গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে পর্ব -১৫+১৬+১৭

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৫

রাগিনীর সকালের গভীর ঘুমটা ভাঙ্গে বিড়াল ছানার সেই সুন্দর ডাকে। হাত-পা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে যেই না পাশ ফিরতে যাবে তখনি তার তুলতলে গালে কোনো কিছুর স্পর্শ লাগে। কানের বেশ কাছে ভেসে আসে মিউ মিউ শব্দটা। চোখটা আধখোলা করে তাকায় রাগিনী। মাথাটা এখনো বেশ ভার। তার ঠিক মুখের সামনে বসে আছে বিড়াল ছানা। তার নীল বড় বড় চোখ দুটো চেয়ে আছে রাগিনীর দিকে। নিষ্পাপ সেই চাহনিটাকে উপেক্ষা করতে পারল না রাগিনী। একগাল হেঁসে তার হাতটা উঠিয়ে বিড়াল ছানার মাথার উপর রেখে মাথা বুলিয়ে দিল। রাগিনী দুর্বল কন্ঠে বলে উঠল,
“আর ইউ হাংরি লিটল ফেইরি?”

বিড়াল ছানাটি কি বুঝল জানা নেই রাগিনীর। সে জোরে জোরে মিউ মিউ করে উঠে তার লেজ নাড়ালো। রাগিনী তার সামনের একটা পা ধরে একটু ঝাঁকিয়ে নরম সুরে বলল,
“ওহ হো! পিচ্চিটা তো অনেকক্ষণ ধরে খায়নি। ভেট ডক্টর বলেছিল বাচ্চাদের একটু সময় পর পর খাওয়াতে। আচ্ছা লিটল ফেইরি, ওয়েট অ্যা মিনিট। এক্ষুনি খেতে দেব তোমায়।”

ধীরেসুস্থে উঠে বসল রাগিনী। বসার সাথে সাথে তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। মাথাটা দুহাতে ধরে চোখ বন্ধ করে নিল সে। মাথাটা ব্যথা করছে এখনো। গা দরদর করে ঘামছে আর জ্বর নামছে। রয়েসয়ে চোখ খুলে পা নামিয়ে স্লিপার পড়ে ফ্লোরে দাঁড়াতেই টলমল করতে থাকলো। এলোমেলো পায়ে হেঁটে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। আয়নায় সেই প্রতিবিম্ব চেনার চেষ্টা করল। নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করল সেই প্রতিবিম্বতে। প্রতিবিম্বতে স্পষ্ট হয়েছে একটা লাল মুখ। ফুলে গিয়েছে দুটো গাল। চোখটা একরাতেই কিভাবে যেন বসে গিয়েছে। চোখ দুটো কচলে হাতের কাছে থাকা মাথার কাটা দিয়ে চুলটা কোনোমতে খোঁপা করে বেঁধে নেয় রাগিনী। কিন্তু তাকে বিরক্ত করতে ছোট চুলগুলো পার পেয়ে এসে পড়ল কপালে। কপালে ফুঁ দিয়ে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকালো সে। ঠোঁট চেপে ধরে ড্রেসিং টেবিল থেকে একটা চুলের ব্যান্ড নিয়ে চুল আঁটকে ফেলল দ্রুত। তারপর বিড়াল ছানার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আই এম রেডি কিউটি! জাস্ট গিভ মিনিটস্।”

বলেই রাগিনী তার বেডের নিচ থেকে একটা ছোট্ট বল বের করে বিড়াল ছানার কাছে দিল। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বল নিয়ে। সেই সুযোগে রাগিনী টাওয়াল ও কাবার্ড থেকে একটা পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল ফ্রেশ হতে।

বেশিক্ষণ সময় নেয়নি রাগিনী। তবে বেশ গরম লাগছিল তার। শরীর থেকে জ্বর নামার পর যা হয় আরকি! তাই শাওয়ার নেয় সে। বিড়াল ছানার জন্য তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়ে ওয়াশরুম থেকে। ব্যস্ত পায়ে হেঁটে চুল মুছতে থাকে। এবার মাথাটাও হালকা লাগছে। শরীরের দুর্বলতা কমেছে। প্যানিক এট্যাকের জন্য জ্বরটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না ফলে দ্রুত রাগিনীর কাছেও স্থায়ী হয়নি। ঘরে এসে রাগিনী খুঁজতে থাকে বিড়াল ছানাকে। কিন্তু না পেয়ে চোখদুটো আশপাশটায় খোঁজ করে। কোথায় সে? বিছানার নিচ থেকে খট করে আওয়াজ আসায় একটু ঝুঁকে পড়ে রাগিনী। মাথা থেকে খুুলে পড়ে যায় বেঁধে রাখা টাওয়াল। তবে মুখে চলে আসে হাসি। এইতো তার লিটল ফেইরি। বল নিয়ে খেলতে খেলতে বেডের নিচে শুয়ে পড়েছে। রাগিনী হাত বাড়িয়ে তাকে একহাতে বের করে নিজের কাছে টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। অনুভব করে তার ঘরের দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ঘুরে পিছু তাকাতেই কাশি ওঠে রাগিনীর। বিড়াল ছানাকে কোনোরকমে নামিয়ে নেয় বেডে। নেত্রপল্লবের ঘনঘন পলক ফেলা বলে দেয় সে চরম বিস্মিত। দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কোহিনূর এমন কাশির আওয়াজ শুনে বিচলিত চোখে তাকায়। কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে। রাগিনী বিস্ময় কাটিয়ে কাশি থামিয়ে তাড়াতাড়ি করে হেঁটে আসতে উদ্যত হয়। আর কিন্তু তার চুল থেকে বেয়ে পড়া পানিতে ফ্লোর কিছুটা ভিজে যাওয়ায় সেখানে পা পড়তেই পা পিছলে যায় তার। কোহিনূর কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাগিনীর ধপ করে পড়ে গিয়ে নাজেহাল অবস্থার সৃষ্টি হলো। কোহিনূর মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল দরজার কাছেই। আসলে এই মূহুর্তে কি করা উচিত সেটা বুঝতে পারছে না। চোখজোড়া স্থির ফ্লোরে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা সেই ভেজা ও মুষড়ে যাওয়া এলোকেশীর দিকে। সেই এলোকেশী যখন দুটো হাত নাড়িয়ে কোহিনূরের ধ্যান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে তখন নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় কোহিনূর। রাগিনী হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করে এখানে সে কী করছে?

অতঃপর উঠে বসতে চায় রাগিনী। কিন্তু কোমড়ে ভীষণ ব্যথা পেয়েছে। সোজা হয়ে বসা যাচ্ছে না। তা দেখে কোহিনূর ভেতরে ঢুকে আসে এবার। রাগিনী চোখ দুটো কপালে তুলে তাকিয়ে থাকে। আসলে কোহিনূর এই সকালে তার বাড়িতে উপস্থিত হবে সেটা ভাবতে পারেনি। এখনো পারছে না। ফলে নিজের চোখটাকে বিশ্বাস করাতে তার এই অপলক চাহনি কোহিনূরের উপর থেকে সরছে না। যখন কোহিনূর একহাত রাগিনীর পিঠ এবং অন্যহাত দিয়ে রাগিনীর হাত স্পর্শ করে রাগিনী এক অন্য ঘোর থেকে বেরিয়ে চকিতে তাকায়। ছটফটিয়ে ওঠে। কোহিনূর তাকে থামাতে নির্বিঘ্নে বলে ওঠে,
“আরে! তুমি একা উঠতে পারবে না। আমি হেল্প করছি।”

“আগে বলুন আপনি এতো সকালে এখানে কি করছেন? আর সায়েদুল চাচা আপনাকে ঢুকতে দিল কি করে? আরো একটা কথা, আপনি আবারও আমার বাড়ি চিনলেন কি করে?”

একটা প্রশ্নের উত্তরও পায় না রাগিনী। তার এমন প্রশ্নের উপর প্রশ্ন এবং তাকে দাঁড়াতে সাহায্য করতে চাওয়া সত্ত্বেও যখন কোহিনূর রাগিনীর মাঝে কোনোরকম হেলদোল দেখতে পেলো না তখন থম মেরে এক মূহুর্ত রাগিনীর পায়ে চেয়ে থেকে হুট করেই মেয়েটাকে আরেক দফা চমকে দিয়ে কোলে তুলে নিল কোহিনূর। রাগিনী বোকা বনে গেল। আকস্মিকতায় সে কূল পেলো না। কাঁপতে থাকল ভয়ে। একহাতে খামচে ধরল কোহিনূরের জামা। মুখ লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে বলে উঠল,
“আশ্চর্য! এটা কি করছেন?”

“হেল্প!”

“এটা কোন ধরণের হেল্প?”

আর উত্তর এলো না কোহিনূরের মুখ থেকে। বিরাজ করল নিরবতা। এমন নিরবতার কারণ দেখতে খিঁচে রাখা চোখ দুটো খুলে তাকায় রাগিনী। তীব্র রোদের আলোয় আবারও বন্ধ হয়ে আসে তার আঁখি। তবে অস্পষ্ট দৃশ্য দেখা যায়। কোহিনূর শব্দহীন হাসছে। তার হাসি বরাবর মারাত্মক! একেবারে রাগিনীর হৃৎস্পন্দনের গিয়ে হা’মলা করে। এই হাসিটা দেখে আবারও নিজের মনে উথাল-পাতাল ঢেউ খেলানোর মানে হয় না। রাগিনী নড়েচড়ে উঠে নামার চেষ্টা করে। আর কোহিনূরের বুকে একটু থাবা মারতেই পুরো শরীর ঝাঁকিয়ে তোলে সে। মুখ দিয়ে ব্যথিত সুরে বলে,
“উঁহু… লাগছে আমার।”

রাগিনীর মনে পড়ে কোহিনূরের গতকালকে পাওয়া আঘাতের কথা। সঙ্গে সঙ্গে রাগিনী হাত সরিয়ে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
“সরি, সরি, সরি! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আপনি আমাকে রোদের দিকে ধরে রেখেছেন। একটু বেডে বসিয়ে দিলেই তো পারেন।”

কোহিনূর আর এক মূহুর্তও না থেমে রাগিনীকে ধপ করেই বসিয়ে দিল বিছানায়। কোমড়ে যেন এবার খট করে উঠল। মুখ জড়িয়ে কোমড়ে হাত রেখে বলল,
“কোলে নিয়েছিলেন যাতে আমি ব্যথা না পাই সেজন্য। এখন বিছানায় ছুঁড়ে ফেলছেন যাতে ব্যথা পাই সেজন্য?”

“কি করব মিস. রাগের রানী! এতোদিন অবধি মনের দরজা বসে বসে ভাঙছিলে সেটা অবধি ঠিক ছিল কিন্তু আজকে আমার শরীরটাকেও আ’ঘাত দিয়ে ক্ষ’তবিক্ষ’ত করে ফেলছো। এতো কিছু মানা যায়?”

কথাটা শেষ করল কোহিনূর ব্যস্ত গলায়, আনমনে। নিজের কাঁধে হাত দিয়ে আলতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল সে। কিন্তু রাগিনীর জবাব না পেয়ে তার মনে হয় সে আসলে একটু আগে কি বলল? মাথা উঠিয়ে কোহিনূর দৃষ্টি রাখে রাগিনীর উপর। মেয়েটা ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে আছে। পলক ফেলার নাম নেই চোখের। উশখুশ করে ওঠে কোহিনূর। আজকাল মুখ দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কথাবার্তা সব বেরিয়ে যাচ্ছে। এর একটা ব্যবস্থা করা উচিত। অন্যদিকে রাগিনী থম মেরে বসে রয়েছে। কানে পালা করে বার বার কাছে কথাটা। কথাটায় মাখানো ছিল কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভূতি। যা রাগিনী অনুভব করতে পারে। সেই অনুভব রাগিনীর হৃদয় নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। সামনে থাকা মানবটির দিকে মনোযোগের সহিত চেয়ে বোঝার চেষ্টা করে, ‘তার মনেও কি বেঁধেছে কোনো নতুন অনুভূতির বাস?’

কোহিনূরের হাতটার শীতল স্পর্শ যখন রাগিনীর কপালে পড়ে তখন মৃদু কেঁপে ওঠে রাগিনী। বড় বড় দুইবার নিশ্বাস নিয়ে কিছু বলার আগেই কোহিনূর বলে ওঠে,
“যাক জ্বরটা নেমেছে।”

“আপনি এখানে এলেন কি করে?”

রাগিনী এবার স্পষ্ট করে দৃঢ় গলায় প্রশ্ন করে। কোহিনূর এক দম নেয়। তারপর উত্তর দেয়,
“আগেরবার যেভাবে এসেছিলাম!”

“কি করে এসেছিলেন আগেরবার?”

“তা তো মনে নেই।”

ভ্রু কুঁচকে যায় রাগিনীর। লোকটার এটা মনে থাকে না কেন? এটা কেমন সমস্যা? এবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“মনে করুন। মনে করে তারপর বলবেন। এখানে কি করে এসেছেন তাও বলুন। বাড়িতে কি করে ঢুকলেন?”

বলেই ঘড়ির দিকে তাকালো রাগিনী। ঘড়িতে সকাল দশটা ছুঁইছুঁই। এর মানে তার বাবা রাশেদ সাহেব এতোক্ষণে নিজের ডিউটির জন্য বেরিয়ে যাওয়া কথা! গিয়েছেনও হয়ত। তাহলে কি কোহিনূর মেইন গেট দিয়ে ঢুকেছে? তাহলে তো সায়েদুল চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তোলার কথা! তেমন তো কিছুই শুনলো না রাগিনী। এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে কোহিনূরের কথায় তার দিকেই মনোযোগ স্থির হলো তার।
“আমার এতটুকু মনে আছে যে আমি এখানে যখন আসি তখন বাড়ির বাহিরে ওই লোকটা আমাকে ঢুকতে দেয়নি তাই পাঁচিল টপকে এসেছি।”

রাগিনীর চক্ষু এবার চড়কগাছে পরিণত হয়। এতো সাংঘাতিক মানুষ! না চাইতেও ফট করে বলে ওঠে,
“আপনি কি আগে চোর বা ডাকাত ছিলেন?”

“হোয়াট?”

কোহিনূর সরু দৃষ্টিতে থাকায়। রাগিনী হালকা কেশে বলে ওঠে,
“না কিছু না।”

এবার কোহিনূরের কিছু বলার আগেই বিড়ালটা মিউ মিউ করে হঠাৎ করেই কোহিনূরের হাঁটুর কাছে এসে দাঁত বের করে। যেন সে খুব রেগে গিয়েছে। তা দেখে কিছুটা চমকে তাকিয়ে রাগিনী স্বভাবসুলভ হাসি দিতেই কোহিনূর বলে ওঠে,
“দেখো, একদিন হতে না হতেই তোমার সঙ্গে থেকে থেকে সে তোমার স্বভাব পেয়ে যাচ্ছে। যখন তখন আমাকে ধমকাচ্ছে। তার নাম আই থিংক রাগিনীর কাট ভার্সন রাখলে ভালো হয়।”

“মোটেও না। সে আপনাকে সহ্য করতে পারছে না কারণ আপনি আমার কাজে বাঁধা দিয়েছেন। আমি ওর জন্য খাবার আনতে যাচ্ছিলাম। সেটা আপনার জন্য এখনো আটকা পড়ে আছে।”

রাগিনী থামে একটু। বিড়াল ছানাকে আলতো করে ছুঁইয়ে কোলে নিয়ে বলে,
“তাছাড়া সে ছেলে। তাই তার জন্য ছেলে নাম ঠিক করতে হবে। এখনো ওর নাম দিতে পারিনি আমি। আপনি বসে বসে নাম ঠিক করুন। আমি ওর জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”

“ওর জন্য খাবার নিয়ে আসছি। বাড়িতে একটা ক্ষুধার্ত আর অসহায় ব্যক্তি এসেছে তার দিকে তোমার হুঁশ আছে? শুধু এই দুই আঙ্গুলের ছানার দিকে খেয়াল!”

রাগিনী উঠে দাঁড়িয়েছিল সবে। দরজার দিকে অগ্রসর হয়েছিল। কোহিনূরের এরূপ কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সে। চোখে পড়ে এক ভ্রু উঁচিয়ে রেখে ঠোঁট কামড়ে ধরে রাখা মানুষটির উপর। বুকে দুটো হাত সুন্দর করে জড়িয়ে রেখেছে। রাগিনী হাসি হাসি মুখেই জবাব দেয়,
“তবে সেই ক্ষুধার্ত আর অসহায় মানুষকে অসহায় অসহায় ভাব ধরতে হবে। তবেই আমি বুঝব। এমন স্টাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে রাগিনী জীবনেও খাবার দেবে না।”

মুখটা কাঁচুমাচু করে তড়িঘড়ি করে হাতটা নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় কোহিনূর। রাগিনীর হাসির শব্দ পায় সে। হেঁসে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। দরজার ওপারে গিয়ে বলে,
“আর একটা কথা, ঘর থেকে বের হবেন না। তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আমি এপাশ থেকে দরজা লাগিয়ে দিলাম।”

বলেই দরজা বন্ধ করে দেয় রাগিনী। কোহিনূর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে। গালে হাত রেখে বিড়াল ছানার দিকে তাকায়। সে এখনো কোহিনূরের দিকে কেমন গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। তা দেখে কপাল কুঁচকায় কোহিনূর। হাতটাকে জড়ো করে বলে,
“এইযে, রাগের বস্তা! আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। চোখগুলো খুলে নিয়ে বাহিরে ফেলে দেব বুঝলে?”

বিড়াল ছানা এবার তেড়ে আসতেই সরে বসে কোহিনূর। বিরবির করে বলে,
“এ্যাংরি বার্ড পুরো! নামটা ভাবছি এ্যাংরি বার্ডই রাখা উচিত। চোখ খুলে নেব না হ্যাপি?”
বিড়াল ছানাটি এবার বসে পড়ে। তার শরীর চুলকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কোহিনূরও এবার চুপ করে। ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি পড়তেই নজরে আসে নিচে পড়ে আছে রাগিনীর টাওয়াল। একটু ঝুঁকে হাত দিয়ে তুলে নেয় সে। চোখটা আঁটকে যায় সেই টাওয়ালেই।
“মেয়েটা এবং তার সাথে জড়িয়ে থাকা প্রতিটা জিনিসই এতো মোহনীয় কেন?”

ফ্রি টাইম চলছে এখন সিটি হসপিটালে। দুপুরের সময়। গরম বেশি পড়েছে। সূর্যমামার প্রকোপ একটু বেশিই। দ্বিতীয় তলার প্রথম চেম্বারের দরজার সামনে বড় বড় করে লিখা, ‘ড. শাহ্ রাশেদ রাশেদ (মনোবিজ্ঞানী)।
চেম্বারের ভেতরে বসে রয়েছেন রাশেদ সাহেব। বাড়িতে সৈয়দের কাছে ফোন করে রাগিনীর খোঁজ খবর নিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত হন তিনি। সকালে অবশ্য চেম্বারে আসার আগে মেয়েটার ঘরে তিনি গিয়েছিলেন। ঘুমিয়েছিলেন বলে ডিস্টার্ব করেন নি আর। তাই মেয়েটাকে একটু দেখেই বেরিয়ে পড়েন কাজের জন্য। উনার বসে থাকার জো নেই। প্রতিদিন কতশত পেশেন্ট আসে তার ঠিক নেই। প্রচন্ড ব্যস্ত মানুষ। সৈয়দের কল সবে কাটতে না কাটতেই আরেকটা ফোন আসে উনার ফোনে। নম্বরটা দেখে খানিকটা অবাক হন রাশেদ সাহেব। সরু চোখে তাকায়। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি আসে। ফোনটা দ্রুত রিসিভ করেন।
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৬

রাশেদ সাহেব ফোনটা রিসিভ করতেই ফোনের ওপাশ থেকে একটা বয়স্ক কন্ঠ ভেসে আসে। রাশেদ সাহেব বিস্ময়ের সাথে জবাব দেন,
“ও মাই গড! ইটস্ রিয়েলি ইউ। এতোদিন পর তাহলে এই পুরোনো বন্ধুকে মনে পড়ল? এতোদিন পর খবর নেওয়ার কারণ কী?”

ওপাশে এবার বয়ে যায় হাসির শব্দ। হাসতে হাসতেই সেই বয়স্ক কন্ঠস্বর জবাব দেয়,
“আমি না হয় স্বার্থপর মানুষ। তুই তো খুব উদার। তাহলে তুই কোনো খবর নিসনি কেন? শেষমেশ আমাকেই তো বাধ্য হয়ে কল করতে হলো।”

“তুই যেমন ব্যস্ত। আমি জানি তুই এই বয়সেও ঠিকঠাক নিশ্বাসও ফেলার সময় পাস না। তোর অর্ধেক ব্যস্ততা আমার থাকলেও আমিও তো সেই হিসেবে ব্যস্ত মানুষ! আমি বলছি কি! এখন রেস্ট নে। তোর ছেলে তো অলরেডি অর্জন করা শুরু করেছে। এতো টাকা দিয়ে করবি? যদি বৃদ্ধবয়সে ইনজয়ই না করতে পারিস তো! এই সাইকোলজিস্টের কথা শোন। মন আর শরীর দুটোই ফ্রেশ থাকবে।”

“হাজার ব্রেক নিলেও আমার এই ছেলেটা আমাকে জীবনেও ফ্রেশ থাকতে দেবে না বুঝলি? সারাদিন আমাকে প্রেশারের উপর না রাখলে তার চলেই না।”

“ছেলেমানুষ। সবে যুবক! একটু চঞ্চল তো হবেই।”

হাফ ছাড়ে ওপাশের মানুষটি। ক্লান্তির সাথে বলে,
“তাই বলে এতো চঞ্চল? কখন কোথায় ম্যাজিকের মতো গায়েব হয়ে যায় সেটা তুই ভাবতেও পারবি না। তার একেকটা আবদার শুনলে মাথা হ্যাং হয়ে যাবে।”

এবার রাশেদ সাহেব হাসেন। হাসিমুখে জবাব দেন,
“তুই যেটাই বল না কেন! অভিরূপ ছেলেটাকে আমার বেশ পছন্দ। কথায় কথায় হাসাতে পারে ছেলেটা। তাকে সেই ছোটবেলায় দেখেছিলাম। তখন থেকেই ছেলেটা গানে ছন্দে ছন্দে কথা বলতো! আমার বেশ ভালো লাগতো।”

আরো এমন বেশ কথাবার্তা মজা ঠাট্টা চলল রাশেদ সাহেব এবং ফোনের ওপ্রান্তে থাকা মি. নাদিম চৌধুরীর মাঝে। নাদিম চৌধুরীও পেশায় একজন ডক্টর। আর এই ডক্টর হওয়ার খাতিরেই উনার পরিচয় রাশেদ সাহেবের সাথে হয়। রাশেদ সাহেবের স্ত্রী মিসেস. নীলিমা যখন ভয়াবহ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তখন তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ছুটে যান ইন্ডিয়ায়। তখন উনার পরিচয় হয় নাদিম সাহেবের সাথে। নীলিমার চিকিৎসা যখন দীর্ঘকাল ধরে চলে তখন রাশেদ সাহেবেট পাশে ছিলেন নাদিম সাহেব। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। মিসেস. নীলিমা পরপারে চলে যান। ছোট্ট রাগিনী তখন কিছুই না বুঝলেও ছোট মেয়েটার চিন্তা এবং নিজের স্ত্রী হারানোর শোকে রাশেদ সাহেব ভেঙে পড়লে তার পাশে ছিলেন নাদিম সাহেব। এভাবেই হয় উনাদের বন্ধুত্ব। তবে দেশে আসার সাথে সাথে ব্যস্ততা, বাস্তব জীবনে জড়িয়ে কোথাও একটা হারিয়ে যান দুজনই। মাঝে মাঝে দুই বন্ধুর কথা হলেও কয়েক বছর ধরে যেন সেটাও হয়নি। আজ অনেকদিন পর দুই বন্ধুর আলাপ জমে উঠেছে। কথার মাঝে হঠাৎই নাদিম সাহেব বলে উঠলেন,
“শোন, তোদের ওখানে কি কোনো টেরো’রিস্ট হা’মলা হয়েছে বা এর প্রকোপ রয়েছে?”

“তা আছেই। জানি না পুলিশ টিম ওদের কবে ধরতে পারবে! কবে দেশে একটু শান্তি মিলবে!”

চিন্তিত সুর রাশেদ সাহেবের। তা দেখে নাদিম সাহেবও নিরব রইলেন। কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে বললেন,
“আর এতো ডেঞ্জারাস টাইমে আমার ছেলের সাধ জেগেছে তোদের দেশে যাওয়ার। এখন তাকে কি করে আঁটকায় বল তো? গিভ মি অ্যা সাজেশন!”

“ওহ হ্যাঁ। দেখলাম আমি। নিউজপেপারে বেরিয়ে গেছে অলরেডি। আটকাতে চেয়েও লাভ নেই রে। কিন্তু এর জন্য আবদার তোর কাছে আছে। যখন ছেলেটা আমার দেশেই আসছে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দে।”

বেশ সোজাভাবে প্রস্তাব রাখলেন রাশেদ সাহেব। তবে নাদিম সাহেব ধীর গলায় বললেন,
“আমি বললেই তোর বাড়ি যাবে সে? অলরেডি হোটেল বুক করা শেষ তার। ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়াই যায় না। কি যে এক ছেলে হয়েছে!”

“তাহলে দেশে আসতে দে। দরকার পড়লে আমি নিজে ওর কাছে গিয়ে সাথে করে নিয়ে আসব। ফ্লাইট কখন অভিরূপের?”

“কালকের পরের দিন। ভোরে সে যাচ্ছে।”

আরো বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল তাদের মধ্যে। দুজনই অনেকদিন পর যেন নতুন আলাপ জুড়ে বসেছেন। ব্রেক শেষ হয়ে আসতে আসতে কলটা কাটলেন রাশেদ সাহেব।

বিড়াল ছানাকে খাবার খাওয়াতে ব্যস্ত রাগিনী। অন্যহাত দিয়ে কাঁধের কাছ থেকে ভেজা চুলগুলো ঠেলে পিঠের দিকে দিচ্ছে সে। ছোট চুলগুলো চোখের সামনে পড়ায় বিরক্তিতে ছেয়ে আসছে তার চেহারা। চুলগুলো তাড়াহুড়ো এবং ব্যস্ততায় পুরোপুরি মুছতেও ভুলে গিয়েছে সে। কোনোরকমে যে টাওয়াল বেঁধে রাখবে তার আগেই উপস্থিত হয়েছিল কোহিনূর। ফলে সেটাও হয়নি। চুল থেকে এখন টুপটুপ করে পানি পড়ে কিছুটা ভিজে গিয়েছে জামা। সামনে থাকায় সিঙ্গেল সোফায় বসে থেকে স্যান্ডউইচ খেতে খেতে আঁড়চোখে রাগিনীর বিরক্তি মাখা মুখটা প্রদর্শন করছে কোহিনূর। রাগিনীর চোখে বিড়াল ছানার প্রতি মায়া এবং যত্ন দুটোই ধরা দিয়েছে কোহিনূরের চোখে। স্যান্ডউইচ মুখ দিয়ে চিবুতেও ভুলে গিয়েছে সে। এতো অপূর্ব দৃশ্য যেন তার জীবনে প্রথমবারই দেখা। হয়ত তাই-ই। মেয়েটির মনে কি আসলেই মায়ার সেই মায়াময় রাজ্য উপস্থিত রয়েছে? যেখানে সকলের প্রতি মায়াদয়া এবং ভালোবাসা বরাদ্দ রয়েছে?

“মুখে একগাদা খাবার নিয়ে এভাবে স্ট্যাচুর মতো বসে থাকলে তো সারাদিনেও খাওয়া হবে না আপনার মি. কোহিনূর। তাড়াতাড়ি খান আর চলে যান এখান থেকে।”

বিড়াল ছানাকে খাওয়াতে খাওয়াতে ব্যস্ত কন্ঠে কোহিনূরের উদ্দেশ্যে কথাগুলো ঝাড়লো রাগিনী। কোহিনূরের ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। আশ্চর্য হয়ে বলল,
“এতো বড় বাড়ি আমার একটা মানুষের জায়গা দিতে অসুবিধে হচ্ছে তোমার? বড়লোকের মন বড় হওয়া উচিত। কিপ্টেমি করছো কেন? তাড়িয়ে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে?”

“আর আপনি না জানিয়ে এভাবে চলে এসেছেন সেটা কি ঠিক করেছেন? আর কোনদিক থেকে নিজেকে সামান্য মানুষ মনে হয় আপনার নিজেকে? নিজের হাতের দিকেই তাকান তো একবার। মনে হচ্ছে দৈত্যের দুটো হাত বেরিয়ে এসেছে। ঠিক একারণেই আমার লিটল ফেইরি আপনাকে ভয় পেয়ে রুড বিহেভিয়ার করে।”

পাহাড়সম বিস্ময় নিয়ে তাকালো নিজের হাতের দিকে কোহিনূর। দুটো হাত নাড়িয়ে দেখল। আসলেই কি? মিনমিন করে বলল,
“এগেইন জায়ান্ট?”

মুখটা থমথমে করে এবার নিজের হাতের স্যান্ডউইচ রেখে দিল কোহিনূর প্লেটে। তা নজরে আসায় রাগিনী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে উঠল,
“কি হলো রাখলেন কেন খাবার? একটু আগেই তো খাবারের জন্য সামান্য বিড়ালটাকেও হিংসে করছিলেন।”

“ইউ নো হোয়াট? তোমার ছোট মনটার জন্য আমি খাচ্ছি না আর। আর খাবও না। সামান্য খাবার খাচ্ছিলাম বলে দৈত্য নিকনেম শুনিয়ে দিলে। আমি আর কোনো ভয়ানক নিকনেম নিতে পারব না।”

ঠোঁট একদিকে বাঁকিয়ে ভেংচি দিল রাগিনী। কোহিনূরকে পাত্তা না দিয়ে আপনমনে বলল,
“না খেলে না খাবেন। তাতে আমার কি?”

কোহিনূর থমথমে মুখে বসেই রইল। অতঃপর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটা আসলেই আর তাকে খেতে বলছে না? আজব! কেন বলবে না? বাঁকা চোখে স্যান্ডউইচের দিকে তাকালো কোহিনূর। রাত থেকে কিছু খাওয়া হয়নি তার। ফলে পেটে খিদেটা রয়েই গেছে। ঢক গিলে আস্তে আস্তে করে স্যান্ডউইচে হাত রাখল কোহিনূর। তৎক্ষনাৎ রাগিনী জোরে জোরে বলে উঠল,
“এখন আবার হাত বাড়াচ্ছেন কেন স্যান্ডউইচের দিকে?”

ধরা পড়ে যেন চোরের মতো তাকালো কোহিনূর। হালকা নড়েচড়ে উড়ে জ্ঞানীদের মতো বলে উঠল,
“তুমি জানো না? খাবার নষ্ট করতে নেই? পাপ হয়। তোমার কথার জন্য তো আমি আর পাপ করতে পারি না। সো আমি খাচ্ছি। নয়ত আমার একদমই খাওয়ার মুড নেই। তবুও খাচ্ছি।”

রাগিনীর হাসি পায়। কোনোরকমে হাসিটা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আঁটকে রাখে। এই মূহুর্তে হেঁসে দিলে লোকটা খাবেই না। সেও জানে কোহিনূর গত রাত থেকে না খাওয়া। ফলে তার খাওয়াতে আর ব্যাঘাত ঘটাতে চায় না রাগিনী। নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“তো পুচকি ছানার কোনো নাম ঠিক করলেন?”

“হ্যাঁ করেছি তো।”

“কি নাম?”

“রাগ।”

কোহিনূরের মুখ থেকে কথা বের হতেই মুখ তুলে অবাক পানে চাইলো রাগিনী। কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ল তার। চোখজোড়া হয়ে এলো সরু। কোহিনূর খেতেই ব্যস্ত। অন্যদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। রাগিনী চরম বিস্মিত হয়ে বলল,
“রাগ? এটা কেমন নাম? কি আজেবাজে নাম বললেন?”

“পারফেক্ট ফর দ্যাট লিটল ডাইনোসর। তোমার নামের সাথে মিলও থাকছে। তোমার আমাকে থ্যাংক দেওয়া উচিত। কারণ এতো ইউনিক নাম তো তোমার মাথায় আসতো না।”

রাগিনী রেগেমেগে গিয়ে চিৎকার দেওয়ার জন্য তৈরি হলো। লোকটার কথা আর নেওয়া যায় না। তবুও চিৎকারটা মুখ থেকে বের করতে পারল না সে। বড় বড় নিশ্বাস ছাড়ল সে। মাথায় কিছু একটা ব্যাপার আসতেই ফট করে বলে উঠল,
“ইয়েস, রিও! রাগিনী, রিও। লিটল ফেইরির নাম হবে রিও।”

কোহিনূর তা শুনে মিনমিন করে বলল,
“আই থিংক রাগ নামটাই বেটার ছিল। রাগিনী, রাগ!”

রাগিনী এবার চোখ রাঙাতেই নিরব হলো কোহিনূর। শেষবারের মতো খাবার মুখে নিতেই হাতের কাছে থাকা গ্লাসটা ধরে চোখের সামনে নিয়ে আসতেই গ্লাসে দুধ ভর্তি দেখে নাক শিটকে এলো তার।
“দুধ! এখন দুধ কে খায়? রাগিনী, আই এম অ্যা জেন্টেলম্যান।”

রাগিনীর দৃষ্টি আবারও কড়া হতে থাকলো। কোহিনূর সেদিকে খেয়াল না করেই বলে উঠল,
“কোথায় বিয়ার থাকবে তা না…”

রাগিনীর দিকে নিজের দৃষ্টি যেতেই মুখের জবান আপনাআপনি বন্ধ হলো কোহিনূরের। দৃষ্টি নিচে নামিয়ে গ্লাসটা মুখে ধরতেই তড়িঘড়ি করে নেমে এসে রাগিনী ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“আগে বলুন তো! আগে কি ছিলেন আপনি? কোনো চোর? ডাকাত? নাকি মদখোর লোক?”

জিহ্বা বের করে মাথা ঝাঁকায় কোহিনূর। চোখ গোল গোল করে বলে,
“ছিঃ ছিঃ! কি বলছো?”

“তো আর কি বলব? বিয়ার চাইছেন এখন। কাল হুইস্কি চাইবেন। পরের দিন ইংলিশ ড্রিংকস্। তারপরের দিন…”

রাগিনীর উত্তেজিত কন্ঠ একেবারেই থেমে গেল কোহিনূরের স্পর্শে। এক নিশ্বাসে বলা কথাগুলো একমুহূর্তে মিইয়ে গেল। কোহিনূর তার ঠোঁটে আলতো করে হাত রেখে চেপে ধরেছে। স্থির হয়ে গেছে যেন এক মূহুর্তের জন্য হৃদকম্পনও। আস্তে করে নিজের পাশে সোফার হ্যান্ডেলে থাকা টাওয়ালটা রাগিনীর মাথায় রেখে এবার দুহাত দিয়ে পেচিয়ে টাওয়াল আঁটকে দেয় কোহিনূর। মনের মাঝে সেই অদ্ভুত অনুভূতির সুর যেন বেজে চলেছে। রাগিনীর সেই দৃঢ় দৃষ্টি উপেক্ষা করার সাধ্য নেই কোহিনূরের। ফলে তার দৃষ্টিও নিবদ্ধ, স্থির! চোখে চোখ রেখেই সে ধীর গলায় বলল,
“কথা বলার মাঝে তো শ্বাসও নিতে পারো নাকি? দম আঁটকে যাবে তো।”

রাগিনীর উত্তর নেই। হাত দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে। কন্ঠস্বর যেন হারিয়েছে অদূরে। কোহিনূর আবারও বলে,
“চুলের পানিতে ভিজে গেছে পিঠের পেছনে। একটু তো খেয়াল রাখা উচিত মিস. রাগিনী।”

বহু কষ্টে দুই কদম সরে এলো রাগিনী। পা দুটোও যেন চলতে ব্যর্থ হচ্ছে। ঢক গিলে বেশ গম্ভীর হয়ে কথা কাটানোর চেষ্টা করে বলল,
“আমরা বের হবো। তাড়াতাড়ি বাকিটা খেয়ে নিন।”

কোহিনূর স্মিত হাসলো। ধপ করে পুনরায় সোফায় বসে পড়ল। সে রাগিনীর চোখেমুখে স্পষ্ট এক গোলাপি আভার আস্তরণ দেখতে পেয়েছে। দেখা পেয়েছে তার লাজুক চোখের। যার প্রতি কোহিনূরের ঝোঁকটা একটু বেশিই।

চেয়ারের উপর ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা পেছন দিকে রেখে চোখ বুঁজে রয়েছে রায়ান। কিছুক্ষণ আগেই দুটো ছেলেকে রিমান্ডে ইচ্ছেমতো উত্তমমধ্যম দিয়ে ক্লান্ত সে। কেসটা ধর্ষ’ণের। খুবই সেনসিটিভ। প্রায় একঘন্টা মা’রধর করার পর অবশেষে দুটো ছেলে স্বীকার করেছে। যখন তারা তাদের মুখে কথাগুলো স্বীকার করেছিল তখনই রায়ানের তীব্র ইচ্ছে জেগে উঠেছিল দুটোকে সেখানেই মে’রে পুঁতে দেওয়ার। কিন্তু তা করা যাবে না। মেজাজ খারাপ নিয়ে বিরস মুখে সব বন্ধ করে রাখা তার। চোয়ালের দু দিক এখনো ওঠানামা করছে। কপালের রগ দপদপ করছে। উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারাটায় লাল আভা দেখা যাচ্ছে। ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন এলো। বেজে উঠল টেলিফোন। রায়ান চোখ মেলে তাকালো। সোজা হয়ে বসে ল্যান্ডলাইন থেকে কল রিসিভ করে বলল,
“হ্যালো, ইন্সপেক্টর রায়ান বলছি!”

“ইন্সপেক্টর রায়ান, আমি তোমার এসপি স্যার।”

এবার অত্যাধিক মনোযোগ দিয়ে কলে কন্সেন্ট্রেট করে রায়ান। শক্ত গলায় বলে,
“ইয়েস স্যার!”

“তুমি কি ব্যস্ত আছো?”

“না স্যার। কোনো সমস্যা হয়েছে কি?”

ওপাশ থেকে ক্ষীণ সুরে ভেসে এলো এসপি অফিসারের গলা।
“তা তেমনটা নয়। তুমি হয়ত জানো যে ইন্ডিয়া থেকে অভিরূপ চৌধুরী আসছেন। আর তোমার তো জানাই আছে এখন তার মতো কোনো সুপরিচিত কেউ আসা মানে আমাদের ক্ষেত্রে বিপদজনক। আর ঢাকায় যে সেই টেরো’রিস্ট টিম এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই ভাবছিলাম বিষয়টা যদি তুমি দেখতে। অন্যদিকে অফিসার নির্জন ব্যস্ত সেকারণে ওকে আর ডিস্টার্ব করলাম না। তুমি কি ওইদিকে সময় দিতে পারবে?”

রায়ান বাধ্য কন্ঠে বলে উঠল,
“জি স্যার। সিউর। অভিরূপ চৌধুরীর প্রটেকশনের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।”

“যাক ভরসা পেলাম।”
আশ্বস্ত হন এসপি অফিসার। তারপর বলেন,
“সো, বি রেডি! পরশুদিন সকাল সাতটায়।”
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৭

নিজের ঘরের দরজা খুলে একটু বের হয়ে আশপাশটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে রাগিনী। পুরো করিডরের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত বেশ ভালোভাবে দেখে নেওয়ার পর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে। কোহিনূর সোফায় বসে ঘুমে ঢুলছে। চোখটা বন্ধ করছে আবারও খুলছে। মাথাটা ঘুমে নিচু হয়ে আসছে আবারও হুঁশ এলে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করছে। অতঃপর নিজের বিরক্তির শ্বাস ফেলে একহাতে নিজের চোখেমুখে হাত দিয়ে ডলে আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলছে। রাগিনী আশ্চর্য হয়ে সব কাহিনী দেখছে। এতো ঘুম কই থেকে আসছে তার? সারারাত কি ঘুমাতে পারে নি? রাগিনী একটু ফিসফিস করে ডাকার চেষ্টা করল,
“চলে আসুন। রাস্তা ফাঁকা আছে। আপনাকে বাড়ির বাহিরে বের করতে পারলে তবেই আমার শান্তি।”

“কিন্তু আমার শান্তি হয় তোমায় অশান্তি দিয়ে মিস. রাগের রানী!”

কোহিনূরের নির্লিপ্তভাবে স্বীকার! চকিতে তাকায় রাগিনী। লোকটা যে তাকে ইচ্ছে করে জ্বালায় সেটা বুঝতে পেরেছে সে এর আগেই। কিন্তু এই জ্বালা যে তার আনন্দের সেটা হয়তবা কোহিনূর সাহেব এখনো বুঝতে পারেন নি। পারার দরকারও নেই। রাগিনী মুখে রাগের ছাপ এনে বলে,
“বের হন আমার ঘর থেকে।”

ঠোঁট বাঁকিয়ে কোহিনূর থমথমে গলায় উত্তর দেয়,
“যাচ্ছি যাচ্ছি। আমার এখানে আসারও কোনো ইচ্ছে ছিল না। নেহাতই আমার জন্যই তোমার…”

কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে নিজের জবান বন্ধ করল কোহিনূর। হাই তুলতে তুলতে হেলেদুলে ঘর থেকে বের হলো। রাগিনী উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাকি কথা শোনার জন্য। কী বলতে চাইলো লোকটা? পিছু পিছু বেরিয়ে এলো রাগিনী। হাঁটতে লাগল কোহিনূরের পেছন পেছন। কোহিনূর তার প্যান্টের দুই পাশের পকেটে হাত দিয়ে খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে হেঁটে বড় বড় পায়ের ধাপ ফেলে যাচ্ছে। রাগিনী হতবাক তার কর্মকান্ডে। হঠাৎ করে কোহিনূর ঠোঁট দিয়ে শিষ বাজিয়ে ওঠাতে ধড়ফড়িয়ে উঠল রাগিনী। লোকটার হাবভাব যেন এমন যে সে তার নিজের বাড়ির করিডোর দিয়ে যাচ্ছে। শিষের শব্দ যেন কারোর কান অবধি না পৌঁছে তাই দ্রুত ছুটে গেল রাগিনী কোহিনূরের পিছু। কাছাকাছি আসতেই কোহিনূরের পরনের জামা টেনে ধরে পায়ের তালুতে ভর করে একটু উঁচু হয়ে ঝাঁপিয়েই পেছন থেকে কোহিনূরের মুখে হাত রেখে তার শিষ বাজানো বন্ধ করার চেষ্টা করল সে। আতঙ্কে নিজেরও যেন বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে। এই মূহুর্তে কোহিনূরকে বাড়িতে দেখলে কাহিনীর শেষ হবে না। তা নিয়ে বেশ ভয়ে আছে রাগিনী। সে ধীরে ধমকে বলে ওঠে,
“চুপ, চুপ! নিজের বাড়ি পেয়েছেন নাকি? আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন আপনি লুকিয়ে এসেছেন আর লুকিয়েই বের হতে হবে।”

বলা শেষে দূরে সরে আসে রাগিনী। তারপর ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বলে,
“আমার পেছন পেছন আসুন।”

“এজ ইউর উইশ।”

রাগিনী কোহিনূরের পাশ কাটিয়ে সামনে হাঁটতে শুরু করে। আশপাশ নজরে রাখে। দোতলার করিডোরে কেউ নেই। তাই সিঁড়িতে পা রাখে সে। কিছুটা নেমে খেয়াল করে নিচের হলরুমে সৈয়দ কাজ করছে। প্রতিটা শোপিচ, সোফার হ্যান্ডেল সযত্নে মুছতে ব্যস্ত সৈয়দ। তা দেখে ফট করে পিছু ফিরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসা কোহিনূরের দিকে তাকায় রাগিনী। আর চোখ গরম করে বলে উঠল,
“আর আসবেন না। নিচু হন। নয়ত আপনাকে দেখতে পেয়ে যাবে।”

“এতো মহা মুশকিল!”

“আপনিই তো ডেকে এনেছেন মুশকিল। নিচু হন।”

খানিকটা জোরে ঝাড়ি দেওয়ায় নিজেই থতমত খেয়ে সৈয়দের দিকে তাকায় রাগিনী। সৈয়দ রাগিনীর আওয়াজ পেয়ে সবে সিঁড়ির দিকে তাকিয়েছেন। তৎক্ষনাৎ কোহিনূর নিচু হয়েছে। রাগিনী অপ্রস্তুত হেঁসে নিচে চলে আসে। এসেই সৈয়দের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“কাকা, আসলে হয়েছে কি! বাবার রুমটার ফার্নিচারগুলোতে অনেক ময়লা পড়েছে। তুমি তো এখানকার জিনিস মুছে নিচ্ছো। তাহলে যদি সেখানকার জিনিসও মুছে নিতে। জানোই তো, বাবার অপরিষ্কার জিনিসপত্র পছন্দ না।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, এখনি যাইতেছি তাহলে পরিষ্কার করতে। এখন শরীর কেমন তোমার? ঠিক আছো তো?”

বেশ বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করল সৈয়দ। রাগিনী মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর করল,
“হ্যাঁ, আমি এখন একদম ঠিক আছি।”

“যাক ভালো! আমিই ভয় পেয়ে গেছিলাম তোমার অবস্থা দেখে। ভালো মেয়েটা বাড়ি থেকে বের হয়ে এমন অবস্থায় ফিরলো! না জানি তোমার বাবা কতটা ভয় পেয়েছিল।”

বলতে বলতে রাশেদ সাহেবের রুমের দিকে চলে যায়। রান্নাঘরের দিকে চোখ যায় রাগিনীর। সেখানে সাহানা রান্না করছে। সাহানা এখানে না থাকলেও রান্না করার জন্য আসেন শুধুমাত্র। রান্না করে দিয়ে চলে যান। চোখে একটু কম দেখেন বয়স হওয়ায়। তাই রাগিনী পিছু ফিরে সিঁড়ির দিকে চেয়ে কোহিনূরকে ইশারা করে আসতে বলতেই কোহিনূর দ্রুত নেমে পড়ে। রাগিনী ফিসফিস করে বলে,
“এদিকে পেছনের দরজা। গিয়ে অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।”

কোহিনূর দ্রুত পেছন দিকে এগোতেই সাহানা রান্না করতে করতে হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে উঠলেন,
“কে? কে ওখানে?”

হকচকিয়ে উঠল রাগিনী। তার হয়েছে জ্বালা! যেদিকে যায় সেদিকেই বিপদ। রাগিনী সাহানাকে সামলাতে বলে ওঠে,
“খালা, আমি! এখানে আমি আছি।”

“তুমি না। মনে হইলো কোনো বেডা মানুষ দৌড়াইয়া পেছন দিকে গেল।”

“কই না তো। আমি তো এখানেই আছি। আমি তো কাউকে দেখলাম না। খালা! দিন যাচ্ছে তোমার দৃষ্টি এতোই প্রখর হচ্ছে যে তুমি ভুলভাল জিনিস দেখছো।”

সাহানার যেন বিশ্বাস হয় না। সে তো কিছুটা স্পষ্টই দেখেছে। তার উপরে শহরে এসেছে আত’ঙ্কবাদী। সাহানা সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকেন। এসব নিয়ে তার রাজ্যের দুশ্চিন্তা! তিনি জলদি গ্যাসের চুলো অফ করে দিয়ে গরম খুন্তি নিয়ে এগিয়ে আসেন। রাগিনী থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। শেষ রক্ষা বোধহয় হলো না! রাগিনীর নিকট এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে সাহানা আদুরে ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,
“তুমি জানো না মণি! আজকাল আত’ঙ্কবাদীর উপদ্রব হইছে। আমার সত্যিই মনে হইতেছে কেউ ছুটে গেল চোরের মতো। তুমি দাঁড়াও আমি গিয়া দেখি।”

বলেই বাড়ির পেছন দিক ধরে হাঁটা শুরু করলো সাহানা। হাতে সাবধানে ধরে রেখেছেন গরম খুন্তি। পিছু পিছু ভয়ে ভয়ে হাঁটছে রাগিনী। মিনমিন করে বলে,
“খালা! তুমি ভুল কিছু দেখেছো। তোমার চোখে তো সমস্যা! যাও না রান্না করো।”

সাহানা রাগিনীর কথা কানেও তুলল না। বরং সামনে এগিয়ে গিয়ে পেছনের ছোট দরজার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়াল। কাউকে দেখতে না পেয়ে আশ্বস্ত হয়ে ফিরতে লাগলেন উনি। রাগিনীও কিছুটা ক্ষ্যান্ত হলো এই ভেবে যে কোহিনূর হয়ত বেরিয়ে গার্ডেনের পেছনের দিকে রয়েছে। কিন্তু তার ধারণা ভাঙলো। কোহিনূর নিচতলার বারান্দা শুরু হওয়ার দিকে যেই দরজা রয়েছে তার ফাঁকে লুকিয়ে। তা দেখে আপনাআপনি হেঁচকি উঠে যায় রাগিনীর। কাঁদো কাঁদো হয়ে সাহানার পানে চাইলো সে। উনি সোজা দৃষ্টি রেখে হাঁটছেন। নজরে আসেনি কোহিনূর। হেঁটে এসে হঠাৎ করেই বারান্দার কাছের দরজায় দাঁড়াল সাহানা। এই মূহুর্তে সাহানা দরজার এপাশে, কোহিনূর দরজার ওপাশে। আর কিছুটা সামনে দাঁড়িয়ে রাগিনী দুজনকেই দেখছে। হঠাৎ করেই সাহানার গরম খুন্তিটা দরজার ওপাশে থাকা কোহিনূরের বাম হাতে ঠেকল। শিরদাঁড়া যেন নড়ে উঠল কোহিনূরের। চোখমুখ লাল হয়ে এলো। হাতটা জ্বলে উঠল। চিৎকার দিতে নিল। কিন্তু সামনে থাকা রাগিনীকে দেখে আর চিৎকার করাটা হয়ে উঠল না তার। মেয়েটা আস্তে করে ইশারা করে তাকে মানা করছে চিল্লিয়ে উঠতে। হাতটা তৎক্ষনাৎ সরিয়ে আলতো করে ফুঁ দিতে লাগল কোহিনূর। সাহানা এবার তেমন না পেয়ে চলে গেল। হাফ ছাড়ল রাগিনী। দমটা যেন আঁটকে ছিল ছোট্ট কুঠুরির মধ্যে। কোহিনূরের হাতটা টেনে দরজার আড়াল থেকে বের করে বলল,
“একটু হলে কী ঘটে যাচ্ছিল জানেন? আপনাকে আর এক মূহুর্তও বাড়িতে রাখা যাবে না। বের হন! বের হন এক্ষুনি।”

কোহিনূর মুখটা কাঁচুমাচু করে বের হবার গেটের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“যার জন্য চুরি করি সে-ই বলে চোর!”

রাগিনী ধুপধাপ করে হেঁটে এসে দরজার লক খুলে বলে,
“আমি চুরি করা জিনিস পছন্দ করি না। তাই চুরি করতে হবে না। দয়া করে চুরি করা বন্ধ করুন।”

বলে কিছুক্ষণের জন্য থামে রাগিনী। আর বাহিরের দিকে ইশারা করে ক্ষেপে উঠে বলে,
“এখন বাহিরে যান।”

কোহিনূর সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। তার মুখভঙ্গি বদলায়। কেমন যেন ছড়িয়ে যায় মলিনতা। রাগিনীর ভ্রু উঁচিয়ে এমন পরিবর্তনের কারণ জানতে উৎসুক হয়। লোকটা কী তার কথায় রাগ করল? তবে রাগিনীকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে কোহিনূর একটু ঝুঁকে রাগিনীর কপালে আঙ্গুল রেখে মলিন সুরে বলে ওঠে,
“আই এম সরি, রাগিনী! এগেইন আই এম সরি।”

নড়চড় নেই রাগিনীর। কোহিনূর তাকে সরি কেন বলছে হঠাৎ? কারণটা রাগিনীর মাথায় এলো না কিছুতেই। পরক্ষণেই সোজা হয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল কোহিনূর। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল রাগিনী কিছুক্ষণ। মনে হলো, লোকটা বোধহয় লুকিয়ে এসে তার সমস্যা বাড়িয়েছে সেটা বুঝতে পেরে সরি বলল। এটা ভেবে নিয়েই রাগিনী দ্রুত পেছনের দরজা দিয়েই বের হয়।

গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসেছে রাগিনী। মনোযোগটা সামনের দিকে রাস্তায়। খুব সিরিয়াস মুখের ভাব। পাশে কোহিনূর বসে বসে একবার আশেপাশে আরেকবার রাগিনীর দিকে চেয়ে রয়েছে। দৃষ্টির ধরণটা অন্যরকম। রাগিনী ড্রাইভিং করছে। সেটা দেখে কিছুটা হতবাক কোহিনূর। রাগিনী কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চায়নি। সে চায়নি ড্রাইভারকে নিয়ে যেতে কারণ রাশেদ সাহেবকে জানিয়ে দিতে তার সময় লাগবে না। কোহিনূর কন্ঠে বাচ্চা বাচ্চা ভাব এসেছে এবার।
“তুমি গাড়িও চালাতে পারো রাগের রানী?”

“উঁহু! শিখেছিলাম এর আগেরবার বাড়িতে এসে। কিন্তু এভাবে ড্রাইভ করা হয়নি। এখন আপনার জন্য সব করতে হচ্ছে। এখন যদি ভুলভাল কিছু হয়ে যায় আমার অদক্ষতার কারণে দায়ি থাকবেন আপনি বুঝলেন?”

“আমাকে কেন দোষারোপ করছো? কী করেছি আমি?”

রাগিনী চোখ বাঁকিয়ে আঁড়দৃষ্টিতে দেখে কোহিনূর মুখ ফুলিয়ে বাচ্চাদের ন্যায় করেছে। রাগিনী বলে,
“আপনি আবার কী করবেন? কিছুই না। এই শুধুমাত্র আমার বাড়িতে গিয়ে ছোটখাটো ব্লান্ডার করে এসেছেন।”

“আচ্ছা! মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে ড্রাইভিং করতে হয়?”

কোহিনূরের উদ্ভট প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে রাগিনী। স্টিয়ারিং থেকে আপনাআপনি এক হাত চলে যায় তার মাথায়। আসলেই তো! এখনো কোহিনূরের বেঁধে দেওয়া টাওয়াল তার মাথাতেই আছে। এতো টেনশনে সবটা গুলিয়ে গেছে তার। অমনোযোগী রাগিনীর হুঁশ ফেরে সামনে থেকে আসা তীব্র হর্ণের শব্দে। পাশ থেকে উশখুশ করছে কোহিনূর। মিনমিন করে বলছে,
“রাগের রানী, রাগের রানী! সামনে বড় গাড়ি। ধাক্কা দিয়ে দেবে তো।”

রাগিনী সামনে থাকা বড় ট্রাক দেখেই যেন সমস্ত শক্তি বেরিয়ে যায় শরীর থেকে। হাত-পা কাঁপতে থাকে। অনেকটা কাছে চলে এসেছে। মৃত্যু যেন অনেক কাছে। চোখ খিঁচে বন্ধ হয়ে আসে তার। স্টিয়ারিং ঘোরানোর শক্তি আর নেই। তখনি তার অনুভূত হলো একটা শীতল স্পর্শ। একটা ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া। কানে এলো উত্তেজনার সাথে বলা দুটো কথা,
“ওহ শিট!”

নেত্রপল্লব আপনাআপনি খুলে গেল রাগিনীর। অস্পষ্ট দৃষ্টিতে স্টিয়ারিংয়ে আরো একটা হাত দেখল। তাকে আগলে রাখা অন্যহাতটাও নজরে এলো ঘাড় বাঁকিয়ে দেখতেই। অন্যপাশে ফিরে তাকাতে তাকাতে ততক্ষণে গাড়ি থেমে গেছে। কোহিনূরের দৃঢ় দৃষ্টি রাগিনী উপেক্ষা করতে পারে না। লোকটির মুখে টান টান উত্তেজনা। কোহিনূর এবার রাগ দেখিয়ে গাড়ির সামনে থাবা মে’রে বলল,
“যেটা করতে পারো না করতে যাও কেন রাগিনী? জানো এখনি কী হতে পারতো?”

বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাগিনী। আঁখির পলক থমকেছে। এ কোন কোহিনূর খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভেতরে প্রশ্বাস ও নিশ্বাস প্রগাঢ় হয়ে উঠছে। দুটো সরু ঠোঁটের দূরত্ব বেড়ে গিয়ে হা হয়ে গিয়েছে। কোহিনূরও নিজেও স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। ঢক গিলে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“এক্ষুনি আমরা ম’রে যেতে পারতাম। ভালো করে গাড়ি চালাও।”

রাগিনীর ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায়। অতি দ্রুত কোহিনূরের পরিবর্তন দেখে আরেক দফা অবাক হয়। তবে প্রকাশ করে না। রাগিনী মাথা নাড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয় আবারও।

মেন্টাল হসপিটালের সামনে পৌঁছে চুলের থেকে টাওয়াল খুলে ফেলে রাগিনী অতি দ্রুত। চুলগুলো একটু ঝেড়ে নিয়ে খেয়াল করে তার পাশে থাকা মানবটি চোখমুখ খিঁচে বসে রয়েছে। চোখেমুখে ফোঁটা ফোঁটা পানি দৃশ্যমান। তা দেখে তাড়াতাড়ি করে চুল ঝাড়া থামিয়ে বলে,
“সরি আমি খেয়াল করিনি।”

কোহিনূর চোখ খুলে ঠোঁট উল্টিয়ে চোখটা নরম করে রাগিনীর কাছে অনুনয়ের সাথে বাচ্চাদের মতো বলে ওঠে,
“কালকে আবার আসবে তো আমার কাছে?”

“হ্যাঁ আসব।”

কথা শেষ হতে না হতে আজিম আসে। কোহিনূরের উদ্দেশ্যে বলে,
“আবার পালাইছিলি? বের হ বলতেছি।”

কোহিনূর আর দেরি করে না। নেমে পড়ে তাড়াতাড়ি করে গাড়ির দরজা খুলে বের হয়। রাগিনীর নজর এড়িয়ে যায় না এবার কোহিনূরের খুব অভিজ্ঞতার সাথে দরজা খোলার ব্যাপারটা। যেন সে ব্যাপারটায় অভ্যস্ত! রাগিনী এবার দৃষ্টি সরিয়ে আজিমের উদ্দেশ্যে বলে,
“দোষটা আপনাদেরই। উনার খেয়াল রাখবেন ভালো করে। এতো ইরেসপন্সিবলের মতো কাজ করলে আমি বাবাকে বলে আপনাদের কাজে রাখব না। এখানে পেশেন্টদের তো সেফটি নেই।”

“সরি ম্যাডাম। আর এমন হবে না।”
মাথা নুইয়ে বলল আজিম। আর কোহিনূরকে ভেতরে যেতে ইশারা করল। কোহিনূর হেলেদুলে ভেতরে যেতে গেলে আজিম তার হাত ধরেই ভেতরে নিয়ে চলে গেল। রাগিনী একধ্যানে শুধু চেয়েই রইল যতক্ষণ না মানুষটা তার দৃষ্টির অগোচর হলো!

সন্ধ্যা হয়েছে। নিজের বাম হাতটা নিয়ে আলতো ছুঁয়ে দেখছে নির্জন। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠছে সে। বাম হাতের তালুর রঙ লাল টকটকে হয়েছে। কেমন যেন ফুলে উঠেছে। তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে হুড়মুড়িয়ে মেহরাজ কেবিনে ঢোকায়। চোখ তুলে তাকাতেই মেহরাজ দাঁড়িয়ে যায়। দাঁত কেলিয়ে হাসে। নির্জন ঘাড় বাঁকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে,
“গেট আউট!”

মেহরাজ থতমত খেয়ে বলে,
“ইয়েস স্যার। কিন্তু কেন স্যার?”

“আই সেইড গেট আউট। গিয়ে বাহিরের দরজায় টোকা দিয়ে সম্মানের সহিত বলবে, মে আই কাম ইন স্যার? তারপর আমি পারমিশন দিলেই ঢুকবে।”

হতাশা ভরা মুখে চেয়ে রয় মেহরাজ। বলার চেষ্টা করে,
“কিন্তু স্যার কথাটা অনেক জরুরি তাই…”

“যাবে নাকি লাগাব দুইটা?”

মেহরাজ দমে গিয়ে বলে,
“জি স্যার যাচ্ছি।”

বাহিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে টোকা দেয় মেহরাজ। গলা খাঁকারি দিয়ে নরম সুরে বলে,
“মে আই কামিং স্যার?”

“ইয়েস কাম ইন।”

মেহরাজ এবার সুরসুর করে ভেতরে আসে। টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই মনে পড়ে কীভাবে নির্জন তার পেটে গুঁতো মেরেছিল তৎক্ষনাৎ সরে গিয়ে দাঁড়ায় সে। আর বলে,
“স্যার, মিস. আহমেদের খোঁজ পাইনি এখনো।”

“পাবে কি করে? ফ্লাইট মিস করেছে। নিশ্চিত এখনো কোনো লন্ডনের হোটেলে আছে।”

“এতো কিছু আপনি কি করে জানলেন স্যার?”

এবার বাম হাতের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেহরাজের দিকে তাকায় নির্জন। হালকা মোটা গোলাপি এবং ধূসরের সংমিশ্রণের ঠোঁটে আসে বাঁকা হাসি। একদিকের দাড়ি সহ গাল ফুলে ওঠে। নির্জন বেশ নির্বিঘ্নে বলে,
“সী ইজ মাই সিস্টার! ওকে রগে রগে আমার চেনা। ও লন্ডনের বাড়িতে ফিরবে না। কারণ গার্ডরা ওখানে এখনো আছে। সমস্যা নেই তবে দেশে ফিরে ও আমার কাছেই আসবে। কারণ ওর সমস্ত ব্যাংকের কার্ড আমি ব্লক করে দিয়েছি।”

হা হয়ে যায় মেহরাজ। বিস্ময়ের সুরে বলে,
“ইউ আর সো স্মার্ট স্যার!”

নির্জন হাসি বজায় রেখে বলে,
“আই নো ইট। আর নতুন কিছু বলার থাকলে বলো।”

মেহরাজ জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে দ্রুত একটা মোটা ফাইল এগিয়ে বলে,
“জি স্যার। একটা ইম্পরট্যান্ট ইনফরমেশন পেয়েছি। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে জানা যায় যে রাগিনী তাজরীন নামে একটা নয় স্যার। দুটো টিকিট কাটা হয়েছিল। তাও দুটো টিকিট ভিন্ন ভিন্ন কোচের।”

নির্জন অবাক হয়। হাসি মুখটা জড়িয়ে আসে। চুল এলিয়ে থাকা ফর্সা কপালে জমে প্রগাঢ় ভাঁজ। ফাইল খুলতেই টিকিট বুক করা সব ব্যক্তিদের নাম চোখে ভাসে। এক পৃষ্ঠায় রাগিনী তাজরীনের নাম দেখলো নির্জন। তাও কোচ নম্বর ‘ছ’। আরেক পৃষ্ঠাতে গিয়ে অন্য রাগিনী তাজরীন নামটাও চোখে পড়ল। সেখানকার কোচ নম্বর ‘গ’। আসলে কি হচ্ছে? বুঝে উঠতে বেগ পেতে হলো নির্জনের।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here