একটুখানি বিশ্বাস পর্ব ২১+২২

একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-২১
রোকসানা আক্তার

ল্যাম্পের আলোয় অরুনের হলুদ মুখখানা অশ্রু ক্ষীণ চোখে দেখছে।মনে তার প্রচন্ড ঘৃণা আর ক্রোধ।এতো সাহস হয় কিভাবে আরেকজনের ফোন থেকে গোপনে ম্যাসেজ করে অন্যকে বিভ্রান্ত করতে!এদের তো মানুষ বলাই দুষ্কর।মনুষ্যত্বই মানুষের পরিচয় কোনো অমনুষ্যত্বের নয়।অশ্রু প্রচন্ড ক্রোধকে সামাল দিতে পারছে না।ওদিকে তার ফ্যামিলির অবস্থা ভালো যাচ্ছে না।আর এখান দিয়ে এদের যত ড্রামা।নাকি এই অমানুষটাই এই ড্রামার কারসাজিতে ফাঁদ পেতেছে নিজের ক্ষোভের বদলা মেটাতে।এরাতো বড়দের সম্মান-অসম্মানের অর্থই জানে না।প্রতিটি মা-বাবার অতি স্নেহের তূল্য মেয়েকে দিয়ে নিজের চাহিদা মেটাচ্ছে।কই একটিবার ই তো ওই মা-বাবার মান-সম্মানের কথা ভাবেনি।কখনোই তো ওই মেয়েগুলোকে নিজের বোন মনে করেনি।তারও যদি এরকম একটা বোন থাকতো,আর সেও অন্য পুরুষের প্রেমে অন্ধ হয়ে রাতে দেহ বিলিয়ে দিত তখনতো বেশ কঠিন গলায় বলতো “নরপশু, তোর জন্মের ঠিক আছে?তোর মা কি একশো ব্যাঁটার সাথে রাত কাঁটিয়ে তোকে দুনিয়ার মুখ দেখিয়েছে!লজ্জা হয়না মেয়েদের সতীত্ব নষ্ট করতে?তোকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো কুত্তা কোথাকার!”মুখ এককুলি থু মেরেই চল আসতো।
অথচ নিজেই এসবে লিপ্ত থেকে পর্দার সামনে কী সুন্দর ডামাডোল বাজাচ্ছে।দশের সামনে তৈলকে তেল করে দেশের মানুষগুলাকেই বোকা বনে পাঠাচ্ছে।দিন শেষে উপাধি পাছে কী– এরা ভদ্র,উঁচু জাতের ভদ্র পোলাপান।বাহ,বাহ দেশের বোকা সমাজ,হায়রে বোকা মানুষ!
এসব ভাবনার মাঝেই অরুনের কাঠিন্য গলার আওয়াজে টনক নড়ে অশ্রুর।অশ্রু স্বাভাবিক চোখেই অরুনের দিকে তাকায়।এখন কেনজানি অরুনকে তার ভয় হচ্ছে না।সাহসে বুকটা যেন ছলছলিয়ে উঠছে।তবে,এত সাহস কোথায় থেকে আসছে এর উৎস খুঁজে পাচ্ছে না।যাইহোক এখন উৎস খুঁজতে গেলে অদম্য সাহসটাই হারাতে হবে।
“এখানে কেন ডেকেছেন তাড়াতাড়ি বলুন।”
“বেরুতে বেশিই তাড়া?”
“তাড়া নয়।অবচেতন এখানে ডাকা অভদ্রতার পরিচায়ক”
অরুন চোখে-ঠোঁটে পিচাশ হাসি টানে।মুখে হাসিটা রেখেই কয়েক কদমে টি-টেবিলের উপর ল্যাম্পটি রাখে। পেছন ঘুরে দু’হাত ভদ্রতা বেশে পকেটে ঢোকায়।বলে,
“দু’বান্ধবী মিলে বেশ ভালো প্ল্যানই বুনেছিলে….
কথার দম রেখেই পকেট থেকে এবার হাতদুটো বের করে।প্রসঙ্গ টেনে আবার বলে,
তবে লাভটা হলো কী তোমাদের?ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বড় একটা আন্ডা!তোমরা দুজনই এখন আমার জালে ফেঁসে আছো।প্রথমত,তোমাদের সাহস দেখে ভাবলাম বাহ বাংলার শ্রেষ্ঠ দু”সাহসী নারী।এদের অদম্য সাহসের জন্যে সোনার মেডেল গলায় তুলে দিব।পরেতো দেখলাম কাঁচকলা। হা হা হা হা!”
অশ্রুর মাথায় ভীষণ রাগ চটে বসে।হাত-পা ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়।নিজেকে দমাতে সংকটাবস্থায় পড়ে। তার দেহের সর্বাঙ্গ থেকেই যেন গরম ধোঁয়া ছোটা অবস্থা।অরুন অশ্রুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলে,
“আমি কিন্তু এখন পারি আমার সহজ-সরল ভাইটাকে মিথ্যে বলে ওই মেয়েটার কপাল আটপৌরে বানাতে।আমি পারি ভুলবাল বলে আমার বাবাকে দিয়ে ওই মেয়েকে এই বাড়ি থেকে বিতাড়িত করতে।পারি,পারবো। তবে করবো না।এতটা নিচক মন নিয়ে থাকি না,নাহলে আজ জুতা ছাড়া লোকচক্ষু দ্বিধামনে থাকতে।কেমরের ওই উন্মুক্ত অংশটুকু নিয়ে হাজারো লোকের কুদৃষ্টির শিকার হতে।এতসব কেন করলাম জানো?আমি চাই না আমার বাড়ির মেহমান আমার নতুন অতিথিকে নিয়ে কোনোরকম কানাকুশো করুক।কারণ আজকে তার সম্মান মানেই আমার সম্মান।”
অরুনের এসব মিথ্যে বিনয় অশ্রুর শুনতে একদম ইচ্ছে না।চোখবুঁজে বিরক্তি নিয়ে দম ছাড়ে।অরুন আবারো ফাটা বুলি বলতে মুখ খুলে ওমনি অশ্রু হাত থামিয়ে দেয়।বলে,
“দোষ তো সবই আমার ছিল তাহলে আমার বাবা কী দোষ করেছে?”
অশ্রুর কথায় অরুন স্বাভাবিকতা বজায় রেখে।সে ভঙ্গিতেই বলে,
“অতঃপর এতদিনে তোমার বাবার কুকার্য চোখে পড়েছে তোমার?”
“মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ। চরিত্রহীনা আরো ভালো আপনিতো তারচেয়েও একটা জানোয়ার!”
অরুন উচ্চ আওয়াজে মাথা উঁচিয়ে হাসতে থাকে।অশ্রুর রাগটা সীমা ছেড়ে যায়।নাহ একে আর ছাড়া যাবে না।এ অনেক বেশিই বাড়াবাড়ি করছে।ভেবেই অশ্রু টি-টেবিলের দিকে চোখ রাখে।সেখানে একটা ফুলদানি সাজানো।রাগের বশে সেটা হাতে নিয়ে হালকা এগিয়েই ওইটা অরুনের কপাল বরাবর মারে।প্রবল আঘাতে অরুনের কপাল বেয়ে টাটকা রক্ত গড়গড়িয়ে বেরিয়ে আসে।রক্ত দেখে অশ্রু ভয় পেয়ে যায়।একপলক দিয়েই জিম্মি বাইরে চলে আসে।রুমের দিকে এগিয়ে দরজা ফাঁক করে ঢুকে পড়ে।ঠাস করে দরজাটা বন্ধ করে হাঁপাতে থাকে।অশ্রু হাঁপাতে হাঁপাতে প্রায় কেঁদেই দেয়।বুকফাটা কান্না আসছে তার।আজ সকাল থেকেই তার সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে।কিছুক্ষণ পরপর বাজে মুহূর্তগুলো এসে তাকে আচ্ছন্ন করছে।।তা কাটানোর অধম শক্তিটুকুও ফুরিয়ে যাচ্ছে।তাহলে সামনের সবকিছুই আবছা অন্ধাকারে ঢেকে যাচ্ছে?খুব কী কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ছে তার পরিবার?এত বড় ঝড় কীভাবে সামলাবে।কূল খুঁজে পাচ্ছে না অশ্রু।দরজায় করাঘাত পড়ে।
“এই অশ্রু দরজা খোল।”
রুমকির হতাশাগ্রস্ত আওয়াজে অশ্রুর শিরদাঁড়া খাঁড়া হয়ে যায়।বাইর থেকে লোকজনের খচর খচর আওয়াজ আসছে।পুরো বাড়ি জুড়ে তুমুল হৈচৈ হৈচৈ। অশ্রু ভয় পেয়ে যায় ভীষণ।মিনিট দশেক আগেইতো সে অরুনের মাথা ফাটিয়ে এখানে চলে আসছে।তাছাড়া, বাসায় ফ্যাসাদ বাঁধার এ ছাড়াতো কোনো কারণ নেই!অরুনের এমতাবস্থায় সবাই কী তাহলে ক্ষেপেছে ভীষণ নাকি অরুন আমার কথা বলাতে সবাই রেগে গেছে।ভাবতেই অশ্রুর লোম খাঁড়া হয়ে যায়।সে ইতস্ততায় একটা ঢোক গিলে।ওপাশ থেকে অশ্রুর জরাজীর্ণ আওয়াজ আসতেই থাকে।অশ্রু তড়িঘড়ি দরজা খুলে দেয়।রুমকি ভেতরে ঢুকেই বলে,
“অশ্রু,খুব গন্ডগোল হয়ে গেছেরে!”
“ক-ক-কী?”
“কে যেন বাসায় ঢুকে অরুনের উপর অত্যাচার করেছে!”
অশ্রুর কান দুটো সজাগ হয়।এখন রুমকিকে সত্যটা বলা যাবে না।আল্লাহ না করুক রুমকি এখন যে ভাবে বেহুশে আছে মনেতো হয় দেবরের জন্যে চরম মায়ার উপচে আসছে।কখন আবার মুখ ফসকে বলে ফেলে কাজটা আমিই করেছি তা বলা মুশকিল।কাজেই সত্যটা ঢেকে রাখাই শ্রেয়।অশ্রু নিজেকে স্বাভাবিকে দন্ডায়মান রেখে বলে উঠে,
“ক-কেন কি হয়েছে?”
“আরেহ গিয়ে দেখ অরুনের মাথা থেকে ঝরঝর রক্ত পড়ছে।সবাই আপসেটে পুরো বাসার সিসি ক্যামেরা অন করে দিয়েছে।কেউবা সিসি ফুটেজ গুলো চেইক করছে।”
অশ্রু চমকে উঠে।এবড়োথেবড়ো গলায় বলে,
“সব রুমেই কি সিসি ক্যামেরা বসানো ছিল?”
রুমকি বলতে যাবে তার আগেই বাইর থেকে কেউ চেঁচিয়ে বলে উঠে,
“অপরাধীকে পাইছি, পাইছি অপরাধীকে!”
এবার অশ্রুর প্রাণ যায় যায় অবস্থা।তারমানে চিলেকোঠার রুমে সিসি অন ছিল।আর এখন যেই তার মুখটা তীক্ষ্ণতায় দেখতে পাবে সাথে সাথেই বলে উঠবে”এই মেয়েটাই এ’কাজ করলো!বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
কেউ কেউ চরম অবাক হবে,কেউবা একঘন্টার জন্যে কোমায় যাবে,আবার কেউবা ভ্রু কুঁচকে দীর্ঘ ধৈর্য্য নিয়ে তার দিকে তাঁকিয়ে থাকবে।অশ্রুর পুরো বুঁকে কাঁপন সৃষ্টি হয়।বুকের ভেতরটা থেকে দাউ দাউ আগুনের উল্কা ধেঁয়ে আসে।চোখবুঁজে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে।রুমকি অশ্রুর হাত ধরে বাইরে নিয়ে যায়।এই মুহূর্তে অশ্রুর এদিকটায় খেয়াল নেই রুমকি যে তাকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।


“অরুন সাহেবকে ফুলদানি দিয়ে আঘাতের দৃশ্যটা সুস্পষ্ট। তবে অপরাধীর কোনো অংশই স্পষ্ট নয় আবছা অন্ধকারে!”
অশ্রুর ধুকপুক করা দম এবার মাতিয়ে উঠে দম নিতে।আল্লাহ তাহলে তাকে অল্পের জন্যে রেহাই দিয়েছে।অন্ধকারের জন্যে বেঁচে গেল,তবে এখন ওই জানোয়ারটা আবার বলে দিবে নাতো?সে ভেবেই অশ্রু অরুনের মুখ পানে তাকায়।অরুনের কপালে চার ভাঁজের ব্যান্ডেজ।তার ফুপী,মামী,দাদী, আংকেল পাশে ঠাই অম্লান মুখ করে দাড়িয়ে আছে।মুখ এক ছিটে ফোটাও কথা নেই।এরই অপোজিটে তোহিয়া রাণী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে একাকার।কে করেছে এসব তার অরুন আব্বুটার সাথে!কে এতটা নিষ্ঠুরতা করলো তার নিষ্পাপ ছেলেটার সাথে। আর বামকোণর সোফায় মিষ্টার ভুট্টো পোদ্দার গাল ফুলিয়ে বসে আছেন।নিজের দাম্ভিকতাকে বহাল রেখেই কড়া গলায় বলতেছেন”সাহস তো কম নয়!পোদ্দার বাড়ি এসে পোদ্দার ছেলেকেই মারে!কোন বাঘের বাচ্চা এ! এই আমি ভুট্টো তাদেখে নিব!দেখবো এর বুকফাটা তেজ কেমন।বুকটা ছিঁড়ে বৃক্কটা নিয়ে আসবো!”

রশিদ বলে,
“এতশত না বলে অরুন একবার অপরাধীর নামটা বলে দিলেইতো হয়।কারণ,সে তো অপরাধীকে দেখেছে।তাই -না অরুন?”অরুনের দিকে তাকিয়ে।
অরুন রশিদের কথায় সেদিকে দৃষ্টিপাত করে নড়েচড়ে বসে।গলা খেঁচকি টানে যেন সে বলে দিবে।আর অশ্রু সেদিকে একফালি নজর দিতেই অরুনের চোখাচোখি হয়ে যায়।রশিদের কথায় অরুন একবার রশিদের দিকে তাকিয়েই অশ্রুর দিকে দৃষ্টি এঁটে।কেউ না জানুক,অরুন নিজেইতো জানে তার অপরাধী কে?কে তার কপাল ফাটা করেছে!অরুন অশ্রুর থেকে স্বাভাবিকভাবে সরিয়ে সশরীরে বলে,
“আমি বলতে পারছি না ঠিক একাজটা কে করেছে।”
“কেন?”
“আবছা অন্ধকারে তোমরা যেমন অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারোনি তেমনি আমিও।”
বেঁচে যায় অশ্রু।তবে অরুনকে মনে মনে ধন্যবাদ দিতে তার মোটেও ইচ্ছে হয় না।কারণ তারমতে অরুন ক্ষমার যোগ্য না।
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-২২
রোকসানা আক্তার

“তোকে অনেক হতাশাগ্রস্ত এবং অস্থির মতির লাগছে। হঠাৎ বাড়িতে যাওয়ার এত উদগ্রীব……
সম্পূর্ণ কথা শেষ না করে মুখটা মলীন করে অশ্রুর কাঁধ চেপে ধরে রুমকি।অশ্রুর মাথাটা তার বরাবর নিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে।আবার বলে,
তোর কিছু হয়েছে অশ্রু?”
অশ্রু ঘোর ঘোর চোখে রুমকির দিকে তাকায়। অশ্রুর চোখ জোড়া টলমল করে উঠে।রুমকির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেনি।খিঁচে আসে মনের ল্যাচমা আর গলার ধেঁয়ে আসা হেঁচকি।হেঁচকাতে হেঁচকাতে এক প্রকারে কেঁদেই ফেলে অশ্রু।রুমকি টাল সামলাতে না পেরে দু’হাতে অশ্রুর গাল শক্ত করে চেপে ধরে।বলে,
“ক-কি হয়েছে অশ্রু?বলছিস না কেন আমায়?প্লিজ বল কি হয়েছে!”
“রুমকি–রে!”
“ব-বল!”
“বাবা অনেক বড় বিপাকে আছে। বাসায় দলবেঁধে পুলিশের আনাগোনা।এই সপ্তাহের মধ্যেই নাকি বাবাকে আদালতে হাজির করাবে আইন।”চাপা কান্নায় বলে।

অশ্রুর কথায় রুমকি আকাশ থেকে পড়ল।মুহূর্তে তান্ডব এক বজ্রপাত তার মাথার উপর দিয়ে বয়ে গেল।হুটহাট এমন অপ্রীতিকর ঘটনার জন্যে সে আসলেই প্রস্তুত ছিলনা।
“মানে?কিসব বলছিস তুই!”
“হ্যাঁ রে হ্যাঁ।”
“কিন্তু কেন?”
“যুগান্তর পত্রিকার অফিস থেকে একটা মিথ্যে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।এর পেছনে নাকি বাবারই হাত আছে ভেবেই অফিসের সবাই বাবাকে সন্দেহ করছে।।শুধু তাই নয়।বাবা নাকি টাকার লোভে এসব করেছে।”
বলেই কান্নার একটা ফুঁপানি তুলে।
অশ্রুর কথায় অজান্তেই রুমকির মুখের উপর হাত চলে আসে।কি ভেবে কি বলবে সে নিজেই ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।দুঃশ্চিন্তায় তার মসৃণ কপালটার ঘন স্তর পড়ে।থ মেরে ধপসে বিছানার উপর বসে পড়ে।তার ক্লান্তি চোখগুলো একদিকে নিবিদ্ধ।অশ্রু নির্লিপ্তে চোখের জল ফেলতে ফেলতে একাকার।দুজনের মাঝেই কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করে।দরজার ওপাশ থেকে শব্দ আসায় বিভোর রুমকির ধ্যাণ ফিরে।ইমতিয়াজ অধীর আগ্রহে ওপাশ থেকে করাঘাত করে আর ডাকে,
“রুমকি,রুমকি,এই রুমকি?তুমি কি এখানে?”
রুমকির দরজার পাঁতে টানটান চোখ তাকায়।ইমতিয়াজ ডাকছে।হয়তো কোনো অতিথি এসছে নতুন তাকে দেখতে তাই এত অধীরতা ইমতিয়াজের।রুমকি তা বুঝতে পেরেই গম্ভীরতায় আওয়াজ তুলে বলে
“হ্যাঁ এখানে।”
“দ্রুত বাইরে আসো।আমার বাবার বন্ধু এসছেন তোমায় দেখবে।”
“যাবো।জাস্ট দু’মিনিট।”
বলেই রুমকি অশ্রুর দিকে মুখ পাতে। ইমতিয়াজ দাড়িয়ে কিনা, ওটার অপেক্ষা আর না করে।গলার হাক ছেড়ে বলে,
“এজন্যেই এখন বাড়ি যাবি?”
“হ্যাঁ।” মুখটা ফ্লোরে নিবদ্ধ রেখেই অশ্রু জবাব দেয়।
রুমকি চারপাশে চোখ বুলিয়ে সংকোচ বোধ নিয়ে বলে,
“যাওয়াতো খুবই দরকার।তবে বাইরের সবাইকে কি বলে যে বুঝ দিব সেটাই মাথায় আসছে না।”
“তেমন কিছু ভাবা লাগবে না।বলিস আর্জেন্ট বাসা থেকে কল আসছে তাই যেতে হচ্ছে।”
“হ্যাঁ।”ছোট গলায়।
বলেই রুমকি মোবাইলের ডিসপ্লে অন করে।ছ’মিনিট পার হলো অথচ সে ইমতিয়াজকে দু’মিনিটের কথা বলে সময় নিয়েছিল।মোবাইলটা সুইচড অফ করে বিছানা ছেড়ে দাড়িয়ে যায় রুমকি।গলার হাক ছেড়ে অশ্রুকে বলে,
“টেনশন নিস না।আল্লাহকে ডাক। বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করার একমাত্র মালিক উনিই।তাছাড়া, নিজের মনকে শক্ত কর।শক্তমনে ফ্যামিলির পাশে গিয়ে দাড়।তুই নড়বড়ে হলে উনারাই ভেঙ্গে পড়বেন।আর তুই থাক একটু পর আসছি।ইমতিয়াজ ডেকেছে।
অশ্রু মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।রুমকি রুম থেকে বেরিয়ে যায়।রুমকিকে দেখামাত্রই ইমতিয়াজ সোফা থেকে দাড়িয়ে এগিয়ে রুমকির হাত ধরে তার বাবার বন্ধুর সামনে দাঁড় করায়।
“রুমকি,উনি আমার বাবার একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু।তাছাড়া বাবার বিজনেস পার্টনারও বলা যায়।ব্যবসায়িক ঝামেলার কারণে উনি আমাদের বিয়েতে আসতে পারেননি।”
রুমকি ভদ্র লোকটিকে সালাম করে উঠে। ভদ্র লোকটি সোফায় বসে সালাম গ্রহণ করে এবং নিজের পরিচয় দিতে থাকে।



অশ্রু যতবার তার মায়ের মোবাইলে কল করছে ততবারই নাম্বার বন্ধ পাচ্ছে।শুধু তার মায়ের ফোন বন্ধ নয় সাথে বাবার ফোনও বন্ধ পাচ্ছে।হতাশাবঞ্জক অশ্রু কাকে কল করে বাবার অবস্থার কথা জানবে তা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবতে থাকে।হুট করে মনে পড়ে বিপুলের কথা।হ্যাঁ বিপুলতো এখন তাদের বাসায়ই।তাকেই কল করা যায়।বিপুলকে অনেকবার কল করার পরও ফোন উঠায়নি।অশ্রুর চোখেমুখে হতাশার চাপ আরো ধেঁয়ে যায়।বাসার অবস্থা কি খুবই খারাপ?বাবাকে আবার জেলে নিয়ে গেল নাতো?মা কি করে?মা ঠিক আছে তো!?নুজিফা, মামী সবাই কি করে?ভালো আছে সবাই?কেমন সময় পার করছে, মনের অবস্থা কেমন তাদের জানতে বড্ড ইচ্ছে হয়।নাহ এক্ষুনি বাসায় যেতে হবে।মা-বাবা কি করে,কেমন আছে আমায় জানতে হবে।এসব ভাবতে ভাবতেই অশ্রু বিভোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আবারো!মনটাকে কিছুতেই মানাতে পারছে না সে।কিছুক্ষণ কাঁদার পর চোখমুখের পানি মুছে নেয়।নাকঁটা হালকা টেনে আবারো পানি মুছে।তারপর বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে বিছানার উপর রাখা শপিং ব্যাগটির দিকে তাকায়। যে ব্যাগটিতে সে কালরাত লেহেঙ্গা রেখেছ।ব্যাগটি হাতে নিয়ে বাইরে যায়।আশপাশের সবাইকে উপেক্ষা করে রুমকিদের দিকে এগোয়।কাছ বরাবর গিয়েই রুমকিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“রুমকি বাসা থেকে আর্জেন্ট কল এসেছে।বাবা নাকি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।আমায় এক্ষুনি যেতে হবে।”সবার সামনে মিথ্যে রিজন দেখায় যেটা রুমকিও জানে।রুমকি খানিক টুকু ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে ভান হওয়ার চেষ্টা করে।উৎকন্ঠা গলায় বলে,
“কি সত্যি?”অশ্রুর সাথে একযোগে গলা মিলিয়ে।
অশ্রু হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়ে।পাশ থেকে ইমতিয়াজ বলে,
“কখন হয়েছে এরকম?”
“আজ সকাল থেকেই।আমিতো জানি না।কিছুক্ষণ আগে মা আমায় কল করে জানিয়েছেন।”
“আচ্ছা আচ্ছা,তাহলে দেরী করার কোনো দরকার নেইই তাড়াতাড়ি যাও।”
তোহিয়া রাণীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।তিনিও অনেকটা বিচলিত হয়ে মায়া জড়ানো গলায় বলেন,
“আহা,বাবা সে’তো অমূল্য রতন।দেরী করোনা মা।।”
অশ্রু সম্মতি হয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে সদর বরাবর পা বাড়ায়।কিন্তু পেছন থেকে তোহিয়া রাণী থামিয়ে দেয় অশ্রুকে।তোহিয়া রাণি কাউকে ডেকে নিয়ে রহিম ড্রাইভারকে ডাক পাঠান।অশ্রু জিজ্ঞাসূচকে তোহিয়া রাণীর দিকে তাকাতেই তোহিয়া বলে উঠেন,
“এখন বাস/সি.এন.জির জন্যে দাড়িয়ে থাকলে সময় ব্যয় হবে। আমাদের রহিম ড্রাইভার একটানে তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসুক।ঝামেলা সহে যাওয়ার দরকার নেই মা।”
অশ্রু তোহিয়া রাণীর অনুরোধ বাক্যে অশ্রু “না” বলতে পারে নি।অশ্রু ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে।
তোহিয়া রাণী যাকে দিয়ে রহিম ড্রাইভারের ডাক পাঠান সে এসে বলে,
“আম্মা,রহিম চাচা কই যানি গেসে!আমি পুরা বাড়ি খুঁইজা খুঁইজা খা খা পাইনি।”
তোহিয়া রাণী মুখে চিন্তার কিঞ্চিৎ রেখা টানে।কপালে ভাঁজগুলো এক করে চারপাশে তাকায়।অদূরে বসা অরুন এবং অরুনের বন্ধুদের দেখে সেদিকে এগিয়ে যান তোহিয়া।অরুনের বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বলেন,
“তোদের মধ্যে কেউ কি ফ্রী আছিস এখন?”
আবিদ বলে উঠে
“নাহ আন্টি।পাসিং ইন গসিপ। “
“তোকে এত ফ্রী হতে বলিনি।তুই চুপ কর।এই রশিদ তুই ফ্রী আছিস?”
রশিদও দু’পাশে মাথা নাড়ে।অর্থাৎ সে ও ফ্রী না।তোহিয়া রাণী মুখটা বেজার করে ফেলেন।ব্যর্থ মুখে একটা দম ছাড়েন।তা দেখে অরুন বলে,
“খালামণি,কোনো দরকার?”
তোহিয়া রাণী অরুনের দিকে মাথাটা হালকা বেঁকে মুখ ফুলিয়ে মাথা দুলায়।
“কী?”
“রুমকির বান্ধবী অশ্রুর বাবা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।তাই অশ্রুকে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। ভাবলাম মেয়েটা গণ পরিবহনে না গিয়ে একাই গেলে ভালো হতো।তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছাতে পারত।এখনতো কাউকে ফ্রী দেখছি না।এই ড্রাইভার রহিমটা থাকলে কী আর এত ঝামেলা হত!”বিরক্তি চেপে বলেন।
তোহিয়া রাণীর কথায় এবার আদিবের মন আনচান হয়ে উঠে।নেঁতিয়ে পড়া ফুলে ভ্রমর বসতে থাকে।সেই ফুলের মধু আস্বাদনে আদিবের নাচতে ইচ্ছে হয়।ইয়া এইতো একটা চান্স অশ্রুকে মনের কথা খুলে বলা।এতবড় সুযোগ হাতছাড়া করা মানেই বোকামি। ভেবেই অরুন তোহিয়া রাণীকে বলে,
“আন্টি রুমকি ভাবীর বান্ধবীকে আমি পৌঁছে দেব।আমি অনেক ভালো ড্রাইভিং জানি।”
“তুই-না কিছুক্ষণ আগে বললি তুই একদম ব্যস্ত!”
“উফস,আন্টি ওটাতো একটা ফাঙ্ক ছিল।আন্টির সাথে একটু ফাঙ্ক করা যায় না বুঝি?”
“কোনটা ফাঙ্ক আর কোনটা ফাঙ্ক নয় সেটা তোর আমায় শেখাতে হবে না।এই রশিদ তুই যাবি?”
“আমিতো আরো আগে ফ্রী আন্টি।” শার্টের কলার ছড়িয়ে বলে রশিদ।অরুন,আদিব এবং অন্যান্য বন্ধুরা সেদিকে ভ্রু কুঁচকে তাঁকায়।আদিব দাঁতগুলো কটমটিয়ে বলে”তুমিও মনে মনে মনকলা খাইছো মনু!কবে কবে এতদূর এগিয়েছ বাব্বাহ!আমার অশ্রর দিকে চোখ। সে চোখ আমি তোর তুলে নিব শালা!”মনের কথা শেষ করেই আদিব গলার খেঁচকি টানে।তোহিয়া রাণীকে বলে,
“আন্টি,ওতো ভালোভাবে ড্রাইভিং-ই জানে না।”
“কে বলল রে আমি ড্রাইভিং জানি না!সেদিন ই তো আমি ড্রাইভিং করে তোদের ঘুরতে নিয়ে গেলাম।”
“মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে!ভাই কত আর মিথ্যে বলবে..
এতে তর্কাতর্কি হয়ে যায়।তোহিয়া রাণীর বিরক্তি লেগে যায়। এদের দিয়ে অশ্রুকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়।যেখানে যাবে সেখানেই এগুলা তালগোল পাকাবে।এগুলার সবগুলোই আদিখ্যোতার জম।অরুনটার আজ যদি এ অবস্থা না হত তাহলে চোখ বন্ধ করেই অশ্রুকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া যেত।ভেবেই তোহিয়া রাণী মাথাটা একটা ঝাঁকানি দিয়ে অশ্রুর দিকে পা বাড়ান।তোহিয়া রাণীর চলে যাওয়া দেখেই অরুন সোফা ছেড়ে দাড়িয়ে বলে,
“খালামণি শুনো?”
তোহিয়া রাণী পেছনে ফিরেন।বলেন,
“বল।”
“তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“কী!মাথা খারাপ?এ অবস্থায় বাইরে যাবি?তোর বাবা শুনলে আমার এক-পা ভেঙ্গে হাড্ডি-গুড্ডি করে ফেলবে।”
“উফস খালামণি সামান্য একটু ফেটেছে,বেশিতো নয়।এটুকু নিয়ে বেরুলে প্রবলেম হবে না।”
“সেটা তো মানলাম।তবে তোর বাবা মানবে না।”
“বাবা মানে কি মানে না তা পরে দেখা যাবে।আগেতো মেয়েটাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।বাবার জন্যে কত আকুলতায় দাঁড়িয়ে আছে।নিজের সামান্য সমস্যার কথা ভেবে অন্যের বড় বিপদকে উপেক্ষা করাতো ঠিক নয় খালামণি।”
তোহিয়া রাণী অরুনের কথায় কিছক্ষণ ভেবে পরে সম্মতি দিয়ে ফেলেন।অরুন সম্মতি পাওয়া মাত্রই উপর থেকে নিজের গাড়ির চাবি নিয়ে আসে।নিজের গাড়ি করেই অশ্রুকে পৌঁছে দেব।মুখে শিষ বাঁজিয়ে বাঁজিয়ে অশ্রুর কাছে এসে বলে,
“এবার যাওয়া যাক।”
পাশে তোহিয়া রাণী এবং রুমকিও ছিল।তোহিয়া রাণী মিটি হেসে অরুনের সাথে একাগ্রতা করেন।অশ্রু ড্যাবা চোখে একবার সদরের দিকে তাকায়,আরেকবার রুমকির দিকে।বেচারী রুমকি নিরূপায়।অরুন পৌঁছে দেওয়ায় সে যে তোহিয়া রাণীকে নাঁখোশ করবে সে সামর্থ্য টুকুও তার নেই।দম খিঁচে কোনোমতে দাড়িয়ে থাকে।রুমকির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে অশ্রু সবাইকে বিদেয় জানিয়ে সদরের দিকে পা বাড়ায়।হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে এসেই গাড়ির পেছনের দরজা খুলে গোমড়া মুখরে বসে যায়।আর অরুন ড্রাইভিং সিটে বসে লুকিং গ্লাসের দিকে তাঁকিয়ে চুল ঠিক করতে থাকে।অশ্রুর পিত্তি জ্বলে উঠে সেদিকে অশ্রু না তাকালেও আঁচ মনে উপলব্ধি করে।অরুন চুল গোছানো বন্ধ করে অশ্রুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“কোনো রকম সমস্যা হলে বলবে।”
অশ্রু শব্দ না করে অন্যদিকে মাথা মুভ করে ফেলে।
অরুন গাড়ি রান করে।গাড়ি চলতে থাকে।চলার মাঝেই অরুন গাড়িটা থামিয়ে ফেলে।গাড়ি থেমে যাওয়ায় অশ্রু বাইরে চোখ রাখে।নির্দিষ্ট গন্তব্যে গাড়ি না থামায় অবাক এবং ক্রুদ্ধ হয়।জলন্ত পিন্ড নয়নে অরুনের দিকে তাকায়।গাড়িতে এতক্ষণে থাকার পর
এখন মাত্র অরুনের দিকে প্রথম দৃষ্টি দিল।এতক্ষণ চোখদুটো তার নিচের দিকেই ধাবিত ছিল।না সে অরুনের দিকে তাকাল,আর না তাকানোর প্রয়োজন মনে করল।তাকাবেই বা কি করে যে আগুন তার মনে মনে দাউ দাউ করে জ্বলছে ওটা নেভাতে অরুনের সাতপক্ষী উপোসেও খাটবে না।করুণ,নিষ্ঠুর মনকষায় সে নিতান্ত পিষে আছে যার শুধু একটাই প্রতিরোধ তা হলো প্রতিবাদ।শুধুই প্রতিবাদ।এখন শুধু বাসায় গিয়ে বাবার থেকে সবকিছু ভালোভাবে শুনে নিলেই ব্যাস।
অরুন ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
“এখানে গাড়ি থামানোর মানে কি?হ্যাঁ?”
“হিসেব-নিকেশ কষতে হবে।তারপর বাসায় যাবে “ অরুন গাড়ির দিকে পূর্ব দৃষ্টি বজায় রেখেই বলল।
“কিসের হিসেব-নিকেশ আমার কাছে?”
এবার অরুন অশ্রুর দিকে মাথা মুভ করে।স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“নাম্বার ওয়ান-আমার রক্তের হিসেব।নাম্বার টু-ছদ্মবেশে আমার বাসায় ঢুকে আমার সব ফাঁস করার হিসেব।”
“আমার বাবাকে এমন একটা কঠিন পরিস্থিতে ফেলে আপনার বদলা নেওয়ার ক্রোধ এখনো শেষ হয়নি?নাকি শেষ পর্যন্ত আমার ফ্যামিলির জান নিতে পারলেই প্রতিশোধের আগুনটা প্রশমিত হবে।কোনটা!?”
অশ্রুর কথায় অরুন মাথা উঁচিয়ে পিঁচাশ হাসি দিয়ে উঠে।

চলবে..
(আজ এ পর্যন্তই।অনেক বঢ করে ফেললাম।আজ কিন্তু নো অব্জার্ভেশন।)
চলবে…
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here