গোধূলী আকাশ লাজুক লাজুক পর্ব ২৬

#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-২৬)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

বড় বড় কদম ফেলে হল থেকে বেরিয়ে বাহিরের গার্ডেন এড়িয়াটাতে এসে দাঁড়ায় মেহজা। এদিক ওদিক চোখ বুলাতেই ইরফানকে চোখে পড়ে। একটি কালো শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়ে আছে সে। বরারবরে মতোই শার্টের হাতাটা ফোল্ড করে রেখেছে। এতে করে তার বলিষ্ঠ হাতটি সবসময় নজর কাড়ে যেন! পুরুষমানুষ যখন এভাবে শার্ট পড়িহিত থাকে সত্যিই তাদের দেখতে অসাধারণ লাগে। সেখানে সুঠাম দেহী ইরফানকে তো আরো বেশিই সুদর্শন লাগছে। মেহজা এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাঁকিয়ে থেকেই হুট করে চেহারায় কঠোরতা আনে। লোকটা সবসময় এত বেশি পরিপাটি হয়ে থাকে কেন? মেয়ে পটানোর ধান্দা না! মানুষ তো সুইট সিক্সটিন খুঁজে আর সে নাহয় একটু বেশি তবুও তো সুইট এইটিন বউ পেয়েছে। তারপরেও পর নারীকে ইমপ্রেস করে কী মজা পায়! আশেপাশে একটু চোখ বুলিয়ে দেখে কেউ আছে কিনা, তারপর দূরে দু একজনকে দেখে আর ততটা পাত্তা দেয়না। ইরফানের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। কোনো কথা বা শব্দ কিছুই করছেনা সে। ইরফান নিজেই কথা বলতে বলতে পেছন ফিরে মেহজাকে দেখে চোখ সরিয়ে নেয়। তার কেন যেন মনেই হচ্ছিল মেহজা তার আশেপাশে। পারফিউমের স্মেল টেলে সে মেহজাকে চিনেনা। কারণ কত পারফিউমই তার আছে আর সবচেয়ে বড় কথা সে পারফিউম ব্যবহার করেনা লোকসম্মুখ্যে। ইরফান ভালো করেই জানে ইরফান যখন একাকী থাকে সেই সময়টাতেই মেহজা সাজ বেশি করবে পারফিউম দিবে সবচেয়ে ভালো ঘ্রান যেটায় আছে সেটাই দিবে। প্রথম প্রথম যখন মেহজারা এসেছিল তখন সে এমনটাই করত। সত্যি বলতে পারফিউমের ঘ্রানে মাঝেমাঝে ইরফানের মনে নিষিদ্ধ ইচ্ছা জাগতো। তবুও কোনোভাবে সে নিজেকে সামলে নিত। তার এখনো মনে আছে তাদের বিয়ের রাতেও মেহজা সেজেগুজে এসেছিল আর সাথে সেই চমৎকার পারফিউমও ছিল। সেই রাতে তো সে এমনি এমনি আকৃষ্ট হয়নি! মেহজার দেহের গঠন, তার জামা, সাজ আর ইরফানের রাগ,আক্রোশ সব মিলিয়েই তো সেই রাতের ভিন্ন সূচনা হয়েছিল। তবে সেই বন্ধন পবিত্র ছিল এবং আছে। ইরফান তপ্ত শ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে যায়। সামনেই ছাউনিতে গিয়ে একটি সোফায় বসে পড়ে। মেহজার মনে হলো ইরফান আবার পুনরায়ের ইরফান হয়ে গেছে। মেহজা তার পেছন পেছন ঘুরঘুর করত আর সে দেখেও না দেখার ভান করত। মেহজা পুরনো প্রত্যাক্ষাণ গুলো মনে করতেই রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যায়। ইরফানের পাশে গিয়েই তার গায়ের সাথে গা লাগিয়ে বসে। আগে তো আর স্পর্শ করতে পারত না তাই বেটা লাই পেয়েছে। এবার কথা না শুনলে বুকে পিঠে দু’ঘা লাগিয়েও দিতে পারবে সে। ইরফান মেহজাকে একবার দেখে নিয়ে কথা বলা শেষ করে ফোনের। ফোনটা হাতেই মুষ্ঠিবদ্ধ রেখে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে। সত্যি বলতে এতক্ষণ যাবৎ সে মেহজার সঙ্গই চাইছিল। মেহজা কঠিন চোখে ইরফানকে পরখ করে বলে,

“কার সাথে এতক্ষণ ধরে কথা বলছিলেন?”

ইরফান চোখ খুলে, মেহজাকে একবার ভালো করে দেখে বলে,

“তোমাকে কেন বলব?”

“আমাকেই তো বলবেন।”

“কেন? তুমি কে আমার!”

“আমি কে মানে? আমি আপনার বউ।”

“তাই নাকি! তো বউ সারাদিন, রাত একবারও স্বামীর খবর নেওয়ার সময় পায়না আর স্বামীকে একটু ফোনে কথা বলতে দেখলেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাঁকাবে আর জেরা করবে তা-ই কী!”

মেহজার কোথায় গিয়ে কথাটা লাগে তা সে বুঝতে পারেনা। মনটা বিষিয়ে ওঠে। সত্যিই তো সে তো গতকাল দুপুর থেকে এখন অব্দি ইরফানের খবর নেয়নি। ভালো মন্দ জানতে চায়নি। সর্বপ্রথম সে ইরফানকে সন্দেহ করেছে। নিজের কাজে নিজেই লজ্জিত হয়। ইরফানের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাঁকায়। ইরফান তা উপেক্ষা করে উপহাসের হাসি হাসে। গলায় গাম্ভীর্য এনে মেহজাকে বলল,

“তুমি কি জানো? গতকাল থেকে এখন অব্দি আমার উপর দিয়ে কতটা স্ট্রেস গিয়েছে? জানবে কীভাবে! সেই সময় কি তোমার আছে নাকি! ভাইয়ের বিয়ে আনন্দ কর ভালো করে। স্বামীকে ভুলে গেলেও চলবে। ব্যাপার না!”

মেহজা এবার ইরফানের কথা শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সাথে সাথে তার দু’চোখ বেয়ে পানি নামে। সে তো এখনো কিশোরী! সংসার স্বামী এসব তো তার কাছে এখনো কষ্টের ব্যাপার। শারীরিক এবং মানসিক দুই ভাবেই সে অপ্রস্তুত। তাও সে দুইরকম ভাবেই ইরফানকে সঙ্গ তো দিয়েছে। ইরফান তো জানেই সে ম্যাচিউড নয়। তার মধ্যে দূরন্তপনা এখনো বিদ্যমান। তারপরেও কি সে পারেনা মেহজার প্রতি একটু সদয় হতে! মেহজার হুট করেই মনে হয় ইরফানের জীবনে হয়তো এমন কোনো নারীর আগমন ঘটেছে যে সবদিক দিয়েই তার যোগ্য। সেদিন রেস্টরন্টের মেয়েটার কথা মাথায় আসতেই তার অন্তরআত্না কেঁপে ওঠে। ইরফান মেহজার দিকেই তাঁকিয়ে ছিল। হঠাৎ মেহজার তার দিকে ফিরে যার ফলে চোখে চোখ পড়ে যায়। ইরফান মেহজার রিক্ত সিক্ত নয়ন দেখে আৎকে ওঠে। সে কি মেহজাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে খুব বেশি? মেহজা কেঁদেছে তার মানে খুব কষ্ট দিয়েছে সে। আবার হঠাৎ করেই ইরফানের মনে হলো সেও তো কষ্ট পেয়েছে। এখন সে নিজে যেমন মেহজার কষ্ট উপলদ্ধি করতে পারছে মেহজা কি তা করেছে? নিশ্চয়ই না! করলে তো হতোই! তার ভাবনার মাঝেই হুট করে মেহজা তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। তার বুকে মাথা গুজে কান্না করতে থাকে। কান্নারত অবস্থায় সে ইরফানকে বলে,

“সত্যি করে বলুন তো! আপনি কি আমাকে ছেড়ে দিবেন! আপনার কারো সাথে সম্পর্ক আছে?”

ইরফান অবাক হয় খুব বেশিই। কোন লেভেলের সন্দেহ মেহজা করতে পারে সে ভেবেই পাচ্ছেনা। এত সন্দেহ কেন তার অন্তরে! সে কি ইরফানকে চেনে না! মেহজা তার জীবনে প্রথম ও শেষ প্রণয়ীনি তা কী সে জানেনা!
ইরফান চাইলেও মেহজাকে তার সাথে মিশিয়ে নিতে পারেনা। মেহজাই তার নিকটে আসে। অশ্রু সিক্ত নয়ন তুলে সে ইরফানের দিকে তাঁকায়। তাতেই ইরফান রাগ অভিমান ভুলে মেহজাকে জড়িয়ে ধরে তার শক্ত বাহুবন্ধনে আলতো হেসে বলে,

“অফিসের খান সাহেবের ফোন ছিল। আমাদের ম্যানেজার। চাইলে চেক করতে পারো। আমার ফোনে কল রেকর্ডারও আছে। চাইলে শুনতেও পারো।”

মেহজা এবার নিজের কাজে লজ্জিত হয়। সে বুঝতে পারে ইরফানের কোথায় সে আঘাত করেছে। ইরফানের সুন্দরতম চরিত্র তে সে আঘাত হেনেছে। লজ্জা আর অপরাধ বোধে সে ইরফানের আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে তাঁকে ফিসফিস করে বলে,

“সরি! আমার ভয় লাগছিল প্রচুর। আপনি যদি…. প্লিজ এই যাত্রায় ক্ষমা করুন আর কখনো আমি এমন কোনো চিন্তা ভাবনা মাথায়ও আনব না।”

ইরফান মেহজার কথা শুনল না। একপ্রকার জোর জবরদস্তি করেই সে কল রেকোর্ডার অন করে। খান সাহেবের মুখে বলা “হ্যালো স্যার” শুনেই সে ইরফানের মোবাইল কেড়ে নেয়। ইরফান মৃদু হাসে মেহজার কপালে চুমু খায়। ইরফানের মোবাইলটা ভালো মত নেড়ে চেড়ে সে গ্যালারীতে ঢুকে কি মনে করে। রাদিফের বিয়ের দিন তোলা কিছু ছবি ছিল সেগুলো দেখতে দেখতে হুট করে একটা ছবি মেহজার চোখের সামনে আসতেই সে কেঁপে ওঠে। সেখানে মেহজার ঘুমন্ত অবস্থায় বেশামাল হয়ে থাকা কিছু ছবি। মেহজার বুঝতে অসুবিধা হয়নি ছবি গুলো কোথায়। এই ছবি গুলো ইরফানের নিজ ফ্ল্যাটে। নিজের উন্মুক্ত অঙ্গ দেখে লজ্জায় সে মরে যাচ্ছে যেন। মুখ তুলে ইরফানের দিকে তাঁকাতেই দেখে সেও স্ক্রিনে সেই ছবিটিই দেখছে। তার দৃষ্টি স্বাভাবিক। কত শত বার যে দেখেছে তার হয়তো হিসেবও নেই। নাহলে এমন স্বাভাবিক ভাবে সে নিতে পারত না। মেহজা ছবি গুলো ডিলিট করতে নিলেই ইরফান ফোন কেঁড়ে নেয়। মেহজার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,

“এত সাহস কোথা থেকে পাও তুমি? আমার ফোনে আমারই ব্যক্তিগত ছবি ডিলিট করতে যাচ্ছো?”

“ফোন দিন! আপনি আস্ত অসভ্য! ছিঃ কেউ এমন ছবি মোবাইলে রাখে? তাও আবার নিজের স্ত্রীর!”

“তো পরের স্ত্রীর রাখব নাকি!”

“ঠোঁট কাটা কেন আপনি? লজ্জা শরম আপনার নেই আমার আছে। আপনি আমার এই রকম ছবি রাখতে পারেন না।”

“অবশ্যই পারি। আফটার অল! সবই তো আমার।”

“ছিঃ কি আপনার! উল্টা পাল্টা বকলে এক্ষুণি আপনার মুখ সেলাই করে দিব একদম।”

“সেটাও যদি পারতে! একটু সেলাইও তো করতে জানোনা!”

মেহজা আরো রেগে গেল যেন। দূরে সরে আসতেই মেহজাকে ইরফান নিজের কোলে বসিয়ে বলে,

“ডোন্ট মুভ! আমার ফোনে থাকা ছবিগুলো আমি এক্ষুণি ডিলিট করে দিব। তোমার সামনেই।”

মেহজা যেন খুশি হয়। ইরফানকে তাড়া দিয়ে বলে,

“জলদি করুন।”

ইরফান করে দেয় সত্যি সত্যি। তারপর মেহজার ঘাড়ে হালকা কাঁমড় বসিয়ে বলে,

“মোবাইলে থাকা গুলো ডিলিট করে দিলাম ঠিকই। তবে!”

“তবে কী?”

“আমার রুমে থাকা বড় ছবিটার কী হবে? যেটা আমি কিছুদিন আগেই দেওয়ালে টাঙিয়েছি!”

“কোন ছছছবি!”

কাঁপা কাঁপা গলায় বলে মেহজা। ইরফান তাকে স্বাভাবিক ভাবেই বলে,

“এই ছবির ডুপ্লিকেট!”

মেহজার চোখ মুখ যেন নীল বর্ণ ধারণ করে তখনিই। ইরফান তাকে আশ্বস্ত করে বলে,

“ভয় নেই! আমি আমার ব্যক্তিগত প্রিন্টারেই নিজে ছাপিয়েছি নিজে ফ্রেমও করেছি। অন্য কেউই দেখেনি।”

মেহজার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। শরীরের ভর ছেড়ে দেয় তৎক্ষণাত। ইরফানও তাকে আগলে নেয় দ্রুত। মেহজার দিকে তাঁকিয়েই বিড়বিড় করে বলে,

“আমিই তো! এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে যে সোজা অজ্ঞানই হতে হলো! ড্রামাবাজ মেয়ে একটা।”

মেহজাকে কোলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে। মেয়েটা অসুস্থ হওয়ার আর সময় পেল না! তাদের দুজনের অনুপস্থিতি এখন সবাইকে অন্য কিছু ভাবাবে। অসহ্যকর!

#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here