#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৬
বিকেলের রোদ্দুর ঢেলে সন্ধ্যা নেমেছে এবার। দূর দূর সকল বিল্ডিংয়ে আলোরাশির সমাহার। বাতাসের দাপটে সর্বত্র এক ঠান্ডা আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। এই হাওয়াটা শরীরে টেনে নিতেই আমার ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীর নিমিষেই সতেজতায় ছেয়ে গেলো। কিছুক্ষণ আগে পড়া শেষ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি এখন। এডমিশন টেস্টের সেই মোটা গাইডবুকের পড়া পড়তে পড়তে মাথাটা কেমন যেন ধরে গিয়েছে। তার ওপর আনভীরের যন্ত্রণাতো আছেই। সেই যে বিকেল থেকে টেবিলে বসিয়ে রেখেছে আমায়, একবারও উঠতে দিলো না। সন্ধ্যের আগে শিউলি ভাবি এসেছিলো আমার কাছে। উদ্দেশ্য ছিলো আজরান ভাইয়ার সাথে ভাবি মার্কেটে যাচ্ছে,আমিও সাথে যাই। কিন্ত আমার হিটলার বর আমার কিছু বলার আগেই না করে দিলো ভাবিকে। আমিও নাছোড়বান্দা, বললাম ভাবির সাথে যাবো মানেই যাবো। কিন্ত শেষমেষ আমায় এমন এক ধমক দিলো যে আমার আর কোনো কিছু বলার সাহস হলো না। এমনিতেও দুপুরে উনার অপেক্ষা না করে একা বাসায় আসাতে আমার ওপর অনেক রেগে আছেন। হয়তো সেই জমানো রাগটাই একবারে ঝাড়লেন। আমি মুখ ফুলিয়ে পড়ায় মন দিলাম এবার। উনার রাগ ধমক এখন কোনো কিছুই গায়ে মাখি না আমি। আমায় হঠাৎ এভাবে চুপ থাকতে দেখেও উনি কোনো পরোয়া করলেন না। চুপচাপ আমায় পড়তে বলে একপাশে ল্যাপটপে রিসার্চের কাজ করতে লাগলেন।
এখন কিছুক্ষণের ব্রেক নিয়ে বারান্দায় অন্যমনষ্ক হয়ে আছি।আনভীর প্রতিদিনকার মতো দু’কাফ কফি নিয়ে আসলেন বারান্দায়। আমি এখন এসব নিয়ে কথা বলি না, আসলে উনার সাথে প্রয়োজন ব্যাতীত কোনো কথাই বলিনা আমি।তবে হঠাৎ উনার একটা উদ্ভট কাজ দেখে আমি বিস্মিত হলাম। উনি আচমকা ডিভানে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন ক্লান্তিবেশে। আমি তাজ্জব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-‘একি? আমার কোলে মাথা রাখলেন কেনো?’
-‘মাথাটা ব্যাথা করছে প্রচন্ড। মাথাটা টিপে দাও আস্তে করে।’
-‘উঠুন তো। আমি পারবো না।’
থমথমে গলায় বললাম আমি। আমি কেনো উনার মাথা টিপতে যাবো? একটু উনিশ থেকে বিশ হবে , পরে এমন একটা লাগামছাড়া কথা বলে দিবে যে লজ্জায় নাক-মুখ লাল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আনভীর আবার বললেন,
-‘তোমার প্যাক প্যাক শোনার মতো ইচ্ছে আমার নেই। মাথাটা টিপে দাও জলদি।’
মানুষটার কথা শুনে রাগ ক্ষোভ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে আমার মস্তিষ্কে।আচ্ছা পূর্বে তো উনি আমার সামনেই আসতে চাইতেন না। আমি আসলেই পারলে গর্জন দিয়ে উঠতেন। তবে এখন এমন করছেন কেনো? আমি এবার মাথাটা টিপে দিতে লাগলাম আস্তে করে। বিড়বিড়িয়ে বললাম,
-‘ইচ্ছে তো করছে গলা টিপে মেরে ফেলতে!’
দু’মিনিট যেতে না যেতেই হঠাৎ পাশে থাকা মোবাইলে ক্রিৎ ক্রিং শব্দ বেজে উঠলো এবার। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম মোবাইলের স্ক্রিনে। ধ্রুব ভাইয়া কল দিয়েছে। হঠাৎ কোচিংয়ের কথা মনে পড়ে গেলো আমার।উনি বলেছিলেন বিকেলে ফোন দিতে। কি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলবেন জানি। আমি মিহি কন্ঠে বললাম,
-‘আল্লাহ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম ধ্রুব ভাইয়া ফোন দিতে বলেছিলেন।’
এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে আমার মাথা টেপা উপভোগ করছিলেন আনভীর। ‘ধ্রুব’ নামটা শোনামাত্রই উনি হতভম্ব হয়ে তৎক্ষণাৎ উঠে পড়লেন। চোখ দৃঢ় করে জিঙ্গেস করলেন,
-‘কে কল দিয়েছে?’
-‘ধ্রুব ভাইয়া। আমি বিকেলে উনাকে কল দিতে বলে গিয়েছিলাম। তাই হয়তো!’
আনভীর চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে ফোন স্ক্রীনে তাকালেন এবার। যেন পারছেন তো না এই মোবাইলে ঢুকেই ধ্রুবকে গলা টিপে খুন করে ফেলতে। উনি গম্ভীর গলায় বললেন,
-‘এই ধ্রুবর এত কি কথা তোমার সাথে?’
-‘কই এত কথা ? উনি তো কিছুদিন ব্যস্ততার জন্য আমার নোটগুলো দিতে পারেননি। হয়তো সেজন্যই কল দিয়েছেন।’
আমি কল রিসিভ করে রুমের ভেতরে চলে গেলাম কথা বলতে।কথা শেষ করে পেছনে ঘুরেই হঠাৎ দেখি উনি আমার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এতক্ষণ, অনেকটা কাছাকাছি। আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,
-‘এভাবে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন কেনো পেছনে? সরুন। আমার কাজ আছে।’
আমি উনাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেই উনি আমার আমার বরাবর দাঁড়ালেন। আমি কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছি। তবে উনি নির্বিকার। চোখের দৃষ্টি আমাতে তীক্ষ্ণ করে বললেন,
-‘কি কথা হলো ধ্রুবের সিথে?’
-‘তা আমি কেনো আপনাকে বলবো?’
-‘আমি তোমার হাজবেন্ট তাই।’
আমি একটা ফিচালো হাসি দিয়ে বললাম ,
-‘সো সুইট আফ ইউ আনভীর। আপনি আমার হাজবেন্ট ঠিকই তবে সেটা এগ্রিমেন্টের জন্য। আর আপনিই আমায় বলেছিলে যে আমি আপনার নামেমাত্র ওয়াইফ। তাই আমি আপনাকে কোনো উত্তর দিতে অবশ্যই বাধ্য নই, তাই না?’
আনভীর কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না। আমি একটা বিশ্বজয়ী হাসি দিয়ে সরে এলাম। আমি জানিনা যে ধ্রুব ভাইয়ার ব্যাপারে উনি এত ইনসিকিউর কেনো তবে এই ব্যাপারটা মনে এক পৈশাচিক আনন্দ দিচ্ছে আমায়। উনি হঠাৎ আমার ফোন নিয়ে কাবার্ডে রেখে দিলেন। আমি কিছু বলতে যাব তখন উনি কড়া গলায় বললেন,
-‘পরীক্ষার আগে কোনো ফোন না, এখন মন দিয়ে পড়ো। আবার ধ্রুবর কথা আমার সামনে উঠালে তোমার খবর আছে।’
বলেই হনহনিয়ে প্রস্থান করলেন উনি।আমি শয়তানি হাসি হেসে খাটে বসে পড়লাম। মানুষটাকে জ্বালাতে ভালোলাগছে। এতদিন অনেক যন্ত্রণা দিয়েছেন আনভীর। এবার আপনাকে যন্ত্রণায় ফেললেই আমার অতৃপ্ত মনে শান্তি পাবে।
.
.
আজ শনিবার। সেই সুবাদে বাবা, আজরান ভাইয়া, আনভীর সবাই বাসায়। সেই সাথে আমিও। একমাত্র এটাই এমন একটা দিন যেই দিন আনভীর পড়ার জন্য কোনো প্রেশার দেয়না আমায়। হুট করে ভোরে আজরান ভাইয়া সবাইকে বললো আজ ভাইয়া আমাদের সবাইকে ঘুরতে নিয়ে যাবে এক জায়গায়। জায়গাটা নাম এখনও বলেননি উনি। সারপ্রাইজ হিসেবে রেখে দিয়েছেন। আনভীর প্রথমে না বলেছিলেন যে আজ উনি যাবে না বাহিরে। কিন্ত আজরান ভাইয়ার জোরাজোরির পর অনেকটা বাধ্য হয়েই রাজি হলেন উনি। এদিকে আমি ভীষণ এক্সাইটেড।কেননা ঢাকায় আসার পর খুব বেশি একটা ঘুরতে পারিনি। আমার আর্ধেক সময় পারই হয়ে গেলো মেডিক্যাল এডমিশন টেস্টের প্রিপারেশন নিয়ে। তাই আজকে হঠাৎ আউটিং এ কথা শুনে আনন্দে নাচতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার। দ্রুত নুড়ী আপার সাথে রান্নাঘরের কাজ সারার চেষ্টা করলাম আমি যাতে একটা ভালো ড্রেস চুজ করার জন্য সময় নিতে পারি।
রান্নাঘরে কাজ সামলে ডইংরুমে গেলাম আমি। শিউলি ভাবি ইতিমধ্যে রুমে গিয়েছেন রেডি হওয়ার জন্য। বাবা, আজরান ভাইয়া ড্রইংরুমে কথা বলছেন। আনভীর এখানেই ছিলেন মাত্র; তবে এখন নেই , হয়তো গ্যারেজে গিয়েছেন গাড়ির ডিজেল চেক করতে। কেননা একটু আগে বাবাকে বলতে শুনেছিলাম আনভীরকে গাড়ির ডিজেল চেক করতে।
উনি আসার আগেই রেডি হতে হবে আমায়। তাই দ্রুত রুমে চলে গেলাম কি পড়বো তা খুঁজার জন্য। কার্বার্ডে এত ড্রেসের বাহার দেখে আমি রীতিমতো পাগল হয়ে যাচ্ছি। এদিকে শিউলি ভাবিও ব্যস্ত যে তাকে পছন্দ করতে বলবো। শেষমেষ দোলা আপুকে ফোন দিলাম আমি। একমাত্র দোলা আপুই আছে যে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে।
দোলা আপু ভিডিও কল রিসিভ করে বললো,
-‘কিরে ! এতদিন পর মনে করলি আমারে?’
-‘এসব কথা পরে বলো আপু। আগে বলো আমি কি পড়বো?আজকে আজরান ভাইয়া আউটিংয়ে নিয়ে যাবে আমাদের।’
কাচুমাচু হয়ে বললাম আমি। আপু অবাক গলায় বললো,
-‘একটা সামান্য ড্রেস চুজ করতে পারিস না তুই ইডিয়াট? তোর বরকে বললেই তো করে দেবে।’
-‘আরে আমার বর আর তুমি কি এক হলে? তোমার পছন্দের ড্রেস গুলা সবসময়ই ভালো হয়। এখন পছন্দ করে দেও না?’
আমি নরম গলায় বললাম। আপু বললো,
-‘আচ্ছা এভাবে তো বুঝবো না, এককাজ কর। ছবি তুলে সেন্ড কর তোর পছন্দের কয়েকটা। তারপর আমি চুজ করে দিচ্ছি।’
আমি তাই মিহি হেসে কল কাটলাম। কাবার্ডে হ্যাঙ্গারে ঝোলানো ড্রেসগুলোর ছবি তোলার উদ্দেশ্যে মোবাইল উচু করে ছবি তুলছিলাম তখনই কাবার্ডের পাশের বাথরুম থেকে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন আনভীর। উনি শুধু একটা সাদা তোয়ালে কমোড়ে পেচিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। চুলে জমা পানিগুলো টপটপ করে ঝরে পড়ছে। এমন দৃশ্য দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম আমি। আমি তো ভেবেছিলাম উনি বোধহয় রুমে নেই,,,,,কিন্ত এভাবে যে দুজন দুজনের মুখোমুখি হয়ে যাবো তা আমরা দুজনেই ধারনা করতে পারিনি। আমি এতটাই আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম যে আমার হাতের মোবাইল ক্যামেরায় এখনও চাপ দিয়ে রেখেছি যার কারনে ড্রেসগুলোর ছবি তোলা হচ্ছে কিনা জানিনা তবে উনার অর্ধনগ্ন ছবি পুরৈটাই তোলা হচ্ছে।
আনভীর আমার হাতের মোবাইলটা উনার দিকে এভাবে তুলে রাখাতে বুঝতে বাকি রাখলেন না যে হচ্ছেটা কি, দ্রুত কাছে এসে পড়লেন আমার। আমি হঠাৎ উনার কাছে আসাতে পিছিয়ে গেলাম এবার। চিল্লিয়ে বললাম,
-‘আপনি এভাবে তোয়ালেমানব হয়ে বেরিয়ে এসেছেন কেনো?’
আমার চিল্লাতে দেখে উনি আমায় পেছনে থাকা বুকশেলফটার সাথে চেপে ধরলেন এবার। একহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেছেন আর এক হাত দিয়ে আমার হাতের মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। উনার আক্রমণে শূণ্যমস্তিষ্কের হয়ে গেলাম আমি। উনি মোবাইলটা ছিনিয়ে কড়া গলায় বললেন,
-‘মোবাইলের গ্যালারীতো আমার অর্ধনগ্ন ছবি তুলে ভাসিয়ে রেখেছো সে খেয়াল কি আছে? জলদি ডিলিট করো।’
.
.#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৭
আমায় চিল্লাতে দেখে উনি আমায় পেছনে থাকা বুকশেলফটার সাথে চেপে ধরলেন এবার। একহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেছেন আর এক হাত দিয়ে আমার হাতের মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। উনার আক্রমণে শূণ্যমস্তিষ্কের হয়ে গেলাম আমি। উনি মোবাইলটা ছিনিয়ে কড়া গলায় বললেন,
-‘মোবাইলের গ্যালারীতো আমার অর্ধনগ্ন ছবি তুলে ভাসিয়ে রেখেছো সে খেয়াল কি আছে? জলদি ছবিগুলো ডিলিট করো।’
আমি যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছি। উনার কোনো কথাই আমার কানে যাচ্ছে না। যাবেই বা কি করে ,এমন সুদর্শন ছেলেকে যদি এ অবস্থায় একজন মেয়ে দেখে ফেলে, তার হিতাহিত জ্ঞান যে নিমিষেই হারিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। আমিও এর ব্যতিক্রম কিছু নই। আমায় এভাবে পাথর হয়ে থাকতে দেখে বিরক্তির চরম সীমায় পৌছে গেলেন আনভীর…..সেই সাথে উনার মধ্যে চরম অস্বস্তিও কাজ করছে। তাই অপ্রস্তুত হয়ে বললেন,
-‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?খেয়ে ফেলবে নাকি?’
আমি নিজের বাস্তবে ফিরে আসলাম। লজ্জায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে ড়েছে আমার গালে। আমি চোখ নামিয়ে উনার থেকে মোবাইলটা নিয়েই পরপর ২০ টা ছবি ডিলিট করে ফেললাম।উনি জিজ্ঞেস করেছেন,
-‘ডিলিট করেছো?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘এখন গ্যালারীর রিসেন্টলি ডিলিট অপশনে যাও।ওখান থেকেও আমার ছবিগুলো ডিলিট করো।’
আমি গোলগোল চোখ করে তাকালাম উনার দিকে। আনভীর শীতল চাহিনী আমাতে নিক্ষেপ করে অপেক্ষা করছে আমার কাজটুকু সম্পন্ন করার জন্য চোখে-মুখে অস্বস্তির চরম রেশ। যেন নিজের শার্টলেস ছবিগুলো কিছুতেই কারও গ্যালারিতে থাকতে দিবেন না। বিষয়টা কেমন যেন আত্নসম্মানে লাগলো আমার। আমি কি ইনটেনশনলি আর উনার ছবি তুলেছি? যা করেছি সবই তো হয়েছে পরিস্থিতির শিকারে পড়ে। উনি ধমকের সুরে বললেন,
-‘এমন খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো?যা করতে বলেছি করো?’
আমি সাথে সাথেই গ্যালারির রিসেন্টলি ডিলিট অপশনে চলে গেলাম ছবিগুলো ডিলিট করতে। একটা করে কাটছি আর মনে মনে হাসফাস করছি। যদিও ছবিগুলো আমি অজান্তেই তুলেছিলাম তবে বলতে বাধ্য শার্টলেস অবস্থায় মানুষটাকে দেখতে পুরাই আগুন লাগে। এই ছবিগুলো দিয়ে ভবিষ্যতে বেশ ভালোমতই উনাকে জব্দ করা যেত। হয়তো উনি আমার আগাম পরিকল্পনার কথা বুঝেই ছবিগুলো ডিলিট করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেছেন।আমি তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললাম,
-‘রিসেন্টলি ডিলিট থেকেও ডিলিট করেছি আপনার ঐতিহাসিক ছবি।’
আমার কথার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিক হয়ে এলেন উনি। গম্ভীর স্বরে ‘গুড’ বলে দ্রুত কাবার্ড থেকে শার্ট আর জিন্স প্যান্ট নিয়ে চলে গেলেন ওয়াশরুমে। আমি করুন চোখে মোবাইলের দিকে তাকালাম। দোলা আপুর মেসেজগুলো টপ স্ক্রিনে ভেসে ওঠছে যে আমি এখনও ড্রেসের ছবি পাঠাচ্ছি না কেনো। কিছুক্ষণ আগের ঘটনাগুলো মনে পড়তেই আমি মোবাইলটা রেখে রেডি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। আর যাই হোক, ওই পাগলটার শার্টলেস দৃশ্যের কথা আরও ভাবলেই আমি হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাবো।
________________
আজকে আকাশটা পরিচ্ছন্ন। দৃশ্যমান নীল আকাশের মেঘের আড়ালে সূর্যের লুকোচুরি প্রাণের শহর এই ঢাকাকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। আজরান ভাইয়া গাড়ি চালাচ্ছেন পরিমিত সীমা নিয়ে। উনার পাশেই বসা আনভীর। পেছনের সিটগুলোতে আমি আর শিউলি ভাবি বসে আছি। আমি জানালার দিকে মুখ এগিয়ে শীতল হাওয়াগুলো অনুভব করতে থাকলাম এবার। গাড়িটি দালানকোঠা ছেড়ে লোকমানবহীন স্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যতই শহরের গন্ডি পেরিয়ে দূরে যাচ্ছি তথই সবুজের সমারোহ। আমার কাছে এসকল কিছু নতুন। তাই আগ্রহটাও কেমন যেন দমিয়ে রাখতে পারছি না। আজরান ভাইয়াকে এবার জিঙ্গেস করলাম,
-‘ভাইয়া যেতে আর কতক্ষণ লাগবে?’
উনি গাড়ির স্টেয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বললেন,
-‘অলমোস্ট এসে পড়েছি। বেশি সময় লাগবে না যেতে। ততক্ষণ জার্নিটা নাহয় ইন্জয় করো।’
আমি এবার পুনরায় বাইরে মনোনিবেশ করলাম। গাড়ির সাউন্ড বক্সে ‘তানভির ইভান’ এর একটা সফ্ট সং পরিবেশটাকে আরও উন্মাদনায় পরিপূর্ণ করে তুলছে। আমি অনেকটা আবেগে জর্জরিত হয়েই আলতোভাবে নিজের বাম হাতটা গাড়ির বাইরে নিয়ে গেলাম। তখনই সামনে ড্রাইভিং সিটে বসা আমার হিটলার বর কড়া গলায় বললেন,
-‘গাড়ির বাহিরে হাত নিচ্ছো কেনো? জানোনা এটা কতটা রিস্কি? জলদি হাত ভিতরে আনো।’
আমি ভ্রু কুচকে সামনের লুকিং মিরের তাকালাম এবার। উনি প্রখর চাহিনী নিক্ষেপ করে রেখেছেন আমার দিকে। একপলক আমার মনে হলো সামনে বসলেও প্রতিটা মুহূর্তে আমায় চোখে চোখে রাখছেন উনি। তাই হয়তো হাত বাহিরে নেওয়ার সাথে সাথেই উনি বিষয়টা খেয়াল করলেন।উনার ধমক খেয়ে দ্রুত হাত ভেতরে নিয়ে আসলাম আমি। আজরান ভাইয়া আনভীরের কান্ড দেখে বললেন,
-‘আহা! বউয়ের সাথে এমন করে কেউ?’
-‘তো কি করবো বলো? আহি তো এখনও পিচ্চি। আগে যেমন বই নিয়ে ছাদে ধুরুম ধারুম লাফাতো,,,এখন আমার মাথায় লাফায়। বাচ্চার মতো ওর প্রতিটা কাজে নজর দিতে লাগে আমাকে।’
আজরান ভাইয়া মিহি হাসলেন এবার। গাড়ির গতি কমিয়ে বললেন,
-‘পিচ্চি বউ আদর করার মানুষ রে ভাই, ধমকি ধামকি দেওয়ার মানুষ না।’
আজরান ভাইয়ার কথা শুনে চোখজোড়া বড় বড় হয়েগেলো আমার। শুধু আমার বললে ভুল হবে, আমার সাথে শিউলি ভাবি আর আনভীরেরও। শিউলি ভাবি একটা শুকনো কাশি দিয়ে উনার পিঠে হালকা চিমটি দিলেন তাই। আজরান ভাইয়া হয়তো বিষয়টি ধরতে পেরেছেন। আমি শুধু ভাবতাম আনভীরই একটু ভয়ঙ্কর কথাবার্তার মানুষ, কিন্ত আজরান ভাইয়া যে উনাকেও ক্রস করে ফেলবে তা একেবারেই কল্পনাতীত ছিলো আমার।আনভীর আজরান ভাইয়ার সাথে কথা না বাড়িয়ে মোবাইল স্ক্রলিং করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। আমিও এসব ধ্যান ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাইরের সৌন্দর্যে মনোনিবেশ করলাম।
তখনও আজরান ভাইয়ার কথাটা কানে বেজে চলছে আমার। তবে এটা আমার কানে বাজলেই কি হবে? আমার হিটলার বর তো এসব থেকে দশ হাত দূরে থাকে। তবে দূরে থাকাই ভালো। কথাতেই যদি লাগাম না থাকে, একটু প্রাকটিক্যাল হলে তো লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে লাগতো আমায়।
.
.
____________
লেকের পাশে এই পিকনিক স্পট টা চমৎকার। লেকের শীতল হাওয়া পুরো জায়গাটাতেই সতেজতায় বিমোহিত করে তুলছে। এ পরিবেশ নিমিষে সবার মন ভালো করে ফেললেও রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে গাছের নিচে আমি বসে আছি। অদূরেই স্টোভে আগুন জ্বালানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন আনভীর আর আজরান ভাইয়া। শিউলি ভাবি বাকি কাজগুলো সারছেন। আজকে এখানেই রান্না হবে অনেকটা ক্যাম্পিং এর মতো। আমিও উনাদেরকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম তবে শিউলি ভাবি না করায় একটু দূরে হাটতেঁ যাই। পরে ফিরে আসার পর আনভীর আমায় এমন এক ধমক দিলেন উনার পার্মিশন না নিয়ে ওদিকে যাওয়ার জন্য যে রাগে রীতিমতো থরথর করছিলাম আমি।
তাই আমি চুপচাপ চাদর বিছিয়ে গাছতলায় বসে রইলাম। উনি শতবার ডাকলেও আমি যাবো না হুহ!
.
কড়া রৌদ্দুরের নিচে স্টোভে রান্না বসানোতে ঘেমে গিয়েছেন উনি। তাই উপরের শার্টটি খুলে কোমড়ে পেচিয়ে রাখলেন। যদিও ভেতরে উনি একটা হালকা আকাশি রঙের হাফ হাতা টিশার্ট পড়েছেন। বাতাসের জন্য স্টোভের আগুন বারবার নিভে যাচ্ছিলে। সেদিকে মূলত নজর রাখছিলেন দুই ভাই। এসব করতে করতে একঘন্টা চলে গেলো , আমি তো ভেবেছিলাম উনি এর মধ্যে ডাকবেন আমায় আর আমি ইগো দেখিয়ে সাড়া দেবোনা উনার ডাকে। তবে আমায় অবাক করে দিয়ে একবারও ডাকলেননা তিনি। আমার রাগের পাল্লা আরও ভারী হয়ে যাচ্ছিলো এতে।
তখনই শিউলি ভাবি এসে বললো,
-‘এখানে মুখ ফুলিয়ে বসে আছো কেনো?’
-‘তোমার বদমাশ দেবরকে জিজ্ঞেস করো গিয়ে।’
রাগে গজগজ করতে করতে আমি বললাম। শিউলি ভাবি ফিক করে হেসে দিলেন আমার কথায়। বললেন,
-‘তুমি পারোও বটে। আরে বোকা, আনভীর চিন্তা করে তোমার জন্য। তাই তো হুটহাট এরকম ধমক লাগিয়ে দেয়।’
-‘কে বলেছে আমার চিন্তা করতে? চিন্তা না ছাই। আমায় না জ্বালালে উনার রাতের ঘুম হয় না।’
-‘আনভীর আগে এতটা কারও প্রতি মনোযোগী ছিলো না আহি।আমার বিয়ের দু বছরে আমি শুধু ওকে পড়াশোনা, লাইফ, ক্যারিয়ার এগুলোই গুছিয়ে উঠতে দেখেছি। তুমিই প্রথম মানুষ যার জন্য আনভীর এতটা যত্নশীল।হয়তো তোমায় ভালোবাসে বলে……….’
শিউলি ভাবির শেষ বাক্যটাতে কিছুটা মৌন হয়ে গেলাম আমি। ভালোবাসার ডেফিনেশন আমি জানিনা। এটাও জানিনা উনার প্রতি আমার কেয়ারিংটা শুধু দায়িত্ববোধ নাকি অন্যকিছু। তবে আমি না থাকলে হয়তো উনার জন্য অনেক ভালোই হতো। ইসসস! গল্প-উপন্যাসের মতো একটা প্রেমিক পুরুষ যদি আমার কপালেও জুটতো?
______________________________
পুরোটা সময় আনভীরের সাথে কোনোরূপ কোনো কথা বলিনি আমি। পুরোটা সময় একপ্রকার এড়িয়ে ছিলাম। আসলে উনার দুপাক্ষিক ব্যাবহার একপ্রকার অতিষ্ঠ করে তুলেছে আমাকে। তারওপর পর পর দু বার ধমকি খেয়ে আর ইচ্ছে হয়নি মানুষটার বাঘের গর্জন শোনার। এখন প্রায় পড়ন্ত বিকেল। লেকের পশ্চিম প্রান্তের হলদেটে আলোতে অন্যরকম সুন্দর লাগছে।আজরান ভাইয়া পিকনিকের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে গাড়ির পেছনে রেখে দিচ্ছেন এক এক করে। সাথেই রয়েছেন আনভীর। আমি যে লম্বা সময় ধরে উনাকে ইগ্নোর করছি উনি বিষয় টা দেখেও পরোয়া করলেন না।এটি আমার অভিমান যেন আরও জোরালো করে তুললো। তাই একটু দূরে লেকের ধার ঘেঁষে বসে থাকলাম। উনি রাগ করলে করুক, এখন নিজেকে সময় দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। হঠাৎ মনে হলো যে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। মানুষটি শীতল কন্ঠে বললো,
-‘আমায় না বলে কেন একা আসলে এখানে?’
আনভীরের কথা শুনে আমার কোনো ভাবান্তর হলো না। উনি হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছেন পেছনে। আমি বললাম,
-‘এভাবে শান্ত গলায় বলছেন কেন? আমি তো আবার অমান্য করেছি আপনার কথা। তাহলে বকবেন না?’
-‘এখন বকার মতো কাজ করলেও তোমার সাথে রুড বিহেভ করতে চাচ্ছি না আহি। এভাবে একা আসাটা কতটা ইনসিকিউর তুমি জানো? তার ওপর রাস্তাঘাটও তো ভালোমতো তুমি চেনো না। একটাবার ভেবেছো তোমায় ওখানে না পেয়ে কি অবস্থা হয়েছিলো আমার? আমায় না বলে একা কেন এই কোনায় আসলে? ‘
-‘প্রয়োজন বোধ করি নি তাই।’
মিহি গলায় বললাম আমি। আমার কথা শুনে আনভীর রেগে গেলেন অনেকটা। হুট করে আমায় হাত টেনে দাঁড় করিয়ে দিলেন আমায়। আমি এহেন কান্ডে কিছিটা বাকবিমূঢ় হয়ে গিয়েছি। আনভীর বলে ওঠলেন,
-‘প্রয়োজন মনে করোনি বলতে কি বুঝাতে চাচ্ছো তুমি? লিসেন, তুমি প্রয়োজন মনে করো বা না করো আমিই তোমার প্রয়োজনীয় মানুষ। সো ভুলেও আমায় ইগ্নোর করার চেষ্টা করবে না। আর এগ্রিমেন্ট মাই ফুট! ওসব এগ্রিমেন্ট বাদ দাও। যদি ওটা ভেবে দূরে সরার চেষ্টা করো দ্যান আই উইল কিল ইউ।’
বলেই হাত টেনে গাড়িতে নিয়ে আসলেন আমায়। যতই দিন যাচ্ছে ততই মানুষটার নতুন নতুন রূপ দেখে অবাক হচ্ছি আমি। একটু আগে কি বললেন উনি? এগ্রিমেন্ট উনার কাছে কিছুই না। হায় আল্লাহ! এই লোক নিজে তো পাগল, আমাকেও এবার পাগল বানিয়ে ছাড়বে।
।
।
।
।
~চলবে,,,,,ইনশাআল্লাহ!