এক শ্রাবণ হাওয়ায় পর্ব ৩০+৩১

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়
#লেখিকা- কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৩০+৩১
সকালে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম কারও উষ্ণ বাহুবন্ধনে।আনভীর আমায় নিজের বুকে আগলে রেখে নিশ্চিতে ঘুমিয়ে আছেন ৷ এতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি আমি। কেননা আনভীরের এতটা কাছাকাছি থাকার অভিজ্ঞতা টি আমার নেই বললেই চলে। আমি উনার হাতের মাঝ থেকে আস্তে করে নিজের হাত সরিয়ে নিলাম। উঠে বসার চেষ্টা করতেই দেখি আনভীর আমার কোমড় জড়িয়ে আছেন শক্তভাবে৷ যেন আমি ছোট একটি বাচ্চা আর উনি ছেড়ে দিলেই যেন ছুটে পালিয়ে যাবো। আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেলো রাতের ঘটনাগুলো। উনার হঠাৎ এখানে আসাটা আমার কাছে বিষ্ময়কর লাগছে৷ চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে উনার পাগলাটে অস্থির মুখটা। আনভীরের পড়নে হালকা নীল রঙের শার্ট আর সাদা প্যান্ট। এসে জামাকাপড়ও বদলাননি উনি। চশমাহীন চোখজোড়া কেমন যেন নিষ্পাপ লাগছে যা দেখলেই যে কারওই উনার প্রতি জমে থাকা অভিমানসূহ পানির ন্যয় গলে পড়বে। আমি নিজের কোমড় থেকে উনার হাত সরিয়ে উঠে বসলাম। গতকাল ছাদে আমি কেনো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম তা আমার নিজেরও জানা নেই। তবে আমার শরীর প্রচন্ড দুর্বল লাগছে৷ মাথার ভেতর চিনচিন ব্যাথার উপদ্রব। আমি পায়ের দিকে তাকিয়ে দখলাম পায়ে ইতিমধ্যে ব্যান্ডেজ করা হয়ে গিয়েছে আমার।

আমার নড়াচড়ার উপস্থিতি অনুভব করে আনভীর তৎক্ষনাৎ উঠে বসলেন। চোখের ঘুমুঘুমু ভাবটা কাটিয়ে বলে ওঠলেন,

-‘আর ইউ ওকে? শরীরটা কি এখনও খারাপ লাগছে?’

-‘না।’

মৌনজবাব দিলাম আমি। আমার এত ঠান্ডা প্রতিক্রিয়া দেখে আনভীর ঠিক কি ভাবছেন তা আমার অজানা৷ কেননা উনি শান্ত চাহিনী নিক্ষেপ করে রয়েছেন আমার দিকে।বেশ কিছুক্ষণ পর উনি বললেন,

-‘খাট থেকে উঠতে হবে না। তোমার যা লাগবে বলো, আমি নিয়ে আসছি। এমনিতেও পায়ের অবস্থা খারাপ। ক্ষততে ইনফেকশন হয়ে গিয়েছে।’

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি আমার তুলোর মতো শরীর কোলে তুলে খাটে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলেন। আমি এবারও নির্বিকার। আসলে অপূর্ব ভাইয়ার সেই কথাগুলো রীতিমতো নাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে।

দরজায় শব্দ হতেই আনভীর গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। মামী এসেছেন। আনভীরকে এবার জিজ্ঞেস করলেন,

-‘ওর শরীর কেমন এখন? রাতে কোনো সমস্যা হয়নিতো?’

-‘মাঝরাতে জ্বর এসেছিলো একটু। এর বেশি আর কোনো সমস্যা হয়নি।’

মামী এবার বললেন,

‘আহারে, তোমায় আমি বারবার বলেছিলাম যে আমিও থাকি আহির সাথে। তুমি তো শুনলেই না আমার কথা। বললে আহিকে তুমিই যত্ন নিতে পারবে। এখন দেখো কি অবস্থা তোমার। একরাত ভালোমতো না ঘুমিয়েই কেমন শুকিয়ে গিয়েছো। এই নাও, তোমার জন্য শার্ট আর প্যান্ট নিয়ে এসেছি৷ একটা ঠান্ডা গোসল সেরে নাও৷ শরীর ভালো লাগবে।’

আনভীর জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যাওয়ার পরে মামী খাটে এসে বসলো আমার পাশে। আমার গালে হাত স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করল,

‘এখন শরীর কেমন তোর?’

‘ভালো।’

‘আচ্ছা কাল তোর কি হয়েছিলো যে এভাবে ছাদে ছন্নছাড়া হয়ে ভিজছিলি? তোকে অজ্ঞান হতে দেখে রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমরা। ‘

আমি এ কথার কোনো উত্তর দিলাম না।মামিকে এবার জিজ্ঞেস করলাম,

‘আনভীর,,,,,,,, হঠাৎ এখানে আসলেন যে?’

‘তোর এই অবস্থা দেখে আমরা ভেবেছিলাম যে ব্যাপারটা আনভীরকে জানানো উচিত। তাই ওকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেই তোর এ অবস্থাটা। তোর মামাও তখন ডাক্তার ডেকে আনলো। তোর জ্ঞান ফিরছিলোনা এ বিষয়টা আতঙ্ক করে দিয়েছিলো আমাদের। পরে ডাক্তার বললেন, স্ট্রেসের কারনে নাকি তোর এমন হয়েছে। রাতের মধ্যেই আনভীর এসে পড়লো। তোর অবস্থার কথা শুনার পর ও তখনই রওনা দিয়েছে ঢাকা থেকে। তারপর পুরোটা রাতই ও তোর সাথে ছিলো। একবিন্দুর জন্যও এদিক সেদিক নড়েনি।’

আমি মামীর প্রতিটা কথাই শুনেছি মনোযোগ দিয়ে। অদ্ভুত কারনে উনার এসব বিষয় মোটেও আমায় ভাবিয়ে তুললো না৷ জানিনা কেনো,তবে আমার মধ্যে অনুভূতি জিনিস টা কেমন যেন বিলুপ্ত প্রায় হয়ে গিয়েছে। আনভীর গোসল সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন৷ শীতল কন্ঠে বললেন,

-‘রেডি হয়ে নাও। ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি আমরা।’

-‘কেনো, এখানে থাকলে কি হবে?’

-‘বোকার মতো কথা বলোনা, তুমি ভাবলে কি করে তোমার এ অবস্থায় তোমাকে আমি একা রেখে ফিরবো?’

আমি আরও কিছু বলতে গেলেই উনি ধমকের সুরে বললেন,

-‘নো মোর ওয়ার্ডস।তুমি আমার সাথে যাচ্ছো দ্যাটস ফাইনাল। না যেতে চাইলে কোলে তুলে নিয়ে যাবো।আমিও দেখবো কিভাবে আমায় থামাবে তুমি। ‘

আমি বিরক্তি প্রকাশ করে কোনমতে উঠে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে পা বাড়ালাম এবার। মামীও মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

____________________________________

গাড়ি এখন গাজীপুর থেকে ঢাকার পথে যাচ্ছে। আশপাশ দিয়ে সা সা করে ছুটে চলছে গাড়ি। আমি এক পলক আনভীরের এর দিকে তাকালাম। উনি ড্রাইভ করছে নির্বিকারে। ভাব করছেন এমন যে আমাদের মধ্যে সবকিছুই স্বাভাবিক। বিষয় টা ক্ষোভ জাগিয়ে তুললো আমার মনে। তাই সিটে দুর্বল ভাবে শরীর এলিয়ে দিলাম। আনভীর এবার শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

-‘গতকাল কি হয়েছিলো তোমার?’

-‘দ্যাটস নট ইউর ম্যাটার।’

আমি গম্ভীর কন্ঠে বললাম প্রতিউত্তরে। আনভীর একটা স্মিত হাসি দিয়ে আবার গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিলেন৷ পুরোটা পথে আর কথা হলোনা আমাদের।বাসায় পৌঁছেই ভাবি, নুড়ী আপা, মা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমায় নিয়ে। আমি আসলে মায়ের সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলাম কিন্ত সেটা পারলাম না আনভীরের জন্য। উনার এ ব্যবহারে আমি তাজ্জব না হয়ে পারছিনা৷ যে মানুষটা রাগ করে দু’দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখলো আমার সাথে আজ আমার জন্য এত চিন্তা?সবাই রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আনভীর বললেন,

-আগামীকাল আমরা হসপিটালে যাবো তোমার চেকআপ করাতে?

-কিসের চেক আপ?

আমি জিজ্ঞেস করলাম। আনভীর বললেন,

-‘পায়ের ইনফেকশনের জন্য যেতে হবে। সময়মতো ট্রিটমেন্ট না করলে পরে সমস্যা হবে তোমার। আর তুমি কি এতটাই বেখেয়ালি? পায়ের ক্ষতটাতো ভালোমতই শুকিয়ে যাচ্ছিলো তাহলে আঘাত করলে কেনো ওখানে? এমন কি হয়েছিলো?’

আমি তপ্তশ্বাস ছাড়লাম।আনভীর আমায় চুপ থাকতে দেখে কিছুটা রেগে গেলেও তা প্রকাশ করলেননা। হয়তো তিনি চাননা আমাদের মাঝে আর কোনো ভুল বোঝবুঝি হোক। আনভীর বললেন,

-‘এখন রেস্ট নাও। এই দুর্বল শরীর নিয়ে এত কথা বলতে হবে না।’

আমি উনার কথায় হ্যা-না কিছুই বলিনি। চুপচাপ জামাকাপড় পাল্টে খাটে শুয়ে পড়লাম।লং জার্নি করার কারনে শরীরটা অবসন্ন প্রায়। তারওপর কিছুক্ষণ আগে কড়া ডোজের ওষুধ খাওয়াতে খাটের সংস্পর্শে আসা মাত্রই সাথে সাথে চোখে ঘুম জড়িয়ে পড়লো।

________________________________

মাথায় বিশাল টেনশন নিয়ে আমি পায়চারী করে চলছি রুমে। আনভীর বাহিরে গিয়েছেন কখন এখনও আসেননি। আজ মেডিক্যাল এক্সামের রেজাল্ট দেওয়ার কথা ছিলো যা এই দুই তিনদিনের ব্যবধানে একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম।আমিই বোধহয় প্রথম এমন ছাত্রী যে কিনা এসব নিয়ে টেনশন না করে ব্যাক্তিগত আর পারিবারিক ঝামেলা সামলিয়ে উঠতে ব্যস্ত। শিউলি ভাবি আমার পাশে বসে আমায় সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন কিন্ত আমি ওপর দিয়ে শান্ত থাকলেও মনের ভেত শুরু হয়েছে তুমুল তোলপাড়। কে জানে আল্লাহ ভাগ্য কি রেখেছে আমার , এসব নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দে আছি।

আনভীর তখনই রুমে প্রবেশ করলেন। ভাবি দেখে বললেন,

-‘এসেছো তাহলে। তোমার বউসাহেবা তো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো রেজাল্টের জন্য।’

আনভীর তৎক্ষণাৎ খাটে ল্যাপটপ নিয়ে বসলেন। আমার বুক ধুকপুক করছে রীতিমতো। ভয় হচ্ছে রেজাল্ট কি হবে আমার। ধ্রুব ভাইয়া বললো যে এবার নাকি আমাদের কোচিং সেন্টার থেকে অনেকেই মেডিক্যালে চান্স পেয়েছে যার মধ্যে ৫ জনই ডিএমসিতে। আমি আনমনে ঠোঁট কামড়াতে গেলেই আনভীর ল্যাপটপের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-খবরদার ঠোঁট কামড়াবে না।

আমি সাথে সাথে স্বাভাবিক হলাম। ভাবি পাশে বসে আমার হাত জড়িয়ে উৎসুক হয়ে বসে আছে। ওয়েবসাইটে ঢুকে কিছু দেখামাত্রই আনভীর তপ্তশ্বাস ফেললেন। আমি মিহি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

-‘ক-ক কি হলো রেজাল্ট আমার?’

আনভীর নিশ্চুপ। চুলগুলো একহাত দিয়ে পেছনে ঠেলে শীতল চোখে তাকালেন আমার দিকে।আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,

-কি হলো , কিছু বলছেন না যে?’

-তোমার মেডিক্যালে চান্স হয়নি আহি।

আমি স্তব্ধ হয়ে এলাম এবার। চোখের পলক পড়ছেনা। এমনকি কথা বলতেও ভুলে গিয়েছি। আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে আমি মেডিক্যালে চান্স পাইনি যেখানে আমার প্রিপারেশন অনেক ভালো ছিলো।হঠাৎ নিজেকে ছন্নছাড়া মনে হতে থাকলো আমার। চোখজোড়া আদ্র অনুভব করছি হয়তো যেকোনো সময় টুপ করে জল গড়িয়ে পড়বে চোখ বেয়ে।
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

এখন থেকে এই সময়তেই গল্প দিবো। ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here