এক জীবনে অনেক জীবন পর্ব ২৫

#এক_জীবনে_অনেক_জীবন(২৫)
**********************************

বেশ অনেক দিন বুটিকে যাওয়া হচ্ছিল না তাবাসসুমের । আজ সকালে উঠেই ঠিক করেছিলেন বুটিকে যাবেন । শিল্পীকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে কায়সারের সাথেই বেরিয়েছিলেন তিনি । যদিও বুটিকের ছেলেমেয়েগুলো সব কাজই গুছিয়ে করেছে তারপরেও কিছু কাজ নিজে হাতে না করলে যেন মন ভরে না । বুটিকে এসে আরো একটা লাভ হয়েছে তাবাসসুমের । গত কয়েক দিন ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণা আর টেনশনে কাবু হয়ে গিয়েছিলেন তিনি । নিজের কাজের জায়গায় এসে সে সব বেমালুম ভুলে গেলেন । একটানা কাজ করলেন বিকেল চারটা পর্যন্ত । এরপর সেখান থেকে বের হয়ে সংসারের জিনিসপত্র কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরে আসলেন তাবাসসুম ।

শিল্পী যদিও সেদিনের সব রান্না শেষ করে রেখেছিল তবুও বাজারের ভেতর ইলিশ মাছ দেখে জিজ্ঞেস করলো –

এই বিকালে মাছ আনলেন খালাম্মা, রান্না করুম এখন?

মাছটা দেখে ভালো লাগলো আর আমার আজকে খুব ইলিশ দো-পেঁয়াজা খেতে ইচ্ছে করছিল তাই নিয়ে নিলাম । তুমি মাছটা কেটে দাও, আমি রান্না করবো । মন্টু ঘি এনেছে না-কি ?

কিসের ঘি ?

ওর মা না-কি খুব ভালো ঘি বানান । সেটা আমাদের খাওয়ানোর জন্য তো সে অস্থির হয়ে আছে ।

মন্টু ভাই তো এখনই আপনারে নিয়া আসলো । আপনি জিজ্ঞেস করেন নাই ?

মনে ছিল না, এখন হঠাৎ মনে পড়লো । তুমি মাছটা তাড়াতাড়ি কেটে দাও, আমি আসছি ।

খালাম্মা জারা কেমন আছে ?

তাবাসসুম কটমট করে তাকালেন শিল্পীর দিকে । বললেন –

যেটা বলেছি সেটা করো । ফালতু কথা কম বলো ।

রুমে এসে বুটিকের সেলের টাকাগুলো আলমারিতে তুলে রাখলেন তাবাসসুম । কাল সকালে ব্যাংকে পাঠাতে হবে । হাতের কাছের কাজগুলো দ্রুত সামলে নিলেন । মাছটা রান্না করতে হবে কায়সার ফেরার আগে । এই রান্নাটা কায়সারও খুব পছন্দ করে ।

রান্নাঘরে যাবেন ঠিক সেই মুহূর্তে মোবাইলটা বেজে উঠলো । অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাবাসসুম ফোনটা রিসিভ করলেন । তাঁর এই ননদের সাথে কথা বলতে তিনি কখনোই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না । তাবাসসুম বললেন –

হ্যাঁ ফাইজা বলো , কেমন আছো ?

আমরা তো ভালোই আছি । তোমাদের কী খবর বলো তো?

আমরাও সবাই ভালো আছি ।

ঠিক বলছো তো ?

মানে কী ! তোমার কাছে ভুল মনে হচ্ছে কেন ?

সবাই কীভাবে ঠিক থাকো ভাবি ? তুমি কী ভেবেছো তুমি না জানালে আমরা আর জানতে পারবো না ?

না আমি এমনটা ভাবিনি । আমি জানি কিছু না জানালেও তুমি নিজের গরজেই সব জেনে যাবে, তাই আর তোমাকে জানাইনি ।

আসলে কী ঘটনা হয়েছিল বলো তো ভাবি ।

তুমি যা শুনেছো তা-ই ঘটেছে ফাইজা । বাদ দাও, তোমরা সবাই কেমন আছো বলো ?

কী বলো ভাবি, এটা কী বাদ দেয়ার জিনিস ? জারা এমন একটা কাজ করে বসবে এটা আমি ভাবতেও পারছি না ৷

ভাবতে না পারলেও সে কাজটা করেছে । এটা নিয়ে আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ফাইজা ।

তোমার ইচ্ছার ওপর কী দুনিয়া চলে ভাবি ? আত্মীয়স্বজন সবাই যে কতো রকম সব কথা বলতে শুরু করেছে তুমি ভাবতেও পারবে না ।

আমার ভাবার দরকার নেই ফাইজা । যাঁদের বলতে মন চায় তাঁরা বলুক । মানুষের মুখ তো বন্ধ করে রাখা সম্ভব না, তাই ওগুলো নিয়ে ভাবছি না ।

আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাচ্ছি জারা এমন উচ্ছন্নে গেল কবে ! সারাক্ষণই তো তুমি মেয়ের আগে-পিছে থাকতে । অবশ্য তোমারই বা দোষ কী ? চোর চুরি করলে তুমি তাকে কতক্ষণ আর পাহারা দিয়ে রাখবে বরং সে-ই তোমাকে পাহারা দিয়ে রেখেছিল । তুমি বুঝতেই পারোনি ।

ফাইজা এইসব কথা এখন কেন বলছো ? তোমাকে রিকোয়েস্ট করছি, প্লিজ অন্য কোনো কথা বলার থাকলে বলো ।

এইজন্যই তোমার মেয়ে খারাপ হয়ে গেছে, বুঝতে পেরেছো ভাবি । তুমি সবসময় সমস্যা থেকে পালাতে চাও । আরে বাবা পালিয়ে গেলে কী সমাধান হয় ? আলোচনা করলেই তো সমাধান বেরিয়ে আসে ।

তাবাসসুমের প্রচন্ড বিরক্ত লাগছিল । এই ননদের সাথে পারতপক্ষে তিনি কথা বলতে চান না । নিজে থেকে তো তিনি কখনোই ফোন করেন না । ফাইজা যখন ফোন করে, তাঁর পুরো দিনটাই মাটি করে দেয় । এর হাত থেকে সহজে পরিত্রান পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে তাবাসসুম বললেন –

আমি মাত্রই বুটিক থেকে ফিরেছি । কিছু কাজ বাকি আছে । ফাইজা তুমি বাসায় এসো, কথা বলবো ।

দুইজন মানুষ তোমরা, বাসায় কিসের এতো কাজ শুনি আর শিল্পী কই ?

আছে ।

সে থাকতে তোমার কাজ করতে হয় কেন ?

সব কাজ তো শিল্পী করবে না, তাই না ?

ভাবি জারা কোথায় ?

আপার বাসায় ।

কেন আপার বাসায় কেন ? মেয়েকে যখন তোমরা ফেরত নিয়েই আসলে তখন অন্যের বাসায় ফেলে রেখেছো কেন ? আমি হলে তো এমন মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দিতাম না কোনোদিন । আচ্ছা লোকজন যে খারাপ খারাপ কথা বলছে, তুমি সেটা জানো ?

তাবাসসুম ঘড়ির দিকে তাকালেন । বেলা পড়ে আসছে, এর পর গোসল করলেই তাঁর ঠান্ডা লেগে যাবে অথচ এর হাত থেকে কখন যে ছাড়া পাবেন বুঝতে পারছেন না । বললেন –

ফাইজা তোমার আর কোনো প্রশ্ন থাকলে একটু জলদি বলো । আমার রাঁধতে হবে ।

ঠিক মতো তো মিথ্যেটাও বলতে পারো না ভাবি । এটা রান্নার সময় ? বাদ দাও, তোমার সংসার তুমি কখন রাঁধবে, কখন খাবে সেটা তোমার ব্যাপার । আচ্ছা জারা পালালো কেন বলো তো ? আজকের দিনে কেউ কী পালায় না-কি ? ছেলেটা কী ভালো ছিল না, তোমরা মেনে নিলে না কেন তাহলে ? পালিয়ে যখন বিয়ে করেই ফেলেছে , তোমরা মেনে নিতে পারতে । তা না করে ছেলেটাকে জেলে ভরে দিলে ৷ কেমন একটা দাগ পড়ে গেল মেয়েটার জীবনে । এই দাগ সারাজীবনেও আর যাবে না বুঝেছো । রোজা’র যেমন ভালো বিয়ে হয়েছে, এর তো ভালো কোনো জায়গায় বিয়েও দিতে পারবে না । ইশ কী যে হয়ে গেল বাচ্চা মেয়েটার সাথে , আহারে ।

তাবাসসুমের রাগ বাড়ছিল ধীরে ধীরে । তারপরেও চরম ধৈর্যের সাথে নিজেকে কন্ট্রোল করলেন তিনি । বললেন –

ফাইজা ফোনে কথা বলে তো তোমার সাধ মিটবে না । এক কাজ করো, কাল বাসায় এসে তোমার ভাইয়ের কাছ থেকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব শুনে নিও । সে-ই ভালো বলতে পারবে সবকিছু ।

তা তো আসবোই । সময় পাচ্ছি না একদম । শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক এসেছে বেড়াতে । এইসব লতাপাতার আত্মীয় আমার একদম ভালো লাগে না ভাবি অথচ কয়দিন পরপরই আমার ঘাড়ে এসে জোটে সব হাভাতের দল । এবার কে এসেছে শুনবে? আশরাফের চাচাতো ভাইয়ের শালীর শাশুড়ি, ভাবতে পারো ! চিকিৎসার নামে আসে তারপর তাদের ঢাকা শহর দেখতে ইচ্ছে করে । আমার জীবনটা পুরো ছারখার করে দিলো ।

তাবাসসুম মনে মনে হাসেন আর ভাবেন, একদম ঠিক আছে । তোমার মতন বদকে জব্দ করার জন্য আশরাফ ভাই ভালো ব্যবস্থা করে রেখেছেন ।

বাদ দাও ভাবি, আমার দুঃখের কাহিনি বলে তো শেষ করা যাবে না । সময় করতে পারলে আসবো । আমাকে শুধু একটা কথার উত্তর দাও তো ভাবি । কথাটা মাথার ভেতর থেকে যাচ্ছেই না ।

বলো কী জানতে চাও ।

এই যে জারা এমন হুট করে চলে গেল, অন্য কোনো ঘটনা ছিল না-কি এরমধ্যে ?

মানে ? ঠিক বুঝলাম না তোমার কথাটা ।

লোকজন কিন্তু এই বিষয়টা নিয়েও কথা বলছে । শর্মী আর আনিকা দু’জনেই এই কথাটা জিজ্ঞেস করলো ।

তাবাসসুম এবার রাগ হয়ে গেলেন । বললেন –

যা বলার স্পষ্ট করে বলো ফাইজা । এর তার নাম দিয়ে বলার দরকার নেই । আর কী জানতে বাকি আছে তোমার বলো ?

ভাবি জারা কী প্রেগন্যান্ট ছিল ?

তাবাসসুম অন্তত এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না । তিনি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলেন ।

কী হলো ভাবি শুনতে পেয়েছো ? কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে ।

ফাইজা একটা কথা বলো তো, তোমার এটা কেন মনে হলো যে জারা প্রেগন্যান্ট ছিল ?

আমার একার না ভাবি, অন্যদেরও তাই মনে হচ্ছে । তুমি নিজেই মিলিয়ে দেখো , কথা নেই বার্তা নেই মেয়ে হুট করে বাড়ি ছেড়ে গিয়ে একবারে বিয়ে করে ফেললো । তারপর আবার যখন ফিরে আসলো তখন তোমার বোনের বাড়িতে তাকে রেখে আসলে । এমন প্রশ্ন আসাই তো স্বাভাবিক ।

অবশ্যই, তোমার মতো নোংরা মানসিকতার মানুষের মাথায় এমন প্রশ্ন আসাই তো স্বাভাবিক । যেভাবেই হোক, যেমন করেই হোক, আমার মেয়েটা একটা ভুল করে ফেলেছে । মানুষ কথা বলবে সেটা আমি জানি । কিছু মানুষের কাজই হচ্ছে অন্যের দুর্বলতা নিয়ে কথা বলে আনন্দ পাওয়া । তাদের মুখ আমি বন্ধ করতে পারবো না । তাদের নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথাও নেই, বিশ্বাস করো ফাইজা । তবে তুমি যখন আপন ফুপু হয়ে আমার মেয়েটার নামে এমন সব নোংরা কথা বলতে পারো, আমার আর কিচ্ছু বলার নেই । তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে, জারা পালিয়ে যাওয়াতে তুমি দারুণ খুশি হয়েছো । এখন যদি আমি বলি যে জারা প্রেগন্যান্ট ছিল তাহলে তোমার সেই পৈশাচিক আনন্দ আরো বেড়ে যাবে । ফাইজা তুমি কীভাবে পারো এইসব ! আমার মেয়েদের ওপরে এতো রাগ, এতো হিংসা কেন তোমার ? রোজা’র বিয়ের সময়ও তুমি প্রচুর নোংরা কথা বলেছো । কায়সারের বোন দেখে কিছু বলিনি তখন কিন্তু আজকে আর না বলে পারছি না ফাইজা । তুমি নিজের সংসারে সুখে নেই তো, তাই মানুষের সুখ তোমার সহ্য হয় না । তোমার নিজের সংসারের দিকে কখনো উঁকি দিয়ে দেখেছো ফাইজা ? আশরাফ ভাই ভালো মানুষ বলে মুখ বুঁজে তোমার সব অত্যাচার সহ্য করে যান । বেচারা সারাজীবন টাকার জোগান দিয়ে গেলেন আর তুমি সেই টাকা নিয়ে ফুর্তি করে, কিটি পার্টি করে বেড়ালে । অল্প বয়সে গাদা গাদা টাকা হাতে দিয়ে তুমি তোমার ছেলেকে নষ্ট করেছো । এসএসসির পরে ছেলেটার আর লেখাপড়াই হলো না । কই আমি তো কোনোদিনও তোমাকে কথা শোনাইনি এসব নিয়ে কারণ শাবাবের খারাপ কিছু দেখলে আমার কষ্ট লাগে । শাফিন কতোবার চেয়েছে ওকে লেখাপড়ার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে, তুমি দাওনি । উল্টো আমার ছেলেকে যা-তা কথা শুনিয়েছো । এতো হিংসা করে কার লাভ হয়েছে বলো তো ফাইজা ? আমি কোনোদিন কাউকে হিংসা করিনি । আমার ছেলেমেয়ে তো আল্লাহর রহমতে মানুষ হয়ে গেছে । আজকে যখন আমরা একটা খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তখন তুমি পাশে না দাঁড়িয়ে এভাবে মজা নিচ্ছো ! অবশ্য তোমার থেকে এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না । তোমার জন্য আরেকটা দুঃসংবাদ আছে, জারা’র প্রেগনেন্সির সুখবরটা আমি তোমাকে দিতে পারলাম না । তোমার আর কিছু জানার থাকতে বলো । আমার অনেক কাজ আছে, ফালতু কথার এতো সময় নেই আমার ।

তাবাসসুম কথা শেষ করতেই ফাইজা আর কোনো কথা না বলে লাইনটা কেটে দিলেন ।

ফোনটা রেখে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল তাঁর । মানুষ এতো নোংরা মানসিকতার হয় কী করে ! তা-ও আবার নিজের মানুষ ? ধ্যাত এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না । কিচেনে এসে শিল্পীকে বললেন মাছটা ফ্রিজে তুলে দিতে । মাছ খাওয়ার সাধ মিটে গেছে তাঁর । মাথার মধ্যে ফাইজার প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে, জারা কী প্রেগন্যান্ট ছিল ?

.
.

জারা কারো সাথে কোনো কথা বলেনি এই ক’দিন । সারাদিন চুপচাপ বসে থাকে সাদাতের রুমে । নিলুফার কয়েকবার এসে কথা বলার চেষ্টা করেছেন, অনেক বুঝিয়েছেন কিন্তু সে তেমনই মনমরা হয়ে বসে থাকে । গতকাল রোজা এসেছিল । জারাকে অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়েছে আবার মাঝে মধ্যে একটু বিরক্তও হয়েছে । রোজা চলে যাওয়ার পর থেকে সে আরো বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে ।

নিলুফার চানাচুর মাখা আর ফিরনী নিয়ে ঢুকলেন রুমে । ফিরনীটা জারা’র জন্যই বানিয়েছেন তিনি । মেয়েটা ফিরনী খুব পছন্দ করে ।

জারা একটা ম্যাগাজিন হাতে বসে ছিল । সাদাত বেশ কিছু ম্যাগাজিন আর গল্পের বই এনে দিয়েছে ওকে । খালাকে রুমে ঢুকতে দেখে জারা ম্যাগাজিনটা পাশে রেখে দিলো । নিলুফার জারা’র দিকে চানাচুরের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বললেন –

তোমার তো চানাচুর খুব পছন্দ, তাই মাখিয়ে নিয়ে এলাম । নাও খাও ।

জারা বাটিটা হাতে নিয়ে বসে থাকলো ।

কী হলো খাও, নরম হয়ে গেলে আর ভালো লাগবে না । নিলুফার জারা’র পাশে বসে বললেন –

মন খারাপ ?

জারা কোনো উত্তর দিলো না ।

মা শোনো জীবনে অনেক সময় অনেক ভুল হয়ে যায় । কিছুটা ইচ্ছাকৃত, কিছুটা অনিচ্ছায় । তোমার এই ভুলটা তো অবশ্যই বড় একটা ভুল কিন্তু ইচ্ছা করে তো তুমি এটা করোনি । ভুল যখন হয়েই গেছে আর তুমি নিজেও বুঝতে পেরেছো যে কাজটা করা ঠিক হয়নি তখন আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করো । বিষয়টা একদম মুছে ফেলো জীবন থেকে । সবাই তো এখন একটু রাগ করবেই কিন্তু আমরা কেউ তোমার খারাপ চাই না । বাবা-মা যে কতোটা কষ্ট পেয়েছে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না । কতো স্বপ্ন নিয়ে, কতো আশা নিয়ে বাচ্চাদের বড় করি আমরা । সেই বাচ্চার সাথে যখন খারাপ কিছু হয়, বাবা-মা’র যে কেমন লাগে সেটা তুমি আজকে বুঝতে পারবে না । তোমার এখন খুব অভিমান হচ্ছে মা’র ওপর । মা কেন তোমাকে বাসায় ঢুকতে দিলো না কিন্তু মা’র দিকটা একবার ভেবে দেখেছো তুমি ? তোমাদের পেছনে জীবনের পুরোটা সময় ব্যয় করে ফেলেছে । কোনটাতে তোমাদের ভালো হবে, তোমাদের যেন কোনো কষ্ট না হয়, সারাক্ষণ এই নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে সে । একটা বাচ্চা বড় করতে মা’কে কতোটা কষ্ট সহ্য করতে হয় জানো ? সেই মা যখন বাচ্চাদের কাছ থেকে এমন আঘাত পায়, সেটা কী সহজে মেনে নেয়া যায় জারা ? মা এখন রাগ হয়ে আছে, দু’দিন পরে সব রাগ শেষ হয়ে যাবে তখন ঠিকই ছুটে এসে তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে । বাবা-মা’র ওপর রাগ, অভিমান করে থেকো না । কয়েকটা দিন যাক, সব ঠিক হয়ে যাবে । মন খারাপ করে থেকো না জারা । সারাদিন এমন মন খারাপ করে ঘরের ভেতর বসে থাকলে ভালো লাগে বলো ?

জারা মাথা নিচু করে বসে আছে । বাটির চানাচুরগুলো এর মধ্যেই নরম হয়ে গেছে । চোখের পানির কয়েক ফোঁটা চানাচুরের ওপরেও পড়লো ।

নিলুফার জারা’র হাত থেকে বাটিটা নিয়ে পিঠে হাত রেখে বললেন –

কাঁদছো কেন বোকা মেয়ে ?

আমি খুব খারাপ । সবাই আমাকে খারাপ বলছে এখন ।

কেউ তোমাকে খারাপ বলছে না । তুমি খারাপ হবে কেন ? একটা ভুল করে ফেলেছো শুধু । ভুল তো মানুষই করে আবার ভুল শুধরে নেয়ার সুযোগও তো আছে তাই না ?

আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করছে ।

এই খবরদার, এইসব বাজে কথা, বাজে চিন্তা একদম করা যাবে না । ছোট একটা ভুল মানেই জীবন শেষ না । আজ থেকে আবার নতুন করে শুরু করো । আমরা সবাই তো আছি তোমার পাশে । ওঠো তো, চলো আমার রুমে চলো । সানজিদা মন খারাপ করে আছে তুমি ওর সাথে কথা বলছো না দেখে । চলো তিনজন মিলে গল্প করবো এখন ।

আমার ভালো লাগছে না খালা ।

রুম থেকে বের হলেই ভালো লাগবে । চানাচুরটা তো নষ্ট হয়ে গেল । আবার করে দেবো ?

না এখন খাবো না ।

ঠিক আছে ফিরনীটা খাও । চলো আমার রুমে চলো ।

নিলুফার জারা’র হাত ধরে জোর করে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন ।

নিলুফার আর সানজিদা মিলে চেষ্টা করে যাচ্ছে জারা’র মন ভালো করার । সানজিদা ওর বন্ধুদের কতো রকম গল্প করে যাচ্ছে । গল্পের মাঝে ইয়াসমিন এসে হাজির হলেন জাফরিনকে নিয়ে । সানজিদাকে বললেন –

এই সানজিদা যা তো আমার জন্য মশলা চা বানিয়ে নিয়ে আয় । মাথাটা খুব ব্যাথা করছে ।

সানজিদা চলে গেলে জারা’র দিকে তাকিয়ে বললেন –

কী খবর তোর, কোথায় গিয়েছিলি ?

জারা থতমত খেয়ে গেল খালার কথা শুনে । নিলুফারের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি তাড়াতাড়ি বললেন –

আপা তোমার পায়ের ব্যাথাটা কমেছে ?

পায়ের ব্যাথার হিসাব পরে দেবো । এই তোকে কী জিজ্ঞেস করছি – এই কাজ করলি কেন ? বেশি বড় হয়ে গেছো ? বাপ-মা লাগে না তোমার ? আমরা সবাই মিলে কী রকম টেনশনে ছিলাম, জানিস তুই ? নিজের যা ইচ্ছে হবে তাই করে বেড়াতে হবে ? তোর বাপ-মা’র মুখের দিকে তো তাকানো যাচ্ছে না । কষ্ট করে তোদের বড় করেছে আজকের দিন দেখার জন্য ? তোর এতোই যখন বিয়ের জন্য তাড়া ছিল, তোর মা’র কাছে বলতি যে আমার বিয়ে দিয়ে দাও, ঘরসংসার করবো । দুইটা দিন আমাদের কেমন করে কেটেছে জানিস তুই ? আর এই জিনিস জুটিয়েছিস কোত্থেকে বল তো ? নিজে যেখানে পড়িস, ওখান থেকেও তো ভালো দেখে একটার সাথে……

আপা তুমি কী বলো এইসব ! এখন এগুলো বলার সময় ? মেয়েটা এমনিতেই ভয়ে অস্থির হয়ে আছে, তার ওপরে তুমি এসব কী বলে যাচ্ছো ?

কী রে তুই ভয় পেয়েছিস ? ওর ভয়ডর আছে না-কি ? ওর বুক ভরা সাহস , সে জন্যই তো এভাবে পালাতে পারলো ।

আপা চুপ করো ।

তুই চুপ কর । সব দোষ তাবাসসুমের । অনেকবার বলেছি হুজুরের কাছে যেতে, না তিনি আমার কথা শুনলেনই না ৷ এবার বোঝো মজা ।

জারা বড় খালার কথাগুলো সহ্য করতে পারছিল না । দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল । জারা চলে গেলে নিলুফার বোনের ওপর রাগ করলেন –

তুমি কী শুরু করলে আপা , এভাবে কেউ বলে ? মেয়েটা এমনিতে যথেষ্ট মানসিক আঘাত পেয়েছে । একটা ভুল করে ফেলেছে, তাই বলে কী.….

তুই চুপ কর । সবাই মিলে আশকারা দিয়ে এগুলোকে মাথায় তুলেছিস । আমার মেয়ে হলে আমি ঐ মেয়ের চেহারা দেখতাম না আর কোনো দিন ।

আপা অন্যের বেলায় বলা খুব সহজ কিন্তু নিজের সাথে যখন হয় মানুষ তখন বুঝতে পারে কী কঠিন সময় যাচ্ছে তার ওপর দিয়ে ।

আমি ঠিকই পারতাম ।

এ তোমার রাগের কথা আপা । বাবা-মা হলে অনেক কিছু পারা যায় না । একটা ভুল মানে কী তার জীবনটা তুমি শেষ করে দেবে ? জারাকে যদি এখন বাসা থেকে বের করে দেয়, একবার ভেবে দেখেছো মেয়েটা কোথায় যাবে ? ওর জীবনটাই তো অনিশ্চিত হয়ে পড়বে ।

আমি ঐসব জানি না । আমার মেয়ে অন্যায় করলে কোনো মাফ পাবে না আমার কাছে ।

থাক আপা ঐ সব কথা এখন না বলো না ।

.
.

খালার রুম থেকে এসে জারা সাদাতে’র রুমে ঢুকলো । তার খুব খারাপ লাগছে, খুব বেশি অস্থিরতা কাজ করছে ভেতরে । কেউ তাকে বুঝতে চাইছে না । সে তো সবার কাছে সরি বলেছে । সে যদি জানতো আদি এভাবে মিথ্যে বলেছে তার সাথে, তাহলে তো কবেই সম্পর্ক শেষ করে দিতো । সে জানে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়াটা ভীষণ অন্যায় হয়েছে কিন্তু সেই সময়ে তার নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না । আদি যেভাবে বলেছে, সে ঠিক সেভাবেই সবকিছু করেছে । বারবার করে ক্ষমা চাওয়ার পরেও কেউ তার সাথে ভালো ভাবে কথা বলছে না । মা তো তার সাথে কোনো কথাই বলেনি । এভাবে সবার অবহেলা সে সহ্য করতে পারছে না । চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে –

হ্যাঁ হয়েছে তো ভুল, একটা ভুল তো আমি করেছি । আমি সরিও তো বলেছি । তারপরেও তোমরা আমার সাথে এমন করছো কেন ? সরি বলার পরে আর কী চাও তোমরা ? আমি মরে গেলে তোমরা খুশি হও ? মরে যাবো আমি কিন্তু কেমন করে মরবো ? চাইলেই তো মরে যাওয়া যায় না তাহলে আমি মরবো কেমন করে ?

জাফরিন সানজিদাকে বললো –

আমার মা সবসময় বেশি কথা বলে । আমার ভাল্লাগে না এইসব । আজকে আসার সময় বাবা বলেও দিয়েছে উল্টোপাল্টা কোনো কথা যেন জারা আপুকে না বলে অথচ দেখো এখানে এসেই মা শুরু করে দিলো । ইশ জারা আপু কী রকম মন খারাপ করে চলে গেল । চলো আমরা জারা আপুর রুমে যেয়ে গল্প করি । তাহলে ওর মনটা ভালো হবে ।

সানজিদা আর জাফরিন জারা’র সাথে গল্প করার জন্য আসলো । জারা বিছানায় বসে আছে । ওরা আসতেই জারা ফিরে তাকালো দু’জনের দিকে । সানজিদা ছুটে এসে চিৎকার করে উঠলো –

মা তাড়াতাড়ি আসো ।

জারা চুপ করে বসে আছে । ডান হাতে কাঁচি ধরা , বাম হাত দিয়ে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়া রক্তের ধারা সাদা টাইলসের ওপর এলোমেলা চিত্র তৈরি করে চলেছে ।………………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here