গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব -১০+১১

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_দশ

সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতেই আচম’কা কেউ ফাইজা’র হাত ধরে টেনে অন্ধকার রুমে নিয়ে আসলো। চারদিকে অন্ধকার দেখে ফাইজার বুক হয়ে কেঁপে উঠলো। একটা চেনা স্পষ্ট ফাইজা’র কোমর জড়িয়ে ধরতেই ফাইজা শা’ন্তির নিশ্বাস ফেলে সামনের ব্যাক্তি’টির শার্ট খামচে বললো….

—আরেক’টু হলে ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করতাম…..

বলতেই চারদিক’টা আলো ফুটে উঠলো। কলেজের দ্বিতীয় তলার ল্যাব রুম এটা। ফারদিন ফাইজার নাকে নাক ঘষে বললো…..

—আমাকে কেনো এড়িয়ে যাচ্ছো সকাল থেকে সুইটহার্ট? কষ্ট হচ্ছে তো….

ফারদিনে’র কথা শুনে ফাইজা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করতেই ফারদিন ফাইজা’কে নিজের সাথে আরো চে’পে ধরলো। ফাইজা চোখে মুখে বিরক্তি ভাব এনে বললো…..

–প্লিজ ছাড়ুন কেউ এসে দেখে ফেললে বাজে কান্ড হবে। এটা কলেজ ভুলে যাচ্ছেন আপনি…..

ফাইজার এহেতুক কথায় ফারদিন মুখের ভঙ্গিমা চেঞ্জ করে গম্ভীর কন্ঠে বললো….

–আমি একটা কুয়েশ্চন করেছি। এন্সার মাই কুয়েশ্চন…..

ফাইজা ফারদিনের দিকে এক নজর তাঁকিয়ে বুঝলো ফারদিন রেগে যাচ্ছে। তাই ফাইজা মাথা নিঁচু করে সোজা উওর দিলো……

–আমি আপনার সব প্রশ্নের উওর দিতে বাধ্য নই। সো, ছাড়ুন আমাকে। আমার ক্লাসে লেট হয়ে যাচ্ছে…..

ওর কথা শুনে ফারদিনের রাগে কপালের রক’টা খানিক’টা ফুলে উঠলো। ফারদিন ফাইজা’কে জোরে চে’পে ধরে বললো…..

–রাগিও না জান। ভালো মুখে আমার প্রশ্নের উওর’টা দিয়ে দাও। কেনো ইগ্নোর করছো আমাকে? হোয়াই জান হোয়াই?

ফাইজা একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো….

–কারনে-অকারনে আমাকে যেখানে সেখানে ছুঁবেন না। বিরক্ত লাগে আমার……

ফাইজার এমন উওরে ফারদিনের হাত’টা সরে এলো ফাইজার কোমর থেকে। ফাইজা কয়েক’পা পিছিয়ে দাড়ালো। ফারদিন এখনো ওর দিকে অবাক চাহনী নিক্ষেপ করে আছে। রাগে হাত’ দুটো মুঠোয় বন্দি করে দেয়ালে সজোরে ঘু”ষি মে”রে বসলো। ফাইজা ফারদিনের কান্ডে চোখ বড় বড় করে তাঁকিয়ে আছে। ফারদিন দ্বিতীয় বার দেয়ালে ঘু”ষি মা”রা”র জন্য হাত উঠাতেই ফাইজা তৎক্ষনাৎ হাত’টা ধরে এক প্রকার চেঁচিয়ে বললো…..

–পা”গ”ল হয়ে গেছেন আপনি। কি করছেন টা কি?

ফাইজার কথা শুনে ফারদিন আগুন ঝড়া দৃষ্টিতে ফাইজার দিকে তাঁকিয়ে ঝাড়ি মে”রে ফাইজার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। ফারদিনের কান্ডে ফাইজা’র চোখের কোনে পানি এসে জমতে শুরু করেছে। ফাইজা আবারো ফারদিনের হাত ধরতে নিলে ফারদিন চিৎকার করে বললো…..

–ডো’ন্ট টার্চ মি। আমার ছোঁয়া তোমার বিরক্ত লাগে সিরিয়াস’লি। ওকে ডান, এই মুহূর্ত থেকে যতক্ষন না অব্দি তুমি নিজে এসে আমার কাছে ধরা দিচ্ছো। ততক্ষন অব্দি তোমার গায়ে সামান্য টার্চ অব্দি করব না। প্রমিস…….

বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো। ফাইজা’কে একটা কথা বলার সুযোগ অব্দি দিলো না। ফারদিন চলে যেতেই ফাইজার চোখ থেকে দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করতেই কাল রাতের কথা মনে পড়লো।
~~~~~~~~~~~~~~
“কাল রাতে”

–আপনার সাথে আমার বিয়ে কবে হয়েছিলো? আর আমাদের বিয়ে হয়েছে আমি কেনো জানিনা? আপনিই বা কেনো আমার সাথে বাজে বিহেভিয়ার করেছিলেন এতদিন? আবার রাতের আধারে কেনো লুঁকিয়ে এসেছিলেন আমার ঘরে? প্লিজ উওর গুলো দেন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে…..

ফাইজা কয়েকবার একি প্রশ্ন করতেই ফারদিন হঠাৎ করে উঠে বসে ফাইজার দিকে রাগী চাহনি দিয়ে দাতে দাত চে’পে বললো……

–তোমাকে আমি বলেছিলাম যখন সময় হবে আমি সব’টা বলব। তোমার সাথে কেনো সবার সামনে বাজে বিহেভিয়ার করতাম? কেনো লুঁকিয়ে আসতাম? সব প্রশ্নের উওর জানতে চাচ্ছো? কিন্তু একবার ও ভাবছো না নিশ্চয়ই কোনো কারন আছে দেখে আমি এখন উওর দিচ্ছি না। বার বার এক প্রশ্ন করে বিরক্ত করছো কেনো? তোমাকে তো আমি প্রুভ হিসেবে ম্যারেজ সার্টিফিকেট দেখালাম। তাও বিলিভ হচ্ছে না?

ফাইজা ফারদিনের আচরনে হা হয়ে তাঁকিয়ে আছে। সামান্য কয়েক’টা প্রশ্ন’ই তো করেছিলো। তার উওর এইভাবে দিতে হবে। কেনো যেনো ফাইজা’র মনে অভিমানেরা এসে হা’না দিলো। ফাইজা শান্ত কন্ঠেই বললো…..

–সামান্য কয়েক’টা প্রশ্ন’ই তো করেছিলাম। এত’টা রেগে যাওয়ার মতো কিছু বলিনি?

ফাইজার কথা শুনে ফারদিন আরো দ্বিগুন রাগ নিয়ে বললো…..

–ওহ রিয়ে’লি,, বার বার এক কুয়েশ্চন করে বলছো সামান্য কুয়েশ্চেনের জন্য আমি কেনো রেগে যাচ্ছি
? বুঝতে পেরেছি প্রশ্নের উওর জানার জন্য’ই তুমি আমাকে এখন সহ্য করছো? ওকে ফাইন, সহ্য করতে হবেনা আমাকে। চলে যাচ্ছি……..

বলেই ফারদিন বেড়িয়ে গেলো। ফাইজা এখনো অসহায় মুখ করে ফারদিনের যাওয়ার দিকে তাঁকিয়ে আছে। ফারদিন রেগে দরজা খুলেই চলে গেছে। ফাইজা’ কিছু একটা মনে করে ফারদিনের পেছন পেছন যেতেই দেখলো ফারদিন ততক্ষনে মেইন দরজা খুলে বেড়িয়ে গিয়েছে। ফাইজা কিছু না ভেবে দরজা আটকে বেলক’নিতে এসে দাড়াতেই দেখলো ফারদিনের গাড়িটা ওদের গেট দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে। ফারদিনের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষন তাঁকিয়ে থেকে ফাইজা অভিমানে চুপ করে এসে সুয়ে পড়লো। সকালে কলেজে এসে ফারদিন’কে যথাক্রমে ইগ্নোর করে চলছিলো ফাইজা। কাল রাতে ফারদিনের ব্যবহারে অভিমান করেছে আর অভিমান থেকেই ফাইজা ফারদিন’কে ইগ্নোর করছিলো। ছুটির পর ফাইজা’র ক্লাস’মেট এসে বললো আরজা ফাইজা’কে উপরে ডেকেছে। আর আসতেই….
~~~~~~~~~~
কাঁধে কারোর স্পর্শ পেয়ে ফাইজা’র ভাবনার ছেদ ঘটলো। ফাইজা তড়িঘড়ি করে চোখের জল টুকু মুছে পেছনে ফিরতেই আরজা’কে দেখতে পেলো। আরজা ফাইজার দিকে অবাক নয়নে তাঁকিয়ে বললো……

–তুই এখানে একা একা কি করছিস ফাইজু?

ফাইজা মুখে হাসির রেখা টেনে বললো…..

—তোকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে পড়েছি।

আরজা ও আর কথা না বাড়িয়ে ফাইজা’কে নিয়ে নিচে নেমে আসলো। নিচে নেমে ফাইজার চোখ দুটো চাতক পাখির মতো কাউকে খুঁজছে। কিন্তু,চারদিকে তা দেখা অব্দি মিললো না। আরজা’কে বিদায় জানিয়ে ফাইজা চলে আসলো।
____________________________________________
ফারদিন এলোমেলোহীন ভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। রাগে বার বার শরীর কেঁপে উঠছে। ফাইজার বিরক্ত ভরা কন্ঠস্বর বাজছে কানে। ফারদিনের গাড়ির পেছনে’ই একটা ট্রাক ছুটচ্ছে৷ ট্রাকের ড্রাইভারের মুখে রুমাল বাঁধা। ট্রাক ড্রাইভারের ফোন’টা বেজে উঠতে’ই সে রিসিভ করে কানে ধরলো। ওপাশ থেকে কেউ একজন কিছু বলতেই ড্রাইভার নিঁচু স্বরে বলল…..

–কাজে হয়ে যাবে ম্যাডাম। চিন্তা করবেন না…..

বলতেই ফোন’টা রেখে নজর দিলো ফারদিনের গাড়ির দিকে। সজোরে ট্রাক’টা এসেই ফারদিনের গাড়ি’টাকে ধাক্কা মা’র’তেই ফারদিনের গাড়ি’টা উল্টে গিয়ে রাস্তার ধারে পড়লো। হঠাৎ করে কি হলো ফারদিন বোঝার আগেই ঘটনা’টা ঘটে গেলো। গাড়ি’টা উল্টে পড়তেই ফারদিনের মাথা ফে’টে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগলো। ফারদিন এক হাতে মাথা চে’পে ধরে পা দিয়ে দরজা ধাক্কিয়ে খুলে অর্ধেক বের হতেই ওর চোখ দুটো বুঝে আসলো। আরেক’টা পা ভেতরে কিছুর সাথে আটকে গেছে। ফারদিন চোখ বন্ধ করার আগে অব্দি ফাইজার চেহারা’টা ভেসে উঠলো। ফারদিনের কাঁধের দিক দিয়ে বেশ খানিক’টা খুবলে উঠে গেছে। মুখ’টা রক্তে মে’খে গেছে। টকটকে লাল র’ক্ত গুলো গড়িয়ে পড়ছে। চারপাশের মানুষ জন দৌড়ে ছুটে এলো। ট্রাক’টা ধাক্কা দিয়েই আর থামলো না। চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেলো। চারপাশের লোকজন ফারদিনের অবস্থা দেখে ধরতে সাহস পেলো না। সবার মনে মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। কেউ কেউ বলছে “ছেলে’টা বোধহয় বেঁচে নেই” আবার কেউ কেউ বলছে “ছেলে’টা বেঁচে আছে নাকি বুঝতে পারছিনা” কয়েকজন সাহস করে এগিয়ে গেলো। পেছন থেকে কেউ কেউ বলে উঠলো “ধরো না পুলিশ ডাকি” একটা মধ্য বয়স্ক লোক ওদের কথার পাত্তা না দিয়ে ফারদিনের সামনে এগিয়ে গিয়ে ওর নাকের সামনে হাত দিয়ে দেখলো নিশ্বাস পড়ছে না। লোক’টা এবার ফারদিনের পার্লস চেক করে সবার উদ্দেশ্য চিন্তির ভঙ্গীতে বললো……

–ছেলে’টা বেঁচে নেই??
#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_এগারো

হসপিটালের ও’টি রুমে মৃ”ত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে ফারদিন। ডাক্তার’রা প্রানপন চেষ্টা করছে ও’কে বাঁচানোর। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের জন্য ওর বাঁচার চান্স অনেক কম। ব্লাড ব্যাংক গুলোতে র’ক্তের খোঁজ চলছে। কিন্তু, কিছু’তেই ও’নেগেটিভ(O-) র’ক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ফারদিনের অবস্থা প্রতি মুহূর্তে খারাপ থেকে ভালো হচ্ছেনা। হসপিটালের কড়িডোরে সায়মা খানম পা’গ’লের মতো বিলাপ করছেন। তাকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো কেউ নেই। স্বামী,সন্তান হারিয়ে ফারদিন’কে আকড়ে ধরে বেঁচে ছিলো এত বছর। আজ প্রানের টুকরো নাতির এমন অবস্থা কিছু’তেই সহ্য করতে পারছেন না তিনি। ও’টি রুমের পাশের দেয়াল ঘেষে নিজেকে হাটুর ভাঁজে গুটিয়ে বসে আছে ফাইজা। ওর মুখ’টা অশ্রুসিক্ত। গাল বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। চোখের সামনে বার বার ফারদিনের রক্তাক্ত মুখ’টা ভেসে উঠছে। কি ভয়ংকর সে দৃশ্য। বুক’টা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। এ এক বিষাদময় যন্ত্রনা। এই যন্ত্রনা কাকে বুঝাবে ও? কে বুঝবে এই কষ্ট? যে এই কষ্ট বুঝবে সে তো নিজেই মৃ’ত্যুর দুয়ারে।
~~~~~~
ফাইজা কলেজ থেকে ফেরার পথে রাস্তায় অনেক ভীড় দেখে কৌতুহল বশত এগিয়ে গেলো সেখানে। ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতেই ওর পা দুটো সহ শরীর অবশ হয়ে গেলো। সামনে র’ক্তা’ক্ত ফারদিন রাস্তায় পড়ে আছে। লোকজন বলা-বলি করছিলো “ছেলেটা বেঁচে নেই”। চারপাশে মানুষজন থাকতেও যেনো কানের মধ্যে কোনো শব্দ আসচ্ছিলো না ওর। ফাইজা হাটু ভেঙে বসে ফারদিনের গালে হাত দিতেই ওর হাত দুটো র’ক্তে লাল হয়ে গেলো। ফাইজার চোখ থেকে পানি পড়ছে কিন্তু ও কাদছে না। কেমন যেনো পাথরের মতো সব’টা দেখছে। ফারদিনের গাঁয়ে সাদা শার্ট’টা র’ক্তে লাল শার্টে পরিনত হয়েছে। ফারদিনের দিকে এক দৃষ্টি’তে কিছুক্ষন তাঁকিয়ে থেকে হঠাৎ করে মুখ ফুটে বললো…..

—উনা’কে একটু কেউ হসপিটালের নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন প্লিজ…….

আশেপাশের থেকে কয়েকজন বললো…

–উনাকে নিয়া যাইয়া কোনো লাভ হইতো না। উনি ম/ইরা গেছে….

কথা’টা শুনে ফাইজা কানে হাত দিয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো……

–একটাও বাজে কথা বলবেন না আপনারা। উনি বেঁচে আছেন। আপনাদের কাছে হাত জোর করে বলছি প্লিজ একটু সাহায্য করুন আমাকে প্লিজ…..

কথাগুলো বলতে ফাইজার গলা আটকে আসচ্ছিলো। ও কি বলছে কি করছে নিজেও জানেনা। মনে হচ্ছে ও নিজের মধ্যে নেই। এই মুহূর্তে সব ভুলে শুধু একটাই কথা মাথায় ঘুরছে। যে করে হোক ফারদিন’কে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে? ফারদিনের কিছু হলে ও বাঁচবে কি করে? ফাইজা যখন সবাই’কে অনুরোধ করছিলো তখনি পেছন থেকে কেউ একজন নানুভাই বলে চিৎকার করে উঠলো। আকস্মিক চিৎকারে ফাইজা পেছনে ফিরতেই একজন বয়স্ক মহিলা’কে দেখতে পেলো। মহিলা’টিকে ফাইজা চিনতে পারলো না শুধু এইটুকু বুঝতে পারলো মহিলা’টি নিশ্চয়ই ফারদিনের কেউ হবে। মহিলা’টি এক প্রকার দৌড়ে এসে ফারদিনের সামনে বসে পড়ে ফারদিনের মাথা’টা কোলে তুলে নিয়ে পা’গলের মতো কাঁদতে শুরু করলো। মহিলা’টির সাথে থাকা ড্রাইভার সহ কয়েকজন মিলে ফারদিন’কে গাড়ি’তে উঠালো। ফাইজা পাথরের মতো দাড়িয়ে সব’টা দেখলো। ফারদিন’কে গাড়ি’তে উঠিয়ে মহিলা’টি হঠাৎ এসে ফাইজার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে গাড়িতে বসালো। ফাইজা অশ্রসিক্ত নয়নে সব’টা দেখছে কিন্তু রিয়েক্ট করতে ভুলে গেছে এতক্ষনে। এত বড় একটা ধাক্কা যে ফাইজা সামলাতে পারছেনা তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে। মেয়ে’টা এই কয়েক মিনিটে পা’গ’লের ন্যায় হয়ে গেছে। ফাইজা আলতো হাতে ফারদিনের মাথা’টা কোলে তুলে নিয়ে নিজের গায়ের সাদা ওড়না’টা শক্ত করে বেঁধে দিলো ফারদিনের মাথায়। মহিলা’টি কাপড়ের আঁচল দিয়ে ফারদিনের কাঁধের সামনের ক্ষ’ত স্থান’টি চে’পে ধরে একাধারে কেঁদে যাচ্ছে। হসপিটালে আসা অব্দি ফাইজা এক নজরে ফারদিনের র’ক্তা’ক্ত চেহার’টার দিকে তাঁকিয়ে ছিলো। ওর চোখ থেকে নোনা জল গড়িয়ে ফারদিনের মুখের উপর পড়ছিলো। হসপিটালে আসতেই ডাক্তা’রা সবাই হুড়মুড়িয়ে আসলো চারদিক থেকে কারন গাড়ি’তে থাকা অবস্থা ভদ্র মহিলা’টি ফোন করেছিলো। তার কথায় ফাইজা’ বুঝতে পেরেছিলো মহিলা’টি হসপিটালেই ফোন করেছে সব রেডি রাখার জন্য। ফারদিন’কে দেখেই ডাক্তার’রা চিন্তিত দৃষ্টি’তে একেক’জনের দিকে তাঁকাচ্ছিলো। ইশারা করে বলছিলো অবস্থা ভালো নয়। তাড়াতাড়ি ও’টির ব্যবস্থা করে ফারদিন’কে ও’টি’তে নিয়ে যাওয়া হলো। সেই থেকে সায়মা খান’ম কড়িডোরের চেয়ারে বসে কেঁদে চলছে। ফাইজা ফারদিনের সাথে সাথে ও’টির দরজা অব্দি এসে র’ক্তা’ক্ত ওড়না’টা বুকে চে’পে ধরে দেয়াল ঘে’ষে বসে পড়লো।
~~~~~~~~
ফাই’জার কানের মধ্যে বার বার ফারদিনের একেক’টা কথা বাজচ্ছে। যেদিকে তাকাচ্ছে সেদিকেই পরিচিত এক মুখের রক্তাক্ত দৃশ্য। আর সহ্য করতে পারছে না ও। দম আটকে যাচ্ছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসচ্ছে। বুকের ভেতর কালবৈশাখী ঝড়ে সব উল্টে পাল্টে যাচ্ছে। ফাইজা’ আর সহ্য করতে না পে’রে এতক্ষন পর হাত দিয়ে জোরে চিৎকার করে পা’গলের মতো কেঁদে উঠলো। ওর কান্না হসপিটালের প্রতিটি দেয়ালে বা’রি খেয়ে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হচ্ছে। হসপিটালে উপস্থিত সবাই দূর থেকে অসহায় চাহনী নিক্ষেপ করে আছে ফাইজার দিকে। ফাইজা’র সাদা ড্রেস’টা র’ক্তে লাল হয়ে আছে। হাটু’তে মুখ গুঁজে শব্দ করে কাঁদছে। কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ পেতেই অশ্রুসিক্ত চোখে উপরে তাঁকাতেই সায়মা খানম’কে দেখতে পেলো। সায়মা খানমের চোখেও পানি। সে ফাইজার সামনে বসতেই ফাইজা কিছু না ভেবে’ই তাকে আচমকা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। সায়মা খানম’ ফাইজার মাথায় আলতো হাতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো…..
–আমার নাতি’টা যে তোমাকে পা’গলের মতো ভালোবাসে। তোমাকে হারানোর ভয়ে পা’গ’লের মতো আচরণ করতে দেখেছি ও’কে। যেই ছেলে’টা মেয়েদের নাম অব্দি সহ্য করতে পারতো না। সেই ছেলে’টা তোমাকে পেয়ে এত বড় বিজনেস ছেড়ে কলেজে জয়েন হলো শুধু মাত্র তোমার জন্য। দূর থেকে আগলে রাখতো পরম যত্নে। তুমি যখন সবে ষোল বয়সী এক যুবতী তখন আমার পা’গ’লটা তোমাকে প্রথম দেখেছিলো। প্রথম দিন তোমাকে দেখেই ছেলে’টা অদ্ভুত আচরণ করছিলো। সেদিন বুঝেছিলাম এই ছেলের মনে ভালোবাসা নামক সুন্দর অনুভূতি জন্ম দিতে কেউ এসেছে। প্রতিদিন তোমাকে দূর থেকে লুঁকিয়ে দেখতো৷ তুমি ওর লাইফে আসার পর থেকে ছেলে’টার মুখে সব সময় এক’টা সুন্দর হাসি লেগে থাকতো। ছেলে’টা যে হাসতে ভুলে গিয়েছিলো নিজের মা’কে হারিয়ে। তোমাকে হারিয়ে ফেলবে বলে তোমার বাবা-মা কে গিয়ে সোজা সুজি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো। আমার নাতি’টা যে কাউকে এত’টা ভালোবেসে ফেলবে আমি নিজেও জানিনা। আমার নাতি’কে তোমার বাবা খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলো কারন তুমি এখনো ছোট ছিলে বলে। সেদিন বাড়ি’তে এসে নিজে’কে পা’গলের মতো আ’ঘাত করেছিলো। বাচ্চাদের মতো কেঁদেছিলো আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি সহ্য করতে পারিনি ওর কষ্ট’টা। তোমার বিষয় সব’টাই আমার সাথে শেয়ার করতো। পরের দিন আমি নিজে তোমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে তাদের হাজার অনুরোধ করে রাজি করেছিলাম। কিন্তু তোমার বাবার একটা শর্ত ছিলো। তোমার বয়স আঠারো না হওয়া অব্দি ফারদিন যেনো তোমার ধারে কাছেও না ঘেষে। পা’গল ছেলে’টা তাতেই রাজী হয়ে গিয়েছিলো। তোমার অজান্তেই তুমি আমার ফারদিনের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে উঠো। ছেলে’টা তোমাকে পেয়ে যখন ভয়ংকর অতীত ভুলতে বসেছিলো। ঠিক তখনি ছেলে’টার ভয়ংকর অতীত আবার ফিরে আসে। আর তখন…….

আর বলতে পারলো না। ও’টি রুমের লাইট’টা নিভে যেতেই তার চোখ সেদিকে গেলো। ফাইজা’কে ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে পড়লো। এতক্ষনে ফাইজা’র কান্না ও থেমে গিয়েছিলো। মন দিয়ে তার কথাগুলো শুনছিলো। হঠাৎ থেমে সেতে দেখে ফাইজা ও তার সাথে সাথে উঠে দাড়ালো। ও’টি রুম থেকে একজন ডাক্তার বেড়িয়ে আসতেই ফাইজা আর সায়মা খানম দুজনেই সেদিকে এগিয়ে গেলো৷ ওরা দুজন কোনো প্রশ্ন না করে ডাক্তারের দিকে চেয়ে আছে। ডাক্তার চিন্তিত ভঙ্গী’তে বলে উঠলো…..

–ও নেগেটিভ (O-) র’ক্তের জোগাড় করার যাচ্ছেনা কিছু’তেই। এক ঘন্টার মধ্যে ও নেগেটিভ( O-) রক্তের জোগাড় না হলে ফারদিন’কে বাঁচানো সম্ভব না দিদা…….
____________________________________________
কাকন সিকদারের নিজের রুমে পায়চারি করছে। তার পাশেই বসে আছে রেজওয়ান। কাকন’কে পায়চারি করতে দেখে সে এক’টা গ্লাসে ড্রিংকস ঢালতে ঢালতে বললো…..

–আহঃ কাকন এত টেনশন কেনো করছো? যেভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে ওর সেখান থেকে বেঁচে ফিরা ইম্পসিবল। সো, নো টেনশন লেট’স ইনজয়…..

রেজওয়ানের কথা শুনে কাকন এক প্রকার রেগে বললো……

–তোমার লজ্জা করেনা বাবা হয়ে ছেলে’কে মে/রে ইনজয় করছো?

কাকনের কথা শুনে রেজওয়ানের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলোনা। কাকন আবারো বলে উঠলো…..

–ফারদিন যদি বেঁচে যায় তাহলে আমরা বাঁচতে পারবো না ভুলে যাচ্ছো কথা’টা…….

#চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here