কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব -০৭+৮

#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_৭
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“আপনি কী এখানে প্র্যাকটিস করতে এসেছেন?”

আচানক কোনো ছেলের কন্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকায় কুয়াশা। তার সামনে একটা ছেলে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। কুয়াশা মা থা নেড়ে বোঝায়, হ্যা! ছেলেটা আবারো বলে,

“আমিও রাজিব স্যারের কাছে প্র্যাকটিস করতে এসেছি।”

“আমি কী আপনার কাছে জানতে চেয়েছি কিছু?”

কুয়াশার এমন কথায় ছেলেটা হেসে উত্তর দেয়,

“মেয়েরা তো জানতে চায় না। কিন্তু ছেলেরা জানতে চায়।”

“মানে?”

“মানে আপনার নাম কী?”

“সেটা জেনে আপনি কী করবেন হ্যা?”

“একসাথে কাজ করতে এসেছি আর নাম জানতে হবে না?”

“না, জানতে হবে না।”

“আচ্ছা আমার নাম সাফওয়ান। আমি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছি।”

“খুব ভালো করেছেন। এখন আমি কী করতে পারি?”

“একা একা বসে থেকে খুব বিরক্ত লাগছিল। তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু পরিচিত হই।”

“একটু পরিচিত হবেন? মানে পুরোপুরি না। একটু?”

“হ্যা। আপাতত নামটুকু বললেই খুশি হব।”

কুয়াশা সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

“কুয়াশা।”

“কুয়াশা! কি সুন্দর নাম!”

আর কিছু বলার আগেই ঢাকার সনামধন্য একজন উকিল মিস্টার রাজিব হাসান নিজের ঘরে প্রবেশ করেন। কুয়াশা আর সাফওয়ান উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দেয়।

“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। বসো তোমরা।”

অতঃপর তিনজনই নিজেদের চেয়ারে বসে। রাজিব হাসান বলে,

“তোমরা আমার কাছে এসেছ কাজ শেখার জন্য।”

“জি স্যার।”

“আগামী ছয় মাস তোমরা আমার সাথে থাকবে। এই ছয় মাস নিজেদের সমস্ত মনোযোগ কাজে দিতে হবে। উকিল হওয়া যতটা সহজ মনে হয়, ততটা সহজ নয় এই পেশা। সৎ পথে থেকে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য নিজেদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। কি পারবে তো?”

“নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।”

কুয়াশার সাথে সাথে সাফওয়ানও একই সুরে বলে,

“অবশ্যই পারব স্যার।”

রাজিব হাসান তাদের দু’জনকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে দিতে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় হয়ে যায়। অনেক্ক্ষণ যাবত কোনো কিছু না খাওয়ার ফলে কুয়াশার এখন প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। সে বাইরে বের হয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে চলে যায়। ফাঁকা জায়গা পেয়ে সেখানে বসার একটু পরেই সাফওয়ান এসে হাজির। কুয়াশা আপনমনে বিরবির করে বলে,

“এই ছেলে আমার পেছনে এমন আঠার মতো লেগে আছে কেন! কি যে বিরক্ত লাগছে আমার। এমন গায়ে পড়া স্বভাবের ছেলে দেখলে ঠাস করে দুইটা লাগিয়ে দিতে ইচ্ছা করে।”

নিজের মনে কথাটা বলে এবার সাফওয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“আচ্ছা আপনার সমস্যা কী? আমার পেছন পেছন এখানে চলে এসেছেন কেন? আর কোনো জায়গা নেই নাকি?”

“আরে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি তো খাবার খেতে এসেছি এখানে।”

“তো আরো অনেক ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে গিয়ে বসুন।”

“এখানে তো আর কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। আপনিই চারপাশে তাকিয়ে দেখুন।”

কুয়াশা এবার চারপাশে তাকিয়ে খেয়াল করে দেখে সত্যিই বাকি জায়গাগুলোতে মানুষ আছে। একমাত্র কুয়াশার পাশের চেয়ার ফাঁকা। কুয়াশা সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,

“বসুন।”

সাফওয়ান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে বসে। সে ভেবেছিল কুয়াশা তাকে বসতেই দিবে না। কিছুক্ষণ পর ওয়েটার মেনু কার্ড দিয়ে যায় তাদেরকে। সাফওয়ান জিজ্ঞেস করে,

“কী খাবেন?”

“আমাকে মেনু কার্ড দিন। আমি দেখে নিচ্ছি।”

অগত্যা সাফওয়ান কুয়াশার হাতে মেনু কার্ড দিয়ে দেয়। কুয়াশা নিজের জন্য একটা হোয়াইট সস পাস্তা এবং একটা সাব স্যান্ডউইচ অর্ডার করে। সাফওয়ান একটা প্ল্যাটার অর্ডার করে। ওয়েটার যাওয়ার সময় বলে যায় খাবার আসতে বিশ মিনিটের মতো সময় লাগবে।

কুয়াশা চুপচাপ বসে ছিল। এমন সময় তার ফোনে কল আসে। রায়াদ কল দিয়েছে। কুয়াশা ফোন নিয়ে একপাশে এসে কল রিসিভ করে।

“বলুন কেন কল দিয়েছেন?”

“কুয়াশা আমি কালকের ব্যবহারের জন্য দুঃখিত। আসলে ওই সময় আমার মা থ ঠিক ছিল না।”

“আমি কিছু মনে করিনি। দুই বছর এসব সহ্য করতে করতে অভ্যস্ত তো এখন আমি।”

“এবারের মতো মাফ করে দাও আমাকে।”

“হ্যা, আমি তো দয়ার সাগর নিয়ে বসে আছি। সবাই আমাকে কষ্ট দিবে। তারপর মাফ চাইবে। আর আমি আমার দয়ার সাগর থেকে কিছুটা দয়া তুলে তার হাতে দিয়ে বলব, যাও তোমাকে দয়া করে মাফ করে দিলাম।”

“এভাবে বলছ কেন?”

“তো আর কীভাবে বলব?”

“আচ্ছা শোনো আমি দেখা করতে চাই তোমার সাথে।”

“একদম না।”

“জরুরি কথা আছে তোমার সাথে।”

“যা জরুরি কথা আছে সেটা ফোনেই বলুন। নয়তো বলতে হবে না।”

“আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই কুয়াশা।”

“লজ্জা করে না আপনার? একজন বিবাহিত মেয়েকে এসব কথা বলছেন।”

“তুমি তো তুরাবের কাছে ভালো নেই।”

“কে বলেছে আপনাকে এই কথা? আমি আমার স্বামীর সাথে খুব ভালো আছি। আপনারও তো বিয়ের বয়স হলো। এবার নিজেও বিয়ে করুন। আর বউ নিয়ে সুখে থাকুন। অন্যের বউয়ের দিকে নজর দিয়ে নিজের চরিত্র খারাপ কেন করছেন?”

“তুমি ভেবে বলছ তো এসব?”

“অবশ্যই ভেবেই বলছি। আমি আপনার মতো যখন যা মুখে আসে তখন সেটাই দুম করে কাউকে বলি না। যে ছেলে সম্পর্কে থাকাকালীন আমাকে অপমান, মানসিক অশান্তি, কষ্ট, চোখের পানি, এসব ছাড়া কিচ্ছু দেয়নি সেই ছেলেকে আমি কোন দুঃখে বিয়ে করব?”

“ভেবেছিলাম তোমাকে আরো একটা সুযোগ দিয়ে একসাথে থাকব। কিন্তু তুমি তো এসব চাও না। বোনের প্রাক্তন এত সুখ দিল যে আমাকে এখন তিক্ত লাগছে?”

“ভদ্রভাবে কথা বলুন। অবশ্য আপনার মতো লাগামহীন ছেলের কাছে ভদ্রতা আশা করা বোকামি। শুনুন, আমি নিজেকে শেষ করে দিলেও কখনো আপনার কাছে যাব না। আপনার মতো মানুষের সাথে থাকা যায় না। অন্তত আপনার থেকে তুরাব অনেক ভালো। মেয়েদের সম্মান করতে জানে। আপনি তো সেটাও জানেন না।”

“মুখ সামলে কথা বলো কুয়াশা।”

“সত্যি কথা গায়ে লাগছে খুব তাইনা? আপনি আর কখনো আমাকে কল দিবেন না। ভুলে যান আমাকে। আর যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে করে নিন। ওহ্ ভালো কথা, বউকে সম্মান এবং ভালোবাসা দিয়ে যত্ন করে রাখবেন কেমন? আমাকে তো অসম্মান আর অবহেলা ছাড়া কিছু দিতে পারেননি। তাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবেন আশা করি। ভালো থাকবেন।”

বরাবরের মতোই রায়াদকে কিছু বলতে না দিয়ে কুয়াশা কল কেটে দিয়ে নাম্বার ব্লক করে দেয়। এই অশান্তি আর ভালো লাগছে না তার। সব অশান্তি যেন তার জীবনে এসে ভীড় করেছে।

“বোনের প্রাক্তনকে বিয়ে করে আমার জীবন অর্ধেক শেষ। এখন নিজের প্রাক্তনকে বিয়ে করলে আমার পুরো জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে। এক ভুল বারবার আমি কখনোই করব না।”

কথা বলা শেষ করে নিজের চেয়ারে বসার পর সাফওয়ান বলল,

“ভালোবাসার মানুষ কল দিয়েছিল নাকি?”

“এটা জানা কী আপনার খুব জরুরি?”

“সেটা কখন বললাম আমি?”

“ভালোবাসার মানুষ থাকলে তো কল দিবে।”

“আপনার কেউ নেই? এটা তো বিশ্বাস করার মতো কথা হতে পারে না।”

“আপনি বিশ্বাস করবেন নাকি করবেন না এটা আপনার ব্যাপার। এখন আপনার এই বকবক একটু থামান।”

“বিরক্ত হচ্ছেন?”

“জি বিরক্ত হচ্ছি আমি।”

“আমি কথা বলতে ভালোবাসি। অনেক্ক্ষণ কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকতে পারি না আমি।”

এই কথাটা শুনে কুয়াশার মন খারাপ হয়ে যায়। একটা সময় সে নিজেও প্রচুর কথা বলত। কথা বলতে বলতে সবাইকে পাগল বানিয়ে ফেলত। অথচ পরিস্থিতির চাপে আজ সে নিশ্চুপ।

কুয়াশা সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,

“কথা বলতে ভালোবাসেন আপনি?”

“হ্যা ভীষণ।”

“কথা বলা মানুষগুলো হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে গেলে একদম ভালো লাগে না। আপনি কথা বলুন। আমার কোনো সমস্যা নেই।”

যে মেয়েটা একটু আগেই চুপ থাকতে বলছিল তার মুখে এমন কথা শুনে খানিকটা অবাক হলেও কথা বলার অনুমতি পেয়ে খুশি হয়ে যায় সাফওয়ান। কুয়াশা তার মুখে এমন হাসি দেখে নিজেও মুচকি হাসে।
#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_৮
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“তুরাব ভাইয়া একটা দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছে কুয়াশা।”

প্র্যাকটিস শেষে বাড়ি ফেরার পথে মলির কল আসে কুয়াশার ফোনে। মলির মুখে এমন কথা শুনে কুয়াশা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কিছুটা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কী বলছিস তুই এসব? কীভাবে হলো এটা?”

“ভাইয়া নাকি কোনো একটা মেয়ের সাথে হোটেলে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার সময় গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খুব বাজেভাবে আহত হয়েছে সে।”

“ওর সাথে সেই মেয়েও ছিল?”

“তা সঠিক জানি না। আমাকে একজন বলল তুরাব ভাইয়ার অবস্থা খুব খারাপ। তাই তোকে জানালাম। তুই কী দেখতে আসবি?”

“জানি না। ভালো লাগছে না। রাখছি এখন।”

কুয়াশা বাসায় এসে হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে ভাবতে লাগে,

“আমার কি যাওয়া ঠিক হবে? কেন যাব আমি? আমি তো আর ওর বউ নই। কিন্তু আইনত আমাদের মধ্যে এখনো সম্পর্ক আছে। কী করব আমি? কী করা উচিত আমার এই মুহূর্তে?”

এতগুলো প্রশ্নের কোনে উত্তর আজ কুয়াশা খুঁজে পাচ্ছে না। আদ্রিতা কুয়াশার পাশে বসে বলল,

“কী হয়েছে? তোকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?”

“তুরাব হাসপাতালে ভর্তি আছে। ওর অবস্থা নাকি ভালো না। এখন আমি ওকে দেখতে যাব নাকি যাব না সেটাই ভাবছি।”

“মন কেমন করছে? অস্থির অস্থির লাগছে?”

“হুম।”

“তাহলে আমি বলব একবারের জন্য হলেও তুই তুরাব ভাইকে দেখে আয়।”

“যাব?”

“হ্যা যাবি। কারণ ঝামেলা যার সাথে সেই তো এখন অসুস্থ। অসুস্থ মানুষের সাথে শত্রুতা হয় কী?”

আদ্রিতার কথায় কুয়াশা সিদ্ধান্ত নেয় সে যাবে তুরাবের কাছে। কোনোরকমে তৈরি হয়ে নিয়ে কুয়াশা আদ্রিতার উদ্দেশ্যে বলে,

“আমি পরশু ফিরে আসব ইনশাআল্লাহ। তুই সাবধানে থাকিস।”

“সাবধানে যা। আর শোন, চিন্তা করিস না। তুরাব ভাইয়ের কিছু হবে না।”

কুয়াশা মলিন হেসে বের হয়ে যায়। তুরাব যেমনই হোক, বেলা শেষে ওই মানুষটা কুয়াশার স্বামী। তার ক্ষতি হলে অস্থির তো লাগবেই। রাত দশটার বাস ধরে কুয়াশা রওনা হয় বগুড়ার উদ্দেশ্যে। তুরাব কুয়াশাকে নিয়ে বগুড়াতেই থাকত। যদিও সে বগুড়ার স্থানীয় কেউ নয়। বাসে উঠে কুয়াশা মলিকে ফোন দেয়।

“হ্যা কলি বল।”

“আমি বগুড়া আসছি।”

“কবে?”

“আজই?”

“এত রাতে তুই একা একা বগুড়া আসছিস কেন?”

“তুরাবকে দেখার জন্য।”

“ওকে দেখার জন্য আজকেই আসতে হবে? আগামীকাল আসলে হতো না?”

“বাদ দে এসব। তুরাব কোন হসপিটালে আছে সেটা বল।”

“পপুলারে আছে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। ওহ্ শোন, তুরাবের সাথে এখন কে আছে সেটা জানিস?”

“ওর বন্ধুবান্ধব, পরিবারের মানুষজন সবারই তো থাকার কথা। আমি সঠিক জানি না।”

“ব্যাপার না। আমি এখন রাখছি। আগামীকাল তুই আমাদের বাড়িতে আসিস। প্রায় মাস খানেক হলো আমাদের দেখা হয় না।”

“আসবোনি।”

“এখন রাখি।”

“আচ্ছা।”

ফোন ব্যাগে রেখে ব্যাগ বুকের মধ্যে আগলে নিয়ে ঘুমিয়ে যায় কুয়াশা। ভোর আনুমানিক পাঁচটার দিকে বগুড়ায় এসে পৌঁছায় সে। নিজের বাড়িতে না গিয়ে সোজা পপুলারে চলে যায় তুরাবকে দেখার জন্য। এই হাসপাতালেই তুরাব এখন ভর্তি আছে।

“এখানে তুরাব তৌহিদ নামের যে ছেলে ভর্তি আছে সে কত নাম্বার রুমে আছে?”

রিসিপশনে এসে প্রশ্নটা করতেই রিসিপশনে বসে থাকা মেয়েটা লিস্ট চেক করে বলল,

“৩১২ নাম্বার রুমে আছে।”

“ধন্যবাদ।”

কুয়াশা ৩১২ নাম্বার রুমের সামনে গিয়ে দেখে সেখানে আপাতত কেউ নেই। কুয়াশা খুশিমনে বলে,

“ভাগ্যিস এখানে কেউ নেই। আমি চাই না কেউ আমাকে দেখে ফেলুক।”

কুয়াশা ধীর পায়ে তুরাবের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ভেতরে যাবে কি যাবে না এই ভেবে বেশ কিছুক্ষণ পর ভেতরে প্রবেশ করে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, মা থা য় ব্যান্ডেজ, হাতে ক্যানোলা দেওয়া ছেলেটাকে দেখে কুয়াশার চোখের কোণে পানি জমা হয়। সেই পানি চোখ থেকে পড়তে দেয় না সে। শুকনো মুখে তুরাবের কাছে এগিয়ে যেতেই একজন নার্স এসে কুয়াশা জিজ্ঞেস করে,

“আপনি কে? এত সকালে এখানে কী করছেন?”

কুয়াশা মলিন কন্ঠে উত্তর দেয়,

“আমি তুরাবের স্ত্রী। আমি বগুড়ার বাইরে ছিলাম। আজকেই এসেছি। ওকে দেখার জন্য অস্থির লাগছিল। তাই এত সকালে এসেছি। দুঃখিত আমি।”

“এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। আপনি এখন বাইরে যান।”

“আচ্ছা তুরাব ভালো হয়ে যাবে তো? ওর কী খুব বড়ো ক্ষতি হয়েছে?”

“আসলে ওনার অবস্থা গতকাল রাতেও আশঙ্কাজনক ছিল। কিন্তু এখন আশঙ্কা কিছুটা কম। আশা করা যায় উনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন।”

“আচ্ছা আমি এখন আসছি। ভিজিটিং আওয়ারে এসে আমি ওকে দেখে যাব।”

কথাটা বলে এক পলক তুরাবের দিকে চেয়ে বের হয়ে আসে কুয়াশা। বাড়িতে যাওয়ার জন্য একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে সেখানে।

দরজায় কড়া নাড়ানোর আওয়াজ পেয়ে ঘুমঘুম চোখে বাড়ির সদর দরজা খুলে মেয়েকে সামনে দেখে মিসেস নাহার অবাক হয়ে বলেন,

“তুমি এত সকালে? কিছু হয়েছে মা?”

“না না কিছু হয়নি। তোমাদের কথা মনে পড়ছিল তাই চলে এলাম।”

“আচ্ছা ভেতরে এসো। তুমি ঘরে যাও। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নাও। আমি তোমার জন্য কফি বানিয়ে আনছি।”

“আহা মা তুমি এত অস্থির হয়ো না তো। আমার কিছু লাগবে না এখন। তুমি আমার পাশে বসো।”

মিসেস নাহার মেয়ের পাশে বসে আলতো হাতে মেয়ের মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,

“আমার মেয়েটা অনেক শুকিয়ে গিয়েছে৷ ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করো না তুমি ওখানে।”

“তোমার চোখে আমি মোটা ছিলাম কবে?”

“আগের থেকেও শুকনা লাগছে।”

“হয়েছে থাক আর বলতে হবে না। আমি মোটা হলেও তোমার চোখে সেই চিকনই থেকে যাব। আচ্ছা বাবা আর ভাই কোথায়? কেমন আছে সবাই?”

“সবাই ভালো আছে। কিন্তু তুমি ঠিক আছ তো?”

“আমি একদম ঠিক আছি। মা আমি এখন ঘরে যাচ্ছি। আর শোনো, দুপুরের রান্না আজ আমি করব। অনেক দিন হলো তোমাদের আমার হাতে রান্না করা খাবার খাওয়াতে পারিনি।”

“ঠিক আছে। আমি সকালের খাবার বানিয়ে নিই তাহলে।”

বেলা বাড়তে থাকে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে কুয়াশার মন অস্থির হতে শুরু করে দ্বিগুণ হারে। কিছুই ভালো লাগছে না তার। সকালের খাবার পরিবারের সাথে খেয়ে সে এখন রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

“তুরাব অসুস্থ। ভারি খাবার খেতে পারবে না। ওর জন্য হালকা কিছু রান্না করে নিয়ে যাই।”

নিজ মনে বিরবির করতে করতে রান্না করছে কুয়াশা। মিসেস নাহার পাশ থেকে বললেন,

“তুমি তুরাবের খবর শুনে ছুটে এসেছ এখানে। ঠিক বললাম না?”

মায়ের কথায় কুয়াশা হেসে বলে,

“আমার মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই তুমি বুঝে যাও। মায়েরা বুঝি এমনই হয়!”

“তুরাবকে ভালোবাসো?”

“সে আমার স্বামী। আমরা আলাদা থাকলেও তার প্রতি আমার একটা টান আছে। সেই টান থেকেই ছুটে এসেছি। এর বাইরে আর কিছুই না।”

“মায়ের কাছে লুকাচ্ছ?”

“সত্যি বলছি আমার তুরাবের প্রতি আলাদা আর কোনো অনুভূতি নেই। আমি প্রথম ভালোবেসেছিলাম রায়াদকে। ওকে মারাত্মক রকমের ভালোবেসে যখন ঠকে গেলাম তখন থেকেই ছেলেদের প্রতি বিশ্বাস কমতে শুরু করে আমার। এরপর তুরাবের প্রতি অনুভূতি জন্মাতে কয়েক মাস সময় লেগে যায়। ওর থেকেও ঠকে যাওয়ার পর আমার মধ্যে তেমন কোনো অনুভূতি আজকাল কাজই করে না। হয়তো আমি অনুভূতিহীন হয়ে যাচ্ছি!”

রান্না শেষ করে মায়ের সাথে আর কোনো কথা না বলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় কুয়াশা। হাসপাতালে গিয়ে একজন নার্সের হাতে খাবারের বাটি দিয়ে বলে,

“দুপুরে তুরাবকে এই খাবার খেতে দিবেন। আর এটা যে আমি রান্না করেছি সেটা ওকে বলার দরকার নেই। বলবেন হাসপাতালের খাবার এটা।”

“মিথ্যা বলব কেন?”

“আমি অনুরোধ করছি। দয়া করে ওকে বলবেন না যে আমি এখানে এসেছিলাম।”

নার্সকে রাজি করিয়ে সে আরেক পলক তুরাবকে দেখে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসে।

“যে সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই সেই সম্পর্কে মায়া বাড়ানোর থেকে ধীরে ধীরে যতটুকু মায়া তৈরি হয়েছে সেটুকুও নষ্ট করে দেওয়ায় শ্রেয়!”

চলবে??
চলবে??

বিঃদ্রঃ আমি ভীষণ অসুস্থ। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন। গল্প দিতে না পারলে আমার নিজেরও খারাপ লাগে। গতকাল গল্প না দেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। 💙

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here