আগাছা পর্ব ৯

#আগাছা
#Khadija_Akter
#পর্ব_০৯

–অনিক আমি বাচ্চাটা চাই।আমার খুব শখ একটা বাচ্চার।আমি এটা নষ্ট করতে চাই না। তুমি আর যাইহোক আ্যবোরেশনের কথা বলো না প্লিজ।

বলতে বলতে কান্নায় আমার কন্ঠ বুজে এলো।
অনিকের দিকে চেয়ে দেখলাম অনিকের মুখ কঠিন থেকে আস্তে আস্তে আরও কঠিনতর হচ্ছে।

আমি ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে অনিকের জবাবের অপেক্ষায় ওর কঠিন মুখের দিকে চেয়ে আছি।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম,আস্তে আস্তে করে অনিকের মুখের কাঠিন্যতা কেটে গিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে প্রশান্তির হাসি।

আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ও আমাকে কোলে তুলে নিয়ে সারাঘরময় ঘুরতে লাগলো।
আর চিৎকার করতে করতে বলছে,
–আমি বাবা হবো!আমি বাবা হবো!

–কি করছো!নামাও নিচে!পড়ে যাবা তো!

আর কিছুক্ষন ছুটোছুটি করে অবশেষে অনিক আমাকে নামিয়ে দিল নিচে।

নামানোর সাথে সাথেই আমার সামনে হাঁটু মুড়ে আমার পেটের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো।তারপর দুইহাতে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে পেটের সাথে কান চেপে রাখলো অনেক্ষন ধরে ।

–কি করছো?

–এই পিচ্চিটার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।

–পারছো কি?

–নাহ্,আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।

–তাহলে আর বৃথা চেষ্টা কেন?

–অনুভব তো করতেই পারি।

–অনেক করেছো।এবার উঠো।

–না আরেকটু।

–আমার কোমড় ব্যাথা করছে।দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।

এবারে কাজ হলো।অনিক উঠে আবারও আমায় আচমকা কোলে তুলে নিল।
তারপর বালিশটা একটু উঁচু করে আলতো করে আমায় শুইয়ে দিল বিছানায়।

অনিক নিজেও আমার পাশে এসে আমার কাঁধে আলগোছে মাথা রাখলো।তারপর পেটের উপর হাতটা রেখে বললো,

–তুমি তখন কি বলেছিলে মেহের?
বাচ্চা নষ্ট করতে চাও না!আমার কাছে মিনতি করছিলে তুমি?

–হুম।

–তুমি কি করে ভাবলে যে আমি আমার অনাগত সন্তানকে হত্যা করার হুকুম দিব তোমাকে?

আমি অভিযোগের সুরে বললাম,

–তুমিই তো বলেছিলে তুমি প্রোমোশন না পাওয়ার আগে বাচ্চা চাও না।

–তো?

–তো কি?

–মেহের শুনো,এটা ঠিক যে আমি চাইতাম আগে আমাদের ভবিষ্যৎটা আরেকটু শক্তপোক্ত হোক।তারপর আমরা নতুন অতিথির দায়িত্ব নিব।যাতে আমাদের জন্য সেটা সহজ হয়।
কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হোক বা আল্লাহর ইচ্ছায় হোক,আমাদের মাঝে যেহেতু আরেকজন আসতে চাইছেই তো আমাদের উচিত তাকে সাদরে গ্রহণ করা।

অনিকের কথাগুলো শুনে আমার বুক থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেল।খুব শান্তি লাগলো।
যাক তাহলে বাবুর বাবাও রাজী।
“আমিও তাহলে মা হবো অন্য মেয়েদের মতো!
ভাবতেই ভিতরটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো।

এর মধ্যেই অনিক উঠে গিয়ে ওর অফিসের ব্যাগ থেকে খুঁজে কি একটা নিয়ে আবার বিছানায় উঠে এলো।।

–মেহের,আমি ভেবেছিলাম সারপ্রাইজটা তোমাকে আমি আমাদের ৪র্থ বিবাহবার্ষিকীতেই দিব।
কিন্তু তুমি আমাকে এতো বড় একটা খুশির খবর দিয়েছো যে তার বিনিময়ে আমিও তোমাকে ছোট্ট একটা সুখব দিতে চাই।

আমার হাতে একটা কাগজ তুলে দিল অনিক।

পড়ে দেখলাম প্রোমোশন লেটার!
তারমানে অনিকের প্রোমোশন হয়ে গেছে!আমি বড় বড় চোখ করে দুহাতে মুখ চেপে ধরে বিস্ময়ে বললাম,

–ওহ মাই গড!প্রোমোশন হয়ে গেছে তোমার অনিক!
কিন্তু তুমি তো বলেছিলে কমপক্ষে আরও ৬ মাস লেগে যাবে!

–হ্যাঁ কিন্তু ১ মাস আগেই আমাদের কোম্পানির হাতে একটা বড় প্রজেক্ট চলে আসে।তখন চেয়ারম্যান ঘোষণা দিয়েছিল,যে এই প্রজেক্টটা ১মাসের মধ্যে সাকসেসফুলি কমপ্লিট করে দিতে পারবে তার প্রোমোশন কনফার্ম।
কিন্তু প্রজেক্ট বরবাদ হয়ে গেলে,ক্ষতিপূরণও সেই ব্যাক্তিকেই ভরতে হবে।

তারপর আমি এই রিস্কটা নিয়ে নিলাম।
জানো,অনেকেই এই প্রজেক্ট পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।কিন্তু আমার বস শুধু আমার উপরই ভরসা করে দায়িত্বটা আমাকে দেয়।
আর দিন রাত পরিশ্রম করে অবশেষে প্রজেক্টটা সাকসেসফুল করতে পেরেছি।
আর আজই এই লেটারটা হাতে পেয়েছি মেহের!

আমার চোখে পানি চলে আসলো।কতটা পরিশ্রম করেছে বেচারা আমার জন্য!আমাদের সংসারের জন্য!আর আমি ভাবতাম,এতো সময় বাসার বাহিরে থেকে হয়তো তরীর সঙ্গে সময় কাটায়!
যাইহোক,মুখে শুধু বললাম,

–এবার তো তাহলে আর কোনো বাঁধা নেই আমাদের এই বাচ্চাটা পৃথিবীতে আনতে।

–হুম কিন্তু তুমি যদি ভাবো প্রমোশন পেয়ে গেছি বলে আমি এই বাচ্চাটাকে এক্সেপ্ট করছি তাহলে কিন্তু ভুল।
আল্লাহ না করুক,আমার যদি ডিমোশনও হয়ে যেত তবুও আমি আমার বাচ্চাকে হত্যা করার চিন্তা মাথায়ও আনতাম না।নিজে না খেয়ে থাকলেও আমার সন্তানকে আমি ঠিকই মানুষের মতো মানুষ করতাম।আর…..

অনিকের ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে অনিককে থামিয়ে দেয় মেহের।
“আর বলতে হবে না,আমি জানি”

তারপর ধাক্কা দিয়ে অনিকের মাথাটা নিজের বুকের উপর থেকে সরিয়ে পাশের বালিশে ফেলে দেয় মেহের।
এরপর নিজের বালিশটা সরিয়ে দিয়ে অনিকের বুকে এসে মাথা রাখে।

অনিক মেহেরকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে নিজের সাথে…………

——————

সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেল।

উঠে আগে নিজে ফ্রেশ হলাম তারপর অনিককে তুললাম।
অনেক ডাকাডাকি করে জোর করে তুলে অবশেষে ওয়াশরুমে ঢুকাতে সফল হয়েছি আমার ঘুমবাবুকে।

এদিকে রান্নাঘরে এসে দেখি শাশুড়ী আম্মা নাস্তা সব তৈরি করে ফেলেছে।
আমি খাবারগুলো টেবিলে নিয়ে সাজিয়ে দিলাম।

আমি আর শাশুড়ী খাবার টেবিলে বসে অপেক্ষা করছি অনিকের জন্য।
একটু পর তরী এসেও বসলো।

অনেক্ষন অপেক্ষা করার পরও যখন অনিক আসছে না।রহিমা বেগম বললেন,
–অনিক এখনো আসছে না কেন?

তরী সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে বললো,
–আমি গিয়ে ডেকে নিয়ে আসি?

তরীর কথা শুনে আমি আর শাশুড়ী দুজনেই ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।আমি কিছু বললাম না,শুধু আম্মার দিকে একবার তাকালাম।
আম্মা দৃঢ় কন্ঠে বললেন,

–অনিককে ডাকার জন্য অনিকের বউ আছে এখানে মা!তোমাকে শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না।

তরীর মুখটা কালো হয়ে গেল।এমনিতেই সারাক্ষণ আমাদের সামনে মুখ কালো করে রাখে আবার এই এক্সট্রা রুপটা যোগ হলে ওর চেহারা দেখার মতো হয়!

আমি কোনোরকমের হাসি চেপে উঠে আসলাম অনিককে নিতে।

রুমে এসে দেখি সাহেব ফ্রেশ হয়ে আবার এসে শুয়ে পড়ছে।

ওকে টেনে তুললাম,টি-শার্ট পড়ালাম।ওর চোখে রাজ্যের ঘুম।বারবার ঢলে পড়ে যেতে চাইছে বিছানায়।আহা বেচারা কাল সারাদিন জার্নির পর রাতেও একটু ঘুমাতে পারেনি।আমারই উচিত ছিল জোর করে হলেও ওকে ঘুম পাড়ানোর।কিন্তু তা না করে উল্টো আমি আরও….

কোনোরকমে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসলাম অনিককে ডাইনিং এ।

আম্মা বললেন,
–কি রে ঘুম কি আর শেষ হয় না তোর?বেলা কয়টা বাজে?দেখো,এখনো বসে বসে কেমন ঢুলছে!

অনিক এক টুকরো রুটি মুখে পুরে দিতে দিতে বললো,
–মা আমার কি দোষ!তোমার বউমাই তো রাতে ঘুমাতে দিল না…

বলতে বলতেই হঠাৎ অনিক থেমে গেল।
ঘুমের রেশে সে এগুলো কার সামনে কি বলছে!।

মেহেরের দিকে চেয়ে দেখলো,মেহের তার দিকে চোখ পাকিয়ে চেয়ে আছে।
অনিক সাথে সাথেই নিজের ঠোঁটে নিজেই আঙুল চেপে ধরে চোখের ভাষায় মেহেরকে বুঝালো,”না,না আর কিছু বলছি!ভুল হয়ে গেছে।আর হবে না!তুমি শান্ত হও।”

আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে গেছে।আম্মা না জানি কি না কি ভাববে।আমরা তো সারারাত গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম।শেষরাতের দিকে নাহয় আমি একটু…..
তাই বলে এভাবে অনিক সবার সামনে…!

আম্মার দিকে চেয়ে দেখলাম,তিনি খাচ্ছেন আর মিটিমিটি হাসছেন।

তরীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম,খাবার শুধু নাড়ছে কিন্তু খাচ্ছে না।
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে রাগে ফুসছে ও।নাকের পাটাতন থেকে থেকে ফুলে উঠছে।

আমি আর আম্মা ওর হাবভাব খেয়াল করলেও অনিকের সেদিকে খেয়াল নেই।ও মাথা নিচু করে ঘুমে জুড়তে জুড়তে রুটি চিবুচ্ছে।

আমি তরীকে আরেকটু জ্বলানোর জন্যই,আদুরে সুরে বললাম,।

–উফফ অনিক,আমার খেতে একদম ইচ্ছা করছে না।আমি আর খাবো না।

–আচ্ছা জোর করে খেতে হবে না,হাতটা ধুয়ে নাও।

বলেই অনিকের মনে পড়ে গেল,মেহের এখন প্রেগন্যান্ট। খাওয়ার অবহেলা করলে একদম চলবে না।
তার ঘুম উবে গেল মুহুর্তেই।সে তড়িৎ গতিতে উঠে এসে মেহেরের পাশে দাঁড়ালো।

–চুপচাপ এখানে বসো।আমি খাইয়ে দিচ্ছি,খেয়ে নাও।

–না খাবো না।

–চুপ একদম চুপ।তুমি না খেলে আমাদের বাচ্চা কি খাবার পাবে?
নাও হা করো।

আমি তরীর দিকে একবার চেয়ে তারপর হা করে অনিকের হাতের রুটিটা মুখে নিয়ে নিলাম।

মেহেরীমা খাবেনা বলার সাথে সাথেই অনিকের চোখের ঘুম উধাও! আবার চোখের সামনে মেহেরীমার প্রতি অনিকের এমন যত্ন!
আর শেষমেষ যা শুনলো “অনিকের বাচ্চা”!

তরী ঠিক থাকতে পারলো না আর রাগে তার হাত পা থরথর করে কাঁপছে! টেবিল থেকে পানি ভর্তি কাঁচের গ্লাসটা নিয়ে ঠাস করে ফ্লোরে ছুড়ে মারে সে।নিজের প্লেটটাও আছাড় মেরে ফেলে দেয়।
তারপর চেয়ারটা শব্দ করে পিছনের দিকে ঠেলে সরিয়ে সেখান থেকে উঠে হনহন করে চলে যায়।

আমরা সবাই চমকে উঠি ওর এই আক্রমনাত্মক রিয়েকশনে।
সত্যি বলতে আমি ঠিক এটাই চেয়েছিলাম।চেয়েছিলাম অনিকের সামনে ও এমন কিছু করুক যাতে অনিক একটু হলেও বুঝতে পারে কিছু।

–তরী!তরী! কি হলো তোমার?উঠে গেলে কেন?

অনিক অস্থির হয়ে উঠে তরীর এই ব্যাবহারে।মায়ের দিকে চেয়ে দেখে,মায়ের চোখে কোনো অস্থিরতা নেই।
তবে কি সে একটু বেশিই ভাবছে তরীকে নিয়ে!
আর তরী এমন করলোই বা কেন!
এই প্রথমবারের মতো অনিকের মনে কিছুটা খটকা লাগে।

———————-

দুপুরে আমি আর আম্মা রান্না করছি রান্নাঘরে।
তরী ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে ফোন চাপছে।

এইসময়ে অনিক এলো।
সে বাহিরে গিয়েছিল কিছু বাজার সদাই করতে।
আসার সময় সাথে মিষ্টিও নিয়ে এলো।
বাসার সবাইকে মিষ্টি মুখ করালো বাবা হবে সেই সুসংবাদে।

মেহেরীমা খেয়াল করলো,তরীর ভাগের মিষ্টিটা তরী ফেলে দিচ্ছে ময়লার ঝুড়িতে!

দুপুরের খাওয়ার পর আমি আর অনিক রুমে চলে আসলাম।
দুজন পাশাপাশি শুয়ে গল্প করছি।

এই কথায় সেই কথায় আমি একসময় বললাম,

–সকালে তরী খাবার টেবিলে কেমন ব্যবহারটা করলো দেখলে?

–হ্যাঁ,হঠাৎ করেই কি যেনো হলো!ভাঙচুর করে চলে গেল।

–আমার মনে হয় তুমি আমাকে খাইয়ে দিচ্ছিলে তাই ও এমন করলো।

–ধুরর আমা বউকে আমি খাইয়ে দিব,এখানে ও জ্বলবে কেন!
ছাড়ো তো ওর কথা।
আমরা দুজন যখন একসাথে থাকবো তুমি মাঝখানে আরেকজকে ঢুকিয়ে দাও কেন।

অনিক কপট রাগ দেখিয়ে পাশ ফিরে গেল।
আমি ওকে জোর করে আবার এপাশে ফিরিয়ে এনে।আদর করে গাল টেনে বললাম,

–আচ্ছা রাগ করো না বাবু।আর আনবো না তৃতীয় ব্যাক্তি।
শুধু তুমি আর আমি!
চলবে?

অনিক খুব খুশি হয়ে গেল,
–চলবে না।দৌঁড়াবে…..!

কিছুক্ষণ একে অপরের সাথে এভাবে খুনসুটি করার পর আমার চোখে ঘুম নেমে এলো।
ঘুমিয়ে গেলাম।

অনিক চেয়ে দেখলো,মেহের ঘুমিয়ে পড়েছে।সে অনেক্ষন শুয়ে থেকে ঘুমন্ত মেহেরের দিকে চেয়ে রইলো।
তার ঘুম আসছে না আর শুয়ে থাকতেও ভালো লাগছে।
ভাবলো উঠে গিয়ে মায়ের সাথে গল্প করি কিছুক্ষণ।

মায়ের রুমে গিয়ে দেখে মাও ঘুমোচ্ছে।

কি আর করার সোফায় অলসভাবে গা এলিয়ে দিয়ে টিভি দেখতে লাগলো অনিক।

একটু পরেই হাতে বইখাতা নিয়ে তরীও হাজির হলো সেখানে।
আসলে তরী একটু আগেই দেখেছে অনিক ড্রয়িং রুমে বসে আছে।
তাই সে তাড়াহুড়ো করে নিজেকে পরিপাটি করে,একটা অঙ্ক বুঝার উছিলায় চলে এসেছে অনিকের সাথে সময় কাটাতে।

–অনিক জি জু!তুমিও এখানে?

–আরেহ তরী যে?আসো বসো।কী ব্যাপার ম্যাথ করবা নাকি?

—হ্যাঁ, তুমি আছো ভালোই হয়েছে।আমি না একটা ম্যাথ কিছুতেই বুঝতে পারছি না।প্লিজ বুঝিয়ে দিবা?

–কোন ম্যাথ দেখাও তো।

তরী সুযোগ পেয়ে একদম অনিকের কোল ঘেঁষে এসে বসলো।তারপর মনটা খারাপ করে বললো,

–ঠিক আছে।কিন্তু ম্যাথ করার আগে তোমাকে একটা কথা বলতে চাই অনিক জিজু।

–বলো কি বলবা?

–আসলে সকালে না আমার খুব পেট ব্যাথা করছিল।ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে আমি ওরকম করেছি।সব ফেলে দিয়েছি।কিন্তু পরে আমার খুব খারাপ লাগছে।
তুমি আবার আমাকে খারাপ ভাবোনি তো?

— ওহ্ আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার!তোমার ঐরকম অদ্ভুত আচরণ দেখে তো আমি চিন্তায় পড়ে গেছিলাম যে হঠাৎ কি হলো আবার।
এখন কেমন লাগছে?পেট ব্যাথা কমেছে।

–হ্যাঁ এখন ঠিক আছি।

তরী যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো,অনিককে এই মিথ্যাটা বুঝাতে পেরে।
সে সকালে রুমে গিয়ে চিন্তা করে দেখেছে,মেহেরীমা আসলে চাইছিল যেনো অনিকের সামনে আমি খারাপ ব্যবহার করি আর অনিক আমাকে ভুল বুঝুক!
তারপর তরী সিদ্ধান্ত নেয়,মাথা গরম করা যাবে না।যা করার ঠান্ডা মাথায় করতে হবে।

–আচ্ছা ঠিক থাকলেই ভালো।
কোন ম্যাথটায় প্রব্লেম দেখাও এবার।

তরী বই খুলে আন্দাজি একটা ম্যাথ দেখিয়ে বললো,

–এই যে এটা।

–আরে এটা তো একদম সহজ অঙ্ক।
একবার দেখিয়ে দিলেই পারবা।এই দেখো…..

অনিক ম্যাথ করে দিচ্ছে আর বুঝাচ্ছে।

তরীর সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই।সে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে অনিকের দিকে।

‌বাতাসে অনিকের সিল্কি চুলগুলো উড়ছে।তরীর খুব ইচ্ছে করছে,চুলগুলো হাত দিয়ে কপাল থেকে সরিয়ে
দিতে।কিন্তু সে আপাততঃ সংযত করে রাখলো নিজেকে।

‌অনিক মাথা নিচু করে খাতার দিকে চেয়ে বুঝাচ্ছে আর তরী চেয়ে দেখছে অনিকের লাল লাল ঠোঁট দুটোর দিকে।
‌উফফ কি আকর্ষণীয়!

‌–বুঝছো এটা?আরেকবার বুঝাবো?কি হলো, বুঝোনি?

বলতে বলতে অনিক এবার মাথা উঁচু করে তরীর দিকে তাকালো।খেয়াল করলো,তরী তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ করেই অনিকের কেমন অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো।
অনিক কিছুটা হেসে নিজেকে সহজ করলো।তারপর তরীর চোখের সামনে আঙুল দিয়ে একটা চুটকি বাজিয়ে বললো,

–এই যে শালীকা!কোন রাজ্যে আছেন আপনি!

তরীর ধ্যান ভাঙতেই থতমত খেয়ে বললো,

–জিজু কিছু বললে?
অঙ্কটা আরেকবার বুঝাবে প্লিজ।

অনিক বুঝতে পারলো,যতক্ষণ সে ম্যাথ বুঝিয়েছে তরীর একটুও মনোযোগ ছিল না এদিকে!

তারমানে পুরোটা সময় ও আমার দিকেই চেয়েছিল নাকি!
যাইহোক,আরেকবার ম্যাথটা বুঝিয়ে দিল অনিল।

এবার তরী বইখাতা সব পাশে সরিয়ে দিয়ে বললো,

–এখন পড়াশোনা করবো না আর।
আসো গল্প করি।

অনিক দেখলো,তরী একবার গল্প শুরু করলে সহজে থামতে চাইবে না।
আগে অনিক অনেক মনোযোগ দিয়ে তরীর কথা শুনলেও এখন শুনতে ইচ্ছে করছে না।
তাছাড়া যেকোনো সময় মেহের উঠে যেতে পারে!তখন আবার উল্টাপাল্টা বুঝে আবার রাগ করে থাকবে।

অনিক সুন্দর করে বুঝিয়ে বললো,

–তরী আমার তো একটু বাহিরে যেতে হবে এখন।
তুমি পড়াশোনা করো।আমরা অন্য একসময় গল্প করবো।

বলতে বলতে অনিক উঠে দাঁড়ালো।অনিককে দাঁড়াতে দেখে তরীও সাথে সাথেই উঠে গেল।

–আমিও যাব জিজু তোমার সাথে?

–কোথায়!

–তুমি যেখানে যাও।বাসায় থেকে থেকে বোর হয়ে যাচ্ছি আমি।কতদিন হলো ঘুরতে নিয়ে যাও না আমায়।

অনিকের মায়া হলো মেয়েটার জন্য।আহা বেচারী,সারাদিন বাসায় থাকতে থাকতে হয়তো আসলেই অনেক বিরক্ত হয়ে গেছে।
সাথে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো।কিন্তু আমি তো যাব অন্য একটা কাজে।সেখানে তরী থাকলে চলবে না!

–তরী আজ না প্লিজ। আজ একটা জরুরি কাজে বাহিরে যাব।
তোমাকে,মাকে আর মেহেরকে নিয়ে আমি কালই কোথাও ঘুরতে যাব।প্রমিজ।

অনিক তরীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

আসলে অনিক যাচ্ছে একটা স্বর্ণকারের দোকানে।
মেহেরের জন্য আর্জেন্ট অর্ডারে ২দিনের মধ্যে একটা ব্রেসলেট বানাবে সে।
২দিন পরেই তাদের বিবাহ বার্ষিকী! বিবাহবার্ষিকীতে মেহেরকে অনিক এই ব্রেসলেট টা উপহার দিতে চায়।

অনিক চলে যেতেই তরী রাগে দাত কিড়মিড় করতে থাকে।
অনিক তাকে কি ইগ্নোর করছে!মেহেরীমার জন্য তাকে ইগ্নোর করছে!
কী আছে মেহেরীমার মধ্যে যা আমার মাঝে নেই!কত সাজগোজ করে থাকি তার জন্য সবসময়। একদিনও তো ভালো করে দেখেও না।

এখন আবার বাচ্চা হবে তাদের!বাচ্চা হয়ে গেলে তো অনিকের পিছুটান বেড়ে যাবে।অনিক আর কখনই আমার হবে না।অনিক মেহেরীমাকে কিছুতেই ছাড়বে না তখন।

কি করবো এখন আমি!কি করবো!কি করবো।

পাগলের মতো এদিক সেদিক পায়চারি করতে থাকে তরী।
অনেক্ষন চিন্তা করার পর হঠাৎ করেই তার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল,”আচ্ছা বাচ্চাটাকে যদি নষ্ট করে দেই আমি!”
আবার এক মুহুর্ত চিন্তা করলো সে,
“শুধু বাচ্চা কেন?যদি বাচ্চার মাকেই মেরে ফেলি!তাহলে তো আমার পথ একদম পরিষ্কার। ”

এখনই তো সুযোগ।অনিক বাসায় নেই।অনিকে মাও ঘুমায়।আর মেহেরীমাও তো ঘুমের মধ্যেই আছে!

যেই ভাবা সেই কাজ।দেরী করা যাবে মা একদম!
তরী উঠে দাঁড়ায়।
মেহেরীমার শাশুড়ীর দরজাটা বাহিরে থেকে আটকে দিয়ে মেহেরীমার রুমের দিকে পা বাড়ায় সে।

এদিকে কিছুদূত যাওয়ার পরই পকেটে হাত দিয়ে অনিক দেখে সে মানিব্যাগ না নিয়েই চলে এসেছে।
ড্রয়িং রুম থেকে তো সোজা বেরিয়ে এসেছে।তার সাথে যে ওয়ালেট নেই এটাও সে বেমালুম ভুলে গেছে!
একবার ভাবলো বেশিদূর তো আসিনি,বাসায় গিয়ে নিয়ে আসি ওয়ালেট টা।
আবার ভাবলো,ধুর স্বর্ণকার তো আমার পরিচিত।তাই কাজ শেষ হলে একবারে গহনা নেওয়ার সময়ই নাহয় টাকা দিয়ে দিব।

তরী এসে উপস্থিত হলো মেহেরীমার রুমে!
তরী দেখলো,হাত পা মেলে দিয়ে বড় প্রশান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে তার বোন।কত নির্ভয়ে,নির্ভাবনায় ঘুমাচ্ছে সে!

তরী মুখ দিয়ে চুহ্ চুহ্ শব্দ করলো।তারপর
বিড়বিড় করে বললো,
–তোর জীবনে এটাই শেষ দিন মেহেরীমা!অনেক শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছিস তুই।তোর শান্তির ঘুম নষ্ট করতে চাই না।ঘুমের মধ্যেই চলে যাবি তুই পরপারে।

তারপর এখানে যা হবার হবে!
ধরা পড়লে পড়বো।এমনিতেও,তুই বেঁচে থাকতে তো আমি অনিককে পাবো না!কারণ অনিক তোকে ছেড়ে কখনোই আমায় ভালোবাসবে না।অনিকের ভালোবাসাই তোর জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ালো রে মেহেরীমা।
আর যদি ধরা না পড়ি।তাহলে তো আমি সফল!হাহাহাহা!আস্তে আস্তে অনিকের মন থেকে তোর নাম ভুলিয়ে আমি তোর জায়গাটা দখল করে নিব।

ভাবতে ভাবতেই তরী ঘুমন্ত মেহেরীমার পাশ থেকে একটা বালিশ হাতে তুলে নিল।

তারপর ঝপাৎ করে বালিশটা চেপে ধরলো মেহেরীমার মুখে!

কয়েক সেকেন্ড পর মেহেরীমার ঘুমন্ত শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে জেগে উঠলো।শ্বাস নিতে পারছে না মেহেরীমা।
দম প্রায় শেষ হয়ে আসছে তার।

হাত দুটো দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুখের উপরে চেপে থাকা জিনিসটা সরিয়ে এক ফোটা শ্বাস নিতে।
কিন্তু এতো শক্তি দিয়ে বালিশটা তার মুখের উপর শক্ত করে ধরে রেখেছে কেউ,যে বালিশটা সরানো একদমই সম্ভব হচ্ছে না।
আরও কিছুক্ষণ দস্তাদস্তি করে একসময় মেহেরীমার জোর কমে আসে!শরীরটা আস্তে আস্তে শিথীল হতে থাকে…….

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here