এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ১০+১১

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১০

-‘এবার তো তোমার কোমড় ছাড়ছিনা মিস।আফটার অল, হাজবেন্ট আমি তোমার। আমি চাইলে তোমার হাত কেন! কোমড়, পেট , পিঠ সব কিছু ধরে রাখতে পারবো।পারলে সারাদিন নিজের সাথে ফেবিকলের মতো আটকে রাখবো। কি করতে পারবে তুমি?’

আমার কান দিয়ে রীতিমতো ধোঁয়া বের হতে থাকলো উনার কথাগুলো শুনে। আল্লাহ! আমারে তুমি ধৈর্য দাও। নাহলে এই অসভ্য লোকের অসভ্য কথাগুলো শুনে কবে জানি আমার প্রাণপাখি ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে।এই আমায় মিস বলে, আবার এই বলে উনি নাকি আমার হাজবেন্ট।এর যে মাথার স্ক্রু ঢিলা আছে আগেই আমার বোঝা উচিত ছিলো। আমি আশপাশে তাকিয়ে অসহায়ভাবে নিজের কোমড় থেকে উনার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। আমায় এমন করতে দেখে উনি আরও শক্তভাবে আমার কোমড় আকড়েঁ ধরলেন। আমি কড়াচোখে উনার দিকে তাকিয়ে দেখি সে নির্বিকার। যেন এসব করাটা তার কাছে মোটেও কোনো ব্যাপার না। আমি তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললাম,

-‘ছাড়ুন আমায়।’

-‘আমি কি তোমায় ধরেছি। আমি তো জাস্ট তোমার……’

এতটুকু বলেই ঠোঁট কামড়ে মাথা ঘুরিয়ে নিলেন। আমার এবার প্রচন্ড রাগ লাগছে। নিজে আমার সাথে অসভ্যতামো করে আর আমি কিছু না করেই উনার রামধমক খাই।আমায় এরকম ফোস ফোস করতে দেখে উনি ছেড়ে দিলেন আমায়। কানের কাছে জড়ানো গলায় বললেন,

-‘কিছু পারো আর না পারো , উনিশ থেকে বিশ হলে সাপের মতো ফোস ফোস করতে ভালোই পারো।(একটু থেমে) যার সাথে কথা বলবে , ডিসট্যান্স নিয়ে কথা বলবে। কারও সাথে হাত মিলাতে হবে না। তোমার হাত মিলানোর জন্য আপাদত আমিই যথেষ্ট।’

বলেই উনি আমায় এখানে রেখে চলে গেলেন আজরান ভাইয়ার কাছে। আমি একপলক উনির দিকে পরখ করে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আমি জানি উনার এসব ব্যবহার শুধুমাত্র ছয় মাসের জন্যই। তারপর আমায় ছুঁড়ে ফেলে দিতেও দু’বার ভাববেন না। যেদিকে আমার বাবাই আমাকে বোঝা মনে করেছেন সেদিকে উনার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা স্বাভাবিক। অনুষ্ঠান শেষে এবার আমরা সবাই রওনা দিলাম বাড়ির জন্য। বাসায় আসতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। তাই বাবা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তখন। মা ড্রইংরুমে আমাদের আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি তার সাথে চোখাচোখি হওয়া মাত্র বরাবরের মতোই একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিলাম।তবে এবার আমায় অবাক করে দিয়ে প্রতিউত্তরে হাসলেন উনিও। অবশেষে উনি আমায় নজর দেওয়া শুরু করেছেন। আমার মনের থেকে এবার একটি চাপা দুঃখ নেমে গেলো।
.
.
বাহিরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জানালা খুলে দেওয়াতে শীতল বাতাস সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি এসময় টেবিলে বসে আজকের ক্লাসের পড়াগুলো রিভাইস করে নিচ্ছি। আমার ছোটবেলা থেকেই লেট নাইটে পড়ার অভ্যাস। এসময় আমি অনেক মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারি। সেই পূর্বের মতো রুটিন অনুসরণ করে এখন টেবিলে বই নিয়ে পড়ছি আমি। মেডিক্যালের পরীক্ষার জন্য আমার পড়াশোনার সময় বাড়িয়ে দিতে হবে অনেক । যেহেতু আমার টার্গেট ডিএমসি। আনভীর রুমে নেই। উনি লাইব্রেরি রুমে চলে গিয়েছেন বরাবরের মত। উনিও আসলে রাত করে পড়াশোনা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আবার ম্যাথ প্রফেসরদের পড়াশোনার জন্য নীরব পরিবেশের প্রয়োজন হয় , তাই রাতে পড়াটাই উনার সবচেয়ে বেশি প্রিয়।
এই কথাটি ভাবতেই একটি পুরোনো ঘটনা স্মৃতিচারণ হলো আমার।

তখন আমার ক্লাস নাইনের মিড টার্ম পরীক্ষা চলছিলো। তাই পড়াশোনারও ছিলো প্রচুর চাপ। আমি তাই সেই সুবাদে রাতে লাইট জ্বালিয়ে পড়াগুলো রিভাইস করছি। আমার টেবিলের ঠিক সামনেই রয়েছে জানালা যেটা দিয়ে আমাদের প্রতিবেশি বাড়িটি দেখা যায় যেহেতু বাড়িটা আমাদের বাড়ির প্রাচীর ঘেষেঁ। সেদিকে চোখ পড়তেই আমি থমকে গেলাম তখন। আনভীর বারান্দায় বসে বসে বই পড়ছেন। এটা ছিলো উনার সাথে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। প্রথম দেখায় উনি যখন আমায় পিচ্চি বলেছিলেন তখন আমি এতটাই রেগে গিয়েছিলাম যে পরবর্তীতে উনার সাথে কথা বলার চেষ্টাও করিনি আমি। হঠাৎ আনভীর মাথা ঘুরাতেই দেখলেন আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের চোখাচোখি হতেই আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। আনভীর ভ্রু নাচিয়ে তখন বললেন,

–‘এই পিচ্চি ! এমন হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে পরীক্ষায় আর পাশ করা হবে না। পড়ো?’
.
.
.
কথাগুলো মনে পড়লেই হাসি এসে পড়ে এখন। তবে সেদিন আমায় পিচ্চি বলাতে আমি অনেক রেগে গিয়েছিলাম। আর সেই পিচ্চি আমিই এখন উনার বউ। আমার ঘুম পাচ্ছে অনেক। তাই বই বন্ধ করে লাইব্রেরিরুমে চলে গেলাম আনভীরকে ডাকার জন্য। গিয়ে দেখি উনি লাইব্রেরির স্টাডি টেবিলে নেই। আমি কিঞ্চিত অবাক হলাম এতে। টেবিল ল্যাম্প জ্বালানো , বই-খাতা, ল্যাপটপ সব এখানে রাখা তাহলে উনি গেলেন কোথায়?আমি উনাকে খুঁজার উদ্দেশ্যে লাইব্রেরি ছেড়ে ড্রইংরুমের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ বারান্দায় একটা সরু শব্দ পেলাম। বারান্দার দরজাটি হালকা ভিড়ানো। আমি শব্দটির উৎস জানার জন্য বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলাম এবার। দরজা খুলে বাহিরে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। আর পা এগোনোর সাহস নেই। আনভীর দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায় বাহিরের দিকে মুখ করে। শরীর ক্লান্ত , অবসন্ন। আমি বুঝতে পারছি না যে এখন উনাকে ডাকা উচিত কি-না।ইনি তো আবার সোজা পথের মানুষ না, ডাকলেই বাঘের মতো গর্জে ওঠবে।
আমি এসব দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম তখনই আনভীর একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ বলে ওঠলো,

-‘এখানে আসো।’

শীতল কন্ঠ আনভীরের। আমি অবাক হয়ে গেলাম এতে। কেননা আমিতো এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আর উনিও তো আমাকে দেখেননি তাহলে বুঝলেন কিভাবে যে আমি এখানে?আমি এবার ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম উনার দিকে। ঠিক আনভীরের পাশে দাঁড়ালাম। উনি তখনই বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আবছা আলোতে উনার মুখটা দেখতে অন্যরকম লাগছে। চশমা না পড়াতে চোখের দৃষ্টি লাগছে কিছুটা ভিন্ন। আনভীর তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললেন,

-‘আজ দুপুরে কি হয়েছিলো তোমার?’

যেই ভয়টা হয়েছিলো সেটাই। তবে আমার এক্সপেক্টেশনের বাহিরে ছিলো যে এখন উনি এ প্রশ্নটা করে বসবেন। আমি দ্বিধায় পড়ে গিয়েছি এবার। চিন্তায় আবার ঠোঁট কামড়াতে গেলেই আনভীরের চোখ রাঙানি দেখে থেমে গেলাম আমি। আনভীর আবারও স্থিরভাবে বললেন,

-‘কি হলো বলো?’

আমার হঠাৎ দুপুরের সেই কথাগুলোর কথা মনে পড়তে লাগলো। আমি স্পষ্ট শুনেছি সেই মানুষটার কন্ঠ।আর যাই হোক , তার অত্যাচারের শিকার আর কখনোই আমি হবোনা। আর ভুগতে চাই না সেই আঘাতগুলোর কষ্টে যখন চাচ্চু-চাচিমা কেউই আমার পাশে দাঁড়াতো না। টাকার জন্য তারা যতটা নিচে নামতে পেরেছিলো ঠিক ততটাই নিচে নেমেছিলো তারা। হঠাৎ আমার কপাল বেয়ে টপ টপ করে ঘাম ঝড়তে থাকলো। আমায় এতটা অস্থির হতে দেখে আনভীর আমার হাত স্পর্শ করলেন আলতো ভাবে। বললেন,

-‘রিলেক্স আহি। থাক, কিছু জিজ্ঞেস করবো না।’

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম উনার কথা শুনে। নিশিরাতের আড়ালে ফুরফুরে হাওয়া সর্বত্র বয়ে শরীরে এক অন্যরকম শিহরণ জাগিয়ে তুলছে এবার। আনভীর বলে ওঠলেন,

-‘আহি।’

-‘হুম?’

-‘ধ্রুবের সাথে কোচিংয়ে পড়ালেখার বাহিরে খুব বেশি একটা কথা বলবে না।’

আমার ভ্রু আপনা আপনি কুচকে এলো। উনার কথাটি আমার কেমন যেন মাথার ওপর দিয়ে গিয়েছে। এই মানুষটা মহা জ্বালায় তো। তাই অবাক হয়ে বললাম,

-‘কেনো, পড়ালেখার বাহিরে কথা বললে কি হবে।’

আনভীর ঠোঁট চেপে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে।কড়া গলায় বললেন,

-‘হাতে-পায়েই শুধু বড়ো হয়েছো। নাহলে মাথাটা এখনও পিচ্চি গতিতে দৌড়াচ্ছে তোমার। এত প্রশ্ন করতে আগেই না বলেছিলাম না? ধ্রুবের সাথে পকর পকর বেশি করবানা দ্যাটস ইট!’

আমি এবার কথা বললাম না কোনো। শুধু মাথা নাড়িয়ে বোকার মতো সম্মতি জানালাম।

____________

কোচিং থেকে বেরিয়ে বাসায় ফিরছি আমি। দীর্ঘ একঘন্টা ক্লাস করার পর মাথাটা কেমন যেন ভোঁ ভোঁ করছে।বাহিরে গতকালকের মতোই আজ প্রচন্ড গরম। তাই রোদে পুড়ে মুখ কেমন যেন লাল হয়ে গিয়েছে। বাসায় দ্রুত এসেই লম্বা সময় একটা গোসল সারলাম। এখন বেশ ঠান্ডা লাগছে। আজ হঠাৎ করে বাবার কথা কিভাবে যেন মনে পড়ে গেলো। আচ্ছা, বাবাকে কি একটা ফোন করবো? কিন্ত আনভীর যে সরাসরি বলে দিয়েছেন তাদের সাথে যোগাযোগ না করতে? আমার কাছে এটা একেবারেই অসম্ভব। একজন সন্তান হয়ে কিভাবে আমি পারবো আমার বাবার সাথে কথা না বলে থাকতে? তাও একজন এমন মানুষের কথায় যে আমাকে স্ত্রী হিসেবে মানে শুধুমাত্র চুক্তির দায়ে।
এখন তপ্ত দুপুর। তাছাড়া এসময় আনভীর কখনোই ঘরে থাকেন না। এটাই মুখ্য সময় বাবার সাথে কথা বলার জন্য। আমি আর কিছু না ভেবে বাবার নম্বরে কল দিয়ে দিলাম। আজ অনেকদিন পর বাবার সাথে কথা বলেছি আমি। যদিও আমি বেশি কিছু বাবাকে জিঙ্গেস করিনি চাপা ক্ষোভের জন্য।এর মধ্যে আমি আরও একটা মিথ্যে বলতে বাধ্য হয়েছি যে আনভীরের সাথে আমার সম্পর্ক সব স্বাভাবিক। কিছু কিছু সময় একটি মিথ্যা কারও মনও ভালো করতে পারে।
কথাবার্তা শেষ করে আমি মায়ের কাছে গেলাম সাহায্য করার জন্য। আনভীর এসেছেন সন্ধ্যার দিকে। আমি তখন ড্রইংরুমে বসে ভাবির সাথে টিভি দেখছিলাম। আনভীরের চোখ মুখ লাল। মুখটা কেমন যেন থমথমে হয়ে আছে। শার্টের ওপর দুটো বাটন খোলতে খোলতে আমার উদ্দেশ্যে বললো,

-‘রুমে আসো আহি।’

আমি এমন কন্ঠে কিছুটা ভড়কে গেলাম। শিউলি ভাবিও হয়তো কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছেন হয়তো। আমি তাই আলতো ভাবে মাথা দুলিয়ে আনভীরের পিছে পিছে গেলাম। আমি রুমে ঢুকতেই শব্দ করে দযজা লাগিয়ে রুমে বিকট একটা শব্দ সৃষ্টি করলেন উনি।আমি কেপেঁ উঠলাম এমন শব্দে। আনভীর দাঁত চেপে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করে চলছেন। আমি কাপাঁ কাপাঁ গলায় জিজ্ঞেস করলাম,

-‘কি হলো আপনার?’

আনভীর এবার রাগের বশে টেবিল থেকে একটা গ্লাস নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারলেন ফ্লোরে। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছি প্রচন্ড। উনার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। নিঃশ্বাস ফেলছে বারবার। এবার উনি আমার কাছে এসে সজোরে বাহু চেপে ধরলেন আমার। ব্যাথায় কাকিয়ে উঠলাম আমি। আনভীর গর্জে বলে ওঠলেন,

-‘সাহস কি করে হলো তোমার উইথআউট মাই পার্মিশন তোমার সো কল্ড ড্যাডকে ফোন দাও তুমি?’

আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। উনি বলে উঠলেন,

-‘কি ভেবেছো আমি বুঝবো না? তোমার বাবা কল দিয়ে দাওয়াত করেছে আমায় তোমাদের ওই নোংরা বাড়িতে।কি বলেছো তুমি? যে আমাদের মধ্যে সব ঠিকঠাক? আমি হ্যাপি লাইফ লিড করছি তোমার সাথে? বিয়ে মাই ফুট!’

আমার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি বারবার নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি উনার আবদ্ধ থেকে। আমায় এমন করতে দেখে উনি আরও ক্ষেপে গিয়ে নিজের সাথে আরও গভীরভাবে মিশিয়ে রাখলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

-‘আর কত মিথ্যা বলবে আহি? আমি আর তোমার এসব কাজ নিতে পারছি না। বারবার শুধু আমার মনে পড়ে তোমার সাথে আমায় নিয়ে বানানো সেই নোংরা কথাগুলোর কথা। আমার ক্যারেক্টারে আঙুল তোলার কথা।আজ তোমার বাবা যখন আমায় কল দিয়ে বললো আমাদের তাদের বাড়িতে আসতে , আমি তার এসব কথা শুনে প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলাম। পরে ভাবলাম যে উনি কল দিলেন কেন? কথাবার্তার এক পর্যায়ে বুঝতে পারি তুমি কথা বলেছো উনার সাথে।তাহলে মিথ্যে বললে কেনো যে আমার সাথে সবকিছু ঠিকঠাক? কিছু বলো আহি!’

শেষের কথাটা এতই জোরে বললেন যে আমার কানের পর্দা ফেটে গিয়েছে। আনভীর আমায় দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,

-‘তুমি যতই আমারওপর নিজের বউগিরি দেখাতে আসো না কেন, তুমি আমার কাছে একটা এগ্রিমেন্ট ছাড়া আর কিছু না। আমি যা করছি সবকিছু করছি দায়িত্ববোধের জন্য, কোনো ভালোবাসা-টালোবাসার জন্য নয়, ‘কজ আই হেইট ইউ আহি।’

বলেই আমার বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিলেন উনি।তারপর জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলেন। একটাবারও জিজ্ঞেস করলেন না যে কেনো বাবাকে আমি মিথ্যা বললাম।তখন আমায় ধাক্কা দেওয়ায় পায়ে কাচের গ্লাস বিধে যাওয়াতে ব্যাথাও লাগছে অনেক। আমার কাছে আশেপাশের সবকিছু বিরক্তিকর লাগছে। লাগছে বিষাক্ত।
আমি সেভাবেই খাটে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম কিছুক্ষণ। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি টেরও পাইনি। তবে আমায় ঘুম ভাঙলো রাতে কপালে কারও স্পর্শ পাওয়ায়।পিটপিট করে চোখ খুলতেই আনভীরের মুখ দেখতে পারলাম আমি। উনি একটু পরপর কপালে ভেজা রুমাল পট্টি দিচ্ছেন। মুখটা অবসাদ, বরাবরের মতো ঝুঁকেই কাজ করতে লাগলেন। আমার বলতে ইচ্ছে করছিলো অনেককিছু। কিন্ত বলতে পারলাম না। উনার শীতল কন্ঠে , ‘ঘুমাও আহি’ বলা কথাটি শুনেই সেই বলিষ্ঠ হাত জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
.
.
.#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১১
পিটপিট করে চোখ খুলতেই আমার মুখের অনেকটা কাছাকাছি দেখতে পেলাম আনভীরকে। উনি খাটের একপাশে বসেই মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। কালো নরম চুলগুলো কপালে পড়ে আছে সন্তর্পণে। আমি আস্তে করে উঠে বসলাম এখন। গতকাল উনার সাথে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর সন্ধ্যার সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তারপর কি হয়েছিলো আমার মনে নেই। এর মাঝে আনভীরকে আমার মাথায় জলপট্টি দেওয়ার বিষয়টি মনে করতেই আমি আশেপাশে তাকালাম। একপাশে একটি গামলা আর তোয়ালে পড়ে আছে। আমার বালিশের পাশেই থার্মোমিটার রাখা। নিজেকে কিছুটা ঘর্মাক্ত দেখে আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে রাতে জ্বর এসেছিলো আমার। হয়তো শেষ রাতে জ্বর ছাড়ার কারনেই কিছুটা ঘেমে গিয়েছি।সকালের আলো ফুটে অবাধ্য রশ্নিগুলো সারা ঘর আলোকিত করে তুলছে।এর মধ্যে মানুষটার ঘুমন্ত মুখ আরও মোহনীয় ছিলো।

আমি আধো ঘুমন্ত চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম উনার দিকে। আনভীর আজকে নিজের জায়গায় ঘুমান নি। খাটের একপ্রান্তে বসেই দেয়ালে কিছুটা মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি তপ্তশ্বাস ছাড়লাম এবার। গতকাল উনার সেই জঘণ্য ব্যবহারের কথাগুলো ভাবতেই কান্না পাচ্ছে আবার। আচ্ছা, আমি কি এতটাই খারাপ যে আমায় এতোটা ঘৃণা করেন উনি? আমি তো বলেছিলাম যে সময় হলে আমি নিজেই চলে যাবো তাহলে কেনো উনি এগ্রিমেন্টের কথাটি বলেন বারবার? আবার গতরাতে আমার জ্বরের মধ্যে এতটা কেয়ারিং এর দরকার ছিলো কিসের? সবই কি শুধু দায়িত্ববোধ?আমি চিন্তায় হাত মুঠো করে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম এবার।

এতদিন আমি উনার সব কিছু মেনে নিয়েছি তবে আর না। এই আমার জন্য কেয়ারিং হবেন আবার এই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে দু’বার ভাববেন না, আমিও তো মানুষ। এবার আমি মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। এই মানুষটার সকল খারাপ ব্যবহার এড়ানোর জন্য নিজেকে শক্ত হতে হবে আগে। এভাবে দুর্বল থাকলে শুধু উনি কেনো, যে কেউই আমায় অপমান করে বেড়াবেন। এখন থেকে উনি শুধু নামেমাত্র আমার স্বামী, দ্যাটস ইট। আমার টার্গেট একটাই , কোনোভাবে মেডিক্যালে চান্স পাওয়া। তারপর আমি না থাকবো এখানে, না ফিরে যাবো আমার বাবার কাছে। এই পৃথিবীতে এখনও একজন আছে যে আমার দেখাশোনা করতে পারবে।

আমি এবার উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফ্রেস হওয়ার জন্য। উনাকে একবারও ডাকিনি খাটে ভালোমতো শোয়ার জন্য। এখন থেকে রীতিমতো আমি এড়িয়ে যাবো আনভীরকে।
.
.
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখি উনি খাটে নেই। বিছানাও ইতিমধ্যে গুছিয়ে ফেলেছেন। গামলা-তোয়ালে ওয়াশরুমের দরজার পাশে রাখা। আমি এগুলো তুলে ওয়াশরুমে রেখে দিলাম। আমার উপস্থিত টের পেয়ে উনি বারান্দা থেকে ভেতরে আসলেন। বলে ওঠলেন,

-‘শরীর কেমন এখন তোমার?’

-‘ভালো। ‘

আমার মৃদু প্রতিউত্তর ।আনভীর এবার বললেন,

-‘আমি ওষুধ এনেছি গতরাতে। টেবিলে রাখা আছে। সকালে নাস্তার পর ওগুলো খেয়ে নিলো।’

-ঠিক আছে।
বলেই আমি রুমের বাইরে পা বাড়াচ্ছিলাম। আমি মনে মনে ভাবি যে গতকালের সেই দুর্ব্যবহারের জন্য হয়তো আমার সরি বলবেন। কিন্ত আমায় একবারও আটকালেন না তিনি। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের বাইরে বের হলাম। গতরাতে জ্বরের জন্য শরীর দুর্বল লাগছে বেশ। তার ওপর আবার দেরিতে উঠেছি। শ্বশুড়বাড়িতে এত দেরিতে ওঠাটি সাধারণত কেউই ভালো চোখে দেখেনা। কিন্ত আমায় অবাক করে দিয়ে কেউই কোনোরূপ কোনো আক্ষেপ প্রকাশ করলো না এতে।আমি রান্নাঘরে এগিয়ে যেতে দেখি নুড়ী আপা প্রতিদিনকার মতো রান্নাঘরে কাজ করছে। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে শিউলি ভাবি। তবে মা’কে দেখে আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। তিনি নিজ ধ্যানে চা বানাতে মগ্ন। সকালে পড়তে বসার আগে চা খাওয়াটা আমার নিত্যদিনের অভ্যাস। তার ওপর গতরাতের জ্বর সারলেও এখন আদা চা খাওয়ার মতো একটা ইচ্ছে জেগেছে মনে। তাই উনাকে চা বানাতে দেখে কিছু বললাম না আমি। আর যাই হোক, নিজের শ্বাশুড়ি মাকে তো কেউ আর মুখের ওপর বলতে পারেনা যে ,’মা! আমায় চা বানিয়ে দাও।’
তাই ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসলাম। পরিকল্পনা করতে থাকলাম যে আজ সারাদিন কি কি করবো। এর মধ্যে হঠাৎ টেবিলে এক কাপ ধোয়াঁয় ওঠা চা আসাতে আমি আমার পরিকল্পনা কাটিয়ে বিস্মিত হয়েছি। পাশে তাকিয়ে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের চোখাচোখি হওয়া মাত্রই তিনি মিহি স্বরে বললেন,

-‘চা টা খেয়ে নাও আহি। শরীরের গ্লানিটা একটু দূর হবে।’

আমি মাথা নাড়িয়ে চায়ের পেয়ালাটি হাতে নিয়ে নিলাম। আমার কোণাকোণি চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি। আমি উনার নতুন রূপ দেখে কিছুটা অবাক হয়েছি। এই বাড়িতে একমাত্র আনভীরের মা’ই একমাত্র মানুষ যে আমার সাথে খুব যেচে যেচে কথা বলেন । কখনও কখনও তো কথাই বলেন না। ইশারায় বা আকার-ইঙ্গিতে ব্যাপারটি বুঝিয়ে দেন। এককথায় যত কম আমার সাথে কথা বলা যায় তই কম কথা বলার চেষ্টা করেন তিনি। তাই হঠাৎ আমার জন্য চা নিয়ে আসাটা বেশ ভাবিয়ে তুলেছে আমাকে। হয়তো গতরাতে জ্বর ছিলো বলেই শরীরের অবসাদবোধ দূর করার জন্য আমায় বানিয়ে দিয়েছেন। বিষয়টিতে একপ্রকার যেমন খুশি রয়েছে , তেমনই রয়েছে আত্নতৃপ্তি।
কেনা আমার মতো মা’হীনা মেয়ের কাছে এধরনের আদর বড়ই দুষ্প্রাপ্য। হঠাৎ আমায় অশ্রুসিক্ত হতে দেখে মা বিচলিত হয়ে বললেন,

-‘একি আহি! আবার শরীর খারাপ লাগছে?’

-‘না মা। ‘

আমার কথা শুনে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আমি বারবার খেয়াল করছি যে উনি হয়তো কিছু বলতে চাচ্ছেন কিন্ত কোনো এক কারনে বলতে পারছেন না। তাই দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করলাম,

-‘মা আপনি কিছু বলবেন?’

মা ‘হ্যাঁ’ বললেন প্রতিউত্তরে। তারপর কিছসময় মৌনতা কাটানোর পর বললেন,

-‘আনভীরকে তোমার কেমন লাগে আহি?’

এমন প্রশ্ন শুনে বিষম খেলাম আমি। অবাক চোখে উনার দিকে তাকাতেই উনি শুকনো কাশি দিলেন। হয়তো পুত্রবধূর কাছে এমন প্রশ্ন করে বেশ বিব্রত হয়েছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

-‘মানে?’

উনি নিঃশ্বাস ফেললেন এবার। মৃদু কন্ঠে বলে ওঠলেন,

-‘দেখো আহি। আমি আমার কথার দ্বারা কি বোঝাতে চেয়েছি তুমি তা ভালোমতই জানো। তাই কথা ঘুরিয়ে-পেচিয়ে বলবো না। এটা সত্য যে তোমাদের বিয়েটা হয়েছে বরাবরই এক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। তবুও তোমরা দুজনেই যে এই বিয়ের দ্বারা এক বন্ধনে আবদ্ধ এটা মানো?’

-‘মানি।’

-‘আমি চাই না যে তোমাদের মধ্যে কোনো দুরত্ব বা ঝামেলা সৃষ্টি হোক। শুরুতে নিজের ছেলের এত পরিবর্তন, একরোখা স্বভাব দেখে কষ্ট পেয়েছিলাম আমি। যেখানে ও বিয়ের জন্যই প্রস্তুত ছিলো না সেখানে হঠাৎ ওর বিয়েটা ভাবিয়ে তুলেছিলো আমাকে। তাই মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো তোমায়। কিন্ত আমি একটু আচঁ করতে পারছি যে আনভীরের তোমার জন্য অনুভূতি আছে। আর সেটাও খুব তীব্র।’

আরও এক দফা বিষম খেলাম আমি। তাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম মায়ের দিকে। উনি নির্বিকার , তবে কিছুটা চাপা ভঙ্গিতে বসে আছে। আমি উনার মতো শ্বাশুড়ি মা কখনোই দেখিনি যে সোজাসাপ্টা নিজের ছেলের ব্যাপারে এভাবে কথা বলে। আমি না পারছি কিছু বলতে না পারছি এখানে থাকতে। উনি আবার বললেন,

-‘গতকাল রাতে সাড়ে বারোটার দিকে জ্বর এসেছিলো তোমার। আনভীর তা দেখে একেবারেই অস্থির হয়ে পড়েছিলো। তোমায় ডাকছিলো কিন্ত জ্বর তোমায় এতটাই কাবু করেছিলো যে গোঙানি ছাড়া আর কোনো শব্দ করোনি। পরে আনভীরের জন্য আজরান একপ্রকার বাধ্য হয়ে পাশের ফ্ল্যাট দেকে আমাদের পরিচিত এক ডাক্তারকে নিয়ে আসে। তিনি বলেন যে স্ট্রেস এর জন্য তোমার এ অবস্থা। আনভীর আবার তখন ওষুধ নিয়ে আসতে গেলো রাত করে। আমি-শিউলি তোমার সাথে বসে থাকতে চেয়েছিলাম কিন্ত আনভীর থাকতে দেয়নি আমাদের। বললো, ও নাকি নিজেই তোমার খেয়াল রাখতে পারবে। এর মানে বুঝো? ও যতই ওর বাবাকে বলুক না কেনো এ বিয়ে ওর অমতে হয়েছে তবুও তোমার প্রতি ওর দুর্বলতা আছে।’

আমি কোনো কথা বললাম না প্রতিউত্তরে। শুধু এটা ভেবে অবাক হলাম যে এই মানুষটাই সন্ধ্যায় আমার সাথে যাচ্ছে তাই ব্যাবহার করেছে আবার রাত পেরোতে না পেরোতেই এত মায়া? উনি যে আসলে চাচ্ছেনটা কি সেগুলো মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। আমি মায়ের অগোচরে ফিচালো হাসি দিলাম এবার। সব উড়িয়ে দিলাম তাচ্ছিল্যতার সাথে। আমার কানে এখনও বাজছে আনভীরের তখনকার বলা সেই কথাগুলো
‘তুমি যতই আমারওপর নিজের বউগিরি দেখাতে আসো না কেন, তুমি আমার কাছে একটা এগ্রিমেন্ট ছাড়া আর কিছু না। আমি যা করছি সবকিছু করছি দায়িত্ববোধের জন্য, কোনো ভালোবাসা-টালোবাসার জন্য নয়, ‘কজ আই হেইট ইউ আহি।’

আমি না চাইতেও বারবার উনি আমায় মনে করিয়ে দেয় যে আমি জাস্ট একটা এগ্রিমেন্ট! ইয়েস, জাস্ট একটা এগ্রিমেন্ট। এবার আর যাই হোক, আগের মতো আর দুর্বল হয়ে থাকবো না আমি। ভুলে যাবো এই মোহনীয় মানুষটাকে।
.
.
বেডরুমে গিয়ে দেখি আনভীর ইতিমধ্যে গোসল সেরে বেরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্ট পড়ছেন। আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ক্লোজেট থেকে জামা বের করতে লাগলাম কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য। যদিও আমার কান অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে উনার মুখে ‘সরি’ শোনার জন্য। কিন্ত বললোনা সে।আমি হতাশ হয়ে টেবিলে ব্যাগ গুছাতে গেলেই আনভীর ডাক দিলেন,

-‘আহি?’

আমি পেছনে তাকালাম। উনি আয়নার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-‘গতকাল তো পড়তে বসোনি।আজকে কোচিং থেকে এসে পড়াগুলো কভার করে নিও। আমি রাতে সেগুলো ধরবো তোমায়।’

বলেই উনি ব্যাগ আর চশমা নিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে চলে গেলেন। হতাশ হলাম আমি। সাথে চাড়া দিয়ে উঠলো প্রবল অভিমান। এবারও উনি তাহলে সরি বললেন না আমায়!!

____________

মেডিক্যাল এডিমিশন টেস্টের জন্য আমাদের কোচিংয়ের এই ব্রাঞ্চটিতে মানুষের সমাহার অনেক। এর মধ্যে অনেকের সাথেই ভালো সখ্যতা হয়ে ওঠেছে আমার যার জন্য ক্লাসের নোট নিয়ে তেমন ঝামেলায় পড়তে হয়না। তবে এর মধ্যে আরও একজন আছে যে আমায় অনেক হেল্প করে , সেই মানুষটা হলো ধ্রুব ভাইয়া। উনি যেহেতু এখানে পড়াচ্ছেন তাই পড়াশোনা নিয়ে আমার তেমন একটা অসুবিধে হয়না। উনি ভালোমতোই পড়াগুলো ধরিয়ে দেন । আবার রাতে সেগুলো নিয়ে বসতে হয় আমার প্রফেসর বরের কাছে। উনি মেডিক্যাল স্টুডেন্ট না হলেও জিকে আর বায়োলজির ব্যাপারে ভালোই জ্ঞান আছে। এখন ক্লাস শেষ করে আমার দুজন ক্লাসমেটের সাথে কথা বলছিলাম আমি। তখনই ধ্রুব ভাইয়া ডাকেন আমায়। আমি এগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

-‘কিছু বলবেন ভাইয়া?’

উনি একগাদা নোট এগিয়ে দিলেন আমার হাতে।বললেন,

-‘আনভীর বললো তোমার বায়োলজিতে নাকি একটু প্রবেম হচ্ছে। তাই তোমার ইজির জন্য এখানে অবজেকটিভ নোট করেছি আনভীরের কথায়।আশা করি সমস্যা হবেনা।’

আমি নিয়ে নিলাম এটি। একটু অবাকও হলাম আনভীরের নামে কথাটি শুনে। আমি ধন্যবাদ বলে ক্লাস থেকে বের হতেই থামিয়ে দিলেন ভাইয়া। বললেন,

-‘এখন ফ্রি আছো আহি?’

-‘জ্বি আছি। তবে কেনো ?’

মিহি হাসলো ধ্রুব। বলে ওঠলো,

-‘পার্কে যাবে?’

আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকাই। কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। ধ্রুব আবার বললেন,

-‘তুমি যেই হারে পড়াশোনা করছো, আই থিংক তোমার কিছুটা রিফ্রেসমেন্টের দরকার। তাই বলছিলাম জাস্ট আধঘন্টার জন্য ঘুরে আসতে। পরে নাহয় বাসায় মন দিয়ে পড়ো।’

আমার হঠাৎ মনে পড়লো আনভীরের কথা। উনি না করেছিলেন পড়াশোনা ছাড়া ধ্রুব ভাইয়ার সাথে খুব বেশি একটা কথা না বলতে। সেদিকে উনার সাথে ঘুরলে উনি রেগে যাবেন নিশ্চয়ই। আমি দ্বিধা নিয়ে বললাম,

-‘আজ না ভাইয়া।’

-‘আনভীরের জন্য ভয় পাচ্ছো?’

উনার সন্দেহ জনিত কন্ঠ। আমি মৌন হয়ে রইলাম। ধ্রুব হেসে বললেন,

-‘রিলেক্স । আনভীর কিছুই বলবে না তোমায়। ও তো আর তোমার প্রতি এট্রাক্টেড না যে বেশি পজেসিভ ফীল করবে। তাছাড়া তোমরা জাস্ট এগ্রিমেন্টের জন্যই একসাথে আছো তা তো আমি জানিই। সো চিল, কিছু বলবেনা আনভীর।’

আবার এগ্রিমেন্ট! এই শব্দটা মাথা খেয়ে ফেলছে আমার। একইসাথে রাগ লাগছে আনভীর আর ধ্রুব ভাইয়ার ওপর। তবে আমি ভাবলাম বিষয়টা। উনি তো আরভুল কিছু বলেননি। যেদিকে আমাদের সম্পর্কটা টিকে আছে একটা খসড়া কাগজের জন্য সেখানে বাধা দেওয়ার আনভীর কে?উনি তো স্পষ্টই বলে দিয়েছেন যে আমায় সে ঘৃণা করে। আমি তপ্ত শ্বাস ফেললাম এবার। পড়াশোনা আর মানসিক যন্ত্রণা অতিষ্ঠ করে তুলছে আমায়। তাই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম আমি।

_________

আকাশ আজ পরিষ্কার। পাখির কলকাকলির আনাগোনায় সুন্দর পরিবেশ।বলতে হবে ধ্রুব ভাইয়া মজার একজন মানুষ। উনার সাথে কিছুক্ষণ হাটাঁহাটি করাতে আমার অবসন্ন মন নিমিষেই ভালো হয়ে গিয়েছে। প্রায় ২০-২৫ মিনিট পার্কে ঘোরাঘোরি করার পর আমি আর ধ্রুব ভাইয়া একটা রিক্সা নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে গেলাম। আমি যদিও না বলেছিলাম যে আমায় বাসায় পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজন নেই কিন্ত উনি শুনলেন না আমার কথা। তাই আমি আর কথা বাড়ালাম না। কলোনির কাছেই রিক্সা থামালাম আমি। আমি নেমে উনাকে বিনয়ী স্বরে বললাম,

-‘আপনিও বাসায় আসুন ভাইয়া?’

উনিও রিক্সা থেমে নামলেন এবার।মিহি হেসে বলেন যে আজ আসবেন না। উনি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তখনই পেছন থেকে কেউ শীতল কন্ঠে বললো,

-‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে আহি?’

আমি চমকে পেছনে তাকালাম এবার। আনভীর দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ভ্রুজোড়া একটু বাকা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি শুকনো ঢোক গিললাম এবার। উনি হঠাৎ এভাবে রেগে গেলেন কেনো?
.
.
.
~চলবে……ইনশাআল্লাহ!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here