“আমাদের উপর তলার ফ্লাটের ইয়াজিদ ভাইয়াকে আমি চোখ টিপ দিয়েছি, এটা শোনার পর আমার আব্বু আমার উপর খুব ক্ষেপেছে। এখন আমি কোথায় লুকাই তুমিই বলে দাও আপু!”
রিমি প্রচন্ড এক ঝটকা খেলো মেহজার কথা শুনে। ইয়াজিদের মত ওতো বড় এক ছেলেকে মেহজার মতোন পুঁচকে একটা মেয়ে চোখ টিপ দেয় কীভাবে সে ভেবেই উঠতে পারছেনা। মাত্র দশম শ্রেণীতে পড়ছে মেহজা আর ইয়াজিদ সেখানে একজন এম এ পাশ করা রাজনীতিবীদ এবং তার পাশাপাশি তাদের পারিবারিক ব্যবসা সামলাচ্ছে। রাজনীতিই সে প্রধান পেশা হিসেবে নিয়েছে কেন না সে রাজনীতি করা খুবই পছন্দ করে। তবে এত শিক্ষিত পড়ালেখা জানা কর্মোঠ ছেলে যদি রাজনীতি নিয়েই পড়ে থাকে তাহলে তার পারিবারিক ব্যবসাও যে লাঠে উঠবে। বাবার একটিমাত্র পুত্র সে। তার বাবার চার মেয়ের পরেই সে এক ছেলে হয়েছে। বলতে গেলে তার বাবা আহনাফ মজিদ বৃদ্ধ একজন মানুষ। বয়স ষাট পেড়িয়েছে অনেক আগেই। ইয়াজিদ ঊনত্রিশ বছর বয়সি তাগড়া এক যুবক সেখানে মেহজার মাত্র সতেরো বছর বয়স। এই মেয়ের এখন উঠতি বয়স যে কাউকে দেখলেই মনে মিথ্যা কিছু প্রেম ভালোবাসা উতলে পড়ে। তাই বলে এমন কারো উপরেই পড়তে হলো! ইয়াজিদ! মানে সত্যিই ইয়াজিদ! রিমি মেহজাকে নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে বসে। ড্রয়িং রুমে এসব নিয়ে আলোচনা করা মহা মুশকিল কেননা তার মা যদি একটিবার ইয়াজিদ নামটি শুনে তাহলে সে ভেবেই নিবে তার মেয়ের আর ইয়াজিদের মধ্যে কিছু একটা তো চলছেই।
বিকেল পর্যন্ত রিমির সাথে থেকে সন্ধ্যার আগেই বাসায় চলে আসে মেহজা। যা হবার হবে এত ভয় নিয়ে পড়ে থাকলে হবেনা। মার খাবেনা কিন্তু তবুও বকা তো সেই এমনিই খাবে। তাছাড়া বাবা মা আর বড় ভাইয়ের সামনে এমন একটা অভিযোগে দাঁড়ানোও যে খুব লজ্জার। রাফসানের উপর রাগ হচ্ছে বদমাইশটা বাবাকে বলে দিয়েছে। আজকে হাতের কাছে পেলে মজা দেখাবে। উফ তাও! আর কোনো পথ নেই। এখন হলেও যেতে হবে পরে হলেও যেতে হবে। তাই আগে যাওয়াই ভালো। লিফ্টে উঠে আঠারোর সংখ্যা চাপ দেওয়ার আগেই কেউ একজন দৌঁড়ে এসে লিফ্টে ঢুকে পঁচিশে চাপ দেয়। মানে ছাদে! মেহজা পুরো বোকা বনে গেল। লিফ্টও চলা শুরু করেছে। এখন আর কি করার! এমন কান্ড করা মানুষটিকে দেখতে গিয়েই মেহজা শকড্। এ কি! ইয়াজিদ দাঁড়িয়ে। ইয়াজিদের কোনো হেলদোল নেই। সে তাদের সামনের আয়নায় এক দৃষ্টিতে মেহজাকেই দেখে চলেছে। হাটুর সমান এই মেয়ে তাকে এসেছে থেকে খুব জ্বালায়। আর আজকে তো সীমা অতিক্রম করেই ফেলেছে। ইয়াজিদকে চোখ টিপ দিল এই পুঁচকে মেয়ে! ইশ ভাবতেই নিজেরই কেমন একটা লজ্জা লজ্জা লাগে তবে রাগটাই বেশি লাগছে। মেয়েটা তাকে চোখ টিপ দিল কীভাবে! তার চোখটা কি একবারো কাঁপলোনা! ভয় পায়নি সে ইয়াজিদকে! ফর্মাল ড্রেসটি ঘামে ভিজে একাকার হয়েছে তার। হালকা নীল রং হওয়াতে শরীরের সাথে লেপ্টে যাওয়া অংশ গুলো দৃশ্যমান। মেহজা তার দিকে স্হির হয়ে তাঁকিয়েই আছে তা দেখে ইয়াজিদ মেহজাকে পরপর দুইবার চোখ টিপ মারলো। এমন কান্ডে মেহজা হতবাক। আর ইয়াজিদ তো পুরোই বিরক্ত। কেন না সে শুধু মেয়েটিকে ভয় দেখাতেই এমন করছে। তার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই মেহজার সাথে ফ্লার্টিং করার। মেহজা বলল
“ভাইয়া এটা কেমন অসভ্যতা!”
ইয়াজিদ অবাক হওয়ার ভান ধরে বলে
“অসভ্যতা? কি বলছো তুমি! এটাই তো ট্রেন্ড। তুমি যদি আমাকে চোখ টিপ দিতে পারো আমি কেন পারবোনা! যেহেতু তোমার থেকেও আমার বয়স বেশি তো আমি তোমাকে বেশিই দিলাম। তাও আমার কাছে কমই লাগছে। মাত্র তো দুইবার দিলাম। কম না! তুমিই বলো!”
মেহজা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝায় আবার না বোঝায়। ইয়াজিদ বলে
“প্রথম এক্সফ্রেশনটাই সত্যি হয়। তাহলে আরেকটা দেই কেমন!”
ঠিক তখনিই লিফ্টের দরজা খুলে যায় মানে ছাদে এসে গেছে। ইয়াজিদ হুট করেই মেহজার হাত টেনে ধরে তাকে নিয়ে গিয়ে ছাদে থাকা বসার জন্য তৈরি করা ইট সিমেন্টের সোফায় নিয়ে বসায়। মেহজার সবচেয়ে প্রিয় এই জায়গাটিই। এই সোফায় বসেও তো সে কত ইয়াজিদকে নিয়ে ভেবেছে! আর আজ স্বয়ং ইয়াজিদই তার পাশে বসে আছে। তবে এখন সেটা মোটেও সুখকর নয়। এটা চরম দুঃখের ব্যাপার। আল্লাহকে ডাকছে আর বিপদ মুক্তির দোয়া আওড়াচ্ছে। ইয়াজিদ সেই কখন থেকেই চাঁদ দেখছে। চাঁদটাতে কি বিশেষ কিছু আছে! না, সে পায়নি বিশেষ কিছু। ইয়াজিদ হয়তো পেয়েছে নয়তো পায়নি, এমনিও তাঁকিয়ে থাকতে পারে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সব কথা গুছিয়ে ইয়াজিদ মেহজাকে বলল
“মেহজা! তুমি ছোট বলে তোমাকে আমি বেশি কিছুই বলব না। বকতে পারতাম পরে মনে হলো তোমার এখন যা বয়স তাতে এমনটা হয়েই থাকে। তোমরা অবেগের শহরে ভাসো। আবার আমি যদি বকে দেই সেটার জন্য তোমার উপর চাপ পড়বে। সামনেই তো তোমার মাধ্যমিক পরীক্ষা আমি চাই না আমার কিছু কথার কারণে তোমার মনে ব্যাপারটা খুব বেশিই প্রভাব ফেলুক আর তুমি ভেঙে পড়। এখন আমি যা বলবো তা প্লিজ মনোযোগ দিয়ে শুনো।”
————
“আমার বয়স ঊনত্রিশ হয়েছে গত মাসে। যেদিন আমার জন্মদিন ছিল সেদিন তুমি আমাকে দশ টাকার একটি কেক এনে বলেছিলে “শুভ জন্মদিন ইয়াজিদ” আমি ব্যাপারটায় প্রথমেই একটু চমকালে পরে তা পাত্তা দেয়নি। তোমার দেওয়া কেকটি আমি গ্রহণ করেছিলাম খুশি মনে। তখনও তোমার মনের অবস্থাটা আমি ধরতে পারিনি। প্রতিদিনই আমি যখন অফিস যাই তখন তোমাকে বেলকনিতে দেখতে পাই। এক ধ্যানে আমার দিকে তাঁকিয়ে থাকো। মনের ভুল ভেবে আর তুমি ছোট ভেবে তা আমি উড়িয়ে দেই। কিন্তু আজ! আজ তুমি আমাকে রাফসানের সামনেই চোখ মারলে। একবারো ভাবলেনা তোমার ছোট ভাইয়ের সামনে তুমি আমাকে তো লজ্জায় ফেলেছো নিজেকে আরো বেশিই…. এখন আর মনের ভুল ভেবে সবটা উড়িয়ে দেওয়া তো যায় না! তুমি আমার থেকে খুব ছোট। খুব বেশিই ছোট। আমাদের বয়সের পার্থক্য এগারো বা বারো বছরের তো হবেই! তোমার সামনে এখনো অনেক কিছু পড়ে আছে। জীবন তো মাত্র শুরু। পড়ালেখা কর মন দিয়ে। এসব নিয়ে থাকলে তোমার জীবন তুমি নিজে হাতেই ধ্বংস করবে। আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছো।”
মেহজা বুঝে নি। সে বুঝতেই চায় না। বয়সের পার্থক্যই কি সব! তার ভালোবাসা কি কিছু না! এটা কেমন ব্যাপার। তবুও মুখে বলল
“জ্বি বুঝেছি ভাইয়া।”
ইয়াজিদ হাসে। সে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষ। সে জানে মেহজা এসব কিছুই মাথাতে নেয়নি। কিন্তু ওর পক্ষে সম্ভব নয় ব্যাপারটা আর বেশি ঘাটার। এমনিতেও সে খুবই ক্লান্ত। খুব!
মেহজা চলে যায়। ভালো লাগছেনা কিছুই তার কাছে। ইয়াজিদকে সে তো ভালোবাসে আর ভালোবাসা একপাক্ষিক হলে হোক। সমস্যা কোথায়? ইয়াজিদ তাকে ভালো না বাসলেও সে ইয়াজিদকে ঠিকই ভালোবেসে যাবে। তবে এমন পাগলামি আর করবেনা।
বাসায় এসে বকা খাওয়ার পর আরো মন খারাপ হয়ে গেল তার। কিন্তু এটাই তো হওয়ার ছিল।
দেখতে দেখতে এক মাস পার হয়ে গেল। মেহজার পরীক্ষা শেষ এবার সে নিশ্চিন্তে ঘুরবে ফিরবে। আহা! এই দিন গুলো বেস্ট! ইয়াজিদের সাথে এক মাসে মাত্র দুইবার দেখা হয়েছে তাও ঐ কাহিনির পর পর দুদিনই দেখেছে। যেখানে আগে প্রতিদিনই দেখা হত। অবশ্য তখন মেহজা চাইতো দেখা হোক এখনো চায় তবে আগের মতো করে নয়।
মেহজার মামাতো বোন রেশমির বিয়ে আজ। বাকি কাজিনরাও আজ আসবে সবাই ঠিক করেছে শাড়ি পড়বে। মেহজাকেও বলা হয় শাড়ি পড়ে যাওয়ার জন্য তাই মেহজা সোনালি রঙের একটি সিল্কের শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নেয়। চুলগুলো সুন্দর করে ঘাড়ের সথে লাগিয়ে খোপা করে নেয়। সাজটাও মিলিয়ে করে শাড়ির সাথে যেটা ভালো মানায় সেটাই নেয়।
লিফ্টের সামনে দাঁড়িয়ে লিফ্টের অপেক্ষা করতে থাকে। মোবাইলের স্ক্রিনে নিজেকে একবার দেখে নেয়। না খারাপ লাগছে না। সুন্দরইতো লাগছে। লিফ্ট আসলে দেখে ইয়াজিদ ও আছে। দীর্ঘ এক মাস পর কাঙ্খিত মানুষটিকে দেখে সে আবেগ আপ্লুত হয়ে যায়। তার চোখটাও হঠাৎ জ্বলছে। এ কি চোখের পানি গুলো বড্ড বেহায়া। ইয়াজিদের সামনেই কেন তাদের আসতে হবে! ইয়াজিদ মেহজাকে দেখছে, আজকে মেহজাকে খুব বড় বড় লাগছে। মেহজাকে প্রকৃতপক্ষেই খুব সুন্দর লাগছে। মেহজা লিফ্টে ওঠে। দেরি করা যাবেনা একদম। ইয়াজিদের তথাকথিত আবেগ গুলোকে একপ্রকার পায়ে পিষেই সে লিফ্টে ওঠে।
সেকেন্ড দশের মাথায় পাশের ব্যক্তিটির মুখ থেকে ভেসে আসা একটি বাক্যে মুহূর্তেই তার হৃদপিন্ড বোধ হয় থমকে যায়। আর সেই বাক্যটি হলো
“তোমাকে কিন্তু আজ আর ছোট লাগছেনা মেহজা।”
চলবে।
#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক
লেখনীতে—ইনশিয়াহ্ ইসলাম।