#গল্পঃকুয়াশার মতো।
#পর্বঃ- ০২
– আপনি কি জানেন সাজ্জাদ কোন গ্রামে যাবে, বা কোন এলাকায়?
– মোহাম্মদনগর গ্রাম, এতটুকুই জিজ্ঞেস করেছি। প্রয়োজন নেই তাই আর বিস্তারিত কিছু জানতে চাই নাই।
– আমি যদি কালকে সকালে উঠে নোয়াখালীতে আসি তাহলে আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবেন ভাই?
– জ্বি আপু চেষ্টা করবো, কিন্তু অপরিচিত এখানে আপনি একা একা আসতে পারবেন?
– আমি আমার পরিচিত কোন বন্ধু নিয়ে আসবো, নাহলে আমার বোনকে সাথে নিয়ে আসবো।
– ঠিক আছে চলে আসুন, আমি যতদূর পারি সেই ভাইয়াকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করবো।
– আচ্ছা ঠিক আছে ভাই।
রান্না ঘরের মধ্যে বিশাল একটা শব্দ হলো, সমস্ত ফ্ল্যাট কাঁপিয়ে আওয়াজ শোনা গেল। রাতের এই নিস্তব্ধ পরিবেশে কেমন যেন ভয় করতে লাগলো। রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম, একটা কালো বিড়াল দৌড়ে বের হয়ে গেল। আশ্চর্য, এখন এই বিড়াল কীভাবে এসেছে?
সাজ্জাদের বন্ধু সজীব ভাইকে কল দিলাম, এতো রাতে বিরক্ত করতাম না। কিন্তু যেহেতু তিনি বিয়ে করেননি তাই সমস্যা হবে না, কেননা তার বিয়ে হলে এতো রাতে একটা মেয়ে হয়ে কল দিতে সাহস পেতাম না।
– আসসালামু আলাইকুম ভাবি!
– ওয়া আলাইকুম আসসালাম, সজীব ভাই আমি দুঃখিত বিরক্ত করার জন্য।
– ছি ছি লজ্জা দিচ্ছেন কেন? আমিই কল দিতাম কিছুক্ষণ পড়ে। বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে গেছে ভাবি, সাজ্জাদ নেই তাই সবকিছু আমাকেই করা লাগে। সাজ্জাদ যখন ছিল তখন সারাদিন আমার তেমন কিছুই করতে হতো না। মুহূর্তের মধ্যে সে কীভাবে যেন সবকিছু করে ফেলতো, কাজের জন্য সাজ্জাদ সিনিয়র জুনিয়র সবার কাছে খুব প্রিয়।
– সাজ্জাদ নোয়াখালী গেছে সজীব ভাই।
– বলেন কি? কীভাবে জানলেন, আপনার সঙ্গে কথা হয়েছে সাজ্জাদের?
আমি সংক্ষিপ্ত করে সবকিছু বললাম। সজীব ভাই অবাক হয়ে গেল, তিনি হয়তো ধারণা করতে পারে নাই সাজ্জাদ এতদূর চলে গেছে।
” বললাম, সজীব ভাই আমি আগামীকাল সকালে উঠে নোয়াখালী যেতে যাই। আপনি আমার জন্য একটা ব্যবস্থা করে দিবেন, আপনি যেহেতু অফিস রেখে যেতে পারবেন না। নাহলে আপনাকেই সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম সজীব ভাই। ”
” ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা করবো, একাই যাবেন নাকি সঙ্গে কাউকে নিবেন? ”
” একাই যাবো, কতদিন কি লাগে তা তো জানি না আর সেখানে যদি কোনো সমস্যা হয়। তাই যা কিন্তু হোক সেটা আমি একাই ভোগ করতে চাই, কাউকে নেবো না। ”
” ঠিক আছে, সমস্যা হলে আমি তো আছি, কোন বিপদ হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবেন। ”
কল দিয়ে বিছানায় বসে ভাবছি, আজকের রাতটা পার করতে কতটা কষ্ট হবে জানি না। অপেক্ষার রাত হয়তো অনেক দীর্ঘ হয়, কিন্তু সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে যদি ভালো কিছু পাওয়া যায় তবে আফসোস থাকে না।
মোবাইলে সুমনা কল দিয়েছে।
” আপু অনেকক্ষণ ধরে তোমার নাম্বার ব্যস্ত পাচ্ছি কেন, কি করো তুমি? ”
” সেই নোয়াখালীতে কথা বললাম, তারপর তোর দুলাভাইয়ের বন্ধুর সাথে কথা বললাম। ”
” আপু বাসায় তো বিশাল কান্ড, বাবা বাসায় এসে দেখে তুমি বাসায় নেই। তারপর যখন তোমার চলে যাবার কথা শুনেছে তখন সঙ্গে সঙ্গে রাগ করে চলে গেছে তোমার বাসার দিকে। এতক্ষণে হয়তো পৌঁছে যাবার কথা, বাবার সঙ্গে অনেক হিসাব করে কথা বলবে। তুমি কিছুতেই আসবে না, আমি তোমাকে কিছু গোপন কথা বলবো। দুলাভাইকে বাবা একদম সহ্য করতে পারে না এর পিছনে খুব বড় ধরনের কারণ আছে। ”
” কি কারণ? ”
” সাক্ষাতে বলবো, তুমি আপাতত বাবাকে কি কি বলবে সেটা সাজিয়ে রাখো। ”
” আচ্ছা। ”
কল কাটতেই কলিং বেল বেজে উঠল, দরজার ছিদ্র দিয়ে বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি আস্তে আস্তে দরজা খুলে দিলাম। রুমের মধ্যে প্রবেশ করেই বাবা বললো,
” এসব কি ধরনের আচরণ শাকিলা? নিজে যা ইচ্ছে তাই শুরু করেছো? ”
” বাবা উত্তেজিত হবার মতো কিছু হয়নি, আমার বাসায় আসার ব্যাপারে তোমাকে নিষেধ করেছি। মা তোমাকে বলেনি কিছু? ”
” তুই নিষেধ করলে শুনবো নাকি? আমি তোকে জন্ম দিয়েছি নাকি তুই আমাকে জন্ম দিয়েছ? ”
” বাবা তুমি কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছো না, আমি কোথাও যাবো না। তুমি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে এখান থেকে চলে যাও, নাহলে…! ”
” নাহলে কি? তুই জানিস তোদের ডিভোর্সের সবকিছু ঠিক করা হয়েছে। সাজ্জাদের মতো এক ছোটলোকের চেয়ে অনেক ভালো পরিবারে তোর বিয়ের কথাও চলছে অলরেডি। ”
” আমি সামান্য হাসলাম। ”
” হাসলি কেন? মজা লাগে আমার কথা? আমার যে অপমান হবে সেটা উপভোগ করতে খুব মজা লাগবে তাই না? ”
” বাবা শোনো, ‘কোথাও কেউ নেই’ উপন্যাসের মধ্যে মুনা তার মামাতো বোন বকুললে একবার বলেছিল ” পৃথিবীতে অনেক খারাপ পুরুষ আছে কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই। ”
” তো কি হয়েছে? ”
” তুমি নিজেই নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে দেখো তো, পৃথিবীতে যদি ভালো বাবাদের লিস্ট করা হয় তাহলে সেখানে তোমার নাম পাবে? ”
” তোর কি ধারণা আমি খুব খারাপ বাবা? ”
” হ্যাঁ কিছুটা। ”
” কেন, কি করেছি আমি? তোর সুখের জন্য সব করতে পারি সেজন্য অপরাধী আমি? ”
” আমার সুখের জন্য মানে? বলো যে তোমার স্বার্থ হাসিলের জন্য তুমি আমাকে ব্যবহার করেছো। নিজের স্বার্থের জন্য তুমি আমাকে ব্যবহার করে উপরে উঠতে চাও বাবা। ”
” কি বলতে চাস তুই? ”
” সাজ্জাদের সঙ্গে তুমি আমার বিয়ে দিয়েছিলে কারণ তোমার অনেক অফিশিয়ালি দুনম্বরি কাজ করাতে পারবে বলে। কিন্তু বিয়ের পড়ে যখন তুমি দেখতে পেলে সাজ্জাদ আত্মীয়স্বজনের চেয়েও সৎ থাকাটা গুরুত্ব দেয়৷ তখন তুমি আফসোসে পুড়তে লাগলে, তারপর থেকে তুমি আমাদের আলাদা করার ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করলে। ”
” ফালতু কথা একদম বলবি না। ”
” তুমি এখন আবার আমার বিয়ে ঠিক করছো, নিশ্চয়ই সেখানে আরও বড় স্বার্থ আছে। ”
” সাজ্জাদের বাচ্চা তোর মগজটা একদম নষ্ট করে দিয়েছে, ওকে যদি একবার হাতের কাছে পাই তবে খুন করে দেবো। ”
” সাজ্জাদের বাচ্চা নয়, সাজ্জাদ। সাজ্জাদের কিন্তু এখনো বাচ্চা হয়নি, যদি হয় তাহলে তুমিও নানা হতে পারবে। ”
” রাগে শরীর জ্বলছে তুই মজা নিস? ”
” মোটেই না, সত্যি বললাম। ”
” আমিও সত্যিই বলছি, ওকে যদি আমি চোখের সামনে পাই তাহলে খুন করে দেবো। আমার অনেক ক্ষতি করেছে ও, ভেবেছিলাম তোকে ওর থেকে ডিভোর্স করিয়ে তারপর একটা বড় ধরনের ব্যবস্থা করবো। কিন্তু এখন তো তার আগেই করা দরকার, তোকেও সে কেড়ে নিয়েছে। ”
বাবা গজগজ করতে করতে বের হয়ে যাচ্ছে, আমি তার পিছনে পিছনে গিয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে বললাম,
” মা’কে বলে দিও আমাকে ক্ষমা করতে। আর আজ থেকে যেন তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে তোমার হেদায়েতের জন্য দোয়া করে। ”
” কেন? ”
” তুমি শুধু এতটুকু বলে দিও। ”
বাবা চলে গেল, দরজা বন্ধ করে সুমনার কাছে কল দিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম।
” মা বললো, কি ব্যাপার মা শাকিলা? তোর বাবা গেছে তোর ওখানে? ”
” হ্যাঁ এসেছিল আবার চলে গেছে, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই মা। ”
” কি কথা? ”
” পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও শেষরাতে তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করো যেন সাজ্জাদের কোন ক্ষতি না হয়। ”
” কেন কি হয়েছে জামাইর? ”
” কিছু হয়নি, তবে তোমার স্বামী মানে আমার জন্মদাতা বাবা ওকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে গেছে। ”
” বলিস কি? আমি বলেছিলাম তোর বাবার কথা শোন, এখন আবার আগুন জ্বলবে। ”
” মা তুমি শুধু তোমার স্বামীকে বোঝাও, নাহলে সাজ্জাদের যদি কোনকিছু হয়ে যায় তাহলে কিন্তু আমিও কাউকে ছাড়বো না। আল্লাহ না করুন, সাজ্জাদের কিছু হলে আমার মা-বাবার জন্য আমি দুই ধরনের সাদা কাপড়ের ব্যবস্থা করবো। ”
” মানে কি শাকিলা? ”
” মানে খুব সহজ মা, বাবার জন্য সাদা কাফনের কাপড় আর তোমার জন্য সাদা বিধবা শাড়ি। ”
” শাকিলা…? পাগল হয়ে গেছো? ”
” চিৎকার করে লাভ নেই মা, সেদিন তুমি মা হয়ে আমার পা ধরে কেঁদেছিলে বলেই এতদিন অনেক কিছু অন্যায় জেনেও চুপচাপ ছিলাম। কিন্তু মা, এভাবে চুপচাপ থাকলে দিনদিন অপরাধ আর পাপের বোঝা শুধু বাড়বে। তারচেয়ে বরং এবার সবকিছুর নিষ্পত্তি হোক, হয় তোমার স্বামীর সব অপরাধ জিতবে। নাহয় আমি হেরে গিয়ে পৃথিবী থেকে হারাবো, কিন্তু এর শেষ দেখতে চাই। ”
” শাকিলা? ”
” আমাকে নয়, আল্লাহকে ডাকো। ”
.
.
.
চলবে…