#এক_জীবনে_অনেক_জীবন(১৬)
*********************************
আওলাদ হোসেন অপেক্ষা করছিলেন রফিকের জন্য । আজ রফিক ফিরলে একটা বিহিত করে তারপর তিনি ছাড়বেন । রফিক ফিরলো বেশ রাত করে । আওলাদ হোসেন জিজ্ঞেস করলেন –
অফিস গিয়েছিলি ?
হ্যাঁ আব্বা অফিস তো গিয়েছিলাম ৷ প্রতিদিনই তো যাই । কেন?
কখন বেরিয়েছিস ?
কোত্থেকে, অফিস থেকে?
হুম ।
বিকেলের দিকে ।
এতক্ষণ কোথায় ছিলি ?
কোথায় আবার থাকবো, কাজে ব্যস্ত ছিলাম । চাকরির পাশাপাশি আমরা কয়েক বন্ধু মিলে একটা অনলাইন ব্যবসা চালু করার চেষ্টা করছি । ওখানে সময় দিতে হচ্ছে । আপনার কাছে তো কয়বার টাকা চেয়েও কোনো লাভ হলো না । আপনি তো একটা টাকাও দিলেন না অথচ আমি ছাড়া আর সবাই যার যার ফ্যামিলি থেকে হেল্প পাচ্ছে ।
তোর অফিস থেকে ফোন করেছিলো আজকে ।
কেন ?
তোর গুণকীর্তন করার জন্য । তুই যে কী কী করছিস ওখানে, কাকে কী বলেছিস, সেই সব কথা শোনানোর জন্য আজম স্যার ফোন দিয়েছিলেন আমাকে ।
আব্বা ঐ কাজ আমার ভালো লাগে না । আমি আপনাকে আগেও বলেছি এমন কাজ আমাকে দিয়ে হবে না আব্বা ।
হুম । আমারই আসলে ভুল হয়েছে । ছোট পোস্টে কাজ করেছি কিন্তু ঐ অফিসে আমার একটা সুনাম ছিল কাজের কারণে । তোকে ওখানে ঢুকিয়ে সেই সুনামটা আমি নষ্ট করলাম । আচ্ছা তুই কী করতে চাস, আমাকে একটু স্পষ্ট করে বল তো ।
রফিক কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকলো ।
শোন এভাবে তো জীবন কাটবে না । আমার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু কুলোয়, আমি তোর জন্য চেষ্টা করেছিলাম । আমারই আসলে ভুল হয়েছে । সন্তানের সুদিন দেখার সুখ তো সব মা-বাপের হয় না । তুই ঠিক করেই নিয়েছিস যে তুই আমাদের শান্তিতে থাকতে দিবি না । আমি খামোখাই তোকে নিয়ে চিন্তা করি সব সময় । আমি বাবা নিরীহ মানুষ, নিজের মতো করে ভালো থাকতে চাই, শান্তিতে থাকতে চাই । তুই আসলে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় জন্ম নিয়েছিস । এই গরীব বাপ মা তোর জন্য না । তুই বরং এক কাজ কর , যেহেতু আমাদের চাওয়া মতোন, আমাদের ইচ্ছে মতো তুই চলতে পারবি না, তুই নিজের মতো আলাদা হয়ে যা ।
আলাদা হয়ে যাবো মানে ?
মানে নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নে ।
আব্বা আপনি কী বলেন এইসব ? নিজের কী ব্যবস্থা আবার ? আপনি কী বাবা হিসেবে আমার জন্য কখনো কিছু করেছেন ?
হ্যাঁ আমি তোর জন্য কখনো কিছু করতে পারিনি । তুই নিজেই এতো বড় হয়ে গেছিস, এই পর্যন্ত নিজেই নিজের সব খরচ চালিয়েছিস । আমি কিছু করতে পারিনি দেখে তোর কাছে ক্ষমা চাইছি । তুই আমাদের সবাইকে মাফ করে দিয়ে নিজের রাস্তা নিজে দেখে নে । আমার বাড়িতে বসে বসে আর খেতে পারবি না ।
সুফিয়া দাঁড়িয়ে স্বামীর কথা শুনছিলেন । এবার আর তিনি চুপ থাকতে পারলেন না । বললেন –
তুমি কী বলো এইসব ! ও কোথায় যাবে ?
তা আমি জানি না । আমি খুব ক্লান্ত হয়ে যাই সুফিয়া ওর ভবিষ্যৎ চিন্তা করলে । টেনশনে আমার বুক ধড়ফড় করে । আমি এই টেনশন থেকে মুক্তি চাই ।
ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে তোমার টেনশন কমে যাবে ?
তা আমি জানি না তবে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে দুনিয়ার কঠিন দিকটা সে চিনতে পারবে হয়তো । একটু ঘুরে দেখুক, দুনিয়াটা যে বাপের হোটেল না এটা বুঝুক ।
ও তো অফিস যাচ্ছে তাহলে এখন আবার কেন বকাবকি করছো ছেলেটাকে ?
হুম তোমার ছেলে অফিস করছে । এতো ভালো পারফরম্যান্স করেছে অফিসে যে সেই সব শোনানোর জন্য অফিস থেকে ফোন এসেছিল ।
কী রে তুই ঠিকমতো অফিস করিস না ?
রফিক মা’র কথার কোনো উত্তর দিলো না ।
কেন এমন করছিস রফিক ? এই চাকরিটা চলে গেলে তোকে আর কে চাকরি দেবে বল তো ? কেন এমন করিস, কী চাস তুই ? আমাদের কাছে টাকা থাকলে তো তোকে দিতাম ব্যবসা করার জন্য । আমাদের অবস্থাটা তো তুই বুঝতে চেষ্টা করবি, না-কি ? কালকে থেকে ঠিক মতো অফিস কর বাবা । এইসব বড় বড় স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দে ।
সুফিয়া স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন –
তুমি রুমে যাও, আর কথা বলো না এখন । রাতে আবার ঘুম হবে না তোমার ৷
ওর দ্বারা কিচ্ছু হবে না , ওর দ্বারা কিচ্ছু হবে না । আওলাদ হোসেন নিজের মনেই কথাগুলো বলতে বলতে তাঁর রুমের দিকে চলে গেলেন ।
.
.
তাবাসসুমের মাথা ধরে আছে বেশ অনেকক্ষণ ধরে । জারা’র বিষয়টা নিয়ে তিনি খুব বেশি আপসেট হয়ে আছেন । কায়সার রুমে এসে তাবাসসুমকে শুয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন –
কী হলো, এই অবেলায় শুয়ে আছো যে ?
ভালো লাগছে না, কিচ্ছু ভালো লাগছে না আমার ।
শোনো এতো অধৈর্য্য হলে কী হয় ? ওঠো, উঠে বসো । শিল্পীকে বলেছি চা দিয়ে যেতে ।
তাবাসসুম উঠে বসলেন ।
কায়সার বললেন –
সব বিষয় জোর খাটিয়ে সমাধান হয় না তাবাসসুম ।
আমি কোথায় জোর খাটালাম ! এই মেয়েকে কতোবার কতো ভাবে বুঝানো হয়েছে, ভুলে গেছ তুমি ? সে কেন এমন করে যাচ্ছে বলতে পারো ?
আমার সব মনে আছে । আমি ওর বয়সটাতে দাঁড়িয়ে বিষয়টা দেখার চেষ্টা করছি । এই সময় ইমোশন খুব বেশি কাজ করে, জেদি ভাবটা পেয়ে বসে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের মধ্যে । সবার ক্ষেত্রে তো হয় না, হয় বলো ? আরো দু’জনকে বড় করলে কোনো রকম জটিলতা ছাড়া । সব বাচ্চা তো এক রকম হয় না । সে একটা কাজ করে ফেলেছে । আমরা যতোই ভুলটা দেখানোর চেষ্টা করি না কেন, সে ভাবছে যে সে-ই ঠিক । আমি আজকেও তাকে ভালোভাবে বুঝিয়েছি, মাঝে মাঝে অবশ্য একটু রাগও করেছি । তুমি আবার ওর সাথে কথা বলো । এক কাজ করো, সেই ছেলেটার ডিটেইলস নাও জারা’র কাছ থেকে । আমি ঐ ছেলের সাথে কথা বলবো । এরা আজকের দিনের ছেলেমেয়ে । রিলেশনশীপটা আজকাল খুব সাধারণ একটা ব্যাপার । জারা’র বয়সের একটা মেয়ের রিলেশন থাকাটাই তো স্বাভাবিক । তুমি তো মেয়েকে এভাবে ঘরে আটকে রাখতে পারবে না তাবাসসুম । কয়দিন পরে তার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে, তখন কী করবে ? তখন তো তাকে ছাড়তেই হবে । বেটার হয়, ঐ ছেলে আসুক । জারাকে সামনে রেখেই আমরা ওর সাথে কথা বলবো । ওর ফ্যামিলির খোঁজ খবর নেই । যদি সবকিছু ঠিক থাকে তাহলে তো আমাদের না করার কোনো কারণ দেখি না । মেয়ে যখন এতো করে বুঝানোর পরেও সেখান থেকে সরে আসতে পারছে না, তার দিকটাও আমাদের দেখা উচিত । আর আরাফাত যে খুব নিশ্চিত করে সব কিছু জানতে পেরেছিলো, তা-ও কিন্তু না । তারও বুঝার ভুল হতে পারে ।
হুম আরাফাতের বুঝার ভুল হতে পারে কিন্তু আমি যে অল্প সময়ের জন্য ছেলেটাকে দেখলাম, ছেলেটাকে কেন জানি আমার ভালো লাগেনি ।
কারণ কী ? দেখতে খারাপ, কথাবার্তার ধরণ ভালো না ?
কেমন যেন, আমি ঠিক বলে বুঝাতে পারবো না তোমাকে । দেখতে তো খারাপ না, চেহারা তো ভালোই । চেহারা তো আসল বিষয় না, ছেলেটার চেহারার মধ্যে খুব ধূর্ত একটা ভাব আছে । সেটা আমার ভালো লাগেনি ।
শিল্পী চা নিয়ে ঢুকতেই কায়সার একটা কাপ নিয়ে এগিয়ে দিলেন তাবাসসুমের দিকে । শিল্পী বেরিয়ে গেলে বললেন –
চা খাও, মাথা ব্যাথা কমে যাবে আর অকারণ চিন্তা দূর করে দাও তো মাথা থেকে । তোমার এমন চেহারা দেখলে আমি ভালো থাকি না, তুমি জানো না?
তাবাসসুম স্বামীর হাতটা ধরে বললেন –
আমার কেন যে এতো অস্থির লাগছে আমি নিজেও বুঝতে পারছি না । আমার শুধু মনে হচ্ছে খারাপ কিছু ঘটবে ।
এইসব বাজে কথা ভেবে সময়গুলো নষ্ট করো না তো । তুমি চা শেষ করে একটু শোও, আমি তোমার মাথা টিপে দিচ্ছি । একটু ঘুমাও তাহলে ভালো লাগবে ।
চা খাইয়ে তারপর বলছো ঘুমাও ! তুমি আমার পাশে একটু বসে থাকো । কিচ্ছু করতে হবে না শুধু আমার হাতটা ধরে বসে থাকো ।
কায়সার চা শেষ করে কাপটা রেখে তাবাসসুমের হাতটা ধরে বললেন –
সব ঠিক হয়ে যাবে । জীবনে তো চড়াই-উতরাই থাকবেই তাই বলে এতো ঘাবড়ে গেলে হয় ? কালকে জারা’র সাথে কথা বলো । দরকার হলে আমরা দু’জন মিলে কথা বলবো ।
তাবাসসুমের চোখের কোণ বেয়ে জল গড়াতে দেখে কায়সার উতলা হয়ে উঠলেন –
তুমি দেখছি আমার মন খারাপ না করে ছাড়বেই না । এরকম করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে ।
কায়সার উঠে এসে তাবাসসুমের কাছে দাঁড়িয়ে চোখের জলটুকু মুছে দিলেন । তাবাসসুম স্বামীর বুকে মাথা রখলেন । কায়সার তাবাসসুমের খোঁপা খুলে এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলো ঠিক করে দেয়ার চেষ্টা করছেন আনাড়ি হাতে । অনেকক্ষণ পর তাবাসসুমের মনটা একটু ভালো হলো ।
.
.
মা’র কাছে একগাদা কথা শুনেছে আগেই তারপর আব্বু কাছ থেকেও কথা শোনার পর জারা’র ভীষণ মন খারাপ ছিল । তার রাগ কিছুতেই কমছে না । আব্বুর ওপর তার ততটা রাগ হচ্ছে না যতটা হচ্ছে মা’র ওপরে । মা সবকিছু নিজের মতো করে করতে চান । কেন সবকিছু তাঁর মন মতো হতে হবে ? কেন মা তার আর আদির বিষয়টা সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন ? বড় খালার ওপরেও রাগ হলো জারা’র । বড় খালার মাথায় সব সময় শয়তানি বুদ্ধি ঘুরতে থাকে । কোনো কিছু না জেনে বুঝেই হুট করে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়ার বুদ্ধি কী করে দেন তিনি ? যদি সত্যিই এমন কিছু হয় তাহলে সে কী করবে ? এই সব কথাগুলো মাথার ভেতর অবিরাম ঘুরপাক খেতে লাগলো । এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত সেটাও সে ঠিক করতে পারছে না । আদির ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বন্ধ । একেকবার ইচ্ছে হচ্ছে সবকিছু ভেঙেচুরে ফেলতে । দু’হাতে খোলা চুলগুলোকে মুঠোর ভেরত চেপে ধরলো জারা । আজ সারাদিন মন খারাপের কারণেই হয়তো খুব ক্লান্তি লাগছে তার । ঘুমানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু ঘুম আসছে না কিছুতেই ।
শুয়ে শুয়ে এলোমেলো চিন্তা করতে করতে একসময় ঘুম চলে এসেছিল জারা’র চোখে । মোবাইল বেজে উঠতেই ঘুম ভেঙে গেল তার । আদির ফোন । ফোনটা ধরে ধমকে উঠলো জারা –
সমস্যা কী তোমার, এতক্ষণ ধরে ফোন বন্ধ কেন ?
ফোনটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ করে । এতক্ষণ পরে চালু হলো আবার ।
তুমি তো অন্য কোনোভাবে আমাকে একটা ফোন দিতে পারতে । আমি কী রকম টেনশনে আছি সেটা কী তুমি জানো ?
সরি সরি খুব ভুল হয়ে গেছে । আর কখনো এমন ভুল হবে না । বাসায় কী অবস্থা বলো ।
বাসায় যা ছিল তা-ই আছে । আমার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না । এভাবে ঘরের ভেতর আটকে থাকলে আমি কিন্তু পাগল হয়ে যাবো ।
তোমাকে তো আমি বলছি যেমন করে হোক তুমি বের হয়ে এসো ।
আমার ভীষণ ভয় করছে আদি । এভাবে বের হয়ে গেলে জিনিসটা আরো খারাপ হয়ে যাবে । মা যে তখন কী করবে এটা ভাবলেই আমার বের হওয়ার ইচ্ছেটা মরে যাচ্ছে ।
জারা সত্যি করে একটা কথা বলবে ?
কী ?
ভালোবাসো ?
বাসি তো ।
বিশ্বাস করো, ভরসা করো ?
খুব বেশি ।
তাহলে আমি যেটা বলছি সেটা করো । তুমি কাল চলে এসো বাসা থেকে ।
তারপর ?
সেটা তুমি আমার কাছে আসার পর ঠিক করবো দু’জন মিলে । জারা আমি তোমাকে হারাতে চাই না, কোনোভাবেই না । তুমি ছাড়া আমার পৃথিবী আমি ভাবতে পারি না জারা ।
আমি বাইরে আসতে চাই আদি । মা আমাকে যেভাবে আটকে রেখেছেন, আমি সহ্য করতে পারছি না সেটা ।
আমি তোমাকে বলছি তো জারা তুমি চলে এসো । আমি নিশ্চিত তোমার মা আর খালা মিলে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করছে । পরে যদি কোনো ঘটনা ঘটে যায় তখন কিন্তু আমাকে দোষ দিও না । আমি কিন্তু তোমার পথ চেয়ে আছি ।
আদি আমি বুঝতে পারছি না কিছু ।
শোনো জারা আজ যদি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাও তাহলে কিন্তু সারাজীবন আফসোস করবে । তোমার জীবনটা হয়তো অন্য কোনো দিকে চলে যাবে । তুমি জানো না, যারা ভয় পায় তারা কখনো জিততে পারে না । তুমি এতো সাহসী একটা মেয়ে, তুমি কেন ভয় পাবে ? তুমি স্বাধীন একজন মানুষ অথচ তোমাকে কেমন খাঁচায় বন্দী পাখির মতো আটকে রেখেছে ।
আমার সত্যি ভীষণ রাগ হচ্ছে মা’র ওপর । মা খুব বেশি বেশি করে ফেলছেন আমার সাথে । আচ্ছা আদি তুমি কী আর একবার মা’র সাথে কথা বলতে পারো না ?
কোনো লাভ হবে না জারা । উনি ঠিক করেই রেখেছেন আমাকে উনি কখনোই পছন্দ করবেন না । কেন বাসায় ফিরে আসার পরেও তো তোমাকে বকাঝকা করেছেন, করেননি বলো ?
হুম কিন্তু……
জারা তুমি আর অন্য কোনো চিন্তা করো না । আমার কথাটা শোনো । ভয় পেয়ো না জারা, আমি আছি তোমার জন্য, তোমার সাথে থাকবো সারাজীবন ।
আমি কোনো ডিসিশন নিতে পারছি না আদি । আমি কী আপুর সাথে একবার কথা বলবো ?
না না কক্ষনো না । জারা আমি এখন ফোন রাখছি । আমার একটু কাজ আছে । তুমি এখন ঘুমাও । ঘুম থেকে উঠে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে আমাকে জানাও কখন আসবে তুমি । আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি জারা ।
আদির সাথে কথা শেষ করে জারার মনে হলো মা’র সাথে আরেকবার কথা বলবে সে । মা’কে তার কথা শুনতেই হবে । আবার যখন মনে পড়লো মা তার সাথে অকারণে বেশি বাড়াবাড়ি করছেন, জারা’র তখন মা’র ওপর জমে থাকা রাগটা ফিরে এলো । দরকার নেই কথা বলার, আদি যা বলছে, সেটাই করবে সে ।
.
.
রাতে কায়সার তাকে বুঝানোর পর তাবাসসুমের মনটা অনেকটুকু শান্ত হয়েছে । সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি ঠিক করলেন কোনো রকম রাগারাগি না করে জারা’র সাথে কথা বলবেন তিনি । আদিত্য ছেলেটার নাম ঠিকানা সব নিয়ে ভালো মতো খোঁজ নেবেন ।
নাস্তা করে কায়সার অফিসে চলে গেলে রোজা আর শাফিনের সাথে কথা বললেন তাবাসসুম । শাফিনকে বিষয়টা এখনই জানালেন না । ছেলেটা দূরে থাকে, অকারণে টেনশন করবে । রোজাকে সব ঘটনা খুলে বললেন ।
রোজা একটু মন খারাপ করে বললো –
মা এতো কিছু হয়ে যাচ্ছে আর আমি কিছুই জানি না । আমি তো ভেবেছিলাম বিষয়টা অনেক আগেই শেষ হয়ে হয়ে গেছে । জারা তো আমাকে সেটাই বলেছিল৷ এরপর আমাকেও আর কখনো জানায়নি ঐ বিষয়ে । তুমি দেখা করতে যাওয়ার সময় আমাকে বলতে পারতে । আমি অফিস থেকে চলে আসতাম ।
ঐটা আসলে তাড়াহুড়ায় হয়ে গেছে আর তুমি আসলেও লাভ হতে না । ছেলেটা তো এতেটুকুও সময় দিলো না ।
ঠিক আছে মা এখন রাখছি৷ আমি সন্ধ্যায় চলে আসবো অফিস থেকে । শোনো তুমি কিন্তু জারাকে বকাবকি করো না ।
হুম ঠিক আছে ।
.
.
সকাল থেকে আদি সমানে কল দিচ্ছে, ম্যাসেজ করে যাচ্ছে । বারবার একই কথা – জারা তুমি কখন বের হবে ?
জারা খুবই দোটানায় আছে । সে এখনো পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি । আদি অনেকক্ষন ধরে তাদের এলাকায় ঘোরাঘুরি করছে । জারা জানালার কাছে গিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলো আদিত্য কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে । সে ফোন দিতেই আদিত্য তার জানালার দিকে তাকিয়ে ইশারায় নিচে নেমে আসতে বললো । আরো বললো আসার সময় যেন আইডি কার্ড আর যতটা সম্ভব টাকা নিয়ে আসে সাথে করে ।
কথা শেষ করে জারা তার জমানো টাকাগুলো ব্যাগে ভরে নিলো, সাথে আইডি কার্ডটাও ।
তাবাসসুম এমন সময় জারা’র রুমে এসে ঢুকলেন, হাতে এক বাটি আইসক্রিম । বাটিটা মেয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন –
আইসক্রিম খাও ।
জারা হাত বাড়িয়ে বাটিটা নিলো । সে খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে ।
তাবাসসুম বললেন –
আমি গোসলটা সেরে আসি । তারপর আমরা বসে কথা বলবো ।
হুম ঠিক আছে ।
সন্ধ্যায় রোজা আসবে ।
আচ্ছা ।
তাবাসসুম গোসলে ঢুকেছেন, শিল্পী রান্নাঘরে মাছ কুটছিল । জারা রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো –
শিল্পী আপু আমি একটু নিচে থেকে আসছি ।
শিল্পী মাছ কুটা থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো –
কই যাও?
আমার একটা পার্সেল এসেছে । আমি যাবো আর নিয়েই চলে আসবো । তুমি দরজাটা বন্ধ করে দাও ।
কথাটা বলে জারা আর দাঁড়ালো না । ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে ব্যাগটা ওড়নার আড়ালে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে ।
শিল্পী উঠে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিলো ।
নিচে এসে আদিত্যকে দেখেও কথা বললো না জারা । হেঁটে চলে এলো রাস্তার মোড়ে । আদিও পিছে পিছে এসে জারার পাশে দাঁড়ালো । জারা’র হাতটা ধরে বললো –
শেষ পর্যন্ত এলে তুমি !
আদির হাতের ছোঁয়া পেয়ে জারা যেন সাহস ফিরে পেলো অনেকটুকু । জিজ্ঞেস করলো –
কোথায় যাবো এখন ?
চলো তো আগে তোমার এলাকা থেকে বের হই তারপর দেখা যাবে ।…………………