#আমার_সংসার
পর্ব-০৪
Sara Mehjabin
“আমাকে ক্ষমা করে দিও আজমী। আজমী আমি বিবাহিত। রিশান আমার-ই ছেলে। এই কথাগুলো তোমার কাছে গোপন করা হয়েছে।”
ফারহানের মুখে কথাগুলো শুনে আজমী কিছুক্ষণ কোন কথা বলল না। একদম শান্ত হয়ে পাথরের মতো বসে রইল।
“তারমানে আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন। ছিঃ এতো বড় একটা সত্যি গোপন করে আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন। নিজের ছেলেকে লুকিয়ে বিয়ে করতে লজ্জা করল না আপনার?”
“আজমী একটু শান্ত হও। শান্ত হয়ে আমার কথা শোনো। (আজমীর মাথায় হাত রেখে) বিশ্বাস করো এর সবটাই আমি বাধ্য হয়ে করেছি; আমি তোমাকে ঠকাতে চাই নি। সম্পুর্ন না জানলে তুমি বুঝবে না আমি কত অসহায়।”
“ব্যস..আমার আর কিছু বোঝার দরকার নেই। আমি আপনাকে চিনে গিয়েছি। বুঝে গিয়েছি আপনি কতটা নিচ ,,,কত জঘন্য আপনি! এখন বুঝতে পারছি আপনি আমার অতীত জেনেও কেন আমাকে বিয়ে করলেন। আমি ভেবেছিলাম আপনি খুব ভালো মানুষ। কিন্তু আপনি আসলে একটা প্রতারক, ঠক।”
চোখভর্তি পানি নিয়ে কান্নাকন্ঠে কোনমতে কথা বলা শেষ করে আজমী। চোখ দিয়ে অবিরাম পানি পড়ছে। ফারহান দুইহাতে আজমীর চোখের পানি মুছিয়ে দিল। তারপর মাথা নিচু করে আজমীর কোমল কপালে ঠোঁট স্পর্শ করাল। ডিপ কিস করল অনেকক্ষণ। আজমীর উচিত লোকটাকে সরিয়ে দেওয়া, যদিও স্বামী। কিন্তু সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যেন ফারহান তাকে স্পর্শ করে পাথর বানিয়ে দিয়েছে।
আজমীর দুই গালে হাত রেখে ফারহান বলল, আমি তোমাকে ঠকাই নি আজমী। কারণ যে নিজে ঠকে সে কাউকে ঠকায় না। আসো, আজ আমি তোমাকে দেখাব আমি কিভাবে ঠকেছি।
ফারহানের ঘরের পাশেই একটা ছোট্ট রুম। রুমটা সবসময় তালা দেওয়া থাকে। ফারহান আজমীকে হাত ধরে সেই রুমে ঢোকাল। রুমজুড়ে একটা মেয়ের অসংখ্য ছবি। মাঝখানের ওয়ালে একটি মেয়ের হাতে আঁকা বিশাল বড় ছবি। ফ্লোরের ওপর শাড়ি, গয়না, নুপুর, কাঁচের চূড়ি সব ছড়ানো-ছিটানো। মেয়েটির ছবির দিকে তাকিয়ে আজমী চমকে উঠল। আনিকা!! বন্ধু নামে তার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। আজমীর ভয়াবহ অতীতের মূল কারণ। তবে ফারহান কে?
আজমী ফারহানের দিকে তাকাতেই ফারহান ঝড়ের চেয়েও গতিতে আজমীর কাছে এসে ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিল। জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করল। আজমীর মাথায় হাত বুলিয়ে বারবার চুমু খেল। আরো শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল আজমীকে।
এদিকে রাগে-ঘৃনায় আজমীর সারা শরীর টগবগ করছে। এই লোকটা শুধু আজকেই নয়; এর আগেও তাকে ঠকিয়েছে। এই লোকটার কারনেই তার জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেছিল।
“জানো আজমী তুমি একটা কথা বলেছিলে না যে ঠকে সে হয়তো কষ্ট পায় কিন্তু যে ঠকায় তার জন্য আরো বেশি কষ্ট অপেক্ষা করে থাকে। আমি ঠকে গেছি আজমী। তোমার থেকে অনেকগুন বেশি কষ্ট আনিকা আমাকে দিয়েছে……”
ফারহান তার জীবনের সমস্ত কাহিনী আজমীকে খুলে বলল। ( ওয়েট। ওয়েট। আপাতত আজমী জানছে। কিন্তু আমি জানি নাই ফারহানের জীবনের কাহিনী কি। জেনে আপনাদের জানাব।)
ফারহান তার কথা শেষ করে আজমীর সামনে হাটু মুড়ে বসে হাতজোড় করল,, আজমী আমার ছেলেটা খুব অসুস্থ। জন্মের পর থেকেই ওর হার্টে ব্লক। হয়তো আমার-ই পাপের ফল। আমার অন্যায়ের শাস্তি আমার ছোট্ট বাচ্চাটার কষ্ট আমাকে দেখতে হচ্ছে। ওর খুব দ্রুত সার্জারি করাতে হবে। হার্টের কনডিশন খুব ক্রিটিক্যাল। অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার চান্স ফিফটি-ফিফটি। ডক্টর ওকে সবসময় হাসিখুশির মধ্যে রাখতে বলেছে; ও যা চায় ওকে তাই দিতে হবে।রিশান ওর মাকে চায়। আজমী, তুমি কি আমার রিশানের মা হবে? তুমি তো মেয়ে। প্রত্যেকটা মেয়ের ভেতরেই তো একটা মা সত্তা আছে। তুমি আমার রিশানের মা হয়ে যাও না আজমী। অন্যায় তো আমি করেছি বলো…আমার বাচ্চাটা তো কোন দোষ করে নি। আমি তোমার কাছে। আমার ছেলের জীবনের জন্য ভিক্ষা চাই আজমী।( আজমীর সামনে হাটু মুড়ে বসে হাতজোড় করে)
আজমী মৃদু হাসল, আপনি হাতজোড় করে বসে আছেন,,, আমার সামনে? জানেন এটা আমার বিশ্বাস-ই হচ্ছে না। আট বছর আগে আমিও এভাবেই আপনার সামনে আমার ইজ্জত আমার বাবার মান-সম্মানের জন্য ভিক্ষা চেয়েছিলাম। আপনার মনে আছে?
“প্লিজ আজমী তোমার যা শাস্তি দেওয়ার আমাকে দাও,,, আমাকে তোমার ইচ্ছামতো অপমান করো। তোমার মনের ভেতর যত কষ্ট রাগ ক্ষোভ জমা আছে আমাকে কষ্ট দিয়ে তার উসুল ওঠাও। শুধু দয়া করো আজমী…দয়া করে রিশানকে কাছে টেনে নাও।” ( হাতজোড় অবস্থায় কাঁদতে কাঁদতে)
এমন সময় দরজা ধাক্কানোর শব্দে দুইজনের ধ্যান ভাঙল। ফারহান গিয়ে দরজা খুলে দিল। ইমা রিশানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“এই যে ভাইয়া তোর বিচ্ছু। দিয়ে গেলাম। টাটা বিচ্ছু, গুড নাইট।”
“কিইই তুই আমাকে বিত্তু বললি! ইমা তিকতিকি(টিকটিকি)…পতা তিকতিকি একটা।”
“ভাইয়া তোর ছেলে আবার আমাকে নাম ধরে ডাকল। আবার টিকটিকি-ও বলল। আমি এর বিচার চাই।”
“ইহ্ তিকতিকি কে তিকতিকি বলব না তো হাতি বলব”
“ভাইয়াআআ”
“বাইয়াআআ” (ইমাকে ভেংগিয়ে) “ঝগলা কত্তে পালে না আমার পাপাকে দাকে। হি হি হি।”
“উফ থাম্ তোরা,,,দুইজনেই চুপ কর্। অনেক রাত হয়েছে। রিশান আব্বু রুমে আসো..চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ো। আর তুই..সারাক্ষণ রিশানের সঙ্গে কি হ্যা? এই বছর এস এস সি পরীক্ষা…তোর পড়াশোনার কোন খবর নেই। পরীক্ষার রেজাল্ট এত্ত খারাপ! বিশেষ করে তোর ঐ নতুন টিচার কি যেন নাম..ওলি। ঐ ওলি পড়ানোর পর থেকে তুই সব বিষয়ে ফেল করছিস।আমাদের বাসায় কেউ এত খারাপ রেজাল্ট করে নাই! একমাত্র তুই করিস।”
“ইয়েস। আই অ্যাম অলোয়েজ স্পেশাল। কেউ যেইটা করতে পারে নাই সেটা আমি করে দেখিয়েছি।”
বলেই দাঁত বের করে দৌড় দিল।
ফারহান দরজা বন্ধ করে পিছনে ঘুরে যে দৃশ্য দেখল তা ওকে একদম চমকে দেয়। বিছানায় পা জড়ো করে বসে আছে আজমী। রিশান আজমীর কোলে ঘুমাচ্ছে আজমীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে। আজমী ধীরে ধীরে রিশানের মাথায় হাত বুলাচ্ছে। কি মিষ্টি একটা বাচ্চা! ছোট্ট তুলোর বলের মতো সাদা কোমল মুখের ওপর লাল টুকটুকে একটা ঠোঁট। গালগুলো সবসময় লাল হয়ে থাকে। মাথাভর্তি কালো রেশমের মতো চুল। সাজিয়ে রাখা একটা ছেলে পুতুল যেন। দেখলেই মায়া পড়ে যায়। অথচ বাচ্চাটার ছোট্ট হার্টটার মধ্যে এতো কঠিন অসুখ। না জানি কত কষ্ট পায় অসুখের জন্য। বাচ্চাটাকে রাগের বশে সকালবেলা মেরেছিল। ভাবতেই আজমীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। রিশানের ঘুমন্ত মুখে চুমু খেয়ে ওকে বালিশে শুইয়ে দেয়। রিশান ঘুমের মধ্যে ছোট ছোট হাত দিয়ে আজমীকে ধরে। আজমী ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল।
পিঠের ওপর কারো স্পর্শ লাগতেই ঘাড় ঘোরায়।
“আপনি?”
“থ্যাংক ইউ আজমী। তোমার কাছে কৃতজ্ঞ হওয়ার আমার কোন ভাষা নেই। আমি তোমার কাছে কিচ্ছু চাই না। কিচ্ছু না। শুধু এইভাবেই রিশানকে ভালবাসা দাও।”
“আমি আপনার জন্য কিছু করছি না। যা করছি রিশানের জন্য। সো আপনার কৃতজ্ঞ হওয়ার কোন প্রয়োজনে নেই। আপনি আমার সাথে কথা না বললেই খুশি হব।”
ফারহান আজমীর পাশ থেকে সরে গিয়ে বিছানার অপর প্রান্তে আজমীর থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে শুয়ে পড়ল। নিজের অজান্তেই বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
রিশান ঘুমিয়ে পড়লে আজমী ধীরে ধীরে ওর পাশ থেকে উঠে যায়। না, সে কিছুতেই এই লোকটার সঙ্গে এক ঘরে এক বিছানায় থাকবে না। সহ্য করতে পারছে না এই লোককে। এর সঙ্গে থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে তো শুধু থাকছে রিশানের জন্য। এখন থেকে রিশানের মা সে। কিন্তু ফারহানের তার জীবনে কোন স্থান নেই।
আজমী দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়ে। প্রতিদিন রিশানকে ঘুম পাড়ানোর পর এখানেই ঘুমাবে সে।
পরেরদিন সকালবেলা আজমী ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করল। কিন্তু পাশে রিশান নেই। এমনকি ফারহানকেও দেখতে পাচ্ছে না।
আজমীর গায়ে সাদা রঙের গরম কম্বল জড়ানো। কম্বলটা সরাতেই আজমী ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল,,,তার সম্পূর্ণ শরীর খালি।
চলবে