এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ১৪+১৫

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৪
আমায় এভাবে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে দেখে উনি এবার শক্ত করে বুকে জরিয়ে ধরলেন আমাকে। তপ্ত শ্বাস ফেলে চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন নিবিড়ভাবে। আমি তখনও উনার শার্ট খামচে ধরে কেদে চলছি। এই মানুষটার হঠাৎ এভাবে জরিয়ে ধরাতে যতটা না অবাক হয়েছি তার থেকেও ভালোলাগছে অনেক। কেন যেন মনে হচ্ছে এই ছোয়াতে আমায় আগলে রাখার ক্ষমতা আছে। আনভীর আমার কানের কাছে ঝুঁকে এলেন এবার। ফিসফিসিয়ে বললেন,

-‘আমার উদ্দেশ্য তোমায় কষ্ট দেওয়া নয় আহি, উদ্দেশ্য তোমায় আরও বেশি স্ট্রং করা। তুমি অনেক নরম প্রকৃতির মেয়ে, আর এ পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে তোমায় শক্ত থাকতে হবে। ভয়-কষ্টকে জয় করা শিখতে হবে। নাহলে কখনোই তুমি উঠে দাঁড়াতে পারবে না।’

আমি উনার বুকে মাথা রেখেই শুনে যাচ্ছি উনার প্রতিটা কথা। আমার চোখ দিয়ে অবধারায় জল বেয়ে পড়ছে। বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠছে মায়ের সেই সাদা কাফনে জড়ানো মৃতদেহের প্রতিচ্ছিবি। অদ্ভুত কারনে সেদিন বাবা একবারের জন্যও কান্না করেননি। বরং আমায় একটি আস্তানায় রেখে নিজের কর্মক্ষেত্র নিয়ে উল্লাস করতে ব্যস্ত ছিলেন । চাচির ভৎসনা, চাচার অবহেলা, দাদির কটুক্তি, দোলা আপু যখন সাহায্য করতে চেয়েও পারছিলো না আর পরিশেষে অপূর্ব ভাইয়া ; এই মানুষগুলো আমার ছোট পৃথিবীটাকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছিলো।এসব ভাবতেই কান্নার গতি দ্বিগুন হলো আমার। আকুলভাবে মন কেদে যাচ্ছে মায়ের জন্য। আনভীর একমুহূর্তের জন্যও শান্ত করলেন না আমায় । বরং শীতল কন্ঠে বললেন,

-‘কাদো আহি। আজকেই মায়ের জন্য প্রাণভরে কাদো। এই চোখের পানি বিসর্জন করা খুব প্রয়োজন তোমার জন্য। এসব পিছুটান অতিক্রম করে সামনে এগোতে হবে তোমাকে।এটাই তোমার শেষ কান্না হবে আহি। আর কখনোই তুমি কাদতে পারবে না।’

আমি উনার বুকে মুখ গুঁজেই কাদতে থাকলাম অঝরে। আমার এই কান্নার জন্য এখন হয়তো এই মানুষটই দায়ী, তাই উনার ওপরক্ষোভ জমেছে বেশ। তবুও আমার মনে হলো আমার কান্না করা প্রয়োজন,খুবই প্রয়োজন।

_____________________________

সময় নিজগতিতে কিভাবে যে চলে গেলো তা ভাবতেই অবাক লাগছে বেশ। হারানো সময়গুলো কখনোই ফিরে পাওয়া যায় না। অন্য চার পাঁচটা সাধারন মানুষের মতো আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে ঠিক তাই। সেদিনের কান্নাটার জন্য দায়ী আনভীর ছিলো এটা সত্য, তবে সেদিনের পর থেকে নিজেকে সামলে নিয়েছি আমি। আগের তুলনায় শক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছি। আনভীর হঠাৎ আমার এ পরিবর্তন দেখে ঠিক কি ভাবছেন তা আমার জানা নেই , তবে আমি আমার এ পরিবর্তন নিয়ে সন্তুষ্ট। উনাকে কড়াকড়িভাবে ইগ্নোর করছি আমি, পড়াশোনার বাহিরে খুব বেশি একটা কথা বলিনা, তাছাড়া উনিও যেচে যেচে কথা বলতে আসেন না আমার সাথে।আমাদের কথা শুরু হয় পড়াশোনার টপিক নিয়ে , আবার শেষও হয় সেই টপিক নিয়েই।
উনি এখন আগের মতো আমার সাথে মাঝে মাঝে খারাপ ব্যবহার করেন না, বারবার মনে করিয়ে দেন না এগ্রিমেন্টের কথা ; আসলে আমিই উনাকে কোনোরূপ কোনো সুযোগ দেই না। বলতে গেলে এক ছাদের নিচে থাকলেও আমার দুইজন দুই দুয়ারের মানুষ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে উনার কেয়ারিংনেস এটিটিউটটা বেশ ভাবিয়ে তুলে আমাকে। উনি আমার সাথে কথা কম বলেন এটা সত্য , তবে আমার প্রতিটি জিনিসের খেয়াল রাখেন উনি। আমার কোনো সমস্যা হলে নীরবে তা নিজদায়িত্বে সামলে নেন। তার কথায় কথায় আমার ওপর একটা সরু নজর নিক্ষেপ করাটা চোখ এড়ায় না আমার। তবুও আমি ভ্রুক্ষেপ করিনা সেদিকে। আমি তো জাস্ট উনার একটা এগ্রিমেন্ট তাই তো? সেটাই হাড়ে হাড়ে উনাকে বুঝিয়ে দেবো। এতো সহজে ক্ষমা করবো না আপনাকে আনভীর,,,,,,,কখনোই না।
.
.
ক’দিন পরেই মেডিক্যাল এডমিশন টেস্ট। তাই পড়াশোনার বলতে গেলে মারাত্নক রকমের চাপ। সেই সুবাদে নাকে-মুখে পড়ছি আমি। একটা মডেল টেস্টও মিস দেইনি। আজকেও কোচিংয়ে মডেল টেস্ট শেষ করে রাস্তায় আমার এক ক্লাসমেট এর সাথে কথা বলছিলাম তখন হঠাৎ পেছন থেকে খুবই পরিচিত কন্ঠে ডাক দিলো আমায়।
মানুষটা আর কেউ নয় , আনভীর। সেই বরাবরের মতো মসৃন চুলগুলো পেছনে আছড়ে রাখা, হাতে সিলভার ডায়ালের ঘড়ি, আকাশী রঙের শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ভাজ করা আর সেই আকর্ষণীয় চিকন ফ্রেমের খয়েরী রঙের চশমা।আমি কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকলাম সেদিকে , কেননা আনভীর সচরাচর আমায় নিতে আসেননা।আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই পাশ থেকে আমার ক্লাসমেট বলে ওঠলো,

-‘আসসালামু আলাইকুম স্যার! আমায় চিনতে পেরেছেন? আমি তারা আপুর ছোট বোন।’

-‘ওয়ালাইকুম আসসালাম ,তো কেমন আছো তুমি? তারার কি অবস্থা?’

-‘তারা আপুর অবস্থা তো ভালোই।এখন তো ম্যাথমেটিক্স নিয়ে পড়াশোনা করতে এবরোড চলে গিয়েছে। আর আমি এইযে , মেডিক্যাল এডমিশন টেস্টের প্যারায় আছি।’

আমি তাদের কথা শুনে কিছুটা আন্দাজ করে নিলাম যে ওর বোন মেইবি আনভীরের স্টুডেন্ট। সে আবার বললো,

-‘তো আপনি আর আহি একে অপরকে চিনেন স্যার?’

আনভীর আমার দিকে তাকিয়ে একটা মৃদু হাসি দিলেন। কি বলবেন গুছিয়ে উঠতে পারছেন না। অতঃপর অপ্রস্তুত গলায় বললেন,

-‘হ্যাঁ, আহি আমার পরিচিত।’

আমার মনের ক্ষোভ আবার বিক্ষোভে পরিণত হলো এবার। আমায় কি উনি এতটাই ঘৃণা করেন যে মানুষের সামনে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দিতেও কার্পণ্য বোধ করেন। আমি তাদের কথাবার্তার মাঝে না থেকে হনহনিয়ে প্রস্থান করলাম এবার। আমায় হঠাৎ এতটা উত্তেজিত হতে দেখে পিছু নিলেন উনিও। আর বেচারি আমার সেই ক্লাসমেট তো বুঝলোই না যে হয়েছিলোটা কি।

আমি দ্রুত পায়ে মেইনরোডের দিকে যাচ্ছি। আনভীর আমায় ডাকলেও আমি শুনিনি উনার কথা। একপর্যায়ে উনি আমার হাত স্পর্শ করতেই আমি ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে দিলাম উনার হাত। সন্ধ্যা হয়েছে এখন। কোচিং ক্লাস সকালে হলেও টেস্টটা বিকেলে দিতাম বলে ছুটি হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সেই সুবাদে আশেপাশে মানুষ একেবারে নেই বললেই চলে। আমি নজর দিলাম না সেদিকে। একটু আগে আনভীরের কথায় সবকিছু চুরমার করে ফেলতে ইচ্ছে কযরছে আমার। উনি আবার আমার হাতের কব্জি টেনে গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আমি চিল্লিয়ে বলে ওঠলাম,

-‘খবরদার! আমায় টাচ করবেন না। যেই মানুষ আমায় সবার সামনে স্ত্রীর পরিচয় দিতে কার্পণ্য বোধ করে তার কোনো রাইট নেই আমায় ছোয়ার।’

আনভীর অবাক হলেন আমার কথা শুনে। বললেন,

-‘তুমি ভুল বুঝছো আহি। এমন কিছুই আমি করিনি। তুমিতো আমায় বলতে দেওয়ার আগেই এসে পড়লে।’

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম এবার। বললাম,

-‘আমার কাছে আপনার সাফাই দেওয়ার প্রয়োজন নেই আনভীর। আমি আবার ভুলে গিয়েছিলাম যে আপনি একবার আমায় বলেছিলেন,আমাদের বিয়ে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি বা আদিক্ষেত্যা না দেখাতে। ,,,,,,,,,,(একটু থেমে) আই এম সরি! আমিই আসলে বেশি রিয়্যাক্ট করে ফেলেছি।আমি তো আসলেই আপনার চুক্তিবদ্ধ বউ। এইযে আর কয়েকমাস থাকবো, তারপর চলে যাবো। ‘

-‘থামো আহি!’

আনভীর স্থির কন্ঠে বললো। আমি ঠোঁটচেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্ত উনার কথা শুনে আবার চিল্লিয়ে বললাম,

-‘কি থামবো আমি? আমি আপনার এসব ব্যবহার জাস্ট নিতে পারছি না। আমিও তো একটা মানুষ আনভীর ! অন্য চার-পাঁচজনের মতো রক্তমাংসে গড়া মানুষ। কিন্ত আমার সাথে কি হলো? মা আমায় ছেড়ে চলে গেলো, বাবা আমায় বোঝা মনে করে চাচার কাছে ফেলে রাখলো, চাচি আমায় কাজের বুয়ার প্রয়োজনে নিজের কাছে রাখলো,বরপক্ষরা নিজের মানসম্মান বাচানোর জন্য আমার সাথে বিয়ে ভেঙে দিলো, আপনার বাবা আপনার আর আপনাদের মানসম্মান বাচানোর জন্য আপনাকে জোর করে আমার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করলো আর সবশেষে আপনিও ছয় মাস আমার সাথে পরিবারের খাতিরে থাকবেন বলে মনোস্থির করলেন।
কেউ কি একটাবারও জিজ্ঞেস করেছে যে আমি কি চেয়েছি?আমার ইচ্ছেটা কি? কেউ একটাবারও জিজ্ঞেস করেনি, সবাই শুধু পুতুলের মতো আমায় ইউজ করে গিয়েছেন নিজ স্বার্থে।

আপনি ঠিকই বলতেন আনভীর। আমি আসলেই নরম মনের মানুষ ছিলাম। কি করবো বলেন তো, মা ছিলো না। বাবা থাকতেও নেই। তাই নিজেকে গুটিয়েই বড় করেছিলাম। তবে আমি আর আগের মতো থাকতে চাই না আনভীর,,,,,,আপনার নামেমাত্র ওয়াইফ হয়ে থাকাটা ইচ্ছেটাও মরে গেছে। জাস্ট আর ক’টা দিন সহ্য করুন আমায়। তারপর আমি চলে যাবো। আর আমায় ওয়াইফ বলতে হবে না।’

আনভীর ঠোঁট চেপে শীতল চোখে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। তারপর বললেন,

-‘আমি কি একবারও বলেছি যে আমি তোমায় ওয়াইফ হিসেবে মানি না?’

-‘মানেন তো! তবে জাস্ট এগ্রিমেন্টের জন্য। দায়িত্বের জন্য। আমি কারও দায়িত্ব হতে চাই না আনভীর। কারও ভালোবাসা হতে চাই। আফসোস! সেই সৌভাগ্য আমার নেই।কেননা আপনি যা করছেন সব করছিলেন দায়িত্বের জন্য, ভালোবাসার জন্য নয়। আপনাকে আর আপনার দায়িত্ব পালন করতে হভে না মিঃ আনভীর। আজ থেকে আপনি মুক্ত। এগ্রিমেন্টের আগেই আমি চলে যাবো।’

আমি এবার একটা রিকশা করে চলে গেলাম বাসায়। আনভীরের প্রতিক্রিয়া কি….আমার জানা নেই, জানার ইচ্ছেটাও নেই। তবে আমি এতটুকু নিশ্চিত, এই সময় আনভীর কোনোমতেই বাড়িতে আসবেন না।আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম এবার। একবার এডমিশন টেস্টটা দিতে পারলেই হয়েছে, তারপর আমি না থাকবো উনার কাছে, না থাকবো আমার বাবার কাছে। এই পৃথিবীতে আমার মায়ের পর এখনও একজন আছে যে আমার দেখাশোনা করতে পারবে। তার কাছেই চলে যাবো।

__________

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে শিউলি ভাবির সাথে টেবিল গুছাচ্ছিলাম আমি। আনভীর তখনও বাসায় আসেননি।আমি ফোনও করিনি একবার। উনি মা’কে বলে দিয়েছেন আজ বাসায় ফিরতে দেরি হবে।আমি তাই বিষয়টি নিয়ে অহেতুক চিন্তা করলাম না। শিউলি ভাবি আড়চোখে আমায় দেখে যাচ্ছেন একটু পর পর। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন,

-‘তোমার কোনো সমস্যা হয়েছে আহি?’

আমি তাকালাম ভাবির দিকে।উনার চোখে মুখে দুশ্চিন্তা।আমি মৃদু হাসলাম বিনিময়ে ।বললাম,

-‘না তো! আমার কিছু হয়নি । তবে পরীক্ষার জন্য একটু টেনশনে আছি।’

শিউলি ভাবির মনের খচখচানিটা দূর হলো একটু। টেবিলের প্লেটগুলো বেসিনয়ের সামনে রাখতে রাখতে বললেন,

-‘তবে যাই বলো না কেনো, আনভীর তোমার পড়াশোনার ব্যাপারে পুরো কেয়ার করছে। ইসসস! এমন বর থাকলে,,,তার বউ মেডিক্যালে চান্স পাবেই পাবে। সো এত টেনশন নিও না!’

আমি সুক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে গেলাম আনভীরের কথা। তার অস্তিত্ব আমায় গ্রাস করে ফেলছে। এবার সেই মানুষ আর তার কথাবার্তা, কোনোটাই আমায় প্রভাবিত করতে পারবে না। আমি তারপর রুমের থেকে বই খাতা নিয়ে লাইব্রেরি রুমে চলে গেলাম পড়াশোনা করতে। আজ এখানেই থাকবো আর এখানেই ঘুমাবো। ওই মানুষটার থেকে যতটা সম্ভব ততটাই দূরে থাকাটাই উত্তম হবে আমার জন্য।পড়াশোনা করতে করতে একসময় টেবিলেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।
.
.
.
মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে কারও স্পর্শ টের পেতেই শরীরে অদ্ভুত শিহরণ জেগে ওঠলো আমার। মনে হচ্ছে আমি যেন শূণ্যে ভাসছি। কিন্ত চোখজোড়া ভারে আমার যেন নুইয়ে পড়েছে। হঠাৎ কেউ আমার নরম বিছানায় ফেলে দিতেই আস্তে করে চোখ খুলি আমি। আনভীর খানিকটা ঝুঁকে আছেন আমার দিকে। আমি তড়িঘড়ি করে উঠে বসার চেষ্টা করতেই উনি আমার দু’কাধ চেপে বিছানায় আটকে রাখলেন আমায়। আমি কড়া গলায় বললাম,

-‘আপনি আমায় নিয়ে আসলেন কিভাবে?’

-‘কোলে তুলে নিয়ে এসেছি।’

উনার শীতল কন্ঠ। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

-আমি বলতে চেয়েছি যে আপনি ওখান থেকে কেন নিয়ে এসেছেন এখানে? সরুন, আপনি যেহেতু আমায় ওয়াইফ হিসেবে মানেন না; তাই আমি চাই না কোনো পরপুরুষের সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে।’

বলে আমি উঠার চেষ্টা করতেই উনি একেবারে আমার ওপর উঠে পড়লেন। আমার দুহাতের নিজের আঙুল আটকে চেপে ধরলেন বিছানায়। আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে এবার উনার এহেন কাজে। উনার চেহারায় কিঞ্চিত রাগের আভাস। তীক্ষ্ণ নজর নিবদ্ধ করেছেন আমাতে। এবার বলে ওঠলেন,

-তো তোমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার ওয়াইফ হওয়ার যে আবারও আমায় ইগ্নোর করছো তুমি? সো লেটস ডু দ্যাট, তুমি যেহেতু আমার ওয়াইফ হওয়ার হক আদায় করতে চাও আমি তাহলে শুনবো তোমার কথা। শুধু এক বিছানায় ঘুমাবো না, আরও অনেক কিছু করবো তোমার সাথে যা প্রত্যেক হাজবেন্টই তার ওয়াইফের সাথে করে। ওয়ানা সি ইট?’
.
.
.#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৫
-তো তোমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার ওয়াইফ হওয়ার যে আবারও আমায় ইগ্নোর করছো তুমি? সো লেটস ডু দ্যাট, তুমি যেহেতু আমার ওয়াইফ হওয়ার হক আদায় করতে চাও আমি তাহলে শুনবো তোমার কথা। শুধু এক বিছানায় ঘুমাবো না, আরও অনেক কিছু করবো তোমার সাথে যা প্রত্যেক হাজবেন্টই তার ওয়াইফের সাথে করে। ওয়ানা সি ইট?’
আনভীরের উথাল পাতাল নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে আমার মুখ বরাবর। আমি বিস্ফোরিত নয়নে মানুষটার দিকে তাকালাম। আমি বলতে চাইলাম কি আর উনি বুঝলেন কি। আমি উনাকে সরাতেও পারছিনা আমার হাত উনার হাতজোড়ায় আবদ্ধ থাকার কারনে। আমি বড় বড় শ্বাস নিলাম কয়েকবার। নিজেকে নিজেই বললাম, ‘বি স্ট্রং আহি! তোমায় এখন ভয় পেলে চলবেনা’। কাট কাট গলায় বললাম,

-‘আমার আপনার সাথে বিন্দুমাত্র কথা বলার শখ নেই। ছাড়ুন আমায়।’

আমি হাত মোচড়ামোচড়ি করতেই উনি ঝুঁকে এলেন একটু। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কেনো যেন মনে হচ্ছে উনার মধ্যে এমন কোনো ইনটেনশন নেই যা আমায় ক্ষতবিক্ষত করে দিবে।এই চোখজোড়াতে আর যাই হোক লালসা থাকা অসম্ভব। কোনোভাবে উনি আমায় জব্দ করতে চা্ছেন না তো? তাহলে আমিও ছাড়ার পাত্রী নই। উনি আমার সাথে যা করেছেন প্রত্যেকটা ব্যবহারের মাসুল দিতে হবে উনাকে। উনার মনের কথাগুলো বোঝার জন্য একটাই উপায় আছে আমার কাছে, ‘ইগ্নোরেন্স মিশন কন্টিনিউ রাখা’। উনি আমার কোনোরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে বিস্মিত হলেন কেমন যেন। জড়ানো গলায় বললেন,

-‘আমার কথা শুনলে তো নিজেকে গুটিয়ে ফেলো তুমি। আর এবার তো কোনো রিয়্যাকশনই দেখতে পারলাম না। বড্ড চেন্জ হয়ে গিয়েছো আহি।’

আমি উনার কথার প্রতিউত্তর দিলাম না এবার। শুধু মৌনস্বরে বললাম,

-‘ছাড়ুন আমায়।’

-‘আগে আমার কথা ঠান্ডা মাথায় শুনো আহি। আই নো সন্ধ্যার ঘটনার জন্য তুমি অনেক রেগে আছো আমার ওপর। বাট ট্রাস্ট মি, আমি বলতে চেয়েছিলাম যে তুমি আমার ওয়াইফ তবে তাকে কথাটা বলার আগেই তুমি হনহন করে চলে এলে। একটাবারও সুযোগ দিলে না আমায় এক্সপ্লেইন করার।’

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম আমি।বললাম,

-‘আমি আপনার কে হই যে আমায় এক্সপ্লেইন করবেন? আপনিই তো বলতেন যে আমি আপনার এগ্রিমেন্ট ছাড়া আর কিছু না। তাহলে কষ্ট করে এক্সপ্লেইন করতে হবে না।’

আনভীর কিছু একটা ভেবে ছেড়ে দিলেন আমাকে। উনার চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আমার কোনো কথাই উনার ওপর কোনোরূপ কোনো প্রভাব ফেলেনি। উনি এবার বিছানায় এক কোণে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। গম্ভীর গলায় বললেন,

-‘যতদিন আমার সাথে আছো রাতে বিছানা ছাড়া অন্য কোথাও ঘুমাবে না। এটা আমার ওয়ার্নিং বলতে পারো।’

-‘কেনো শুনবো আমি আপনার কথা?’

-‘আমি তোমার হাজবেন্ট তাই।’

আনভীরের মৃদু উত্তর। আমি উঠে বসলাম এবার। উনার কথাবার্তাগুলো নির্ঘাত পাগল করে দিবে আমাকে।আমি ক্ষীপ্ত স্বরে বললাম,

-‘আপনি যে কি চান আপনি নিজেও মনে হয় জানেন না আনভীর। আমাদের বিয়ের শুরুর কয়েকদিন তো আমার সাথে যা তা ব্যবহার করেছেন। হ্যা মানছি যে আপনার প্রেস্টিজ আমার জন্য নষ্ট হয়েছিলো তাই বলে আমার সাথে এমন করবেন?আচ্ছা সেটাও মেনে নিলাম। তাহলে আমার ওপর এত দরদ কেনো আপনার? আমি কি পড়ে যাবো, কার সাথে কথা বলবো, আমার পড়াশোনা , আমায় নিয়ে দুশ্চিন্তা করা এগুলো সবই করেন আপনি। আমার পড়াশোনার খেয়াল রাখেন, আমি সন্ধ্যাবেলা কফি খাই সেটা পর্যন্ত নজরে রাখেন, আমার জ্বর হলে সবচেয়ে অস্থির কিন্ত আপনিই হয়ে পড়েন। এটা কি আদৌ আপনার শুধু দায়িত্ব? আপনাকে একবার দেখলে মনে হয় আপনার মতো কেউ আমার খেয়াল রাখতে পারবে না, আবার নিমিষেই আকাশের মতো রং পাল্টে দুর্ব্যবহার করেন আমার সাথে।আমি এবার গোলকধাধায় পড়ে গিয়েছি আনভীর। আপনার দুই-পাক্ষিক আচরণ আমায় উদ্বিগ্ন করে তুলছে।’

আনভীর গহীন দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। আমি কথা বলে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকলাম এবার। আজ উনাকে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতেই হবে। নাহলে কিছুতেই উনাকে ঘুমাতে দেবো না। আনভীর ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর মৃদু গলায় বললেন,

-‘আমি মানুষটাই এমন।আকাশের রঙের মতো পাল্টে যাই পরিস্থিতির শিকারে। তোমার একটা প্রবলেম কি জানো?তুমি আমার সব আচরণ ধরে বসে থাকো। আমি যতবার তোমার সাথে রাগারাগি করেছি বা এগ্রিমেন্টের কথা বলেছি ততবারই সব করেছি রাগের বশে। কিন্ত তুমি তো আবার বুঝো উল্টো। খালি এটা নিয়ে পড়ে থাকো যে আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। তোমায় কেনো কষ্ট দেই জানো? যাতে তুমি নিজেকে শক্ত করতে পারো। তুমি খুবই দুর্বল ছিলে আহি। কেউ কিছু বললেই কষ্টে মন ভাসিয়ে দিতে। কারণটাও আমার অজানা নয়। তাই আমি চাইতাম যে তুমি স্ট্রং হও। সবাই সাময়িক সময়ের কথা ভাবলেও আমি চেয়েছিলাম তোমায় স্ট্রং রাখতে। তোমার এন্সার পেয়েছো? তাহলে আমায় নিয়ে গবেষণা বন্ধ করে পড়ালেখায় মন দাও।সামনে এডমিশন টেস্ট আর তুমি আমায় নিয়ে গবেষণা করছো।
আর আমি যে ঠিক কি চাই তা ভালোমতই জানা আছে আমার। সেটা তোমায় ভাবতে হবে না। নাও লেট মি স্লিপ।এখন নিজেও ঘুমাও আর প্লিজ এই মেলোড্রামা অফ করো।’

বলেই মাঝখানে একটা কোলবালিশ দিয়ে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। আমার মনের জমানো অভিমান তিলে তিলে বেড়ে ওঠলো এবার। আমিই আসলে অনেক বেশি আশা করে ফেলেছিলাম উনার কাছ থেকে।আমি বুঝে ফেলেছি উনি যা করছেন এসব দায়িত্ববোধ ছাড়া কিছুই নয়। আমি বিছানায় হুয়ে পড়লাম এবার। কাটিয়ে দিলাম একটি নিদ্রাহীন রাত।

__________________

সকালে কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি আমি। আনভীর তখন নাস্তা শেষ করে রুমে আসলেন হঠাৎ। আমার মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর নেই। আনভীর বললেন,

-আজকে ক্লাস হবে নাকি মডেল টেস্ট?’

-‘ক্লাস হবে।’

মৃদু গলায় বললাম আমি। আমায় এতোটা কঠোর হতে দেখে আনভীর চমকে গেলেন একটু। তবে কিছু প্রকাশ করলেন না। হাতঘড়ি পড়তে পড়তে বললেন,

-‘আজকে আমি দিয়ে আসছি তোমাকে।’

-‘আপনার যেতে হবে না। ধ্রুব ভাইয়া আসছেন এখানে। উনার সাথেই চলে যাবো।’

ধ্রুব নামটি শুনে আনভীরের শান্ত মুখখানা নিমিষেই ক্রোধে ছেয়ে গেলো হঠাৎ। আমি সেদিকে একপলক তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিলাম। আনভীর শীতল গলায় বললেন,

-‘ধ্রুব এখানে আসছে কেনো? ওর আসার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি দিয়ে আসছি তোমাকে।’

-‘বললাম তো আপনার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আমার কোচিং আপনার ভার্সিটির একেবারে উল্টোদিকে। তাই আমার জন্য আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে হবে না।’

আনভীর অপ্রসন্ন হলেন আমার কথায়। তাই বললেন,

-‘সময় লাগলে লাগুক। ওই ধ্রুবের সাথে তোমায় ছাড়ছিনা আমি। পাগল পেয়েছো আমাকে?’

আমি বিস্ময় নিয়ে তাকালাম উনার দিকে। তাজ্জব হয়ে বললাম,

-‘আপনার হয়েছেটা কি একটু বলুন তো?আমি ধ্রুব ভাইয়ার সাথে গেলে আপনার কি তাতে? জেলাস ফীল করছেন নাকি!’

আমি সন্দিহান চোখে উনার দিকে তাকাতেই ভড়কে গেলেন উনি। কিছু বলতে চেয়েও পারলেন না। এইপ্রথম দেখলাম উনাকে এতটা অপ্রস্তুত হতে। তবে মানুষটাকে জব্দ করতে পেরে ভালোলাগছে বেশ। উনাকে চুপ থাকতে দেখে বললাম,

-‘থাক! কিছু বলতে হবে না। আমি গেলাম এবার।’

বলেই আমি দ্রুত চলে গেলাম বাহিরে। আনভীরও দ্রুত আমার পিছু পিছু আসছিলো তখন ড্রইংরুমে শিউলি ভাবি উনাকে বললেন,

-‘একি আনভীর! এভাবে কোথায় যাচ্ছো।’

-‘বউয়ের বডিগার্ড হয়ে যাচ্ছি।’

আনভীর এই কথাটি বলেই দ্রুত প্রস্থান করলেন ফ্ল্যাট থেকে।আমি উনার কথা শুনেও না শোনার ভান করলাম। যতই মানুষটাকে এড়িয়ে যেতে চাই ততই কাছে আসার চেষ্টা করেন যেন। ধ্যাৎ! ধ্রুব ভাইয়ার কথাটা বলাতেই মনে হয় ভুল হয়েছে। গ্যারেজের বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি কোথাও নেই ধ্রুব ভাইয়া। পরক্ষণেই আমার মনে পড়লো যে আনভীরের থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আজ ১০ মিনিট আগেই নেমে এসেছি আমি। বিরক্তির আভাস দেখা দিলো আমার কপালে। সব দোষ ওই চশমিশ বিলাইটার! হিটলার কোথাকার! আজ তার জন্যই এই গরমে এখন দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আমাকে। হুট করে কোথোকে গাড়ি নিয়ে সামনে এসে পড়লেন আনভীর। গাড়ির কাচ খুলে স্থির কন্ঠে বললেন,

-‘ফটাফট বসে পড়ো গাড়িতে।’

আনভীরের চোখ মুখ থমথমে। হঠাৎ উনার এরকম পরিবর্তনে একটু তটস্থ হলাম আমি। এই লোকের সুবিধা নাই। পরে না বললে আবার জানি কি উল্টাপাল্টা করে বসবে।আমায় পুনরায় চোখ রাঙানি দিতেই আমি এবার দরজা খুলে বসে পড়লাম গাড়ির সিটে। সাথেসাথেই উনি আমার কাছে ঝুঁকে সন্তর্পণে লাগিয়ে দিলেন সিটবেল্টটি। একবারও জিজ্ঞেস করলেন না যে আমি লাগাতে পারবো কি-না।গাড়ি স্টার্ট করতে করতে গম্ভীর গলায় বললেন,

-‘এতোদিন একা যাওয়া আসা করেছো দ্যাটস ইট। এখন থেকে আমিই তোমায় দিয়ে আসবো আর নিয়ে আসবো। ধ্রুবের এখানে আসার প্রয়োজন নেই।তোমার জন্য আপাতত আমিই যথেষ্ট। বুঝেছো?’

-‘হুম্।’

আনমনে উত্তর দিলাম আমি।আমি বুঝিনা যে ধ্রুব ভাইয়ার ব্যাপারে উনি এমন কেনো? ধ্রুব ভাইয়া তো উনারই ফ্রেন্ড। তবুও এত ইনসিকিউর?ওহ্! আমি তো আবার ভুলে গিয়েছিলাম এতো আবার পাগল মানুষ। কখন মাথায় কোন ভুত চড়ে বসে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। শেষমেষ এক পাগলের পাল্লাতেই পড়তে হলো আমায়।
.
.
কোচিংয়ের সামনে গাড়ি থামাতেই আমি নেমে যাচ্ছিলাম তখন উনি বললেন,

-‘থামো। আমিও আসছি।’

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম এতে। জিজ্ঞেস করলাম,

-‘আপনিও আসছেন?’

-‘হ্যাঁ।’

বলেই গাড়ি থেকে নেমে আমার হাত ধরলেন তিনি। আমার কয়েকজন ক্লাসমেট অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেননা এই এক মাসে সচরাচর একাই এসেছি আমি। আনভীর আসলেও কেউ আমাদের একসাথে এভাবে দেখেনি। তাই হঠাৎ আমার সাথে এক সুদর্শন ব্যক্তিকে দেখে সবাই একটু বিস্মিত । কোচিংয়ে এক স্যারের সাথে আমার পড়াশোনার ইমপ্রুভমেন্ট নিয়ে কথা বললেন তিনি। আমার বায়োলজিতেই জাস্ট একটু প্রবলেম হচ্ছে এটা শুনে আনভীর স্যারকে আমার একস্ট্রা ক্লাস নিতে বলে দিলেন এবার। এখানকার সব স্যারই মূলত উনার পূর্বপরিচিত। তাই স্যার যখন উনাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি উনার কে হই , উনি নির্দ্বিধায় বললেন,

-‘আমার ওয়াইফ!’

আমি বড় বড় চোখ করে তাকালাম উনার দিকে। এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়, উনি কোচিংয়ের আমার সকল ক্লাসমেটদের বলেছেন যে আমি উনার স্ত্রী। সবাই তো রীতিমতো আমায় প্রশ্ন করা শুরু করেছে যে এতদিন আমি বলিনি কেনো। ব্যাপারটা খুব সাবধানে সামলে নিলাম আমি। আনভীর এবার কোচিং থেকে যাওয়ার সময় আমায় বললেন,

-‘ছুটির সময় একা যেওনা। আমি আসবো নিতে।’

উনার রাতারাতি পরিবর্তন বেশ ভাবিয়ে তুলছে আমাকে। একদিন আগেও যেই মানুষটা আমায় সবার সামনে স্ত্রী বলে পরিচয় দিতে চাননি সেই মানুষটাই এখন সবার সামনে নির্বিকারে আমার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। আসলেই! পৃথিবীটা যেমন অদ্ভুত, আনভীর তার থেকেও বেশি অদ্ভুত!!
.
.
~চলবে……ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here