আগাছা পর্ব ১০

#আগাছা
#Khadija_Akter
#পর্ব_১০

মেহেরীমা হাত দুটো দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুখের উপরে চেপে থাকা জিনিসটা সরিয়ে এক ফোটা শ্বাস নিতে।
কিন্তু এতো শক্তি দিয়ে বালিশটা তার মুখের উপর শক্ত করে ধরে রেখেছে কেউ,যে বালিশটা সরানো একদমই সম্ভব হচ্ছে না।
আরও কিছুক্ষণ দস্তাদস্তি করে মেহেরীমার জোর কমে আসে!শরীরটা আস্তে আস্তে শিথীল হতে থাকে!

ঠিক তখনি কলিং বেলটা ঝংকার শব্দে জানান দিল এই বাসার সামনে এসে কেউ উপস্থিত হয়েছে।

চমকে উঠলো তরী!কে কে!কে এসেছে এই সময়!
আরেকটু পরে এলে কি হতো!কাজটা কি অসমাপ্তই থেকে যাবে!
সে উঠাচ্ছে না বালিশ!চেপে ধরেই আছে।

আবারও শব্দ করে বেজে উঠলো কলিং বেল।
এবারে তরী ভয় পেয়ে বালিশটা উঠিয়ে নিল।বালিশটা রেখে দ্রুত পালাতে যাবে সে,কিন্তু এ কি!বালিশটা হাত থেকে ছুটছে না কেন?
চেয়ে দেখে বালিশের কভারের একটা সুতা তার ভেঙে যাওয়া একটা নখের কোণায় পেঁচিয়ে আছে।
সে ঝটপট ছাড়াতে চেষ্টা করে সুতোটা!কিছুতেই ছুটছে না।
তখন বালিশের পুরো কভারটাই খুলে নেয় তরী।বালিশটা খাটের উপর ফেলে রেখে কভারটা হাতে পেঁচিয়ে নিয়ে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে যায় সে।

নিজের রুমে ঢোকার আগেই আলগোছে,অনিকের মায়ের রুমের ছিটকিনিটা খুলে দিয়ে যায়।

কলিং বেল বাজছে বাজছে বাজছে…….!
কেউই দরজা খুলছে না।

অনিক মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।তরীও কি ঘুমিয়ে গেছে নাকি!
ধুরর ফিরে আসাটাই বৃথা হলো।

মেহেরকে ফোন দিতে গিয়েও দিল না সে।ঘুম ভাঙানোর দরকার নাই।
ওয়ালেট না নিয়েই অনিক আবার দরজার সামনে থেকে চলে যায়।

সে ভেবেছিল স্বর্ণকার তার পরিচিত তাই টাকা বায়না না দিলেও চলবে।কিন্তু মেহেরের জন্য কিছু ভিটামিন সিরাপ আর ফ্রুটসও তো কিনতে হবে।তাই ফিরে গিয়ে মানিব্যাগ নিয়ে আসাটাই ভালো মনে করলো।
কিন্তু বাসায় গিয়েও কাজ হলো না,সবাই ঘুমাচ্ছে।
দেখি কি করা যায়….

——————

সন্ধ্যা হবে হবে করছে।ঘরময় ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে।
রহিমা বেগম উঠে হাতমুখ ধুয়ে নিলেন সাথে ওযুটাও করে নিলেন।

বউমার রুমে উঁকি দিয়ে দেখলেন,সে এখনো ঘুমাচ্ছে।
তিনি আর লাইট অন করলেন না।থাক ঘুমাক,মেয়েটার শরীর ভালো যাচ্ছে না কয়েকদিন ধরে।
তিনি কিচেনে এসে নিজের জন্য চা করে নিয়ে রুমে চলে গেলেন।

সন্ধ্যা মিলিয়ে যেতেই বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো।

রহিমা বেগম নামাজ শেষ করে মাত্রই নামাজীটা ভাঁজ করতে যাচ্ছিলেন।কলিং বেলের শব্দ শুনতে পেয়ে তিনি নামাজিটা হাত থেকে খাটের উপর রেখে দরজা খুলতে গেলেন।

দরজা খুলতে অনিক বেশ ঝাঁঝালো গলায় বললো,

–দরজা খুলতে এতোক্ষণ লাগে নাকি?

রহিমা বেগম অনিকের হাত থেকে ব্যাগগুলো নিতে নিতে শান্ত সুরে জবাব দিলেন,

–নামাজ পড়ছিলাম তো বাবা।
কি হয়েছে?আজ মেজাজ এতো চড়া কেনো আমার ছেলেটার।

–কিছুই হয়নি।
মেহের বা তরী কোথায়?ওরা কি বাসায় নেই?এতোবার করে বেল বাজাতে হয় কেন?বাসার মানুষগুলোর কি কানে সমস্যা হয়ে গেল নাকি!

ঘ্যানঘ্যান করতে করতে অনিক নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।
রুমে ঢুকেই দেখে সন্ধ্যা বাতিটা পর্যন্ত জ্বলেনি রুমে এখনো।মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল তার।

লাইটটা জ্বালিয়ে এক পলক বেডের দিকে তাকিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকে যায় সে!

একটুপর ওয়াশরুম থেকে মুখ মুছতে মুছতে আবার বেরিয়েও আসে অনিক ।

বিছানার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ তার কেনো যেনো মনে হলো মেহের ঠিক স্বাভাবিকভাবে শুয়ে নেই!কেমন একটু শরীরটা এলিয়ে শুয়ে আছে।

অনিক আরও কাছে যায় মেহেরের।বেড শীট কুচকানো;একটা বালিশ পায়ের নিচে,অন্যটা মাথার নিচে আছে ঠিকই কিন্তু কেমন ত্যাড়া করে রেখেছে।ওড়নাটা পড়ে আছে ফ্লোরে।
মেহেরের একটা হাত পেটের উপর আর আরেকটা হাত বিছানার বাহিরে ঝুলছে!

অনিক এই প্রথম দেখলো মেহেরকে এতো অগোছালো ভাবে ঘুমিয়ে থাকতে।
ফ্লোর থেকে ওড়নাটা তুলে মেহেরের পাশে রাখলো।
তারপর আলতো করে হাতটা কপালে রেখে কোমল গলায় ডাকলো,
–মেহের!

মেহের যে অজ্ঞান হয়ে আছে সেটা বুঝতে বেশি সময়
লাগলো না অনিকের।চেচিয়ে মাকে ডাকলো সে।তারপর ডাক্তারকে কল দিল।

ডাক্তার আসার আগেই জ্ঞান ফিরে মেহেরীমার।
চোখে মুখে পানির ছিটা পড়তেই সে চোখ খুলে আস্তে আস্তে করে।
চারদিকে চেয়ে দেখে আম্মা ও অনিক উদ্বিগ্ন মুখে তারপাশে বসে আছে।
পায়ের কাছে তরীকেও দেখলো বসে আছে।
সে কিছুই মনে করতে পারছে না।কি হয়েছে তার!সবাই এমন করে চেয়ে আছে কেন?আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলো,

–কি হয়েছে আমার?

রহিমা বেগম জবাব দিলেন,
–কি হয়েছে সেটা তো আমরা জানতে চাইবো তোমার কাছে মা।তুমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলে!কি এমন হইছিল যে অজ্ঞান হয়ে গেলে সেটা ভেবেই তো কুল কিনার পাচ্ছি না আমি।

ডাক্তার আসলেন।চেক-আপ করলেন।
বললেন,”রোগীর নার্ভ দূর্বল।ঘুমের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে গেছেন।
অনেক স্ট্রেস যাচ্ছে হয়তো রোগীর উপর দিয়ে।উনাকে চাপমুক্ত রাখার চেষ্টা করুন।এভাবে আর দুয়েকবার অজ্ঞান হয়ে গেলে সেটা বাচ্চার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।”

ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে গেল অনিক।

ডাক্তার সাহেব চলে যাওয়ার সাথে সাথেই তরীও উঠে তার রুমে চলে গেল।
ভয়ে তার কলিজা ছোট হয়ে আছে;মুখ পাংশুটে হয়ে গেছে।কিন্তু বাহিরে সে এটা কাউকে বুঝতে দিল না।

সে আরও অবাক হলো যখন দেখলো মেহেরীমার জ্ঞান ফিরে তাকে দেখেও কোনো ধরনের এক্সট্রা রিয়েক্ট দেখালো না!তাহলে কি তার কিছুই মনে নেই বিকালের ঘটনা!
যাক বাবাহ্,মনে না থাকলেই বাঁচি!

এদিকে অনিক আর তরী চলে যেতেই রহিমা বেগম বউমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

–পাগলী মেয়েটা আমার!তুমি তরীকে নিয়ে অনেক টেনশন করো তাইনা?দেখো শরীরের কি হাল করেছ!আর আজ তো অজ্ঞানই হয়ে গেলে।
তুমি কিচ্ছু চিন্তা করো না,ওই মেয়েটাকে বাসা থেকে বের করার দায়িত্ব আমার।
তুমি শুধু নিজের খেয়াল রাখো।

মেহেরীমা শুধু ঘাড় কাত করে শাশুড়ীর কথায় সম্মতি জানালো।

———————-

রাত-১১টা
আমার শরীর এখনো বেশ দূর্বল।একা একা উঠতেই পারছি না।
একটু আগে ওয়াশরুমে গেলাম,তাও অনিকের কোলে উঠে।
দুপুরে ঘুমানোর আগে তো বেশ ভালো শরীর নিয়েই ঘুমালাম।কিন্তু এখন কেমন যে লাগছে বলতে পারবো না।

খেতে ইচ্ছে করছে না আমার একদম।
তবু খেতে না চাইলেও জোর করে খাইয়ে দিচ্ছে অনিক।আর সমানে আমাকে বকেই যাচ্ছে,

–আগেই বলেছিলাম নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখো।ঠিক মতো খাবা না, ঘুমাবা না;শুধু আজেবাজে চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরবা।তাহলে অজ্ঞান তুমি হবা না তো কে হবে?

এখন যে নিজের শরীরের সাথে আরেকট অস্তিত্ব মিশে আছে সেই খবর কি আছে তোমার!
এতো কেয়ারলেস কিভাবে হও তুমি!
এখন থেকে যদি আর কোনোকিছুতে একটুও অনিয়ম দেখি,তো আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না,এটা বলে দিচ্ছি মেহের।

আমি চুপ করে খাচ্ছি আর ওর ঝাড়ি শুনছি আর মুচকি মুচকি হাসছি।বেশ ভালোই লাগে যখন অনিক
আমাকে এভাবে বকে।

আমার হাসি দেখে অনিক কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

–আশ্চর্য!হাসির কিছু বলেছি কি!আমার কথা সিরিয়াসলি নিচ্ছ না তাইনা?
ভালো রুপ তো দেখছো খারাপ রুপ তো দেখো নাই তাই এমন করছো তুমি বুঝছি!

খাওয়ানো শেষ করে আমার মুখ মুছিয়ে দিয়ে অনিক প্লেট রেখে আসতে গেল।আর আমি একপাশ থেকে অন্যপাশ হয়ে শুইলাম।

চোখ পড়লো পাশে থাকা বালিশটার উপর!বালিশের কভার গেল কোথায়?

মুহুর্তেই বিকালের সমস্ত ঘটনা মনে পড়ে যায় আমার।সেই ধস্তাধস্তির ঘটনা!আমি তো মারাই যাচ্ছিলাম প্রায়ই!কিন্তু আমি বেঁচে রইলাম কি করে!আর কে আমাকে ঐভাবে চেপে ধরছিল!

ঘটনাটা মনে পড়তেই ভয়ে আমি থরথর করে কাঁপতে থাকি।শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করলাম,
–অনিক!

অনিক মেহেরের চিৎকার শুনে এক সেকেন্ডের মধ্যে হাজির হলো,মেহেরের কাছে।দেখলো মেহেরের মুখ ভয়ে কেমন পাংশুটে হয়ে গেছে।হাত-পা কাঁপছে রীতিমতো!

অনিক মেহেরকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।

–কি কি হয়েছে?তু তুমি ঠিক আছো তো?ভয় পেয়েছ তুমি?এই তো আমি।আমি এখানেই তো ছিলাম।এইতো পাশের রুমেই।

আমি হাউমাউ করে কাঁদতে বলতে থাকি,

–অনিক,অনিক তোমরা জানতে চেয়েছিলে না আমি কিভাবে অজ্ঞান হই?কেন হই?
আমাকে কেউ মেরে ফেলতে চেষ্টা করেছিল অনিক!
আমার মুখের উপর কিছু চেপে ধরেছিল।আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না।তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।আমি কিভাবে বেঁচে আছি!কীভাবে বেঁচে আছি অনিক!

অনিক বুঝলো,মেহের ভয়ংকর কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছিল বিকালে আর সেটার প্রভাবেই অজ্ঞান হয়ে যায়।সে মেহেরকে বললো,
–তুমি শান্ত হও।সব ঠিক যাবে লক্ষ্মীটি।

–অনিক,আমি জানি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছো না।কিংবা ভাবছো আমি স্বপ দেখেছি।

কিন্তু বিশ্বাস করো আমি সত্যি বলছি!এই যে দেখো,এই দেখো এই বালিশটার কভার নেই।কিন্তু এটার তো কভার ছিল!তাহলে কভার কোথায় গেল?
কেউ তো এসেছিল আমার রুমে নিশ্চয়ই। আমাকে মেরে ফেলার জন্যই এসেছিল।এই বালিশটা দিয়েই হয়তো মেরে ফেলতে চেয়েছিল।

মেহের আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে।
অনিক দেখলো,আসলেই বালিশটার কভার নেই।এবার সে কিছুটা চিন্তিত হলো।
ধরে নিলাম মেহেরের কথা সত্যিই। কিন্তু ওর রুমে কে ওকে মারতে আসবে আর কেনই বা আসবে!ওর সাথে তো কারো কোনো শত্রুতা নেই।বাসায় ছিল শুধু মা আর তরী।আর তো কেউ ছিল না!
আর যদি ধরে নেই এটা স্বপ্ন,তাহলে বালিশের কভারটা কোথায় গেল!

–অনিক, আমার মনে হয় তরী এসেছিল তরী!
আমি যদিও নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।কিন্তু তরীই একমাত্র ব্যক্তি এই বাসার,যে আমাকে সহ্য করতে পারে না অনিক।

–কি বলছো তুমি এগুলো মেহের!তরী তোমার বোন হয়।
ধরে নিলাম ও তোমায় সহ্য করতে পারে না কোনো কারণে!কিন্তু তাই বলে কি তোমায় মেরে ফেলতে চাইবে!মানে এতটুকু সাহস ওর হবে!
তুমি এটা বিশ্বাস করো!

এবার আমি নিজেও কনফিউজড হয়ে গেলাম।আর যাইহোক তরী এতো নিচে তো নামবে না যে মানুষ হত্যা করবে!তাহলে?তাহলে কি আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম?কিন্তু বালিশের কভারটা গেল কই?
কিছুই ভেবে না পেয়ে আমি চুপ করে রইলাম।

অনিক আবার বললো,

–আর আমি কিন্তু বিকালে আরেকবার এসেছিলাম বাসায় জানো?অনেকবার বেল বাজালাম কিন্তু দরজাই খুললো না!কারণ তোমরা তিনজনেই তখন ঘুমাচ্ছিলে।
তরী জেগে থাকলে তো নিশ্চয়ই দরজা খুলে দিত,তাইনা?
তারমানে তোমার মতো তরীও তখ ঘুমাচ্ছিল।

আর এতো হাই সিকিউরিটির মাঝে বাহিরের কেউ আমাদের বিল্ডিং এ ঢুকতেও পারবে না, তুমি বেশ ভালো করেই জানো।
তুমি নিশ্চয়ই কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছো সোনা।

অনিকের কথায় যুক্তি ছিল।এখন আমারও মনে হচ্ছে,আমি স্বপ্নই দেখেছিলাম!আর বালিশের কভারটা হয়তো এদিক সেদিক কোথাও খুলে পড়ে আছে!সকালে উঠে খুঁজে দেখতে হবে।

অনিক আমাকে আস্তে করে শুইয়ে দিয়ে বললো,

–আচ্ছা সোনা,এটা নিয়ে আমরা পরে কথা বলবো।
এখন ঘুমাও।আমি আছি তো তোমার পাশে।

——————

সকাল-১১টা
নাস্তা শেষ করে অনিক বাহিরে বেরিয়ে গেল!

যাওয়ার আগে মাকে বলে গেল মেহেরের খেয়াল রাখতে।

অনিক একজন পরিচিত মনোচিকিৎসক এর কাছে এসে উপস্থিত হলো।

আসলে সে সারারাত ঘুমাতে পারেনি কাল।
মেহেরের জন্য অনেক চিন্তা হচ্ছিল।ও যেভাবে বর্ণনা করেছিল ওর স্বপ্নের কথা,একদম বাস্তব মনে হচ্ছিল।কিন্তু বাস্তব হওয়ার কোনো যৌক্তিক সম্ভাবনাই দেখছি না।

কিন্তু রহস্য শুধু বালিশের কভারটা নিয়েই।এটা উধাও হয়ে গেল কি করে!
রাতে মেহের ঘুমিয়ে যাওয়ার পর অনিক কভারটা খুঁজেছে বিছানার উপরে,নিচে,কার্পেটের নিচে।কিন্তু কোথাও পায়নি।

আর ঠিক এই ব্যাপারে কথা বলতেই সে একজন সাইক্রিয়েটিস্ট এর কাছে এসেছে।

তার কাছে সব খুলে বলার পর ভদ্রলোক বললেন,

–দেখুন,আপনি যেহেতু জোর দিয়ে বলছেন,বাসার ভিতরে এমন কেউ নেই বা বাহিরের কেউ ঢোকারও সুযোগ নেই যে আপনার ওয়াইফকে আক্রমণ করতে পারে।
তাই স্পষ্টতঃই বুঝা যায় যে এটা আপনার ওয়াইফের বলা ঘটনাটি একটি দুঃস্বপ্ন।

কিন্তু যখন শুনলাম বালিশের কভার খুঁজে পাচ্ছেন না আর আপনার ওয়াইফ এই বালিশকে ঘিরেই হত্যার কথাটা বর্ণনা করছে,তখন বুঝলাম এটা কোনো দুঃস্বপ্ন নয়।এটা আপনার ওয়াইফের মনের সাজানো একটা ঘটনা।

–মানে?ঠিক বুঝলাম না।

–দেখুন অনিক সাহেব।আপনার ওয়াইফের এখন প্রেগন্যান্সি পিরিয়ড চলছে।এই সময়ে অনেকেরই মুড সুইং হয়।এটা খুব স্বাভাবিক।
কেউ কেউ আবার এই সময়টাতে অস্বাভাবিক আচরণ করে।
নিজের প্রতি অন্যের আ্যটেনশন পাওয়ার জন্য ওরা কল্পনার সাথে বাস্তবের একটা যোগসূত্র তৈরি করে ফেলে।ওরা কিন্তু এটা নিজেরাও বুঝতে পারে না।

আপনার ওয়াইফের সাথে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটা ছিল আপনার ওয়াইফের মনের একটা কল্পনা,আর কল্পনা ঘোরেই সে বালিশের কাভারটা খুলে কোথাও লুকিয়ে ফেলেছে।ঠিক এখানে এসেই কল্পনা আর বাস্তবের মাঝে একটা যোগসূত্র সে তৈরি করে ফেলেছে।

আর যখন তার পুরোপুরি হুশ ফিরে আসে তখন তার আগের কিছুই মনে থাকে না।
এই যে আক্রমনাত্মক একটা কল্পনা ঘুরে বেড়ায় আপনার স্ত্রীর মাঝে এটাকে আমরা মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে থাকি স্কিৎসোফ্রেনিয়া।

–এখন কীভাবে এটা থেকে পরিত্রাণ পাবো ডাক্তার সাহেব?

–যেহেতু আগে কখনো উনার সাথে এমন ঘটনা ঘটেনি তাই স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে যে এটা তার প্রেগন্যান্সি সময়ের সাময়িক আচরণ!
এটা ঠিক হয়ে যাবে নিজে নিজেই,ভয়ের কোনো কারণ নেই।
শুধু রোগীকে একটু চোখে চোখে রাখবেন যেনো নিজের কোনো ক্ষতি না করে বসে।

–অনেক অনেক ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেব।

————–

অনিক বাসায় এসে মোটামুটি যতটা পারা যায় বুঝিয়ে বললো আমাকে যে ডাক্তার কি কি বলেছে।

আমি চুপচাপ সব শুনে নিলাম আর মেনেও নিলাম।

আসলে সকালে ঘুম ভাঙার পর আমার কাছেও কালকের ঘটনাটা নিছক আজগুবি চিন্তা ছাড়া আর কিছুই লাগেনি।
দু’জন মিলে বালিশের কাভারটা খোঁজাখুঁজি করলাম আরও কিছুক্ষণ কিন্তু পেলাম না কোথাও।

ব্যাপার টা তখনকার মতো সেখানেই ধামাচাপা পড়ে গেল।

আজ বিকালে সবাই মিলে সিনেমা দেখে এলাম।সিনেমা শেষ করে রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়েদেয়ে একবারে বাসায় এসেছি।

অনেকদিন পর বাহিরে যেতে পেরে মন খুব ফুরফুরে লাগছে।
আর অনিকও বললো,এখন থেকে রোজ অল্প হলেও আমাকে বাহিরে থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।
আমিও ভীষণ খুশি।

রাত ১২টার দিকে চাচার ফোন আসলো।
ভোর ৫টায় তাদের ফ্লাইট।
চাচা-চাচীর সাথে অনেক্ষন যাবৎ কথা বললাম আমি আর অনিক।
কথা শেষ লরে ফোন রেখে অনিকের সাথে ব্যালকনিতে চলে আসলাম।
দু’জন মিলে স্মৃতিচারণ করছি পুরানো দিনগুলোর কথা।এই তো সেদিন বিয়ে হলো আমাদের আর দেখতে দেখতে ৪টা বছর পার হয়ে গেল প্রায়!

হঠাৎ করেই অনিক একটা গান ধরলো।আর আমি ওর কাঁধে মাথা রেখে মুগ্ধ হয়ে শুনছি…

চাঁদ নেমে আসে
আমার জানলার পাশে
ঘুম ছুয়ে ভাসে
চাঁদের গান।
দূর থেকে যদি ডাকে তারা
রাতে ঘুম হবে দিশেহারা
সবটুকু আঁধারের পাড়ে
গান হবে সারা।
………………………..
……………………….

———————-

সকালে নাস্তা করে সোফায় এসে বসলো অনিক।
ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে সে।

একটুপর তরীও এসে পাশে বসলো।
ফোন থেকে চোখ তুলে অনিক এক নজর তাকালো তরীর দিকে।দুজনেই মুচকি হাসি আদান-প্রদান করলো।

তারপর আবার অনিক ফোনের দিকে নজর দিল।

চোখ অনিকের ফোনের দিকে আছে ঠিকই কিন্তু তার মনে হচ্ছে তরী তাকে দেখছে,তার দিকেই তাকিয়ে আছে!

অনিক মাথা তুলে আবারও তাকালো তরীর দিকে,যা ভেবেছে তাই!
তরী এক দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে।বেশ সাজগোজ করে আছে তরী।ঘরের মধ্যেও গাঢ় রঙের লিপস্টিক মেখে রেখেছে ঠোঁটে!

অনিক গতকালের মতো আবারও অস্বস্তিবোধ করতে থাকে।
তরীর চাল-চলন একটু অন্যরকম ঠেকছে তার।

আসলে মেহের যেদিন বললো,”তরী মনে হয় তোমাকে ভাইয়ের চোখে দেখে না!”
সেদিন থেকেই অনিক একটু সতর্ক হয়ে চলছে,একটু একটু নোটিশ করতে শুরু করেছে তরীর হাবভাব!

যদি মেহেরের কথাই সত্যি হয়!যদি আসলেই তরী আমাকে নিয়ে ওর মনে অন্যরকম চিন্তা-ভাবনা এনে থাকে!এটা তো তাহলে খুবই খারাপ হবে ব্যাপারটা।

নাহ্ এটা নিয়ে তরীর সাথে সিরিয়াসলি কথা বলতে হবে।
অনিক ফোনটা পাশে রেখে,সরাসরি তাকালো তরীর দিকে।

–কি অবস্থা?কেমন যাচ্ছে?

–খুব ভালো জিজু।
খুশিতে ডগমগ হয়ে যায় তরী।সে আরেকটু আকর্ষণীয়ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে,নড়াচড়ার ছলে শরীর থেকে ওড়নাটা ফেলে দেয়।ভাব নিল যেনো সে কিছুই খেয়াল করেনি।

অনিক চোখ সরিয়ে নেয় তরীর উপর থেকে।কোনোরকমের ভনিতা না করে সরাসরিই বললো,

–দেখো তরী,তোমার এখন যে বয়সটা চলছে,এটা কিন্তু খুবই মারাত্মক একটা বয়স!

–মানেহ্?কিরকম?কি বলতে চাও জিজু?

–মানে এই বয়সটাতে তোমার মুড সুইং হবে বেশি বেশি।যেকোনো জিনিস এক দেখাতেই ভালো লেগে যেতে পারে,আবার দেখা গেল দুইদিন পর সেই জিনিসটাই আর ভালো লাগছে না।
তরী,তোমাকে একটা কথা আজ সরাসরি বলি,
ঠিক তোমার মতো দেখতে আমার একটা বোন ছিল, জানো?আমি তোমাকে আমার সেই বোনের মতোই দেখি।
আশা করি আর কিছু বলতে হবে না।

আমি রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনিকের সব কথা শুনছিলাম।
যাক বেশ ভালোই হয়েছে অনিক তরীকে সরাসরি কিছু একটা বলতে পেরেছে।

এদিকে তরী অনিকের উপর মনে মনে খুব রেগে যায়।আর ভাবতে থাকে,”অনিক তুমি আমাকে কি নজরে দেখো,সেটা আমার কাছে বড় ব্যাপার না।আমি তোমাকে কি নজরে দেখি সেটাই আমার কাছে বড়।
আর আমি তোমাকে পেয়েই ছাড়বো দেখে নিও তুমি।”

হঠাৎ তরীর চোখ যার,রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেহেরীমার উপর।
“ওহ্ এবার বুঝতে পেরেছি,নিশ্চয়ই এই মেহেরীমাই শিখিয়ে দিয়েছে অনিককে এসব কথা আমাকে বলতে।
আগেরবার তো বেঁচে গেছিস তুই,এবার ধরলে আর বাঁচবি না দেখিস।”

অনিক দেখলো,তরী তার কথার কোনো উত্তর দিচ্ছে না।চুপ করে বসে কে যেনো ভাবছে।

অনিক উঠে চলে এলো তরীর সামনে থেকে।

—————–

মাঝখানে আরও একটা দিন চলে গেল।তেমন কোনো ঘটনা ঘটলো না।
তরী শুধু ভাবছে কিভাবে মেহেরীমাকে হেনস্থা করা যায়।
আর এদিকে মেহেরীমা আর ওর শাশুড়ী ভাবছে কিভাবে এই মেয়েকে বাসা থেকে বের করা যায়!

———–

আজ অনিক আর মেহেরীমার ৪র্থ বিবাহবার্ষিকী। তারা ঘটা করে বিবাহবার্ষিকী পালন করে না ঠিকই ।
তবে ওই দিনেবাসায় ভালোমন্দ রান্নাবান্না করা হয়।কাছের কিছু বন্ধুবান্ধবকে বাসায় দাওয়াত দেওয়া হয়।সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া হয় এইটুকুই।
অন্যান্য বছর এইদিনে মেহেরীমার শ্বশুরও সাথে থাকেন কিন্তু এবারে উনি নেই!

সকাল থেকেই শ্বশুর আব্বার কথা খুব মনে পড়ছে আমার।
আসতে তো আর পারবেন না তাই ফোনেই কথা বলে নিলাম।

এদিলে অনিক সারাঘর ফুলে ফুলে সাজিয়ে দিয়েছে ডেকোরেশনের লোক এনে।
এবারে ওর আনন্দটা যেনো অন্যবারের চেয়ে একটু বেশিই!এবার শুধু মেহের না, মেহেরের সাথে আছে আরেকটা অস্তিত্ব! তাকে দেখাতে হবে তো,বাবা যে মাকে কত ভালোবাসে!

সারাদিন মোটামুটি হৈ-হুল্লোড়ের করেই কাটিয়ে দিলাম সবাই মিলে।
রাত বাড়ার সাথে সাথে একে একে সব মেহমান বিদায় নিয়ে নিল।আমি আর আম্মা মিলে যতটুকু সম্ভব বাসাটা গোছগাছ করে যে যার রুমে চলে আসলাম।

রুমে এসে দেখি বিশাল বড় একটা গিফটের বক্স খাটের উপর রাখা।আর খাটের পাশে দাঁড়িয়ে অনিক আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে।

আমি সেদিকে পাত্তা দিলাম না।গরমে খুব অস্থির লাগছে। এমনিতেই শাড়ি পড়ে থাকতে পারি না ১ঘন্টাও।আর আজ সারাদিন এতো ভারী একটা শাড়ী পরে সবার সামনে ঘুরঘুর করতে হইছে।
এখন জাস্ট অসহ্য লাগছে শাড়িটা।

আলমারি থেকে নাইট গাউনটা হাতে নিতে নিতে এদিকে অর্ধেক শাড়ী খোলাও হয়ে গেছে আমার।
অনিক বললো,

–কি করছো,দরজাটা বন্ধ করে অত্যন্ত চেঞ্জ করো।

এই বলে সে নিজেই দরজার দিকে এগিয়ে যায় বন্ধ করার জন্য।আমার মনে পড়ে গেল,রান্নাঘরে রাখা অনিকের জন্য দুধের গ্লাসটা আনা হয়নি এখনো ।
আমি অনিককে বাঁধা দিলাম,

–দরজা আটকিও না,আমার রান্নাঘরে কাজ আছে ।তুমি বরং দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দাও কেউ আসে নাকি।
কথাটা বলেই চোখ টিপে হাসলাম ওর দিকে চেয়ে।

অনিক দরজাটা আড়াল করে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে মেহেরীমার দিকে।
শাড়ির সবটাই খুলে ফেলেছে প্রায় ও। শুধু কোমরের দিকে একটু লেগে আছে।
কাজ করে আর গরমে কেমন যেনো ক্লান্ত -অবসন্ন দেখাচ্ছে মেয়েটাকে।খোঁপা খুলে গিয়ে ঘাড়ের কাছে দলা পাকিয়ে পড়ে আছে চুলগুলো।ওর ফরসা পেটের ঐ তিলটার দিকে তাকিয়েই আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না অনিক।

দরজা ছেড়ে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে মেহেরকে।দুইদিক থেকে দুই হাত দিয়ে ওর পেট চেপে ধরে ঘাড়ের কাছে মুখ ঘষতে থাকে অনিক।

–এই এই কি করছো ছাড়ো!কাজ শেষ হয়নি আমার।অনেক কাজ বাকী এখনো।সময় নষ্ট করো না।

অনিক আঠার মতো রেগেই রইলো।একচুলও নড়লো না।এবার আমি ঘুরে গিয়ে ওর মুখোমুখি হলাম।

— অত্যন্ত ড্রেসটা তো চেঞ্জ করতে দাও।

–না দিব না।

–উফফ অনিক

–কি মেহের!

–সরো

–সরবো না,কি করবা করো।

অনিক আলতো করে মেহেরের পেটে একটা চিমটি কাটে।মেহের চেচিয়ে উঠে!
তারপর দ্বিগুণ জোরে অনিককে একটা চিমটি কেটে জিজ্ঞেস করে,
–এখন কেমন লাগে?

–খুব মজা লাগে তো!আরও দাও।

আমি বুঝলাম,অনিক এখন আমাকে ছাড়তে চাইবে না কিছুতেই।তাই জেদ না দেখিয়ে অনুনয় করে বুঝিয়ে বললাম,

–লক্ষ্মীটি এখন ছাড়ো।আমি একটু পরেই আসছি।কাজ সব শেষ করে আসছি।তখন যত খুশি…..!

অনিককে বুঝিয়ে বলার পর ওর হাতের বাঁধন কিছুটা ঢিলে হয়ে গেলো।অর্থাৎ ও যাওয়ার জন্য সম্মতি দিচ্ছে।

আমি ওর থেকে দূরে সরতে যাব ঠিক তখনি চোখ পড়লো,দরজার কাছে একটা ছায়া পড়েছে।এই মাত্র কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।
আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম এটা তরীই হবে!
দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম দরজার কাছ থেকে।

অনিককে ছেড়ে দেওয়ার বদলে ওকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলাম আমি।
আকস্মিক আমার সাড়া পেয়ে অনিকও খুশি হয়ে গেল।ওর ঢিলে হওয়া বাঁধন আবার শক্ত হয়ে গেল।
আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল।

আমি যেনো কোথাও পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম…..হৃদয় পোড়ার গন্ধ!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here