এখানে আকাশটা ভালোবাসার পর্ব ১৭

#এখানে_আকাশটা_ভালবাসার
#লেখিকাঃ নয়নতারা নাতাশা
#পর্বঃ ১৭
.
“সানজানা দরজা খোল, সানজানা”
বারবার নক করতে থাকে রাহাত।
তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে সানজানা।
“কি হয়েছে ভাইয়া?”
“ইতু….”
“কি ইতু?”
“ইতু… আমি ইতু ছাড়া থাকতে পারব না”
“কেন.. ইতু কি বলেছে?”
“ও আমাকে চায় না, সানজানা বাবু শোন, আমি ভুল করেছি তার জন্য অনুতপ্ত আমি, কিন্তু আমি ওকে হারাতে পারব না, প্লিজ, আমি ওকে ভালবেসে ফেলেছি।”
ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ভালবাসার গভীরতা বুঝতে পারে সানজানা। ইতুকে সে সত্যিই ভালবাসে।
“কিন্তু ভাইয়া, ইতুকে কি বলব আমি? একসময় তুমিও তো ওকে এই কষ্টটাই দিয়েছিলে…!”
“সানজানা আমি ভুল করেছি, আমি ভুল করেছি, ইতু ইতু আমি ভুল করেছি”
বারবার বলতে থাকে রাহাত। বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে হিসেবে রাহাতের জীবনে এমন কিছু নেই যা সে চেয়েছে অথচ পাইনি।
কিন্তু ভালবাসা পাওয়ার জন্য তো ভালবাসাকে আঁকড়ে ধরতে হয়, ভালবাসা তো ‘প্রয়োজনের প্রিয়জন’ নয়! ভালবাসা হচ্ছে ‘প্রিয়জনের প্রয়োজন’।
“ভাইয়া আমি দেখছি, তুমি ঘুমাবে চল”
“না আমি ঘুমাবো না, আমার ইতুকে চাই, উঠিয়ে নিয়ে আসব ওকে” উদ্ভ্রান্তের মতো জবাব দেয় রাহাত।
“জেদ করে ভালবাসা পাওয়া যায় না। জেদ করে ইতুকে পেতে পারো ইতুর ভালবাসা নয়! ঘুমাবে এখন তুমি”
“তাইতো… তাইতো…. আমি কি করব!!!”
“ঘুমাবে”
জোর করে ভাইয়ার হাত ধরে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেয় সানজানা। ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে গায়ে কাঁথা টেনে দিল সানজানা। তারপর ভাইয়ের টেবিলে গিয়ে ভাইয়ের মোবাইল টা নিয়ে যায় নিজের রুমে। দুইদিন না ঘুমানো রাহাত বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে পড়ে।
রুমে এসে মেসেজ চেক করে সানজানা
“আপু সব আপনার কথা মতোই হচ্ছে”
রকিং চেয়ারে বসে মেসেজটা পড়ে মোবাইল সরিয়ে চোখ বন্ধ করে সানজানা।
.
নিশিকা আর জয় আজ চলে যাবে অস্ট্রেলিয়াতে।
সবাই এসেছে সি অফ করতে। নিশিকা প্রচুর কাঁদছে। বিয়েতেও এত কাঁদেনি নিশিকা।
নওশি নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছে। এতদিন তো ইচ্ছে হলেই দেখতে পেত, আর এখন…!
সবার চোখে পানি।
সবার কাছে বিদায় নিয়ে নিশিকাকে নিয়ে এয়ারপোর্টের ফর্মালিটিজ শেষে প্লেনে উঠে জয়।
খুব কাঁদছে নিশিকা।
জয় বুঝতে পারছে আজ স্বান্তনা দিলে আরো কান্না বাড়বে, তাই কিছু বলতে গিয়েও বলল না।
কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে মাথায় হাত রাখে,
“আর কাঁদে না নিশিকা, এবার অসুস্থ হয়ে পড়বে”
জয়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে নিশিকা।
নওশির আর মন খারাপ হয়ে আছে সাথে মেজাজও। কেন তা সে নিজেও জানে না। বিরক্ত লাগছে তার।
রোশনি ঘুমাচ্ছে, তাই নওশি কি করবে বুঝতে না পেরে রিদিমার কাছে গিয়ে বসল।
কেন যেন রিদিমা একদমই সহ্য করতে পারে না রায়ান আর নওশিকে। আর কারোর উপর ওর এত রাগ হয় না।
নওশি কিছুটা বুঝলেও নিজের ভুল ধারণা ভেবে নেয়।
“ভাবি কি করছ?”
“এইতো নওশি, আমি ব্যবসা স্টার্ট করছি নতুন একটা, তারই কিছু পেপারস দেখছিলাম”
“ওয়াও গুড নিউজ, আমাদের বিজনেস আরো বাড়ছে! ট্রিট পাওনা রইল”
“না নওশি, তোমাদের না নওশি, এটা আমি নিজে স্টার্ট করছি” রাগ রাগ স্বরে বলে রিদিমা।
“মানে?” বিস্ময়ে যেন আকাশ থেকে পড়ে নওশি।
“ধূর পাগলি, এমনি বললাম, হুম আমাদের বিজনেস” তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেয় রিদিমা।
“ওকে ভাবি কাজ করো”
“হুম”
“ভাইয়া তোকে একটা কথা বলব? তুই কাউকে বলবি না প্লিজ?”
রায়ানের কাছে এসে বলে নওশি।
“কি রে বাবু কোনো ছেলেকে ভালো লেগেছে?”
“মজা করিস না, শোন ভাবির কথা বার্তা না আমি তেমন বুঝতে পারিনা।”
“কি হয়েছে?”
রিদিমার আর তার কথোপকথন খুলে বলে নওশি।
.
কয়েকদিন কেটে গেলেও ইতু কোনো সাড়া দেয়নি। রাহাত ভালভাবেই বুঝেছে ইতু তার জীবনে আসলে কি ছিল! রাহাত কাঁদছে আজ। ভাইয়ের কান্না দেখে সানজানা আর স্থির রাখতে পারেনি নিজেকে।
আস্তে আস্তে ভাইয়ের পাশে গিয়ে বলে,
“ইতু কে সত্যি ভালবাসো তুমি? কষ্ট দেবে না তো ভাইয়া?”
“না সানজানা, জানিস ও আমাকে কষ্ট দিচ্ছে আমার তাতে একটুও রাগ হচ্ছে না, মনে হচ্ছে এর চেয়ে বেশি কষ্ট আমি ওকে দিয়েছি। কিন্তু আমার সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে এখন”
সানজানা বুঝেছে সে যেটা চেয়েছে সেটা হয়েছে। তাই আর না লুকিয়ে বলে দেয় সে,
“হুম, ভাইয়া… ইতুর কোনো দোষ নেই।
ও যা করেছে আমার কথাতেই করেছে। আমিই বলেছিলাম তোমাকে রিজেক্ট করতে”
“মানে?”
“মানে আমি বুঝতে পেরেছিলাম তুমি নিজের ভুল বুঝেছ। কিন্তু ইতুকে ভালবাস কিনা সেটা তুমি বোঝনি ভাইয়া। তাই তোমাকে এই কষ্টটা দিলাম আমায় ক্ষমা করো ভাইয়া। আমি চেয়েছিলাম তুমি ইতুর কষ্টটা বুঝে ওকে কখনো কষ্ট না দাও”
রাহাত অবাক হয়ে শুনছে সানজানার কথা। আজ আর তার রাগ হচ্ছে না। আজ এই ছোট বোনটার জন্যই সে নিজের সত্ত্বাকে চিনতে পেরেছে, নিজেকে বুঝতে পেরেছে।
সানজানার হাত ধরে পাশে বসিয়ে বলে,
“তোর কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ সানজানা, তুই আমাকে নিজেকে চিনতে শিখিয়েছিস। কি চাস তুই আমার কাছে?”
“মিষ্টি ভাবিটাকে এনে দাও” মুচকি হেসে সানজানা বলে।
“তাই না?”
“হুম”
“আচ্ছা বুড়ি তুই এত কথা কোথা থেকে শিখলি, এত বাস্তব জ্ঞান তোর মাঝে কিভাবে এলো? চোখের সামনে তুই এত বড় হয়েছিস আমি বুঝতেই পারিনি!”
ভাইয়ের প্রশ্নে লজ্জা পায় সানজানা, মনে মনে উত্তর দেয় ‘রায়ানের কাছে’
মুখে বলে, “আমি যাই ভাইয়া”
বলেই নিজের রুমে চলে যায় সানজানা।
সানজানা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই রাহাত ফোনে কল আসে। রাহাত তাকিয়ে আছে ফোনের স্ক্রিনের দিকে, সেই বহু প্রতীক্ষিত নাম “ইতু”
.
“ভীষণ ভালবাসি তোমাকে সায়ান” সায়ানের বুকে মাথা রেখে বলল রিদিমা।
“আমিও তোমাকে খুব ভালবাসি রিদিমা”
“সায়ান আমি একটা কথা বলি?”
“বলো…”
“আমি না একটা বিজনেস স্টার্ট করতে চাচ্ছি, তুমি প্লিজ না করো না”
“হুম আমাদের বিজনেস বাড়াবে এত ভালো কথা”
“আসলে তোমাদের বিজনেস এর পাশাপাশি আমি আলাদা একটা বিজনেস করতে চাচ্ছি, প্লিজ না করো না”
“কিন্তু রিদিমা… তুমি আলাদা কেন করবে?”
“দেখ সায়ান, আমি যদি সাবলম্বী হতে চাই তাতে কি সমস্যা? প্লিজ আমি তো আছি! না করো না”
রিদিমার এই চাহনি এড়াবার ক্ষমতা সায়ানের নেই। রাজি হলো সে,
তবুও ওর মনে কেমন যেন লাগছে। সেটা রিদিমার কাছে প্রশ্ন করতে পারছে না।
প্রথম থেকেই সব ভালবাসার মাঝেও রিদিমা নিজের চারিদিকে কেমন যেন একটা দেয়াল দিয়ে আড়াল করে রেখেছে। যে ওপাশে রিদিমার আরেকটা জগত।
সায়ান সেই জগতে ঢুকতে পারেনি। কেন পারেনি এই প্রশ্নের উত্তর সায়ান জানেনা।
“বেশ তাই হবে। বাবা কে বলে দেখি”
“প্লিজ একটু রাজি করাও”
“ওকে ওকে ওকে মাই সুইট বেটার হাফ!”
ভীষণ খুশি হয় রিদিমা।
কিছু মানুষ আছে যারা নিজের চাহিদা ইচ্ছে গুলো এত সুন্দর করে পূরন করে নেয় যেটাতে তাকে স্বার্থপর বলা যায় না, কিন্তু নিঃস্বার্থও ভাবা যায় না। রিদিমা হয়তো তাদেরই একজন।
রিদিমার নতুন বিজনেস স্টার্ট হয়ে যায়। সবাই প্রথমে একটু অবাক হয়ে যায়, কিন্তু তাদের ম্যানেজ করার সামর্থ্য রিদিমা রাখে।
সায়ান আর রিদিমার কি হবে কেউ জানেনা। কিন্তু সবারই মনে কোথায় যেন একটু কিন্তু ভাব থেকে যায়। কেউ কিছুই বলে না, কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে দোষ দেওয়া যায় না আবার পুরোপুরি মেনে নেওয়া যায় না।
নিজের মা থেকেও সেই মা ছাড়া বাবার কাছে অনিক কেমন আছে আমরা কেউ জানিনা। অনিকের খবর নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা রিদিমা করেনি। অনিকের কথা সবার জানতে ইচ্ছে হয় কিন্তু রিদিমার জানতে ইচ্ছে করে কিনা সেটা রিদিমা ছাড়া কেউ জানেনা।
আপাতত আমরা এটাই জানি যে রিদিমা খুশি কারণ তার স্বপ্ন পূরনে একধাপ এগিয়ে আছে সে।
সাহরাফ সাহেবের নামকরা কোম্পানীর সবসময়ই পাশাপাশি থাকায়, সায়ানের রেকমেন্ড আর হেল্প এর জন্য অল্প কয়েকদিনেই রিদিমার বিজনেসে সাকক্সেসফুল হতে থাকে।
.
“কি মিস সানজানা সানহা, আমার জন্য কি আপনার সময় নেই?”
“আপনার জন্য সানজানা সানহার সময় ফুরাবে না”
“তাই বুঝি?”
“তবে যে আমি তৃষ্ণার্ত কাকের মতো চেয়ে আছি”
“তুই পারিস ও রায়ান”
“আপনি বুঝি কম পারেন সানজানা সানহা, তবে কি আমি শিখিয়ে দেব?”
“রায়ান! ফের ফর্মালিটি দেখাবি তাহলে খবর আছে!”
“আমি ভয় পেয়েছি”
“আমি আছি তো”
“সব পেয়েছি”
হাসতে থাকে সানজানা। রায়ান তার এক অন্য পৃথিবী।
যে পৃথিবীতে কান্নার মুখ লুকানোর জায়গা আছে, আবার হাসির রাজ্যে হারিয়ে যেতে মানা নেই।
“সানজু, আমি কি সেই ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ড গুলো শুনতে পারি?”
“খুব ভালবাসি তোকে রায়ান”
“তোকে আমিও ভালবাসি সানজু”
চোখে পানি এসে যায় রায়ানের। তাদের এই ভালবাসাকে কোনো ভুল পথে নিয়ে যেতে চায় না রায়ান।
যথেষ্ঠ সম্মান করে সে সানজানাকে। তার ভালবাসার মানুষ! তার প্রিয়জন, প্রিয়তমা।
ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর আত্মবিশ্বাস যেখানে মিশে এক পরিপূর্ণতার সৃষ্টি করেছে সেখানে আর কি লাগে।
.
(চলবে)
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here