আগাছা পর্ব শেষ

#আগাছা
#Khadija_Akter
#পর্ব_১৩(সমাপ্ত)

সকাল ১০:০৫
অনিক অফিসে যাওয়ার জন্য রেডী হচ্ছে।আজকের এমন একটা দিনেও তার লেইট হয়ে যাচ্ছে।

ঘুম থেকে উঠতেই দেরী হইছে তার,মেহেরও আজ সজাগ পায়নি।
অনেক রাতে ঘুমিয়েছিল গতরাতে তারা।আর ফলাফল হিসেবে ঘুম ভেঙেছে ১০টার একটু আগে।
মা নাকি অনেকবার এসে দরজায় নক করে গেছেন।কি ঘুমা ঘুমালাম যে শুনলামই না!

অনিক কাপড় পরছে আর আমি ওর মুখে রুটি তুলে দিচ্ছি।জানি, না খাইয়ে দিলে এখন না খেয়েই বের হবে!
খাইয়ে ওকে মুখ মুছিয়ে দিলাম।

পুরোপুরি রেডী হয়ে গেছে ও।আমার কপালে একটা আর গালে দুটো চুমু দিয়ে অফিসের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে।

একটু পর দেখলাম আবার ফিরে এলো।
আমার সামনে এসেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।পেটের সাথে মাথাটা চেপে বললো,

–এই যে লিটল,পাপা অফিসে যাচ্ছে এখন।
মাম্মামকে বিদায় দিল কিন্তু তোমাকে একটু কিছুও বলে গেল না এটা ভেবে অভিমান করে নেই তো?
এই যে পাপা আবার ফিরে এসেছে তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে,
বলেই পেটের মধ্যে টুক করে একটা চুমু খেয়ে নেয় অনিক।
আজ তুমি একটা আন্টির বাসায় যাবে।
পাপা তোমায় আজ রাতে মিস করবে খুব।কাল সকাল হতেই তোমাকে নিয়ে আসবে নিজের কাছে। একদম মন খারাপ করবে না কিন্তু কেমন?

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনিকের আধো আধো বুলিতে বলা কথাগুলো শুনছিলাম আর হাসছিলাম।অনিক যেনো বেমালুম ভুলেই গেছে তার যে দেরী হচ্ছে।

–উঠো এবার।অনেক হইছে ঢঙ!
দেরী হচ্ছে কিন্তু তোমার।

অনিক উঠে দাঁড়ালো।আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,

–সাবধানে যেও।গিয়ে ফোন দিও।
বাসায় এসে যদি আমি তোমাকে খুব বেশি মিস করি।তাহলে কিন্তু সোজা চলে যাব তোমার বান্ধুবীর বাসায়;যত রাতই হোক না কেনো মনে রেখো।

আমি ফিক করে হেসে উঠলাম।এই ক্ষেত্রে অনিক একদম বাচ্চাদের মতো।সারাদিন যেখানেই থাকুক না কেনো,যতদূরেই থাকুক,যত রাগ-অভিমান থাকুক;রাত হলেই সে আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না।
তার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায় আমাকে পাশে না পেলে।

অনিককে বিদায় দিয়ে এসে সোফায় বসলাম।
আম্মা আর আমি বসে বসে গল্প করছি।

তরীর হাঁটাচলা বেশ চোখে পড়ছে আজকে।অযথাই এঘর ওঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে।তার মুখে খুশির জোয়ার উপচে পড়ছে যেনো।
এই প্রথমবার ওর খুশি দেখে আমিও মনে মনে হাসলাম!

বিকালে রেডী হচ্ছি।তখন তরী আমার কাছে এসে খুব মিষ্টি করে এসে বললো,

–আপু তোমরা তো একটু পরেই চলে যাবে, তাই না?

–হ্যাঁ

–তাহলে চাবিটা আমাকে দিয়ে দাও।আমি এখনি বের হবো।বান্ধুবীর বাসায় যাব।আসতে তো সন্ধ্যা হবে।

–আচ্ছা বেশি দেরী করো না।
রাতে খাবার গরম করে তোমার জিজুকে খেতে দিও।

–এগুলো আমাকে বলতে হবে না আপু।

তরী চাবি নিয়ে চলে গেল।
আমি মনে মনে আরেক দফা হাসলাম।হায়রে তরী খুশির আতিশয্যে একবারও মনে হলো না তোমার,”আমার মতো শিয়ালের কাছে আপু মুরগী জমা দিয়ে যাচ্ছে কেন!”

তরী বাসা থেকে বের হয়ে যেতেই আমি আর আম্মা দুজন মিলে ঝটপট কিছু শুকনো খাবার প্যাক করে নিলাম আর সাথে নিলাম এক বোতল পানি।
তারপর দুইটা টুল,ফোন,পার্স নিয়ে স্টোররুমে ঢুকে গেলাম।

তার আগে দাঁড়োয়ান চাচাকে কিছু বকশিস দিয়ে বাসাটা বাহিরে থেকে তালা লাগিয়ে নিলাম।

আসলে আরশীর ছেলের বার্থডে টার্থডে কিছু না।
আমাদের প্ল্যান এটাই ছিল কিছু একটা বলে,আমি আর আম্মা বাসার বাহিরে চলে যাব। আর তরীকে সুযোগ করে দিয়ে যাব অনিকের সাথে একা থাকার।

প্রথমে ভেবেছিলাম বাহিরের কোনো একটা হোটেলে গিয়ে উঠবো আমরা।
কিন্তু পরে একটা কথা চিন্তা করে দেখেছি।ছেলে মানুষ তো আসলেই হায়েনার জাত!মেয়েদের মাংসের গন্ধ পেলে তাদের পুরষত্ব জেগে উঠবেই।

যদিও আমি অনিককে ১০০ তে ৯৫ ভাগই বিশ্বাস করি তবুও তো পুরুষ বলে কথা!যদি কোনো ভাবে তরীর ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে!এটা অসম্ভবও কিছু না,তরী তো আর অনিকের আপন বোন না!

আমি এই রিস্কটা নিতে চাইনি!পরে হিতে বিপরীত হয়ে আমার নিজের হাতেই না আবার নিজের সংসার টা নষ্ট করে ফেলি।
তারপর অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম,স্টোর রুমে লুকিয়ে থাকাই সবচেয়ে উত্তম উপায়।
এখানে কেউ আসবেও না অযথা ;আবার এখানে থেকে দেয়ালের ভেন্টিলেটর দিয়ে লাইভ সবকিছু দেখাও যাবে।

এখন শুধু অপেক্ষার পালা।

একটু পরের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি করে টুলের উপর দাঁড়িয়ে ভেন্টিলেটর এর ফাঁক দিয়ে মেইন দরজার দিকে তাকালাম।দরজাটা এখান থেকে সরাসরি দেখা যাচ্ছে না কিন্তু একটু পরেই চোখের সামনে তরী দৃষ্টিগোচর হলো।

ও তো বলেছিল,সন্ধ্যার আগে ফিরবে না!আমি আগেই বুঝেছিলাম,বান্ধুবীর বাসায় যাওয়ার নাম করে আমাদের সাথে না যাওয়াটা ছিল একটা বাহানা মাত্র।

আর আজ আমাদের দেখানোর জন্যই মূলতঃ বাহিরে চলে গেছিল।
একটু ঘুরে টুরে এখন আমরা চলে গেছি ভেবে ফিরে এসেছে।

তরীর দিকে নজর রাখছি।দেখি,তরী এঘর ও ঘর উঁকি দিয়ে ভালো করে নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছে আমরা গিয়েছি কিনা।
তারপর কাকে যেনো হাতের ইশারায় ডাক দিল ভিতরে আসার জন্য।

এখান থেকে ড্রয়িং রুমটা দেখা যায় স্পষ্ট ;তরীর রুমটাও পুরোটাই দেখা যায়।আম্মার রুমের কিছু অংশ আর ডাইনিং এর কিছু অংশ দেখতে পাওয়া যায়।
আমার রুম ভিতরের দিকে হওয়ায় একদমই দেখা যাচ্ছে না।তবে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে যতটুকু দেখা যাচ্ছে ততটুকুই যথেষ্ট।

একটু পর দেখলাম ৩ জন পুরুষ আমাদের ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়ালো।একজন মধ্যবয়স্ক আর অন্য দুজনের বয়স কম।তাদের সাথে আছে ঘর সাজানোর নানান রকমের জিনিসপত্র। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা ডেকোরেশনের লোক।

ঠিক এক ঘন্টার মধ্যে ওরা আমার বাসাটার এমন রুপ দিল যে আমার নিজেরও নিজের বাসাটা চিনতে কষ্ট হচ্ছে।
দেখে মনে হচ্ছে,বিশাল বড় কোনো পার্টির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে হলরুম!ঝাড়বাতি,মরিচাবাতি,আর্টিফিশিয়াল ফ্লাওয়ার,ক্যান্ডেল,বেলুন,কালার পেপার্স আরও নানান রকম আর্টিফিশিয়াল জিনিস দিয়ে ড্রয়িং রুমটাকে সাজানো হয়েছে।

তরীর রুমের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে,তরীর বেডটাকে সাজানো হয়েছে।
নতুন বর কনের জন্য যেভাবে বাসররাতের খাট সাজায় একদম সেরকম।সম্পূর্ণটাই সাজানো হয়েছে তাজা ফুল দিয়ে!ফুলের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে বাসা।
আমার বুকটা কেমন ধক ধক করছে এসব দেখে।

আমি জানতাম খালি বাসা পেয়ে তরী অনিককে ইম্প্রেস করার অনেক চেষ্টা করবে।কিন্তু তার জন্য এতো আয়োজন,এতো তোড়জোড় করবে তা কল্পনাও করিনি।

আমার ভিতরটায় কুহু ডাকছে!
আচ্ছা অনিক ঠিক থাকতে পারবে তো!নাকি তরীর এই আহবান সে ফিরেয়ে দিতে অক্ষম হবে!

আবছা অন্ধকারে আমার হাতটা আম্মা চেপে ধরলো।

–বউমা এতো টেনশন করো না।আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।যা হবে সব ঠিকই হবে।
দুরুদুরু মনে আমরা অনিকের ফেরার অপেক্ষায় বসে রইলাম।

রাত ৮টা বাজার একটু আগেই হঠাৎ বাসার সব আলো নিভে গেল!
প্রথমে ভেবেছিলাম ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে!পরে দেখলাম ফাঁকফোকর দিয়ে অন্যান্য বাসার আলো এসে ঢুকছে স্টোররুমে।
তারমানে তরী ইচ্ছে করে লাইট অফ করে দিয়েছে!

এমনিতেই প্রচুর গরম তার উপর এখন প্রায় ঘুটঘুটে অন্ধকার তার উপর আছে আবার আছে মশার কামড়।
বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম!

গরমে আর টিকতে না পেরে আশেপাশে পাতলা কিছু খুঁজতে লাগলাম বাতাস করার জন্য।

অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে একটা বাক্সের মধ্যে হাত ঢোকালাম।তরীর অপ্রোয়জনীয় বইখাতার বাক্স এটা।গতকালই এখানে ফেলে রেখে গেছে।
এখান থেকেই পাতলা কোনো বই খুঁজে লাগলাম।
খসখসে কাগজের মাঝে ঘাটতে গিয়ে নরম কোনো কাপড়ের উপর হাত পড়লো আমার।কাপড়টা উপরের দিকে সরিয়ে রেখে,নিচ থেকে খুঁজে একটা পাতলা বই বের করে বাতাস করতে লাগলাম।

কতক্ষণ এভাবে বসেছিলাম খেয়াল নেই।

হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠায় আমি আর আম্মা সতর্ক হয়ে গেলাম।
তড়িঘড়ি করে দুজন দুটো টুলের উপর দাঁড়িয়ে ভেন্টিলেটর এর ফাঁক দিয়ে চোখ রাখলাম।

ইলেকট্রিক লাইট অফ করে দিয়ে,ছোট ছোট ক্যান্ডের জ্বালিয়ে রেখেছে তরী!
ড্রয়িং রুমের একদম মাঝামাঝি একটা লাভ আকারর নকশার চারপাশে ক্যান্ডেল জ্বলছে টিমটিম করে।

আসন্ন ভবিষ্যতে ঘটরে যাওয়া ঘটনার কথা চিন্তা করে আমার বুকটা কেঁপেকঁপে উঠছে,হৃদপিণ্ডটা রীতিমতো লাফাতে শুরু করেছে!

তরী কি ধরা পড়বে আজ!নাকি অনিক নিজেই তরীর ফাঁদে আটকে পড়বে।
আমি পাশে থাকা আম্মার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখি।

দ্বিতীয়বার কলিং বেল বেজে উঠতেই তরী রুম থেকে একটা লং গাউন গায়ে জড়াতে জড়াতে বেরিয়ে এলো।
তরীকে দেখে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
তরী একদমই লো কাট একটা মিনি ড্রেস পরে আছে।
যেটা হয়তো ওর শরীরের বিশেষ অঙ্গগুলো কোনোরকমের ঢেকে রেখেছে।নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতে তরী কতটা নিচে নেমে গেছে!ছি!
গর্জিয়াস সাজে সেজেছে সে আজ!যদিও দেখতে একদম বারের সস্তা মেয়েদের মতো লাগছিল।

গাউনটা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে তারপর দরজাটা খুলে দিল তরী।
একটু পরের রুমের মৃদু আলোয় অনিকের অস্পষ্ট মূর্তিটা চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো।

দেখলাম অনিক অবাক হয়ে চারদিকে দেখতে দেখতে ড্রয়িংরুমের মাঝামাঝি এসে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

এদিকে আমি আর আম্মা চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সমস্তকিছু দেখছিলাম।আমার হার্টবিট এতো বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে বুকের ভিতর কেউ হাতুড়ি পিটাচ্ছে আর সেই শব্দ আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।
পরের ঘটনা দেখার জন্য রূদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি।

এদিকে এতসব আয়োজন দেখে অনিক অবাক হয়ে তরীর দিকে তাকালো।

–কি ব্যাপার আজ কোনো প্রোগাম আছে নাকি বাসায়?
তোমার আপু আর আন্টি যায়নি তাহলে আরশীদের বাসায়!
ওহ আচ্ছা আচ্ছা বুঝছি।আমার জন্য তারা সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে রাইট?হাহা
কোথায় ওরা?

তরী অনিকের একদম কাছে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাদকময় কন্ঠে ফিসফিস করে বললো,

–বাসায় কেউ নেই অনিক!আমরা দুজন একদম একা!
এই ছোট্ট আয়োজন আমার পক্ষ থেকে শুধু তোমার জন্য।

তরীর বলার ভঙ্গি আর ওর মুখে নিজের নাম এভাবে বলতে দেখে অনেকটাই আশ্চর্য হয়ে যায় অনিক।তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।অবাক হয়ে জানতে চায় অনিক,

–মানে?কিসের আয়োজন?

তরী রআরও কাছে এসে অনিকের কাঁধে একটা হাত রাখে অন্য হাত রাখে অনিকের বুকে,

–তোমাকে সব বলবো অনিক।আজ আমার মনের কথা সব বলবো।আজ সুযোগ এসেছে সব বলার।
আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি খুব।তোমাকে সারাজীবনের জন্য পেতে চাই!
আমার এই দেহমন সমস্তটাই তোমার জন্য।

বলতে বলতে তরীর ওর গায়ের থেকে গাউনটা খুলে ফেলে।বের হয়ে আসে পূর্ণ যৌবনে ভরা ওর ফর্সা নদর দেহটা।আচমকা তরী তরীর ঠোঁট দুটো দিয়ে হামলা করে বসে অনিকের ঠোঁটের উপর।

প্রচন্ড জোরের ধাক্কায় তাল সামলাতে না পেরে তরী ছিটকে গিয়ে পড়ে সোফার উপরে।

অনিক দ্রুত লাইট জ্বালিয়ে দেয় ঘরের।
রাগে অনিকের শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে!কপালের শিরাগুলো ফোলে উঠে তার!চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে সে!

ছি!ছি! এসব কি হচ্ছে!এটা স্বপ্ন দেখছে না তো!
তরী!তরী তাকে এগুলো কি বলছে!কি করছে ও এসব!পাগল হয়ে গেছে নাকি!
সেই তরী যাকে সে নিজের আপন বোনের জায়গায় বসিয়েছে।
অনিকের মাথা ঘুরতে থাকে।
ঘুরে সে তাকায় তরীর দিকে।সাথেসাথেই চোখ ফিরিয়ে নেয়।গাউনটা তুলে ছুড়ে মারে তরীর দিকে।

–ছিঃ তরী ছিঃ! তোমাকে আমি আমার বোন ভেবেছিলাম আর সেই তুমি এতোটা জঘন্য মস্তিষ্কের একটা মেয়ে এটা আমি আগে বুঝিনি।
তোমার লজ্জা হয়না,নিজের বোনের স্বামীকে নিয়ে এসব ভাবতে!নিজের বোনের সংসারটা নষ্ট করতে চাইছো তুমি?তোমাকে কত ভালোবেসে আমরা এখানে থাকতে দিয়েছি।নিজেদের বোনের মতো করে ট্রিট করেছি।আর তুমি এটা কি পাগলামী করছো!আমার কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না!
তুমি আমাকে ভালোবাস!নিজের করে পেতে চাও!
জাস্ট আই ক্যান্ট বিলিভ ইট।

মেহের আমাকে অনেকবার বলেছিল তোমার ব্যাপারে আমি একদমই বিশ্বাস করিনি।আর আজ কিনা চোখের সামনে প্রমাণ পেলাম!

সোফা থেকে উঠে ছুটে আসে তরী অনিকের কাছে।অনিকের পায়ে ধরে কাঁদতে থাকে,

–অনিক দেখো একবার তুমি আমার দিকে চেয়ে,দেখো একবার।আমি কোনো অংশে কম নই তোমার বউয়ের থেকে বরং দ্বিগুন সুন্দরী।
আমাকে বিয়ে করলে তুমি আমার বাবার ধন সম্পদ সব পাবে।
অনিক প্লিজ তুমি আমায় রিজেক্ট করো না।আমি তোমায় খুব ভালোবাসি।তুমি চাইলে তোমার প্রথম বউকেও রাখতে পারো আমার কোনো আপত্তি নাই।
আর বিয়ে ছাড়াও আমি এই মুহুর্তেই তোমার সাথে বিছানায় যেতে প্রস্তুত অনিক।তুমি শুধু একবার আমার সাথে বিছানায় আসো অনিক।দেখবা তুমি ঐ মেহেরীমাকে ভুলে যাবে।

তরীর কথাগুলো শুনে কান ঝালাপালা করে উঠে অনিকের।কান গরম হয়ে ধোঁয়া উঠতে থাকে জাস্ট।

দুহাতে তরীকে ধরে উঠায় সে তারপর প্রচন্ড জোরে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারে তরীর গালে।
পাশে রাখা বিশাল বড় কেক ও কেকের টেবিলটা লাথি দিয়ে ফেলে দেয় অনিক।

–তোকে ভদ্র ভাষায় বললে তুই বুঝিস না?তুই কোনোদিন দেখছিস কোনো ভাই তার বোনকে নিয়ে বিছানায় যায়?দেখছিস?বল দেখছিস?
আমি যে তোকে আমার বোন ডাকি তোর কানে যায়না সেটা?এতোটা নির্লজ্জ আর বেহায়া মেয়ে তো আমি আমার জীবনে এই প্রথম দেখলাম।

তোর শরীরের ক্ষুধা যদি এতোই বেশি তাহলে রাস্তায় বেরিয়ে যা।অনেক পুরুষ পাবি তোর চাহিদা মেটানোর জন্য।
আমার সংসারের সুখ তুই নষ্ট করিস না।তোর ছায়া কারো উপর পড়লে সেই মানুষটা পর্যন্ত অপবিত্র হয়ে যাবে। ঠিক এতোটাই জঘন্য নরকের কীট মনে হচ্ছে আমার তোকে।

কান খুলে শুনে রাখ,আমি শুধু মেহেরকে ভালোবাসি।মেহেরই আমার জীবনের প্রথম ও শেষ ভালোবাসা।

আর কাল সকালের সূর্য উঠার আগেই তুই এই বাসা ছেড়ে যাবি।
মেহের আর আম্মা মুখোমুখি তুই হবি না।তোর এই কলঙ্কিত মুখ আমার প্রিয় মানুষগুলোকে আর দেখাবি না।
একটা কথা আজ বুঝে গেলাম,বোনের মতো দেখতে হলেই বোন হয়ে যায় না!খুব বোকা ছিলাম আমি এতোদিন,খুব বোকা!

কষ্টে অনিকের কন্ঠ রোধ হয়ে আসে।

তরী গালে হাত দিয়ে এখনো চেয়ে আছে অনিকের দিকে।সে মনে হয় কল্পনায়ও ভাবতে পারেনি অনিক তার এই ভরা রুপ যৌবনকে পায়ে ঠেলবে!
বিস্ময়ের ঘোর তার এখনো কাটেনি।

এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে সমস্তটা দেখে গেলাম আমি আর আমার শাশুড়ী।
অবশেষে আমরা পেরেছি!আমরা পেরেছি অনিকের সামনে তরীর মুখোশটা টেনে খুলতে।খুশিতে আমার কান্না চলে আসলো।
এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।

অনিক আর তরীকে চমকে দিয়ে ক্যাচক্যাচ শব্দে স্টোররুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো আম্মা!আম্মার পিছু পিছু আমিও বের হলাম।কিন্তু কিছু একটাতে আমার ওড়না লেগে টান পড়াতে আমি আবারও স্টোররুমে ঢুকে গেলাম ওড়না ছুটাতে।
নিচু হয়ে ওড়নাটা সরিয়ে উঠতে যাব তখনি দরজা দিয়ে আসা সরু আলোয় চোখ পড়লো তরীর ফেলে রাখা পরিত্যক্ত বাক্সটার উপরে।

সেখানে পড়ে থাকা বালিশের কভারটার দেখতে পেয়ে চমকে উঠলাম আমি।
দ্রুতবেগে কভারটা হাতে নিয়ে বের হয়ে আসলাম বাহিরে।কভারটা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম!এটা তরীর কাছে গেল কীভাবে!
চোখ পড়লো কভারের কোনায় সুতার সাথে আটকে থাকা তরীর নখটার দিকে।

পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে সমস্তটা! সেদিন বিকালে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করার ঘটনাটা তাহলে আমার কোনো স্বপ্ন বা কল্পনা ছিল না!সেটা সত্যি ছিল!
তরীই আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল!

এদিকে আমাকে আর আম্মাকে এভাবে স্টোররুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে অনিক খুব অবাক হয়ে যায়।কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল নেই।আমি দৌড়ে অনিকের কাছে এসে বালিশের কভারটা দেখাই ওকে।তরীর পরিত্যক্ত জিনিসের মধ্যে এটা পাই সেটাও জানাই।
আর কভারের কোণে সুতায় পেঁচিয়ে থাকা নখটা দেখাই, সেই নখ যেটা তরী সুতা থেকে ছাড়াতে না পেরে অবশেষে রুমে এসে নখটাই কেটে ফেলেছিল।

আমরা ৩ জনেই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি এক তরীর দিকে!
আমি চিৎকার করে বললাম,

–তরী!তুই এতোটা নিচে নামলি!আমাকে মেরে ফেলার কথা ভাবতেও তোর কলিজা কাঁপলো না!ভালোবাসায় এতোটা মগ্ন হয়ে গেছিস তুই আরেকজনের স্বামীর উপর যে নিজের বোনকে হত্যা চেষ্টা চালিয়ে যেতেও তোর বুক কাঁপলো না!

তরী এতক্ষণ চুপ করেছিল।কিন্তু এখন অনিকের সামনে তার সমস্ত কিছু ফাঁস হয়ে গেছে।
এদিকে অনিক তাকে আগেই রিজেক্ট করে দিয়েছে।আর এই বাসা থেকে বেরও করে দিয়েছে।সব মিলিয়ে তার এখন আর হারাবার কোনো কিছু নেই।
তার কান্নাভেজা মুখ এখন বাঘিনীর রুপ ধারণ করলো।চেচিয়ে বললো,

–আমি তো আগেই বলেছি আমার পথে যে আসবে তাকে আমি মেরে ফেলবো।তোকে তো মারতামই,দরকার হলে এই বুড়িকেও মারতাম।কিন্তু আফসোস বেঁচে গেলি।
সেদিন তো আমার হাতে মরেই যেতি কিন্তু কেউ এসে কলিং বেল বাজানোতে আমি ভয় পেয়ে সেখান থেকে চলে যাই নাহয় আজ তোর লাশ মাটির সাথে মিশে যেত।

তবে তোকে মারতে পারিনি তো কি হইছে,দেখ তোর বাচ্চার কি করি!

কথাটা বলে এক মুহুর্তও দেরী না করে পাশে থাকা টিভির উপর থেকে ভারী ফুলদানীটা নিয়ে ছুঁড়ে মারে আমার পেটের দিকে তরী।
আমি দেখতে পাচ্ছিলাম ফুলদানীটা আমার দিকে উড়ে আসছে কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় আমি এতোটাই থ হয়ে যাই যে নড়ার একটুও শক্তি পাচ্ছি না।

ঠিক তখনি একটানে অনিক আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিজের দিকে নিয়ে আসে।ফুলদানীটা গিয়ে দেয়ালে আছড়ে পড়ে।
এদিকে অনিকের টানে তাল সামলাতে না পেরে দুজনের পড়ে যাই হুড়মুড়িয়ে নিচে।
উপুড় হয়ে বেকায়দায় নিচে পড়ার পড়ার আগেই অনিক আমার পেটের নিচে হাত পেতে দেয়।
আলহামদুলিল্লাহ আমার পেটে কোনো আঘাত লাগেনি।কিন্তু কেক কাটার ছুড়িটা খাড়া হয়ে থাকায় সেটা দিয়ে অনিকের হাতে খোঁচা লেগে অনেকটাই কেটে যায়।

অনিক সেদিকে খেয়াল না দিয়ে সে আর আম্মা মিলে আমাকে উঠালো।আম্মা আমায় দূরের একটা সোফায় এনে বসিয়ে দিল।
এদিকে আমাকে সেইফ করে, তরীর দিকে ধেয়ে যায় অনিক।শরীর সমস্ত শক্তি দিয়ে চড় মারে সে তরীকে।
তরী ছিটকে গিয়ে পড়ে দেয়ালের সাথে।কপাল কেটে গলগল করে রক্ত বের হতে থাকে তার।

অনিকের রাগ কিছুতেই কমে না।ছোট টেবিলটা তুলে নেয় সে তরীর দিকে ছুড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
রহিমা বেগম দৌঁড়ে এসে আটকায় ছেলেকে।

–একটা দূর্ঘটনার ঘটে গেলে পরে বিপদ হবে আবার।বাবা তুই পুলিশকে খবর দে।

তারস্বরে চেচিয়ে উঠে অনিক,

–ওর সাহস হয় কি করে মা আমার সামনেই আমার বাচ্চাকে আঘাত করার চেষ্টা করার!
আমার বাসায় থেকে আমার অগোচরে আমার স্ত্রীকে হত্যা করার চেষ্টা করা।ওরে তো আমি….

অনিক দাঁত কিড়মিড় করে ধেয়ে যায় তরীর দিকে।রহিমা বেগম ছেলেকে আটকে রাখতে পারছেন না কিছুতেই।

আমি উঠে এসে পিছন থেকে অনিকের কাঁধে হাত রাখি।
অনিক ঘুরে তাকিয়েই আমাকে দেখে বুকে টেনে নিল।

–তুমি ঠিক আছো মেহের?

–হুম

–শরীর ঠিক আছে তো?কোথাও আঘাত লাগেনি তো?আর পেটে…?

অনিক আলতো করে হাত রাখে আমার পেটে।আর ঠিক সেভাবে জড়িয়ে ধরে আমাকে, মন খারাপ থাকলে যেভাবে ধরতো।
আমার মাথারটা বুকে চেপে ধরে আমার মাথার উপর থুতনীটা ঠেকিয়ে চোখবন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সে।

রাত-১১:৩০

দুই দুইবার হত্যা চেষ্টা করার অপরাধে একটু আগেই পুলিশ এসে তরীকে হাতকরা পরিয়ে নিয়ে গেছে।
যাওয়ার সময়ে তার মুখে ছিল পরাজয়ের গ্লানি কিন্তু চোখ তখনো হিংস্র বাঘিনীর মতো ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছিল।
মেহেরীমার মুখে ছিল বিজয়ের হাসি আর মনে ছিল প্রশান্তির ছোঁয়া।

শাশুড়ী আম্মা ড্রয়িং রুমের লণ্ডভণ্ড ঘরটা যথাসম্ভব গুছানোর চেষ্টা করছেন।

তরীকে নিয়ে যেতেই আমি তরীর রুমটা সার্চ করে অনিকের সাদা শার্ট খুঁজে পাই।দেখাই সেটা অনিককে!অনিক বিস্ময় নিয়ে শার্টটার দিকে চেয়ে থাকে শুধু।

অনিক বিছানায় শুয়ে আছে।আমি ওর হাতের কাটা অংশটা ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।আর আমার আর আম্মার করা প্ল্যান পরিকল্পনার সমস্ত কিছু একে একে খুলে বলছি।

এদিকে সবকিছু শুনে অনিক ক্ষমা চাইলো মেহেরের কাছে;এতোদিন তাদের কথায় বিশ্বাস না করার জন্য।আসলে ভ্রাতৃস্নেহে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল সে।তরীর প্রতি একরোখা বিশ্বাস তাকে এতদিন অন্ধ করে রেখেছিল।

———————–
রাত-৩টা

অনিকের কাঁধে মাথা রেখে ব্যালকনিতে বসে আছে
মেহের।দু’জনে একই চাদরের নিচে জড়াজড়ি হয়ে বসে আকাশের চাঁদ দেখছে।

এই কয়েকদিনের ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা,পুরোনো দিনগুলোর স্মৃতিচারণ,ভবিষ্যৎ দিনগুলো কীভাবে সাজাবে এসব নিয়ে গল্প করতে করতেই একসময় রাতের অন্ধকার শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটতে থাকে ধরণীর বুকে।

এবার আমি অনিককে তাড়া দিলাম,

–সারারাত তো না ঘুমিয়েই কাটালাম। চলো এবার একটু ঘুমাই।

–আরেকটু থাকি না।ভালোই তো লাগছে।

কপট অভিমান দেখিয়ে উঠে গেলাম আমি,

–থাকো তুমি।আমি যাই।

ব্যালকনি আর রুমের দরজার মাঝামাঝি আসতেই পিছন থেকে হাত টেনে ধরে অনিক।সেও উঠে আসে।

আমার সামনাসামনি এসে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।
ওর এই অপলক দৃষ্টির কাছে আমি হার মেনে নেই বরাবরের মতোই।সারামুখ লজ্জার রক্তিমায় রক্তাভ হয়ে উঠে আমার,দৃষ্টি নামিয়ে নেই আমি।

আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই আমার মাথার পিছনে ওর হাতটা নিয়ে যায় অনিক।আলগোছে আমার খোঁপাটা খুলে দেয়।
অবিন্যস্ত চুল গড়াতে গড়াতে কোমরের কাছে এসে থেমে যায়।কিছু অবাধ্য চুল কান ছাড়িয়ে মুখের উপর এসে পড়ে।

অনিক খুব যত্ন নিয়ে চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে কানের পিছনে গুজে দেয়।তারপর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।
একসময় টুক করে আমার কপালে একটা চুমু খায়।

তারপর পরম মমতায় আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয় সে।
আমিও দুই হাত দিয়ে অনিকের পিঠ আঁকড়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখি।

দুই ফোটা চোখের পানি টুপ করে গড়িয়ে পড়ে আমার গাল বেয়ে।
এই কান্না থামানোর একটুও চেষ্টা করছে না অনিক।সে জানে আমার এই কান্না সুখের কান্না।আর এই সুখকে চোখের পানি হয়ে প্রকাশ করতে দেওয়া উচিত।

কপালে এক ফোটা পানির ছোয়া পেতেই আমি চকিতে মাথা তুলে তাকাই উপরের দিকে!
কাঁদছে!অনিকও কাঁদছে!

সোনার ফসল আজ আমার আগাছামুক্ত হয়েছে।অপেক্ষা শুধু ফসল ঘরে তোলার।

অনেক অনেক দিন পর আজ একটা শান্তিময় সকালের দেখা পেলাম।
প্রিয় মানুষটার বুকে মাথা রেখে সূর্য উঠার দৃশ্যটা দেখার অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ!

#সমাপ্ত

(গল্পটা কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন।😊

এটা একটা কাল্পনিক গল্প হলেও আমাদের সমাজে বাস্তবেও এমন অনেক নারী আছে যারা তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে দু’জনের মাঝে এন্ট্রি নিয়ে সুখের সংসার তছনছ করে ফেলে।
আবার সমাজের সব পুরুষও কিন্তু অনিকের মতো লয়্যাল হয় না।ঘরে বউ রেখেও তারা পরনারীতে আকর্ষিত হয়।সংসারের সুখকে পায়ে ঠেলে।🙂

ধিক্কার জানাই এমন সব নারী-পুরুষদের,যাদের জন্য ঘরে ঘরে অশান্তির সৃষ্টি হয়।💔

যাইহোক,সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাপোর্ট দিয়ে যাওয়ার জন্য।সবসময় এভাবেই পাশে থাকার অনুরোধ করছি।💙 )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here