#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ২৪
-‘তুমি আর আনভীর এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী একসাথে থাকছো?’
মা শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন আমায় । আমার মুখ থেকে আতঙ্কে কোনোরূপ কোনো কথা বেরিয়ে আসছে না উনার এমন শীতল প্রতিক্রিয়া দেখে। মা তাই আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-‘আমি তোমায় প্রশ্ন করেছি আহি? উত্তর দাও?’
আমি তবুও কথাটি এড়ানোর প্রসঙ্গে বললাম,
-‘মা , এখন এসব কথা থাক না? উনি আসলেই নাহয়……….’
-‘আমি তোমায় যা জিজ্ঞেস করেছি সেটার উত্তর দাও।’
থমথমে গলায় বলে ওঠলেন মা। আমি এবার হাল ছেড়ে দিলাম কথাটি এড়ানোর জন্য। উনি সবটা জেনেই গিয়েছেন। শুধু আমার মুখে শুনতে চাচ্ছেন সেই কঠিন সত্যটা। আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
-‘হ্যাঁ মা। আমরা এগ্রিমেন্টের মোতাবেকই একসঙ্গে থাকছি।’
মায়ের চোখ দিয়ে টুপ করে একফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। সেই সাথে তোলপাড় করে ওঠলো আমার হৃদয়। কেননা এই শক্ত মানুষটিকে আজ প্রথম কাদতে দেখেছি। আমি হাটুগেড়ে বসলাম উনার কাছে। হাত ধরার চেষ্টা করতেই উনি বলে ওঠলেন,
-‘খবরদার ! আমায় ষ্পর্শ করবেনা। তোমরা দুজন প্রতারণা করেছো আমাদের সাথে, তোমার পরিবারের সাথে, এমনকি নিজেদের সাথেও।’
আমি নীরব। মা আবার বললেন,
-‘তোমরা দুজন যে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছো একবারও বড়দের জিজ্ঞেস করলে না যে এটা কতটা যুক্তিযুক্ত? আমিতো ভেবেছিলাম তোমাদের বিয়ে দুর্ঘটনার জন্যে হলেও হয়তো ভাগ্যকে মেনে নিয়েছো। কিন্ত ভুলধারনা ছিলো এটা আমার। কিভাবে পারলে এত বড় একটা নাটক সাজাতে? আরে আমার কথা বাদ দাও। তোমরা একটাবার কি ভেবেছো যে তোমাদের বাবারা ঠিক কতটা লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়ে তোমাদের বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো?
যেখানে তোমার পরিবারই তোমার আর আনভীরের ব্যাপারে বিশ্বাস করেনি সেখানে আনভীরের বাবা শুধুমাত্র তোমাদের মানসম্মান বাচানোর জন্য , তোমায় কটুক্তি থেকে বাচানোর জন্য বিয়ে করিয়েছিলো আনভীরের সাথে। শুরুতে উনার তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত আমার মেনে নিতে কষ্ট হলেও তোমাদের দুজনের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছিলেন উনি। আর তোমরা কি করলে? একটাবার যদি উনি জানেন যে তোমরা ছয় মাসের জন্য চুক্তিবদ্ধ স্বামী স্ত্রী তাহলে ভেঙে যাবেন। মেনে নিতে পারবেন না তোমাদের এই বিশ্বাসঘাতকতা।’
মায়ের প্রতিটা কথাই আমার হৃদয়ে তীরের মতো বিধঁছে। কথাটি সত্য একজন মা যেন সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসতে পারে তেমনি নিজের ক্ষত প্রকাশের মাধ্যমেও কষ্ট দিতে পারে। আমাদের এই সিদ্ধান্তে মা অনেক কষ্ট পেয়েছেন। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন নিজের। তাছাড়া উনার প্রতিটা কথাই তো সত্য। আমরা তো বিশ্বাসঘাতকতা করেছি সবার সাথে।
পুরো ঘর জুরে পিনপন নীরবতা। মায়ের অশ্রুসিক্ত লালচে চোখ দেখে ভালো লাছে না আমার। তারওপর আনভীরের ব্যবহারগুলো স্মৃতিচারন হতেই আমার মন-মস্তিষ্ক ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলো। বারবার কানের কাছে উনার বলা শেষ কথাটি বেজে উঠছে যে আমি শুধুমাত্র উনার দায়িত্ববোধ ! জাস্ট একটা দায়িত্ববোধ।
আমি নীরবতা কাটালাম এবার। বললাম,
-‘এগ্রিমেন্টের সিদ্ধান্ত আনভীরের ছিলো মা। আমার না। আমিও শুরুতে চেয়েছিলাম উনার সাথে কো-অপ করতে তবে আমি পারিনি উনার ভয়ঙ্কর রাগের শিকার হয়ে।’
আমি তারপর একে একে সব খুলে বললাম মাকে।বলতে বাধ্য হলাম। কেননা আনভীরের করা একটি কঠিন সিদ্ধান্তের কাছে আমি নত থাকলেও মাকে আমি কষ্ট দিতে চাচ্ছি না। আমাদের প্রথম দিনের এগ্রিমেন্টের ব্যাপার, উনার ভয়ঙ্কর রাগে বলা কথাগুলো, আমায় মানসিকভাবে চাপে রাখা সবকিছু। মা স্তব্ধ হয়ে গেলেন আমার কথা শুনে। কেননা উনি ভাবতে পারেননি যে আনভীর আমার প্রতি এতটা নির্দয় হবেন। আমি জড়ানো কন্ঠে বললাম,
-‘ আমি আনভীরের এসব ব্যবহার জাস্ট নিতে পারছি না মা। আমিও তো একটা মানুষ! অন্য চার-পাঁচজনের মতো রক্তমাংসে গড়া মানুষ। কিন্ত আমার সাথে কি হলো? আমার জন্মদাত্রী মা আমায় ছেড়ে চলে গেলো, বাবা আমিয় বোঝা মনে করে চাচার কাছে ফেলে রাখলো, চাচি আমায় কাজের বুয়ার প্রয়োজনে নিজের কাছে রাখলো,বরপক্ষরা নিজের মানসম্মান বাচানোর জন্য আমার সাথে বিয়ে ভেঙে দিলো, বাবা আপনার আর আপনাদের মানসম্মান বাচানোর জন্য আনভীরকে জোর করে আমার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করলো আর সবশেষে উনিও ছয় মাস আমার সাথে পরিবারের খাতিরে থাকবেন বলে মনোস্থির করলেন।
কেউ কি একটাবারও জিজ্ঞেস করেছে যে আমি কি চেয়েছি?আমার ইচ্ছেটা কি? কেউ একটাবারও জিজ্ঞেস করেনি, সবাই শুধু পুতুলের মতো আমায় ইউজ করে গিয়েছেন নিজ স্বার্থে।’
প্রত্যেকটা কথা বলার সময় আমি কেপে উঠছিলাম। গলা দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে আসছিলো না। মা স্থির হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। উনার দৃষ্টিতে একরাশ নির্মলতা। যেন আমার বহু বছরের আপন কেউ। আমি আবার বললাম,
-আমি কারও দায়িত্ব হতে চাই না মা। কারও ভালোবাসা হতে চাই। আফসোস! সেই সৌভাগ্য আমার নেই।কেননা আনভীর যা করছেন সব করছিলেন দায়িত্বের জন্য, ভালোবাসার জন্য নয়। আমি আর কারও সিমপ্যাথি চাচ্ছি না মা। আমি অনেক ট্রাই করেছি উনার মন বুঝার। যতবারই মনে হয়েছিলো যে উনি বোধহয় আমায় ভালোবাসেন ততবারই উনি আমার চোখে আঙুল দিয়ে আমার ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন।তাই আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এগ্রিমেন্টের আগেই আমি চলে যাবো আনভীরের কাছ থেকে।’
আমি কিছুটা কৌতুহল নিয়ে এবার তাকালাম মায়ের দিকে। অজান্তে অনেক কথাই তো বলে ফেললাম মাকে, উনি এখন ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন সেটাই আমার জানার বিষয়। মা এবার আড়ষ্ট কন্ঠে বললেন,
-‘চলে যাও তাহলে আহি!’
আমি চমকে গেলাম উনার কথা শুনে। কেননা আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো আটকাবেন আমায়। একজন এজ ইউজুয়াল গুরুজনদের মতো আমার এ সিদ্ধান্তকে বাচ্চামো মনে করবেন। কিন্ত উনার এই সম্মতিসূচক ব্যবহার অবাক করেছে আমাকে।উনি এবার নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন,
-‘অবাক হয়েছো যে আমি তোমায় যেতে বললাম কেন?’
-‘একটু হয়েছি।’
উনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-‘শোনো আহি! তুমি একটু নরম ধরনের মেয়ে। কেউ কোনো কথা বললে তার সাথে সাথে প্রতিবাদ করতে পারো না তুমি। আমি জানি মূলত পারিপার্শ্বিক কারনেই তুমি এতটা নরম। তবে তোমায় আরও শক্ত হতে হবে আহি। তুমি কি জানতে চাও যে তোমার প্রতি আনভীর ঠিক কেমন অনুভব করে?’
-‘শুরুতে কৌতুহল ছিলো, কিন্ত সেটা মিটে গিয়েছে।’
আমি তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম। মা গম্ভীর হলেন এবার। বললেন,
-‘আমি যদি তোমায় একটা সুযোগ করে দেই?’
উনার কথার ধরনটি ঠিক বুঝতে পারিনি আমি।তবে মনে হচ্ছে খুব গভীর একটা বিষয় তিনি ভেবে রেখেছেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-‘মানে?’
-‘আনভীর তোমার প্রতি যা করেছে তার সাথে আমি মোটেও একমত নই। আর আমি চাইবোও না যে তোমরা আলাদা হয়ে যাও। তবে আনভীরকে অবশ্যই তার প্রাপ্য শাস্তি পেতে হবে৷ নিজের ইগোর জন্য কিভাবে সে পারলো বিয়ে নিয়ে ছেলেখেলা করতে? তাই বলবো, হ্যা্, চলে যাও তুমি আহি। আনভীর থেকে অনেক দূরে চলে যাও। ওর বুঝতে হবে যে ও কত্তো বড়ো ভুল একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তোমায় দূরে সরিয়ে।’
আমি মৌনতা বজায় রাখলাম। ভেবে নিয়েছিলাম নিজের ছেলের এ কাজের জন্য হয়তো তিনি চরম কষ্ট পেয়েছেন। সেই সাথে জন্মেছে আমার প্রতি অগাধ মায়াও। তাই হয়তো আমার এ সিদ্ধান্ত শুনে তিনি বিচলিত হননি। আমি গম্ভীর হয়ে এলাম এতে। এমন একজন মমতাময়ী মা পেতে পেতেও হারিয়ে ফেললাম যে!
_____________________________________
দুপুরে মা চলে যাওয়ার পর একটা লম্বা সময় ধরে শাওয়ার নিলাম শরীরটা রিফ্রেশ করার জন্য। আমার ভুলে গেলে চলবে না আগামীকাল পরীক্ষা আমার। তাই খাওয়া দাওয়া সেরে একমনে টেবিলে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছি আমি। সচরাচর মেডিক্যাল এডমিশন এক্সামের অনেক বড় বড় গাইডবুক থাকে।সেগুলো রিভাইস করা আমার কাছে বেশ সময় সাপেক্ষ ছিলো।
সন্ধ্যার পর বাড়িতে আসলেন আনভীর। হালকা ফ্রেস ট্রেস হয়ে আমার টেবিলের পাশে চেয়ার নিয়ে আমায় বই থেকে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ পড়া জিজ্ঞেস করলেন। আমি উনার সাথে পড়া ব্যতীত কোনো কথা বললাম না আর। এটাও বললাম না যে মা আমাদের ব্যাপারে সবটা জেনে গিয়েছেন। কেননা মা না করে দিয়েছেন এসব বলতে। আমায় এতটা মৌনতা বজায় রাখার ব্যাপারটা আনভীর খেয়াল করেছেন , তবুও কিছু বললেন না। এককথায় এমন এক ভাব দেখালেন যে আমার এসব ব্যাপারে উনার কিচ্ছু আসে যায় না। একপর্যায়ে উনি বললেন,
-‘প্রিপারেশন মোটামোটি তোমার ভালোই আছে। এখন খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়ো। কারন পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়াটা কখনোই ভালো ফল আনেনা।’
আমি কাঠপুতুলের ন্যায় বই বন্ধ করে চলে গেলাম খাটে। গম্ভীর স্বরে বললাম,
-‘আমি খাবোনা। এখন প্লিজ ডিস্ট্রাব করবেন না।’
আনভীর নীরব দর্শকের মতো আমার কাজকর্ম দেখলেন। কোনোরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। হয়তো অন্যসময় হলে আমায় ধমকে পাঠাতেন খাওয়ার জন্য । তবে আজ অমন কিছুই করলেননা। না করেই ভালো হয়েছে। উনার এসব ছোটোখাটে কেয়ারিং,,,,,,ওপস! ভুল বললাম , দায়িত্ব আমায় জর্জরিত করে ফেলছে। এখন আমার একটাই ইচ্ছা, দূরে চলে যাবো আমি এই মানুষটা থেকে । অনেক দূরে।
আনভীর লাইট বন্ধ করে খাটে আমার পাশে শুয়ে পড়লেন এবার। বরাবরেই মতোই আমাদের মাঝখানে এক কোলবালিশ। আমার ঘুম আসছে না চিন্তায়, উদ্রেকে, উত্তেজনায়। হতাশা আর বিভ্রান্তি সবকিছু আমায় কেমন যেন ঘিরে ধরেছে। আমি মাথাটা হালকা ঘুরিয়ে তাকালাম আনভীরের দিকে।উনি আমার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছেন। আমি ঠোঁট দিয়ে নিজের জিভ ভিজিয়ে উনার ডাকার চেষ্টা করলাম। বললাম,
-‘আনভীর?’
আমার দিকে না কাত হয়েই উনি বললেন,
-‘ঘুমাও এখন।’
-‘একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই আপনাকে?’
-‘বললাম না ঘুমাতে?’
এবার থমথমে গলায় বলে ওঠলেন উনি। আমার উনার এধরনের ব্যবহারে প্রচন্ড কষ্ট লাগছে। এইতো গত দু’রাত আগে আমায় শাস্তিস্বরূপ নিজের কাছে টেনে ঘুমাতে বলেছিলেন আমাকে। আর আজ এত দুরত্ব? উনি যে ঠিক কি চান আমি নিজেও জানিনা। সবসময় আমায় পড়ার মধ্যেই আবদ্ধ রাখেন।বলেন নিজেকে স্বাবলম্বী হতে। কিন্ত এসব আর নিতে পারছি না আমি। তাই আবার বললাম,
-‘এটাই আমার শেষ প্রশ্ন আনভীর ! প্রমিস কখনোই আর আপনাকে বিভ্রান্ত করবো না।’
উনি একটা লম্বা সময় নীরব ছিলেন। আমি কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে ফেললাম,
-‘আচ্ছা আমি কি আপনার কাজে শুধু দায়িত্বই রয়ে যাবো?’
উনি বিরক্ত হয়ে বললেন,
-‘এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি রাজি নই। ঘুমাও তো ! পরীক্ষার কথা বাদ দিয়ে কিসব বলছো।’
-‘প্লিজ বলুননা উত্তরটা?’
-‘হ্যাঁ। আমার উত্তর হ্যাঁ। নাও হ্যাপি? লেট মি স্লিপ।’
বলেই উনি কম্বল দিয়ে আপাদমস্তক শরীর ঢেকে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে নজর দেওয়ার ইচ্ছে পোষণও করলেননা উনি। আমিও তাই অন্য কাত হয়ে পড়লাম। চোখ বেয়ে ক্রমাগত অশ্রু বেয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। যেদিকে একজন নরমাল মেডিক্যাল এক্স্যামিনার পরীক্ষার টেনশনে ক্লান্ত সেদিকে আমি ক্লান্ত হতাশায়। অনেক হয়েছে, অনেক সুযোগ দিয়েছি উনাকে। তবে এবার আমি উনার সো কল্ড দায়িত্ব থেকে চিরতরে মুক্তি দিয়ে দিবো।পরীক্ষা দেয়ার পর চলে যাবো এ বাড়ি থেকে। ভুলে যাবো আমার জীবনের আনভীর নামক অধ্যায়টিকে!!
.
.#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ২৫
কারও মিহি কন্ঠ শুনে আমি পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম আনভীরকে। উনি আমায় ঘুম থেকে তুলার জন্য খানিকটা ঝুঁকে ডাকছিলেন আমায়। আমি তৎক্ষণাৎ উঠে বসলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে ছয়টা বাজে। আজকে এডমিশন টেস্ট আমার। তাই ভয় আর চিন্তার সাথে উত্তেজনাটাও কাজ করছে। আনভীর বললেন,
-‘জলদি ফ্রেস হয়ে একটু রিভাইস করে নাও। অতিরিক্ত পড়তে হবেনা, জাস্ট পড়া টপিকগুলোতেই চোখ বুলিয়ে নিবে। আমি আর ভাবিমণি আজ তোমার সাথে যাচ্ছি এক্সাম হলে।’
আমি উনার কোনো কথার প্রতিউত্তর না দিয়ে উঠে চলে গেলাম ওয়াশরুমের দিকে।গতরাতের কথপোকথনের পর আমার আর কোনো ইচ্ছে হলোনা উনার সাথে দু’দন্ড কথা বলার। তবে আমার এত ঠান্ডা ব্যবহারে আনভীর শুরুতে উদ্ভ্রান্ত হয়ে এলেও তেমন কিছু একটা বললেন না।
আজকে আকাশটা একটু মেঘাচ্ছন্ন। দক্ষিণা শীতল হাওয়ার আমেজে রুমটা কেমন যেন শীতল হয়ে গিয়েছে। আমি একেবারে ফ্রেশ হয়ে টেবিলে বসে পড়লাম পড়াগুলো রিভাইস দেওয়ার জন্য। আনভীরের ব্যবহারের জন্য উনার প্রতি আগেই আমার অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছি আমি। এখন আমার সব কনসানট্রেশন শুধুমাত্র মেডিক্যাল এক্সামটির জন্য। আমার লক্ষ্য ছিলো ডাক্তার হওয়ার এবং এ লক্ষ্যটি আমি চাই বাস্তবায়ন করতে। তার জন্য উনার মতো মরীচিকাকে ভুলে আমায় প্রচুর পড়ালেখা করতে হবে। লক্ষ্য অনুযায়ী এগোনোর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে। এর সবটাই করেছি আমি। এখন ভালোমতো পরীক্ষাটা দিতে পারলেই হবে। বাকিসব আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিবো ।
পড়া রিভাইস করার পুরোটা সময় আনভীর রুমে ছিলেন না। এককথায় আমায় পড়ার প্রতি মনোযোগ রাখা জন্য উনি আমায় একা রুমে রেখেছেন। এই সময়গুলো যে কিভাবে চলে গেলো টেনশনে খেয়ালই করিনি আমি। আসলে আমার প্রচন্ড রকম টেনশন কাজ করছে মাথায়। বারবার মনে হচ্ছে যে আমি যেগুলো পড়েছি সেগুলো ভালোমত পড়া হয়নি। পরীক্ষার হলে এগুলো ভুলে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে তাই রিভাইস করা পড়াগুলো বারবার চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি আমি।
এরমধ্যে পেছন দিয়ে দরজা খুলে আনভীর এসে পড়লেন হঠাৎ। আমায় এত চিন্তিতভাবে একই পড়া বারবার পড়তে দেখে বললেন,
-‘একই পড়া বারবার পড়ছো কেনো?’
-‘আমার কেনো যেন মনে হচ্ছে পরীক্ষার হলে এগুলো ভুলে যাবো সব। তাই না ভুলার জন্যই এভাবে পড়ছি।’
আমি মলিন কন্ঠে প্রতিউত্তর দিয়ে আবার বইয়ে ডুব দিলাম। আনভীর ট্রাউজারর পকেটে হাত গুঁজে শীতল চোখে দেখলেন আমায়। তারপর দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘এক ঘন্টা অলমোসন্ট হয়ে গিয়েছে আহি তুমি টেবিলে বসে আছো।এখন বই বন্ধ করো। মাইন্ডটাকে একটু রেস্ট দাও। নাহলে এক্সামে ভালো পারফরম্যান্স করতে পারবে না।’
আমি উনার কথায় তেমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। আনভীর বিরক্ত হচ্ছিলেন সকাল থেকে আমার এমন শীতল রূপ দেখে। যে আহি সবসময় উনার কথায় গুটিশুটি হয়ে থাকতো, কথায় কথায় নিজের ইমোশন প্রকাশ করে ফেলতো আজ সেই আহি এতটা নির্বিকার ! বিষয়টা শুধু উনাকে ন আমাকেও রীতিমতো ভাবাচ্ছে নিজের এমন বিরাট পরিবর্তন দেখে। তবে একটা জিনিস সম্পর্কে আমি ভালোভাবেই অবগত হয়েছি , পরিবেশ আর পারিপার্শ্বিক অবস্থা খুব সহজেই একজনকে পরিবর্তন করে ফেলে , যেমনটা আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে।
আনভীর আমায় এভাবে মানবমূর্তির মতো বসে থাকতে দেখে আমার চেয়ার ঘুরিয়ে নিজের মুখোমুখি করলেন। আমি অবাক ন্যায় কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনি আমার হাতের কব্জি টেনে উঠিয়ে বারান্দার ডিভানে বসিয়ে দিলেন আমায়। আমি প্রতিক্রিয়াহীনভাবে প্রশ্ন করলাম,
-‘এভাবে টেনে নিয়ে আসলেন কেনো আনভীর?’
আনভীর আমার বরাবর ছোট্ট টুলে নিয়ে বসলেন কিছুটা দুরত্ব ঘেষে। বললেন,
-‘আমার কথা শুনছো না তাই টেনে নিয়ে আসলাম। আজ তোমার এডমিশন টেস্ট আহি। তাই বলছি এত লং টাইম পড়ে মাইন্ডটা ক্লান্ত করে ফেলো না। পরীক্ষা দিতে হয় ঠান্ডা মাথায়। আর তুমি যদি এত চিন্তামগ্ন থাকো , তাহলে কখনোই সেটা ভালো রেজাল্ট আনবে না।’
আমি নীরব।
-‘আর তাছাড়া এই প্রিপারেশনের সময়টুকু আমি তোমায় না পড়ালেও তোমার সবকিছু নজরে রেখেছি আমি আহি। আমি কনফিডেন্টলি বলতে পারবো তোমার প্রিপারেশন অনেক ভালো আর মেডিক্যালে চান্স পাওয়ার জন্য একটা হিউজ নম্বর তোমার হাতে আছে। এখন শুধু এটা দেখতে হবে যে ভাগ্য তোমায় ডিএমসিতে সুযোগ করে দেয় কি-না। তাই নিজে আগে কনফিডেন্ট রাখো।’
আমি তপ্তশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়িয়ে বুঝালাম যে উনার প্রতিটা কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনেছি আমি। আনভীর আলতো হাসলেন। সুদর্শন মুখের এই হাসিটা নিমিষেই আমার ভারক্রান্ত মনে একটা অন্যরকম অনুভূতি জাগিয়ে তুললো। আনভীর নিঃসন্দেহে পারফেক্ট একজন হাজবেন্ড। আমার প্রতি সবধরনের খেয়াল আছে উনার। এমনকি আমায় উৎসাহ দেওয়ার জন্যও একজন নিঃসন্দেহে চমৎকার মানুষ। তবে এগুলো সবই উনার রেসপন্সিবিলিটি ছাড়া আর কিছুই না। আমি এটাও জানি যে আজ হোক বা আগামীকাল একদিন এখান থেকে আমায় চলে যেতেই হবে। আমার আর ইচ্ছে নেই কারও হাতের পুতুল হওয়ার। উনার কথামতো মুক্তি দিয়ে দেবো এই আহি নামের মানুষটি থেকে।
_______________________________________
আনভীর আমার এডমিট কার্ড নিয়ে খুজে চলছেন পরীক্ষার হলরুমটি। শিউলি ভাবিও সাথে আসতে চেয়েছিলেন তবে আজরান ভাইয়া না করে দিলো আসতে। কেন উনি না করেছিলেন কে জানে। পরীক্ষার কেন্দ্রে এমন স্টুডেন্টসদের সাথে কমবেশি প্রত্যেকেরই কেউ না কেউ একজন এসেছে। আমি কিছুটা নীরব। মনে মনে অসংখ্যবার সূরা পড়ে ফেলছি। ছোটবেলায় আমার দাদি সবসময়ই বলতো যে বেশি কথা বললে পরীক্ষার সময় নাকি সব পড়া ভুলে যায়। তখন আমার বয়স ছিলো ৭ কি ৮ বছর! তবে দাদির এই ছোট্ট কথাটি আমার জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলেছিলো। এরপর থেকে পরীক্ষার দিন পরীক্ষা না দেওয়ার আগ পর্যন্ত খুব বেশি একটা কথা বলতাম না আমি।যার অস্তিত্বটা এখনও রয়ে গেছে। আমি তাই কোনোরূপ কোনো কথা না বলে উনার পিছু পিছু হাটতে লাগলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পর পেয়েও গেলাম হলরুম। এই রুমে আমি আমার কোচিং সেন্টারের দু’তিনজন পরিচিত মানুষদেরও দেখতে পেয়েছি। তবে আচমকা অবাক হলাম ধ্রুব ভাইয়াকে দেখে। ধ্রুব ভাইয়া আমাদের কোচিং এরই একজন স্টুডেন্ট এর সাথে কথা বলছিলেন। আমায় দেখে মুচকি হাসলেন উনি। জিজ্ঞেস করলেন,
-‘কি অবস্থা আহি? পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত তো!’
-‘অবশ্যই। তবে আপনাকে এখানে দেখে প্রচন্ড অবাক আমি।’
-‘এইতো তোমাদের সাথেই দেখা করতে এসেছি। আর ভুলে যেও না, আমি কিন্ত এই ডিপার্টমেন্টেরই একজন। ‘
ধ্রুব ভাইয়া আরও কিছু বলতে যাবেন তার আগেই আনভীর হাত চেপে ধরলেন আমার। ধ্রুব সেটা দেখে আর কথা বাড়ালেন না। আনভীর মেকি হেসে বললেন,
-‘থ্যাংকস টু ইউ ধ্রুব, একজন স্যার হিসেবে স্টুডেন্ট দের প্রতি তুমি খুব লয়াল এন্ড আই লাইক ইট। তবে এখন আহির সাথে আমি আছি তো, তাই ওকে নিয়ে তোমার এত চিন্তা না করলেও চলবে।’
ধ্রুব একটা সুক্ষ্ম হাসি দিলেন বিনিময়ে। অন্যত্র যাওয়ার আগে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
-‘শুভাকামনা থাকলো।’
আনভীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নম্বর খুজে সিট দেখিয়ে দিলেন আমায়।হলে অনেক মানুষ গিজগিজ করছে৷ আনভীর শান্ত কন্ঠে বললেন,
-‘লিসেন, মাথা ঠান্ডা রেখে পরীক্ষা দেবে। কোনো কিছু না পারলে বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ো না৷ কেননা মেডিক্যাল এডমিশন এক্সামে এমন অনেক প্রশ্ন দেয় যা অনেক হার্ড হয়। সবার সেগুলো উত্তর দিতে পারবে না৷ তাই ওগুলো নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে যেগুলো পারবে ওগুলোর উত্তর আগে দিবে। কোনো প্রশ্নের উত্তর স্কিপ করো না। যা উত্তর দিবে সব সিউর হয়ে দিবে। বুঝেছো?’
-হুম।
আনভীর দৃষ্টি গম্ভীর করলেন এবার।তারপর জড়ানো গলায় বললেন,
-‘ভালোমতো পরীক্ষা দিও তাহলে। বেস্ট উইশেস ফর ইউ!’
হল থেকে সবাইকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিতেই চলে গেলেন আনভীর।
পরীক্ষাটা আমার এক্সপেক্টেশনের বাহিরে মোটামুটি ভালোই হয়েছে।
আমি পরীক্ষা শেষ করে এবার হল থেকে বাহিরে বেরিয়ে এলাম। আজ সকালটা যেমন মেঘাচ্ছন্ন ছিলো সেই পুঞ্জীভূত কালো মেঘগুলো এবার বৃষ্টিতে রূপান্তর হয়েছে। আমি এতে ভিজে যাচ্ছি একটু। এত মানুষ আর ছাতার সমাগমে আনভীরকে খুঁজে পেতেও কষ্ট হচ্ছে বেশ।একটা লম্বা সময় পর ধীরে ধীরে খালি হতে লাগলো পরীক্ষা কেন্দ্রটি, কিছু স্টুডেন্ট তাদের পরিচিতদের দেখা পেয়ে চলে গিয়েছে কেন্দ্র ছেড়ে। আর কিছু স্টুডেন্ট আমার মতো খুঁজে চলছে তাদের পরিচিতদের। এর মধ্যেই কোথেকে ধ্রুব ভাইয়া হাজির হলো আমার কাছে৷ উনার হাতে নীল রঙের একটি ছাতা। এভাবে আধভেজা হয়ে থাকতে দেখে উনি চিন্তাগ্রস্থভাবে বললেন,
-‘তুমি দেখি পুরো ভিজে গিয়েছো। আনভীর কোথায়? ‘
-‘আসলে, উনাকে খুঁজে পাচ্ছি না ভাইয়া। ‘
-‘না পাওয়াটাই স্বাভাবিক এত মানুষের মধ্যে। ‘
আমি নীরব রইলাম। ঠান্ডায় জবুথবু অবস্থা আমায়। ধ্রুব ভাইয়া তা দেখে বললেন,
-‘আচ্ছা আমিও দাঁড়াই এখানে। আনভীর এসে পড়বে, টেনশন করো না।’
বলেই আমার মাথার ওপর ছাতা নিয়ে আসতেই আচমকা আনভীর এসে নিজের কোর্ট খুলে আমার গায়ে জরিয়ে দিলেন।উনার তৎক্ষনাৎ কাজে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি। আনভীর গহীন দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার দিকে। আড়ষ্ট কন্ঠে বললেন,
-‘তোমার শরীর ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টির জন্য। বাসায় চলো এখন। পরীক্ষার কথা বাসায় গিয়ে করবো।’
বলেই উনি ধ্রুব ভাইয়ার দিকে তাকালেন। স্মিত হেসে বললেন,
-‘আহির জন্য আমি আছি ধ্রুব। তোমায় এত টেনশন না করলেও চলবে।’
বলেই উনি আমার হাত একহাত দিয়ে চেপে ধরলেন আর একহাতে আমাদের দুজনের মাথার ওপর নিয়ে নিলেন ছাতা। আমি মৌনভাবে উনার কাজকর্ম দেখে যাচ্ছি। উনার পরনে নিজের কোটটি আমার গায়ে জড়িয়ে দেওয়াতে আমার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। সেই সাথে কাজ করছে নানা ধরনের চিন্তা।উনার চোখে আমার জন্য একরাশ সুপ্ত অনুভূতি দেখতে পারছি তবুও কেন উনি বলেন যে আমি শুধু উনার দায়িত্ববোধ ?
আনভীর এবার দ্রুত আমার হাত টেনে বেরিয়ে এলেন পিচঢালাই পথের মধ্যে। বৃষ্টির কারনে মানুষজন কমে গিয়েছে আশপাশে। আমি অবাকমিশ্রিত চাহিনীতে পরখ করে নিলাম এই গহীন সৌন্দর্যবান মানুষটিকে। বৃষ্টির গতি বাড়াতে যেই না আমার ডান পাশ ভিজে যাচ্ছিলো উনি আমার বাহু চেপে নিজের কাছে নিয়ে আসলেন ছাতার মধ্যে। আমি কেপে উঠলাম। বুকের দ্রিম দ্রিম শব্দ বেড়ে গিয়েছিলো হঠাৎ করে। না আহি ! এই মানুষটার প্রতি এত দুর্বল হওয়া চলবে না তোর। কেননা তোকে আনভীর মানুষটিকে ছেড়ে যেতে হবে।
চলে যেতে হবে- বিষয়টি ভাবতেই আমার হৃদয় খা খা করে ওঠলো।কেননা আজই চলে যাবো আমি। এখানে কারও দায়িত্ব হয়ে থাকার ইচ্ছেটা আমার মরে গিয়েছে। আমি এখন শুধু শান্তি চাই । চাই , এসব কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পেতে। এই #এক_শ্রাবণ_হাওয়ার মতো আনভীরের প্রতি আমার দুর্বলতাটি কঠোর থাকলেও তা স্মৃতির কোঠায় বন্দী করে রাখতে চাই।
তাই আমি উনার থেকে রাগবশত একটু দূরে সরে আসতেই উনি ক্ষীপ্তভাবে চেপে ধরলেন আমায়। গম্ভীর স্বরে বললেন,
-‘ভুলেও আমার কাছে থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করোনা আহি!’
আমি নির্বাক। উনার ব্যবহার আমায় সর্বত্র প্রহেলিকার জালে ঘিরে ধরেছে। তবে এবার আপনার কথা প্রথমবারের মতো অমাণ্য করবো আমি। আমিও দেখতে চাই আমি চলে যাওয়ার পর আপনি ঠিক কেমন অনুভব করেন।
.
.
.
.
~চলবে……….ইনশাআল্লাহ !!