এক প্রহরের খেলা, পর্ব:২০

0
347

#এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি

২০||
জায়গাটা লোকে লোকারণ্য। গাড়ী চলাচল আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তার উপরে বড় বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে দুপাশ আটকে দিয়েছে স্থানীয় লোকজন। দুর্ঘটনার জায়গাটা ছাড়া রাস্তার দু’ মাথাতেই গুড়ির ওপাশ থেকে গাড়ীর লম্বা লাইন বহুদূর পর্যন্ত গেছে। একদল ঝিনাইদহের দিকে মুখ করে আছে, আরেকদল ঢাকামুখী। প্রত্যেকেই অপেক্ষায় আছে। এই বুঝি জ্যাম ছুটবে। বিশেষ করে পেছনের দিকের গাড়ীগুলো ঘটনা জানতে না পারায় তাদের অস্থিরতা আরো বেশী। কেউ কেউ আবার গা এলিয়ে পড়ে আছে। একটা গাড়ীতে দেখা গেলো গান বাজছে।
-” জিনে কী হ্যায় চারদিন ওওও…
বাকিকে বেকার দিন ওওও….!”

এরই মধ্যে আচমকাই ধুম করে পটকা ফাটার মতো শব্দ হলো বাইরে। তার পরপরই খিস্তি খেউর। মুহূর্তেই সচকিত হয়ে উঠলো যাত্রীরা। প্রায় সবাই জানালা দিয়ে ঘটনা কী তা বোঝার চেষ্টা করছে। দেখা গেলো একজন আধাপাগল গোছের লোক ইচ্ছামত চিৎকার করছে।

-” এই শালাগো দিলে কী দয়া মায়া নাই ? শালারা ঐখানে মানুষ মরছে আর এইখানে অরা গান বাজাইতাছে । শালা বড়লোকে গো আল্লায় খালি শইলডা দিসে । বিবাক দেয় নাই। হেগো বিবাক মিরতো। হোই সব গাড়ী বন। শালাাগো একটা গাড়ি আইজ যাইবার দিমু না। শালারা মানুষের লাশ সামনে লইয়া ফুর্তি মানায়, শালার বড়লোক। থুহ্…!” চিৎকার করে বলে উঠলো লোকটা । তার সাথে যোগ দিয়েছে আরো কয়েকজন। তবে এরা বেশীর ভাগই সুযোগ সন্ধানী। বাস বা ট্রেন দুর্ঘটনার সময় এদের দেখা যায় সক্রিয় হতে। তবে দলের নেতৃত্বে যে লোকটা চেঁচাচ্ছে তার মনোভাব এদের মতো নয়। তাকে দেখলেই মনে হয় বাস্তবিকই সে মানুষের নির্দয়তার বিরক্ত। তার চিৎকার চেঁচামেচিতেই পরিবেশটা বেশ থমথমে হয়ে উঠলো। মুহূর্তেই থেমে গেলো গানটা। গানের তালে তালে এতক্ষণ যারা কোরাস মেলাচ্ছিলো তাদের মধ্যে প্রভাব ফেললো কথাগুলো। মধুর ধমক তাদের চমকিত করেছে বোঝা গেলো। দলের মেয়েগুলোও বেশ ভয় পেয়েছে। কারণ একটু আগে গাড়ীর বনেটেও দমাদম চাপড় মেরেছে কেউ। গাড়ীর মেয়েগুলো ভয় পেলেও ছেলে দুটো হয়ত বুঝতে পারলো ভয়টা অমূলক। কারণ বাকিরা সবাই শান্তই আছে। এরা হয়ত সুযোগের অপেক্ষায় আছে। চেঁচাচ্ছে কেবল ঐ আধাপাগল লোকটা । সেই সুযোগে এরা একটা সিনক্রিয়েট করার চেষ্টা চালাচ্ছে ।এদের বাড়তে দেয়া ঠিক হবেনা। ব্যপারটা মনে আসতেই সামনের সিটে বসা তরুণটা রাগে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলো। বুক চিতিয়ে এগিয়ে গেলো সে।
-” হেই, হোয়াটস দা প্রবলেম। রাস্তা আটকেছিস ক্যান ?” বলেই মধুর কাঁধে ধাক্কা মারলো তরুণটা। সাথে সাথেই যেন মৌচাকে ঢিল পড়লো। পাগলটা ক্ষেপে গিয়ে তেড়ে উঠলো একেবারে।
-” ঐ মিয়া, গায়ে হাত দিবেন না কইলাম। কেউর বাপেরটা খাইও না পিন্দিও না। মধু কেউরে ডরায় না। এতো গরম দেহান কারে ? শালা আপনেরা মানুষ না পশু ? ঐখানে মানুষ মরছে আর আপনে গো মনে রঙ লাগছে যে গান বাজনা করতাছেন ? যান, রাস্তা বন। কুনু গাড়ী যাইবো না। কারে ফুন করবেন করেন গা। আইছে ফুটানি মারাইতে। হুঁহ…!”

মধু নামের লোকটার নির্ভিক আচরণে সামান্য হকচকিয়ে গেলো ছেলেটা। ঝামেলায় যাওয়াটা সমীচীন মনে করলো না। দুর্ঘটনার ব্যপারটা হয়ত তার জানা ছিলো না। সে মিনমিন করে কিছু একটা বলতে বলতে সরে গেলো । মধু নামক স্বেচ্ছাসেবক লোকটাকে এবার দেখা গেলো লাঠি হাতে চিৎকার করতে করতে ঘটনাস্থলের দিকে হেঁটে যেতে।

ঘটনাস্থল এখন থমথমে। একটু আগেও মহা হুলুস্থুল বেঁধে গিয়েছিলো। বাসটাকে যে বা যারা পড়তে দেখেছে তারাই চিৎকার চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করে ফেলেছিলো। তারপর একদল ছুটে গিয়ে ডোবা থেকে কিছু লাশ উদ্ধার করে ডাঙায় তুলেছে। যারা বাসের জানালা দিয়ে ছিটকে পড়েছিলো তাদের মধ্যে যারা ডোবায় পড়েছে তারা আহত কম হয়েছে। বাকি যারা এদিক সেদিক পড়েছে তারা বেশ জখম হয়েছে। পুলিশকে সাথে সাথে খবর দেয়া হলেও তাদের আসতে দেরী দেখে স্থানীয় লোকজনই ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধারকাজে। মোটামুটি সবাইকে উদ্ধার করার পর জানা গেলো পাঁচজন ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। ড্রাইভার সহ ড্রাইভিং সিটের পাশে বসা তিনজনের অবস্থা বেশ গুরুতর।

পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছানোর পর পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেলো। পুলিশ এসে আহত তিনজনকে তৎক্ষণাৎ স্থানীয় হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা নিলে একজন পথিমধ্যেই মারা যায়। অপর দুজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থাতেই হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। বাকী যারা আছে তারা সবাই কমবেশী আহত। এদেরকেও হাসপাতালে পাঠানো হলে কয়েকজনকে ফাস্ট এইড দেবার জন্য পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেলো আর কয়েকজনের আঘাত গুরুতর বলে ভর্তি রাখা হয়েছে।

বাকী মৃতদের ডাঙায় তুলে সারি করে শুইয়ে রাখা হয়েছে। উৎসুক জনতা এখন নিরাপদ দুরত্বে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে স্যুটিং দেখার মতো করে পুলিশের তৎপরতা দেখছে। থানা থেকে প্রথমে চার সদস্যের নিয়ে টিম নিয়ে এস.আই সাহেব এসেছেন। তিনি এসেই স্থানীয়দের সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছেন। আহতদের হাসপাতালে পাঠানোর কাজটাও তারই কিন্তু মৃতদের সামনে থেকে জনতার জটলাকে তিনি সরাতে পারেন নি। এদিকে থানা থেকে বেশ কয়েকবার ফোন করে বলা হচ্ছে, সকাল আটটার সময় মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় এই পথ দিয়ে যাবেন। কাজেই এর মধ্যে রাস্তা ক্লিয়ার করতে না পারলে বিরাট সমস্যায় পড়ে যেতে হবে তাদেরকে। এস.আই সাহেব ফোনে এখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে মোটামুটি সবকিছুই জানালেন ওসি সাহেবকে। সংবাদ পেয়ে আধা ঘন্টার মধ্যে ওসি সাহেব এসে হাজির হলেন। জনতার সাইকোলজী ভালোই বোঝেন তিনি। তিনি এসেই প্রথমেই স্থানীয় মাতব্বর গোছের কয়েকটাকে ডেকে নিয়ে গোল মিটিং করলেন। কনস্টেবলদের উপর হম্বিতম্বি করে এস.আইকে আহত ও নিহতদের লিস্ট বানাতে বললেন। এস. আই জানালেন তিনি অলরেডী আহতদের নাম লিস্ট করে ফেলেছেন কিন্তু নিহতদের সবার পরিচয় এখনও বের করা সম্ভব হয়নি। ওসি সাহেব কর্তব্যরত সকলকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে মধুকে ডাকলেন। মধুর সম্পর্কে আগেই শুনেছেন তিনি। ওর হম্বিতম্বি আর স্থানীয় জনগনের উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দেখে বাকিটা যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন ওসি সাহেব । মধুকে আসতে দেখে এগিয়ে গিয়ে আন্তরিকতার সাথে ওর কাঁধে হাত রাখলেন তিনি।

-” মধু, অনেক সাধুবাদ জানাই তোমাকে। তুমি দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে মৃতের সংখ্যা হয়তো আরো বাড়তো। ধন্যবাদ দিয়ে তোমাকে ছোট করবো না। ”

-” কি যে কন সার। আমি পাগল ছাগল মানুষ। তয় পদক্ষেপ নেওনের লিগা আমার বউরে দন্যবাদ দেওন দরকার সার। বেডি গুস্সা অইলেই রাইত আর দিন দেহেনা সার। ঘর থন বাইরোইয়া যায়। হেয়ই বাসডারে পড়তে দেইক্কা দুর দিয়া আমারে ডাকছে। সবেরে ডাকছে। নাইলে এই কানা রাইতে এতো লুকজন তো থাহে না। ”
-” সেটাই বলছিলাম মধু। তুমি আর তোমার বউ যথেষ্ট করেছো। এবার আরেকটা কাজ যে করতে হয় মধু। ”
-” কন সার।”
-” রাস্তার ব্যারিকেড গুলো তুলে নাও। একসিডেন্টটা যে ইচ্ছাকৃত নয় সেটা তুমিও জানো। অযথা লোকগুলোকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী বলো ? ”
-” এসকিডিন ইচ্ছামতুন অয়নি এটা নাহয় মানলাম সার কিন্তুক মানুষডিরে বাচানির লিগা আপনের থানার তন কেউ আসেনাই। আমরা এইডার লিগা মন্ত্রী সাবেরে নালিশ দিবার চাই। আমি খবর পাইসি ভুরবেলা তিনি এদিক দিয়াই যাইবো। তারে আমাদের দরকার। এই রাস্তাডায় পরায় পরায়ই এসকিডিন হয়। এইডারও বিহিত হওন দরকার।”
-” মধু। আমার উপর আস্থা রাখো। প্রশাসনের সাথে কথা যা বলার আমি বলবো। বাকিদের কষ্ট দিয়ে এমনিতেও কোন লাভ নেই। বরং হীতে বিপরীত হতে পারে। আমার কথা শোনো। রাস্তাটা খুলে দাও। তুমি হয়তো মন থেকেই সমাধান চাও। অনেকর এটাকে পুঁজি করে লুটপাটের ধান্ধা করছে। এরইমধ্যে কিছু বিশৃঙ্খলার খবর আমার কানে এসেছে। এটার দায় তুমি এড়াতে পারবেনা মধু। তোমাদের যা বলার তার জন্য থানা তো আছেই। আমরা সেখানে স্থির হয়ে বসে দুটো কথা বলতে পারি। এইমুহূর্তে আসলে কোন কথা হবার নয় মধু। বরং যানজট বাড়লে পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। তখনআসল বিপদ দেখা দিবে। মৃতগুলোরও তো ব্যবস্থা করা দরকার।”
মধু কিছুক্ষণ এদিক সেদিক তাকিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর ক্লান্ত ভঙ্গিতে সালাম ঠুকে সরে গেলো। মোটামুটি একঘন্টার মধ্যেই ওসি সাহেবের বিচক্ষণতায় মহাসড়কটি যানজট মুক্ত হলো।
নিহতের স্বজনেরা এবার সবাই এবার ভীড় করলো সদর হাসপাতালে। যারা অল্প আহত তাদের সাথে কথা বলেই তাদের আত্মীয় স্বজনকে খবর দেয়া হলো। এস.আই জানালেন গুরুতর আহত লোকটার জ্ঞান এখনও ফেরেনি। কাজেই তার সম্পর্কে কোনো খোঁজ খবর বের করা সম্ভবপর হয়নি। তবে তার বুক পকেটে মোবাইল পাওয়া গেছে। ওসি সাহেব সব শুনে তার মোবাইলের সর্বশেষ কলারের কাছে ফোন করে তার সম্পর্কে খোঁজ নিতে বললে এস.আই সাহেব তখনই চলে গেলেন।

=====

-” আস্সালামুআলাইকুম, নাম বলেন আপনার ? এই নম্বরধারী আপনার কী হন ? ”
-” মানে ? কে বলছেন আপনি ?” ঘুম ঘুম গলায় কথা বলে উঠলো আজাদ। ঘুম ভেঙে মাত্রই মোবাইলটা ওপেন করেছে সে। এরই মধ্যে এই ফোন। ওপাশ থেকে লোকটা বললো,
-” আমি কে সেটা না জানলেও চলবে। আপনি এই মোবাইল মালিকের কী হন সেটা তাড়াতাড়ি বলেন ! ”
-” আমি কী হই মানে কী ? আচ্ছা, এই ফোনটা আপনার কাছে কেন বলুন তো ? ” বলেই আজাদ ফোনটা আরেকবার চোখের সামনে ধরলো। ঘুমের ঘোরে কী ভুল দেখলো নাকি ? নাহ্, রূপম রিজভীই তো। ইন্সপেক্টর সাহেবের সাথে কথা বলার সময়ই সেভ করে নিয়েছিলো এই নামটা। কিছুটা বিরক্ত হয়ে কনুই এর ভরে সামান্য উঁচু হলো। আর তখনই আজাদের ঘুম ঘোর পুরোপুরি কেটে গেলো মুহূর্তেই । স্তব্ধ বিস্ময়ে নির্বাক শুনে গেলো কথাগুলো। ফোনটা হাত থেকে খসে পড়ার উপক্রম হলো। নিজেকে সামলে নিয়ে ফ্যাসফেসে গলায় কেবল বলতে পারলো, ” কী বলছেন কী এসব ? আর ইউ শিওর ? কোত্থেকে বলছেন আপনি ? ”
আজাদের প্রশ্নের উত্তরে যান্ত্রিক সুরে উপজেলা সদর হাসপাতালের নামটা বলেই ফোন কেটে দিলো লোকটা। আজাদের মনে হলো ও ভুল শুনেছে। অঘুমো রাতের ঘুমঘুম নেশা হয়তো এখনও কাটেনি। সেকারণেই কী শুনতে কী শুনেছে। সে পাল্টা ফোন করলো রূপম রিজভীর নম্বরে। গতরাতেই তো এই নম্বরে কথা হয়েছে রুমকির বরের সাথে। মাত্র এইটুকু সময়ের মধ্যে এসব কী শুনছে সে ? নিশ্চয়ই ফোনটা ছিনতাই করেছে কেউ। ছিনতাই করতে গিয়ে মারা পড়েছে। আচ্ছা, রুমকির নম্বরে কী ফোন করে জানতে চাইবে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে ? রুমকি কী ওর ফোন ধরবে ? ফোন রিসিভ হলে আজাদ দ্রুত বলে উঠলো।
-” হ্যালো, রুপম বলছেন ? ”
-” আমি ঝিনাইদহ থানা থেকে সাব ইন্সপেক্টর মামুন বলছি। এই মোবাইলটা যার কাছে পাওয়া গেছে তিনি এখন বাস একসিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আপনারা কাইন্ডলি সরাসরি উপজেলা সদর হাসপাতালে চলে আসেন। রুগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক।” আজাদ বুঝতে পারলো এটা প্রথমজন নয়, অন্য কেউ রিসিভ করেছে ফোনটা কিন্তু এসব কী শুনছে সে ? ওর কান মাথা সব একসাথে ভোঁ ভোঁ করতে লাগলো। ঘোরের মধ্যেই কেবল মনে পড়লো আজ রুমকি তার বরের সাথে ঢাকা ফিরে যাবার কথা। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো এবার।তাহলে কী ফোনের কথাগুলো সত্যিই !! কাঁপা হাতে আব্দুল্লাহ মামার নম্বরটা খুঁজে বের করে নির্দ্বিধায় ডায়াল করলো আজাদ। ভালো করেই জানে এই ভোর বেলা আজাদের ফোন পেয়ে তিনি খুশি হবেন না। হয়তো বিশ্বাসও করবেন না কিন্তু উপায় নেই। তাকে বিশ্বাস করতেই হবে। কারণ তিনি তো জানেন যে তার মেয়ে গত রাতের বাসে ঢাকা যাচ্ছিলো। আজাদ নিজে এখন অনেকটা দুরে নয়তো নিজেই সেখানে ছুটে যেতো।
ফোন বেজে বেজে থেমে গেলো। কিন্তু আব্দুল্লাহ মামা ধরলেন না। আজাদ জানতো এমনটাই হবে। তারপরেও সে ক্রমাগত ফোন করেই যেতে লাগলো। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে নিশ্চয়ই ফোনটা ধরবেন মামা। কিন্তু বারবার বাজার পরও ফোনটা কেউ না ধরায় আজাদ কিছুটা অস্থির হয়েই বিছানা থেকে নামলো। ঘাড় ফিরিয়ে অদিতিকে দেখলো একবার। মেয়েটা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। চেহারায় রাজ্য জয়ের পর মুহূর্তের ক্লান্তি। মহিয়সীর মতো দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। ঘুমুলে কী মানুষকে এতোটাই নিষ্পাপ দেখায় ? তাকে নিশ্চয়ই দেখায় না। কারণ সে নিজে মোটেই ইনোসেন্ট না। ভাবতে ভাবতেই প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে কান থেকে ফোন সরিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো আজাদ। একটু দুঃখিতও হলো কারণ ফোনটা সরাসরি তার নবপরিণীতার হাতে গিয়ে লেগেছে। ভেবেছিলো মেয়েটার ঘুম ভেঙ্গে যাবে কিন্তু নাহ্, ভাঙেনি। সে এখন পাশ ফিরে শুয়েছে। আজাদ মনে মনে অস্থির বোধ করলো এবার। সংবাদটা ওকে ভেঙেচুরে একাকার করে দিচ্ছে একেবারে। রুমকির সাথে এতোবড় অঘটন ঘটে গেলো ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। পরক্ষণে নিজেকেই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হলো। অবচেতন মনের একটা অংশ বলে উঠলো, রুমকির জীবনে এই অঘটনের জন্যেও তুইই দায়ী আজাদ। নইলে মেয়েটা হয়তো আজই ঢাকা ফিরে যেতো না। কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই ফের হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নিলো আজাদ। এবার ফোন চাপলো মায়ের নম্বরে। মা’কেই বলতে হবে সে যেন নিজে মামাদের বাড়ী গিয়ে রূপমের খবরটা দিয়ে আসে। এছাড়া আর কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছেনা সে।

দ্রুত মায়ের নম্বরে কল দিলো আজাদ। প্রায় সাথে সাথেই রিসিভ হলো কলটা। আজাদের কাছে মনে হলো মা যেন হাতে নিয়েই বসে ছিলেন মোবাইলটা। হড়বড় করে রিসিভ করেই তুবড়ি ছোটালেন তিনি।
-” হ্যালো কে আজাদ ? ”
-” হ্যাঁ, মা। ”
-” কী রে তোর ফোন বন্ধ কেনো ? সেই রাত থেকে পাগলের মতো চেষ্টা করছি। বারবারই বলছে সংযোগ দেয়া সম্ভব না। এটা কেমন কথা যে প্রয়োজনেও ফোন দিয়ে তোকে পাওয়া যাবেনা ? ”
-” মা, আমি তোমাকে আগেই বলেছি আমি কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতে চাই। সে কারণেই ফোন সুইচড অফ রাখতে হচ্ছে। গতকাল থেকে মাত্র তিনবার ফোন খুলেছি। একবার তোমার সাথে কথা বলার জন্য আরেকবার রুমকির স্বামীর সাথে কথা বলার জন্য। আর আজ সকালে খুলেছিলাম….!”
-” রুমকির জামাই এর সাথে তোর কী কথা ? তুই তাকে কেন ফোন দিবি ? তাহলে কী রাজনের কথাই সত্যি নাকি ? ” আজাদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন জাহানারা।
-” মা রাজন ঝড়ে বক মেরেছে আর স্কোর করে ফেলেছে। আমি ওর কাছে এরকম কিছুই বলিনি যে আমি আমার অংশ রুমকিকে দিতে চাই। এটা ও তোমার কাছে কেন বলেছে সেটা আমি ওর কাছ থেকেই শুনবো। তবে ডিসিসানটা আমি পরে নিয়েছি এটাও সত্যি। যাই হোক, আমি যেটা বলতে ফোন করেছি….!”
-” রাখ তোর কথা। তুই আগে আমার কথা শোন্ । খবরদার যদি জায়গা সম্পত্তি রুমকিকে দেবার নাম নিয়েছিস তো। রুমকি আমাদের জন্য মরে গেছে। বড় শখ করেছিলাম মেয়েটাকে বউ করে ঘরে আনবো। আমার ভাই বেইমানী করে রাতারাতি মেয়ে পার করলো। ওর কী হয় দেখিস না। আমার ঘর উজাড় করে সে আরেক ঘর বসাতে গেছে। মুখে মুখে কী মিষ্টি কথা, ফুপু ফুপু, আজাদ ভাই আজাদ ভাই…! আর গোপনে গিয়ে কী সুন্দর বিয়ে করে ফেললো। তোর নিজের কী খারাপ লাগেনি? ”
-” এজন্য তুমি দায়ী। আমি সরাসরি তোমাকেই দায়ী করবো। কেন অযথা ঐ মেয়েটাকে দুষছো ? ”
-” একশ বার দুষবো। তোর এতো লাগে কেনো ? ওর দুঃখেই তো বিয়ে করলি এক হিন্দুকে। আমি জীবনে ঐ মেয়েকে মেনে নেবো মনে করেছিস ? ”
-” ও হিন্দু তোমাকে কে বলেছে ? ” আজাদ বিপন্ন বোধ করলো হঠাৎ। যা বলার জন্য ফোন করেছে তা বলার সুযোগই পাচ্ছেনা। মায়ের সাথে কথা বলার এই এক জ্বালা। দাড়িকমা ছাড়া ননস্টপ রেলগাড়ী ছোটাতে থাকে। আজাদ কিছু বলার আগেই শুনলো,
-” হিন্দু তো অবশ্যই। ওর নাম শুনেই আমার সন্দেহ হয়েছে।”
-” তোমার নামও তো জাহানারা, তাই বলে কী তুমি মুসলমান ? ” আজাদ এবার কিছুটা ক্ষেপে গেলো। জাহানারা হতভম্ব হয়ে বললেন,
-” তার মানে ? আমি তবে কী ? ”
-” সে তুমি জানো। কিন্তু মুসলমান কিনা তা হলফ করে বলতে পারবে ? মুসলমানের তো আল্লাহর উপর বিশ্বাস থাকে। আখিরাতে বিশ্বাস থাকে। তার কাজকর্ম পরিচালিত হয় আল্লাহর ভয়কে মাথায় রেখে। তোমার কোনটা আছে শুনি?”
-” আমি কী এমন করলাম যে আজ তুই আমাকে এসব কথা বলছিস? আমার বাপ ঐ যুগেই খাসি জবাই দিয়ে আমার নাম রেখেছিলো।”
-” তাতেই তুমি মুসলিম হয়ে গেলে ? শোনো মা, শুধু নাম দিয়েই যদি কেউ মুসলমান হতো তাহলে এদেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষই মুসলমান হতো। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখো গিয়ে কতজনের মনে আল্লাহ আর আখেরাতের ভয় আছে । পঞ্চাশ পার্সেন্টও হবে কিনা সন্দেহ আছে আমার ।”
-” খুব যে বড় বড় কথা বলছিস ? ঐ মেয়ে একরাতে অনেক সবক শিখিয়ে দিয়েছে দেখা যায়? ”
-” অনেক সবক শেখায়নি মা তবে এটুকু শিখিয়েছে যে একটা মেয়ের সম্মান সবার আগে তার নিজের কাছে। সে নিজে যদি নিজেকে সস্তা করতে না চায় তবে তাকে সূলভে পাওয়া বড় মুশকিল। যেটা নিজের অবস্থানের জোরে কিংবা ক্ষমতার জোরে সমাদ্দাররা পায়নি কিন্তু বিশ্বাসের জোরে আমি পেয়ে গেছি। মেয়েটা যথেষ্টই বুদ্ধিমতী । তুমি ওকে না মানলেও আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন থেকে আমি যতদিন বাঁচবো ওর জন্যই বাঁচবো।”
-” বাহ্, এই না হলে সন্তান ? এজন্যেই কী তোকে পেটে ধরেছিলাম? ”
-” কেন পেটে ধরেছিলে সে তুমি জানো কিন্তু তোমার নিজের জন্যে বা আমার জন্যেও আমাকে উপকারী করে গড়ে তোলোনি। কেবল পরের জিনিস লুটতে শিখিয়েছো। যাক্, যেজন্যে ফোন দিয়েছিলাম সেটাই বলার সুযোগ এখনও পেলাম না। এখন তো মনে হচ্ছে বলেও বিশেষ লাভ হবেনা। শুনে হয়তো তুমি খুশিই হবে। রুমকি গতরাতে ওর স্বামীর সাথে ঢাকা ফেরার পথে বাস একসিডেন্ট করেছে। রুমকির স্বামীর অবস্থা তেমন ভালো না। ওর মোবাইলে আমার নাম্বার সবার সামনে ছিলো বলে পুলিশ আমাকেই সরাসরি কল করেছে আর সৌভাগ্যক্রমে আমার মোবাইল খোলা পেয়ে গেছে। রুমকির কোন খবর এখনও জানিনা। এবার তুমি সিদ্ধান্ত নাও। খবরটা মামাকে জানাবে কী না। রুপমদের কাউকে আমি জানিনা নয়তো আমিই ফোন করে ওদের বলে দিতাম। এখন রাখি মা।” বলে আজাদ ফোন রাখতে গিয়েও মায়ের অন্যরকম আদ্র কণ্ঠে থেমে গেলো।
-” আজাদ শোন্।”
-” বলো ! ”
-” সত্যিই কী রুমকি..?”
-” একসিডেন্ট নিয়ে কেউ মিথ্যে বলেনা মা।”
-” ওহ্। ইয়ে, তোর কাছে দুটো ছেলে এসেছিলো গতকাল সন্ধ্যায় । আমাকে খুব আম্মা বলে ডাকছিলো। বললো তুই নাকি ওর কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাস। তোকে ছাড়া দেবেনা বললে আমি ওদের বলতে বাধ্য হয়েছি যে তুই কুয়াকাটা গেছিস নতুন বউ নিয়ে। ছেলেটা চেক ভাঙিয়ে আসছি বলে তো আর এলো না। আমার তো খুব চিন্তা হচ্ছে। ”

রাগে দুঃখে অভিমানে এবার কথা আটকে এলো আজাদের। কিছুক্ষণ নিরব থেকে শান্ত স্বরে বললো, ” চিন্তার কী আছে মা। খুব বেশী হলে ওরা তোমার ছেলেকে মেরে ফেলবে আর মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ফুর্তি করবে। তোমার তো আর কোন ক্ষতি হচ্ছেনা। কাজেই চিন্তা করে লাভ কী। সত্যিই মা, তোমার মত মায়েদের আসলে কিসে যে লাভ সেটাই বুঝলাম না। যাক্ , অনেক বড় একটা উপকার করেছো আমার। আমার শত্রুকে আমার গতিবিধি জানিয়ে দিয়ে। এই না হলে মা। রাখলাম আমি ।” বলেই ফোন কেটে দিলো আজাদ। আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ফোন সুইচড অফ করে দিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইলো কয়েক মিনিট। তারপরই চট জলদি সিদ্ধান্ত নিলো। হাত বাড়িয়ে মৃদু ধাক্কায় অদিতিকে জাগিয়ে দিতেই সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো।
-” কী…কী হয়েছে ? ”
-” দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নাও। আমরা আধাঘন্টার মধ্যে বেরুবো। ”
-” এখান থেকেও ? ” সদ্য ঘুম ভাঙা চোখদুটোতে রাজ্যের বিস্ময়। আজাদ সেদিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালো, ” হম, কুইক। দেরী করলে বিপদ হতে পারে।”
-” ওহ্, আজাদ। তুমি বড্ড ইনসিকিওরড ফিল করো। আমার তো মনে হয় তোমার ভয় পুরোটাই অমূলক। তাছাড়া তুমিই তো বললে, এখানে কোন ভয় নেই। ” অদিতির কণ্ঠে আহ্লাদের সুর। মেয়েটা গতরাত থেকেই তুমি করে ডাকছে ওকে। আহ্লাদিরও সীমা ছিলো না। মেয়েদের এই একটা অদ্ভুত সাইকোলজি। প্রথমে তো নিজেকে দেখতেও দেবেনা। অধিকার দেবার পর নিজেরাই উপযাচক হয়ে প্রানটা পর্যন্ত সঁপে দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
আজাদ নিরাসক্ত চোখে তাকিয়ে কেবল বলল ,” পনের থেকে বিশ মিনিট সময় পাবে। এর এক সেকেন্ড বেশী না। ” বলেই হাফপ্যান্ট বদলে নিজের প্যান্টটা পড়লো। গতরাতেই বীচ থেকে দুটো কিনেছিলো জলকেলি করার জন্য। সমুদ্রে নামা না হলেও এখন বেশ কাজে দিচ্ছে ওগুলো। আজাদ গেট পর্যন্ত গিয়ে ফিরে তাকিয়ে বললো, ” এই যে শোনো, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। ফিরে না আসা পর্যন্ত ভুলেও দরজা খুলবে না। আমার সঙ্কেত হবে প্রথমে দুটো টোকা একসাথে। ত্রিশ সেকেন্ডের বিরতি দিয়ে আবার একটা টোকা। তারপর বলবো, ‘গাড়ী’ । এটা হলো কোড ওয়ার্ড। এটা শুনেই দরজা আনলক করবে তার আগে না।”
-” এতো কিছু কেন বুঝলাম না ? আমার নাম ধরে ডাকলেই হয়। দুই টোকা তিন টোকা, গাড়ি..! ” বিড় বিড় করে বিছানা ছাড়লো অদিতি। ওর বলার ভঙ্গিতে হাসি পেলেও হাসলো না আজাদ। মনটা এমনিতেই ভীষণ অস্থির হয়ে আছে।
গম্ভীর স্বরে বললো, ” যারা আসবে তারা তোমার নাম ধরে আমার ভয়েস নকল করেও ডাকতে পারে। তখন কী করবে তুমি ? না বুঝে তো বলিনি। নাও, ভেতর থেকে গেট আটকাও। ” মৃদু ধমকের সুরে বলেই বেরিয়ে গেলো আজাদ।
অদিতিও আর কোনো তর্ক করলো না। গত দুদিনের পরিচয়ে এতোটুকু বুঝতে পারছে যে লোকটা বড় একরোখা। মাঝেমধ্যে তো গোঁয়ারদের মতো আচরণ করে। এই এখনই তো। কেমন বেরসিকদের মতো করে কথা বলছে। কে বলবে এটা গতরাতের আজাদ ! যে ওকে ভালোবাসায় ভাসিয়ে দিয়েছিলো। ওকে এখন সন্ধ্যার সেই ভুতে ধরা আজাদ বলে মনে হচ্ছে। তবে এটা ঠিক যে, লোকটার মনটা বড় ভালো। আর এটা অদিতি তার সাথে পরিচয়ের পর থেকেই টের পাচ্ছে। কাজেই ওকে ক্ষেপাতে রাজী নয় সে। শুধু অপেক্ষায় আছে কবে লোকটাকে নিয়ে একটু থিতু হতে পারবে। ভাবতে ভাবতেই দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে এবার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো অদিতি। লোকটা হয়তো একটু পরেই ফিরে আসবে। তারপর সারাদিনের জন্য আবার বাইরে বাইরে। অযথা গোসলটা মিস করা ঠিক হবেনা।
=====

কোহিনূর মেয়ে হিসেবে যথেষ্ট করিৎকর্মা । স্বামী বাউন্ডুলে হলে স্ত্রী’র করিৎকর্মা না হয়ে উপায় থাকেনা। কারণ তার স্বামী মধু নামেই মধু। মধুর সামান্যতম মিষ্টতা যদি ওর মধ্যে থাকতো তাহলেও একটা কথা ছিলো। সেটা দিয়েই পেট ভরাতো কোহিনূর। কিন্তু ঐ অকর্মার ধাড়ি স্বামী, সারা এলাকার ঠেকা নিয়ে রাখলেও তার সংসারের ঠেকা সে নিতে পারে নাই। ওটা কোহিনূরের একলার দায়। সেকারণেই ঝুড়ি বেচে, পরের বাড়ীর ধান ভেনে, উঠানে লাগানো গাছগুলো থেকে লাউটা কুমড়োটা বিক্রি করে নিজের পেট পালতে হয় সাথে ঐ একরত্তি সন্তান মনুটার। ওর কারণেই চেয়ারম্যান বাড়ী কাজ করতে যায় কোহিনুর। নয়তো একলার পেট হলে যেতো না। নিজের বাড়ীতেই মমুখ থুবড়ে পড়ে থাকতো আর মধুর মধুমাখা কথা শুনতো। কিন্তু সেটা তো আর হবার নয় সেকারণেই রোজ দুবেলা চেয়ারম্যান বাড়ী যাওয়া। সেদিনও চেয়ারম্যান বাড়ীর কাজ সেরে বাড়ী ফিরছিলো। চেয়ারম্যানের ছোট ছেলেটার বিয়ে লেগেছে। মাঝরাত পর্যন্ত চলেছে চাল কোটা আর পিঠা বানানো। কোহিনূরকেও থাকতে হয়েছে সেখানে। চাল বেছে কুটে পিঠা বানিয়ে তবেই এক গামলা পিঠা নিয়ে বাড়ী ফিরেছিলো। ফিরতে সেদিন রাতই হয়ে গিয়েছিলো বলে বাড়ী ফিরেই মধুর সাথে বচসা বেঁধে যায় তার। ওর দেরী দেখে বাচ্চাটা কান্না করছিলো এটাই মধুর রাগ। যা তা বলে গালি দিয়েছিলো কোহিনুরকে। কোহিনুরও কম যায়না। একফোটা ছেলে সামলাতে পারেনা তো সে পারেটা কী ! কোহিনুরও রাগ করে ওর কপালে ঝাঁটার বাড়ী মেরে বেরিয়ে গিয়েছিলো বাড়ী থেকে। প্রবল ইচ্ছে ছিলো মধুকে এবার সাইজ করবে। এক সপ্তাহের জন্য চলে যাবে বাপের গ্রামে। থাকুক ছেলে নিয়ে একলা। আপনিই সোজা হবে। কিন্তু ঘটনা বাস্তবায়নের আগেই ঘটলো আরেক ঘটনা। কোহিনুর বড় রাস্তা পর্যন্ত আসার আগেই দেখেছিলো নির্মম একটি দুর্ঘটনা আর অসংখ্য মানুষের সমস্বরের চিৎকার। অত রাতে রাস্তাঘাটও খালি। কোহিনুর পাগলের মতো দৌড়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ মধুকে খবর দিলে মধূও ঐ পায়েই ছুটে আসে। সাথে এসে জোটে আরো কিছু লোকজন। মধু নিজেই কয়েকজনকে টেনে বের করেছে বাসের ভেতর থেকে। কেবল এই বোরকা পরিহিতাকে মহিলাটাকে সে ইচ্ছে করেই ধরেনি। চিৎকার করে বউকে ডেকে এনে তাকে দিয়েই বের করিয়েছে। মধুর এই একটা জিনিস ভালো। মেয়েদের ব্যপারে তার দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা। সারা দুনিয়ার মধ্যে কোহিনুর ছাড়া আর কোন মেয়েকে চেনেনা সে। এই একটা কারণে লোকটাকে ফেলে থাকতে পারেনা কোহিনুর। নইলে কবেই চলে যেতো।

মেয়েটা নিঃসাড়ে পড়ে আছে। জ্ঞান ফিরেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। বাস থেকে যখন মহিলাকে বের করেছে তখন বেচারী রক্ত আর কাদায় মাখামাখি অবস্থ ছিলো । মধু তখনই নির্দেশ দিয়েছে একে মহিলা সদনে নিয়ে যেতে। মহিলা সদন মধুর বাড়ী লাগোয়া। সেখানে শুধু মহিলাদের চিকিৎসা হয়। মধুর মতে, এই মহিলাকে সবার সাথে সদর হাসপাতালে পাঠানো ঠিক হবেনা। দেখা যাবে সেখানে বেচারীকে বারো ব্যাটার সাথে বারান্দায় ফেলে রাখবে। তারচেয়ে মহিলা সদনেই নিয়ে যাক। সেখানেও চিকিৎসা খারাপ হয় না। পরামর্শটা কোহিনূরেরও মনে ধরেছে। কারণ মহিলার পুরো শরীর কালো কাপড়ে ঢাকা। হাত পা পর্যন্ত। একে সব পুরুষের সাথে সদর হাসপাতালের বারান্দায় ফেলে রাখতে মন টানছিলো না। তাই মধুর সাথে একমত পোষণ করে একটা ভ্যান যোগাড় করে তাতে মহিলাকে একাই তুলেছে কোহিনুর। নিয়ে এসেছে মহিলা সদনে। নার্সের সাহায্য নিয়ে মহিলার ভেজা পোশাক আলগা করে তাকে নিজের নতুন শাড়ী দিয়ে পেঁচিয়ে দিয়েছে। এখন সে অর্ধোচেতনের মতো পড়ে আছে। জ্ঞান ফিরেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।
কর্তব্যরত ডাক্তার আপা মেয়েটিকে দেখে প্রাথমিক চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছে নার্সকে। সব ঠিক থাকলে কাল পরশু হয়তো ছেড়ে দেবে। তবে মেয়েটার ভাগ্য ভালো বলতে হবে যে হাত পা ভাঙ্গেনি। ওর জ্ঞান ফিরলে কথা বলতে হবে। তারপর ওর সাথে কথা বলে বাড়ী পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
রুমকিকে নড়েচড়ে উঠতে দেখেই দ্রুত তার কাছে ছুটে গেলো কোহিনুর। কান পাতলো ওর মুখের কাছে।
মেয়েটা বিড়বিড় করে একটা নামই উচ্চারণ করছে, ” ঋভূ…ঋভূ।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here