এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ২৬+২৭+বোনাস

##এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব -২৬
আনভীর আমায় বাড়ির সামনে নামিয়েই চলে গেলেন উনার ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। আমি তাই এবার দ্রুত পায়ে বাসায় এসে পড়লাম। উদ্দেশ্য একটাই, যতদ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে।বৃষ্টিতে সামান্য ভিজে যাওয়ার কারনে খানিকটা সিক্ত আছি আমি। তাই দ্রুত শুকনো কাপড় পড়ে আলমারি থেকে কাপড়-চোপড় নামিয়ে ব্যাগ গুছাতে থাকলাম। গতরাতেই মামার সঙ্গে কথা হয়েছে। উনাকে শুধু এতটুকুই বলেছি যে আমি আসছি। কেন আসছি, কার সাথে আসছি এ ব্যাপারে কিছুই বলিনি৷ প্রথমে উনাদের কাছে যেয়ে নেই তারপর বিস্তারিত সব বলবো। আমার ব্যাগ গুছানোর মধ্যেই আচমকা মা ঘরে প্রবেশ করলেন। উনার উপস্থিতিতে আমার হাত আপনা আপনি কেমন করে যেন থেমে গেলো।

মা নির্বাক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছেন আমার কাজকর্ম। মলিনভাবে বললেন,

-‘আমিই হয়তো প্রথম শ্বাশুড়ি যে কি না নিজের বৌ মাকে ছেলের কাছ থেকে আলাদা হতে দেখে কিছু বলছি না।’

আমি নীরব। উনি এবার বললেন,

-‘একটা কথা বলবো আহি, তোমায় আমি কিন্ত সবসময় নিজের মেয়ের মতোই দেখেছি। শিউলির মতো তোমাকেও প্রচন্ড স্নেহের মনে করি তবে তুমি আর আনভীর আমাদের সাথে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো তা আমি কখনোই ভুলতে পারবো না।’

আমার চোখজোড়া টলমল করছে অশ্রুতে। অজান্তেই এই মানুষটিকে বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি। আর উনি এত বড় সত্য,জানার পরেও একবারও বাবাকে কথাটি বললেন না যাতে উনি এখন কষ্ট না পায়, তবে একদিন না একদিন আমাদের সত্য উনাকে তো জানতেই হবে।মা আবার জিজ্ঞেস করলেন,

-‘আহি, আনভীরকে কি আর একটাবার সুযোগ দেওয়া,,,,,,, ‘

উনি কথাটি সম্পূর্ণ না করতেই আমি থমথমে গলায় বললাম,

-‘কি সুযোগ দিবো আমি মা? আবারও যাতে আমায় কষ্ট দেয় সেই সুযোগ?,,,,(কিছুটা থেমে),,,,আনভীর আমায় নিজের একজন রেসপন্সিবিলিটি ছাড়া আর কিছুই মনে করেননি। উনার সাথে আমার সকাল শুরু হয়েছে পড়াশোনা নিয়ে আর রাতও হয়েছে পড়াশোনা নিয়ে৷ উনি কখনোই আমায় বলেননি যে আমার প্রতি উনার কোনো অনুভূতি আছে৷ পুরো দুটো মাস উনার সঙ্গে কাটিয়েছি আমি মা। উনার এই কোল্ড বিহেভ আমি আর সহ্য করতে পারছি না৷ আমি চাই উনাকে উনার দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করে দিতে।’

মা কিছু বললেন না বিনিময়ে। যেখানে আমার হঠাৎ এত বড় সিদ্ধান্তের কারনই আনভীর ছিলেন সেখানে ছেলের পক্ষে কি সাফাই দিবেন উনি! মা একটা সুক্ষ্ম হাসি দিলেন এবার। আড়ষ্টতা ভাব নিয়ে বলে ওঠলেন,

-‘এর উত্তরগুলো আমি কেনো দিলাম না জানো? কারন আনভীরই সময়মতো তোমায় উত্তর দিয়ে দিবে। তোমায় আমি চলে যেতে বলেছি এই কারনে যাতে আনভীর তোমার প্রতি দুর্বলতাটি অনুভব করতে পারে৷ আমি তোমার বাবা, আজরান ভাইয়া আর শিউলি ভাবিকে এটাই বলবো যে তুমি কিছুদিনের জন্য তোমার মামার বাসায় বেড়াতে যাচ্ছো। তবে আনভীরকে কিছুই বলবো না।’

উনার কথার তেমন পরোয়া করলাম না আমি৷ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম মামার সাথে ব্যাপারটি নিয়ে কথা বললে উনি পরে বাবার সাথে কথা বলবেন। তবুও আনভীরেক আর মেনে নিতে পারবো না আমি। শিউলি ভাবি যেহেতু আমার সত্যটা জানেন না তাই বারবার বলছিলনে আমায় একা এতদূর না যেতে, আজরান ভাইয়া বা আনভীর আসুক, তারপর যেতে।কিন্ত আমি সাফ না করে দিলাম। যার থেকে পালানোর জন্য এতকিছু আবার তাকেই ডাকবো আমি ! এছাড়া আমি নিশ্চিত আমাদের বিয়ের সেই ঘটনার পর আনভীর আর যাই হোক আমাদের বাসায় মোটেও যাবেন না। তাছাড়া আমার মামার বাসা কোথায় সেটাও জানেন না উনি। এসব ভাবতে ভাবতেই আমি সবাইকে দেখে নিলাম একপলক। কেননা এর পর আমি হয়তো উনাদের মুখোমুখি আর হবো না।

__________________________________

আমার মামু’বাড়িটি ঢাকার অদূরেই গাজীপুরে অবস্থিত। বাস চেপে সেখানে গেলে ঘন্টা পাচেক সময় লাগে। ট্রেনে গেলে সময় লাগে আরও কম। তবে ট্রেনের টিকেট না পাওয়ার জন্য অগত্যাই বাসে যেতে হয়েছে আমায়। তারপর সেখান থেকে অটোরিকশায় মধুগন্জ। বাস থেকে নেমেই দেখি আমার ছোট মামু দাড়িয়ে আছে আমার জন্য। মহাশয় এখনও বেকার বিধায় বড় মামুর সাথেই থাকছে, খাচ্ছে আর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর ছোট মামুর সাথে ২০ মিনিটের মধ্যেই চলে গেলাম সেই প্রত্যন্ত ভিটেবাড়িতে। মা মারা যাওয়ার পর এই নিয়ে দ্বিতীয়বার আসলাম এখানে। আগের তুলনায় সড়কের অবস্থারও বেশ উন্নত হয়েছে।

বাড়িতে বড় মামু-মামী আমার মামাতো ভাইবোনেরা বেশ ভালোভাবেই অ্যাপায়ন করেছে আমায়। আমি আসার কথা শুনে খালামণিও খালুজানকে নিয়ে ছুটে এসেছে। আমার নানা-নানি মারা গিয়েছিলেন আমার জন্মেরও আগে। তাই তাদের দেখার সৌভাগ্য কখনও হয়নি। সেই সুবাদে মায়ের সঙ্গে তার ভাই-বোনদের সম্পর্ক অনেক সুগভীর ছিলো। তবে মায়ের মৃত্যুর পর আমার বাবা একেবারেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় উনাদের সাথে। মামু বহুবার আমায় এডপ্ট করার প্রস্তাব দিলেও তাতে বাধা দেয় চাচা চাচী, তাই তাদের খালামণি-ছোট মামু বা আমার মামাতো ভাইবোন কারও সাথেই আমার কোনো যোগাযোগ ছিলো না। তবে বড় মামা প্রায়ই দেখা করে যেতেন আমার সাথে। মায়ের পর একমাত্র উনিই একজন মানুষ ছিলেন যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছি আমি। এমনকি অপূর্ব ভাইয়ার পাগলামি থেকে আমায় বাচানোর জন্য উনিই নিজ তদারকে ভাইয়াকে প্রবাসে পাঠিয়ে দেন।
এসব ভাবতে ভাবতেই আমি সবার সাথে কথপোকথন চালালাম। এর মধ্যে মামি আমায় জিজ্ঞেস করতে করতে অস্থির হয়ে উঠেছেন যে , জামাই কই , জামাই কই ! এভাবে একা ঢাকা থেকে চলে এলে কেন ; কিন্ত আমি এসবের কিছুই প্রতিউত্তর দিলাম না। বলতে গেলে সুক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে গেলাম। আমার এই বিষয়টা কেউ আন্দাজ করতে না পারলেও আমি জানি যে বড় মামু ঠিকই ধরতে পেরেছেন কোনো একটি সমস্যা। কিন্ত এখানে কিছুই বললেন না উনি। একপর্যায়ে ছোট মামু অধৈর্য হয়ে বললেন,

-‘আহা ভাবি ! ওকে এত অস্থির করছো কেনো? কত লম্বা জার্নি করে এসেছে। একটু রুম দেখিয়ে দাও মেয়েটাকে, ফ্রেশ টেশ হওয়ার পর জামাই কেনো; জামাইয়ের চৌদ্দগুষ্টির খবর নিও।’

তারপর ছোটমামুর কথামতো আমার মামাতো বোন নীলু আমায় রুমে নিয়ে গেলো। আজ সারাটাদিন বড্ড ধকল গিয়েছে আমার শরীরে। তাই জামাকাপড় পাল্টে দ্রুতই বিছানায় একটা হালকা ঘুম দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম।

______________________

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে বড় মামুর মুখোমুখি বসেছি আমি। বাইরে ফুরফুরে বাতাস। বাগান থেকে হাওয়ার তালে ফুলের ঘ্রাণ মৌ মৌ করে বেড়াচ্ছে বাড়ির বাইরে এই লম্বা বারান্দায়। মধুগন্জ এলাকাটি আটটার পরই কেমন যেন থমথমে রূপ ধারন করে। তবুও এই মৌনতার মধ্যে কাজ করে আলাদা একরকম প্রশান্তি। আমি জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিলাম এবার। গলা দিয়ে কথা বের করার চেষ্টা করছি। মামু আমায় এতটা উদ্বিগ্ন দেখে গম্ভীর স্বরে বললেন,

-‘শান্ত হও আহি। আমি ধৈর্য ধরে শুনবো তোমার কথা। এতটা তোমায় উদ্বিগ্ন হতে হবে না।’

আমি নিঃশ্বাস ফেললাম বারকয়েক। তারপর মিহি কন্ঠে বললাম,

-‘আমি আপনার কাছে থাকতে চাই মামু। আমি ফিরে যেতে চাই না !’

মামু কিঞ্চিত হাসলেন আমার কথায়। বললেন,

-‘জামাইয়ের সাথে রাগ করে এসেছো নাকি ! তবে এখানে এসে ভালোই করেছো। নাহলে তোমার বাবা তো কখনোই এ বাড়িতে আসার অনুমতি দিতো না।’

আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছিনা। যদি উনিও একবার শুনেন যে আমার আর আনভীরের মধ্যকার সম্পর্ক একটা চুক্তির ভিত্তিতে করা তবে শুনে খুব কষ্ট পাবেন। তবুও একবুক সাহস নিয়ে উনাকে বলতে যাবো তখন ছোটমামী মামুর জন্য ওষুধ নিয়ে আসতেই আমি থেমে গেলাম। আমায় দেখে মামী হেসে বললেন,

-‘মামু-ভাগনীর মধ্যে কি আলাপ হচ্ছে গো?’

আমি কিছু বললাম না প্রতিউত্তরে। পরে মামুই একটা উত্তর সাজিয়ে বললেন। আমি বুঝলাম এখন উনার সাথে কথা বলার উপযুক্ত সময় না। তাই উনাদেরকে শুভরাত্রি জানিয়ে আমি ঘুমোতে চলে গেলাম। স্থির করলাম , সকালে উঠেই মামুর সাথে কথা বলবো।

_____________________________

বিছানায় হাত পা মেলে ঘুমানোর মধ্যে আলাদাই এক আনন্দ আছে। আনভীরের সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকে সে আনন্দটাকে আমার মাটিচাপা দিয়ে দিতে হয়েছিলো। এমনিতেও অসভ্য মানুষ, আমার ভুলবশত এমন হওয়াতে কখন কি বলে ফেলতো হিসাব নাই। তবে এতদিন পর এমন একটা ঘুম দিয়ে ভালোলাই লাগছিলো আমার। এতটাই ভালোলাগছিলো যে কম্বল থেকে মাথা বের করার ইচ্ছে করছিলো না। সকাল হয়ে গিয়েছে। আলো ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। এর মধ্যে আড়মুড়িয়ে পা দিয়ে গায়ের থেকে কম্বল সরিয়ে অন্যকাত হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। তবে অদূরে যা দেখতে পেলাম তা দেখে আশ্চর্যের সীমা রইলো না আমার। আনভীর সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছেন। পরনে ব্ল্যাক শার্ট আর গ্রে জিন্স। উনার ঐতিহ্যবাহি চশমা এবার শার্টে রেখে দেওয়াতে সেই বিপদজনক চোখজোড়া যেন পাগল করে দিচ্ছে আমায়। আমি তৎক্ষণাৎ উঠে বসলাম।উনি শীতল কন্ঠে বললেন,

-‘বিছানায় দাপাদাপি করা হয়েছে তোমার? এখন উঠো তাহলে, তুমি আজই আমার সঙ্গে ঢাকায় ব্যাক করছো?’

আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম এই কথায়।মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন দেখছি। এটা আদৌ স্বপ্ন নাকি আসলেই এই আনভীর পাগলটা এসেছেন আমায় নিয়ে যেতে? ও মাই গড আহি , তুই এবার শেষ!
.
.
.
~চলবে,,,,,ইনশাআল্লাহ

ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ২৭
-‘বিছানায় দাপাদাপি করা হয়েছে তোমার? এখন উঠো তাহলে, তুমি আজই আমার সঙ্গে ঢাকায় ব্যাক করছো?’
আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম এই কথায়।মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন দেখছি। এটা আদৌ স্বপ্ন নাকি আসলেই এই আনভীর পাগলটা এসেছেন আমায় নিয়ে যেতে? আমি অপ্রস্তুত কন্ঠ বলে উঠলাম,

-‘আ আপনি ক কি আসলেই আনভীর?’

-‘কোনো ডাউট আছে?’

আনভীরের কাট কাট গলা। আমি শুকনো ঢোক গিললাম ক্রমাগত। মনে মনে এটাই ভাবছি যে এটা যেন দুঃস্বপ্ন হয়, আনভীর যেন এখানে না থাকে, কিন্ত এমন কিছুই হলো না। কেননা আমার চোখের সামনে সত্যি সত্যিই আনভীর আছেন যার প্রমাণ আমি আরও ভালোমতো পেলাম উনার কথায়,

-‘তুমি যেহেতু আমায় ওয়াইফ সে হিসেবে তোমায় আমার বেডে ঘুমানো উচিত ছিলো, বাট তোমায় আমি সেখানে না পেয়ে পেলাম তোমার মামুবাড়িতে, ব্যাপারটা স্ট্রেইন্জ না মিসেস আহি আনভীর খান?’

আমার শরীর দিয়ে একপ্রকার ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো উনার মুখে ‘মিসেস আহি আনভীর খান’ সম্বোধনটি শুনে। তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছি উনি আমার ওপর ভয়ঙ্কর রেগে আছেন। চোখ মুখ টকটকে লাল , যেন সারারাত ঘুমাননি। উনার চেহারা দেখে এমন মনে হচ্ছে যে উনার শরীরের ওপর দিয়ে একটা বিশাল ঝড় বয়ে গিয়েছে যার জন্য উনি এতটা উদ্ভ্রান্ত। আমি কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেললাম এখন। তারপর জিজ্ঞেস করলাম,

-‘আপনি এখানে কেনো এসেছেন?’

-‘আমার বউ যেহেতু এখানে আছে, আমার এখানে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু না।’

উনার মুখে এসব কথাশুনে রীতিমতো গা জ্বলে যাচ্ছে আমার। আমায় এভাবে বিছানায় বসে থাকতে দেখে উনি ভ্রু কুচকে বললেন,

-‘হোয়াট হ্যাপেন্ড? কি বলেছিলাম কানে যায়নি? ফটাফট ফ্রেস হয়ে নেও। আজই আমরা ঢাকা ব্যাক করছি।’

-‘আপনি চলে যান। আমি আমার মামুবাড়ি থেকে একপাও নড়বো না।’

উনি আমার কথা শুনে আচমকা সোফা থেকে উঠে আমার কাছে এসে আমায় বিছানার সাথে চেপে ধরলেন এবার। উনার হঠাৎ আক্রমণে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছি।গলার স্বর কেমন যেন বন্ধ হয়ে আসছে। আমি শুকনো ঢোক গিললাম। উনি আড়ষ্ট গলায় বললেন,

-‘লিসেন আহি, খুব কষ্ট করে আমি নিজের রাগ সামলে রেখেছি। এখন তোমার এধরনের কথায় আমি রাগের বশে তোমার সাথে কি করে ফেলবো তা আমি নিজেও জানিনা।,,,,,,(নিঃশ্বাস ফেলে),,,,,তোমার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না। হাউ ডেয়ার ইউ আহি উইদআউট মাই পার্মিশন এখানে এসেছো তুমি? একটাবার ভেবেছো যে তোমায় খুঁজে না পেয়ে কি অবস্থা হয়েছিলো আমার? মা’কে আমি বারবার জিঙ্গেস করছিলাম যে তুমি কোথায় বাট মা কিছুই বললোনা। শেষ পর্যন্ত ভাবিমণি বললো যে তুমি তোমার মামুর বাসায় গিয়েছো। তারপর আমি না চাওয়া সত্বেও তোমার বাবাকে কল দিতে বাধ্য হই শুধুমাত্র তোমার ঠিকানা পাওয়ার জন্য। আমি তারপর সময় নষ্ট না করে তখনই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাই এখানে আসার জন্য।যেখানে আমি সারাটারাত তোমার জন্য ছটফট করছিলাম সেখানে তুমি দিব্যি মামু বাড়িতে হাত-পা মেলে ঘুমাচ্ছো।’

উনার প্রখর কন্ঠ শুনে আমি চোখ নামিয়ে ফেললাম। তবে অবাকও হয়েছি বেশ কথাগুলো শুনে। আমি তো ভেবেছিলাম আমি চলে আসাতে উনি বড্ড খুশিই হবেন। তবে এভাবে যে আমায় ছাড়া একরাতেই পাগল হয়ে এখানে ছুটে এসে পড়বেন তা ছিলো আমার ধারনার বাহিরে। আমি উনার চোখে চোখ রেখে এবার দৃঢ় কন্ঠে বললাম,

-‘কেন ছটফট করবেন আপনি আমার জন্য। আমি তো আপনার কাছে জাস্ট দায়বদ্ধতা ছাড়া আর কিছুই না? তাহলে এত ছটফটানি কেনো?’

-‘কারন তোমাকে আমার প্রয়োজন।’

উনি তৎক্ষণাৎ বলে ফেললেন মিহি কন্ঠে। আমি যেন থমকে গিয়েছি উনার এই কথাতে। আনভীর নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। চশমাবিহীন চোখের কালচে বাদামী মণিগুলো অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। উনিনিঃশ্বাস ফেলছেন বারবার। কেমন যেন অস্থির দেখাচ্ছে মানুষটাকে। উনি আবার বলে ওঠলেন,

-‘এর বেশি আর কিছু শুনতে চাও তুমি আহি, তুমি আমার দায়িত্ব না, তুমি আমার প্রয়োজন। এই উত্তরটা কি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়?’

-না নয়।

আমি থমথমে কন্ঠে উনাকে এই কথা বলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। কেননা আনভীরের আর কোনো কথাতেই দুর্বল হচ্ছি না আমি। এবার উনি যাই বলুক না কেনো, আমি উনার সাথে ফিরে যাবো না, কিছুতেই যাবো না। আনভীর উঠে আমার ঠিক কাছাকাছি দাঁড়ালেন এবার। পকেটে হাত গুজে শান্ত চাহিনী দিয়ে বললেন,

-‘তাহলে তুমি সিউর যে আমার সাথে আসছো না।’

-‘হাড্রেট পার্সেন্ট সিউর।’

আমি কাটকাট গলায় প্রতিউত্তর দিলাম। আনভীর আমার উত্তর শুনে খানিকটা হেসে বললেন,

-‘ওকে ফাইন।’

আমি এতে তাজ্জব বনে গেলাম। আনভীরের এত ঠান্ডা ব্যবহারের সাথে রীতিমতো আমার প্রথম সাক্ষাত এটা। আমি তো ভেবেছিলাম উনি আরও চিল্লাচিল্লি করবেন, জোর করবেন আমায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্ত সেসব না করে উনার সম্মতি জানানোটা রীতিমতো ভাবিয়ে তুলছে আমায়। তবুও আমি নিজেকে আশ্বস্ত করে বললাম,

-‘তাহলে চলে যান এখান থেকে।’

-‘ওয়েট অ্যা মিনিট, আমি কি একটাবারও বলেছি যে আমি এখান থেকে ফিরে যাবো?’

-‘মানে?’

আনভীর খানিকটা কাছে এসে দাঁড়ালেন আমার। বললেন,

-‘আমার বউ যতদিন এখানে , আমিও ততদিন এখানে। ইউ নো হোয়াট ! বউ ছাড়া আমি আবার ঘুমাতে পারি না।’

আমার পুরো মুখমন্ডল জুড়ে রক্তিম আভা ছাড়িয়ে পড়লো। ঘুম থেকে উঠে যদি এরকম অস্বস্তির চরম মাত্রায় চলে যাই….আমার মনে হয়না পৃথিবীতে এর থেকে বিদঘুটে জিনিস আর আছে। লাইক সিরিয়াসলি ! যেদিকে বিয়ের এতদিন উনি শুধু আমায় দায়িত্ব , এগ্রিমেন্ট এসব বুলশিট বলে রীতিমতো ডিপ্রেসড করে রেখেছেন সেদিকে উনার এতদিন পর মনে হলো আমি উনার বউ? এই লোকটা তো বিছানায় রীতিমতো বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত বানিয়ে রাখেন, তাহলে কোন মুখে বলেন যে আমায় ছাড়া উনি ঘুমাতে পারেন না? আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,

-‘সকাল সকাল কি আমার সাথে আপনি মজা করছেন আনভীর? বারবার আমায় নিজের বউ বলে সম্বোধন করছেন কেন? আমি তো আপনার চুক্তিবদ্ধ বউ। জাস্ট একপ্রকার দায়বদ্ধতা। আপনি এতদিন বলেছেন আর যাই হোক আমায় আপনি ভালোবাসতে পারবেন না, এই বিয়ে আপনি জাস্ট পরিস্থিতির চাপে করেছেন ব্লা ব্লা ব্লা তাহলে এখন আমার প্রতি এত দরদ কেনো?আমি তো আপনাকে মুক্ত করে দিয়েছি।’

আনভীর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠলেন আমার কথায়। আমার বাহু টেনে তাই সজোরে চেপে নিয়ে আসতেই আমি ‘আহ্’ শব্দ করে উঠলাম। কেননা উনি খুব কড়াকড়িভাবেই আমায় চেপে ধরেছেন যার দরুন আমি ব্যাথা পাচ্ছি। উনি বললেন,

-‘মুক্ত করতে হবেনা আমায় শুনেছো? আমি দরকার পড়লে আজীবন তোমার আবদ্ধে বন্দী থাকবো। পুড়ে ছারখার হয়ে যাক ওই এগ্রিমেন্ট। আই ডোন্ট কেয়ার।আমি তোমায় ওয়ার্ন করলাম আহি ফার্দার তুমি কখনোই আমার থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করবে না। এতে আমার কি অবস্থা হয়েছিলো একটাবার খবর নাও তুমি? এখানে আসার পর ফোন সুইচড অফ করে রাখার পর অন করে চেক করেছো কতোগুলো কল করেছি আমি তোমায়?আরে হাফ মেন্টাল হয়ে গিয়েছিলাম আমি।’

-‘কেনো আমার জন্য আপনি এত তৎপর হয়ে ওঠবেন? এত চিন্তা কেনো আমার জন্য?’

উনি কিছু বলতে গিয়েও বললেন না।আমি উনার থেকে ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে। খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম আনভীরের থেকে আঘাত পাওয়ার পর। কিন্ত একরাতের ব্যবধানেই মানুষটা ফিরে এসে সব তছনছ করে দিলো। আমার কাছে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো মনে হচ্ছে। আমার ধারনা হয়ে গিয়েছে যে এই মানুষটা আমায় না নিয়ে ঢাকায় ফিরবেন না।

____________________

ডাইনিং টেবিলে আমি খাচ্ছি কম রাগের বসে ঠোঁট কামড়াচ্ছি বেশি। আমার অসভ্য বরটা আমার পাশেই কোনোমতে খেয়ে চলছেন। মামাশ্বশুড় বাড়িতে মহাশয় যেহেতু প্রথম এসেছেন তবে সবার আপ্যায়ন তো করাই লাগে। সেই সুবাদে মামা-মামী, নীলু , খালামণি সবাই তৎপর হয়ে ওঠেছেন উনাকে নিয়ে। এসব অতিরিক্ত ভক্তি দেখে জাস্ট বিরক্তি লাগছে আমার। আর এই লোকতো এসেই নিজের কথার জালে সবাইকে হাত করে নিলো। ছোটমামার মতো মানুষকেও সে নিজের পরম ভক্তও বাধিয়ে ফেলেছে। আমি শুধু ভাবছি যে আমার সকালে এই কিছুক্ষণ ঘুমের ফলাফল যে এমন পাবো তা জানলে আমি সারারাত সকাল একবিন্দুও ঘুমাতাম না। আমি প্রচন্ড রাগ নিয়ে প্লেটের দিকে মনোনিবেশ করলাম। ছোট মামু আমার এমন কান্ড দেখে বললো,

-‘কিরে আহি ! খাচ্ছিস না ক্যান?’

কথাটি বলেই মামু গপাগপ খাওয়াতে মন দিলো। এমন বিস্ময়কর মামু এই পৃথিবীরইতিহাসে মনে হয় আমারই আছে। দাঁতে দাঁত চেপে তাই বললাম,

-‘তুমি যেই হারে খাচ্ছো, আমার খাওয়ার সাধ মিটে গিয়েছে।’

আমি মামীর দিকে তাকালাম এবার । জিজ্ঞেস করলাম,

-‘মামী , এই লোকটাকে খাইয়ে দাইয়ে বিদায় করো। আমার জাস্ট সহ্য হচ্ছেনা।’

মামী তাজ্জব হয়ে বললেন,

-‘ছিঃ ছিঃ আহি, বরকে কেউ এভাবে ডাকে? তাছাড়া বেচারা সেই সাতটা বাজে তোর জন্য ঢাকা থেকে এসে পড়েছে। আর তুই পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে উঠলি সাড়ে আটটা বাজে। তোর ঘুম থেকে উঠার জন্য কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলো তুই জানিস?’

আমি আনভীরের দিকে তাকাতেই উনি অগোচরে চোখ টিপ মারলেন আমায়।আমি সাথে সাথে খাওয়াতে মনোযোগ দিলাম। এক রাতের ব্যবধানে আমায় না পেয়ে উনি নিশ্চিত মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। এমন রসকষহীন মানুষটাকে এমন রূপে দেখবো তা আমি কল্পনায়ও আনতে পারিনি।খালামণি এবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-‘তুই এত মনমরা হয়ে আছিস কেনো রে আহি? বল আমাকে?’

-‘আমি যাবো না।’

-‘মানে?’

-‘আমি উনার সাথে যাবো না এখন ব্যস। এই এডমিশন এডমিশন টেস্ট করে এই লোক আমার মাথার খুলি উড়িয়ে ফেলেছে। এখন আমি তোমাদের সাথে টাইম স্পেন্ড করতে চাই। উনাকে ফিরে যেতে বলো। আমি আরও কিছুসময় এখানে থাকবো।’

আমি পুরোপুরি সত্যটা বললাম না কাউকে। কেননা আমার প্রথমে বড় মামুর সাথে কথা বলতে হবে।আমার কথা শুনে হেসে দিলেন সবাই। আনভীর এবার খাওয়া শেষ করে বললেন,

-‘এই মেয়েকে নিয়ে মহা জ্বালায় আছি খালামণি ! পরীক্ষার আগের দিন একটু মনোমানিল্য হয়েছিলো জাস্ট। এতই ক্ষেপে গিয়েছে যে না বলে এসে পড়ছে এখানে।আমার কি অবস্থা হয়েছিলো এই পিচ্চির ধারনা আছে? ওকে বলে দাও আমি ওকে ছাড়া যাচ্ছি না ব্যস !’

ছোট মামু সাবাসি দিয়ে বললেন ,

-‘এই নাহয় আমাদের জামাইবাবু , এভাবেই বউকে পটিয়ে যাও মশায়। একটাবার আমার বিয়েটা হোক , আমিও এভাবে বউরে মানাবো।’

-‘তোমার এই জন্মেও বিয়ে হবেনা চাচ্চু।’

নীলু মুখ চেপে কথাটি বলতেই হেসে দিলেন সবাই। আমি এবার আনভীরকে বললাম,

-‘আপনি কেনো থাকবেন এখানে? এটা আমার মামু বাড়ি। আপনার মামু বাড়িতে গিয়ে আপনি থাকেন।’

-‘আমি আগেই বলেছি যে আমি তোমায় নিয়েই ঢাকায় ব্যাক করবো। আফটার অল্ , শ্বশুড়বাড়ির আদর তো আর পেলাম না।এবার নাহয় মামশ্বশুড় বাড়ির আদরটা পেয়ে যাই?’

মামী খুশিতে গদগদ হয়ে বলে ওঠলেন,

-‘তোমার যতদিন ইচ্ছে ততদিন থাকো। আর আহি তো এমনিতেও ফুলের মতো মেয়ে। ওর রাগ ভাঙতে কষ্ট হবেনা তোমার। তবুও আহিকে আরও কিছুদিন এখানে থাকুক কেমন? বেচারি এমনিতেও এখানে বেশি আসতে পারেনা।’

আমি কথা না বাড়িয়ে খাওয়া ছেড়ে রুমে চলে গেলাম এবার। কেননা আনভীর থাকলে সর্বোচ্চ একদিন থাকবেন। তারপরদিনই এখান থেকে নিয়ে যাবেন আমায়।যা আমি মোটেও চাচ্ছিনা। আমার এমন কান্ড দেখে আমার পিছু পিছু খালামণি, মামী , নীলু এমনকি আনভীরও এসে পড়লেন। আমি দরজা লাগিয়ে গুমশুম হয়ে বসে রইলাম এখন। মামী জিজ্ঞেস করলেন,

-‘আহা আহি ! বরের সাথে এত রাগ করতে নেই গো মামণিটা। ‘

-‘তুমি উনাকে ফিরে যেতে বলো মামী। আমি বললাম না আরও কিছুদিন এখানে থাকবো। তাছাড়া উনারও তো ভার্সিটিতে ক্লাস আছে। তাহলে থাকবেন কিভাবে এখানে? উনারে তোমরা চিনো না। কাল হুট করে ধমকি-ধামকি দিয়ে নিয়ে যাবে আমায়।’

ছোট মামু বললেন,

-‘কার এত সাহস তোরে ধমক দিবে? কেউ কিচ্ছু বলবেনা তোকে। তোর যতদিন ইচ্ছে ততদিনই থাকিস।এখন দরজাটা খোল রে।’

পরে আমায় ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে যেমনভাবে বললেন আমি আশ্বস্ত হয়ে দরজাটা খুলাম। বস্তুত আনভীর চাচ্ছিলেন আজই আমায় নিয়ে যেতে। কিন্ত পরে বাধ্য হয়ে রাজি হলেন আমায় এখানে আরও কিছুদিন থাকার অনুমতি দেওয়ার জন্য। আমি যেহেতু এখানে থাকছি তাই উনিও বললেন যে একপাও আমায় ছাড়া উনি নড়বেন না। সবাই উনার এ সিদ্ধান্তে আনন্দে থাকলেও গোমরামুখ করে থাকলাম আমি। বাকিরা চলে যাওয়ার পর উনি বাকা হেসে আমার কানের কাছে ঝুঁকে এলেন। বললেন,

-‘ওসব এগ্রিমেন্টের কথা ভুলে যাও আহি। বিয়ে যেহেতু আমরা করেছি, তাই সেটা মেনে নিতে হবে আমাদের। আফটার অল এত সুইট , কিউট বউটাকে তো আর হাতছাড়া করা যায় না? আজরান ভাইয়া ঠিকই বলতো , এমন বউ রাগারাগি করার জিনিস না ; আদর করার জিনিস।এখন তুমি যেহেতু গতকাল আমায় পাগল করে দিয়েছো এখন তোমায় শাস্তি দেবো নাকি আদর করবো?’
.
.
.#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#বোনাস_পার্ট
-‘ওসব এগ্রিমেন্টের কথা ভুলে যাও আহি। বিয়ে যেহেতু আমরা করেছি, তাই সেটা মেনে নিতে হবে আমাদের। আফটার অল এত সুইট , কিউট বউটাকে তো আর হাতছাড়া করা যায় না? আজরান ভাইয়া ঠিকই বলতো , এমন বউ রাগারাগি করার জিনিস না ; আদর করার জিনিস।এখন তুমি যেহেতু গতকাল আমায় পাগল করে দিয়েছো এখন তোমায় শাস্তি দেবো নাকি আদর করবো?’

আমি তৎক্ষণাৎ উনার বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম উনাকে। আমার হৃদস্পন্দন ক্রমাগত যেন বেড়েই চলেছে। আমি এখনও বুঝতে পারছি না যে উনার এরকমটা করার কারন কি। উনি এবার বললেন,

-‘ভয় পাওয়ার দরকার নেই। জাস্ট মজা করছিলাম। বাই দ্য ওয়ে, আমি তখনও বলেছিলাম এখনও বলবো, সময় আছে। ঢাকায় ফিরে চলো আমার সাথে। আজ নাহয় কাল তোমায় আমার সাথে ফিরে যেতেই হবে।’

আমি উনার সাথে কথা না বাড়িয়ে এবার রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।কেননা আমি জানি আনভীর মুখে মুখেই মামীকে হ্যাঁ বলেছেন এখানে আজ রাত থাকবেন। তবুও আমি নিশ্চিত উনি নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করবেন আজকের মধ্যেই আমায় এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তবে আনভীর তো এর আগে আমায় স্পষ্টই বলে দিয়েছেন যে আমার সাথে উনার কোনো যোগসূত্র নেই। তাহলে এখন এগ্রিমেন্টের কথা ভুলে যেতে বলছেন কেনো? আমার কাছে উনার নতুন ব্যবহার কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। খুব শীঘ্রই এর কারন জানতে হবে আমায়।

__________________________

মোটামোটি অনেকক্ষণই উনাকে কড়াকড়ি ভাবে এড়িয়ে চলেছি আমি। একটাবারের জন্যও আনভীরের মুখোমুখি যাইনি। উনি আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছেন কিন্ত ছোট মামা যেভাবে উনার সাথে শলাপরামর্শ করে চলছেন উনি না পারছেন থাকতে না পারছেন সরে আসতে। ছোটমামা উনার সাথে কথার মাঝখানে বললো,

-‘বুঝলা আনভীর, দেশের জন্য বড় কিছু করার অনেক ইচ্ছা আছে আমার। আমার খুব খারাপ লাগে বেকার ছেলেদের চাকরির জন্য এভাবে হন্য হয়ে ঘুরে বেড়াতে। আমি ভাবছি এ এলাকার সব বেকার যুবকদের নিয়ে একটা সংঘ গড়ে তুলবো। ওরা যেন চাকরির আশায় বসে না থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার কথা পরিকল্পনা করতে পারে সে ব্যাপারে সবাইকে বুঝাবো।আইডিয়াটা কেমন?’

-‘আইডিয়াটা দারুন মামা , তবে আপনি একা সব করবেন কিভাবে?’

-আমি একা কেনো করবো, তুমি আছো না? তাই তো তোমার সাথে আইডিয়াটা শেয়ার করলাম।’

আনভীর কোনোমতে ঠোঁটচেপে হাসলেন। আমি বুঝেছি মহাশয় ভালোই ফ্যাসাদে পড়েছে। তবে আমি একদন্ডের জন্যও উনার মুখোমুখি হলাম না। ছোটমামা যেই , একদিনের মধ্যেই উনাকে বাসায় ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। বিষয়টা ভাবতেই আমার মনে পৈশাচিক আনন্দ ফুটে ওঠলো। আজ মামীর সাথে মটরশুটির ডাল রান্না করা শিখেছি আমি। যদিও ছোটবেলা থেকেই কাজের হাত আমার বড্ড পরিপক্ক , তবে রান্নার বিষয়টা এখনও ভালোমতো সামলে ওঠা হয়নি। আজ মামীর সাথে ইলিশ ভূনা, গরুর মাংস , চিংড়ীর মালাইকারী আরও হরেক রকম পদ রান্না করা হয়ে গিয়েছে। এগুলো পরিবেশনের সময়ই আনভীরের মুখোমুখি হতে হলো আমাকে। তবে আমি উনাকে খুব সুক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে চলেছি ।
.
.
এখন দুপুরের প্রহর কাটিয়ে দীপ্তমান বিকেল। মামুদের ছাদে ছোট মামা বাহারি পদের গাছ লাগিয়ে পুরো বাগান করে রেখেছেন। মামীর এ নিয়ে অনেক বিক্ষোভ যে এ গাছগুলোর জন্য সে ঠিকমতো কাপড় শুকাতে পারে না। কিন্ত ছোট মামা তো ছোট মামাই। উনার মাথায় একবার একটা ভূত ঢুকলে উনি তা করেই ছাড়েন। একবার পরিবেশ সংরক্ষণের এক সেমিনারে গিয়ে উনি পরিবেশে গ্রীণহাউস গ্যাসের প্রভাব কমাবেন বলে নিজের লক্ষ্যকে স্থির করেন। পরে বড় মামু থেকে সাড়ে সাতহাজার টাকা নেন শুধুমাত্র গাছ কিনে বপন করার জন্য। ছয় মাস হতে না হতেই উনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে এখন বেকার যুকদের নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করলেন। এসব কিছুই ছাদে বসে আমায় বলছেন ছোটমামা। আমি উদগ্রীব হয়েই উনার প্রতিটা কথা শুনছি। হঠাৎ মামী আমায় ডাকতেই পরে মামাকে একা রেখে অগত্যা রান্নাঘরে যেতে হলো আমায়। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

-‘আমায় ডেকেছিলে?’

মামী আমার হাতে চায়ের ট্রে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-‘তোর বড় মামুর রুমে নিয়ে যা। আনভীর আর তোর মামু কথা বলছেন ওখানে।’

আমি মাথা নাড়িয়ে ট্রে টি নিজেরহাতে নিয়ে চলে গেলাম বড় মামুর ঘরের উদ্দেশ্যে। দরজার ঠিক কাছাকাছি যাওয়ার পর আমি উনাদের কিছু কথা শুনেই পা থামিয়ে দেই। মামু এবার আনভীরকে বললেন,

-‘তোমার আর আহির মধ্যকারসম্পর্কটি আমি একটু হলেও আন্দাজ করতে পারি আনভীর। যতই হোক , একটা বাজে পরিস্থিতির সাপেক্ষেই তোমাদের বিয়ে হয়েছে।’

আনভীর নিশ্চুপ।মামু এবার বললেন,

-‘একটা কথা বলি আনভীর। আহি বাচ্চা একটি মেয়ে। উনিশে পা দিয়েছে বেশিদিন কিন্ত হয় নাই। তবুও এই জীবনে ওর মা মারা যাওয়ার পর অনেক অমানুষিক যন্ত্রণার স্বীকার হয়েছে ও। আমি অনেকবার আহিকে দত্তকে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। গ্রামের পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে কোট কাচারি সবকিছু আমি বিচরণ করেছি। কিন্ত আহির যেহেতু বাবা আছে এবং সে সাবলম্বী আহিকে লালন পালনের জন্য তাই ওকে দত্তক নেয়াটা সম্ভব হয়নি আমার। এসবের জন্য আহির বাবা আমাদের সাথে একেবারেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ,,,,,,(কিছুটা দম ফেলে),,,,,আহি অন্য চারপাঁচটা মেয়ের মতো এতটা স্ট্রং না আনভীর। মা’হীনা মেয়ে যার কাছে বাবার ছায়াও ছিলো না তাই নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রাখতো। আমি চাই না যে বিয়ের পরেও ও এসব কষ্টে ভুগুক।’

-‘আপনি ভুল ভাবছেন মামা। আমিও চাই যে আহি নিজেকে সাবলম্বী করুক। এন্ড আমি জানি যে ও খুব আবেগী ধনের মেয়ে। তাই ওর সাথে এমন কোনো আচরণ করতে আমি চাই নি যাতে ও পড়ালেখা ছেড়ে ক্ষণিকের আবেগে হারিয়ে যাক। ওর প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছি আমি মামা। ওর পড়ালেখা থেকে শুরু করে সব কিছুর প্রতি আমার নজরছিলো। তবে একজন হাসবেন্ট হিসেবে যেটা আমি করিনি তা হলো নিজেকে ওর কাছে প্রিয়জন করে তোলা। কেন করিনি জানেন? যাতে ও পড়ালেখা বাদ দিয়ে শুধু আমায় নিয়ে যেন চিন্তা না করে। ভালোবাসার মতো ক্ষণিকের ভালোলাগা যেন ওর পড়ালিখার ক্ষতি না করে। আমি ওর সাথে স্ট্রিক্ট হয়েছি শুধুমাত্র ওকে বুঝানোর জন্য যে আহিকে নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এভাবে নিজেকে গুটিয়ে ফেললে চলবে না। এককথায় ওর মনের দুর্বলতা কাটানোর জন্য যা করার দরকার সেই সবটুকু রেসপন্সিবিলিটি আমি পালন করেছি।’

-‘বিয়ের সম্পর্ক দায়বদ্ধতার মধ্যে থাকে না আনভীর। আমি সরাসরি তোমায় তাই প্রশ্ন করবো।,,,,,,,,তুমি কি আহিকে ভালোবাসো?’

আনভীর থমকে গেলেন। সেই সাথে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আমিও। মামুর মতো আমিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি উনার উত্তরটি শোনার উদ্দেশ্যে। আনভীর এবার তপ্তশ্বাস ছেড়ে বললেন,

-‘আহিকে আমি ভালোবাসি কি-না তা আমি জানিনা মামা ,তবে আহিকে আমার প্রয়োজন।’

আমার আর কিছু শোনার বাকি থাকলো না আর। যা উত্তর জানার তা পেয়েই গিয়েছি। উনি উনার প্রয়োজনীয়তার তাগিদে আমায় নিতে এসেছেন শুনতেই চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমি কোনোমতে নিজেকে সামলে নীলুর কাছে গিয়ে বললাম ট্রে টা দিয়ে আসতে। তারপর আমি নিজেকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখলাম। দোষ আমারই। উনার ব্যবহারে আমি বেশি আশা করে ফেলেছি। আমি শুধুমাত্র উনার প্রয়োজনীয়তা, আর কিছুনা !!!

____________________

রাত ১ টা বাজে প্রায়। বিছানায় নির্ঘুমে রাত কাটছে আমার। ঘরে আমি একা। আনভীর নেই। উনি চলে গিয়েছেন আমায় একা রেখে। বলতে গেলে উনাকে চলে যেতে আমি বাধ্য করেছি। সন্ধ্যার সময় আনভীরের সাথে ভয়াবহ মনোমানিল্য হয় আমার। উনি জেনে গিয়েছেন যে আমাদের চুক্তির ব্যাপারটা মাকে বলেছি আমি। উনি এই নিয়ে অজান্তেই আমার সাথে একটু রাগারাগি করে ফেলেন। আমি শান্ত হয়েই উনার সব কথা শুনছিলাম। তবে উনি যখন পুনরায় আমায় ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য জোড় করলেন নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারিনি আমি। প্রখর গলায় জিঙ্গেস করলাম,

-‘কেনো যাবো আমি আপনার সাথে? আমি আপনার প্রয়োজনীয়তা বলে?’

-‘কথা অন্যদিকে ঘুরিও না আহি। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। মা যদি বুঝেন যে তুমি আর আসবে না তাহলে বাবাকে সব সত্য বলে দিবে। যা আমি চাচ্ছি না।’

-‘কিন্ত আমি চাই না আপনার সাথে ফেরত যতে। আমার আপনার দায়বদ্ধতা বা প‍্রয়োজনীয়তা কোনোটাই হওয়ার ইচ্ছে নেই। বাই দ্য ওয়ে মিঃ আনভীর? আমি আপনার কেমন প্রয়োজনীয়তা ? মানসিক নাকি শারীরিক? তো সেটা তো চাইলে আপনি আগেই ভোগ করতে পারতেন আমার ওপর জোর খাটিয়ে। এখন এমন করছেন কেনো?’

আনভীরের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠলো আমার কথায়। খুব কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছেন। কিন্ত আমি নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছি। উনার তখনকার কথায় আমার মাথায় শুধু শারীরিক প্রয়োজনীয়তাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। উনি এবার তৎক্ষণাৎ একটা সিদ্ধান্তনিয়ে ফেললেন। বলে ওঠলেন,

-‘আমাদের বিয়ের দিন মানুষদের নোংরা কথা আমায় যতটা না হার্ট করেছিলো তার থেকেও বেশি হার্ট করলো আমায় তোমার কথাটি। তুমি এখানেই থাকো আহি। যতদিন খুশি থাকো। আমি আর জোর করবো না এটলিস্ট শারীরিক প্রয়োজনীয়তা কথাটি শোনার পর। আমি চলে যাচ্ছি।’

আনভীর একমুহুর্তের জন্যও থাকলেন না এখানে। সবাই বারবার জিঙ্গেস করছিলো যে উনি হঠাৎ কেনো ফিরে যাচ্ছেন তবুও আমরা দুজনের কেউই কিছু বললাম না। আনভীরের এমন শীতল প্রতিক্রিয়া আমায় ভাবিয়ে তুললেও আমি নিজেকে শক্ত করে রাখলাম। উনার জন্য মনের কোঠায় শূণ্যতা সৃষ্টি হলেও সারাত নির্ঘুমে কাটিয়ে দিলাম। সেই ঘটনার আজ চারদিন হতে চললেও আনভীর একটাবারের জন্যও কল করেনি আমায়। আমি অধীর আগ্রহী হয়ে বসে ছিলাম উনার ফোনের জন্য । জানিনা কেন। তবে উনার গম্ভীর কন্ঠ শোনার জন্য আমার কান যেন তৃষ্ণার্ত হয়ে গিয়েছিলো। আচ্ছা উনি কি একটাবারের জন্যও মনে করলেননা যে উনার ব্যবহারে আমি ঠিক কেমন কষ্টটা পেয়েছিলাম? শুধু নিজের রাগ আর ইগোর কথা ভেবে এভাবে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করাতে অভিমানটা আমার আরও চাড়া দিয়ে উঠলো।মনে হতে থাকলো সবকিছু কেমন যেন বিষাক্ত।

________________________________

সকালে আমার ঘুমটা ভেঙেছিলো নীলুর ধাক্কাধাক্কিতে। বিগত কিছুদিন ধরে নির্ঘুমে রাত কাটানোর জন্য প্রায়ই সকালে উঠতে দেরি হয়ে যায়। তাই এসময়ে নীলুর কন্ঠে আমি বেশ বিরক্ত হলাম । ঘুমুঘুমু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

-‘কি হয়েছে?’

-তুমি জলদি উঠো।

নীলুর দ্বিধাগ্রস্থ কন্ঠ। এমন কন্ঠ পেয়ে তৎক্ষণাৎ উঠে বসি আমি। নীলুকে চিন্তিত লাগছে। চোখমুখ ফ্যাকাসে। কমাগত শুকনো ঢোক গিলছে। আমি তাই ওর গালে হাত স্পর্শ করে জিঙ্গেস করলাম,

-‘তোকে এমন দেখাচ্ছে কেনো? কি হয়েছে?’

নীলু ভয়ার্ত গলায় বললো,

-অ অপূর্ব ভাইয়া এসেছে আপু!

আমার চোখের ঘুম উড়ে গিয়ে নিমিষেই স্থান করলো ত্রাসের রাজত্ব। অপূর্ব ভাইয়া এসেছেন — কথাটি কানে আমার নুপুরের ন্যায় বাজছে। আমি শুকনো ঢোক গিললাম ক্রমাগত। কিন্ত হঠাৎ এভাবে এখানে আসলেন কেনো ভাইয়া?
.
.
~চলবে…….ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here