আমার আকাশে মেঘ জমেছে
পর্ব:- ৭, ৮
.
আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশী প্রায় সবাই জানতো আমি প্রহর ভাইয়ের বাগদত্তা। এক বাড়িতে এভাবে অবিবাহিত অবস্থায় দুজনের থাকা অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু ছিল। হাওয়ায় এমন অনেক খবর মনি মা’র কানে এসে পৌঁছাত।
দেশে পা রাখার তিনদিনের মাথায় তাই প্রহর ভাইকে বিয়ের আসরে বসতে হয়। মনি মা কিছু কাছের মানুষকে দাওয়াত করেছিলেন বিয়েতে।
.
দিনটা ছিল শুক্রবার। সকাল থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছিল।
আমি একরাশ ঘোরের মাঝে কবুল বলি।
আব্বা ছিলেন না আমার বিয়েতে। আম্মাও ছিলেন না। অসংখ্য মানুষের ভীড়েও আমি একা ছিলাম। কন্যার বিদায়ের সময় প্রহর ভাইয়ের হাতে আব্বা আমাকে তুলে দেননি। বিদায় হয়নি আমার। প্রতিটি বিয়ের মতো আমার বিয়েতে বাজানো হয়নি,
” আমি যাচ্ছি বাবা, আমি যাচ্ছি
চোখ মুছে মুখ তোলো, স্নেহের বাঁধন খোলো…”
আম্মার গলা জড়িয়ে কাঁদতে পারিনি আমি। আব্বার পায়ে সালাম করতে পারিনি। আমার হাত ধরে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়নি আব্বা।
রেজিস্ট্রি খাতায় সাক্ষর করার সময় হাত কাঁপছিল ভীষণ। মনি মা আমার হাতের উপর ভরসার হাত রেখেছিলেন। উনার মুখের দিকে তাকিয়ে সাক্ষর করেছিলাম।
.
আব্বা- আম্মার মৃত্যু পর আমি যে রোবট হয়ে গেছিলাম তা বিয়ের দিন বুঝতে পারি। ভর্তির পর মেডিকেল ক্যাম্পাস নিয়ে কোন স্মৃতি আমার স্মরণে ছিলনা। বিয়ের আগে প্রহর ভাইয়ের সাথে মিষ্টি মিষ্টি প্রেমময় খুনসুটি আমি মিস করেছি।
বিয়ে পড়ানো পর প্রহর ভাইকে নিয়ে এসে যখন আমার পাশে বসতে বলা হয়, উনি আমার পাশে বসার বদলে আমার কোলে বসে গিয়েছিলেন। উনার ভাই-বোনেরা কী পরিমাণ মজা করেছিল এই বিষয় নিয়ে তা বলার বাইরে।
উনার জবাব ছিল এমন,
” আমার বউ, আমি ওর কোলে বসবো নাকি ওকে কোলে নিয়ে নাচবো এতে তোমাদের কী?”
এই কথায় সবাই আরও এক দফা হেসে নিয়েছিল।
প্রহর ভাইয়ের কোন ভাই বোনের সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। উপরে উপরে ভাব দেখানো সম্পর্ক ছিল আমাদের। এতো বড় বাড়িতে মনি মা, আমি একা থাকতাম। মনি মা ‘র দুই ছোট ছেলে মেয়ে ( আমার দেবর ননদ) হোস্টেলে থেকে মানুষ। বাড়িতে নাকি ওদের গ্রুমিং ঠিকঠাক ভাবে হবে না। দুজনেই উচ্চ শিক্ষার জন্য বাইরের দেশে যেতে আগ্রহী।
এই আপ এন্ড ডাউন সম্পর্কের কারণে বিয়ের দিন ওদের সিম্পল সিম্পল জোক গুলোতে আমি অস্বস্তি ফিল করছিলাম।
মনি মা আমাকে সেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দেন। আমাকে নিয়ে আসেন প্রহর ভাইয়ের ঘরে।
আমার নতুন পৃথিবীতে…………..
দোতলা বাড়ির এই একটি মাত্র ঘর আমার কাছে খুব প্রিয় ছিল। জানতাম এটা প্রহর ভাইয়ের ঘর। বিয়ের আগে এই ঘরে থাকার পারমিশন আমি পাইনি। যখনি মনি মা কে জিজ্ঞেস করতাম কেন আমাকে সেই ঘরে থাকতে দিচ্ছেন না উনি? উত্তরে উনি বলতেন,
-” অতিথি এই ঘর হলো তোর আর প্রহরের ছোট্ট একটা পৃথিবী। তোরা এই পৃথিবী নিজের মতো সাজাবি। একসাথে সাজাবি। মানুষ অভ্যাসের দাস। তুই এই ঘরে থাকলে তোর অভ্যাস হয়ে যেত এখানের। এক সময় অভক্তি চলে আসতো এই ঘর নিয়ে। নতুনত্ব আমাদের সবার ভালোলাগে। তুই যখন প্রহরের সাথে প্রথম এই ঘরে এসে বাস করতে শুরু করবি তখন দেখতে পাবি তোর এই ছোট পৃথিবীর এক বিচিত্র রূপ।”
.
সেদিন মনে হয়েছিল আমি সত্যি এক বিচিত্র দুনিয়ায় পদগমন করেছি। রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো ঘরটা মিষ্টি ফুলের গন্ধে ম ম করছিল। আমি অবাক হয়ে চারপাশ দেখছিলাম। মনি মা ঠিক আমার মনের মতো করে ঘর সাজিয়েছেন। প্রহর ভাই যে এসবের আগে পিছেও নেই এই ধারণা আমার আগে থেকেই ছিল। ১৯’৬” ঘরটা তখন আমার কাছে নতুন সংসার। ডবল বেডের একটি খাট, একটি টেবিল, একটি কাঠের আলমারি, মাঝারি একটি বুকশেলফ, একটি ড্রেসিং টেবিল আর কাঠের আলনা। ঘরের বাইরে সবচেয়ে নজরকারা সৌন্দর্য হলো এ বাড়ির বারান্দা। অর্ধ খোলা ছাদের বারান্দাটা যেন দক্ষিণের সব বাতাস টেনে নিয়ে আসত। হাত দিয়ে বৃষ্টি ছোঁয়া যেত, মন চাইলেই ভিজতে পারা যেত…… একান্তে।
.
ছোট বেলায় বাংলা সিনেমায় দেখতাম নায়িকা বিয়ের সাজগোজ নিয়েই বাসর ঘরে অপেক্ষা করে বরের জন্য। বর এসে ঘোমটা তুলে বউয়ের মেকাপের বাহার দেখে কিছু উপহার দেয়। কিন্তু মনি মা আমাকে একটি সুতির টাঙ্গাইল শাড়ি পরিয়ে দিয়ে যান।
আমরা কল্পনায় যা ভাবি, বাস্তবে তার কিছুই হয়না।
যদি হয়ও, তা আলাদা হবে; নতুন কিছু হবে।
তবে কল্পনার ভাবনার সাথে তার কোন মিল থাকবে না।
লাল জমিনের মাঝে সাদার হালকা ছিটাফোঁটা। ভারী গহনা খুলে কানে পরিয়ে দেন পাঁচ আনার একজোড়া ছোট দুল। গলায় পরিয়ে দেন সোয়া ভরির পাতাপাতা ডিজাইনের একটি লকেট চেইন। বিয়েতে প্রাপ্ত চারটা আংটি আর খুলতে হয়নি। সেই ভারী শাড়ি, মেকাপ, গহনা খুলে শান্তি লাগছিল খুব। আবার ভয়ও লাগছিল প্রহর ভাই বকবে না তো?
.
রাত সাড়ে বারোটার দিকে প্রহর ভাই ঘরে ঢুকেন। আমি তখন মনি মা’র রেখে যাওয়া ভাত তরকারি নিয়ে ব্যস্ত। সারাদিন খেতে পারি নি তেমন। তার উপর পোলাও মাংস আমি বেশি খেতে পারিনা। মনি মা তাই সাদা ভাত, ডাল আর সবজি দিয়ে গেছিলেন আমার খাওয়ার জন্য। ভেবেছিলাম প্রহর ভাই আসতে আরও দেরি করবেন। কিন্তু উনি এসেই পেটুক বলে চিল্লিয়ে উঠেন।
-” ওহ আল্লাহ্, অতিথি। ডোন্ট টেল মি তুমি দুপুরে কিছু খাও নি।”
-” খেয়েছি তো।”
-” আবার খাচ্ছ? দুপুরের সেই ভারী খাবার এখনও আমার হজম হয়নি। আর দুপুর কই? খাওয়া দাওয়া হলো তো বিকালের দিকে।”
-” তাও খিদা লেগেছে আমার।”
-” কী পেটুক মেয়েরে বাবা।”
উনার চিল্লানোর ধরণ এমন ছিল যেন আমি উনার মাথা খেয়ে ফেলছি।
-” আর খাবো না। যান নিয়ে যান এগুলা।”
” এহ বললেই হলো? সব খাও।”
-” বললাম তো খাবো না ভাইয়া। যান তো।”
আমি আবার শাস্তি পাই। প্রহর ভাই তার বিখ্যাত থেরাপি আমায় দেন। ঠিক সেই সময় থেকে তিতা করল্লা আমার উপর “ভাইয়া” শব্দের জন্য একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেন। আমার মুখ থেকে ভাইয়া শব্দ শুনলে আমার শাস্তির সময় দীর্ঘ হবে বলে জানান দেন। প্রহর ভাইয়া থেকে ডাকা শুরু হয় প্রহর…
আমাকে দিয়ে তিনি দুই তিনবার শুধু প্রহর নামে ডাকান। তাও গড়মিল করে ফেলছিলাম অনেকবার।
.
-” বলো প্রহর আমি তোমাকে ভালোবাসি। ”
-” বলেছিলাম তো।”
-” কবে?”
-” আপনার দেশের বাইরে যাওয়ার আগে।”
-” সেটা তো তুমি নিজের স্যারকে বলেছিলা। স্যার বর এক নাকি? এখন বরকে বলো।”
-” পারবো না।”
-” ওকে শাস্তি..”
-” আই লাভ ইউ।”
-” কী বললা? শুনতে পাইনি।”
-” প্রহর আই লাভ ইউ। এবার হয়েছে?”
-” রাগি রাগি গলায় নয়। প্রেম মিশ্রিত গলায় বলো প্রহর আই লাভ ইউ।”
-” প্রহর আই লাভ ইউ।”
-” ঠিকই আছে। তবে আমার মনে হয় তুমি এর থেকেও বেটার বলতে পারতে।”
এই মানুষ টা আমাকে কথায় কথায় রাগাত।
.
সেই রাত শুরু হয়েছিল আমাদের খুনসুটি দিয়ে। স্বর্ণের চেইন উপহার পেয়েছিলাম তার থেকে।
উনি বলেছিলেন চেইনটা নকল উপহার। আসল উপহার পরে দিবেন।
.
দুজনে কথা বলছিলাম আর জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। অন্ধকার রাতেও সোডিয়ামের আলোয় বৃষ্টির ফোঁটারা নৃত্য করে বেড়াচ্ছিল।
হঠাৎ প্রহর ভাই থেকে প্রহর হওয়া মানুষটা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় অর্ধ খোলা বারান্দাটায়। আকস্মিক আমার কোমর জড়িয়ে দাড় করায় তার সামনে। বৃষ্টির পানিরা মানুষটার মুখ বেয়ে নিচে পড়ছিল। আমার চারপাশ তখন সীমাহীন মুগ্ধতায় ঘিরে ছিল। কোন শব্দ বের হচ্ছিল না মুখ দিয়ে।
আমাকে উঁচু করে উনার দুই পায়ের উপর আমার দুই পা রেখেছিলেন উনি। আমি চোখ বন্ধ করে গলা জড়িয়ে ধরেছিলাম উনার। বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছিল দুজনকে। কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানিনা। আমার চোখের পাতা খুলে তার ভারী কণ্ঠে।
”
যদি কখনো তুমি দূরে সরে যেতে চাও
কখনো অবাস্তবের ভিড়ে বাস্তব হারিয়ে ফেলতে চাও
আমাকে খুঁজে পাবে সেই অবাস্তবের ভিড়ে।
বাস্তবের দর্পণ তুলে ধরবো তোমার সামনে
অবাস্তব থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে।
.
যদি কখনো তুমি অভিমান করতে চাও
বিষাদের কালো মেঘ ছোঁয়া বৃষ্টি গায়ে মাখতে চাও
মাথার উপরের এই খোলা আকাশের দিকে তাকাবে,
খুঁজে পাবে আমাকে সেই কালো মেঘের মাঝে।
ভালোবাসার রঙিন পৃথিবী সাজাবো তোমার জন্যে
তোমার অভিমানের কালো মেঘ দূর করতে।
.
যদি কখনো দূর দিগন্তে হারিয়ে যেতে চাও
ক্লান্তিহীন জীবন ফিরে পেতে চাও
আমাকে পাশে পাবে তোমার।
কারণ,
আমি ছিলাম তোমাতে, আছি তোমাতে
আজীবন থাকতে চাই শুধু তোমাতে…
”
-” ভালোবাসি তোমায়।”
“ভালোবাসি” এই একটি শব্দ শোনার জন্য কত অপেক্ষা করেছিলাম আমি। কতগুলো দিন, কতগুলো মাস শুধু অপেক্ষায় কাটিয়েছিলাম।
-” কখনো ছেড়ে যাবেন না তো?”
-” উঁহু, এই তোমাকে জড়িয়ে শপথ করলাম, কখনো ছেড়ে যাব না।”
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে আর তিনি তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। আমাদের দৃষ্টি কথা বলেছিল সেদিন….অনেক কথা।
.
-” জানেন তো আপনার গানের গলা অসাধারণ। ”
-” গান শুনবে?”
-” আপনি গাইবেন?”
উনি কোন ভনিতা ছাড়াই গলা ছেড়ে গান ধরেছিলেন।
”
একটা ছিল সোনার কন্যা মেঘ বরণ কেশ
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ,
দুই চোখে তার আহারে কি মায়া
নদীর জলে পড়ল কন্যার ছায়া,
.
তাহার কথা বলি, তাহার কথা বলতে বলতে
নাও দৌড়াইয়া চলি।।
.
কন্যার চিল দীঘুন চুল
তাহার কেশে জবা ফুল
সেই ফুল পানিতে ফেইলা কন্যা করল ভুল,
কন্যা ভুল করিস না
ও কন্যা ভুল করিস না,
আমি ভুল করা কন্যার লগে কথা বলব না।।
.
হাত খালি গলা খালি
কন্যার নাকে নাকফুল,
সেই ফুল পানিতে ফেইলা কন্যা করল ভুল,
কন্যা ভুল করিস না
ও কন্যা ভুল করিস না,
আমি ভুল করা কন্যার লগে কথা বলব না,
একটা ছিল সোনার কন্যা মেঘ বরন কেশ,
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ,
দুই চোঁখে তার আহারে কি মায়া,
নদীর জলে পড়ল কন্যা ছায়া,
এখন নিজের কথা বলি
নিজের কথা বলতে বলতে নাও দৌড়াইয়া চলি,,
সবুজ বরণ লাউ ডগায়া দুধসাদ ফুল ধরে,
ভুল করা কন্যার লাগি মন আনচান করে
আমার মন আনচান করে..
”
.
-” আকাশে মেঘগুলোর দিকে তাকান। কত সুন্দর লাগছে তাইনা?”
-” বৃষ্টিতে আর ভিজতে হবে না, ঘরে চলো। ”
-” এভাবে থাকি না। আমার খুব ভালো লাগছে। আপনার কী কষ্ট হচ্ছে?”
উনি আরও নিবিড় ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন,
-” নাহ, একদম না।”
-” একটা কথা বলি?”
-” বলো।”
-” আমার না- মেঘ, বৃষ্টি অনেক ভালো লাগে।”
-” হিংসা হচ্ছে।”
-” কেন?”
-” আমি থাকতেও মেঘ, বৃষ্টি তোমার এতো প্রিয়।”
লজ্জা পেয়ে নত মুখে সেদিন তার উদ্দেশ্যে বলেছিলাম,
-” আমার মনে কিন্তু আপনি সেই মেঘ বৃষ্টি।”
-” জানি তো। আমি মেঘ, আমি বৃষ্টি। জানো অতিথি, তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় একজন। আমার মায়ের পরেই তোমার স্থান। মায়ের জন্য যেমন আমি বেঁচে ঠিক তেমনি তোমার জন্য আমার হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হচ্ছে। ভালো থাকার অক্সিজেন তুমি।
আজ ওয়াদা করলাম, তোমার চোখে কখনো আমার জন্য পানি আসতে দিব না।
সব সময় মেঘ হয়ে বৃষ্টি ঝাড়াবো
তোমার মনের আঙিনায়।”
.