কবি বর পর্ব ৪

গল্প : কবি বর | পর্ব : চার

এক চিলতে সূর্যের আলো জানালার পরদা ভেদ করে বিছানায় আছড়ে পড়েছে। আজ ছুটির দিন। তাই একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছিল আদ্রিতা। চোখ কচলে মোবাইল ফোন অন করতেই সেটা শব্দ করে কেঁপে উঠল। তারপর ফোনের ভেতর থেকে ভেসে এল একটি সুর। সেই সুর বলল,

“আমি হিমেল। হিমেল হাসান।”

তারপর আদ্রিতার বুকে যে ঢেউ উঠল, তার বর্ণনা করা সম্ভব নয়। সে মোবাইল ফোন আলতো করে গালের কাছে ধরে নিশ্চুপ বসে রইল। অবশ্য এক আধবার কী বলবে তা ভেবে নিল। কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। খানিক বাদে আবার ওপাশ থেকে ভেসে এল,

“চিনতে পেরেছেন আমাকে? আমি হিমেল। ক’দিন আগে আপনি আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে হসপিটালে ভর্তি করিয়েছিলেন।”

“জি, বলুন।” সংক্ষেপে জবাব দিলো আদ্রিতা।

“আপনি সেদিন এত বড়ো উপকার করলেন। অথচ ধন্যবাদটুকু এখনও দেওয়া হয়নি। তাই আপনার ফোন নাম্বার জোগাড় করলাম।”

“ইটস্ ওকে। ধন্যবাদ দিতে হবে না। শুধু আপনি নন, যে কেউ বিপদে পড়লে আমি হেল্প করতাম।”

“তা কী করে হয়? ইউ ডিজার্ভ ইট। এবং আপনাকে সেটা নিতে হবে। তবে কথা হলো, ফোনে নয়, সরাসরি সামনে দাঁড়িয়ে ধন্যবাদ দিতে চাই। প্লিজ না করবেন না।”

না না করেও শেষমেশ রাজি হয়ে গেল আদ্রিতা। সে সন্ধ্যার পর হিমেলের সঙ্গে দেখা করবে। সবকিছু হয়ে গেল ঘোরের মধ্যে। ফোন রেখে দেওয়ার পর অনেক্ষণ হতভম্বের মতো বিছানায় বসে রইল আদ্রিতা। হঠাৎ উদ্-ভ্রান্তের মতো ছুটে গেল। দাঁত ব্রাশ করে চা খেল। অন্য সব ছুটির দিনে সকালে বই পড়ে আদ্রিতা। তবে আজ কিছুতেই বইয়ে মন দিতে পারল না। একটি প্রশ্ন সারাক্ষণ ভাবিয়ে তুলল তাকে। হিমেলের সঙ্গে দেখা করা কি আদৌ ঠিক হবে তার? বিষয়টা ধীরে ধীরে অন্য দিকে মোড় নিতে পারে না? কোথায় হিমেল। মন্ত্রীর ছেলে। তার উপর এত বড়ো গায়ক। আর আদ্রিতা। সে একজন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা। তবে কি হিমেলের সঙ্গে দেখা না করাই ঠিক হবে?

কৃত্রিম বাতির হলদে আলোয় বসে আছে হিমেল। বসে আছে বললে ভুল হবে। সে অপেক্ষা করছে। যে মেয়েটি তাকে বাঁচিয়েছিল, সেই মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করছে। আর চেয়ারে বসে টেবিলে কনুই রেখে চোখ বুজে ভাবছে। কল্পনা করছে সেদিনের কথা। রাস্তায় পড়ে আছে হিমেল। রক্তে ভরে যাচ্ছে রাস্তার একটি একটি পাথর। একটি একটি বালি। হিমেলের গায়ে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। সে নিথর হয়ে পড়ে আছে। চোখদু’টো বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমশ। আর তখনই একটি মেয়ে এল। হলুদ জামা পরা একটি মেয়ে। হিমেল তার নাম দিয়েছে হলুদ পরী। সেই হলুদ পরী বিদ্যুৎ বেগে ছুটে এসে হিমেলের সামনে বসে পড়ল। তারপর ডান হাতের দু’টো আঙুল হিমেলের নাকের সামনে ধরে রাখল। হ্যাঁ, হিমেল নিশ্বাস নিচ্ছে।

মেয়েটি এক মুহূর্ত দেড়ি না করে দু’হাত বাড়িয়ে দিলো। এক হাত হিমেলের ঘাড়ের নিচে। অপর হাত হাঁটুর নিচে। তারপর ঘটে গেল অবিশ্বাস্য ঘটনা। চোখের পলকে হিমেলের পুরো দেহ শূন্যে তুলে ফেলল মেয়েটি। এলোমেলো পা ফেলে রিকশা অবধি নিয়ে গেল। আচ্ছা, তখন রিকশাওয়ালা সাহায্য করল না কেন? সে কি রক্ত দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল? না কি এমন অবাক কান্ড দেখে সে-ও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল?

বাঁ হাত উঁচু করে ঘড়ি দেখে নেয় হিমেল। ৭:৩২মিনিট। মেয়েটি আসার কথা সন্ধ্যা সাতটায়। অথচ সাতটা বাজার পর আরো আধা ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। তার মানে কি সে আসবে না? তীব্র অস্বস্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায় হিমেল। এ-যাবৎ লোকজন তার জন্য অপেক্ষা করেছে। আর আজ কিনা সে অন্যের জন্য অপেক্ষা করছে। এদিকে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। অস্বস্তি বেড়েই যাচ্ছে কেবল। শেষে হিমেল চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই কোথাও চোখ আটকে গেল। আলো আঁধারে হলুদ রং। মেয়েটিকে চিনতে একটুও দেড়ি হলো না। সে আজও হলুদ জামা পরেছে। তবে তাকে দেখে যতটা অবাক হলো হিমেল, তার থেকে বেশি অবাক হলো তার মুখ দেখে। এই মেয়ের সাথেই তো সেদিন স্কুলে দেখা হলো!

“বোসুন।” হিমেল আগ বাড়িয়ে বলল।

মেয়েটি বিনীত হেসে চেয়ার টেনে বসল। একবার হিমেলের দিকে চোখ তুলে তাকাল। আবার দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল।

“আমি হিমেল।”

“আমি আদ্রিতা।”

গাঢ় নিস্তব্ধতায় আটকা পড়ল দু’জনেই। কারোর মুখে রা নেই। এরই মধ্যে ওয়েটার এসে দু’কাপ কফি দিয়ে গেল। কফির মগ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। আটতলা বিল্ডিং-এর উপর রেস্তোরাঁ। মাথার উপর খোলা আকাশ। চারপাশে মৃদু আলো। পরিবেশটা কেমন যেন অন্যরকম। মনে হয়, হাত বাড়ালেই আকাশ ধরা যাবে। আদতে তা নয়। আকাশটা অনেক অনেক উঁচুতে। সেখানে খন্ড খন্ড মেঘ জমে আছে। মাঝে মাঝে এক ঝাপটা শীতল হাওয়া গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। আদ্রিতা কফির মগের চুমুক দেয়। হিমেল আনমনে বলে,

“আপনার সবকিছুই কি অন্যরকম?”

অাদ্রিতা এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে বিস্মিত চোখজোড়া হিমেলের দিকে তাক করে বলে,

“মানে?”

“মানে আপনি সবার থেকে একটু আলাদা। তা-ই বলছিলাম।”

আদ্রিতা মৃদু হেসে দৃষ্টি নিচু করে নেয়। হিমেল একটি চারকোনা রঙিন বাক্স এগিয়ে দেয়।

“কী এটা?” আদ্রিতা নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে।

“গিফট। তবে এখন খুলবেন না প্লিজ।”

“কেন, কী আছে এতে?”

“বোম।” বলে শব্দ করে হেসে ফেলে হিমেল। আর তখনই একটু দূরের টেবিলে বসে থাকা একজন ছুটে আসেন। কিছুক্ষণ চোখ বড়ো বড়ো করে হিমেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর অবাক হয়ে বলেন,

“হিমেল হাসান? দ্য ফেমাস রকস্টার?”

“জি।” হিমেল সংক্ষেপে জবাব দেয়।

তারপর লোকটা সেলফি তুলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। তাকে দেখে অন্য লোকজনও ছুটে আসে। এতক্ষণ হিমেল অন্ধকারে বসে ছিল বলে কেউ তাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু এই লোকটার কান্ড দেখতে সবাই এক নজর এদিকে তাকাচ্ছে। এবং যখন হিমেলকে দেখতে পাচ্ছে, তখন সবার মুখ হা হয়ে যাচ্ছে। সবাই তার সঙ্গে ছবি তুলবে। মিনিটের মধ্যে ভীড় জমে গেল। একে একে ছবি তুলতে লাগল সবাই। ভীড় কমে আসতেই হিমেল আবিষ্কার করল, আদ্রিতা নেই। হিমেল চারপাশটা ভালো করে দেখে নিল। উঁহু, কোথাও নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here