কৃষ্ণচূড়ার রং লাল পর্ব ৩২

কৃষ্ণচূড়ার রং লাল-৩২.🎈
@হাফসা আলম
_____________________
হঠাৎ করেই পাহাড়ের আনাচে কানাচে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি শুরু হচ্ছে।পাঁচজনের দলটা এসে থেমেছে একটু দূরে।এই তো দূরের সেই রাক্ষস পুরী এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে।সবার গায়ে জমেছে ধূলা আর ধূলা।রামিম ক্লান্ত শরীরে সেগুন গাছের গুঁড়িতে বসে।গায়ের ব্যথাগুলো খুব তীব্র।আকাশও ক্লান্ত।মেয়েরা আর যাই হোক এই দুই দিনে তেমন মার তো খায়নি।কিন্তু রামিম আর আকাশ তো হুলুস্থল পিটানি খেয়েছে।তাই তারা শারীরিক এবং মানসিক দুই ভাবেই ভারি ক্লান্ত।রামিমের পাশে বসে আকাশ।দুই রাতের ঘুম,উড়াধূনা লাঠি পিটা।সব মিলিয়ে তাদের এখন নাজেহাল অবস্থা।তার মাঝে তুতুল আর রিঝের কোনো দেখা নেই।ভয়ে সবার মনটা ছোট হয়ে আছে।রূমাশ্রীকে দেখেই আকাশ বলল,
“ যাও তো এবার নিজের বাড়ি যাও।আর ঝামেলা ভালো লাগছে না।যতসব।”
রূমাশ্রী নিচু গলায় বলল,” আপনাদের এখানে আসতে কে বলেছে একটু বলবেন??কি দরকার ছিলো নাচতে নাচতে পাহাড়ে বিয়ে দেখতে আসার??না আসলে তো এতো কিছু হতো না।এখন আমার দোষ।”
আকাশ ত্যাছড়া ভাবে তাকালো।রাগ চোখে মুখে ফুঁটে উঠেছে তার।রূমাশ্রী একবার আড়চোখে আকাশকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।মনে মনে ভয়ও পেলো।বিড়বিড় করে নিজেকে বলল, “ রূমার বাচ্চা চুপ থাকতে পারছ না।”
তারপর আবার একবার আকাশের দিকে তাকালো।আকাশ শুধু তাকিয়েই আছে।কিন্তু কিছু বলছে না।সে চুপ করে আছে এটা রূমাশ্রী মেনে নিতে পারছে না।ছেলেটা মুখিয়ে থাকে তার সাথে তর্কে জড়াতে।আর এই কথার জন্য এখন কিছুই বলছে না??হলোটা কি??
মানুষ জাতির একটা জাতীয় সমস্যা হচ্ছে তাদের নিজেদের ভাবনার বাহিরে কিছু ঘটলে তা সহজে নিতে চায় না।রূমাশ্রীও নিতে পারলো না।সে আবার বলে বসলো, “ আপনারা না আসলে এতো কিছু হতো না?নিজেদের সাথে আমাকেও জলে ভাসিয়ে দিচ্ছেন।”
আকাশ এবার নড়েচড়ে বসলো।ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,” এই যে মহারানী ভিক্টরিয়া আপনি কেনো আমাদের পিছনে পিছনে এসেছেন??আমরা কি আপনাকে বলেছি আমাদের সঙ্গ দেন??না কি বলেছি রানী সাহেবা আপনি ছাড়া আমরা বাঁচতে পারবো না।বিপদ থেকে আমাদের বাঁচান?বলেছি??”
“ হ্যাঁ তা বলেন নি।তো কি হয়েছে, আপনার সাথে তো আমার বিয়ে হয়ে গেছে।বিয়ে না হলে আমি জীবনেও আপনাদের পিছনে পিছনে আসতাম না।”
“ বিয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে??মাথা কিনে নিছো??তুমি এই মুহূর্তে সামনে থেকে সরো।অসভ্য মেয়ে একটা।” রাগে আকাশের কপালে ভেঁসে উঠা রগ উঠানামা করছে।রূমাশ্রী এবার মনে মনে হাসলো।লোকটা রেগে গেছে।রাগাতেই তো চেয়েছে।আকাশ ফোঁস ফোঁস করে আবার বলল,
“ যাচ্ছো না কেনো??”
রূমাশ্রী এবার আর কিছু বলল না।দেখলো বেশি খেপে গেছে।আর চেতাই লাভ নেই।সে সবাইকে পাশ কাটিয়ে একটা জায়গায় গাছের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে।মং দাড়িয়ে আছে।সে বসছেও না যাচ্ছেও না।রামিম বসা অবস্থায় থেকেই বলল,” তুমি চাইলে বসতে পারো।বা চলেও যেতে পারো।”
মং বুঝলো না।সে আগের মতো হা করে তাকিয়ে আছে।মুখের ভাবটা এমন যেনো রামিমের মুখ থেকে যে বাক্য বের হয়েছে এই বাক্য পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য!রামিম আবার বলল, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো??বসে পড়ো।”
কথাটা শেষ করেই তার মনে পড়েছে এই ছেলে তো বাংলা ভাষা বুঝে না।তারাও মারমা ভাষা পারে না।তাই সে ইশারা করে বসতে বলল।মং বসলো না।সে তাকিয়ে আছে পথের দিকে।আকাশের রাগ একটু কমে আসতেই সে চারপাশে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো।মেয়েটা আছে??না কি গেছে?আসমা মৃদূ হেঁসে পিঠ চাপড়ে বলল,
“ ওই তো তোর বউ।”
আকাশ কড়া চোখে তাকায়।ক্যাট ক্যাট করে বলে,
“ আসমা ফাইজলামি করবি না।ও আমার বউ না।দেখলি না কেমন ক্যাট ক্যাট করে সারা দিন।বলে কি না আমাদের দোষ??”
“ তুই ও তো ক্যাট ক্যাট করছ।বাদ দে।ও নিজেও তো বিপদে আছে আমাদের মতো।আসলে এটাও সত্যি আমরা যদি না আসতাম এসব হতো না।”
সবার মুখে একটা বিরক্ত আর আফসোসের ভাব ফুটে উঠে।আকাশ ত্যাড়া চোখে তাকায় গাছের কোল ঘেঁষে শুয়ে থাকা মেয়েটার দিকে।আকাশ জুড়ে মেঘের ছড়াছড়ি।বাতাসে শুভ্র ভাব।আশেপাশে পাখিদের কিচিরমিচির ডাক শুনা যাচ্ছে।কটা বাজে এখন কেউ যানে না।সময় কোন গতিতে চলছে তাও বুঝা যাচ্ছে না।নিচে সবুজ ঘাসের গালিচা।পাহাড় ভরা সেগুন গাছ।আকাশ আগে কখনোই ভালো করে রূমাশ্রীর দিকে তাকায়নি।তাকাতে ইচ্ছেই করেনি।কারণ মেয়েটা খুবই বিরক্তি কর তার কাছে।এই মেয়ের জন্যেই তো এতো কিছু।মানুষ অন্যকে দোষ দিতে পছন্দ করে।নিজের দোষ চোখে পড়ে না।কিন্তু অন্যের বিন্দু পরিমান দোষ এড়িয়ে চলার ক্ষমতাও এরা রাখে না।হঠাৎ বৃষ্টি বাড়ে।আকাশ আরো কালো হয়ে যায়।যা দেখে সবার মনের ভয় আরো বেড়ে যায়।অনেক সময় তো হলো কিন্তু ওরা আসছে না কেনো??সুশ্চিন্তা নামের রাজা সবার মাথায় চড়ে বসেছে।বৃষ্টির ঝুমঝুম বর্ষণ যখন পড়তে শুরু করে সবাই তখন বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।শীতকালে বৃষ্টি!কি আশ্চর্য ব্যাপার!সবাই গাছের নিচে চলে যায়।আকাশ রূমাশ্রীর দিকে তাকিয়ে দেখে।কি অদ্ভুত মেয়ে,এই বৃষ্টির ফোঁটা কি তার গায়ে পড়ছে না??এতো ঘুম!বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ছে রূমাশ্রীর চোখে মুখে।দু’রাতের ঘুম তাকে গভীর ভাবে চেপে ধরেছে।মেয়েটা দেখতে খারাপ না।আকাশ মনে মনে একবার বলল।তারপর আরো একটু ভালো করে দেখতে শুরু করলো।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।চেপটা নাক,ফর্সা বকের মতো শরীর।সাদা শরীর জুড়ে সাদা জামা।কমলা রঙ্গের ঠোঁট,চোখ গুলো ফুলা,ফুলা।গালে দুই একটা তিল আছে।গলার একটা হাড় খাড়া হয়ে আছে।তার উপরে একটা কালো তিল।বিশাল লম্বা চুল গুলো তারের মতো সোজা।পরে আছে মাটিতে।আকাশ নাকটা একটু উঁচিয়ে বিড়বিড় বলল,
“ মেয়েটা এতো ফর্সা কেনো??”
রামিম শুনতে পায়।পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে আকাশ প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে রূমাশ্রীর মুখের উপরে ঝুঁকে দাড়িয়ে আছে।তাই তার মুখে বৃষ্টির পানি কম পড়ছে।আকাশ অদ্ভুত এক চাহনী দিয়ে তাকিয়ে আছে।রামিম অবাক হয়।এই মেয়েটিকে তো আকাশ একদম পছন্দ করে না।বলতে গেলে আকাশ এই পৃথিবীতে শুধু এই মেয়েটিকেই অপছন্দ করে।তাহলে এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো??আর এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেনো??বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচাচ্ছে??কাহিনী কি?রামিমের ভ্রু আপনা আপনি কুঁচকিত হয়।সে কিছুসময় একুই ভাবে তাকিয়ে থাকে।তারপর কি মনে করে দারুন ভাবে হাসে।নিঃশব্দের সেই হাসি কারো চোখে পড়ে না।মনে মনে ভাবে,সে শুনেছে বিয়েতে না কি জাদু আছে।এটা সে বিশ্বাসও করে একটু একটু।জাদু না থাকলে কিভাবে চেনা নেই জানা নেই এমন একটি মেয়ে/ছেলের সাথে হুট করেই মাঝ পথ থেকে জীবন শুরু করে?এরা আবার বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয় হাত ধরে।অপরিচিত হাত ধরে জীবন শেষ করে।ভারী চমৎকার ব্যাপার স্যাপার!রামিম আবার হাসলো।আসমা চোখ উল্টে বলল,“ তুই হাসছিস কেনো??”
রামিম দ্রুত হাসি চেপে বলল,“ আরে না হাসছি না।”
“ আমি দেখলাম।”
রামিম মুখটা গম্ভির করে বলল,“ হাসার সময় না এখন।দোয়া কর রিঝ যাতে জলদি ফিরে আসে।আমার না খুব ভয় করছে।”
“ আমারও করছে।খুব!!আল্লাহ যাতে ওদের ভালো রাখে।”
আসমা একটু আবেগ প্রবল হয়ে পরে।সে রামিমের বাহু চেপে ধরে।রামিম চাপা হাতটার দিকে তাকায়।তারপর মনে মনে ভাবে, তারা তো সে তুলোনায় বহু দিনের পরিচিত।তাহলে তাদের বিয়েটা কি টিকবে??কাটাতে পারবে কি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত?না কি ঢাকা শহরে পা রাখতেই সব শেষ হবে??পরক্ষণেই চিন্তা উল্টে নেয় সে।আসমা আতঁঙ্কিত কন্ঠে বলল, “ আমরা সবাই এক সাথে ঢাকায় যেতে পারবো তো??যেভাবে এসেছি??”
রামিম দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আসমার হাতটা আরো ভালো করে চেপে নিয়ে বলল,” ইনশাআল্লাহ্।”
________________________
প্রচন্ড টেনশনে আলভী আজ দুদিন অফিসে যায়নি।ঘুম হচ্ছে না তার।দিনের বেশির ভাগ সময় সোফার উপরে বসে থাকে সে।টেবিলের উপরে থাকে টেলিফোন।নিজের ফোন,মায়ের ফোন,শুধু বাবারটাই বাদ থাকে।কারণ তিনি অফিসে যায়।কিছুক্ষণ পর পর সে মুঠো ফোনটা কানে ধরে।কল করতেই থাকে।কিন্তু অপর পাশ থেকে বরাবরই তাকে নিরাশ হতে হয়।মহিলাটির বিরক্তিকর কন্ঠে সে এখন রেগে যায়।ইচ্ছে হয়,মহিলার কন্ঠ রোদ করে দিতে।কিন্তু দূরত্বের কারনে তা সম্ভব হয় না।ঘরে ভাঙ্গচুর করে।আজও সে পূর্বের মতো মিসেস আমিনার প্রিয় একটি মগ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।আজ আয়েশা রহমান এসেছে।ড্রয়িং রুমে বসে মিসেস আমিনার সাথে খুবই চিন্তিত গলায় বলছিলেন,“ আজ তিন দিন হতে চলেছে।কোনো খবরই পাচ্ছিনা।আগে যখন রিঝ পাহাড়ে যেত তখন এমন হতো।কারণ পাহাড়ে নেটওয়ার্ক থাকে না।কিন্তু সে আগেই আমাকে কল করে জানিয়ে দিত।কিন্তু এবার যে কি হয়েছে আমি বুঝতে পারছিনা আমু।”
“ যাই হয়ে থাকুক ফোন করাটা উঁচিত ছিলো আপা।তুতুলের মাঝে একটু ছেলেমানুষী বেশি।কিন্তু আপা আমাদের রিঝতো খুবই বিচক্ষণ ছেলে।সেও এমনটা করতে পারলো আপা??আলভী রেগে আগুন হয়ে আছে।খায় না দায় না শুধু ফোন নিয়ে বসে থাকে।এরে ওরে কল করে।ভাঙ্গচুর করে।এমন কি রিঝের প্রতিও তার ভয়ংকর রাগ প্রকাশ পাচ্ছে।আপনি তো জানেন আলভীর প্রান তুতুল।আমার এগুলো ভালো লাগছে না।”
কথাটা শেষ করার আগেই কন্ঠ ভারী হয়ে আসে আমিনা বেগমের।একটা সময় তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।গরিয়ে পরে চোখের দরজা খুলে নোনা জল।আয়েশা রহমানেরও খুব খারাপ লাগছে।চিন্তা হচ্ছে।আলভী কিছুক্ষণ আগে রামিমের বাসায় গিয়েছিলো।কলিংবেল খুব জোড়ে বেজে উঠে।তুতুলদের বাসার কাজের মহিলা দরজা খুলে দেয়।আলভী পাগলের মতো ছুঁটে আসে।কারো সাথে কোনো কথা না বলে সে টিভির রিমোট খুঁজতে শুরু করে।রিমোটের পাশে কাঁচের গ্লাস ছিলো।খুঁজতে গিয়ে কাঁচের গ্লাস খান খান হয়ে ভাঙ্গে।আমিনা বেগম বার বার বলছিলো কি খুঁজছ আব্বা??সে কোনো জবাব দিলো না।টিভি অন করতেই ব্রেকিং নিউজে ভেসে উঠে লাল লাল অক্ষরে, প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে বান্দরবানে পাহাড় ধসে পড়েছে।উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে।”
আলভী ফ্লোরে বসে পড়ে।বাকিরা কেউ কিছুই বুঝলো না।ব্যাপারটা বুঝতে তাদের সময় লেগেছে কয়েক মিনিট।আলভী প্রবল রেগে সামনের কাঁচের টেবিলে লাথি মারে।চিৎকার করে বলে উঠে,“ আমার বোনের যদি কিছু হয় রিঝ তোরে ছাড়বো না আমি।”
আলভীর এমন রাগ দেখে আয়েশা রহমানও ভয় পেয়ে যায়।দরজা খোলাই ছিলো।আনাস আর আদ্রি ছুটে আসে।সাথে আসে আদ্রির ছেলে রায়হান।তারাও খবরটা শুনেই এসেছে।
______________________
খবর,তথ্য,সংবাদ বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ে।ঠিক একুই ভাবে পাহাড় ধসের খবর ছড়িয়ে পরে চারপাশে।সেনাবাহিনী উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে।উথৌয় অনুমতি পত্র জোগার করেছিলো।তুতুলকে খুঁজবে বলে।তার আর প্রয়োজন পড়েনি।
অপেক্ষা করতে করতে যখন সন্ধ্যা হয়ে গেলো রামিমরা তখন বসতিতে ফিরে গেলো।জানতে পারলো পাহাড় ধসের কথা।কলিজা ধকধক করে উঠলো।কেনো যেনো খারাপ লাগা শুরু করলো।সেখানে আর দাড়ালো না।ঘটনাস্থলে চলে গেলো সবাই মিলে।আসমা আতঙ্কে কেঁদে দিলো।রামিম আকাশেরও অবস্থা ভালো না।মাটি সরিয়ে যখন দেখতে শুরু করলো উথৌয় তখন রিঝের ভাঙ্গা চশমা পেলো।রামিম মাথায় হাত দিয়ে মাটির স্তুপের উপরে বসে পড়লো।আকাশ চশমা হাতে নিয়ে কেঁদে ফেললো।তারপর উম্মাদের মতো হাত দিয়ে মাটি সরাতে লাগলো।উদ্ধার কর্মীরা তাদের সরিয়ে দিলো।তারা খুঁজে দেখলো সব।কিন্তু তাদের দেখা মিললো না।দুজন মৃত মানুষ পাওয়া গেলো।রামিম আকাশ প্রচন্ড ভয়ে পেয়ে গেলো।তারা দেখতে চাইলো না।উথৌয় খবর দিলো রিঝ তুতুলকে এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।যারা মারা গেছে ওরা রিঝ তুতুল নয়।সবাই ভাবলো তারা শান্তিবাহিনীর কাছেই রয়ে গেছে।পাহাড় এক পাশে নয় অনেক পাশে ধসে পড়েছে।শান্তিবাহিনীর একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।তাই তারা জায়গা পরিবর্তন করেছে।পাহাড়ের উপরে যাদের বাসা ছিলো তারা আহত হয়েছে অনেক।এক পরিবারের তিন জন মৃত।খবর পাওয়া গেলো একটু দূরে একজন ছেলে এবং মেয়ের দেহ পাওয়া গিয়েছে।মেয়েটা রক্তাক্ত বেশি।ছেলেটা মেয়েটার তুলোনায় কম আঘাত প্রাপ্ত।কিন্তু অবস্থা সিরিয়াস।জ্ঞান নেই।সবাই সেই জায়গায় উপস্থিত হয়ে দেখলো রামিম আর তুতুল।দুজনেরই প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।দ্রুত হসপিটালে নিতে হবে।রামিম সোজা সোজি প্রশ্ন করলো,” বেঁচে আছে কি না বলো তুমি??”
উথৌয় আহত কন্ঠে বললো,” আছে।কিন্তু অবস্থা বেশি ভালো না।”
রামিম বুঝতে পারছে না ওরা এদিকে আসলো কেনো??তার মাথা এলোমেলো লাগছে।তুতুলের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠে সবাই।আহত সবাইকে হসপিটালে পাঠানো হয়।হসপিটাল থেকে বলে দেওয়া হয়েছে আহতদের চট্টগ্রামে শিফট করতে হবে।আহতদের অবস্থা খুব একটা ভালো না।হসপিটালে নিতে নিতেই আহত একজনের মৃত্যু হয়।ফুঁসফুঁসে মাটি ঢুকে গেছে তার।নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে।তাই এখানে রাখা বেশি রিস্কি হবে।রামিম আকাশ আরো ভয় পায়।তারা জানিয়ে দেয় ঢাকা নিয়ে যাবে।গাড়িতে যাওয়া রিস্ক আরো বেশি।তাই হেলিকপ্টার নেওয়া হবে রিঝ তুতুলকে।দ্বিগুন টাকা দিয়ে রামিম রাজি করালো।রিঝের ছোট চাচ্চু মিশনে গিয়েছে।ঘটনা শুনে তিনি ফ্রিতেই নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।ঘন্টা দুই একের ভেতরে স্বপ্নের রাজ্য থেকে আহত হৃদয় নিয়ে সবাই ঢাকার আকাশে যাত্রা করলো।বান্দরবানে ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই।বিশেষ করে গুরুত্বর রোগীদের জন্য।চট্টগ্রামের চাইতেও ঢাকা বেশি পরিচিত রামিমদের।আসার সময় রূমাশ্রীকেও নিয়ে আসতে হয়েছে।উথৌয় তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিলো,” প্লিজ আমার বোনকে দেখে রেখো।”
আকাশ ক্ষেপা গলায় বলেছিলো,” রিঝের কিছু হইলে তোরেও দেখে রাখমু আমি হারামজাদা।তোদের জন্য এসব হইছে।বহুত সখ বিয়ার তাই না??মনের মতো বিয়া করানো দিখামু তোদের।”
আকাশের শরীর থরথর করে কাঁপছিলো।রামিম শান্ত কন্ঠে বললো,” উথৌয় কিছু মনে করোনা।আসলে তুমি তো জানোই বিয়ের জন্য যদি আটকে না রাখতো তোমার বাবা তাহলে এসব কিছুই হতো না।আসা করি তুমি বুঝতে পারছো।পরিস্থিতি এখন খুবই খারাপ।তাই ভালো কথা আসছে না।”
“ আমি বুঝতে পারছি।আনন্দ করতে এসে তোমরা কষ্ট নিয়ে যাচ্ছো।আমি সত্যি স্যরি।অন্তর থেকে দুঃখিত।প্লিজ দু’জনের খবর দিও আমাকে।আমি এখানে চিন্তা করবো।”
“ দেওয়ার চেষ্টা করবো।দোয়া প্রয়োজন।আসি।”
___________________
তুতুলের পড়ার কথা ছিলো গর্তে।কিন্তু নিচে পাহাড় থাকায় সে পাহাড়ে পড়েছে।শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত পেয়েছে।গড়িয়ে গর্তে পড়ার আগেই পাহাড় ধসে পড়েছে।রিঝ ছিটকে পড়েছে পাশের ছোট পাহাড়ে।সেও আঘাত পেয়েছে।কিন্তু বেশি উপর থেকে পড়েনি তাই সে তুতুলের মতো বেশি আহত হয়নি।দু’জনকেই অ্যাপোলোতে নিয়ে আসা হয়।চিকিৎসা দ্রুত শুরু হয়।রামিম একে একে ফোন করে তুতুলের পরিবারকে,তারপর রিঝের পরিবারকে।ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সবাই এসে হাজির হয় হসপিটালে।আলভী সবচাইতে বাজে পরিস্থিতি তৈরি করেছে।তাকে উম্মাদের মতো লাগছে।রামিমের কলার ধরে সে কয়েকটা ঘুষিও বসিয়ে দিয়েছে।পাগলামি করেছে অনেক।তার জন্যে হসপিটালে একটা হট্টগোল শুরু হয়।উপর থেকে কড়া ভাবে নিষেধ আসে।এমন কিছু করলে সবাইকে হসপিটাল থেকে বের করে দেওয়া হবে।আলভী যখন নিজের রাগ আর কারো উপর ঝাড়তে পারলো না তখন সে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।তুতুলের টিকমেক করছে মেয়ে ডাঃ সানজিদা প্রীতি।প্রীতি যখন এসে বললো,” রোগীর অবস্থা খারাপ।এই মুহূর্তে রক্তের প্রয়োজন।”
আলভী হন্তদন্ত হয়ে বললো,
“ আমার রক্ত নিয়ে নিন।সব নিয়ে নিন।তবুও আমার বোন ঠিক চাই।ও আমার এক মাত্র বোন।আমার আর কোনো বোন নেই বিশ্বাস করুন।”
আলভীর কন্ঠে আকুলতা।আহত কন্ঠের স্বর।প্রীতি ভরকে যায়।এমন নয় যে সে এসব দেখেনা।পরিবারের ব্যকুলতা সে বুঝে।ডাক্তার হিসেবে সে রোজ এগুলো দেখে।কিন্তু আলভী ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।বোনের প্রতি ভালোবাসা থাকেই।কিন্তু এমন পাগলামু সে আগে তেমন দেখেনি।হোসাইন সাহেব ছেলেকে সামলাবে না স্ত্রীকে বুঝতে পারছে না।মিসেস আমিনা সেন্সলেস।তার কোনো জ্ঞান নেই।হসপিটালে এসে তুতুলের খারাপ অবস্থার কথা শুনে তিনি জ্ঞান হারান।তারপর থেকে একটু জ্ঞান আসে আবার যায়।জ্ঞান আসলে মেয়ের জন্য ব্যকুল হয়ে তিনি জ্ঞান হারান।আয়েশা রহমান কঠিন মহিলা।কষ্ট দাবিয়ে তিনি সবাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।আল্লাহকে ডাকতে বলছেন।নামাজ পড়ছেন।ধৈর্য্য ধারন করতে বলছেন সবাইকে।আল্লাহ ছাড়া কেউ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে না।তবুও মাঝে মাঝে চোখের বারান্দায় উপচে পড়ে নোনাজল।প্রীতি ভারী বিরক্ত গলায় বললো,” পৃথিবীতে শুধু আপনারই এক মাত্র বোন নয়।অনেকেরই আছে।আমি নিজেও একজনের একমাত্র বোন।বুঝতে পারছি আপনি আপনার বোনকে খুব ভালোবাসেন।তাই বলে এমন অদ্ভুত ব্যবহার করবেন না।প্লিজ ধৈর্যের সাথে কাজ করুন।এতো উত্তেজিত হচ্ছেন কেনো??শান্ত।”
প্রীতির কথায় আলভীর রাগ আকাশ ছুঁয়েছে।রাগে আগুন হয়ে বললো, ওই ডাক্তারনী বললাম না আমার একটা মাত্র বোন।সবার সাথে আমার বোনকে মিলাতে আসবেন না।ও আমার বোন।আমার আদরের তুলাপাখি।রক্ত লাগবে তো??আমার রক্ত নিতে বললাম না??”
“ আপনি শিক্ষিত??আপনার ভাষা শুনে আমার তেমন মনে হচ্ছে না।”
হোসাইন সাহেব এগিয়ে এলেন।ছেলের পিঠে হাত রেখে বললেন,” আলভী এবার থামো।তুমি যে একজন ব্যাংকার তোমার ব্যবহার দেখে কেউ বুঝবে না।উনি ঠিক বলেছে।কথা শুনে তোমাকে তেমন মনে হচ্ছেও না।সবাই তোমাকে গুন্ডা লাফাঙ্গা ভাবছে।মেয়ে আমারও।ধৈর্য ধরো।সবাই চিন্তিত।তুমি একা না।”
আলভী নেতিয়ে যায়।প্রীতি ভ্রু কুঁচকায়।মানুষটা কি ভয়ংকর ভাষায় তার সাথে ঝগড়া করছিলো।আর এখন বাবা যেই একটু বললো সাথে সাথে সোজা??তার উপরে না কি ব্যাংকার!!ভারী আশ্চর্য!
ডাঃ প্রীতি যে রক্তের গ্রুপের কথা বললো সে রক্ত কারো সাথে মিললো না।হসপিটালেও পাওয়া গেলো না।কিন্তু পরিবারের সাথে মিললো না ব্যাপারটা প্রীতিকে অবাক করেছে।পরিবারের কারো সাথেই রক্ত মিললো না??সাধারণত এমন হয় না।এতো ভালোবাসে যে ভাই তার সাথে মিলাটা অনন্ত প্রয়োজন ছিলো।কিন্তু এদের কাহিনী ভিন্ন।আলভী বুঝলো।সে ফোন করে বন্ধুবান্ধব ,কলিগ,তাদের আত্নিয় সবার সাথে কথা বলে রক্তজোগার করলো।ডাক্তার শেখর দত্ত রিঝের অপারেশন করেছে।ওটি থেকে বাহিরে এসে তিনি বললেন,” মেরুদন্ডে আঘাত লেগেছে।ঘাড়ের একটা রগ ছিড়েছে।অপারেশন করে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।ডান হাত ভেঙ্গেছে।সুস্থ হতে ক্ষত সারতে সময়ের প্রয়োজন আছে।কিন্তু জ্ঞান ফিরেনি।কখন ফিরবে বলা যাচ্ছে না।আমরা আমাদের বেষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি।শিক্ষার আর চেষ্টার বাহিরে ডাক্তার কিছুই করতে পারে না।”

আইসিইউতে সিফট করা হয়েছে রিঝকে।গ্লাসের দরজা বেদ করে তাকে দেখা যাচ্ছে।মাথায় ব্যান্ডেজ,একটা হাতে ব্যান্ডেজ,মুখে অক্সিজেন মাস্ক।একজন মায়ের জন্য এটা খুবই মর্মান্তিক দৃশ্য।পৃথিবীর কোনো মা নিজের ছেলেকে এভাবে দেখতে চান না।আয়েশা রহমানের শরীর ঘামে ভিজে উঠে।মাথা ধরে তিনি দরজার পাশ ঘেষে বসে পড়েন।একটা সময় জ্ঞান হারান।আনাস চেঁচিয়ে উঠে,
“ আম্মু বলে।”
দৌড়ে এসে ধরে।

সবার সাথে হিমেল মায়শা রেয়ানাও এসেছে।তারা খবর পেয়েই হসপিটালে ছুটে যায়।সেখান থেকে ঢাকা।দীর্ঘ ১৮ ঘন্টা অপারেশন হয় তুতুলের।এই সময়টায় আলভী একটুও বসেনি।ঠাই দাড়িয়ে ছিলো।লাল বাতি বন্ধ হতেই সে উদ্বেগী হয়ে তাকিয়ে থাকে।প্রফেসর ডাঃ ইমরান এবং সাথে ডাঃ প্রীতি বেড়িয়ে আসেন।ইমরানের মেয়েই প্রীতি।বাবা মেয়ে দুজনেই নিউরো সার্জারি গুলো করে।তুতুলের মাথার থেকে ঘাড়ের রক্ত চলাচল করার রগে রক্ত জমা হয়েছে।আরো অনেক ইঞ্জরি ছিলো।তাই অপারেশন করেতে হয়েছে।ইমরান সাহেবের চেহারা দেখে আলভী প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়।হোসাইন সাহেব থরথর করে কাঁপতে শুরু করেন।বাবার এমন অবস্থা দেখে ইমরান সাহেব আর বললেন না।নিজেও একজন বাবা তাই বাবার কষ্ট তিনি বুঝতে পারছে।তিনি তুতুলের বাবাকে ধরে দাড়ালেন।প্রীতি সাহসী মেয়ে।খারাপ লাগলেও তার কিছু করার নেই।গম্ভীর মুখে সে বলে উঠলো,sorry. আসলে ………
কথা শেষ করতে পারলো না।তার আগেই আলভী ভয়ংকর কাজ করে বসে।ঠাস করে ঠাটিয়ে গাল লাল করে দেয় প্রীতির।আকর্ষীক কাজে সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে।প্রীতি নিজের গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে পড়ে।নার্স,ওয়ার্ড বয় সবাই হতবাক!প্রীতি সাহসী এবং রাগী মেয়ে।সে যে পাল্টা থাপ্পড় দিবে এটা সবাই জানতো।কিন্তু সে এমন কিছুই করলো না।হা করে লাল হয়ে উঠা আলভীর মুখটা দেখতে লাগলো।আলভী প্রচন্ড রেগে চিৎকার করে বললো,” ওই ডাক্তারনী ফরমালিটি করেন??বাংলা সিনেমা পাইছেন??স্যরি সি ইজ নো মোর এসব বলবেন??এমন কিছু বলার হলে আমি আপনাকে সাবধান করছি।আমি কিন্তু আমার বোনের জন্য সব করতে পারি।সব।এভরিথিং।আমার মাথা খারাপ করবেন না।বলে দিলাম।”
আলভী পাগলামু শুরু করে।নিজের চুল টেনে ছিড়ে ফেলছে সে।প্রীতি কিছুই বললো না।শুধু তাকিয়ে আছে।আলভীর ডান হাতটা কাঁপছে।হাত লাল হয়ে আছে তার।প্রীতির শ্যামবর্ণের মুখের অবস্থাও রক্তাক্ত।বাকি কথাটা যদি বলে তাহলে আরো কয়টা থাপ্পড় খেতে হবে ভাবছে সে!
_______________________

#চলবে…………
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here