আগাছা পর্ব ৬

#আগাছা
#Khadija_Akter
#পর্ব_০৬

আমি চিৎকার দিয়ে উঠে শাশুড়ীর পাশে গিয়ে বসলাম।
–আম্মা!আম্মা!কি হয়েছে আপনার?
চোখ খুলেন আম্মা!

–আমি কি ভূত নাকি পেত্নী যে আমাকে দেখেই এভাবে বেহুশ হয়ে যেতে হবে!যত্তসব পাগল ছাগলের কারখানা!

বলতে বলতে তরী বিরক্তি নিয়ে আবার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

তরীর কথা শুনে আমার অনেক রাগ উঠলো।কিন্তু এই মুহুর্তে ওর কথায় পাত্তা দেওয়ার সময় নাই।

আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কি করবো।আর আম্মা তরীকে দেখে এমন অজ্ঞানই বা হয়ে গেল কেন এটাও মাথায় ঢুকছিল না!

যাইহোক,তাড়াতাড়ি পানি এনে শাশুড়ীর মুখে পানির ছিটা দিলাম।
তারপর উনার হাতে হাত রেখে জোরে জোরে ঘষতে লাগলাম।

একটুপর উনি অল্প অল্প করে চোখ খুলে তাকালেন।
পুরোপুরি চোখ খুলতেই,হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে এমন ভাবে চারদিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন।

–আম্মা আপনি ঠিক আছেন তো?কি হয়েছে?কিছু খুঁজছেন?আমাকে বলুন এনে দিচ্ছি।

–ঐ ঐ ঐ মেয়েটা কই?ঐ মেয়েটা?

–কে?তরী?ও তো ওর রুমে চলে গেছে।

–রুমে চলে গেছে!ওহ্ আচ্ছা…..আচ্ছা।

রহিমা বেগমের মুখ জুড়ে বিষাদের ছায়া নেমে আসলো।উনাকে দেখে এখন যে কেউই বলে দিতে পারবে উনার ভিতরে ভয়ংকর কোনো ঝড় বয়ে যাচ্ছে!

আমি বুঝলাম কিছু তো একটা রহস্য আছেই এখানে।পরে সব জানা যাবে,আগে আম্মাকে একটু স্থির হতে দেই।

–আম্মা,আসেন আপনাকে রুমে দিয়ে আসি।এখন আপনার রেস্টের দরকার।সারারাত জার্নি করে এসেছেন তাই হয়তো শরীর ক্লান্ত লাগছে।
রুমে গিয়ে আরাম করবেন,আসুন।

আমার শাশুড়ী বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে দাঁড়ালেন রুমে যাওয়ার জন্য।আমি উনাকে ধরে ধরে রুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলাম।
কাঁথাটা গায়ের উপর উঠিয়ে দিয়ে বললাম,

–আম্মা আপনি এখন রেস্ট নিন।চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন, দেখবেন রিলাক্স লাগবে।
আমি আপনার জন্য নাস্তা বানিয়ে নিয়ে আসছি।

রহিমা বেগম ঘাড় কাঁত করে ইশারায় সায় দিলেন বউমার কথায়।

আমি রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে চলে গেলাম নাস্তা বানাতে।কিছু প্রশ্ন আমার মাথায় খুব করে ঘুরছে।
উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাবো না।

এতোসব চিন্তা মাথায় ঘুরছে যে রুটি বেলতে বেলতে সত্যি সত্যি আমার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো।দেয়াল ধরে কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিলাম।

————-

বিকাল-৫ঃ২৫

আম্মা আমার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছেন আর আমার সাথে গল্প করছেন।
আমিও অনেকদিন পর শাশুড়িকে পেয়ে পেটের ভিতর জমিয়ে রাখা অনেক কথা বলছি।
একজন কথা বলার সঙ্গী পেয়ে ভালোই লাগছে আমার।

আমার শাশুড়ী এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক।তবে সকাল থেকে এই পর্যন্ত তিনি নানান উছিলায় শুধু তরীর ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন অনেকবার!আর আমিও স্বাভাবিকভাবেই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি।

সকালের ঘটনাটা নিয়ে আর আমাদের মধ্যে কথা হয়নি।
কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর আমার না জানলেই হচ্ছে না।
তাই করবো না,করবো না করেও এই সেই কথায় একসময় আম্মাকে প্রশ্নটা করেই ফেললাম।

–আচ্ছা আম্মা,যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আপনার কাছ থেকে একটা কথা জানতে চাই?

–দেখো কেমন পাগলী মেয়ে আমার!কিছু জানতে চাও তো এখানে আবার অনুমতি নেওয়ার কি আছে।বলো কি জানতে চাও?

আমি কিছুটা ইতস্তত করে বললাম,।

–আপনি কি তরীকে আগের থেকেই চিনেন?
না মানে সকালে তরীকে দেখে এভাবে চমকে গেলেন কেন আম্মা?আবার সেন্সলেসও হয়ে গেলেন…….।

রহিমা বেগম দীর্ঘসময় চুপ করে রইলেন।তারপর ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে আস্তে করে বললেন,

–না চিনি না।
আর কেন চমকে উঠলাম সেটা তোমায় বলতে পারবো না বউমা।

–কিন্তু কেন আম্মা?কেন বলতে পারবেন না?কি এমন কথা যা আমাকেও বলতে পারবেন না!আপনি তো আমার কাছে সব শেয়ার করেন।তাহলে এটা কেন বলতে পারবেন না?আমার যে জানাটা খুব জরুরি!

–দেখো বউমা, আমি বলতে পারব না কারণ অনিকের নিষেধ আছে এখানে।আর আমি নিজেও বলতে আগ্রহী না।দয়া করে তুমি এটা নিয়ে আর কথা বলো না।।

আমার শাশুড়ী তেলের বাটিটা রেখে উঠে চলে যাচ্ছিলেন।আমি উনার হাতটা ধরে ফেললাম।উনাকে খাটের উপর বসিয়ে আমি নিচে বসলাম।তারপর শাশুড়ীর কোলে মাথা রেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।

মেহেরীমার এরকম মেঘ ছাড়া আকস্মিক বৃষ্টি দেখে রহিমা বেগম বেশ বিচলিত হয়ে উঠলেন।কোল থেকে বউমার মাথাটা তুলে ধরে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন,

–কি হয়েছে মা!কাঁদছো কেন?আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দেইনি তাই কাঁদছো কি?

আম্মার আদুরে ভঙ্গিতে কথা শুনে, আমার আরও বেশি কান্না চলে আসলো।
এখন পর্যন্ত তরী আর অনিকের অন্তরঙ্গতার ব্যাপারটা আমি আমার শাশুড়ীকে জানাইনি।চেয়েছিলাম ব্যাপারটা একাই সামলাবো।
কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে,আমার শাশুড়ী তরীকে নিয়ে আমার কাছে কিছু একটা লুকাচ্ছে।

সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম,এখনি আম্মাকে সব খুলে বলবো।

কাঁদতে কাঁদতেই জবাব দিলাম,

–আম্মা তরীর জন্য আমার সংসার ভেঙে যাচ্ছে!আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
অনিক নিজের মুখে আমাকে,বলেছে তরীর জন্য ওর অনেক টান আছে।আর আমি আজ এটাও বুঝে গেছি আপনিও তরীকে চিনেন কিন্তু আমাকে বলতে চাচ্ছেন না। আমার এতো বছরের সংসার সব শেষ হতে চলেছে।আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আম্মা।

রহিমা বেগম মেহেরীমার কথা শুনে প্রথমে চমকে উঠলেন।তরীর জন্য সংসার ভাঙছে মানে!

পরে একটুক্ষণ চিন্তা করেই তার কাছে সবকিছু পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল যে কেন কাল ফোনে মেহেরীমা বলেছিল,আমার ছেলে আর ওকে ভালবাসে না!আজ আবার বলছে, তরীর প্রতি অনিকের টান আছে আর তাই ও এদিকে কষ্ট পাচ্ছে।

তরী মেয়েটার প্রতি অনিকের কিসের টান সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন রহিমা বেগম।কিন্তু এই বোকা মেয়েটা তো আর জানে না কিসের টান। আর অনিকও নিশ্চয়ই মুখ খুলেনি ওর কাছে!
তাই ভুল বুঝে এই পাগলী মেয়েটা এতোটা কষ্ট পাচ্ছে।

আজ যদি মুখ না খুলি ,তাহলে আমার ছেলের সোনার সংসারটা ভুল বোঝাবুঝিতে নষ্ট হয়ে যাবে তার চোখের সামনেই।এটা রহিমা বেগম কিছুতেই হতে দিবেন না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রহিমা বেগম নিজেকে প্রস্তুত করে নিলেন অনেক বছর আগের ধামাচাপা দেওয়া একটা ইতিহাসের পাতা খুলতে।
তিনি মেহেরীমার মাথায় আলতো করে হাত রাখলেন,

–শুনো মেয়ে,তুমি কষ্ট পেয়ো না।আর আমার ছেলেটাকে ভুলও বুঝো না।
তুমি তোমার কাজিন তরীর প্রতি তোমার স্বামী অনিকের যে টান,যে ভালোবাসা,যে আগ্রহ দেখেছো সেটা কোনো প্রেমিকের তার প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা না।
সেটা হলো একজন ভাইয়ের তার বোনের প্রতি ভালোবাসা।

–বোন!

–হ্যাঁ বোন।সেই বোনের প্রতি টান যে বোন আজ থেকে ১২ বছর আগেই মারা গেছে।

বলতে বলতে রহিমা বেগম মুখে আঁচল টেনে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন।আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,

–মারা গেছে!
তাহলে তরীর সাথে আপনার মেয়ের কী সম্পর্ক!

–তুমি জানতে চেয়েছিলে না,আমি তরীকে দেখে কেন চমকে উঠেছিলাম?কারণ তরী দেখতে অবিকল আমার মেয়ে আনিকার মতো।
এটা এক আশ্চর্য বিষয়!পার্থক্য বলতে শুধু এটুকুই যে তোমার কাজিনের চোখের মনি কালো আর আমার মেয়েটার চোখের মনি ছিল বাদামী।

রহিমা বেগমের কান্নার বেগ আরও বেড়ে যায়।

এদিকে আমি কষ্ট পাবো নাকি অবাক হবো বুঝতে পারছি না।অনিকের একটা বোন ছিল আর সেটা আমি আজ জানতে পারলাম!

গত সাত বছর ধরে জেনে এসেছি অনিকই একমাত্র সন্তান তার বাবা-মার।মাত্র আজকে জানলাম তাদের আরেকজন মেয়ে সন্তানও ছিল।
কিন্তু এটা লুকানোর কি আছে?লুকালো কেন আমার কাছে এটা তারা!

একটু চুপ থেকে আমি আবার জানতে চাইলাম,

–আম্মা অনিকের একটা বোন ছিল কিন্তু এখন আর নেই।এটা বুঝলাম।আর আমার বোন তরী দেখতে অনেকটাই আপনার মেয়ের মতো এটাও বুঝলাম।

কিন্তু আপনি তাহলে এই সহজ একটা কথা আমাকে বলতে এতো দ্বিধাবোধ করছিলেন কেন?অনিকও তো কখনো আমায় বলেনি এই ব্যাপারে।
আর আপনার মেয়ে আনিকা মারাই বা গেল কিভাবে?

–তুমি শেষ যে প্রশ্নটা করেছো না মা?ঠিক এই প্রশ্নটার মুখোমুখি হতে হবে বলেই আমরা কখনো কাউকে জানাই না,আমাদের যে আরেকটা সন্তান ছিল!

–মানে?

–বলছি সব বলছি। আনিকার কথা বলেই যেহেতু ফেলেছি,এখন সবই বলবো তোমায়।কিচ্ছু আর লুকাবো না।তবুও তোমাদের সংসারটা বাঁচুক।
কিন্তু মা,অনিক যদি জানতে পারে এসব কথা আমি তোমাকে বলেছি।তারপর কী হবে আমি জানি না।

রহিমা বেগমের গলা কেঁপে উঠলো।আমি উনাকে অভয় দিয়ে বললাম,

–অনিক কখনো জানবে না,আম্মা।আর জানলেও সেটা আমি ম্যানেজ করে নিব।আপনি নিশ্চিন্তে বলুন।

–অনিক আর আনিকা,এই ২ ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার ছিল সুখের সংসার।তোমার শ্বশুর আব্বা তখন একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন।উনার চাকুরীর সুবাদে আমরা বগুড়াতে থাকতাম সরকারী কোয়ার্টারে।সেখানেই ওদের দুই ভাইবোনের শৈশব,কৈশোর কাটে।

অনিকের চেয়ে ৩ বছরের ছোট ছিল ওর বোন। ২ ভাই-বোনের মধ্যে ছিল গলায় গলায় ভাব।কেউ কাউকে ছাড়া থাকতেই পারতো না এরকম।একজন আরেকজনকে চোখে হারাতো সবসময়।

অনিকের ভালোবাসাটা যেনো একটু বেশিই ছিল ওর বোনের প্রতি।বোনের আবদার,বোনের রাগ-অভিমান,চাওয়া-পাওয়া সব ছিল ভাইকে ঘিরে।

অনিকের জন্য আমরা কখনো আনিকার গায়ে হাতও তুলতে পারতাম না।এতোটা প্রোটেক করে রাখতো বোনকে।
আনিকা কখনো অভিমান করলে তখন অনিক পাগল হয়ে যেত কখন কিভাবে ওর অভিমান ভাঙাবে।
এই ছিল অবস্থা।

এইটুকু বলে রহিমা বেগম একটু চুপ করে রইলেন।তারপর চোখ মুছে আবার বলতে শুরু করেন,

–আজ থেকে প্রায় ১২ বছর আগে,আনিকা তখন দশম শ্রেণিতে পড়ে।তখন ও একটা ভুল করে ফেলে।সেটাই ওর জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়!

একটা ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যায় সে।
কোন ছেলে বা বাড়ি কোথায় কিছুই জানি না আমরা।

আনিকা শুধু একটা চিঠি লিখে গিয়েছিল।যেখানে বলা ছিল আমরা যেনো ওর জন্য চিন্তা না করি।ও ওর ভালোবাসার মানুষটির সাথে ভালোই থাকবে।

আমি যখন টের পেলাম আনিকা পালিয়ে গিয়েছে।
তাড়াতাড়ি করে অনিক আর ওর বাবাকে জানালাম।

২দিন, ঠিক ২দিন পর আনিকা ফিরে এলো ক্ষত বিচ্ছিন্ন, ছিন্নভিন্ন হয়ে!গায়ের জামাটা পর্যন্ত অনেক জায়গায় ছেঁড়া ফাটা ছিল। এসেই আমার কোলে ঝাপিয়ে পড়েছিল, “মা আমাকে ক্ষমা করে দাও” বলে।

এই দুইদিনে অনিক আর ওর বাবা চেনা-অচেনা সম্ভাব্য সকল জায়গা খুঁজে তন্নতন্ন করে ফেলেছিল।যেহেতু তোমার শ্বশুর সেই এলাকার একজন সম্মানীয় পুলিশ অফিসার তাই এই ঘটনাটা আমরা তখনো কাউকে জানাইনি মান-সম্মানের ভয়ে ।নিজেরা নিজেরা যতটা পারা যায় খুঁজেছি।

কিন্তু কোথাও পাইনি মেয়েটাকে।ঠিক কোথায় ছিল আমার মেয়েটা এই ২দিন সেটা জানারও সুযোগ হয়ে উঠেনি, এতোটা হতভাগী আমি।

আনিকা যে মানুষটাকে ও বিশ্বাস করে তার হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল সেই মানুষটা ওর জন্য সঠিক ছিল না।ধোঁকা দিয়েছিল ওকে।।
ওরা ৪/৫ জন বন্ধু মিলে টানা ২দিন ধরে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে গিয়েছিল এলাকার পাশে। সেখান থেকে ও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাসায় এসে যখন হাজির হয়,তখন দিনের আলো শেষ হয়ে রাত্রি নেমেছে পৃথিবীর বুকে।

রহিমা বেগম আবারও একটু থামলেন।কান্নার দমকে তার অনেক কথাই জড়িয়ে যাচ্ছিল।তবুও উনি বলে চললেন,

–আনিকা বাড়ি ফিরে আসার একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে অনিক বাসায় ফিরে।
বোনের শোকে-দুঃখে অনিক পাথর হয়ে ছিল তো ঠিকই কিন্তু বোনকে দেখে ও তাৎক্ষণিক ভাবে অনেক রেগে উঠে।

এতো আদর ভালোবাসায় বড় করার পরেও,এতো চোখে চোখে রাখার পরেও যখন আনিকা তার ভাইকে ফাঁকি দিয়েছিল,সেটা সহজেই মেনে নিতে পারেনি অনিক।

আনিকাকে চড় মেড়ে বসে একটা।আরও অনেক অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বাসা থেকে বের হয়ে যা অনি আর যাওয়ার আগে বলে যায়, “তোর যদি লজ্জা থাকে তাহলে তোর এই মুখ আর দেখাস না আমাদের!”

‌সেই রাতে আমি আমার নিজ হাতে মেয়েকে ফ্রেশ করিয়ে,খাইয়ে,শুয়িয়ে দিলাম।অনেক রাত পর্যন্ত ওর রুমে ছিলাম।ওকে অনেক কথা বুঝালাম,শান্তনা দিয়ে এলাম।


‌ফজরের আজানের সময় ওযু করার জন্য উঠলাম।ওযু করেই আনিকার রুমে গেলাম,ওকে এক নজর দেখার জন্য।

‌কথা বলার এই মুহুর্তে এসে আমার শাশুড়ী হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
‌আমার চোখ দিয়েও ইতিমধ্যে টপটপ করে পানি পড়ছিল।আম্মাকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিতে লাগলাম।
‌কিছুটা শান্ত হয়ে রহিমা বেগম আবারও বলতে শুরু করেন,

‌–রুমে গিয়েই দেখি,নাই!আমার মেয়েটা আর নাই!মৃত দেহটা ঝুলছে শুধু ফ্যানের সাথে।
‌আমি চিৎকার করে উঠি।
‌আমার চিৎকারে অনিক আর ওর বাবাও আসে!

‌——–

‌সন্ধ্যার একটু আগে আগেই মেয়েটাকে দাফন করা হয়।ওর বাবা পুলিশ হওয়ায় আইনি ঝামেলাটা সহজেই মিটমাট হয়ে গিয়েছিল ঠিকই।কিন্তু এলাকার মানুষের কথার দায়ে সেখানে টিকে থাকা মুস্কিল হয়ে গিয়েছিল।

সব জায়গায় রটে গিয়েছিল,আনিকা একজন ধর্ষিতা।অনিক ধর্ষিতার ভাই!আমি ধর্ষিতার মা!তোমার শ্বশুর ধর্ষিতার বাবা!

‌আমরা কেউ বাহিরে বের হলেই লোকে আড় চোখে তাকাতো,কানাঘুষা করতো,কেউ কেউ আবার আজেবাজে কথাও বলতো।

এসব দেখে ‌তোমার শ্বশুর বদলির জন্য দরখাস্ত করলেন।উপর থেকে নোটিশ আসলো,ট্রান্সফারের সকল প্রসেস শেষ হতে হতে প্রায় ৬মাস লেগে যাবে।

‌এদিকে বোনের মৃত্যুর পর অনিক প্রায় পাগলের মতো হয়ে গেছিল।ও আনিকার মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী করে!বলে, “আমি যদি সেদিন রাগ না দেখাতাম! যা হওয়ার হইছিল,সব ভুলে যদি বোনটাকে বুকে আগলে নিতাম!বোনটা তাহলে আমার মরতো না।”

‌এক সময় এমন একটা পরিস্থিতি আসলো যে অনিককে ঘরে আটকে রাখতে হতো।নাহয় দরজা খোলা পেলেই বোন বোন করে চিৎকার করতে করতে রাস্তায় বেরিয়ে যেত।

‌এদিকে এলাকার মানুষের ঠাট্টা-মস্করা আর নিতে পারছিলাম না।অন্যদিকে তোমার শ্বশুরের
‌অন্য জায়গায় বদলি হতেও অনেক সময় লাগবে।

তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে,আমি আর অনিক আমাদের দেশের বাড়ি চাঁদপুরের ভিটে মাটিতে চলে যাবো এখন।আর এখানে শুধু তোমার শ্বশুর থাকবে,৬মাস চাকুরীটা করবে এখানে থেকে।
‌অন্য জায়গায় বদলি হলে তখন আবার আমরা তিনজন একসাথে থাকবো।

‌কিন্তু পাগল প্রায় ছেলে আর মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া স্ত্রীকে একা ছাড়তে কিছুতেই রাজী হলেন না তোমার শ্বশুর।
তার কথা,”থাকলে ৩জন একসাথে থাকবো আর গেলে ৩জন একসাথে যাবো।

অনেক ভেবে তিনি তার লাইফের একটা বড় সিদ্ধান্ত ন্ত নিলেন।
ছেড়ে দিলেন চাকুরী!পরদিন গিয়েই রিজাইন লেটার সাবমিট করে চলে আসলেন।
‌আর এর ২দিন পরেই আমার শিফট হয়ে যাই চাঁদপুরে।

এর পর থেকেই আমরা এই চাঁদপুরে আছি।এখানকার কেউই জানে না যে,আমাদের একটা মেয়ে ছিল।
কারণ মেয়ের কথা জানলেই তার মৃত্যুর কথা জানবে,আর মৃত্যুর কথা উঠলেই সে কীভাবে মারা গিয়েছে বা কি হয়েছে সেসব কথা আসে।তাই আমরা এটা কাউকে জানাতে চাই না।
তুমি আমাদের পরিবারেরই একজন।তাই আজ তোমাকে জানালাম মা।

আর আনিকার মৃত্যুর পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে অনিকের প্রায় ২ বছর সময় লেগে যায়। অনিক এখনো নিজেকেই দায়ী ভাবে তার বোনের মৃত্যুর জন্য।

তাই ওর সামনে কখনো আমি বা তোমার শ্বশুর আনিকার স্মৃতি স্মরণ করি না।আনিকার কথা উঠলেই ও পাগলের মতো আচরণ করতে থাকে।ও ভুলে থাকতে চায় ওর বোনকে।

এখানে এসে তরীর মাঝে ওর বোনের ছায়া পেয়ে ওর মনে আবার ভ্রাতৃস্নেহ জেগে উঠেছে।

কিন্তু তুমি ব্যাপারটাকে অন্যভাবে নিয়েছো আর এদিকে আমার ছেলেও তরীর প্রতি ওর ভালোবাসার কারণটা তোমাকে খুলে বলতে পারছে না।
তাই তোমাদের সংসারে অশান্তি লেগে গেছে।

আশা করি এবার তুমি তোমার সব উত্তর পেয়ে গেছো।

–জ্বী মা।আমার কাছে সব এখন পরিষ্কার লাগছে।
আমার নিজের ভিতরটা যে কতটা হালকা লাগছে আমি বলে বুঝাতে পারবো না।

কথাগুলো বলে চোখ মুছে আমি শাশুড়ীর কোলে মাথা রাখলাম।তারপর ডুবে গেলাম চিন্তার সাগরে।

আনিকার ঘটনাটা শোনার পর কষ্ট লাগলেও।
অন্যদিকটা ভেবে আমার এতো এতো খুশি লাগছে যে খুশিতে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে।
আমার অনিক আমারই আছে।হ্যাঁ শুধু আমার।শুধুই আমার!

অনিক শুধু আমাকেই ভালোবাসে।ও আমার সাথে বেঈমানী করেনি,ধোঁকা দিচ্ছিল না ও আমাকে।ওর মনে কোনো কুটিলতা ছিল না।

মনে পড়ে গেল,তরী যেদিন প্রথম এসেছিল আমাদের বাসায় সেদিনকার কথা।
হুম ঠিক সেদিন রাতেই তো অনিক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।সারারাত ছটফট করেছে।কখনো মাথায় পানি দিয়েছে,কখনো ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল,কখনো বা পায়চারী করেছে সারা রুম জুড়ে,আবার কখনো বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করেছে।

তখন ভেবেছিলাম,কাজের প্রেশারে হয়তো ও এরকম অস্থির হয়ে গেছে।কিন্তু আজ বুঝলাম,তরীকে দেখার পরই ওর এই অবস্থা হয়েছিল যেমনটা আম্মাও আজ তরীকে দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।

তরীকে যথেষ্ট সময় দেওয়া,গিফট দেওয়া,তরীর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা,তরীর সব কথা রাখতে চেষ্টা করা,তরীর সাথে হাসাহাসি করা,তরীর প্রতি ওর এক্সট্রা কেয়ার,এক্সট্রা সব সব সব কিছু তাহলে অনিক একজন ভাইয়ের জায়গা থেকে করেছে!

আমি অযথাই সন্দেহ করে গেছি।সন্দেহের বশে ওকে কত অপমান করে ফেলেছি ভাবতেই আমার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো অনিকের জন্য।

অনেক অনেকদিন পর আজ বুক ভরে শ্বাস নিলাম।

কী যে ভালো লাগছে আজ!আরও অনেক অনেক দিন বাঁচতে চাই আমি,অনিকের সাথে বাঁচতে চাই!
আমি কখনো হারাতে চাই না অনিককে।

কিন্তু তরী?অনিকের প্রতি তরীর অনুভূতি তো আর ভাইসুলভ না!তরীর মনে তো অনিকের জন্য ঠিকই অন্যরকম টান!তরী..তরী…তরী………

ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যায় মেহেরীমা।

————-

ইন্ডিয়ান সময় রাত-৯ঃ৩০

দার্জিলিং এর একটা হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা দেখছে অনিক।

একটা একটা তারাকে নির্দিষ্ট করে,সেটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছে সে। আর তার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে…..।

হ্যাঁ অনিক কাঁদছে!অনেক অনেকদিন পর কাঁদছে সে।

‌এখানে গত ২০মিনিট যাবৎ একই ভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে সে ১২ বছর আগের কিছু ঘটনার স্মৃতিচারণ করলো আজ।স্মৃতিচারণ শেষ হতেই সে চোখ মুছে ব্যালকনি থেকে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল।

‌চোখেমুখে পানি দিয়ে একটু পরেই আবার ফিরে আসলো আগের জায়গায়।
‌ব্যালকনিতে থাকা দোলনাটায় বসে,পকেট থেকে ফোন বের করলো।
‌গ্যালারি থেকে খুঁজে খুঁজে একটা নির্দিষ্ট ছবি বের করে জুম করে করে দেখতে লাগলো।

একটু আগে অনিকের মুখে যে মেঘের ঘনঘটা ছিল,সেটা কেটে গিয়ে রোদের মুখ দেখা দিচ্ছে।হাসছে অনিক মিটিমিটি করে।তার হাসি আস্তে আস্তে আরও প্রসারিত হচ্ছে,আরও বেশি………!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here