এক মুঠো প্রেম পর্ব -২৬

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ২৬

-কাল সারারাত পিহুকে নিজের সাথে কেন রাখলি, ভাইয়া?

প্রণব বিছানায় বসে হাই তুলে ছোট ছোট চোখে সামনে তাকাতেই দেখলো, প্রান্তি আর আনিলা ওর দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবে মাত্র ঘুম ভেঙেছে প্রণবের। তাই বিরক্তি নিয়ে বললো,

-সকাল সকাল কী শুরু করলি তোরা? এমনিতেই একরাত ঘুমোতে পারিনি!

আনিলা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,

-তোরা সারারাত না ঘুমিয়ে থেকেছিস? কী করেছিস সারারাত?

প্রান্তি সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,

-অনাথসনাথ কিছু করিসনি তো তোরা? আমি তো রহস্য রহস্য গন্ধ পাচ্ছি!

কথাটা বলেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে জিভ কাটলো প্রান্তি। এটা কী বলে ফেলেছে সে? বাঁ চোখটা সামান্য খুলে তাকাতেই দেখলো, প্রণব রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সেটা দেখে প্রান্তি জোরপূর্বক ঠোঁট টেনে হাসলো। কিন্তু হাসি বারবার মিলিয়ে যাচ্ছে ওর। প্রণব গাঢ় গলায় বললো,

-ভুলে যাস না আমি তোর বড় ভাই! আর সারারাত আমি একাই জেগে ছিলাম। স্পৃহা ঘুমোচ্ছিলো, তাই।

আনিলা আমতা আমতা করে বললো,

-তুই বসে বসে ওকে পাহারা দিচ্ছিলি নাকি?

-তোরা কি আমায় সন্দেহ করছিস নাকি? সন্দেহ করেও লাভ নেই, ডিয়ার্স! স্পৃহার ভাষ্যমতে, আমি ওর ভাইয়ের মতো।

এমন কথা শুনে প্রান্তি আর আনিলা চোখ বড়বড় করে তাকালো। প্রণব ওদের দিকে আড়চোখে তাকাতেই প্রান্তি আর আনিলা একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিটকিটিয়ে হেসে দেয়। প্রণবও ঠোঁট বাঁকিয়ে হালকা হাসলো।

-ওকে এভাবে একটু দুশ্চিন্তায় ফেলাটা দরকার ছিল। আহিরের মৃত্যুর খবর শুনে কেমন থম মেরে গিয়েছিল, দেখিসনি? ওর চুপ হয়ে যাওয়াটা-ই সবচেয়ে বেশি খারাপ ইফেক্ট ফেলত। তাই এমন একটা পরিস্থিতিতে ওকে ফেলেছিলাম, যেন ও নিজে থেকেই কথা বলে, প্রশ্ন করে, আগ্রহ দেখায়। আই থিংক, আমি সফলও হয়েছি।

আনিলা এবার কৌতূহলী গলায় বললো,

-তুই স্পৃহাকে নিয়ে এতো ভাবছিস কেন বল তো?

প্রণব শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসলো। রহস্য মিশ্রিত সেই হাসির আড়াল থেকে একটা বাক্যই ভেসে এলো,

-সব প্রশ্নের উত্তরই দিবো, কিন্তু সঠিক সময়ে সবটা প্রকাশ পাবে; তার আগে নয়!!!
___________________________

সকালের কুয়াশার চাদর ভেদ করে প্রকৃতির বুকে আছড়ে পড়ছে ফালি ফালি মিষ্টি রোদ। ঘোলাটে পরিবেশ ঘিরে ছড়িয়ে পড়ছে হালকা তপ্ততার আমেজ। গাছের পাতা ও ফুলের গায়ে চকচক করছে শিশিরের গোলাকৃতির কণা গুলো। সেই মোহনীয় বিন্দু গুলোর সৌন্দর্যের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে স্পৃহা। ছাদের এক কোণায় বসে বসে অদূরে সাজিয়ে রাখা ফুলের টবগুলোর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ তার। স্পৃহার ঠিক বিপরীত পাশে বসেই ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিতে দিতে পত্রিকার ওপর চোখ বুলাচ্ছেন মিস্টার চৌধুরী। স্পৃহা নিজ থেকেই ছাদে এসে তার পাশে বসেছে। নীরবতা ভেঙে সে বললো,

-আজ আপনি অফিসে যাবেন না, আংকেল?

মিস্টার চৌধুরী পত্রিকার পাতা থেকে চোখ তুলে তাকালেন। কফির মগে শেষ চুমুক বসিয়ে সেটা টেবিলের ওপর রাখলেন। পত্রিকা ভাজ করতে করতে অমায়িক হেসে বললেন,

-আমার মায়ের আজ ছেলের সাথে আড্ডা দেওয়ার শখ জেগেছে মনে হচ্ছে!!

স্পৃহা ঠোঁট টেনে নিঃশব্দে হেসে বললো,

-না, তেমন কিছু না। আপনি একা একা বসে আছেন যে! তাই জিজ্ঞেস করলাম।

-এই বুড়ো বয়সে কী আর কাজকর্মে মন বসে? তার ওপর একাকিত্ব তো আছেই!! প্রান্তি ছাড়া সারাদিনে নিজের সাথে কথা বলার মতো একজন মানুষও পাই না আমি।

স্পৃহাও বিষয়টা খেয়াল করেছে। নিজের আগ্রহ দমিয়ে না রেখে তাই প্রশ্ন করেই বসলো সে,

-কেন এমনটা হলো, আংকেল? আপনার কাছের মানুষ গুলো কেন আপনার পাশে থেকেও নেই?

মিস্টার চৌধুরী স্পৃহার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন,

-নিজের জীবন থেকে অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করেছ তুমি! কাছের মানুষ কাছে থেকেও কীভাবে পর হয়ে যায়, সেই বিষয়ে তোমার ধারণা আমার থেকে বেশি থাকার কথা।

স্পৃহা একটা ছোট শ্বাস ছেড়ে বললো,

-আমার জীবনের মতো জটিল তো আর আপনার জীবন নয়, আংকেল! আপনারা সবাই খুব ভালো। তবুও বিচ্ছিন্ন হয়ে কেন থাকেন, সেটাই জানতে চাইছি আমি।

মিস্টার চৌধুরী চোখ থেকে ভারী চশমাটা সরালেন। স্পৃহা আগ্রহী চোখে তাকিয়ে আছে। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে মিস্টার চৌধুরী বললেন,

-আমি এককালে পাগলা প্রেমিক ছিলাম, জানো? নিজের বউকে মন-প্রাণ উজার করে ভালোবাসবো বলে বিয়ের আগে কোনো নারীর প্রতি অনুভূতি সৃষ্টি করা থেকে বরাবরই সংযত ছিলাম। ভালোবাসা নামক বস্তুটাকে নিজেকে হৃদস্থলে বাক্সবন্দী করে রেখেছিলাম, যেন সেটা খুলে শুধু নিজের প্রিয় মানবী-টাকেই দেখাতে পারি। কিন্তু সত্যি ও বাস্তবতার নিষ্ঠুরতার সাথে এসবের সম্পর্ক সমানুপাতিক। ভালোবাসার পরিমাণ যত বেশি হবে, ভাগ্যের পরিহাসও নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতম হবে। আমিও সেই সেই নিষ্ঠুরতার অসহায় শিকার।

বলেই মিস্টার চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। স্পৃহা সবটা নীরবে শুনলো। কথাগুলো আসলেই সর্বাংশে যৌক্তিক। তাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো মিস্টার চৌধুরীর পরবর্তী কথা শোনার উদ্দেশ্যে,

-মেহরীনকে আমি নিজের সবটা দিয়েই ভালোবেসেছিলাম। আর সবশেষে ও-ই আমার সবটা কেড়ে নিয়েছে। কীভাবে কী হয়েছে, সেটা আমি বলতে চাই না! প্রণবের রাগের কারণ এটাই যে, আমি কেন ওর মাকে অবিশ্বাস করেছি। কিন্তু পরিস্থিতিটা তখন এইরকমই ছিল যে, না চাইলেও আমায় অবিশ্বাস করতে হয়েছিল। ওদেরও তো বোঝা উচিত ছিল, আমার অবস্থাটা। এতো কিছু সত্ত্বেও কেন আমি মেহরীনকে ডিভোর্স পেপার পাঠাতে পারিনি, সেটা ওদের মাথায় এলো না?

স্পৃহা অবাক চোখে তাকালো,

-আপনার আর আন্টির ডিভোর্স হয়নি? আপনার ডিভোর্স ছাড়াই সেপারেটেড?

মিস্টার চৌধুরী হাসলেন। হেসেই বললেন,

-পারিনি। অনেক বার চেষ্টা করেছি ডিভোর্স পেপারে সাইন করার। কিন্তু কলম ছুঁইয়েও নিজের নামটা লিখে দেওয়ার সক্ষমতা হয়নি আমার। সাইন করতে গেলেই ওর মায়াবী মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতো। কীভাবে সব সম্পর্ক ছিন্ন করবো তার সাথে আমি? বড্ড ভালোবাসতাম যে! বলতে গেলে, আজও বাসি। আমার সন্তানের মা ও। ওকে দূরে ঠেলে দিলেও মন থেকে তো সরাতে পারিনি! আর তাই সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারিনি।

কথা গুলো শুনে স্পৃহার ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো। সত্যিই ত্যাগ করাটা বড্ড কঠিন! কিন্তু আদ্র? তার কাছে তো এটা কঠিন কিছু ছিল না! কী অবলীলায়-ই না সে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল তাদের মধ্যকার পবিত্র সম্পর্কটাকে! একবারও কি তার বুক কাপে নি ডিভোর্স পেপারে সাইন করার সময়?
_______________________

-মিসেস নিস্তব্ধতা!!!

মেইনডোরের দিকে এগিয়ে যাওয়া পা দুটো থেমে গেল স্পৃহার। অদ্ভুত নামটা দিয়ে কে সম্বোধন করেছে আর কাকে সম্বোধন করেছে, সেটা বোঝার বাকি নেই তার। তাই আড়ালে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে। প্রণবকে সিড়ির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,

-কিছু বলবেন?

-কোথাও যাচ্ছেন?

-হ্যাঁ, প্রান্তি তো আমাকে রেখেই চলে গেল বিকেলের ক্লাসে! তাই একাই যাচ্ছি।

-ওহ্! যান তাহলে। আমি তাহলে আনিলার কাছেই যাই।

বলেই প্রণব সিড়ি দিয়ে উপরে চলে গেল। স্পৃহাও ব্যাগটা একবার চেক করতে করতে মেইনডোরের দিকে পা বাড়াতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। স্পৃহা খানিকটা চমকে উঠলো। পরমুহূর্তেই ভাবলো, সে নিজেও তো বাইরে যাচ্ছে। তাই দরজাটা তারই খুলে দেওয়া উচিত। ভেবেই দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলতেই এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো।

সাথে সাথেই ভ্রু কুঁচকে আবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই কপালের সুক্ষ্ম ভাজ গুলো মিলিয়ে গেল তার। দৃষ্টি হয়ে গেল স্থির। তার চোখের সামনে স্বয়ং আদ্র দাঁড়িয়ে আছে।

আদ্র চোখ তুলে সামনে তাকাতেই অক্ষিপট স্পৃহার ওপর বাঁধা পড়ে গেল তার। সারা দেহ যেন জমাট বেঁধে গেল মুহূর্তেই। স্পৃহা এখানে কী করছে? কীভাবে এলো? স্পৃহা কি এখন ওকে দেখে কাঁদবে? তার জন্য কোনো স্থান কি আদৌও স্পৃহার মনে অবশিষ্ট আছে? যদিও ভাবনা গুলো নিতান্তই যুক্তিহীন, তবুও কথা গুলো মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করছে শুধু তার। ঠোঁট ভেদ করে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই বেরিয়ে এলো,

-স্পৃহা, তুমি এখানে?

# চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here