোর করে মুখে কিছুটা হাসি ফুটিয়ে,তরীর দিকে ইশারা করে আম্মাকে বললাম,

–আম্মা,ঐ যে তরী।আমার কাজিন,যার কথা আপনাকে বলেছিলাম একদিন।

আর তরীর দিকে চেয়ে বললাম,এটা আমার শাশুড়ী।

তরী মিষ্টি করে হেসে বললো,
–আসসালামু আলাইকুম আন্টি।

-ওয়ালাইকুম আসসালাম।
সালামের জবাব দিতে দিতে রহিমা বেগম ঘাড় ঘুরিয়ে তরীর দিকে তাকালেন।

তরীকে এক নজর দেখেই তিনি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন!

উনার হাত থরথর করে কাপছে,গরম চায়ের কিছু অংশ ছলকে তার হাতে পড়লো।সেদিকে উনার খেয়াল নেই।

তিনি চোখ বড় বড় করে এক দৃষ্টিতে চেয়েই রইলেন তরীর দিকে।
রহিমা বেগমের ঠোঁট কাপছে!চোখের পাতা কাঁপছে তিরতির করে! হাত কাঁপতে কাঁপতে একসময় ঝনাৎ করে চায়ের কাপটা মেঝেতে পড়ে গেল।

উনি তরীর দিকে ইশারা করে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে বলতে আমার চোখের সামনেই সেন্সলেস হয়ে সোফার উপর ঢলে পড়লেন!

আমি চিৎকার করে উঠে গিয়ে শাশুড়ীর পাশে বসলাম।

–আম্মা!আম্মা!
কি হয়েছে আপনার?চোখ খুলেন আম্মা!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here