গল্প : কবি বর | পর্ব : পাঁচ
বাসায় ফিরে আস্তে করে দরজা ভিড়িয়ে বিছানায় বসে পড়ল আদ্রিতা। উপহারের প্যাকেটে পেঁচানো স্কচটেপ কেটে মূল বাক্স বের করে হাতে নিল। সেটার ভেতর ছোট্ট একটি বাক্স এবং একটি হলুদ কাগজে হাতে লেখা চিরকুট। আদ্রিতা সবার আগে চিরকুটে মন দিলো। সেখানে লেখা,
প্রিয় হলুদ পরী,
আমি আপনার নাম হলুদ পরীই দিয়েছি। আশা করি কিছু মনে করবেন না। আমি এমন নই। একদম গোমড়ামুখো একজন। আমাকে ইন্ট্রোভার্ট-ও বলা যেতে পারে। তাই একটু লোনলি। আমি কারো সাথে মিশতে অনেক সময় নেই। এবং খুব সহজে আমার সাথে কারোর বন্ধুত্ব হয় না। অথচ, আপনাকে একবার-ই মাত্র দেখেছি। এরই মধ্যে নামও দিয়ে ফেলেছি। আশা করি নামটা আপনার পছন্দ হবে। যাহোক, গিফট্ হিসেবে আপনাকে দেশের সবচে’ দামি কিছু দিতে পারতাম। শুধু দেশের কেন, পৃথিবীর যেকোনো দামি জিনিস কিনে দেওয়ার সাধ্য আমার আছে। তবে আপনাকে যা গিফট্ করেছি, তা কেবলমাত্র একজোড়া কানের ঝুমকো। তার মূল্য বর্তমান সময়ে দশ হাজার হবে কি না সন্দেহ আছে। কিন্তু এই ঝুমকোজোড়া আমার কাছ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জিনিস। যা আমি আপনাকে দিয়েছি।
এই পুরনো ঝুমকো দু’টোকে শ্রেষ্ঠ কেন বললাম জানেন? কারণ ওগুলো আমার মা পরতেন। তাঁর মৃত্যুর পর সব গয়না ব্যাঙ্কে রেখে দিলেও ঝুমকোজোড়া আমি আমার কাছে রেখে দেই। ভেবেছিলাম মায়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে ওগুলো আজীবন আমার কাছেই থাকবে। কিন্তু আজ আমি তা করতে অপারগ। আজ আমার মনে হলো, ঝুমকোজোড়া আমার কাছে না রেখে আপনাকে দিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। কেন জানি না, তবে এটা শুধু মনে হলো। মা সব সময়ই বলতেন, খোকা, তুই সকলের কথা শুনতে যাবি না। তুই তা-ই শুনবি যা তোর মন বলে।
তাই আজ ওগুলো আপনাকে দিলাম। তবে হ্যাঁ, এর পক্ষে আমার কাছে একটি যুক্তি আছে। মা আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন। তখন আমি প্রথম জীবন পেয়েছিলাম। এরপর আপনি আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। তখন আমি দ্বিতীয়বার জীবন ফিরে পেলাম। সুতরাং…
আপনি বলতে পারেন, জন্ম-মৃত্যু তো আল্লাহর হাতে। জীবন ফিরে পাওয়াটাও তাঁরই কাছে। হ্যাঁ, আমিও তা-ই মানি। তবে আল্লাহতায়ালা আমাকে জীবন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে আমার মা’কে ব্যবহার করেছিলেন। দ্বিতীয়বার আপনাকে।
আর তাই আমি আমার মৃত মায়ের শেষ স্মৃতি আপনাকে দিলাম।
ইতি,
হিমেল হাসান (কবি)
সোনার ঝুমকোজোড়া পরে নিল আদ্রিতা। সে শুয়ে শুয়ে গভীর রাত পর্যন্ত অজানা ভাবনায় ডুবে রইল। একটি কথা বারবার তার কানে বাজল। মনে হলো, হিমেল তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে,
“আমি আমার মৃত মায়ের শেষ স্মৃতি আপনাকে দিলাম।”
বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় ফিরতেই মা’র কণ্ঠ শুনল আদ্রিতা। মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরো কে যেন কথা বলছে। গলাটা পরিচিত। তবে কার গলা তা এই মুহূর্তে মনে করা যাচ্ছে না। আদ্রিতা ছাতাটা নামিয়ে রেখে মায়ের ঘরে উঁকি দিলো। মা বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে আছেন। তার সামনে চেয়ার টেনে বসেছেন ছোটো মামা। তিনি পান মুখে দিয়ে কথা বলছেন। তাই কথাগুলো কেমন যেন। ভালো করে না শুনলে বুঝা যায় না।
আদ্রিতা চলে এল। তবে ছোটোমামা এ-বাড়িতে কেন এসেছেন? এই প্রশ্ন বারবার চিন্তিত করে তুলল তাকে। ছোটো মামা ত্যাঁদড় লোক। সারাদিন ঘুরে ঘুরে বাঁদরামি করাই তার কাজ। বড়ো মামা বিদেশে গা খাটিয়ে ক’টা টাকা দেশে পাঠান। তাই দিয়ে ছোটোমামার চলে যায়। তিনি বড়ো ভাইয়ের পয়সায় খান আর টইটই করে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু আজ তিনি এ-বাড়িতে কেন এলেন?
বাথরুমে গিয়ে গোসল সেরে নিল আদ্রিতা। বাসি কাপড় ছেড়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বেরিয়ে এল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হিমেলের দেওয়া ঝুমকোগুলো দেখছিল সে। আর তখনই মা এলেন। কোনো কথা না বলেই বিছানায় বসে পড়লেন। আদ্রিতা মা’র দিকে ঘুরে বসল। মা’কে একটু খুশি খুশি লাগছে। আদ্রিতা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কী ব্যাপার, মা? এভাবে মিটিমিটি হাসছো কেন?”
মা গদগদ হয়ে বললেন,
“তোর ছোটোমামা সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে। পাত্র খুবই ভালো। ব্যাঙ্কে চাকরি করে। প্রতি মাসে চল্লিশ হাজার টাকা বেতন পায়। শহরে নিজের বাড়ি আছে।”
“ওমা! এই বয়সে তুমি আবার বিয়ে করবে! এটা কিন্তু ভালো দেখাবে না, মা।”
মুহূর্তেই মা’র মুখ কালো হয়ে গেল। তিনি ধমক দিয়ে বললেন,
“আমি বিয়ে করতে যাব কেন? আমার বিয়ের বয়স আছে নাকি? সে বয়স তো তোর। আমিই তোর মামাকে বলেছিলাম তোর জন্য পাত্র দেখতে। লোকটাকে সারা জীবন অকর্মা ভাবলাম। অথচ দ্যাখ, সে-ই এত ভালো পাত্রের সন্ধান নিয়ে এল!”
আদ্রিতা চুপ করে রইল। মা এবার বললেন,
“শোন মা, তুই আজকালকার মেয়ে। পছন্দ-টছন্দ তোরও থাকতে পারে। যদি সেরকম কেউ থাকে তবে এখনই বল।”
আদ্রিতা কিছু বলল না। চুপ করে রইল। মা আবার বললেন,
“নেই তো সেরকম কেউ?”
আদ্রিতা এবারও কিছু বলল না। মা খুশি হয়ে আদ্রিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আদ্রিতার গালে আলতো হাত রেখে বললেন,
“আমি জানি আমার মেয়ে কেমন। এরকম একটি মেয়ে পুরো পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। আমি জানতাম, আমি যাকে পছন্দ করব তাকেই তুমি বিয়ে করবে। কিন্তু তবুও জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিৎ ছিল। দোয়া করে দিলাম। আল্লাহ্ তোমাকে সুখী করবেন।” বলে নিজের হাতে চুমু খেয়ে চলে গেলেন তিনি।
এতকাল মা আদ্রিতাকে তুই করে বলে এসেছেন। আজ হঠাৎ বিয়ের প্রস্তাব আসতেই তিনি তুই থেকে তুমিতে নেমে এলেন। এভাবে একটু একটু করে পর হয়ে যাবেন তিনি। সব মেয়ের ক্ষেত্রেই তা হয়। দুই যুগ কিংবা তার চেয়েও বেশিদিন দেখে আসা পৃথিবীর সবচে’ আপন মানুষ অর্থাৎ মা হঠাৎ করেই বদলে যেতে শুরু করেন। মায়ের এই বদলে যাওয়া তখন থেকেই শুরু হয়, যখন মা বুঝতে পারেন মেয়ে বড়ো হয়েছে তাকে বিয়ে দিতে হবে।
আদ্রিতা হঠাৎ খেয়াল করল, তার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। সেই জল মুছতে গিয়েই চোখ পড়ল আয়নায়। কানের ঝুমকোগুলো দেখেই কেমন যেন শিহরণ জাগল তার মনে। ঝুমকোগুলো যেন চুপিসারে বলল,
“আমি আমার মৃত মায়ের শেষ স্মৃতি আপনাকে দিলাম।”
এই মুহূর্তে আদ্রিতা খুশি হওয়ার কথা। অথচ উল্টো চোখ বেয়ে পানি পড়ছে তার। বুকের ভেতর তীব্র হাহাকার। কিন্তু কেন? কী কারণে? ভাবতে ভাবতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দৃষ্টি আটকায় আদ্রিতার। কানে ঝুলে থাকা সোনার ঝুমকো চোখে পড়তেই যেন সারা গায়ে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়ল। সে এক লাফে বিছানায় গেল। বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে হিমেলের নাম্বার ডায়েল করল।
“আপনার মায়ের ঝুমকো আমাকে কেন দিলেন বলুন তো?” আদ্রিতা অভিমানী গলায় বলল।
“সে-কথা চিঠিতেই লিখেছি। চিঠিটা পড়েননি?”
“পড়েছি। মুখে বলুন।”
“আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন তাই।”
“তাই বলে নিজের মায়ের শেষ স্মৃতি আমাকে দিয়ে দেবেন? দেওয়ার মতো অনেক কিছুই ছিল। এত ইচ্ছে করলে অন্য একটি কিনে দিতেন। কিংবা অার কিছু দেওয়া যেত। মায়ের স্মৃতি আমাকে দিতে হবে কেন?”
“আমি কি ভুল করেছি?”
“অবশ্যই ভুল করেছেন। এমন কেউ করে?”
“কিন্তু আমার যে দিতে ইচ্ছে করছিল খুব! তাছাড়া মায়ের কথাই তো শুনলাম। মা বলেছিল, মন যা বলে তা-ই যেন করি। এবং আমি তা-ই করেছি।”
“কিন্তু আপনার একবার ভাবা উচিৎ ছিল। আপনার মায়ের পুরনো গহনা যদি কাউকে দিতেই হয়, সেটা দেওয়া হবে আপনার বউ’কে। আপনি যেহেতু অবিবাহিত সেহেতু আপনার বিয়ের পর যিনি আপনার স্ত্রী হয়ে আসবেন তাকে দেওয়া উচিৎ ছিল। অথচ আপনি আমাকে দিয়ে বসলেন। এটা কি ঠিক হলো?”
“আপনার কণ্ঠ এমন লাগছে কেন?”
হিমেলের প্রশ্নে বিব্রতবোধ করল আদ্রিতা। সে কাঁদছে। চোখ বেয়ে ঝড়ে পড়ছে অজস্র জলের স্রোত। এর বিন্দুমাত্র কারণ সে জানে না। শুধু জানে, বুকের ভেতরটা হঠাৎ দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তবে কি তার মনের ব্যথা টের পেয়ে গেল হিমেল?
“আপনি কি খুব রেগে আছেন আমার উপর? দেখুন, আমি অতটা ভেবে দেইনি। ইচ্ছে হয়েছে তাই দিয়ে দিয়েছি। তবে আপনি চাইলে আমরা ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে পারি। অর্থাৎ আপনি যা বললেন। মানে ঝুমকোজোড়া আমার বউকে দেওয়া উচিৎ ছিল।”
“কী করবেন আপনি?” আদ্রিতা শক্ত গলায় বলল।
“আপনাকে বিয়ে…”
অস্পষ্ট কথাটা অস্পষ্টই রয়ে গেল। টুট্ টুট্ শব্দ করে ফোন কেটে গেল। আদ্রিতা এতটাই শক খেল যে, কিছুক্ষণ নড়তে অবধি পারল না। কানের কাছে ফোন ধরে রেখে শক্ত হয়ে বসে রইল।