একটুখানি বিশ্বাস পর্ব ২৩+২৪+২৫

একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-২৩
রোকসানা আক্তার

অরুন পিচাশ হাসি থামিয়ে পেছনে খানিকটুকু বেঁকে।
ঠোঁটের কিঞ্চিৎ অংশ বাঁকিয়ে ঝ্যাঁঝ গলায় বলে,
“আমি তোমার বাবার পরিস্থিতির কথা শুনতে আসিনি। আমার বিরুদ্ধে উসকে যাওয়ার ফয়সালা করতে এসছি।”
অরুনের তেতো কথায় অশ্রু ছলছলে চোখে তার দিকে দৃষ্টিপাত করে।কথাগুলো ছিল বিষম খাওয়ার মতো।আস্ত একটা ঢোক গিলে ছোট একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে অশ্রু।অবিচল চোখে তাকিয়ে থেকেই টপাটপ কথাগুলোর শ্রবণ করে।তবে কিছুটি বলার বাকশক্তিটুকুও থাকে না।অরুন আবারও এক কদম কথা ছুঁড়ে দেয়।
“আমার জেদ,আমার ইগো,আমার অহংকারের উপর কেউ যখন বাম হাত বসাতে আসে,আমি তখন তাকে শকুনের মতো খুবলে খুবলে খেতেও দ্বিধাবোধ করিনা।অথচ, দেখেছ?তোমার কত সাহস,যে-কিনা ছদ্মবেশে আমার বাড়ি ঢুকে আমার উপরই হামলা করে বসেছ।আজ আবার ফুলদানি দিয়ে আমার মাথার রক্ত ঝরিয়েছ।আমার শরীরের রক্তের প্রতিটি বিন্দুকণার অনেক দাম। তোমার বাবার সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ এবং তোমাদের ফ্ল্যাটটা বিক্রি করলেও এর দাম চুকাতে পারবে না।”
নির্লিপ্ত অশ্রু এবার আর চুপ থাকতে পারেনি।মনে চেপে রাখা জেদ মুহূর্তে ছ্যাৎ করে জ্বলে উঠে।সে তাচ্ছিল্যতায় বলে,
“মেয়েদের সাথে রাতের পর রাত কাটিয়ে দিনের বেলায় বাম আঙ্গুল উঁচিয়ে নিজেকে জাহির করার নামই ইগো?
নিজ ক্ষমতা জাহির করে অন্যের আত্মসম্মান হরণ করাই জেদ?অন্যকে মিথ্যে বলে দয়া করাই নিজের অহংকার?কিসের উপর দাড়িয়ে আপনি?শূন্যে নাকি মাটিতে, বলুতো আমায়?
অসাড় অরুন ক্রোধানলে চোখদুটো বুঁজে আনে।নিজের ক্ষমতাকে বিরাজ রেখেই উচ্চকম্পনে বলে উঠে,
” আমার পার্সোনাল লাইফ আমার।কোনটা ভালো,কোনটা মন্দ সেটা আমি বুঝব।এখানে অন্য কাউকে নাক গলাতে মাইনে কেয়ারটেকার রাখি নি আমি!আর তোমার সাহসই বা হলো কি করে, যে অরুন পোদ্দারের প্রেসটিজে প্রশ্ন তুল!এবার তোমার এবং তোমার ফ্যামিলির প্রেসটিজ নিয়ে ভাবো।”
“তাহলে আপনিই?আপনিই আমার বাবাকে ফাঁসিয়েছেন?বলুন?”ভারাক্রান্ত গলায়।
“হ্যাঁ, আমি।” বলেই অরুন কার্পণ্যভাবে হাত দুটো ভাঁজ করে অশ্রুর দিকে পিশাচ চাহনিতে তাকায়।মুহূর্তের মধ্যে অশ্রুর সারা গাঁয়ের লোম খাঁড়া হয়ে যায়।অশ্রুর আজ ভাবতেও খুব ঘৃণা হয় মানুষ ক্ষমতার ধাবমাননায় কতটা নিচে নামতে পারে।এদের কাছে কারো মা-বাবার সম্মানের কোনো মূল্য নেই?এরা নিজের সুখ,নিজের স্বার্থটাকে খুব ভালো করেই আটস্থ করে অন্যের গলায় চুরি বসিয়ে।বাহ বাংলাদেশ! আর তোমরাই এদের পা চাঁটো!অশ্রুর ভাবনাগুলো আবারো টসকে যায় অরুনের আরেকটা নির্দয়তার পরিচয়ে।
“আজ তোমায় চিলেকোঠায় নিয়ে এসেও আমার ফয়সালা শেষ করতে পারিনি।তার আগেই তুমি আমার কপালে ফুলদানি দিয়ে তীব্র আঘাত করে বসলে।সামান্য কিছুটা রক্ত বেরিয়েছে বৈ-কি তবে তাতে আমার প্রবলেম নেই।আমার প্রবলেমটা আসলে…
একদমে বলেই অরুন একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে।এবার হালকা কেশে গলাটা ধারালো করে। ক্ষীণস্বরে প্রসঙ্গ টেনে আবার বলে,
“জীবনটা আমার খ্যাতির সম্ভাষণায়।আর সে খ্যাতি তুমি কেড়ে নিতে চেয়েছিলে।এরজন্যে তোমার প্রতি আমার প্রচন্ড ঘৃণা এবং জেদ জমে আছে। মনটা মুহূর্তে মুহূর্তে বুদবুদ আকারে উতলে উঠে চরম ক্রোধানলে।মাঝে মাঝে এটাও প্লান করি-না তোমায় একেবারে শেষই করে দিব।।তোমায় শেষ করে দিলে আমার মনের দাবানলটা ঠান্ডা হবে।..
খানিকটুকু থেমে,
বরাবরই তোমার সেই স্মিত মুখখানা যতবার চোখের সামনে পড়ে ততবারই কিছুক্ষণের জন্যে দমে যাই।যেদিন মার্কেটে গিয়েছিলে সেদিন তোমার করুণ চেহারার একরাশ আভা আমার মনটাকে খানিকটুকু বিচলিত করে।তুমি যখন ভাইয়ার বউয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলেছিলে ভাবলাম এধরনের মেয়েদের জন্যে আসলেই এই পৃথিবীটা, এদের জন্যেই এই পৃথিবীটা আজও বেঁচে আছে।এদের জন্যেই পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ এত সুন্দর।তোমা মেরে ফেলা আমার এই অসমর্থ ক্রোধটা আসলেই বৃথা।তোমার জায়গায় অন্য মেয়ে হলে এতদিনে কবরে তার হাড্ডি,নাড়িভুড়ি পঁচে গিয়ে দুর্গন্ধ বেরুতো। এখন জাস্ট আমার ছোট্ট একটা আবদার,আই হোপ, তা নিয়ে তোমার কোনো অব্জার্ভেশন থাকবে না।আই মিন বলতে চাচ্ছি তুমি আমার আবদার টুকু রাখবে।”
কথা শেষ করেই অরুন অশ্রুর দিকে তাঁকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে।অশ্রু সেই কৃত্রিম হাসিটুকুর দিকে টগবগিয়ে তাকিয়ে থাকে।অরুনের আবদারের কথাটা তার বেঘোরে। অশ্রুর সাড়াশব্দ না পেয়ে অরুন তূরী বাঁজায়।বলে,
“মিস অশ্রু,তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?”
অশ্রু নড়েচড়ে বসে।মুখে বিষন্নতার আভা চেয়ে যায় তার চোখেমুখে।অরুনের কথা সে ঠিকই শুনতে পেয়েছে তবে কথার ফসলা তুলেনি বা তুলতে অপ্রস্তুত।তার ভাবনা অরুন নামের মানুষটিকে সে যদি কখনো চেনতে না পেত তাহলে তার জীবনটা বৃথাই যেত।কখনো জানতোই পারতো না মিষ্টির আদলেও যে তিক্ততা আছে।যে তিক্ততা ঝাঁঝটা তীব্র গন্ধ ছড়ানোর মতো।অশ্রু টানটানে চোখে অরুনের দিকে তাকায়।তা দেখে অরুন হাসে।অশ্রু বলে,
“আমার বাবার জন্যে আমি সব আবদার রাখতে রাজি।বলুন আপনার কি এমন আবদার/রিকুয়েষ্ট? ”
“রুমডেট।সোজা বাংলায় হলো এক বিছানায় আমার সাথে শুবে।একরাতের জন্যে নিজের সব আমায় বিলিয়ে দিবে।পারবে?”
অভাগা অশ্রু অকূল পাথারে।না তার মুখে কোনো ভাষা,আর না কোনো অগ্রাহ্যতা।অবশেষে সে আজ সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার হলো অরুন তার জেদটা কিসের হাসিলে চুকাতে চায়।”দেহ”নামের দুটি এ অক্ষরে এতদিনে তার প্রবল ঝোঁক ছিল।তা শান দিতেই অশ্রুর সবথেকে দুর্বল পয়েন্টে হাত দিয়ে বসেছে অরুন।।অশ্রুর পৃথিবীটাই তার বাবা।তার বাবার সম্মানটা মাথার ঘাম পায়ে পেলে জুগিয়েছে। আর সেটা খরস্রোতা নদীর মতো ভেসে ভেসে চলে যাবে।তা সে দু’চোখ খুলে দেখবে এবং আফসোস করবে।কীভাবে পারবে সে?সত্যিই সক্ষম হবে?বাবার তাজা দেহটা কোনো এক দেয়ালের কোণে আবদ্ধতা থেকে ঢুকরে ঢুকরে চুপসে যাবে।আর দিনকে দিন নানান ভাবনায় চোখের নিচে গাঢ় কালো ছাপ পড়বে।একা,একাকীত্বতায় বিষন্ন মনে নিজের মনকে হত্যা করবে?পারবে মানুষটি আর বাঁচতে?মনকে হত্যা মানেইতো প্রাণটা চলে যাওয়া।বাবার জন্যে নিজের জীবনটাকে বিসর্জন দিতে মেয়ের একটুখানি আপত্তি!তাহলে বাবা জন্ম দিয়েছে কেন?জন্মের পরই তো লবণ খাইয়ে মেরে ফেলতে পারত।
ভাবনার গোচরে অশ্রুর চোখ বেয়ে টপটপ পানি পড়ে।সেই পানি টুকুর দিকে অরুন স্বাভাবিক নয়নে তাকিয়ে আছে।মেয়েদের কান্নায় অরুনের কী আসে যায়!মেয়েদের দেহতেই তাদের তৃপ্ততা।তাদের হাহাকার চাহিদার তাড়না পূরণ হয়।মেয়েদের চোখের কান্নার কথা ভাবতে গিয়ে নিজের ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখারতো মানে হয়না। অরুন গলায় খচকি টানে।বলে,
“আমি কাঁদতে বলিনি।জাস্ট হ্যাঁ/না উত্তর আশা করছি।”
অরুনের শব্দতায় অশ্রু চোখের কোণের পানি মুছে নেয়।মাথাটাকে নিচের দিকে নুইয়ে ক্ষীণ গলায় বলে,
“আমি বাসায় গিয়ে আপনার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলব!”
অরুন হাসোজ্জল হাসে।বলে,
“ওকে বেশ।মেনে নিলাম।যেদিন তুমি আমার ফ্ল্যাটে আসবে সেদিন তোমার বাবা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হবে।”
বলেই অরুন গাড়ি স্টার্ট করে।গাড়ি চলে তড়িৎ বেগে।অশ্রু নিঃশব্দতায় জানলা দিয়ে বাইরের ঝলমলে রৌদ্দুর প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকে।
একটা জায়গায় এসে গাড়ি স্থির হয়।অশ্রু তাকিয়ে তার বাসার সামনে।সে নিজ মগ্নতায় গাড়ি থেকে নেমে নামে।পেছনের দিকটা ইগনোর করেই বাড়ির দিকে হেঁটে চলে।অরুন পেছনে দাড়িয়ে তার চলে যাওয়া কি দেখছে?নাকি চলে গিয়েছে সেদিকে অশ্রুর মোটেও কর্ণপাত নেই।
অশ্রু বাসার ভেতরে ঢোকে।বসার রুমে বসে নুজিফা টিভি দেখছে।আলাউদ্দিন সোফার কোণায় একমগ্নে বসে আছেন।আর পারুল বেগম কিচেনে।সেখান থেকে খাবারের ঝ্যাঁঝ গন্ধ আসছে।হয়তো তিনি রান্নাবান্না কাজে ব্যস্ত।অশ্রু টিপ পায়ে বাবার সামনে গিয়ে দাড়ায়।মেয়েকে দাড়ানো দেখে আলাউদ্দিনের মেয়ের দিকে তাকান।খানিক টুকু হাসার চেষ্টা করে বলেন,
“তুই চলে আসছিস,মা?”
অশ্রু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।তারপর খুব আলতোভাবে বাবার পাশে বসে। বলে,
“বাবা তোমার কি অবস্থা?”মৃদু শব্দে।
” এইতো।
বলেই আবারো হাসার চেষ্টা করেন।অর্থাৎ ভালো না থাকলেও মেয়ের সামনে এখন ভালো থাকার অভিনয় করছেন।মেয়েকে অভিশংস ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে দিবেন না।তিনি কালরাতই পারুল বেগমকে বলে দিয়েছেন অশ্রু যাতে এসবের কিছুই না জানে।গত মাসে থেকেই মেয়েটি তার ILTS – এ ক্লাস করছে।কত স্বপ্ন সে ফরেনে মাস্টার্স করবে।সেখানে ৬ লাখের মতো যাবে।তিনিও মেয়েকে কথা দিয়েছেন সে ফরেনে মাস্টার্স কম্প্লিট করবে,যত টাকা যায় তা বহন করবেন।এখন যদি শুনে তার বাবার চাকরিটা শেষ তারউপর এমন অপবাদ তাহলে মেয়েটা তার খুব কষ্ট পাবে।তাই এই বিষয়টা মেয়ের কানে কিছুতেই ঘেষতে দিবেন না।
মেয়েকে কথার বাড়ার সুযোগ না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ টেনে আবার বলেন,
“আজই চলে আসলি?আর ক’টা দিন থাকতি।সবার সাথে কিছু সময় কাটাতি।”
“ভালো লাগে না বাবা।তাই চলে আসছি।”
অন্যতা মনে বলেই অশ্রু চারদিকে চোখ বুলায়।মামী এবং বিপুলের অনুপস্থিতি উপাখ্যান করতে পেরে বলে,
“বাবা,মামী এবং বিপুল ভাইয়া কোথায়?উনাদের যে দেখতে পাচ্ছি না?”
“বিপুলেরতো সেমিষ্টার চলে ।ওতো পরিক্ষার সিজনের বন্ধ সময় আমাদের বাড়ি এসছে।কাল ওর ইংরেজি পরিক্ষা।তাই আজ সকালেই কোহিনূর ভাবীকে নিয়ে চট্রগ্রামে রওনা করে।”
“ওহ।
ছোট করে বলে।এরমধ্যে মোবাইলে টুং করে শব্দ হয়।অশ্রু সেদিকে তাকায়।তাকিয়ে একটা মেসেজ আসছে কারো।চেইক করে দেখে অরুনের।অশ্রু অসংযত হয়ে মোবাইল থেকে চোখ সরায়।বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
আচ্ছা থাকো আমি রুমে গেলাম।”




“” খুব শীঘ্রই জানাবে।আই ক্যান্ট ওয়েট ফর লং টাইম।””
মেসেজটি পড়ে অশ্রু নিথর মনে বিছানার উপর বসে।
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-২৪
রোকসানা আক্তার

পুরো বাসা জুড়ে এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।বাসায় চার-চারটে প্রাণীর উপস্থিতিতেও মনে হচ্ছে বাসাটা একটা মরার বাড়ি।আলাউদ্দীন দু’হাত টি-টেবিলে রেখে একমগ্নতায় সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন।উনার চোখদুটো একদিকে স্থবির, যে চোখে কোনো ভাষা নেই আছে একফালি নিরবতার অনুভূতি।কিচেনে পারুল বেগম চুপচাপ বসে বটিতে তরকারি কুটছেন আর দিকে দিকে দেয়ালের জুলন্ত ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছেন।বেলা অনেক হয়েছে।আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে খুব দেরী হয়ে গিয়েছে।সেই ভোরে ফজরের নামাজটা সেড়েই কাহিল মনে বিছানায় পিঠ ঠেকান আর নিমজ্জে চোখ বুঁজে আনেন বিভোর চিন্তায়।আকস্মিক এক ঘটনায় পুরো বাসায় যেন ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে গেল।আর সবকিছু তছনছ করে দিয়ে সুখের বাতিঘরে অন্ধকার নিয়ে এলো।এমন এক পরিস্থিতিতে পড়বেন তা পারুল বেগমের কল্পনার বাহিরে ছিল।ধ্যাণঘোরে পরিবার,সংসার,মেয়েদের পড়াশুনার চিন্তা,স্বামীর চাকরিটা হাত ছাড়া হওয়া এধরনের হাজারো চিন্তায় কখন যে অনেক বেলা পড়ে গেল তা পারুল বেগম খেয়াল করেননি।তাই সকালের নাস্তাটাও আর বানানো হয়নি।আর খুব তাড়া নিয়েই রান্না-বান্নায় হাত লাগিয়েছেন।
তাছাড়া অশ্রুও যে সাথে এসে সাহায্য করবে সে জো টুকু নেই।কাল রাত থেকেই তার প্রচন্ড মাথাব্যথা। এখন বালিশে মাথা ফেলে বিছানায় শুয়ে আছে।দু-দুটো নাপা এক্সট্রা খেয়েছে এবং কপালে মলমও লাগিয়েছে তবুও সাড়ে নি।তাই মেয়েকে বিরক্ত করছেন না।আর নুজিফা সে তো রান্নার ভাঁজই বুঝে না।তাই খামোখা নুজিফাকে ডেকে হয়রানি হওয়ার একদম ইচ্ছে নেই পারুল বেগমের।

কিছু সময় পার হয়।বাসায় কলিং বেল বাঁজার শব্দে আলাউদ্দিন নড়েচড়ে বসেন।তাকিয়ে নুজিফাকে দরজা খুলতে বলেন।নুজিফা রুম থেকে বেরিয়ে তড়িৎ বেগে দরজা খুলে দেয়।ভেতরে একজন এসপি এবং পুলিশ প্রবেশ করে।তাদের দেখে আলাউদ্দিন কিঞ্চিৎ অসংযত হয়ে যায়।মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে বলে,
“আপনারা?”
এসপি মিস্টার অরূপ কুমার দুলে দুলে হেঁটে কাছে এসে বলেন,
“আলাউদ্দিন সাহেব,আমরা আপনার বিরুদ্ধে একটা রিপোর্ট নিয়ে এসছি।রিপোর্টটা কতটুকু সত্য বা কতটুকু মিথ্যে তা জানি না।তবে যথাসম্ভব এটির সত্য উৎঘাটনে চেষ্টায় আছি।আই হোপ,আপনি আমাদের এ ব্যাপারে হ্যাল্প করবেন।”
আলাউদ্দিন কপালের ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভাবেন।ভাবনা শেষে উনাদের বসতে বলেন।দুজন বসেন।আলাউদ্দিন নিজ সিটে বসে খুব সেম্প্যাথিকভাবে বলেন,
“জ্বী বলুন,আমার বিরুদ্ধে কেমন রিপোর্ট আর কি হ্যাল্প করতে পারি?”
“ভুট্টো পোদ্দারকে তো চেনেন,না?”
“কোন ভুট্টো পোদ্দার?”
“দেশের এক নাম্বার বিজন্যাসম্যান এবং বিশ্বের মধ্যে ছ’নাম্বার স্থান অধিকার করে আছেন তার কথা বলছি।” একদমে বলে শেষ করেন মিস্টার অরূপ কুমার।
“জ্বী,চেনতে পারলাম।তো উনার সাথে আমার কি সম্পর্ক? ”
“সম্পর্কটা উনার সাথে নয়।উনার আদলে বাঁধা ছোট ছেলেকে নিয়ে।কয়েক মাস আগে আপনি মিস্টার অরুনকে নিয়ে একটা মিথ্যে রিপোর্ট লিখতে চেয়েছিলেন, রাইট?”
আলাউদ্দিনের কপালের ভাঁজ এবার স্বাভাবিক হয়।এসপি কোন ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলছে তিনি মোটামুটি ক্লিয়ার।বলেন,
“হুম চেয়েছি।তবে, শাসিত এ দেশে সত্যকে তুলে ধরতে ব্যর্থ আমি।কষ্ট শুধু এটাই স্বাধীন দেশে জন্ম গ্রহণ করেও স্বাধীনতা পাইনি!”
“কথার ল্যাঁচমা একটু কমান মিস্টার আলাউদ্দিন সাহেব!এখানে আপনাকে কেউ যুক্তি তুলতে বলেনি।আমার সোঁজা কথা হলো ভুট্টো পোদ্দারের ছেলেদের ব্যাপারটা ভুট্টো পোদ্দার বুঝবেন।সন্তান বড় করেছেন উনি।উনিই ভালো করে জানেন উনার ছেলে ভালো নাকি খারাপ।সেখানে বাবার প্রবলেম না থাকতে দেশের মানুষের প্রবলেম কেন,হ্যাঁ?কী ভাই অন্যকে নিয়ে না মাতামাতি করলে দিন চলে না বুঝি?মানলাম একজন সাংবাদিক হিসেবে কাউকে নিয়ে রিপোর্ট লিখা আপনার অধিকার আছে।তাই বলে ভালো কোনো মানুষকে নিয়ে বাজে কোনো রিপোর্ট লেখা দেশের আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।আর আপনি এর জন্যে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি পাবেন।”
“আমি শাস্তি পেতে যাবো কোন দুঃখে?আমিতো অন্যায় কিছু করিনি!তাছাড়া আগের এবং পরের ঘটনা দুটোই যে আমার উপর…
আলাউদ্দিনকে এসপি আর বলতে দেয়নি।আঙ্গুলে ইশারা করে চুপ থাকতে বলে।একটা রিপোর্ট বের করে উনার সামনে ধরে।বলে,
” এটাতে সাইন করুন!”
“কিসের সাইন?”
“সাইন করতে বলছি সাইন করুন।”
“না জেনে আমি কোনো কিছুতে সাইন করবো না।” ক্রুদ্ধ মনে।
এসপির রাগ উঠে যায়।সড়াৎ করে দাড়িয়ে মুখটা বেঁকে আলাউদ্দিনের দিকে তাকায়। বলে,
“আমি আপনার সাথে খুটুরখাটুর করতে হাতে বেশি সময় নিয়ে আসিনি।সময় খুবই কম।যেটা বলছি সেটা করুন!”
“যদি না করি?”
এসপি বেঁকে হাসি দেয়।হাসি থামিয়ে বলে,
“সোঁজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে না।”
একথায় আলাউদ্দিন সাহেবের ভীষণ রকম বুকের মাঝখানটা ছ্যাৎ করে উঠে এসপির এমন কথায়।এরাও যে ঘুঁষ খেয়ে এক একটা পা চাঁটা কুকুর তা আলাউদ্দিন ঠিকই বুঝতে পারছেন।কিন্তু কিছুই বলার নেইই!এখন প্রতিবাদী হতে গেলেই সে সন্ত্রাসী।এখন সত্য কথা বলতে গেলেই সে মিথ্যাবাদী। টাকার সত্যিই কি অনেক ক্ষমতা যে মুহূর্তে অসীম ক্ষমতাকে জয় করে ফেলে!তাহলে সততা,আদর্শ,মানবতা,মূল্যবোধ,প্রতিবাদী চেতনার কি কোনোই মূল্য নেই?
ভাবতে ভাবতে ঢুকরে উঠে আলাউদ্দিন। এসপি বুঝতে পারছে আলাউদ্দিনকে এত সহজে টলাতে পারবে না।তাই ব্যতিক্রম প্ল্যানিং নিয়ে আবার আসবে।এখন ব্যাঘাত সময় না ব্যয় করে বাসায় গিয়ে একটু আরাম করা যাক।একে পরে আরেকটা চিবুনি দিয়ে টাস টাস করে সাইন করিয়ে নেওয়া যাবে।ভেবেই এসপি আঙ্গুলটা আর একবার নাড়িয়ে বলেন,
“এখনো সময় আছে জনসম্মুখে সব স্বীকার করে নেন আলাউদ্দিন সাহেব।সময় গড়িয়ে গেলে নতি স্বীকারের কোনো মূল্য থাকে না।”
বলেই দপদপ পা পেলে দুজনই বাসা থেকে বেরিয়ে যান।আলাউদ্দিন সং হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন।উনারা চলে যাওয়ার পর-পরই পারুল বেগম কাছে আসেন।আশঙ্কা মিশ্রিত কন্ঠে বলেন,
“উনারা ভুট্টো পোদ্দারের ছেলের কথা কেন বললো?আর ভুট্টো পোদ্দারের ছেলেকে নিয়ে কি রিপোর্ট লিখেছিলে? তাছাড়া কিসেরই বা আবার সাইন?”
“রিপোর্ট লিখতে চেয়েছি।দেশের দস্যুদের জন্যে পারি নি।আর সাইনটা ছিল আমায় মিথ্যে অপবাদে ফাঁসানোর আরেকটা পসরা।ব্যাখ্যার্থে ওই রিপোর্টেরই আলোচ্য বিষয়। ”
“কি রিপোর্ট ছিল ওইটা? ”
“নিচু চোখের মানুষের জন্যে কেমন রিপোর্ট লিখতে হয় তা তুমি জানো না?”
“নিচু চোখ মানে?”
“বুঝিয়ে বলতে হবে?”রাগে আওয়াজ করে বলেন।
” নাহ মানে..ওরা তো সবার চোখে উঁচু প্রকৃতির লোক তাই তারা নিচু চোখের মানুষ ব্যাপারটা…….”
আলাউদ্দিন পারুল বেগমের হযরলব কথা থামিয়ে নিজেই বলে উঠেন,
“নিচু চোখের মানুষ মানে অসভ্য,বদমাশ প্রকৃতির লোক।এবার বুঝতে পেরেছ?”
বলেই আলাউদ্দিন পারুল বেগমকে পাশ কেটে চলে আসেন।পারুল বেগম থ হয়ে সেখানেই দাড়িয়ে থাকেন।
এতক্ষণে অশ্রু দরজার ওপাশ থেকে সবটা শুনতে পায়।নির্লিপ্তে মনের অজান্তে তার চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি বেরিয়ে আসে।এতক্ষণে সবগুলো কথোপকথন যে অরুনকে ঘিরে হয়েছিল তা অশ্রু বেশ বুঝতে পারছে।অরুনকে নিয়ে রিপোর্ট যদি সত্যিই লিখার চেষ্টা করা হয় তাহলে অরুনের জেদটা এখানে নয়তো?হতে পারে।নাহলে সে আলাউদ্দিনকে চেনলো কীভাবে আর এটাও জানলো কীভাবে অশ্রু যে সাংবাদিক আলাউদ্দিনের মেয়ে!হয়তো রিপোর্টই তারও একটা কারণ হতে পারে।আলাউদ্দিন তার কুকর্ম নিয়ে রিপোর্ট লিখার চেষ্টায়রত ছিল বলেই আলাউদ্দিন এবং তার পরিবারকে চোখেচোখে রেখেছে অরুন।
বাবা-মেয়ে দুজন দু’দিক থেকে অরুনে উপর ভেতরগত আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে অশ্রু তা মোটামুটি এখন ক্লিয়ার হলো।
অশ্রু বিষয়টা বুঝতে পেরেই বিষয়টা নিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করে সে।পুরনো প্রতিশোধের সাথে নতুন প্রতিশোধ যোগ-বিয়োগ করতে থাকে। রিপোর্ট লিখার চেষ্টার কারনে সেই প্রতিশোধে তার বাবার চাকরি খেয়েছে আর আদালত অব্দি নিয়ে যেতেও এক পায়ে দাড়িয়ে আছে।অন্যদিকে, অডিও ভাইরালে রুমডেটের অফার করে তাকে দিয়ে এতদিনের ফুঁসে রাখা দাবানল চুকানোর চেষ্টা করছে।আর দেওয়া শর্ত বরখিলাপ করবে মনস্থির করছে।অর্থাৎ তার বাবাকে মুক্তি দিবে না অথচ তাকে ব্যবহার করবে।
ফাঁদটা খুবই কঠিনভাবে পাতছে নাতো অরুন?এধরনের মানুষদের বিশ্বাস সাপে-নেউলে।কেননা এদের সামনের রূপের থেকেও পেছনের রূপটা বিমর্ষ।বাহিরে কমলতা রূপ দেখানোর মাঝেও কালসাপ হয়ে দাড়াতে এদের বেশিক্ষণ সময় লাগে না।।।

অশ্রুর নিরবতা ভাবনার ছেদ ঘটে একটা ফোনকলে।অশ্রু মোবাইলটা হাতে নেয়।অরুন কল করেছে।অশ্রু রিসিভ করতেই অরুন ওপাশ থেকে বলে উঠে,
“কল রিসিভ করতে এত সময় নেওয়া আমার জন্যে বিরক্তিকর।সেকেন্ডবার যেন এরকম না দেখি!”
অশ্রুর ভ্রু কুঁচকে আসে অরুনের এহেন কথায়।অরুন প্রসঙ্গ টেনে আবার বলে,
“আর কল যে কারণে করা– আমি এখন তোমার বান্ধবীর বাসায়।আইমিন ভাইয়ার শ্বশুর বাড়িতে আছি। যদি সম্ভব হয় এখনই চলে এসো।তোমার সাথে আমার আর কিছু কথা কার্টসিট কর বাকি আছে।যদি যাতায়াতের কথা ভাবো তাহলে আমি বলব মিরপুর থেকে ধানমন্ডি বেশি দূরে নয়।ডু ইউ আন্ডার্সটেন্ড?”
“ক-ক-কিন্তু!”
“নো এক্সকিউজ। আমি রাখলাম।একঘন্টার মধ্যে এখানে যেন দেখি বায়।”
বলেই অরুন কলটা কেটে দেয়। অশ্রুর মাথায় যেন একটা বাজ পড়ে।
অধিকার খাটানোর ধমক কত ওর!ও আসলে চায় টা কি আমার থেকে! এমন ভাব করে যেন ওরটা খাই এবং ওরটাই পড়ি।তবে তুমি যাই বলো না কেন মিস্টার অরুন,এই অশ্রু কখনো কাঁচা মাছ খায়না।সে সাগ্রহতা দেখালেও অন্য প্ল্যানিং এ অধীর ব্যাকুল।এই অশ্রুকে বোকা বানানো এত সহজ নয়!ঠিক বাবার মতো।
একটুখানি বিশ্বাস
পর্ব-২৫
রোকসানা আক্তার

অশ্রু হাত ঘড়িতে তাকায়।বেলা এখন এগোরটা বাজে।এ অসময় অরুন রুমকিদের বাসায়। ব্যাপারটায় তার কেমন জানি একটু খটকা খটকা লাগছে।তাছাড়া আজ রুমকির বৌ-ভাত।রুমকিকে ধানমন্ডি নিয়ে আসতে তার ফ্যামিলির সবাই আজ পোদ্দার বাসায় যাবে।আসতে সন্ধে হবে।কিন্তু তার আগেই অরুন এ বাসায়? কারণতো একটা নিশ্চয়ই আছে কিছুক্ষণ ভেবে অশ্রু ব্যাপারটাতে একাগ্রতা হতে পারেনি।তাই ব্যাপারটা ক্লিয়ার হতে সে তড়িঘড়ি রুমকিকে কল করে।দু-তিনবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হয়।রুমকি ব্যস্তমনে ওপাশ থেকে বলে,
“হ্যাঁ অশ্রু বল।”
“তুই এখন কোথায় রুমকি? তোদের বাসায়?”
“নাহ।আমিতো এখন ইমতিয়াজদের বাড়ি।কিছুক্ষণ পর আমার বাড়ির লোকজন আসবেন।তারপর বাড়ি যাবো।কিন্তু কেন?”
“নাহহ এমনি।আচ্ছা রাখি তাহলে।”
“কি ভেবে কল করলি নিজেই কারণ বলতে পারছিস না।আচ্ছা রাখ।”
অশ্রু কল কেটে দেয়।তার কাছে অরুনের মতিগতি ভালো ঠেকছে না।তবে অরুন মিথ্যে কথাটা কেন বলল!আর কি কারণ থাকতে পারে মিথ্যে বলার?কি চায় অরুন!ভেবেই অশ্রু মাথা ঝাঁকায়।মাথাটা তার প্রচন্ড ভার ।এরউপর এমন উদ্ভট পরিস্থিতিতে পড়ে মাথাটা আরো পঞ্চাশ মণ ওজনের হয়ে গেছে।
মনের অস্বস্থিতে অশ্রু বিছানায় সোঁজা হয়ে শুয়ে চোখগুলো কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ করে নেয়।কিছুক্ষণ এভাবে কাঁটার পর হঠাৎ পারুল বেগমের ডাকে চোখ খুলে।পারুল বেগম বিছানার কার্ণিশে বসে অশ্রুর মাথায় রাখেন।মৃদু গলায় বলেন,
“মাথাব্যথা কমেছে তোর?”
মায়ের কথায় অশ্রু বিছানা থেকে উঠে বসে।দু’পাশে মাথা হেলিয়ে না ইঙ্গিত করে।
“ডাইনিং-এ খাবার বেড়ে রেখেছি।খাওয়া শেষ করে বকুলের ফার্মেসীতে যাস।বকুলকে ভালোভাবে সমস্যার কথা বলে ওষুধ নিয়ে আসিস।তাপমাত্রাটাও মেপে নিস একটু।অনেক সময় দেখা যায় শরীরের ভেতরের তাপমাত্রা বাড়ার কারণে মাথাব্যথা হয়।”
“আচ্ছা মা।”
পারুল বেগম মেয়ের কাঁধ চেপে কাপড়ের আঁচল টেনে নিয়ে উঠে দাড়ান।তারপর রুম থেকে চলে যান।পারুল বেগম চলে যাবার পর অশ্রুও ডাইনিং খেতে যায়।খাওয়াদাওয়া শেষ করে রুমে এসেই দেখে অরুনের কল বাঁজছে।অশ্রু মুখে কিঞ্চিৎ রাগ চেপে হাতে মোবাইল নেয়।সবুজ বাটনে টাস করতেই ফোনের ওপাশ থেকে অরুনের ভয়াল কন্ঠ ভেসে আসে।
“কোথায় এখন তুমি?”
“তা শুনে আপনি কি করবেন?”
“কি করবো মানে?কিছুক্ষণ আগে তোমায় কি বলেছি?”
“কই কিছুইতো বলেননি!”
“মিস অশ্রু,ন্যাকামোটা বন্ধ করো বলছি।রাগটা বাড়ায়ও না আমার।”
“আজিব তো,আপনার রাগ দিয়ে আমি কি করব?”
“অশ্রু!?”
সাথে সাথেই অশ্রু কলটা কেটে দেয়।আর ফোনটা বন্ধ করে বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে।তারপর আয়নার সামনে দাড়িয়ে গাঁয়ের চারপাশে ভালোভাবে ওড়না বিঁধে রুম থেকে বের হয়।মাকে বলে বকুলের ফার্মেসীর উদ্দেশ্য রওনা করে।বাসা থেকে বকুলের ফার্মেসীর দূরত্ব ত্রিশ ফিট হবে।হেঁটে যেতে ৫/৬ মিনিট লাগে।বকুল অশ্রুর বাবার বন্ধুর ছেলে।পুরনো পরিচিতিতে অশ্রুর ফ্যামিলির সবাই বকুলের ফার্মেসীর উপরই ডিপেন্ডেড।তাছাড়া,বকুল খুটখাট পড়ালেখা শেষ করেই ফার্মেসীতে বসে নি।প্যারামেডিকেল পড়া সম্পূর্ণ শেষ করেই শখের বসে ফার্মেসী দিয়ে বসেছে।তাই ওষুধপাতির ব্যাপারে অনেক ভালো অভিজ্ঞতা আছে তার।
অশ্রু হাটি হাটি পা ফেলে সামনের দিকে এগুচ্ছে।হুট করে নজর পড়ে রিক্সার দিকে।প্রথম যেদিন অশ্রু প্রেমের প্রপোজাল নিয়ে অরুনের বাড়ি গিয়েছিল এবং বাসায় ব্যাক করার সময় পথিমধ্যে একটি মেয়ের সাথে দেখা। তাছাড়া সে তাকে অরুনের ফাঁদে পা না-রাখার জন্যে বারণ করেছিল সে মেয়েটিই এখন রিক্সায় বসে আছে।অশ্রুর মুখখানা পুলকিত হয়ে উঠে।অশ্রু হাতটা নাড়িয়ে জোরে শব্দ তুলে মেয়েটিকে ডাকতে থাকো।অশ্রুর আওয়াজ মেয়েটির কান অব্দি পৌঁছায়।সে অশ্রুর দিকে তাঁকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা থামাতে বলে।রিক্সাওয়ালা গাড়ি থামালে সে ব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে রিক্সা থেকে নেমে পড়ে। তড়িৎ পায়ে অশ্রুর কাছে এসেই বলে,
“তুমি ওই মেয়েটি না?”
“হু।”
“তোমার সাথে আবার কিছু ঘটলো নাকি?”
“সেরকম চান্স পায়নি।” মুখে হাসি রেখেই বলে অশ্রু।
“গুড!আমি স্মৃতি।”
“আমি অশ্রু।”
“সুন্দর নাম।”
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে স্মৃতি।সময় হবে তোমার?”
স্মৃতি কিছু একটা ভেবে তারপর সম্মতি দেয়।
“নো প্রবলেম।আই হ্যাভ এনাফ টাইম।চলো আমরা ওই গ্রাইন্ড সিটে গিয়ে বসে বসে কথা বলি।”
“চলো।”
অশ্রু এবং স্মৃতি গোলবৃত্ত সিটে গিয়ে বসে।স্মৃতি উৎসুক হয়ে বলে,
“হঠাৎ কি ভেবে আমায় থামালে?জানতে পারি?”
“অরুনের ব্যাপারে তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছি।”
“আবার ওই অরুন!?প্লিজজ ওর কথা বলো না।এই শব্দটাকে আমি ঘৃণা করি!অনেক ঘৃণা করি!”
অশ্রু খুব ভালো করে লক্ষ করলো অরুনের কথা স্মৃতিকে বলাতে তার মুখটা বিমর্ষ হয়ে উঠছে।সাথে চাপা রাগ।অশ্রু স্মৃতির পাশে আরেকটু ঘেঁষে।তার কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলে,
“কিছু হয়েছে তোমার সাথে?”বিশ্বাস করো বলতে পারো আমায়।”
“কি আর বলবো বল!?ও আমার লাইফটাকে হেইল করে দিয়েছে।সমাজে এখনো কিভাবে যে বেঁচে আছি নিজেও জানি না।ওসব কুলাঙ্গার আমার সাথে এরকম ছিট করবে আমি ভাবতেও পারিনি।”বলেই বিভোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে স্মৃতি।”
“কেঁদো না।আমি তোমার সাথে আছি।ওর পতন দেখতে চাও,বলো?”
স্মৃতি চোখ ভেঁজা পানি মুছে অশ্রুর দিকে ফকফক চোখে তাঁকায়।কিছুটা ভরসার নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
“হ্যাঁ দেখতে চাই।আমি অনেক খুশি হবো।তারচেয়েও বেশি খুশি হবে আমার পেটের যে বাচ্চাকে পৃথিবীর মুখ দেখানোর আগেই ওপারে পাঠিয়ে দিল সে।
“বাচ্চা মানে?কার বাচ্চা?”
স্মৃতির চোখের পানি খরস্রোতা নদীর মতো বেয়ে পড়ছে।অশ্রুকে কিছু বলতে যেয়েও পারছে না।হৃদয়ে জমানো অব্যক্ত কথাগুলো গলায় এসেই আঁটকা যায়।অশ্রু স্মৃতির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে বুঝতে আর সমস্যা হয়নি।অশ্রুর এবার আরো বেশি রেগে যায়।অরুনকে আগে যতটা ভালো ভাবতো এবারতো তারচেয়েও বেশি ঘৃণা জন্মাচ্ছে ।প্রচন্ড ঘৃণা,ক্রোধে অশ্রুর দুকান লাল হয়ে উঠে।শক্তমনে স্মৃতির হাত চেপে ধরে।নিজেও বুঝছে না স্মৃতিকে কি থেকে কি বলবে বা কীভাবে স্বান্তনা দেবে।কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিথর মুখে বলে,
“তোমার নাম্বারটা আমায় দাও।যা বলব সব ফোনে।আর আমায় একটু ফার্মেসী যেতে হবে।বেশি দেরী হলে মা আবার টেনশন করবেন।”
“সমস্যা নেই।নাম্বারটা বলছি তুমি উঠাও।”
অশ্রু স্মৃতির থেকে নাম্বার নিয়ে তাকে বিদেয় দেয়।নিস্তব্ধ মনে হেঁটে হেঁটে ফার্মেসী পৌঁছায়।বকুল অশ্রুকে দেখামাত্রই খুশি হয়ে যায়।বলে,
“আরেহ অশ্রু আজ তুই যে এলি আমার ফার্মেসীতে?”
“বাবা অসুস্থ তাই আসতে পারেনি।”
“ওহ”ছোট করে বলে।বকুলের এই ছোট করে বলাটতে তার মুখের অবয়ব প্রকাশ পাচ্ছে সে-ও আলাউদ্দিনের ব্যাপারটা জানে।অশ্রু যদি নিজ থেকে না বলে তাহলে সেও এ ব্যাপারে কথা তুলবে না মনস্থির করে।প্রসঙ্গ টেনে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
“তো দাড়িয়ে ক্যান।বস এখানে।”
“নাহ বসব না ভাইয়া।তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে।”
“আচ্ছা বল কী প্রবলেম নিয়ে আসলি?”
“প্রচন্ড মাথাব্যথা আর বালিশ থেকে মাথা উঠাতেও কষ্ট হয়।”
“ওকে। তারপর….?”
তারপর অশ্রু সমস্যাগুলো এক এক করে বকুলকে বলতে থাকে।বকুল সমস্যাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে অশ্রুকে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়।অশ্রু ওষুধ নিয়ে বাসায় ফেরার পথেই কেউ এসে গাড়ি দিয়ে তার পথ আঁটকায়।অশ্রু হতচকিত হয়ে গাড়ির দিকে চোখ রাখে।ভেতরে অরুন।অরুনকে দেখামাত্রই তার বুকের মাঝখানটা ছ্যাৎ করে উঠে।হম্বিতম্বি অশ্রু অপ্রস্তুত বোধ করে।ইচ্ছে হয় এক লাঁফে একে খুন করে দৌড়ে চলে যেতে।এ মুহূর্তে এই মানুষটার মুখ দেখতে তার মোটেও ইচ্ছে হয় না।যতবার এর মুখের দিকে তাকায় ততবারই স্নায়ুতে নরপিশাচ,কুলাঙ্গারের ধ্বনি স্নায়ুতে টান পড়ে।অশ্রু চোখবুঁজে দৃঢ়ে একটা দম নেয়।অরুন গাড়ি থেকে বেরিয়ে হাতে চাবি নিয়ে ঘুরাতে থাকে।
“পথ আঁটকালেন কেন?”
“তোমায় দেখবো তাই।”
“মানে?”
“কিছু না।তুমি আজ আসো নি কেন?”
“কেন যাবো?”
“তাহলে আমার শর্ত?”
“কিসের শর্ত?”
“ভেঙ্গে বলতে হবে?”
“তোমার কালকের রূপের সাথে আজকের রূপের কোনে মিল নেই।তোমার বাবা আবার তোমার মাথায় কোনো মশলা মাখলো নাতো?”
“স্টপ!প্রতি বারংবার আমার বাবাকে টানা কেন ধরনের বদভ্যাস এটা?”
অশ্রুর কথায় অরুন মুঁচকি হাসে।হাসি থামিয়ে বলে,
“তোমার বাবা খুব চালাক তো তাই বললাম।”
“অন্যায়কারীর অন্যায় দেখার পরও যদি হাততালি দিয়ে বাহবা দিত তাহলে আমার বাবা নিশ্চয়ই আপনার আদরের পরশমণি হত।তাই না?”
অরুন আবারো বেঁকে হাসে।
“একটা মেয়ে এভাবে যে একটা ছেলেকে কুটিয়ে কুটিয়ে কথা শুনাচ্ছে তারপরও তার মাথায় একটু কমনসেন্স থাকা উচিত।এভাবে বেঁকে হেসে হেসে নিজের ওয়েট কমানোর কোনো মানে হয় না।”
এবার অরুনের দম ফাটা হাসি চলে আসে।হাসতে হাসতে গড়গড়ি খাবে তার এমন অবস্থা।এ দেখে অশ্রুরতো নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম।দাড়িয়ে না থেকে অরুনকে পাশ কাটতে গেলেই অরুন দু’হাত দিয়ে আবারো বাঁধা প্রদান করে।
“আবার পথ আঁটকলেন কেন? কি চাই আপনার?”
“তুমি বোধহয় আমার রিকুয়েষ্ট রাখবে না,রাইট?”
অশ্রু চুপ থাকে আর মনের ক্রোধে ফুঁপিয়ে উঠে।মন চায় অরুনের দু’গালে ঠাস ঠাস চারটা চড় বসিয়ে গালটা ফুলিয়ে দিতে।আর মুখে থুতু ছুঁড়ে দিয়ে কুলাঙ্গার, নরপিশাচ, জারজ সম্বোধন করে রুদ্ধ হওয়া দমটাকে মুক্ত করতে।তবে এ মুহূর্তে তা সম্ভব নয়।এখন এসব করা মানেই আরেক ঝাঁক বিপদ কাঁধে নেওয়া।এমনিতেই তো বিপদের শেষ নেই,তারউপর আরেকটা ঝামেলা কাঁধে নেওয়ার মানে হয়না।অশ্রু নিজের ক্ষিপ্র মুডটাকে শান্ত করে।
“আমার বাসায় যেতে হবে।অনেক সময় অতিবাহিত হয়েছে বাইরে এসেছি। মা টেনশন করবেন।”
অরুন অশ্রুর কথায় কেনো জবাব না তুলে সোঁজা তার কথা বলে,
“তুমি তোমার বাবাকে বাঁচাতে চাও তো?”
“নারীর দেহের প্রতি যদি এতই আক্রোশ থাকে।তাহলে পতিতালয়ে যান,সেখানে চমক চমক বেশ্যা মেয়ে পাবেন যে আপনার মনটা ভরিয়ে দেবে।আর অন্য মেয়ের পেছনে এভাবে টো টো করা লাগবে না!”
বলেই অশ্রু আর একমুহূর্তেও না দাড়িয়ে সোঁজা পাশ কেটে চলে আসে।আর অরুন অশ্রুর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।মনের অজান্তে ঠোঁটের কোণে একটা তাচ্ছিল্য হাসি টেনে বলে,
“আমার তোমাকেই প্রয়োজন অশ্রু!শুধুই তোমাকে!”

চলবে…
(“আমার তোমাকেই প্রয়োজন অশ্রু!শুধুই তোমাকে! “কি বুঝলেন এ উক্তিতে?এই উক্তির মধ্যে অরুন অশ্রুর থেকে কি চায়?আর তার বাবাকে কেনইবা এমন করছে??আশা করি গঠনমূলক কমেন্ট করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here