কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব -০৫+৬

#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_৫
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“কুয়াশা তোর বরকে আজ অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখলাম। দেখে মনে হচ্ছিল ওরা যেন স্বামী-স্ত্রী। নিজের বরকে একটু আগলে রাখতে পারিস না?”

ট্রেনে বসে থাকতে থাকতে কুয়াশার চোখ কিছুটা লেগে এসেছিল। এমন সময় তার ফোনে কল আসে মাইশার। মাইশা কুয়াশার কলেজ জীবনের বান্ধবী। প্রথমত কুয়াশার কাঁচা ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তার উপর মাইশার মুখে এমন কথা শুনে কুয়াশার মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

“মাইশা তোর কী আর কোনো কাজ নেই বোন?”

“মানে?”

“মানে আমার বর কার সাথে ঘুরছে না ঘুরছে এসব দেখেছিস ভালো কথা। সেটা আবার আমাকে বলার কী আছে?”

“ওমাহ্ তোর বর এসব করে বেড়াচ্ছে, আর আমি তোর বান্ধবী হয়ে তোকে জানাব না?”

“না রে বান্ধবী জানাতে হবে না।”

“কেন?”

“কারণ ওর যা ইচ্ছা করুক। আমার তাতে কিছুই যায় কিংবা আসে না। আমরা এখন আলাদা থাকি।”

“তুরাব ভাইয়ার এই চরিত্রের জন্যই কী তোরা আলাদা হয়ে গিয়েছিস?”

“কেন আলাদা হয়েছি সেটা নাহয় অজানা থাকুক।”

“ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে নাকি তোদের?”

“না, আমাদের ডিভোর্স হয়নি।”

“এমন সম্পর্কে থেকে কী করবি? বের হয়ে আয়।”

“ডিভোর্স কী এত সহজ? আচ্ছা তুই আমাকে একটা কথা বল, এই সমাজে ডিভোর্সি মেয়েদের ভালো চোখে দেখা হয় কী? জানি তুই এখন বলবি যে একজন আইনের ছাত্রী হয়ে এমন কথা আমাকে মানায় না। কি করব বল? সমাজের সবার কথা মানি বা না মানি, কিছু কিছু কথা একদম বুকে এসে লাগে। আজ আমি তুরাবকে ডিভোর্স দিব। আগামীকাল থেকেই আমার নামের পাশে ডিভোর্সি তকমা লাগবে। দোষ আমার না হলেও দোষী আমাকেই বানাবে সবাই। এমনিতেই অনেকের অনেক কিছু সহ্য করেছি। আর পারব না আমি। আমাকে দেখিয়ে সবাই বলবে আমি একজন ডিভোর্সি। এক বছরও স্বামীর সংসার করতে পারিনি। স্বামীকে আটকে রাখতে পারিনি। অক্ষমতা আমার এবং শুধুমাত্র আমারই। ছেলেদের দোষ দেখে কয়জন?”

কুয়াশার কথাগুলো শুনে মাইশা চুপ হয়ে যায়। কুয়াশা আবারো বলে,

“জানিস? আমিও না স্বামীর সংসার করতে চেয়েছিলাম। মজার বিষয় হলো বিয়ের পর আট মাস খুব সুখেই সংসার করেছি। কিন্তু যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে থাকা সম্ভব নয়। আট মাস পর বুঝলাম আমি যেটাকে ভালোবাসা ভেবেছি সেটা আসলে মিথ্যা অভিনয়। হ্যা, আমরা আলাদা হয়েছি। সে আমাকে ডিভোর্সও দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমি ডিভোর্স চাই না এখন। ডিভোর্স আমি তখনই দিব যখন বুঝতে পারব আমার গায়ে আর মিথ্যা অপবাদ লাগবে না। অতিরিক্ত কঠোর অথবা সমাজের চোখে নিজের অবস্থান দৃঢ় করে তবেই আমি তুরাবকে ডিভোর্স দিব। তার আগে নয়। অতিরিক্ত কঠোর এজন্য হতে হবে যেন সমাজের মানুষের বিষাক্ত তীরের মতো কথাগুলো হজম করার সহ্য ক্ষমতা তৈরি হয় আমার মধ্যে। কথার আঘাতের চেয়ে তীব্র এই ত্রিভুবনে আর কিছুই হতে পারে না। তা হজম করার শক্তি এখনো হয়নি আমার।”

“তোর অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। কিছু মনে করিস না কুয়াশা। আমি হয়তো তোর ক্ষত বাড়িয়ে দিলাম।”

“এটা তো কেবল শুরু। আজ তুই কল দিলি। কাল আরো দশজন কল দিয়ে হরেকরকম কথা বলবে। আমি আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। সমস্যা নেই আমার।”

“আচ্ছা ট্রেনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি মনে হয়। তুই কোথায়?”

“আমি ঢাকায় যাচ্ছি।”

“কেন?”

“পরিপূর্ণ উকিল হওয়ার জন্য।”

“বাহ্ এটা তো দারুণ খবর। শুভকামনা রইল তোর জন্য। সাবধানে থাকিস দোস্ত। আর মাঝেমধ্যে একটু কথা বলিস। তোকে তো অনলাইনে খুব বেশি পাওয়া যায় না।”

“সমস্যা নেই। আমি তোর সাথে যোগাযোগ করব।”

“আচ্ছা আমি এখন রাখি। পরে কথা হবে ইনশাআল্লাহ।”

“ভালো থাকিস মাইশা। আল্লাহ হাফেজ।”

“আল্লাহ হাফেজ।”

কথা শেষ করে ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে কুয়াশা আনমনে ভাবে,

“আমাদের সমাজ তৈরি হয়েছে আমাদের মানুষদের নিয়েই। অথচ সেই সমাজ ছেলেদের দোষ হলে বলে দুষ্টুমি। আর মেয়েদের সামান্য দোষও কত বড়ো করে দেখা হয়। আজ আমাকে সবাই বলছে ডিভোর্স দিতে। অথচ এই মানুষগুলোই পরবর্তীতে আমাকে ডিভোর্সি বলে হাসাহাসি করবে। দুই দিন পর যদি আমি দ্বিতীয় বিয়ে করি তাহলে আমাকে বলবে, আমি আরেক জায়গায় সম্পর্ক করে এই বিয়ে ভেঙেছি। কি দরকার এত কথা শোনার। একজন মানুষের জীবনে বিয়ে সব হতে পারে না। একবার বিয়ে করে শখ মিটে গিয়েছে। আর কারোর সাথে জড়ানোর ইচ্ছা নেই। হাজার হলেও আমি বিবাহিত। বিয়ের তকমা যখন আমার গায়ে লেগেছে তখন আমার জীবন কিছুটা হলেও জটিল এখন এটা মেনে নিতে হবে আমাকে। অনেকের কাছে বিয়ে খেলার অংশ হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে বিয়ে মানে অনেক কিছু। পবিত্র সম্পর্ককে যারা কলুষিত করেছে তাদের শাস্তি পেতে হবে। অন্যায়ের কোনো ক্ষমা হয় না। অন্তত আমার কাছে তো একদমই না।”

দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার ট্রেন ভ্রমণ শেষে কুয়াশা ঢাকায় পৌঁছায়। এই শহর তার খুব চেনা। প্রায় সাড়ে চার বছর সে এই শহরে থেকেছে। বন্ধুবান্ধবের সাথে হুটহাট ঘুরতে যাওয়া, ফুলের দোকানের সামনে গিয়ে কয়েকজন বান্ধবী মিলে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে ছবি তোলা, শাড়ি পড়ে রাতের শহরে পায়ের ছাপ ফেলা, সন্ধ্যায় চায়ের দোকানের সামনে চা পান করতে করতে গল্প করা কিংবা গভীর রাতে কষ্ট ভোলার জন্য খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কখনো কান্না কখনো হাসি আবার কখনো বিষন্ন চাহুনি নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে একা একা কথা বলা, এই সবকিছুর সাথে কুয়াশার পরিচয় হয়েছে এই শহরে আসার পরেই।

সময়গুলো মনে করে লম্বা শ্বাস টেনে কফির কাপে চুমুক দেয় কুয়াশা। রাত এখন প্রায় দশটা। কুয়াশা একা বসে আছে ছাদে। মন খারাপের সময়গুলোতে ছাদে এসে কফির কাপে চুমুক দেওয়া আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা বহু পুরোনো স্বভাব তার।

হঠাৎ ফোন বেজে উঠলে ঘোর কাটে কুয়াশার। ফোন হাতে নিতেই চমকে যায় সে। এই নাম্বার তার চেনা। ভীষণ চেনা! এতগুলো দিন পর এই নাম্বার থেকে কল আসাতে সে ভীষণ অবাক হয়েছে। কারণ এই নাম্বার থেকে আর কখনে কল আসবে এটা ভাবাও বারণ ছিল কুয়াশার। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করে সে। কিন্তু কোনো কথা বলে না। দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার পর অপর পাশ থেকে কেউ একজন বলে,

“কেমন আছ কুহু?”

কুয়াশার পুরো নাম কুয়াশা তাসমিম কুহু। কুহু নামে তাকে অল্প কয়েকজন ডাকে। তার মধ্যে অন্যতম হলো রায়াদ। কুয়াশা রায়াদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বসে।

“কেন কল দিয়েছেন আপনি আমাকে?”

“কেন? আমার কী কল দেওয়া বারণ?”

“অবশ্যই। কারণ আমি এখন বিবাহিত।”

“জানি আমি। এমনটা কেন করলে তুমি আমার সাথে?”

“আমি আপনার সাথে কিছুই করিনি। বরং আপনি আমার ভালো থাকা কেড়ে নিয়েছিলেন।”

“নিয়েছিলাম? তার মানে এখন তুমি ভালোই আছ। তা বোনের প্রাক্তনকে নিয়ে খুব সুখেই আছ মনে হয়।”

“আপনি কী আমাকে খোঁচা দেওয়ার জন্য কল দিয়েছেন?”

“না, আমি তোমাকে এটা জানানোর জন্য কল দিয়েছি যে আমি ভালো নেই কুহু। তোমাকে ছাড়া আমি একদম ভালো নেই।”

“নিজেই তো সম্পর্ক শেষ করেছেন। এখন ভালো নেই কেন?”

“একটা ভুল আমাদের সব শেষ করে দিল।”

“কী ভুল?”

“তোমাকে ছেড়ে দেওয়া। তোমার মতো মেয়েকে ছেড়ে দেওয়া মানে নিজের সুখ বিসর্জন দেওয়া। একটা বছর হতে চলল তোমার সাথে আমার যোগাযোগ নেই। তুমি যদি আমার উপর অভিমান করে এই বিয়েটা না করতে তাহলে আজ আমরা সুখী দম্পতি হতে পারতাম।”

“এসব বলে আর লাভ নেই। যা হওয়ার সেটা তো হয়ে গিয়েছে। পুরোনো কথা মনে করার কী দরকার?”

“একবার দেখা করবে?”

“কেন?”

“দয়া করে না করো না। তুমি তো আমার সব কথা শুনেছ। শেষবারের মতো অনুরোধ করছি। একবার দেখা করতে চাই তোমার সাথে।”

“আমি বগুড়ায় নেই। ঢাকায় চলে এসেছি।”

“আমিও ঢাকাতেই আছি। তুমি শুধু বলো দেখা করবে কিনা।”

“হঠাৎ আপনার আগমন কেন এটাই আমি বুঝতে পারছি না।”

“এই এগারো মাসে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে আমার সাথে। সবকিছু তোমাকে বলে একটু হালকা হতে চাই আমি।”

“ঠিক আছে। আগামীকাল সকাল দশটার দিকে দেখা করব আমরা রমনার চত্বরে।”

“ধন্যবাদ।”

“এখন কল রাখি।”

“আর একটু সময় থাকা যায় না কলে?”

“না!”

আর কিছু বলার সুযোগ পায় না রায়াদ। তার আগেই কল কেটে দেয় কুয়াশা।

চলবে??#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_৬
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“সম্পর্কে থাকাকালীন কখনো এভাবে পাশাপাশি হাঁটার সুযোগ হয়নি। অথচ আজ!”

রায়াদের কথায় কুয়াশা কিছু বলে না। চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছে সে। রায়াদ আবারো বলে,

“আমাদের সম্পর্কটা অন্যরকম ছিল। আমরা এমন এক সম্পর্কে ছিলাম যেখানে একে-অপরের হাত কখনো ধরতে পারিনি। তোমাকে ছোঁয়া যে বারণ ছিল আমার। কথা ছিল বিয়ের পর সম্পূর্ণ নিজের করে তোমাকে পাব। তার আগে কোনো স্পর্শ নয়। আমি তোমার কথা রেখেছি। তাতে লাভ কী হলো? তুমি কী আমার হলে কুহু?”

কুয়াশা এবার রায়াদের চোখে চোখ রাখে। মেয়েটার দু’চোখ যেন তার ভেতরে জমে থাকা অনেক না বলা কথা বলে দিচ্ছে তার চাহুনির মাধ্যমে।

“নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছি সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। সর্বপ্রথম নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে ভালোবাসি কথাটা বলা থেকে শুরু করে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া, সবকিছু আমিই করেছি। যেগুলো মূলত আপনার করার কথা ছিল। এরপরেও আপনার অভিযোগ একটাই। আমি আমাদের প্রায় দুই বছরের সম্পর্কের জন্য কিছুই করিনি। আমার জন্যই সম্পর্ক ভেঙেছে। সত্যি কী তাই?”

“কুহু বিশ্বাস কর সেই সময় আমি রাগের মা থা য় তোমাকে বিয়ে করে নিতে বলেছিলাম। মন থেকে একটা কথাও বলিনি আমি। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।”

“এসব শুনতে চাই না আমি। বিবাহিত মেয়েকে এসব বলতে লজ্জা করে না আপনার?”

“আমি জানি তুমি ওই তুরাবের সাথে সুখে নেই। ফিরে এসো আমার কাছে। আমি আজও তোমাকে প্রথম দিনের মতো করেই চাই।”

“মনে আছে আপনার? একদিন আপনি আমাকে বলেছিলেন যে কখনো যদি আমি নিজ ইচ্ছায় কারোর সংস্পর্শে যাই তখন আপনি আমাকে আর গ্রহণ করবেন না। আমি তুরাবের কাছে নিজ ইচ্ছাতেই গিয়েছি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যা যা হয় আমাদের মধ্যে সব হয়েছে। এরপরও গ্রহণ করবেন আমাকে?”

“তুমি নিজ ইচ্ছায় ওর কাছে গিয়েছ?”

“হ্যা নিজ ইচ্ছাতেই গিয়েছি ওর কাছে। হাজার হলেও সে আমার স্বামী তো!”

“তুমি এটা কী করে করতে পারলে?”

“আপনি যেমন আমার সাথে সম্পর্কে থাকাকালীন সময়ে অন্য মেয়ের সাথে গভীরতার সাগরে ডুব দিয়েছিলেন ঠিক সেইভাবে।”

“আমি কারোর সাথে কখনো থাকিনি। কোনো মেয়েকে স্পর্শ করিনি।”

“তা ঠিক। তবে কথা তো বেশ গভীরভাবেই বলেছেন। অনলাইনে সব হয়ে গেলে অফলাইনে আসার কী দরকার?”

“তুমি আজও একইরকম আছ। একটুও বদলাওনি নিজেকে।”

“কার জন্য বদলাব? বেইমান, বিশ্বাসঘাতকের জন্য?”

“আমারই ভুল হয়েছে তোমার কাছে এতদিন পর আবার ফিরে আসা।”

“এসেছেন কেন?”

“ভালোবাসি যে তাই।”

“ভালোবাসা! কোনটা ভালোবাসা? দিনের পর দিন মিথ্যা বলে ঠকানো আপনার কাছে ভালোবাসা? নাকি রাতের পর রাত আমাকে কাঁদিয়ে নিজে হেসেছেন সেটা ভালোবাসা?”

রায়াদ কোনোকিছু না বলে রেগে বড়ো বড়ো পা ফেলে সেই স্থান থেকে চলে যায়। কুয়াশা তাকে আটকায় না। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে। এই ছেলেটা প্রতিবার এভাবে হুট করে এসে আবার হুট করেই চলে যায়। দুই বছরের সম্পর্কে এমন প্রায় প্রতিবারই হয়েছে। পুরোনো কাজ বিধায় এখন অভ্যস্ত কুয়াশা। তার জীবনে দু’জন পুরুষ এসেছে। দু’জনই তাকে মিথ্যা বলেছে, ভালোবাসার নামে মিথ্যা অভিনয় করেছে, চোখে চোখ রেখে মিথ্যা বলেও জোর গলায় বলেছে সে মিথ্যা বলেনি। ঠকবাজ, বেইমান, বিশ্বাসঘাতক, এই শব্দগুলো রায়াদ আর তুরাবের সাথে ভালোভাবেই যায়। কুয়াশার এখন মনে হয়,

“ভালোবাসা, বিশ্বাস, ভরসা, এই শব্দগুলো কুয়াশা নামক মেয়ের জীবনে বড্ড বেমানান!”

ধীর পায়ে রমনার চত্বর থেকে বেরিয়ে আসে কুয়াশা। ব্যস্তময় শহরে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অন্যের দিকে তাকানোর সময় কারোর নেই। নতুবা সবাই দেখতে পেত একটা মেয়ের চোখের কোণে লুকিয়ে থাকা পানি কিভাবে বারংবার উপচে পড়তে চাইছে। আর মেয়েটা অনেক কষ্টে সেই পানি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

“না কুয়াশা না! তুই কাঁদবি না। তোর চোখে পানি একদম মানায় না। কাঁদলে তোকে সবাই দুর্বল ভাববে। সবাই তখন তোর কষ্ট দেখে মজা পাবে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে তোর কষ্ট বহুগুণ বাড়িয়ে তুলবে। মানুষ তো এমনই। একজন কাঁদে তো অপরজন হাসে! এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম।”

নিজেকে নিজেই বোঝাচ্ছে কুয়াশা। নিজের জন্য সে একাই যথেষ্ট। তার ভাষ্যমতে,

“পৃথিবীতে নিজের সেরা বন্ধু হিসেবে কেবল নিজেকেই পাওয়া যায়। কারণ জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু অন্য কোনো সত্তা হতে পারে না। নিজের পরিস্থিতি নিজেকেই বুঝে নিতে হয়। এবং সেই অনুযায়ী মোকাবিলা করতে হয়। আমি কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছি এটা কিছু মানুষ অনুভব করতে পারলেও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারবে না কখনোই। সম্পূর্ণ বোঝা একমাত্র নিজ সত্তার দ্বারাই সম্ভব। অন্য কারোর দ্বারা নয়। তাই নিজের প্রকৃত বন্ধু নিজেকেই হতে হবে।”

বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই কুয়াশার এক রুমমেট আদ্রিতা এসে জিজ্ঞেস করল,

“কুয়াশা তোর প্র্যাকটিস শুরু কবে থেকে?”

“আগামীকাল থেকে।”

“ওও আচ্ছা। এই শোন ঘুরতে যাবি?”

“না রে। ভালো লাগছে না আমার।”

“আরে চল না একটু আশেপাশে থেকে ঘুরে আসি।”

“একটু আগেই বাইরে থেকে এলাম। এখন আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না।”

আদ্রিতা কুয়াশাকে টেনে তুলে বলল,

“কোনো কথা শুনব না। বেশি কিছু করতে হবে না। তোকে আমিই তৈরি করে দিচ্ছি।”

অতঃপর আদ্রিতা যত্নসহকারে কুয়াশাকে তৈরি করে দিয়ে বিছানার উপর অনেকগুলো জামা রেখে বলল,

“কোনটা পড়বি বল?”

“আমার যেতেই ইচ্ছা করছে না। আর তুই জামা নিয়ে আসছিস।”

“আরে তাড়াতাড়ি বল।”

“বোরকা পড়ব আমি।”

“আচ্ছা তাহলে আমিও বোরকা পড়ি।”

দু’জন ঝটপট তৈরি হয়ে বের হয়ে গেল বাসার কাছের একটা রুফটপ রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। আদ্রিতা ফোন হাতে নিয়ে কুয়াশাকে বলল,

“ছবি তুলব। একটু সুন্দর করে হাসি দে বোন। এমন গম্ভীর হয়ে বসে আছিস কেন?”

“আমার ভালো লাগছে না।”

“তোর ভালো লাগার জন্য এত চেষ্টা করছি। আর তুই এখনো বলছিস ভালো লাগছে না! কী করলে তোর মন একটু ভালো হবে বল আমাকে। আমি সেটাই করব।”

আদ্রিতার এমন কথায় কুয়াশা চকিত দৃষ্টিতে তাকায় আদ্রিতার দিকে। এই মেয়েটার সাথে কুয়াশার খুব বেশি দিনের পরিচয় নয়৷ হবে বছরখানেক ওর সাথে পরিচয়ের। তার মধ্যেই মেয়েটা এত ভাবছে ওর জন্য! কুয়াশা ঢাকা থেকে চলে যাওয়ার সময় আদ্রিতার ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। প্রতিদিন ফোন করে কুয়াশার খবর নিত। মাঝখানে যোগাযোগ বন্ধ থাকলেও আদ্রিতা নিজেই একদিন কুয়াশাকে কল দিয়ে কথা বলে। তারপর থেকে আবারো নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হয় তাদের মধ্যে।

এসব মনে করে কুয়াশার মুখে আপনাআপনি হাসি ফুটে ওঠে। এই সুযোগে আদ্রিতা কুয়াশার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নেয়। তারপর বলে,

“হাসলে তোকে ভারি মিষ্টি লাগে। আগে কত হাসিখুশি ছিলি তুই। এখন কী হয়েছে তোর?”

“তুই তো জানিস আমার অবস্থা!”

“হুম জানি। কিন্তু তুই তো ভেঙে পড়ার মতো মেয়ে না কুয়াশা। তোকে শক্ত হতে হবে। যারা তোকে কষ্ট দিয়ে ভালো আছে তাদের জন্য তুই কেন কষ্ট পাবি? বরং নিজেকে এমনভাবে তৈরি কর যেন একদিন তারা সবাই তোকে দেখে আফসোস করে। তোকে হারানোর জন্য আফসোস করে। নিজেকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব কিন্তু নিজেরই। অন্যের হাতে সেই দায়িত্ব ছেড়ে দিলে ভালো থাকাটাই হারিয়ে যায় কুয়াশা।”

“ঠিকই বলেছিস তুই। আমার নিজেকে ভালোবাসতে হবে। আমি যদি নিজেকেই ভালোবাসতে না পারি তাহলে অন্যরা আমাকে কিভাবে ভালোবাসবে!”

কথাটা বলে কুয়াশা নিজে থেকেই হেসে আদ্রিতার সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে যায়। হাসি না আসলেও হাসতে হবে। বেশি বেশি হাসতে হবে। যেন কান্নারা হাসির কাছে হেরে গিয়ে পালিয়ে যায় বহুদূরে!

চলবে??

বিঃদ্রঃ 💙

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here