একথোকা কৃষ্ণজোড়া ও তুমি পর্ব -১৩+১৪

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৩
ফুলে সজ্জিত রুমের বিছানায় চুপটি করে বসে আছে প্রাহি।কেমন যেন লাগছে ওর কাছে।এই দিনটার জন্যে কতোকাল ধরে অপেক্ষা করেছে ও।অথচ কাঙ্খিত দিনটা আসতেই মনে মনে ভয় কাজ করছে প্রাহির।অস্থিরতা ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে ওকে।প্রাহি ঘোমটার ভীতর হতেই রুমের চারদিক চোখ বুলালো।খুব সুন্দর করে রুমটা সাজিয়েছে ওরা।চারদিকে ফুল আর ক্যান্ডেল লাইট দিয়ে ভরা।মোহময় পরিবেশ।বারান্দায় যাওয়ার জন্যে স্লাইডিং ডোরটা পুরো খুলে দেওয়া সেখানে সাদা পর্দা টানানো।পর্দাগুলো বাতাসের দাপটে খানিকবাদে উড়ে উড়ে আবার থেমে যাচ্ছে।বাহির থেকে হেমন্ত,হিয়া আর আরাফের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে।ওরা অর্থকে টাকা দেওয়ার জন্যে বলছে।খানিকবাদে চেঁচামেচি থেমে গেলো।খট করে দরজাটা খুলে গেলো।প্রাহির মনে হলো দরজাটা খোলার শব্দে যেন কলিজাটা ছ্যাত করে উঠেছে।ভয়ে গায়ের শাড়িটা খামছে ধরলো সজোড়ে।মাথা ঘুরাচ্ছে অধির চিন্তার কারনে ওর।
এদিকে রুমে ডুকেই সর্বপ্রথম বিছানায় বসে থাকা প্রাহির দিকে নজর গেলো অর্থ’র।যেই অর্থ মেয়েদের ধার কাছেও যেতো না।আর সেই অর্থ না-কি আজ থেকে একটা মেয়ের সাথে একই রুমে সারাজীবন কাটাবে।অদ্ভুত, অদ্ভুত,জীবটা বড্ড অদ্ভূত।অর্থ আস্তে করে প্রাহির পাশে বসলো।প্রাহি হালকা নড়ে উঠলো।অর্থ প্রাহি ঘোমটাটা মাথা থেকে সরিয়ে ফেললো।ঘোমটা সরাতেই প্রাহির মায়াবি মুখটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো অর্থ।মুখে কোন ভারি মেক-আপ নেই।শুধু চোখে গাঢ়ো করে কাজলটানা আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপ্সটিক্লক। এতেই যেন সৌন্দর্যে অর্থ’র চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে।অর্থ নিজের অজান্তেই বলে উঠলো,
‘মাশা-আল্লাহ!’
অর্থ’র এমন ঘোরলাগা কন্ঠস্বর শুনে বুক কেঁপে উঠলো প্রাহির।আঁড়চোখে তাকালো অর্থ’র দিকে।লোকটা এখনো তাকিয়ে আছে ওর দিকে।প্রাহি আস্তে করে এইবার সালাম দিলো।এতে ধ্যান ভাঙ্গে অর্থ’র।অর্থও সালামের জবাব দিলো।অর্থ এইবার প্রাহির হাতে একটা ছোট প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। প্রাহি অবাক হয়ে তাকালো অর্থ’র দিকে।বললো,
‘ এইগুলো কি?’
অর্থ’র গম্ভীর কন্ঠস্বর,
‘ এইগুলো তোমার মোহরানার টাকা। আমি সব পরিষোধ করে দিলাম।এইবার তুমি এইগুলো দিয়ে কি করবে তোমার ব্যাপার।’
প্রাহি মাথা নাড়িয়ে স্বায় জানালো।অর্থ এইবার প্রাহির কপালে হাত দিয়ে দোয়া পড়তে লাগলো।প্রাহি অবাক নয়নে চেয়ে আছে। লোকটাকে সাদা পাঞ্জাবিতে অনেক স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। সুদর্শন এই যুবকটা আজ থেকে ওর স্বামি।ভাবতেই প্রাহির মনের ভীতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। অর্থ দোয়া পড়ে শেষে প্রাহির গায়ে ফুঁ দিয়ে দিলো। ধীর আওয়াজে বললো,
‘ চলো ওজু করে আসি।নফল নামাজ পরে আল্লাহ্’র কাছে আমাদের নতুন জীবনটা যেন সুখের হয় সেই দোয়া করি।’
‘ হুম চলুন।’
প্রাহি আর অর্থ দুজন ওজু করে নামাজ পড়ে নিলো।নামাজ শেষে অর্থ বললো,
‘ বারান্দায় যাবে?’
‘ হুম চলুন!’
বারান্দায় গিয়ে অর্থ দোলনায় বসে পড়লো,তারপর প্রাহিকেও বসতে বললো।প্রাহি বসতেই অর্থ বলে উঠে,
‘ গান শুনবে?’
প্রাহির অবাক কন্ঠ শোনা গেলো,
‘ আপনি গান গাইবেন?’
অর্থ চারদিকে নজর বুলিয়ে ভ্রু-কুচকে প্রাহির দিক তাকিয়ে বলে,
‘ এখানে তো আমি ছাড়া আর কাউকে দেখছি না।তাহলে নিশ্চয়ই আমি শোনাবো।’
প্রাহি ফিঁক করে হেসে দিলো।অর্থ প্রানভরে সেই হাসি দেখলো।আজ আকাশে মস্তো বড় একটা চাঁদ উঠেছে।চাঁদের আলো যেন প্রাহিকে মায়াময়ী করে তুলেছে।নীল আর সাদার সংমিশ্রনে শাড়ি পরেছে প্রাহি।মেয়েটা শাড়ি পরলে অর্থ’র যেন হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়।এইযে মেয়েটা হাসছে।এইটা তো রিতিমতো অপরাধ একটা।এইভাবে নিজের হাসি দিয়ে যে মেয়েটা সামনের ব্যাক্তিটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে তা তো মেয়েটা জানলই নাহ।অর্থ প্রাহির দিক তাকিয়েই গান গেলো,

🦋♪♪♪`তোমার চোখে আকাশ আমার চাঁদ উজাড় পূর্ণিমা
ভেতর থেকে বলছে হৃদয় তুমি আমার প্রিয়তমা
তোমার চোখে আকাশ আমার চাঁদ উজাড় পূর্ণিমা
ভেতর থেকে বলছে হৃদয় তুমি আমার প্রিয়তমা

পথের শুরু থেকে শেষে যাবো তোমায় ভালোবেসে
বুকে আছে তোমার জন্য অনেক কথা জমা

তোমার চোখে আকাশ আমার চাঁদ উজাড় পূর্ণিমা
ভেতর থেকে বলছে হৃদয় তুমি আমার প্রিয়তমা
তোমার চোখে আকাশ আমার চাঁদ উজাড় পূর্ণিমা
ভেতর থেকে বলছে হৃদয় তুমি আমার প্রিয়তমা`♪♪♪🦋
(পুরোটা নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন)

গান শেষে অর্থ তাকিয়ে দেখে প্রাহি ওর কাঁধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পরেছে।মুঁচকি হাসলো অর্থ।প্রাহিকে কোলে নিয়ে বিছানায় এনে সুইয়ে দিলো।নিজেও অন্যপাশে সুয়ে তারপর প্রাহিকে বুকে টেনে নিলো।প্রাহির কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে অর্থ বললো,
‘ জানিনা।কেন আমি তোমাকে এতোটা চাই।আমার হৃদয়ে তুমি এমনভাবে গেঁধে গিয়েছো যে এখন চাইলেও আমি তোমাকে ছাড়া থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নাহ।এই ক’টা দিন আমি প্রচন্ড অস্থিরতায় পার করেছি।আজ আমি আমার কাঙ্খিত চাওয়া পেয়ে গিয়েছি।আজ আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাবো।’
প্রাহির গালে আলতো করে চুমু খেয়ে প্রাহিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো অর্থ।
_____________
ভোর সকাল।পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যাচ্ছে।বাতাসে ফুলের ঘ্রান।স্নিগ্ধময়ী পরিবেশ।আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো প্রাহি।চোখ খুলতেই নিজেকে অর্থ’র বুকে আবিষ্কার করলো।লজ্জায় গালজোড়া লাল হয়ে গেলো।ইসস, সে কিনা এই লোকটার বুকে ঘুমিয়েছে সারারাত।আর লোকটাও কি সুন্দর ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে।কি সুন্দর নিষ্পাপ দেখাচ্ছে লোকটাকে ঘুমন্ত অবস্থায়।প্রাহি আলতো হাতে অর্থ’র কপাল,গাল,নাক ছুঁয়ে দিলো।ঠোঁট জোড়া ছুঁতে গিয়েও ছুঁলো না।কেমন যেন লজ্জা লাগছে প্রাহির।প্রাহি অর্থ’র হাতজোড়া সরিয়ে উঠে যেতে নিতেই।প্রাহিকে হেঁচকা টানে নিজের বুকের উপর ফেলে দেয় অর্থ।প্রাহি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।প্রাহিকে আরো অবাক করে দিয়ে অর্থ দুষ্টু হেঁসে বললো,
‘ আমার সব জায়গা ছুঁয়ে দিলে নিজের কোমল হাতজোড়া দিয়ে।তাহলে (নিজের ঠোঁট দেখিয়ে) এইখানে কি দোষ করলো?’
প্রাহি অর্থ’র কথা শুনে লজ্জায় চোখ নামিয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো।আর অর্থ মুঁচকি হেসে হুট করে ওর গালে একটা চুমু দিয়ে দিলো।প্রাহি সাথে সাথে চমকে উঠে নিজের গালের সেখানে হাত দিলো।কি করলো এটা অর্থ?অর্থ ওকে কিস করলো?সারাশরীর কেঁপে উঠলো প্রাহির।জায়গাটায় এখনো ভেজা ভেজা আবেশ লেপ্টে আছে মনে হচ্ছে।প্রাহিকে এইভাবে চমকে তাকাতে দেখে অর্থ নিজের ঠোঁট কামড়ে হাসলো।বললো,
‘ এইভাবে অবাক হওয়ার কিছু নেই।এইটা নিয়ে তিনটা কিস করে ফেলেছি আমি ওলরেডি।’
প্রাহি ঝটকার পর ঝটকা খাচ্ছে।তুতলিয়ে বললো,
‘ মা…মানে?’
অর্থ’র কন্ঠ গম্ভীর শোনালো,
‘ মানে সিম্পল। কাল তুমি আমার গান শুনতে শুনতে আমার কাঁধেই ঘুমিয়ে পরেছিলে।আমিও সেই সুযোগে তোমার গালে আর কপালে চুমু খেয়ে নিয়েছি। হলো না দুটো?আর এখন একটা খেলাম।মোট তিনটা।’
‘ আপনি আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে চুমু খেয়েছেন?’
অর্থ প্রাহির দিকে ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে বললো,
‘ এইভাবে অবাক হওয়ার কিছু হয়নি।তুমি আমার বউ।এই সামান্য তিনটা চুমু তো কিছুই না আমি চাইলে আরো অনেক কিছু করতে পারি।সেই অধিকার আমার আছে।’
অর্থ’র কথায় প্রাহি শুকনো ঢোক গিললো।অর্থ এইবার প্রাহিকে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে ওর কানে ফিসফিস করে বললো,
‘ কিন্তু আমি করবো না।কারন আমি চাই আমার বউ নিজ ইচ্ছায় আমার কাছে আসুক।সে যতোদিন না চাইবে আমি তাকে কোনদিন জোড় করবো না।তবে মাঝে মাঝে ছোট ছোট দু একটা চুমু খেতে পারি।সাথে বউও আমাকে দু একটা চুমু রিটার্ন গিফট হিসেবেও দিতেই পারে।এতে কোন সমস্যা নেই।’
কথাগুলো শেষ করে অর্থ তাকালো প্রাহির দিকে।মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে আছে।প্রাহির ঠোঁটের কোণের মুঁচকি হাসিটাও চোখ এড়ায় না অর্থ’র।সাথে সাথে ওর নিজেও হেসে দেয়।অর্থ প্রাহিকে সরিয়ে উঠে বসলো।প্রাহি হকচকিয়ে তাকালো অর্থ’র দিক।অর্থ হুট করে প্রাহিকে কোলে তুলে নিলো।প্রাহি নিজেকে সামলাতে অর্থ’র গলা জড়িয়ে ধরলো।প্রাহি অবাক হয়ে বলে,
‘ কি করছেন এইগুলো?’
অর্থ তার দৃষ্টি সামনের দিকে রেখেই জবাব দেয়,
‘ কিছুনা।বউকে কোলে তুলেছি।আর হ্যা শুনে রাখো আজ থেকে প্রতিদিন এইভাবেই তোমাকে আমার কোলে চড়ে ওয়াশরুমে যেতে হবে।আনরা দুজন একসাথে ফ্রেস হবো প্রতিদিন।’
প্রাহি হাসলো।মাথা ঝাকিয়ে বললো,
‘ আচ্ছা!’
অর্থ আর প্রাহি দুজন একসাথে ফ্রেস হয়ে নিলো।প্রাহি এইবার অর্থকে বললো,
‘ এইবার আপনি বের হোন আমি শাড়ি চেঞ্জ করবো।’
‘ আচ্ছা ঠিকাছে।কিন্তু তুমি তো শাড়ি আনোনি।’
প্রাহি জিভ কাটলো,
‘ ইসস। আপনিই তো কোলে করে নিয়ে আসলেন।আচ্ছা আপনি বাহিরে যান আমি নিয়ে আসছি।’
অর্থ প্রাহিকে থামিয়ে দিলো।বলে,
‘ তার দরকার নেই।আমি তোমাকে শাড়ি দিচ্ছি সেটাই পরবে তুমি।’
অর্থ বেড়িয়ে গেলো। প্রাহি মনে মনে ব্লাস হতে লাগলো।কিছুক্ষন পর অর্থ প্রাহিকে একটা লাল টকটকে মখমলে কাপড়ের শাড়ি দিলো।প্রাহিও সেটা নিয়ে সুন্দরভাবে পরে বের হয়ে আসলো।প্রাহি বের হতেই অর্থ মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো প্রাহিকে।লাল শাড়িতে যেন মেয়েটাকে কোন ফুটন্ত লাল গোলাপ লাগছে।অর্থকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসলো প্রাহি।আস্তে করে বলে,
‘ এইভাবেই তাকিয়ে থাকবেন নাকি নিচেও যাবেন?’
অর্থ সম্ভীত ফিরে পায়।মাথা চুলকে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
‘ এখনো না।এক মিনিট দারাও।কাল রাতে আমি তোমাকে উপহার দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।সেটা এখন দিয়ে নেই।’
অর্থ ড্র‍য়ার খুলে উপহার খুজতে লাগলো।এইফাকে প্রাহি গিয়ে নিজের চুল আচড়ে নিলো,মুখে ক্রিম লাগালো,চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপ্সটিক দিলো।হঠাৎ প্রাহি ঘারে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠলো।হাত থেকে কাজলটা পরে গেলো ঠাস করে।সারাশরীর শিরশির করে উঠলো।নিভু নিভু চোখে আয়নায় তাকায় প্রাহি ।অর্থ যত্নসহকারে প্রাহির চুলগুলো একসাইডে নিয়ে প্রাহির গলায় একটা ডায়মন্ডের লকেট পড়িয়ে দিচ্ছে।প্রাহি তাকিয়েই আছে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে দুজনকে একসাথে।প্রাহি মনে মনে আল্লাহ্’র কাছে প্রার্থনা করলো।ওরা যেন সারাজীবন এইভাবেই একে-অপররের সাথে থাকতে পারে।
#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৪
এর মাঝে কেটে গেছে তিনদিন।এই দিনে অর্থ আর প্রাহির সম্পর্ক আরো একটু স্বাভাবিক হয়েছে।প্রাহি এখন টুকটাক কথা নিজ ইচ্ছাতেই বলতে আসে অর্থ’র সাথে।এমনিতেও তো ও চায় সারাদিন অর্থ’র সাথে কথা বলতে কিন্তু কেমন যেন একটু লজ্জা আর ভয় কাজ করে ওর মাঝে।তবে অর্থ’র ওর প্রতি এতোটা কেয়ারিং ব্যাবহার দেখে আস্ত আস্তে অনেকটা ভয় কেটে গিয়েছে ওর।অর্থ কাল রাতে প্রাহিকে বলেছে কাল থেকে যেন ভার্সিটি যায়।কারন ফাইনাল ইয়ারের এক্সামের আর মাত্র পাঁচমাস বাকি আছে।তাই ভার্সিটি ক্লাসগুলো যেন ও ঠিকঠাকভাবে এটেন্ড করে। তাই আজ সকালে রেডি হয়েই সবার সাথে নাস্তা করতে বসেছে।নাস্তা খেতে খেতে হিয়াজ শিকদার ছেলেকে প্রশ্ন করলো,
‘ তা অর্থ কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?এখনি রিসিপশনের আয়োজন করে তোদের বিয়ের এনাউন্সমেন্ট করে দিবি?না-কি আরো পরে?’
অর্থ খাওয়া থামিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
‘ নাহ বাবা এখন না।প্রাহির ফাইনাল ইয়ারের এক্সামটা শেষ হোক।তারপর রিসিপশন পার্টি রাখা হবে।’
ছেলের কথায় সহমত জানালেন হিয়াজ শিকদার বললেন,
‘ আচ্ছা তুই যা ভালো মনে করিস।’
অর্থ খাওয়া শেষে উঠে হাত ধুয়ে নিলো।তারপর প্রাহিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ প্রাহি তোমার খাওয়া শেষ হলে এসো।আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি।’
হেমন্ত চোখ ছোট ছোট করে তাকালো অর্থ’র দিকে।বলে,
‘ আমাকে তো জীবনেও এইভাবে বলো নি ভাই।যে আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি তুই আয় হেমন্ত তোকে ভার্সিটি দিয়ে আসবো।প্রাহিকে তো ঠিকই বলছো।’
অর্থ রাগি চোখে তাকালো হেমন্ত’র দিকে বললো,
‘ আমি দেশে থেকেছেই বা ক’দিন হ্যা?আর তুই তো সেই ক্লাস টেন থেকেই বাইক চালাস।বাইকে করেই কলেজ,ভার্সিটি তুই যাওয়া আসা করিস।আর হ্যা প্রাহিকে বলছি কারন ও আমার বউ। আর বউয়ের সব কিছুতে খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব। ‘
অর্থ হনহনিয়ে চলে গেলো কথাগুলো বলে।এদিকে প্রাহি লজ্জায় লাল হয়ে রইলো।হেমন্ত নানানভাবে প্রাহিকে ইশারায় আরো লজ্জা দিচ্ছে।প্রাহিও উঠে হাত ধুয়ে এসে ব্যাগ নিয়ে ছুটলো ওর পিছনে।হেমন্ত’ও গেলো ওর পিছন পিছন।কিন্তু প্রাহি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে আসতেই থমকে গেলো ও।পিছন পিছন হেমন্ত’ও চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। হিয়া আর আরাফ ঝগরা করতে করতে বাহিরে আসছিলো।প্রাহি আর হেমন্তকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওরাও ভ্রু-কুচকে সামনে দৃষ্টি ফেলতেই ওরাই হা করে তাকিয়ে রইলো।আরাফ অবাক হয়ে বলে,
‘ এই শাকচুন্নি এইখানে আসলো কিভাবে?এটাকে তো অর্থ আটকানোর জন্যে কতোকিছু করলো।তারপরেও এটা এখানে এসে টপকে পরেছে।আজ তো এর খেল খতম।আজ আমিও একে বাঁচাতে পারবো না।’
হিয়া চোখ বড় বড় তাকিয়ে থেকেই আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ এটা আপনার ওই কাজিন ইলফা না?’
আরাফ করূন চোখে তাকালো হিয়ার দিকে। তারপর হ্যাসূচক মাথা নাড়ালো।হিয়া রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আরাফের দিকে।আরাফ আরো করূন চাহনী দিলো।হিয়া ভেংচি কেটে সামনে এগিয়ে গেলো।
এদিকে প্রাহি বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে অর্থ আর ওকে জড়িয়ে ধরে ইলফার দিকে।অর্থকে এইভাবে একটা মেয়ে জড়িয়ে ধরে আছে দেখে প্রাহির বুকের ভীতরটা কেমন যেন করছে।মাথাটা ঘুরছে।চোখজোড়া ছলছল করছে।অর্থ’র পাশে ও কাউকে সহ্য করতে পারেনা।একদম না।আর এই মেয়েটাই বা কে?কেন অর্থকে এইভাবে জড়িয়ে ধরে আছে।প্রাহি মৃদ্যু চিৎকার করে বলে,
‘ এইগুলো কি হচ্ছে এখানে?’
অর্থ প্রাহির কন্ঠস্বর শুনে সেদিকে তাকালো।দেখে প্রাহি ওর দিকে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।প্রাহি কান্নারত লাল হয়ে যাওয়া ছলছল চোখজোড়াও ওর নজর এড়ায় না।অর্থ তাড়াতাড়ি ছিটকে ইলফাকে সরিয়ে দেয়।তারপর কষিয়ে এক থাপ্পর মারে ইলফাকে।ইলফা পড়ে যেতে নিতেই আরাফ ওকে ধরে ফেলে।অর্থ দ্রুততম পায়ে প্রাহির দিকে এগিয়ে এসে ওর গালে হাত রাখলো।অস্থির কন্ঠে বলে,
‘ প্রাহি তুমি যা ভাবিছো এমনটা কিছুই না।আমি ওই মেয়েকে জড়িয়ে ধরেনি।বিশ্বাস করো।’
প্রাহি এখনো সেই একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্থ।অর্থ প্রাহির এরূপ দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে।রাগি চোখে তাকালো ইলফার দিকে।তারপর তেড়ে গিয়ে বলে,
‘ এই হেভ বিন টোল্ড আ হ্যান্ড্রেড টাইমস টু স্টে এওয়ে ফ্রোম মি।দ্যান হুয়ায় ডু ইউ কাম টু মি এগেইন এন্ড এগেইন। ইউ ডু নট হেভ দ্যা লাভ ওফ ইউর লাইফ?’
ইলফা গালে হাত রেখেই দাঁত খিচিয়ে বলে,
‘ না নেই। কজ আই লাভ ইউ।’
অচেনা মেয়েটার মুখে অর্থ’র উদ্দেশ্যে বলা ভালোবাসি কথাটা শুনে দুনিয়া ঘুরে উঠলো প্রাহির।কান্নাগুলো উগলে বেড়িয়ে আসতে চাইছে।তাও নিজেকে সামলে নিয়ে ভরাট কন্ঠে হেমন্ত’কে বলল,
‘ হেমন্ত আমার এইসব নাটক দেখতে ভালো লাগছে না।আমাকে তোর সাথে ভার্সিটি নিয়ে চল প্লিজ।’
হেমন্ত আমতা আমতা করে বলে,
‘ কিন্তু ভাইয়া।’
প্রাহির চোখ ভরে এলো।ক্রোদন কন্ঠে বলে,
‘ প্লিজ হেমন্ত!’
হেমন্ত রাজি হলো।অর্থ দেখার আগেই প্রাহিকে নিয়ে বাইকে উঠে শা করে চলে গেলো।এদিকে বাইকের আওয়াজ পেয়ে অর্থ ভড়কে গেলো।চারদিকে তাকিয়ে দেখে প্রাহি নেই।অর্থ বুঝলো প্রাহি কষ্ট পেয়ে হেমন্ত’র সাথে চলে গিয়েছে।অর্থ’র রাগ যেন এতে দ্বিগুন বেরে গেলো। কষিয়ে আরেকটা চড় মারলো ইলফার গালে। রাগে চিৎকার করে বলে,
‘ আজ যদি তোর কারনে প্রাহির সাথে আমার কোন ভুল বুঝাবুঝি হয়।ছাড়বো না তোকে।ভুলে যাবো তুই আমার বেষ্টফ্রেন্ডের কাজিন।’
আরাফ এগিয়ে এসে বলে,
‘ তুই আর হাইপার হবি না প্লিজ।আমি ইলফাকে নিয়ে আজই বাড়ি চলে যাচ্ছি।তুই প্রাহিকে সামলা।’
অর্থ রাগে ফুসতে ফুসতে বলে,
‘ তুই কেন যাবি?তুই আমার সাথে এই বাড়িতেই থাকবি।একে বল চলে যেতে।’
আরাফ করূন গলায় বলে,
‘ তুই তো জানিসই আমারও কোন ইচ্ছে নেই সেই বাড়িতে যাওয়ার।বাবা তো কোরিয়া থেকে একশোবার ফোন করে বলছে বাড়িতে গিয়ে যেন ওনার ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের সাথে দেখা করতে কিন্তু তুই তো জানিস আমার সেখানে যাওয়ার বিন্দুমাত্র মন নেই।আমি শুধু ওকে দিয়ে এসে পরবো।প্লিজ রাগিস নাহ।’
অর্থ একটু শান্ত হলো।গম্ভীর কন্ঠে বলে,
‘ হুম।জলদি এসে পরিস কিন্তু।’
‘ আচ্ছা।’
অর্থ গাড়ি নিয়ে চলে গেলো।না জানি প্রাহি কি ভাবছে ওকে নিয়ে।মেয়েটা এইভাবে ভুল বুঝে চলে গেলো।একবার তো কথাটাও শুনে যাবে।না তা করবে কেন?সে দিব্বি চলে গেলো হেমন্ত’র সাথে।ওই হেমন্তকেও দেখে নিবে অর্থ।
———-
অর্থ যেতেই আরাফ ইলফাকে বলে,
‘ আর কতো ছোট করবি আমাকে তুই অর্থ’র কাছে।আমি বার বার অর্থ’র কাছে ছোট হয়ে যাবি শুধুমাত্র তোর এই ছ্যাছড়া বিহেইভ এর কারনে।’
ইলফা ন্যাকা কান্না করে বলে,
‘ ভাইয়া! তুমি আমাকে এটা বলতে পারলে?তুমি তো জানো আমি অর্থকে ভালোবাসি।’
আরাফ ধমকে উঠলো,
‘ জাস্ট সাট-আপ।আমি ভালো করেই জানি।তুই অর্থ ভালোবাসিস নাকি বাসিস না।আমাকে রাগাবি না ইলফা।নাহলে অর্থ’র দেওয়া দুটো চড় তো কিছুই না।আমি তোকে আরো দশটা চড় মারবো।’
ইলফার একরোখা কন্ঠে,
‘ নাহ,আমি যাবো না।অর্থকে বলতে হবে।কেন ও আমাকে ভালোবাসতে পারবে নাহ?’
আরাফ রাগি গলায় বলে,
‘ সেটা জিজ্ঞেস করে লাভ নেই।কারন অর্থ ম্যারিড।’
ইলফার মাথায় যেন বাঁজ পরলো।অবাক হয়ে বলে,
‘ মানে কি বলছো এসব?তুমি মিথ্যে বলছো ভাইয়া!’
‘ আমি কোন মিথ্যে বলছি না।আজ চারদিন হয়েছে অর্থ বিয়ে করেছে।আর একটু আগে ও অস্থির হয়ে যেই মেয়েটার কাছে বারবার যাচ্ছিলো।সেই মেয়েটাই ওর বউ।হেমন্ত’র বেষ্টফ্রেন্ড।প্লিজ তুই নিজের জেদ ছেড়ে দে।অর্থ তোর কোনদিন হবে না।আর এখন তো একেবারে ইমপসিবল কারন প্রাহিকে অর্থ অনেক ভালোবাসে।প্লিজ ইলফা বাড়িতে চল।মনে রাখ জোড় করে কোন কিছু পাওয়া যায় না।ভালোবাসা তো একেবারেই না।আর তুই তো অর্থ’কে ভালোইবাসিস নি।ভালোবেসেছিস ওর টাকাকে আর রূপকে। চল গাড়িতে উঠ।’
ইলফা আরাফের কথায় কোন কিছু বললো না। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো।তবে মনে মনে বললো,
‘ অর্থ আমি ছাড়া কারো না।অর্থ তো আমারই হবে।যে করেই হোক। আমার ওকে চাই।এর মাঝে যে আসবে ওকে মরতে হবে।ওই মেয়েটাকেও মরতে হবে।ওর সাহস কি করে হলো আমার অর্থকে বিয়ে করার। পস্তাবে ওই মেয়ে।আই উইল কিল হার।’
____________
ভার্সিটিতে গিয়ে একটা ক্লাস করেই ভার্সিটি থেকে চলে এসেছে প্রাহি,হেমন্ত আর ইশি।প্রাহির মন ভালো না দেখে ভার্সিটির থেকে একটু দূরেই একটা পার্ক আছে সেখানে নিয়ে এসেছে হেমন্ত আর ইশি ওকে।প্রাহির চোখ,গাল,নাক,কান লাল টকটকে হয়ে আছে।মেয়েটা কাঁদছেও না।তবে ভীতরে ভীতরে অনেক কষ্ট পাচ্ছে।তাই তো এই অবস্থা ওর।ইশি প্রাহির এই অবস্থা কেন জিজ্ঞেস করায় হেমন্ত ইশিকে সবটা বলেছে। সব শুনে ইশি কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।এইটা স্বাভাবিক।নিজের স্বামির সাথে এইভাবে একটা অন্য নারি জড়িয়ে ধরা অবস্থায় দেখলে প্রতিটা মেয়েরই খারাপ লাগে তবে প্রাহি এটা ভুল করেছে একবার তো অর্থ’র কথা শুনতে পারতো মেয়েটা।হেমন্ত প্রাহির এমন গুম হয়ে থাকা সহ্য করতে পারছে না।এইবার ফুঁসে উঠে বলে,
‘ এমন করে আছিস যেন বিয়ের রাতেই বাসর ঘর থেকে তোর জামাই ভেগে গেছে।’
প্রাহি রাগ নিয়ে তাকালো হেমন্ত’র দিক।ধুম করে ওর পিঠে একটা কিল দিয়ে বলে,
‘ আর একটা বাজে কথা বলবি না।তুই কি বুঝবি হ্যা?বিয়ের তিনদিনব হতে না হতেই নিজের জামাইরে অন্য একটা মেয়ে চুয়িংগামের মতো চিপকে ধরেছিলো। সেটা বাসর ঘর থেকে জামাই ভেগে যাওয়ার দুঃখ থেকে কোন অংশ কম না।তুই কি বুঝবি হ্যা?’
ইশি আর হেমন্ত একে-অপরের দিকে তাকালো।এই মেয়েকে এখন বুঝিয়ে লাভ নেই। যার জন্যে এমন হয়েছে এখন সেই ওকে সামলাতে পারবে।দুজনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।প্রাহির মতোই চুপচাপ বসে থাকলো।এছাড়া আর কোন উপায় নেই যে এখন আর।
#চলবে_________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here