গল্পটা_আমারই পর্ব : ১৯

0
292

#গল্পটা_আমারই

পর্ব : ১৯
(সুরমা)

তারপর আমার কিছু মনে নেই। আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি আমার চারপাশে লোকজন। আমার মা, বাবা, ভাই সবাই আমাকে ঘিরে বসে আছে। আম্মুর চোখে পানি। মনে হচ্ছে কাঁদছিল এতক্ষণ। আমি চোখ মেলে তাকাতেই আব্বু বলে,,,,,

– কি হয়েছেরে মা। তোর কি হয়েছে? হঠাৎ এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলি কেন? শরীর খারাপ? আব্বু আমার কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
আর আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। আগের কথাগুলো আমার মাথায় আসছে না। এখনও মাথাটা কিছুটা ঝিম ঝিম করছে।

আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আম্মু অস্থির হয়ে বলে,,,,
– কি হয়েছে বলছিস না কেন? বল কি হয়েছে তোর।
আমি বিছানায় উঠে বসি। আগের সব ঘটনা আমার চোখের সামনে আয়নার মতো পরিষ্কার।

আমার সব মনে পড়ে গেছে। আমার অজ্ঞান হওয়ার কারণও। কিন্তু বুঝতে পারছি না তখন আমি ঠিক শোনেছিলাম নাকি ভুল। অর্ণব বলে আমি একটু বেশিই পণ্ডিত। সব কিছু দুলাইন বেশি বুঝে যাই।

কিন্তু আব্বু আম্মু আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য বাসায় নিয়ে এসেছে। এটা মাথায় আসতেই আমার খুব কান্না পাচ্ছে। আমি যে অর্ণবকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আব্বু আবার বলে,,,,

– কি হয়েছে বল। আমি শুনি তোর কি হয়েছে? আমার বুক ফেটে যাচ্ছে কিন্তু মুখ ফোটছে না। আমি অনেক কিছু বলতে চাইছি। কিন্তু কিছুই বলতে পারছি না। অর্ণব আমাকে আরেকটা কথা বলে, ‘ কাজের সময় আমি আসল কথাটা বলতে পারি না। কিন্তু ফালতু নাকি অনেক কথা বলি।’ যদিও আমি অর্ণবের এই কথাটাকে পাত্তা দেইনি। কারণ, ওর সাথে আমার হুদায় আজাইরা কথা বলতেও ভাল্লাগে।

অর্ণবকে এখনও কল করা হয়নি। অর্ণবকে সব কিছু এক্ষণি বলা উচিত। আমার মোবাইল গুলো কোথায় আছে? অর্ণব নিশ্চয় আমাকে কল দিতে দিতে অস্থির হয়ে গেছে। আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম,,,,

-আম্মু আমার মোবাইল কোথায়?
– তোর মোবাইল কোথায় আমি কি বলবো? আসার পর তো তুই নিজেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলি। আমরা তোকে নিয়েই দৌঁড়াদৌঁড়ি করছি। বাসায় নতুন মেহমান আসছে।

তাদেরও আপ্যায়ন করতে পারিনি। তোরও জ্ঞান ফিরছে না। আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেছি। আমি আম্মুর কথায় পাত্তা না দিয়েই বললাম,,,,

– আমার ব্যাগ কোথায়? ব্যাগের ভেতরেই আমার মোবাইলটা ছিল। আমি আমার ছোট ভাই দিপ্তর দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

– ড্রয়িং রুমে আমার ব্যাগ। একটু এনে দে প্লীজ।
– আচ্ছা তুই বস আমি আনছি। দিপ্ত ব্যাগ আনতে চলে যায়। আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। এতো জার্নি করে আসলাম।

একটু হাত পা ধুয়ার চান্সও পাইনি। আমি বিছানা থেকে নামতে নিলে আব্বু বলে,,,,

– কি করছিস? তোর শরীর খারাপ। আমি আব্বুর দিকে চেয়ে থেকে বললাম,,,,

– আমি সুস্থ আছি। হয়তো খালি পেটে জার্নি করে আসার কারণে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। আমার কথা শোনে আম্মু বিচলিত হয়ে বললো,,,,

– আগে বলবি না তোর ক্ষুদা পেয়েছে। যা তুই গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয় আমি খাবার দিচ্ছি। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি আম্মু খাবার নিয়ে বসে আছে। অনেক রকম আইটেম। আম্মু নিজেই ভাত মেখে আমায় খাইয়ে দিতে লাগলো।

আব্বুকে কোথাও দেখছি না। রুমে এখন আম্মু আর আমি। আমার ব্যাগ গুলোও দেখছি দিপ্ত এসে দিয়ে গেছে। আমি অর্ণবকে কলও করতে পারছি না। আম্মুকে বললাম,,,,

– আম্মু, আব্বু কোথায়???
– নিচে ড্রয়িংরুমে। আজ তোকে দেখতে ছেলে পক্ষ এসেছে। অনেক্ষণ ধরে তারা বসে আছে। তুই অজ্ঞান হয়ে গেলি বলে এতো কিছু হলো। এবার আমার চোখ ছলছল।

আমার বুক ফেটে কান্না আসছে। চোখের কোনে পানি জমাট বেধেছে। আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। তবুও আমি ভারী কণ্ঠে বললাম,,,,,

– আম্মু আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা। আমার কথা শোনে আম্মু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ গুলো বড় বড়। মনে হয় আমার কথাটার অর্থ বুঝতে পারছে না। আমি আবার বললাম,,,,,

– আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা। আমি যাবো না ওই লোকগুলোর সামনে। প্লীজ আম্মু। তুমি আব্বুকে বলো ওদের বিদায় করে দিতে। এবার আম্মু হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আম্মুর হাত ধরে একটু ঝাকি দিয়ে বললাম,,,,

– আম্মু তুমি শোনছো?? আম্মু আবার আমার মুখে খাবার তুলে দিয়ে বলে,,,,,

– আগে খা। ওদের অনেক্ষণ যাবৎ বসিয়ে রেখেছি। বিয়ে না করতে চাইলেও ওদের সামনে যেতে হবে। নাহলে তোর বাবার অসম্মান হবে। এবার আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। আম্মু আমার চোখের পানি দেখে বলে,,,,,,

– কান্না করার কি আছে? দেখতে আসলেই কি বিয়ে হয়ে যাবে?? তাছাড়া ছেলেটা খুব ভালো। ইঞ্জিনিয়ার। দেখতেও স্মার্ট। হয়তো ছেলে দেখে তোর পছন্দ হয়ে যাবে। আমি কান্না করতে করতে বললাম,,,,

– আমার পছন্দ হবে না। আম্মু আমি তোমাকে অনেক কিছু বলতে চাই। আব্বুকেও বলতে চাই। প্লীজ, আমি বিয়ে করবো না। আম্মু আমি একজ,,,,,,,আম্মু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,,,,,,

– তোর সব কথা পরে শোনবো। আগে চল। ওরা অনেক্ষণ বসে আছে। আমি না চাওয়া সত্ত্বেও আমাকে পাত্রপক্ষের সামনে যেতে হলো। আম্মু আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিলো।

হালকা সাজও করিয়ে দিলো। আমি অনেকবার না করলাম। কিন্তু আম্মু শোনলো না। আম্মু বললো,

– বিয়ে হোক বা না হোক। কিন্তু তারা যেন আমার মেয়েকে দেখে অপছন্দ করতে না পারে। সবাই যেন আমার মেয়ের প্রশংসাই করে।

আমি মূর্তির মতো তাদের সামনে বসে রইলাম। তারা আমার অনেক প্রশ্নও করলো। আমি একবারের জন্যও ছেলেকে তাকিয়ে দেখলাম না। দেখার ইচ্ছে নেই। সে যতই ভদ্র হোক, স্মার্ট হোক। আমার কাছে অর্ণবের থেকে বেশি সুন্দর কেই না।

ছেলে পক্ষ আমাকে দেখে পছন্দ করলেন। এটা শোনার সাথে সাথে আমার দুনিয়া অন্ধকার। আমার আব্বুর কথা শোনে যে কেউ বুঝবে আব্বু কতটা খুশি। কতটা চাচ্ছে আমার বিয়েটা এই লোকটার সাথেই হোক।

আব্বু খুব খুব খুশি। বাসার সবাই খুশি। শুধু আমার হৃদয়ে আগুন জ্বলছে। মনে হচ্ছে দশমিনিটের মধ্যেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যাবো।

আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলছে। আব্বু যখন খুব হেপি থাকে তখন হো হো করে প্রাণ খুলে হাসে। এখনও হাসছে। ছেলে পক্ষের সামনে থেকে আমি আমার রুমে এসে অনেক কান্না করেছি।

কাঁদতে কাঁদতে চোখ গুলো ফোলিয়ে ফেলেছি। অর্ণব এর মাঝে কয়েকবার কল করেছে। আমি রিসিভ করিনি। করে কি বলবো ওকে? আমি ড্রয়িংরুমে এসে একপাশে দাঁড়ালাম।

অর্ণবের সাথে কথা বলার আগে আব্বুর সাথে কথা বলা উচিত। আব্বু কথা বলার ফাঁকে আমার উপর চোখ পড়ে। আমাকে দেখেই খুশি হয়ে বলে,,,,

– এতো দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয়, আমার কাছে আয়। আমি গিয়ে বসলাম আব্বুর পাশে। আব্বু আমাকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সাথে। আমার মন খারাপ। প্রচণ্ড খারাপ। আব্বু হাসি মুখে বললো,,,,,

– আমি জানতাম আমার মেয়ের কপাল ভালো। দেখেছিস ছেলেটা কতো স্মার্ট? মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। প্রচুর টাকা পয়সা। অনেক টাকা বেতন। ছেলে সিপ অফিসার। আমার মেয়ে রাজ রাণীর মতো থাকবে। আর লোকে দেখলেও বলবে, এতো ভালো জামাই কোথায় পেলেন?’ কথাটা বলেই আব্বু হোহো করে হাসতে শুরু করে।

আমি কখনও আব্বুর কথা অমান্য করিনি। কিন্তু আজ হতে হবে। আমি চাইছিলাম না আমার জন্য আব্বু কষ্ট পাক। কিন্তু আমিও যে অসহায়। আমি কেঁদে কেঁদে বললাম,,,,,

– আব্বু আমি বিয়েটা করবো না। আমি করতে চাইনা। প্লীজ তুমি তাদের না করে দাও। আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। আমার চোখের পানি দেখে আব্বু অনেকটা অবাক হয়। তারপর বলে,,,,,

– বিয়ের কথা শোনে মন খারাপ লাগছে? পাগলি মেয়ে আমার। সব মেয়েদের একদিন শ্বশুর বাড়িতে যেতে হবে। মা বাবাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা শোনে মেয়েরা খুব কাঁদে। কিন্তু দেখবি এমনটা থাকবে না।

তুই আমাদের কাছেই বেশি বেশি থাকবি। আর যখন রবিন তোকে তার কাছে শিপে নিয়ে যাবে তখন তার সাথে সাথে এক দেশ থেকে অন্যদেশে ঘুরে বেড়াবি।

আমি আব্বুর দিকে তাকিয়ে আরো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আব্বুকে কিভাবে বলি? কিন্তু না বলেও উপায় নেই। আমি মাথা নিচু করে বললাম,,,,,

– আব্বু, আমি একজনকে ভালোবাসি। আমি তাকেই বিয়ে করতে চাই। প্লীজ, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। এই বিয়েটা আমি কিছুতেই করতে পারবো না।

আমার কথা শোনে আব্বু আম্মু দুজনেই নিরব হয়ে গেলো। আমি কাঁদছি। বুক ফেটে কাঁদছি। আব্বু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার মাথায় হাত রেখে বললো,,,,,

– ভালোবাসিস তো বেশ। কান্না করার কি আছে? আমরা কি তোকে এই ছেলের সাথে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি নাকি? তোর যাকে ভালো লাগে তার সাথেই বিয়ে দিবো। আমি চাই আমার মেয়ে সুখি হোক। আমি আব্বুর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম। আব্বু আমার চোখের পানিটা মুছে দিয়ে বললো,,,,,,

– তুই যাকে ভালোবাসিস তাকে বল আমার সাথে দেখা করতে। তার ফ্যামিলি নিয়ে আসুক। আমি তার সাথেই আমার মেয়ের বিয়ে দিবো।

চলবে———-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here