এক মুঠো প্রেম পর্ব -১৭

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ১৭

-প্রণব মেহরাজ চৌধুরী!!! ……

সুনশান পরিবেশে স্পৃহার মুখ থেকে অস্ফুটে নিঃসৃত শব্দ তিনটা প্রণবের কানে পৌঁছুতেই ওর ভ্রু যুগল আপনাআপনি-ই সংকুচিত হয়ে এলো। মেয়েটা প্রণবকে চেনে- এটা অস্বাভাবিক কিছু না! তবে ওর পুরো নাম কী করে এই মেয়েটা জানলো- সে ব্যাপারটাই ওর মনে প্রশ্ন সৃষ্টি করছে। প্রণব তো নিজের বাবার ‘চৌধুরী’ পদবিটা ব্যবহার করে না! তাই সন্দিগ্ধ কন্ঠে প্রশ্ন করে বসলো সে,

-আমার কয়েকজন কাছের মানুষ ব্যতীত বাইরের দুনিয়ার সবাই আমায় ‘সিঙ্গার প্রণব মেহরাজ’ নামেই জানে। আপনি আমার পুরো নাম কীভাবে জানলেন বলুন তো?…

স্পৃহা চোখ তুলে মাথা উঁচিয়ে প্রণবের মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। এই প্রথম মুখোমুখি দেখছে তাকে স্পৃহা। সুউচ্চ বলিষ্ঠ সত্তার শ্বেত-শুভ্র সেই গাম্ভীর্য পূর্ণ মুখশ্রী এতো কাছ থেকে দেখতে পাবে, ভাবতেই পারেনি স্পৃহা। তবে সবচেয়ে চোখে পড়ছে তার কাঁধে আড়াআড়ি ভাবে ঝুলানো গিটারটা।

স্পৃহাকে দূর্বল চোখে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বেশ বিরক্ত হলো প্রণব। মেয়েদের এমন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটা ওর মা-রা-ত্ম-ক অপছন্দের একটা বিষয়। প্রচন্ড রকমের বিব্রতবোধ করে সে এমন পরিস্থিতিতে পড়লে। তাই একটু গলা ঝেড়ে বললো,

-তো মিস অর মিসেস …… হোয়াটেভার!!! আমাকে স্ক্যান করা শেষ হলে আমার কোয়েশ্শেন-এর আন্সারটা দেবেন, প্লিজ? আমার হাতে আপনার জন্য আনলিমিটেড সময় নেই। আই নিড টু গো!

কথাগুলো কর্ণকুহরে বারি খেতেই স্পৃহা যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। হালকা নড়েচড়ে উঠতেই নিজেকে অন্য এক পুরুষের সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছিটকে সরে এলো সে। হাটতে হাটতে এই সুনশান রাস্তায় কখন চলে এলো, টেরই পায়নি স্পৃহা।

ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় স্পৃহার অশ্রুভেজা হলদেটে মুখটা এবার ভালোভাবে চোখে ধরা পড়লো প্রণবের। মেয়েটা এতো রাতে একা এই রাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে হাঁটছিল কেন? চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে প্রণব বললো,

-আপনি কি কথা পারেন না? যাইহোক, আমি আর আপনার উত্তরের আশায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। আপনি কি উত্তর দিবেন? স্যায়, ইয়েস অর নো!

কথাগুলো স্পৃহা যেন শুনেও শুনলো না। কয়েক পা পিছিয়ে গেল সে। প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছে। বিরবির করে বললো,

-মেয়েটা কি কানেও শোনে না নাকি? পাগল-টাগল নয়তো??

স্পৃহা এবার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়েই পা ঘুরিয়ে উল্টো ঘুরে চলে যেতে লাগলো। কিন্তু কয়েক পা এগোতেই ওর মাথা ভনভন করে উঠলো। সারা দুনিয়া ঘুরে উঠলো যেন। কয়েকবার চোখ মেলে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে দূর্বল ও নিস্তেজ দেহ নিয়ে লুটিয়ে পড়লো পিচের রাস্তাতেই।

স্পৃহাকে ওভাবে ঢুলে পড়ে যেতে দেখেই প্রণব ছুটে এগিয়ে এলো। ওর পাশে হাটু মুড়ে বসে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে আশেপাশে একবার তাকালো। কম্পিত হাতে স্পৃহার কপাল স্পর্শ করতেই পিলে চমকে উঠলো তার। মেয়েটার গা তো প্রচন্ড গরম! জ্বরে সেন্সলেস হয়ে গেল না তো! ভাবতে ভাবতেই ওকে কোলে তুলে নিলো প্রণব। অদূরে দাঁড় করিয়ে রাখা নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল সে।

গাড়ির কাছাকাছি যেতেই দেখলো ড্রাইভার গাড়ির সামনের বনেটের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। প্রণবকে দেখতেই হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে পা দিয়ে পিষে দিলো। চোখ তুলে প্রণবের কোলে অপরিচিত এক মেয়েকে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-এটা কি ম্যাডাম নাকি, স্যার? আপনার সাথে ভালোই মানিয়েছে। কিন্তু ওনার কী হয়েছে?

ড্রাইভারের এমন উদ্ভট কথা শুনে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো প্রণব। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-কোলে তুললেই ম্যাডাম হয়ে যায় নাকি, ইডিয়েট? মেয়েটা বিপদে পড়েছে, তাই হেল্প করবো। এখন চলো, গাড়িতে ওঠো।

বলেই স্পৃহাকে নিয়ে গাড়ির ব্যাকসিটে বসে পড়লো প্রণব। ড্রাইভার কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। প্রশ্ন করার জন্য মুখ খুলতেই প্রণবের রাশভারি মুখটা দেখে কৌতূহল এক ঢেকো গিলে নিজেকে দমিয়ে নিল সে।
_________________________

ঘড়ির কাটায় রাত দুটো বাজে। এমনসময় বাড়ির ডোর বেল বেজে উঠতেই চমকে উঠলো প্রান্তি। বই বন্ধ করে পড়ার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। নিচে এসে দরজা খুলতেই চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেল ওর। সামনে প্রণব দাঁড়িয়ে আছে, তাও স্পৃহাকে কোলে নিয়ে। হতভম্ব হয়ে প্রান্তি বলে উঠলো,

-ভাইয়া… তুই দেশে ফিরেছিস? কবে? আর তোর কোলে পি…

প্রান্তির কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রণব বিরক্ত হয়ে বললো,

-প্রশ্ন করার অনেক সময় পাবি পরে। এখন ভেতরে ঢুকতে দে। মেয়েটা অসুস্থ!

-অ … অসুস্থ??…

প্রান্তি অবাক চোখে স্পৃহার দিকে একবার তাকিয়ে একটু সরে দাঁড়ালো। প্রণব স্পৃহাকে নিয়ে প্রান্তির ঘরে শুইয়ে দিতেই প্রান্তি স্পৃহার পাশে বসলো। ওর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। স্পৃহা তো প্রেগন্যান্ট ছিল! কিন্তু স্পৃহাকে এখন দেখে তো তা মনে হচ্ছে না! আর এতো রাতে প্রণব কীভাবে ওকে পেল? মাথার ভেতর প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে ওর। ভাবতে ভাবতেই স্পৃহার ফ্যাকাসে মুখে হাত ছোঁয়াতেই কেঁপে উঠলো প্রান্তি। চকিত স্বরে বললো,

-ওর গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে!

প্রণব চিন্তিত স্বরে বললো,

-হুম। এতো রাতে ডক্টর পাওয়া সম্ভব নয়। তাই মাকে আসতে বলেছি।

-মা আসতে রাজী হলো?

-হয়নি। কিন্তু বুঝিয়ে বলার পর রাজী হলো।

প্রান্তি একটা শ্বাস নিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,

-ওর এই অবস্থা কী করে হলো, ভাইয়া? ও তো ঠিক ছিল! আর ওর বেবি? মানে আমি কিছু বুঝতে পারছি না!

প্রণব কিছু বুঝতে না পেরে কনফিউজড হয়ে বললো,

-মানে? তুই ওকে চিনিস?

-আরে ও-ই তো পিহু! বলেছিলাম না তোমায়?

প্রান্তির কথা শুনে প্রণব চোখ বড়বড় করে তাকালো। এমন কথার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। পুরোই হতভম্ব হয়ে গেছে সে। এতক্ষণে বুঝলো, স্পৃহা কীভাবে ওর পুরো নাম জানে!

এমনসময়ই মিসেস মেহরীনের আগমন ঘটলো। তিনি গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে বললেন,

-কই তোর পেশেন্ট, প্রণব? এতো রাতে তোর কথায় শুধু এ বাড়িতে এলাম!

প্রণব কিছু বলার আগেই প্রান্তি কান্নামাখা গলায় স্পৃহাকে দেখিয়ে বললো,

-মা! প্লিজ, ওকে বাঁচাও। কী হয়েছে ওর? ওকে সুস্থ করে দাও!

মিসেস মেহরীন বেশ সময় নিয়ে স্পৃহাকে পর্যবেক্ষণ করলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-প্রান্তির কথা অনুযায়ী মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। কিন্তু আমার ধারণা ওর বেবি মিসক্যারেজ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এতে অতিমাত্রায় ব্লিডিং হওয়ায় ওর শরীরের অবস্থা এখন একদমই ভালো নেই। ও সুস্থ হয়ে যাবে, কিন্তু একটু সময়ের প্রয়োজন। মেডিক্যাল টেস্ট ছাড়া এর বাইরে কিছু বলতে পারছি না আমি।

প্রণব চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে। খারাপ লাগছে মেয়েটার জন্য ওর। ভাগ্যিস ওকে সাথে করে নিয়ে এসেছিল! নয়তো কী হতো মেয়েটার?

প্রান্তি এসব কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। স্পৃহার সাথে এমন কিছু ঘটে গেল, আর ও জানতেই পারলো না?অনেক চেষ্টা করেছিল স্পৃহার সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু কোনোভাবেই ওর খোঁজ পায়নি। চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে ওর।

-প্রান্তি ম্যামের সাথে একজন এসেছে দেখা করতে।

সার্ভেন্টের মুখে এমন কথা শুনে অবাক হলো সবাই। এতো রাতে কে দেখা করতে আসবে? ভাবতে ভাবতেই প্রান্তি নিচে এসে দেখলো ড্রয়িং রুমে স্পন্দন বসে আছে। স্পন্দন প্রান্তিকে দেখে ব্যস্ত স্বরে বললো,

-তুমিই প্রান্তি? পিহু কি তোমার কাছে এসেছে? তোমার সাথে কোনো কথা হয়েছিল ওর?

প্রান্তি স্পন্দনকে আশ্বস্ত করে বললো,

-ভাইয়া, শান্ত হোন। পিহু এখানেই আছে। আমার ঘরেই আছে।

স্পন্দন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,

-থ্যাংক গড!! এখানে চলে এলো কীভাবে কে জানে? কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি!!

-ভাইয়া, ওর কী হয়েছিল? আই মিন, ওর অবস্থা দেখে ……

স্পন্দন একে একে ওকে সব খুলে বললো। প্রান্তি দু’হাতে মুখ চেপে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। এতো কিছু ঘটে গেছে স্পৃহার জীবনে? আর ওরা কিছু জানতেই পারলো না!

স্পন্দন স্পৃহাকে নিয়ে যেতে চাইলে প্রান্তি বললো,

-ভাইয়া, ও আমার সাথে থাকুক না কিছুদিন! ওর মনের অবস্থা আর শারীরিক অবস্থা ভালো না হওয়া পর্যন্ত এখানে থাকলেই ভালো হবে।

-কিন্তু …

-প্লিজ, ভাইয়া। আমার মায়ের আন্ডারে ওর ট্রিটমেন্ট চলবে। আমি ওকে দেখেশুনে-ই রাখবো।

স্পন্দন প্রান্তির এমন আবদার শুনে হাসলো। মেয়েটা স্পৃহাকে অনেক ভালোবাসে। তাছাড়া স্পৃহার এখন একটা সঙ্গীর-ও অনেক দরকার। ও নিজে তো আর সারাক্ষণ বোনের সাথে থাকতে পারবে না! আর নিজের পরিবারের কথা তো বাদ-ই। সেই হিসেবে স্পৃহার প্রান্তির সাথে থাকাটাই বেটার হবে।
_____________________

সকালের মিষ্টি রোদের আলো স্পৃহার মুখের ওপর এসে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল স্পৃহার। দূর্বল চোখ দুটো আস্তেধীরে খুলতেই চোখের সামনে প্রান্তির হাসি মাখা মুখটা দেখতে পেল। প্রান্তি মিষ্টি হেসে বললো,

-গুড মর্নিং, পিহু!!

স্পৃহা অবাক হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে উঠে বসলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই গত রাতে প্রণবের সাথে দেখা হওয়ার বিষয়টা মাথায় আসতেই ও বুঝতে পারলো কীভাবে এখানে এসেছে। একটা ছোট শ্বাস ছেড়ে গুটিশুটি মেরে বসে রইলো সে।

প্রান্তি স্পৃহার এমন গুটিয়ে যাওয়া দেখে ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। জীবনের এই ছোট্ট পরিসরে কতো ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছে মেয়েটা। প্রান্তি আবার হাসিমুখে তাকিয়ে বললো,

-চল, তোকে ফ্রেশ করিয়ে নিচে নিয়ে যাবো। ব্রেকফাস্ট করবি না?

স্পৃহা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো প্রান্তির দিকে। প্রান্তি বুঝতে পারলো, স্পৃহা নিচে যেতে চাইছে না। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে ও আরো অস্বাভাবিক হয়ে পড়বে। আর প্রান্তিও নাছোড়বান্দা। তাই জোর করে ওকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে প্রান্তি বললো,

-আমি কোনো কথা শুনছি না। তোকে আমার সাথেই ব্রেকফাস্ট করতে হবে। আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠতে হবে।

নিচে যেতেই একজোড়া তীক্ষ্ণ চাহনি দেখে স্পৃহা মিইয়ে গিয়ে নিজেকে আরো বেশি গুটিয়ে নিল।

# চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here