কিচিরমিচির পর্ব -০১

“এটা কি করলেন পর্বভাই? আপনি আমার ঘুড়িটা কেটে দিলেন কেন?”

ইশিতার কথায় ঘুড়িতে কয়েকটা টান দিতে দিতে পর্ব বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ্’ শব্দ করলো।তারপর আবার নিজের ঘুড়ি ওড়ানোতে মন দিলো।তা দেখে ইশিতার রাগ আরও দশগুণ বেড়ে গেল।দাঁতে দাঁত চেপে নিজে নিজেই বললো,

“কিহ্ ইশিতা কাবিরকে ইগনোর করা! দেখাচ্ছি ইগনোর করা”

বলেই ফোসফোস করতে করতে পর্বের দুই হাতে ধরে থাকা সুতোর দিকে এগিয়ে গেল।সুতোর দুইদিকে ধরে সুতোই মুখ দিলো।তা দেখে পর্ব পেট ধরে শরীর কাঁপিয়ে ফিক করে হেসে দিল।কোনো মতে হাসি থামিয়ে পেট ধরে বললো,

“এ ফিডার তোর দাঁত খুলে পড়ে যাবে তাও সুতো ছিড়বে না যা তো চোখের সামনে থেকে..এহ্ এখনো নাক টিপলে দুধ বের হবে সে আবার আসছে পর্ব আহমেদকে ঘুড়ি কাটার চ্যালেঞ্জ করতে তোকে শুদ্ধ ভো কাট্টা করে দেবো। যা ঘরে গিয়ে পড়তে বস।তোর না সামনে ফার্স্ট সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা? যা পড়তে বস…”

ইশিতা এবার বেশ ভালোই চটে গেল।সুতো থেকে মুখ সরিয়ে পর্বের সামনে গিয়ে দাড়ালো।তবে পর্বের কাছে সে নিতান্তই ছোট্ট বিড়াল ছানার মতো।তাই পায়ের বৃদ্ধ আঙুল দুটিতে ভর দিয়ে একটু উঁচু হওয়ার চেষ্টা করলো।পর্ব নিজের তর্জনি দিয়ে ইশিতার কপালে একটা গুতা দিলো শুধু বৃদ্ধ আঙুলের উপর দাড়ানোর ফলে ইশিতা পরে যেতে গেল।তবে তার আগেই পর্ব ইশিতার ডান হাত ধরলো।আর সোজা করে দাড় করালো।তারপর শান্ত কন্ঠে বললো,

“লম্বা হওয়ার দরকার নেই আমার হার্টবিট গুণতে পারলেই চলবে”

পর্বের কথায় চোখ পিট পিট করে তাকালো ইশিতা। তারপর নিজের মনে মনে বললো,

“মাঝে মাঝে পর্ব ভাই এতো কঠিন কঠিন কথা বলে না তা আর কি বলবো।ধূর ওসব বাদ কোথায় যেন ছিলাম হ্যা হ্যা ফিডারে ছিলাম।”

নিজের মনে কল্পনা জল্পনার ভেতর হঠাৎ মুখের সামনে তুড়ি বাজালো পর্ব।ফিডারের কথা মনে পড়তেই আবার রেগে বোম হয়ে গেল ইশিতা।পর্ব ঠাট্টা করে বললো,

“কি আফা কোন প্রেমিক পুরুষের কথা চিন্তা করছেন?”

ইশিতা আবার ফোসফোস করা শুরু করলো।চোখ দুটো দিয়ে পর্বের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন এখনই খেয়ে ফেলবে।তা দেখে পর্ব কয়েবার ঘন ঘন পলক ফেললো।ইশিতা এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে রেগেমেগে চেচিয়ে উঠে বললো,

“এই ফিডার কে হ্যা?”

পর্ব ঠোঁট টিপে হাসলো।তারপর নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,

“তুই ছাড়া আর কে?”

এবার আর ইশিতা রাগ দেখে কে।কিহ্ এতো বড় অপমান নাহ্ এ মেনে নেওয়া যায় না। ইশিতা বেশ চেচিয়ে বললো,

“এই আপনি আমাকে কখনো দেখেছেন ফিডার খেতে হ্যা?বলেন দেখেছেন?

পর্ব লাটাই হাতে নিতে নিতে আড় চোখে ইশিতার দিকে তাকিয়ে বললো,

” তোকে আমি জামা প্যান্ট ছাড়া শুধু টাওয়ালেতেও দেখেছি”

কথাটা শুনতেই চোখ বড় বড় করে ফেললো ইশিতা। মাথাটা কেমন ঘুরাচ্ছে মনে হয় অজ্ঞান হয়ে যাবে সে।না অজ্ঞান হয়ে কি যাবে শেষমেষ অজ্ঞানই হয়ে গেল।
এদিকে পর্ব লাটাই এ সুতো গুটাতে ব্যস্ত ছিল পাশে ধুপ করে কিছু পরার শব্দে পাশে তাকিয়ে দেখে ইশিতা ছাঁদের মেঝেতে পরে আছে।পর্ব দ্রুত তার কাছে গিয়ে ইশিতার মাথাটা নিজের কোলে নিলো উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলতে লাগলো,

“ইশু চোখ খোল।ইশু চোখ খোল কি হলো তোর ইশুমনি চোখ খোল প্লিজ”

পর্বের চেচামেচি শুনে নিচে থাকা পর্বের মা,ইশিতা মা আর ইশিতা বোন দৌড়ে এলো।পর্বের মা ইশিতাকে নিচে পরে থাকতে দেখে বললো,

“কিরে পর্ব ইশিতার কি হয়েছে?ও অজ্ঞান হয়ে গেল কিভাবে”

পর্ব ইশিতাকে কোলে তুলে ছাঁদ থেকে নামতে নামতে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,

“আমি কিছু জানিনা আম্মু ও তো আমার সাথেই কথা বলছিলো।হঠাৎ ওর কি হলো বুঝতে পারলাম না”

পর্বের পিছন পিছন সবাই নামছে।পর্বের মা এবার কড়া গলায় বললো,

“তুই একটু খেয়াল রাখবি না মেয়েটার দিকে জানিসই তো কেমন ছেলে মানুষ ও”

পর্ব ইশিতাকে নিয়ে এশার রুমে চলে গেল।ইশিতাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পাশে টেবিলের উপর থাকা জগের একটু পানি নিয়ে এশার চোখে মুখে দেয়।

——————
আমি ইশিতা কাবির। বাবা-মায়ের আদরের ছোট মেয়ে।খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছি কিছুদিন হলো।মা গৃহিণী আর বাবা সাংবাদিক।মায়ের নাম স্মিতা কবির আর বাবা অনিক কবির।আর বোন নাফিসা কবির আমার নামে কাবিরটা আসলে আমিই বানিয়েছি মাতব্বরি করে।কাবির শুনতে ভালো লাগে আর একটা কেমন গুরুগম্ভীর ভাবও আছে।
আমার একমাত্র স্বপ্ন লাইফের সব মুহুর্তগুলো নিজের মতো করে অনুভব করতে চাই।একদম স্বাধীনভাবে পাখির মতো উড়তে চাই।
হাহ্ তবে এই পর্ব নামের বাঁশের মতো কাঁটাটা আমার লাইফে যতদিন আছে ততদিন আমার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।কত চেষ্টা করেছি এই ব্যাটাকে একটা মেয়ের সাথে আমার লাইফ থেকে ভাগিয়ে দিতে। কিন্তু এতো একদম সুপার গ্লু আমার সাথে সারাদিন চিপকায় থাকে।

দেখতে মাশাল্লাহ্ খারাপ না।গায়ের রং শ্যামলা মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।ঘন কালো কুচকুচে বড় বড় কোঁকড়া চুল। বড় বড় চোখে ঘন পাপড়িগুলো যেন চোখের মায়া আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।পাতলা ঠোঁটটা খয়েরী রঙের ছোঁয়ায় তৈরি।লম্বা পাঁচ ফুট এগারো।খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে অনার্স শেষ বর্ষে।বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে।মা কনিকা বেগম আর বাবা আরিফ আহমেদ।মা গৃহিনী আর বাবা একটা ছোট বিজনেস আছে।খুবই জেদি আপসহীন আর রাগী ছেলে।আর তার সবচেয়ে পছন্দের কাজ আমার লাইফটাকে তেজপাতা বানানো।
——
পর্বভাই হলো ঘুড়ি ওড়ানোর ওস্তাদ।আমিও মোটামুটি ভালোই ঘুড়ি ওড়ায় আর আমি তাকে চ্যালেঞ্জ করেছি আমার ঘুড়ি যদি সে কাটতে পারে তো তাকে আমি বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াবো আর আমি যদি তার ঘুড়ি কাটি তাহলে সে আমাকে রান্না করে খাওয়াবে। পর্বভাইয়ের হাতের রান্না খাবো ভাবতে খুশিতে খুশিতে এটাই ভুলে গেলাম যে সে ওস্তাদ আর আমি তার শীর্ষ।
———
পিট পিট করে চোখ মেলে তাকাতেই চোখের সামনে চিপকুটার চেহারা ভেসে উঠলো।আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে পর্ব ভাই উত্তেজিত কন্ঠে বললো,

“ইশুপাখি তোর কি হলো হঠাৎ তুই ঠিক আছিস?তোর কি গার্লস প্রবলেম হয়েছে তুই হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলি কেন?”

পর্ব ভাইয়ের কোনো কথা আমার কানে ঢুকছে না আমার কানে শুধু একটা কথায় বাজছে আর সেটা হলো ” আমি তোকে জামা প্যান্ট ছাড়া শুধু টাওয়ালেতেও দেখেছি।” কথাটা মনে পড়তেই মাথাটা আবার চক্কর দিয়ে উঠলো আমার। আমি এবার আর থাকতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম।তা দেখে পর্ব ভাই তড়িঘড়ি এসে আমাকে নিজের বুকের মধ্যে জরিয়ে নিলো।এদিকে আমি কান্না করছি আর সর্বশক্তি দিয়ে পর্ব ভাইয়ের বুকে ধাক্কাচ্ছি আর বলছি,

“ছাড় ছাড় আমাকে.. লুচ্চা একটা! তুই কি করেছিস আমার সাথে বল লুচ্চা কথাকার”

পর্ব ভাই আমার ধাক্কা ধাক্কিতে আমাকে নিজের সাথে আরও জোরে চেপে ধরলো আর অবাক কন্ঠে বললো,

“এসব কি বলছিস তুই ইশু আমি তোর সাথে কি করেছি?আর কখন করেছি”

আমি পর্ব ভাইয়ার বুকের ভিতর ছোট্ট বিড়াল ছানার মতো নাক টেনে টেনে কান্না করছি আর মাঝে মাঝে পর্ব ভাইয়ার শার্টে নাক ঘষা দিচ্ছি পর্ব ভাইয়ের মাতাল করা গাঁয়ের গন্ধ আমার নাকে ধরা দিচ্ছে।পর্ব ভাইয়ের ডান হাত আমার মাথায় আর বা বাম হাত আমার পিঠে।আমি যতবার পর্ব ভাইয়ার বুকে নাক ঘষছি ততবার পর্বভাই কেঁপে কেঁপে উঠছে। বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারলাম না।আমি পর্বভাইয়ের বুকে থুঁতনি ভর দিয়ে মাথাটা উঁচু করে নাক টেনে টেনে বললাম,

“আপনি তখন বললেন আপনি আমাকে জামা কাপড় ছাড়া টাওয়ালেতে দেখেছেন আপনি আমার সাথে এমন কেন করলেন পর্বভাই?”

বলেই আমি আবার নাক টেনে কান্নাকাটি জুড়ে দিলাম। পর্বভাই আমার মাথা ডান হাতটা সরিয়ে চোখ মুছে দিতে দিতে আদুরি স্বরে বললো,

“ইশু তুই একটা গাধা! একদম বোক!আরে পাগলি ওটা তো আমি তোর ছোটবেলার কথা বলেছি যখন তুই একদম বাবু ছিলি তখন দেখেছি। ”

পর্বভাইয়ের কথায় কান্না আমার আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে গেল। তারপর কিছুক্ষণ ভালো করে নিজের মনে মনে গবেষণা করে বুঝলাম ঠিকই তো আমি যখন ছোট ছিলাম তখন তো পর্বভাই আমাকে দেখেছে।তাহলে পর্বভাই ঐসময়ের কথাই বলেছে।নিজের মনে মনে হাজার গবেষণা চালানোর পর চোখ পিট পিট করে পর্বভাইয়ের দিকে তাকালাম সে আমার দিকে গালে হাত দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমি সন্দিহান কন্ঠে বললাম,

“সত্যি তো? বড় হয়ে কিছু দেখেননি তো?”

পর্বভাই গাল থেকে হাতটা নামিয়ে মুচকি হেসে আমার চোখে জমে থাকা বাকি পানিটা মুছে দিতে দিতে বললো,

“হ্যা বাবা সত্যি ”

বলে আমার কপালে একটা চুমু খেলেন।দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতেই পর্বভাই আমার থেকে একটু দূরে গিয়ে বসলেন।আম্মু এসেছে রাতের খাবার নিয়ে।আম্মু পর্বভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“ডাইনিং এ খাবার দিয়েছি যা পর্ব গিয়ে খেয়ে নে কাল তো আবার অনেক কাজ।”

পর্বভাই আমার চোখের সামনে পড়া চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,

“হ্যা..! তা বড় মেয়েকে তো বড় জামায়ের হাতে তুলে দিচ্ছো ছোট মেয়েকে কবে আমার হাতে তুলে দিবে?”

আমি পর্বভাইয়ের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলাম না।আম্মু সতর্কতার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে পর্বভাইয়ের দিকে তাকালো।সে নির্বিকারভাবে পায়ে জুতোটা গুঁজে আমার দিকে তাকিয়ে আহ্লাদী গলায় বললো,

“ইশুপাখি আমি যাচ্ছি তুই কিন্তু বিছানা থেকে একদম উঠবি না আর তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পর আমি সকালে এসে তোকে ডেকে দিবো ঠিক আছে”

বলে পর্বভাই আম্মুর দিকে একবার দেখলো।আম্মু জড়তা নিয়ে দাড়িয়ে আছে বেডের পাশে।আম্মু হাতের খাবারগুলো আমাকে দিয়ে বললো

“ইশু তাড়াতাড়ি খাবারটা খেয়ে নে তো মা।তারপর ঝটপট ঘুমিয়ে পর কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে তোর আপু গাঁয়ে হলুদ না কাল”

#গল্প_কিচিরমিচির
#আদিয়া_মির্জা_সানা(জ্যোতি)
#সূচণা_পর্ব

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here