কান্তা মনি পর্ব -০৭

#কান্তা_মনি
#পর্ব_৭
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা

ভোর হতেই নূর নাহারের মৃত্যুর সংবাদে শোকের ছায়া এসে পড়েছে জমিদার বাড়িতে। জমিদার বাড়ির কেউ হয়ত কল্পনাও করেননি নূর নাহার তাদেরকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু ওই যে একটা কথা আছেনা? জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এ তিনটিই সৃষ্টিকর্তার হাতে।

নিস্তব্দতায় খাঁ খাঁ করছে জমিদার বাড়ি।
নূর নাহারের দাফনকার্য শেষে সকলেই যার যার কক্ষে এসে ঝিমিয়ে পড়েছেন। পালঙ্কের এক কোণে গুটিসুটি মেরে কান্নায় ভেঙে পড়েছে কান্তা মনি। এই কয়েকদিনেই বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল দাদী নূর নাহারের সহিত। মানুষটা যে যন্ত্রণায় দিন রাত কাতরাতেন।

আজ ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে কান্তা মনি নূর নাহারের কক্ষে গিয়ে মেঝেতে বসে পালঙ্কের ওপর শুয়ে থাকা নূর নাহারের কোলের কাছে মাথা দিয়ে বসে ছিল। হঠাত গোংরানোর আওয়াজ পেয়ে নূর নাহারের মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে কান্তা মনি। আঁতকে উঠে কক্ষের বাইরে গিয়ে ছটফট করতে করতে সকলকে ডাকতে থাকে। কবিরাজকে খবর দেওয়া হয়। পুনরায় কক্ষে গিয়ে নূর নাহারের অবস্থা দেখে কান্না শুরু করেন দেয় কান্তা মনি।সকলে নূর নাহারের শরীরের অবস্থার কথা শুনে ছুটে আসে। শরীর ঘামতে দেখে পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে কান্তা মনি। দুই/তিন দফা পানি পান করানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। কিন্তু সে তো আর জানেনা দাদীজান মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে ছটফট করছেন। কেউ মাথায় হাত বুলাচ্ছে তো কেউ হাত-পা টিপছে। বড় একটা নিঃশাস নিতে নিতে বিড়বিড় করে কালেমা পড়তে পড়তে ছটফটানি থামিয়ে দেন নূর নাহার। পুরো কক্ষ নিমিষেই নিস্তব্দ হয়ে যায়। কবিরাজ এসে হাতের নাড়ি পরীক্ষা করে জানান দেন দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন নূর নাহার।

জানালার পাশে বাইরের দিকে মুখ করে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিয়াজ মির্জা। একটু কিছুতেই যে সে আর “দাদীজান” বলে আবেগী সুরে তার অতি প্রিয় দাদীজানকে যে ডাকতে পারবেনা। না পারবে ক্লান্ত দেহে দাদীজানের কোলে মাথা রেখে সারাদিনের সমস্ত কার্যের বিবরণ দিতে। ছোটবেলায় যখন আম্মা বকা দিতেন দৌড়ে গিয়ে দাদীজানের শাড়ির আচলে নিজেকে লুকিয়ে ফেলত সে। আনমনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিয়াজ। বুক আজ বড্ড খাঁ খাঁ করছে যে। ওপাশ থেকে নূর জাহান এবং মেহেরুন্নেছার গুনগুন কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।

বেশ কিছু দিন কেটে গেছে।

-এই বাড়িতে এসেছো বেশিদিন হলো না এতেই এতো মায়া জন্মে গেছে? তুমি যেভাবে কাঁদছ ওভাবে তো কেউ কাঁদেনই আম্মার মৃত্যুতে। এত মায়া মনে? (কান্তা মনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন মেহেরুন্নেছা)

মেহেরুন্নেছার কোলে মাথা রেখে পালঙ্কের ওপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে কান্তা মনি।

-জানো কান্তা মনি আম্মার জন্য অনেক মন কেমন করছে। ছোটবেলা থেকে সেই আমাকে লালন-পালন করেছেন। আমাকে একটুও মায়ের অভাব বুঝতে দেন নি। (মেহেরুন্নেছা)
-মানে! (মেহেরুন্নেছার কোল থেকে মাথা তুলে উঠে বসে কথাটা বলে উঠল কান্তা মনি)
-আসলে আব্বার দ্বিতীয় বেগম ছিলেন আমার আম্মা। দুই সতীন ভেতরে নাকি রেষারেষি লেগে থাকত। পরে ধীরে ধীরে একটু সখ্যতা হয়া। তারপর আমার জন্ম হয়। আমার বয়স যখন চার বছর তখন আম্মা মারা যান। তখন থেকে এই আম্মাই আমাকে লালন-পালন করতেন। আমার আম্মার ঘাটতি সে পূরণ করে দেয়। আমার যেখানে বিয়ে হয় সেখানে নওশাদ জন্ম নেওয়ার পরে আমার স্বামী নওশাদের দশ বছর বয়সের সময় মারা যান। আমাদের আর আমার স্বামীর বাড়িতে ঠাই মেলেনি। ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমাকে আর আমার দশ বছর ছেলেটাকে বের করে দেয়। সেই থেকে বাপের বাড়িতেই পড়ে আছি। (কথাগুলো বলেই বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন মেহেরুন্নেছা)

কান্তা মনি অবাক চোখে মেহেরুন্নেছার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটা তার জীবনে কত লড়াই করে টিকে আছে।
মেহেরুন্নেছা কান্তা মনির চোখের কোণে লেপ্টে থাকা অশ্রু মুছে দিয়ে কপালের ওপর পড়ে থাকা বাড়রি চুলগুলো কানে পেছনে গুজে দেন।
-আপনি এতো ভালো কেন ফুফু মনি? (কান্তা মনি)
বিনিময়ে মুচকি হাসেন মেহেরুন্নেছা।
-আচ্ছা ফুফুমনি আহসান ভাইদের আম্মাজান কোথায়? (কান্তা মনি)
হঠাত মেহেরুন্নেছার মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
-মুঞ্জিলা তো পাগল হয়ে গেছে। হঠাত কি এমন হয়েছিল কেউ জানেনা। সবাই ধারণা করে যে জ্বিনে ধরছিল। তারপর থেকে নাকি মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। মুঞ্জিলা ওর বাপের বাড়িতে থাকে। এখানে কেউ থাকে সামলে রাখতে পারেনা। (মেহেরুন্নেছা)
-শুনে খারাপ লাগল। (কান্তা মনি)

মেহেরুন্নেছা কিছু বলতে নিতেই কক্ষের অপর পাশ থেকে দ্বারে ঠক ঠক আওয়াজ হতেই দুজনেই নড়েচড়ে বসে। রক্ষী দ্বার খুলে দিতেই বেগম নূর জাহান প্রবেশ করেন।
-সারাদিন শুধু গল্পে মশগুল থাকলে হবে না বুঝছিস মেয়ে। আর মেহেরুন তুমিও পারো। এই মেয়ের ভেতরে কি যে পেয়েছো তোমরা আমি তা বুঝিনা। (নূর জাহান)
দুজনেই থতমত খেয়ে মাথা নুয়ে নেয়।
-আজকে বাড়িতে তালিমের ব্যবস্থা করেছি তা কি তোমাদের কর্ণগোচর হয়েছে? (ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলেন নূর জাহান)
-হুম জানি আম্মা। (কান্তা মনি)
-অতিথি শালায় অতিথিরা উপস্থিত হয়ে গেছে। হেতিজা, যোহরা, রেহানা, মুর্শিদা ওরা একা কত কিছু করবে তোমরাও হাত লাগিয়ে সব ব্যবথাপনার সাহায্য করো। দ্রুত যাও। (নূর জাহান)

রাতে ভোজন শালা থেকে ফেরার সময় সিড়ি বেয়ে উঠতে নিতেই সিড়ির পাশের পরিত্যক্ত কক্ষের ভেতর থেকে পুরুষালী কন্ঠ ভেসে আসে কান্তা মনির কানে। সিড়িতে উঠানো এক পা নিচে নামিয়ে ধীর পায়ে সেই কক্ষের সামনে গিয়ে দ্বারের সাথে কান ঠেকিয়ে ভেতরের কথোপকথন শোনার চেষ্টা করে। ভেতরের কথোপকথন শেষ হয়েছে বুঝতে পেরেই ঝটিপট সেখান থেকে সরে যায় কান্তা মনি। সিড়ি বেয়ে উঠছে আর বাকা হাসছে। প্রজাদের লুট-পাট করার ষড়যন্ত্র যে এই বাড়ির কেউই করেছে তা এবার সম্পূর্ণ পরিষ্কার তার সামনে। একাধিক লোকের কন্ঠগুলো চিনতে যে তার একদম অসুবিধা হয়নি। এবার শুধু প্রমাণ যোগার করা তার একমাত্র লক্ষ্য। শাড়ির আচলের কোণা হাতের আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে কক্ষে প্রবেশ করে কান্তা মনি।

কান্তা মনিকে কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে হাতে থাকা কাগজ-পত্র পাশের চৌপায়ার ওপর গুছিয়ে রেখে মুচকি হাসার চেষ্টা করে নিয়াজ মির্জা।
-খাওয়া-দাওয়া তো শেষ কখন। এতক্ষণ কোথায় ছিলে কান্তামনি? (নিয়াজ মির্জা)
-ভোজন শালাতেই ছিলাম। হেতিজা, যোহরা,মুর্শিদা ভাবির সাথে গল্প করছিলাম। শুনলাম আহসান ভাই শহর থেকে এসে পড়ায় মহাশিন ভাইজান নাকি মুর্শিদা ভাবিকে নিয়ে কিছুদিন পরেই শহরে চলে যাবেন। (মুখখানা কিছুটা ভার করে বলল কান্তা মনি।
-হ্যা মহাশিন এখন থেকে শহরে থেকেই ব্যবসা দেখাশোনা করবে। তা তোমার কি মুখটা ভার হয়ে আছে এজন্য? (নিয়াজ মির্জা)
উপর নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যা’ সূচক ইঙ্গিত দেয় কান্তা মনি।
-হুম ভাবি খুব ভালো মনের মানুষ। আমাকে খুব ভালোবাসেন। অনেকটাই একা হয়ে যাব সে চলে গেলেই। (কান্তা মনি)
এক ঝটকায় কান্তা মনিকে নিজের কাছে টেনে নেয় নিয়াজ মির্জা।
-আমি আছিনা? (নিয়াজ মির্জা)
নিয়াজের এহেন কান্ডে হালকা কেঁপে ওঠে কান্তা মনি। চোখ খিচে বন্ধ করে নেয়। দম যেন তার এখনই বন্ধ হয়ে যাবে।
-কি হলো ? আমি থাকতে তোমার একা লাগবে কেন? নাকি আমাকে ভালো লাগেনা? (নিয়াজ মির্জা)
লজ্জায় কুকড়ে ওঠে কান্তা মনি।
-কি এমনভাবে ছুটাছুটি করছো কেন তুমি? আমি কি তোমাকে খেয়ে ফেলছি নাকি? (নিয়াজ মির্জা)
কান্তা মনি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে কান্তা মনির দিকে। কান্তা মনিকে আস্তে করে ছেড়ে দিয়ে হাত টেনে এনে জানালার পাশে এসে দাড়ায় নিয়াজ। কান্তা মনির ঘাড়ে থুতনি রেখে এক হাতের আঙুল দিয়ে চাঁদের দিকে ইশারা করে নিয়াজ মির্জা বলে ওঠে,
-ওইযে আকাশের চাঁদ আর এইযে শাহ নিয়াজ মির্জার চাঁদ। একান্তই শাহ নিয়াজ মির্জার চাঁদ। কথাটা বলেই নিয়াজ বুকের সাথে কান্তামনির পিঠ ঠেকিয়ে মৃদু দুহাতে আগলে ধরে। লজ্জায় কান্তা মনি মুখ লুকানোর স্থান পায়না।

গভির রাত বালিশে মাথা ঠেকিয়ে আনমনে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে যুবতি। হঠাত পাশ ফিরে নিয়াজের দিকে দৃষ্টিনিপাত করে কান্তা মনি। গভীর নিমগ্ন নিয়াজ। কি সুন্দর লাগছে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায়। আসলেই সে ফেসে গেছে এই যুবকের অফুরন্ত ভালোবাসায়। মুচকি হাসে যুবতি।

হঠাত মাথায় কিছু প্রশ্ন চাড়া দিয়ে ওঠে।
নিয়াজ মির্জার এবং জমিদার বাড়ি সম্পর্কে খবরদারী করতে গুপ্তচর পাঠানো, নিয়াজ এবং তাকে আক্রমণ করার চেষ্টা, প্রজাদের লুট করার ষড়যন্ত্র, সেদিনের পত্র লিখে পাঠানো হুমকি, দাদীজানের মৃত্যু সব কি একই সূত্রে বাধা?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here