গোধূলী আকাশ লাজুক লাজুক পর্ব ২৮+অন্তিম পর্ব

#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-২৮)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

একটি বট গাছের নিচে ইরফান মেহজাকে নিয়ে এসেছে। সে ভেবেছিল হয়তো কত শত আয়োজন করে রেখেছে ইরফান। কিন্তু ইরফান তো ইরফানই! সে আগেও তার অনুভূতির দাম দিত না এখনো দেয়না। মেহজা মন খারাপ করে বট গাছের নিচে বসে পড়ে। ইরফানও গাড়ি থেকে তখন একটি কেক নিয়ে আসে যার মধ্যে তার আর মেহজার রাদিফের বিয়ের দিন তোলা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অসাধারণ ছবি। হুট করেই মেহজা যেন সব অভিমান ভুলে গেল একটি কেকই যেন তাকে আনন্দিত করল। তবে ইরফান কিন্তু আদৌও এত ছোট পরিকল্পনা করেনি প্রেয়সীর জন্য। জোরে একটি শিষ বাজাতেই গাছটা আলোকিত হয়ে পড়ে। হরেক রকম রঙিন আলোয় গাছটি উজ্জ্বল করে উঠে। চারিদিকে আতশবাজি ফুটতে থাকে আকাশের বুকে হওয়া স্কাইশট গুলোতে স্পষ্ট লিখা থেকে হ্যাপি এনিভার্সেরী। মেহজার চোখে জল চিকচিক করে, প্রিয় মানুষটি যে তার কল্পনার ঊর্ধ্বে যেতে পারে তা সে ভাবতেই পারেনি। ইরফানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে। ইরফানও পরম ভালোবাসা মিশিয়ে তার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মেহজার কাছে সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে এই সেই ইরফান যাকে পাওয়ার জন্য এক সময় সে অনেক পাগলামী করেছিল। আজ সেই ইরফানকে সে পেয়েও গেছে এত আনন্দ সে কোথায় রাখবে এখন? কারো নজর লেগে যাবেনা তো! মেহজা হু হু করে কেঁদে ওঠে। ইরফান তাকে কাঁদতে বাধা দিল না, কাঁদুক না একটু! সুখের সাথে একটু দুঃখ মেশানো অনুভূতি না থাকলে কী হয়?

ইরফানের বাহুডোরে আবদ্ধ মেহজা ইরফানকে আজ মুখে বলেই দিয়েছে ” ভালোবাসি মি. ইয়াজিদ!” পাষণ্ড ইরফান বদৌলতে একটুও ভালোবাসি বলল না তাকে। তাতে অবশ্য মেহজার দুঃখ নেই। আজকাল সে ইরফানের ভালোবাসার গভীরতা উপলদ্ধি করতে পারে। ইরফানের বিরুদ্ধের তার অভিযোগটাও সীমাবদ্ধ বলা চলে। ইরফানকে হুট করেই মেহজা অনুনয়ের সুরে বলে,

“আমার এইচ এস সি পরীক্ষার পর অনুষ্ঠানটা করলে কী খুব সমস্যা হবে?”

“একদমই না।”

“আপনি সত্যি বলছেন।”

“তুমি চাইলে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেই না হয় অফিসিয়ালি আমার ঘরে যেও।”

“না না! এইচ এস সি হলেই হবে। আমার ধৈর্যসীমা খুব কম।”

“তাই?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু আমার তো আছে।”

“আপনি একটা বাজে লোক।”

“তোমারই তো!”

“হ্যাঁ! আপনি শুধুই আমার।”

মুখ উঁচিয়ে কথাটি বলল মেহজা। দেখতে পেল ইরফনের চোখে মুখে তৃপ্তি ছড়িয়ে আছে। আলতো হেসে চোখ বুজে সে।

————————-

সিনান আর অনার আকদ করিয়ে ফেলেছে সবাই। অনার শত বারণ করার পরও তারা কিছু শুনেনি। বর্তমানে অনার রুমে অনার বিছানায় সিনান বসে আছে। অনা তার থেকে এক হাত দূরুত্বে বসে আছে। সিনান নীরবতা ভেঙে বলে,

“কিছু বলবেনা অনা?”

“কি বলব? আর কিছু বলার বাকি আছে আমার! আর এখন কিছু বলেও কি কোনো লাভের লাভ হবে?”

“হবে আবার হবে না।”

“পেচিয়ে কথা বলা মানুষ আমর একদম পছন্দ না।”

“তোমার তো আমিটাকেই পছন্দ না অনা।”

“জানেন যখন বিয়ে করলেন কেন?”

“ভালো লাগে তাই।”

“যা দরকার ছিল তা তো পেয়েই গিয়েছিলেন। কোন ভয়ে এখন আমাকে বিয়ে করছেন? ওহ পুলিশে দিব তাই?”

“উহু! কোনো পুলিশেই আমাকে কিছু করতে পারবেনা। কারণ আমি কোনো অন্যায় করিনি।”

অনা এবার রেগে গিয়ে সিনানের কলার চেপে ধরে বলে,

“সেই রাতে আপনি যা করেছেন তা অন্যায় ছিল না? ঘৃণিত অন্যায় ছিল সেটা, চরম পাপ ছিল সেটা।”

“সেই রাতে কিছুই হয়নি অনা।”

সিনানের আলতো হেসে বলা কথাটি অনার হৃদয়ে শীতলতা এনে দিল যেন। সিনানের কথা তার বিশ্বাস হচ্ছে কেন তা সে নিজেও জানেনা। তবুও নিজের দাম্ভীকতা বজায় রেখে বলে,

“আপনি মিথ্যে বলছেন।”

“একদম নয়। চাইলে এক্ষুণি প্রমাণ দিতে পারি! দিব?”

“কীসের প্রমাণ?”

“দুটো অপশন আছে। একটা হচ্ছে ছোট খাটো একটি রেকর্ডার আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটি শারীরিক…….

“আপনি নোংরা লোক!”

“নোংরা হই বা যাই হয়ে থাকিনা কেন সত্য একটাই তুমি কুমারী আছো।”

এই কথাটি বলেই সিনান তার রুম থেকে প্রস্থান করে। অনা শুধু চেয়ে থাকে অবাক চোখে। তার মন মস্তিষ্ক দুটোই বলছে সিনানকে ভরসা করতে। যদি কিছু হয়েও থাকে তাহলে তো সে নিজেও বুঝতে পারত একটু হলেও। সিনানের গমনের পরই অনার মা এসে তাকে বলল,

“সিনান এমন রেগে বের হলো কেন অনা? কিছু হয়েছে?”

“না।”

“সত্যি বলছিস তো?”

“হ্যাঁ।”

“সিনান কি তোকে বলেছে আজ রাতে মিশনের উদ্দেশ্যে তাকে মিশর যেতে হবে।”

“মিশন? তাও আবার মিশরে!”

“হ্যাঁ তো, তোকে বলেনি কিছু?”

“না বলেনি আমাকে।”

“দুই বছরের জন্য যাচ্ছে শুনলাম।”

“তাই নাকি! ভালোই তো।”

“আরে ভালো না ছাই! শুনেছি এসবে বিপদ থাকে অনেক। কত মানুষ মরেছে। আমার তো ভয় করছেরে।”

“তুমি এখন যাও আমি একটু ঘুমাতে চাই।”

“এই অবেলায় ঘুমাবি কেন? শরীর খারাপ!”

“না, মন!”

অনার মা আসিয়া বেগম বের হয়ে এলেন রুম থেকে। অনার হুট করেই সিনানের জন্য মায়া জন্মালো। কে জানতো এই মায়া গভীর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাবে একদিন!”

————————————————–

“আমাদের বিয়ের তিন বছর পর হুট করেই আমার পেটে ইজহাম চলে আসে। ওর বাবা তো সেই খুশি হয়েছিল কিন্তু মুহূর্তেই আমার ক্যারিয়ারের কথা ভেবে সে চুপসে যায়। তার এত খুশির বলিদান সেদিন আমি দিতে পারিনি। মা হওয়ার মত আনন্দের বিষয়টি আমি সাদরে গ্রহণ করেছি। প্রথম বর্ষের শেষের দিকে ইজহাম হয়। আমার সত্যি বলতে একটুও কষ্ট করতে হয়নি। তার বাবা,ফুফুরা, দাদা-দাদু,নানা-নানু, মামা-মামি সবাই তাকে মহা আনন্দে লালন পালন করেছে। দেখতে দেখতে আমার অনার্স কমপ্লিট হয়ে গেল। পাড়ি জমালাম সূদুর আমেরিকায়। ইয়াজিদের বিজনেসের কাজটা এখানেও থাকাতে তাকে বছরের ছয়মাস আমেরিকা আর ছয়মাস বাংলাদেশ দৌঁড়াতে হতো। যা খুব কষ্টের ছিল। ততদিনে আমারও মাস্টার্সের জন্য আমেরিকার নাম করা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া হয়ে যায়।
এক বছর হলো আমেরিকায় এসেছি। সবাইকে খুব মিস করি। ইরা আপুর সাথে সপ্তাহে একবার সেখা হয়। একদিন হলিডেতে সেও ক্যালিফোর্নিয়ার এই বাড়িটিতে আসে আমাদের সাথে দেখা করতে।
ইয়াজিদ লোকটি আমাকে খুব ভালোবাসে। যদিও যে আজ অব্দি মুখ ফুটে ভালোবাসি বলেনি। অবাক হওয়ার হলেও এটা সত্যি। তবে তার প্রতিটি কাজে প্রমাণ পায় আমাকে আর বাবুকে খুব ভালোবাসে তিনি। আজ আমি খুব খুশি। কারণ আজ আমার আর তার দ্বিতীয় সন্তানের এই পৃথিবীতে আসার সুসংবাদটি আমি জানতে পেরেছি। আর দেখ! লোকটি তা সম্পর্কে মোটেও অবগত না। বাহিরে ছেলের সাথে স্নো ফল নিয়ে খেলায় মত্ত সে। আচ্ছা! দ্বিতীয় জনের আসার খবরে সে কি খুব খুশি হবে? যেমনটি হয়েছিল ইজহামের বেলাতে!”

——- ডায়েরীতে এতটুকু লেখেই হাত থামালো মেহজা। আনন্দে তার শরীর কাঁপছে। পেটে হাত বুলিয়ে ডায়েরীটা লক করে দেয়। আজ সুপার শপে পাসওয়ার্ড সিস্টেম এই সুন্দর ডায়েরীটি দেখে লোভ সামলাতে পারেনা। ফটাফট কিনে নেয়। আজ থেকে সে সব কিছুই এই ডায়েরীতে বন্ধি করে রাখবে বলে মনঃস্থির করেছে।

চেয়ার ছেড়ে বড় জানালাটির পাশে দাঁড়ায়। ছোট্ট টি টেবিলটা থেকে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা কেটলি থেকে ঢেলে নেয়। এক চুমুক দেওয়ার পরই হঠাৎ তার নজরে যায় কেটলির পাশে একটি কাগজ। চায়ের কাপটা শব্দ করে রেখে কাগজটি খুলে বিস্মিত হয় সে, যাতে লেখা আছে,

“ধন্যবাদ প্রিয়তমা! সবকিছুর জন্যই ধন্যবাদ। আমার পরবর্তী সন্তানকে নিজ গর্ভে ধারণ করার জন্য আরো ধন্যবাদ। একদম বিচলিত বা অবাক হবেনা যে আমি জানলাম কীভাবে! আপনি কি এটা জানেন না যে আমি সবদিকেই খেয়াল রাখি! এই মাসের পিরিয়ডটা যে মিস গিয়েছে তা আমি জানি। ডক্টর স্টেইফির কাছ থেকে আজ প্রেগন্যান্সী রিপোর্ট এনেছেন তাও জানি। ধারণা সঠিক! ডক্টর স্টেইফি আপনাকে রিপোর্ট দেওয়ার আগেই আমাকে ইনফর্ম করেছে বেগমজান। সরি টু সে! আপনার সারপ্রাইজটা ভেস্তে গেল। আর শুনুন

“ভালোবাসি খুব”
আমি ভালোবাসি কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারিনা। কারণ আমার গোধূলী আকাশটা লাজুক লাজুক!
আমার আর ইজহামের পক্ষ থেকে লিটল ওয়ানকে অনেক ভালোবাসা।”

মেহজার ঠোঁট প্রশস্ত হয়। এই প্রথম লোকটি ভালোবাসি বলেছে মুখে নয় ঠিকই লিখে তো বলেছে! মেহজা চট করেই সামনে তাঁকায়। তাঁকিয়ে দেখে ইরফান তার দিকেই তাঁকিয়ে আছে মুখে লেগে আছে সেই মুঁচকি হাসি। হঠাৎ তার নজরে গেল পাশে থাকা স্নোম্যানটার দিকে। যার গায়ে মেহজার ওড়না পেচিয়ে রাখা হয়েছে। কপট রাগ দেখিয়ে কিছু বলবে তার আগেই ইজহাম চেঁচিয়ে বলে,

“মাম্মা!”

এই একটি ডাক আর প্রিয়তমর মুঁচকি হাসি দুটোই তার রাগ বিলীন করে নিমিষেই! মেহজা আকাশের দিকে তাঁকায় সবকিছুর জন্যই মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করে সে।
#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (শেষ পাতা)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

চারিদিক বরফে ঢাকা পড়ে আছে, ইরফান কোনোরকমে গাড়িটি পার্ক করে বাংলোতে ঢোকে। দুই বার কলিং বেল বাজাতেই তাদের কেয়ার টেকার জিমি দরজা খুলে দেয়। ছোট করে মুঁচকি হেসে “ওয়েলকাম হোম স্যার” বলে ইরফানকে স্বাগত করে। ইরফানও তাকে ছোট করে “থ্যাঙ্ক ইউ” বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। ঘুমন্ত ইজহামকে এক নজর দেখে আসে তার রুম থেকে। নিজেদের রুমের দিকে পা বাড়াতে নিলে তার কানে আসে অতি পরিচিত একটি গান যা বরাবরই তার পছন্দের তালিকায় থাকে। শব্দহীন পায়ে গিয়ে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। মেহজা একদৃষ্টিতে জানালার ধারে বসে তুষারপাত দেখছে। এই সুন্দর দৃশ্যটা হয়তো আরেকটু দেরি করলে দেখতেই পেত না সে। মেহজার স্বাস্থ্য বেড়েছে আবার। ইজহামের বেলায় যতটা সুন্দর হয়েছিল এবার তার থেকেও বেশি সুন্দর দেখায় মেহজাকে। হয়তো আবহাওয়ার বদলের কারণেই। বাচ্চাটাও নিশ্চয়ই ফকফকা সাদা হবে। মেহজার এই সুন্দর ফোলা মুখটা ইরফান খুব ইন্জয় করে। ভালোই লাগে যখন এই ফোলা গাল নিয়ে হাসে আবার রাগ করে লাল করে ফেলে। তখন তো দেখতে আরো সুন্দর লাগে। ইরফান এবার সাউন্ড বক্সটার দিকে তাঁকায় যেখান থেকে গানটি ভেসে আসছে কর্ণকুহুর অব্দি।

‘তুমি বললে আজ দুজনে, নীল রঙা বৃষ্টিতে ভিজবো!’
‘রোদেলা দুপুরে একসাথে নতুন সুরে গান গাইবো।’
‘শেষ বিকেলের ছায়ায় নিয়ে আকাশের বুকে আমি, লাল রঙা স্বপ্ন আঁকবো!’
‘আমি কবি নই! তবু কাব্যের ভাষায় বলব আজ!’
‘তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে স্বপ্ন নিয়ে ভাঁসতে চাই, তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে স্বপ্ন নিয়ে ভাঁসতে চাই!’

ইরফান মৃদু পায়ে বিছানায় গিয়ে মেহজার পাশে বসে। ইরফান অবাক হয়, মেহজা এতক্ষণেও তার উপস্থিথি টের পেল না! এটা কীভাবে সম্ভব! অন্যদিন তো গাড়ি নিয়ে আসার আগেই বুঝে ফেলত ইরফান আসছে। তাহলে এখন কী হলো? মেহজা কি কিছু নিয়ে চিন্তিত! ইরফান মেহজাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে মেহজাও ইরফানের আরেকটু কাছে গিয়ে তার বুকে মুখ লুকায়। মেহজা বিরক্ত ভাব এনে বলে,

“আপনি আবারও সেই বাজে পারফিউম টি লাগিয়েছেন?”

“বাজে বলছো? একসময় তুমিই কিন্তু এই পারফিউমের দিওয়ানি ছিলে।”

“একসময় তো আমাকে দিওয়ানি করতেন। তো এখন কাকে করছেন? আমি তো পুরোনো হয়ে গেছি আমাকে আর ভালো লাগেনা না! মোটা হয়ে গেছি আপনার তো স্লিম ফিগারের মেয়ে লাগবে। বুঝি আমি সব বুঝি।”

“বেশি বুঝো! এত বেশি বোঝা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।”

“আমার স্বাস্থ্য নিয়ে যখন এত চিন্তা তাহলে এই পারফিউমটা দেন কেন? জানেন না আমার বমি পায় এই গন্ধে।”

“একটুই তো দিয়েছি। আচ্ছা আর দিব না। এখন এটা বল কি নিয়ে এত ভাবছিলে? আমি এলাম কোনো লাফালাফিও করলেনা রোজকার মতো। ব্যাপার কি?”

“ভালো লাগেনা কিছু বুঝলেন! একটুও ভালো লাগেনা। কাছের মানুষগুলোকে কতদিন দেখিনা! এইরকম একটা সময়ে তারা পাশে না থাকলে কেমন অসহায় অসহায় লাগে। আপনি বুঝবেন না।”

“হ্যাঁ সব তো আপনিই বোঝেন আমরা তো মহা অবুঝ!”

মেহজা ইরফানকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। চারমাস চলছে এখন তার পেটটা কিছুটা উঁচু হয়ে আছে। এখনও হাটা চলার ব্যাপারে তেমন সমস্যা তার হয়না। তবুও ইরফান তাকে শুয়ে আর বসে থাকতেই বলেছে। একা একা বেরোতে পর্যন্ত দেয়না। সবকিছুই কেমন দম বন্ধকর লাগে তার কাছে। এই ভাবে চলা যায়? উহু! একদমই না। মেহজা সাউন্ড বক্সটা বন্ধ করে দেয়। এখন আর গান শুনতেও ইচ্ছে করছেনা। কিছুক্ষণ আগেই জিমি মাদার্স হরলিক্স এনে দিয়েছিল। প্রতিদিন কম করে একবার হলেও তাকে এটি খেতে হয়। অবশ্য মেহজার ভালোই লাগে খেতে। মগটা হাতে নিয়ে এক চুমুক দেয়। তারপর ইরফানের দিকে তাঁকায়, ইরফানের দৃষ্টি তার দিকেই স্থির। মেহজা লজ্জা পায়। লোকটা দিন দিন বেহায়া হয়ে উঠছে। কেমন করে তাঁকিয়েই থাকে। সেই দেখার শেষ হয়না যেন! মেহজা ভ্রু কুঁচকে ইরফানকে বলল,

“এমন তাঁকিয়ে না থেকে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। দিন দিন নোংরা হয়ে যাচ্ছেন দেখছি। আগের মতো এসেই ফ্রেশ হতে যান না। ঠেলে ঠুলে পাঠাতে হয়।”

“কি আর করবে বল! বুড়ো স্বামী পেয়েছো এখন তার শরীরে কি সবটা কুলোয়! বয়স হয়েছে হাড়ে ঝং ধরেছে আরো কত কি!”

মেহজা হো হো করে হেসে দেয় ইরফানের কথার ধরণ দেখে। ইরফানও সেদিকে তাঁকিয়ে ফিক করে হেসে দেয়। মেহজা ইরফানকে আবারও বলল,

“বুড়ো আর আপনি? এই দেখুন! পাশের বিল্ডিংয়ের কলেজ পড়ুয়া এক মেয়ে সবসময় আমাদের বারান্দায় উঁকি ঝুকি দেয়। কেন দেয় বলুন তো? আপনার জন্য। আর আমাকে কেউ একটু দেখে! এক বাচ্চা আমার হাঁটে তো এক বাচ্চা পেটে। আমাকেই তো লোকে বুড়ি বলে ডাকবে দুদিন পড়, যখন দেখবে বাচ্চাদের নিয়ে একটু বাহির হলাম। কিন্তু আপনি! ছয়ত্রিশ বছর বয়স হয়েছে কেউ দেখলে বলবে! যে ভাব নিয়ে থাকেন আর যে রুপ চর্চা করেন আপনাকে পঁচিশ বছর বয়সী যুবক উপাধি দিলেও ভুল হবে না।”

“তাহলে তো ভালোই। তবে একটা জিনিস খেয়াল করেছো? আমাকে বেশিরভাগ পাশের বাসার প্রতিবেশী আর নিচের তলার প্রতিবেশীরাই বেশি পছন্দ করে। কারণটা কী?”

মেহজাকে ফোঁড়ন কেটে যে কথাটা ইরফান বলেছে তা মেহজা ভালোই বুঝতে পারে। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই সে হেসে কাবার্ড থেকে ড্রেস বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। মেহজাকে তার খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সে পারছেনা! মেহজা দিন দিন বেশিই সুন্দর হয়ে যাচ্ছে। কেউ একবার নজর দিয়েই দেখুক! ঠ্যাং ভেঙে দেবে তার।

রাতে ঘুমানোর সময় ইজহামকে মেহজা সাথে করে নিয়ে আসে। বাচ্চা ছেলেকে কিনা একা ঘুমাতে দেয় ইরফান। তার ছোট্ট ছেলে মায়ের বুকে ঘুমাবে তা নয় তাকে একা রাখে। কারণ সব ঘরেই এই নিয়ম। বাচ্চাদের একা ঘুমানোর অভ্যাস তৈরি করতে হবে। তাই বলে এত ছোট বয়সে! সবে মাত্র চার বছর হয়েছে তার ছোট্ট ইজহামের। এখনই তাকে মায়ের কাছ থেকে দূর করার মানেই হয়না। অবশ্য ইরফান আপত্তি করেনা যখন ও তাদের সাথে ঘুমায়। ছেলেকে সেও ভালোবাসে কিন্তুর ছেলের মাকে কে বোঝাবে যে এখানে ছয়মাসের বাচ্চাও আলাদা ঘুমায়। এইখানকার কালচার এমনই!

মেহজা শুয়ে ছেলের মাথায় বিলি কাটছে। ইরফান ঘুমায়নি তবে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। চোখ খুলে মেহজাকে আলতো স্বরে ডাকে,

“মেহজা?”

“হু! ঘুমাচ্ছেন না কেন?”

“একটা কথা বলার ছিল।”

“বলুন না।”

“মা কল করেছে। বলেছে কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশ যেতে আমারও কাজের চাপ কমেছে বাবুর স্কুলেও ভ্যাকেশন চলছে। তোমারও ইউনিভার্সিটি এখন বন্ধ। তাই বলছিলাম কি যাবে? এক মাসের জন্য ঘুরে আসি।”

“আগে বলবেন না! আমিও তো যেতে চাই। কবে যাবেন বলুন!”

“পরশু টিকিট কেটে রাখব। নেক্সট উইক যাচ্ছি তাহলে।”

“ঠিক আছে।”

উচ্ছাসিত মেহজার দিকে একবার তাঁকিয়ে চোখ বুজে ইরফান। মা তাকে সবসময় যেতে বলে। তবে আজ সে যাচ্ছে মেহজার জন্য। কাজের চাপ কমেনি বরং বেড়েছে তবুও তাকে যেতে হবে। আপনজনদের দেখার জন্য তার মনটাও ছটফট করছে।

——————————-

অনা মেয়েকে খাইয়ে তৈরি করে রেখেছে একেবারে। এমন উঁড়নচন্ডী মেয়েটা যে তার পেটের মাঝেমাঝে বিশ্বাস হয়না। অবশ্য বাপটা তো সেরকম তাই বাপের বেটি বলা যায়। মেহজারা তিনদিন হলো দেশে এসেছে। সিনান তাদের ইনভাইট করেছে সাথে প্রথিও আসছে। অনেকদিন পর প্রিয় বান্ধবীদের দেখতে পাবে সেই খুশিতে আত্নহারা হয়ে পড়েছে সে। সিনান অবশ্য দু তিনবার ধমকে গেছে এত নাঁচার কি আছে এই বলে। কিন্তু সে কি বুঝবে তার কাছে ঐ দুটো কি!

সেদিন যখন সিনান মিশরে গিয়েছিল অনা তাকে নিয়ে ভেবেছিল। তবে শুধুই সেদিনের জন্যই। সিনান যাওয়ার পর তিনমাস কল করে খোঁজ খবর নিত। অনা প্রতিবারই রাগ দেখিয়ে কল কেটে দিত। তিনমাস পর হুট করেই সিনান সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কারো সাথেই কোনো যোগাযোগ করতো না। অজানা ভয়ে অনার বুক কাঁপতো শুধু। বারবার মনে হতো লোকটার কিছু হয়ে যায় নি তো! তার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে একমাস পর আবারও সবার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে সিনান। শুধু অনাকেই সে কোনো ফোনকল করত না। সবাইকে জানিয়েছে অন্য জায়গায় গিয়েছিল এমন অবস্থায় ছিল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হয়েছে। কিন্তু অনা জানতো সত্যি কথা। সিনান তার উপরে রাগ করেই একমাস সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। তারপর থেকেই অনার মনে সিনানের জন্য অন্যরকম অনুভূতি তৈরি হয়। যা ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয় ধীরে ধীরে। তাইতো দুই বছর পর যখন সিনান আসে এয়ারপোর্টে ভরা লোকের মাঝে সিনানকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদে। সিনানও সেদিন পরম আবেশে প্রিয়তমা স্ত্রীকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। তারপরে অনাকে তার ঘরে তুলে নেওয়া হয়। অনার অনার্সের পরই তাদের মেয়ে সানা হয়। যার বর্তমানে এক বছর বয়স। তবুও এই ছোট্ট মেয়েই অনাকে জ্বালিয়ে শেষ করে। কিছু করতেও পারেনা সিনানের জন্য। তার এক কথা!

“আমার মেয়ের গায়ে হাত তুললে আনোয়ার রহমানের মেয়েকেও পিটিয়ে বস্তায় ভরে তার বাড়িতে ফেলে দিয়ে আসব।”

অনা জানে সিনান এমন কাজ কখনো করবেনা, তবুও যখন সিনান রেগে ধমকের সুরে এই কথা বলে তখন ভয়ে অনা কেঁপে ওঠে।

ইরফান আর মেহজা আসলে তাদের সাদরে গ্রহণ করে সিনানের পরিবার। আতিথেয়তার কোনো কমতি রাখেনা সিনান। ইরফানের সাথেও বিগত কয়েক বছের তার সম্পর্ক বন্ধুর মতো হয়েছে। ইজহামকে সবাই আদর করছে খুব। অনা মেহজাকে নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে বসে। একে অপরের সাথে দীর্ঘ আলাপ জুড়ে দেয়। মেহজা প্রথির কথা জিজ্ঞস করতেই অনা বলে,

“আসছে হয়তো এখুনি এসে পড়বে।”

“প্রথি বিয়ে সাদি করবেনা? ওর বিয়ে কি আর খাওয়া হবেনা!”

“অবশ্যই হবে। আর বিয়ে যেহেতু ফরজ তাই করতেই হবে।”

প্রথির গলার আওয়াজে মেহজা পেছন ফিরতেই প্রথি এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। অনাও দুজনকে দুহাতে আবদ্ধ করে নেয়। প্রথি তাদের মাঝে বসে বলল,

“দেখ! বিয়ে তোরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই করে ফেলেছিস। তাই তোরা এখন বাচ্চার মাও হয়ে গিয়েছিস। আমার দ্বারা আবার এত দ্রুত এসব সম্ভব নয়। একটু সময় নিতে চাচ্ছি।”

“এতদিনেও হয়নি?”

প্রথি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“অফিসের বসটাকে ভালোবাসি কিন্তু বেটা এতদিন ভাও দিল না। আজ অফিস গিয়ে শুনি কে বা কারা গুজব ছড়িয়েছে আমার নাকি বিয়ে। নিজের কেবিনে এসে বসতে না বসতেই বস বেটা এসে হাত চেপে ধরে বলে প্লিজ প্রথি! অন্য কোথাও বিয়ে কর না। আমি তোমায় খুব ভালোবাসি তুমি প্লিজ এমনটা কর না। আমি খুশিই হলাম। গুজবটা যেই রটিয়েছে আমার লাভ হয়েছে খুব। শোন মেহজা! এই মাসেই বিয়ে করছি সো দাওয়াত খেয়েই যাবি। বিয়ে খাইস না!”

সবাই অট্টহাসিতে মেতে ওঠে। প্রথি কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“অনা আমার কলিগ রাহুল ভাইয়াকে দিয়েই তুই এই গুজব ছড়িয়েছিস না! যাতে করে বেটা বস মুখ ফুটে মনের কথা বলে! একমাত্র তুই জানতি অর্ণব স্যারকে আমি পছন্দ করি। আর সেও আমার বিশেষ খেয়াল রাখে।”

অনা অপরাধীর মতো তাঁকিয়ে থাকে। আসলেই কাজটা সে করেছে। প্রথি কেন সবসময় সবকিছু ধরে ফেলে! আনন্দ মাটি করায় ওস্তাদ এই মেয়ে।

অর্ণব সেই লোকটাই যাকে কমিউনিটি সেন্টারে অনা আর প্রথির নামে ভুলভাল শুনিয়ে রাস্তা সাফ করে সিনান। পরে মেয়ে হওয়ার পর সিনান নিজে তার সাথে যোগাযোগ করে। সবটা জানায় তাকে। অর্ণব অবিবাহিত শুনে সে চমকায়। অর্ণবের কিছুটা আফসোস হলেও মজা করে বলে,

“আপনার ভাগ্য ভালো সিনান সাহেব, কথাটা আমি দেরিতে জেনেছি। আরো আগে জানলে আপনার বউকে কেড়ে নিতাম।”

“আমিও সোজা আপনার জায়গা মতো শ্যুট করতাম।”

কথাটা বলেই দুজনে হাসাহাসি করে। তার কিছুদিন পরই প্রথি তার কম্পানিতে জয়েন করে। সে প্রথম দেখায় প্রথিকে চিনতে পারে কারণ শরীরে বাড়লেও চেহারা একই আছে। তারপর থেকে সে ধীরে ধীরে প্রথির প্রতি দুর্বল হয়। আর আগামীতে তাদের বিয়েও হতে চলেছে। একেই বলে ভাগ্যের লিখন!

ইরফানের বসুন্ধরার সেই ফ্ল্যাটটিতে এখন ইরফানরা অবস্থান করছে। আহনাফ মজিদ আর মাহিমা বেগমও সাথে আছে। মেহজা এই মুহূর্তে রেগে আছে। একটু আগেই সে ইরফানের সাথে ঝগড়া করেছে। কারণ কাবার্ডে সে সত্যিই সেই ছবিটি পায়। ইরফান কাড়াকাড়ি করে মেহজার থেকে ছবিটি নিয়ে এখন অন্য কোথাও লুকিয়ে রেখেছে।

কিছুক্ষণ পর ইরফান রুমে আসে এবং সে মেহজাকে বলল,

“রাগ করার কিছুই নেই। এখানে খোলামেলা কিছুই নেই যে এতটা রাগ করছো তুমি।”

“আপনি চুপ করুন দূষিত পুরুষ কোথাকার।”

“তোমারই তো!”

মেহজা অবাক চোখে ইরফানকে দেখে। কতদিন পর আবার আগের মত করে সে বলল,

“তোমারই তো!”

মেহজা চোখ বন্ধ করে শ্বাস ছাড়ে। রাগ ভুলে শুধু একটা কথা ভাবে,

“আমারই তো! মানুষটা আমার! তার সন্তানের মা আমি। এতকিছু কি করে হয়ে গেল তাই না! আল্লাহর মর্জি তো ছিলই তার সাথে হাসনার ক্রেডিটও যায়।”
হাসনাকে পেলে নিশ্চয়ই জড়িয়ে ধরে চুমু খেত সে। মেহজা হঠাৎ এসব ভেবে খিলখিল করে হাসে। ইরফান তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“হাসছো কেন?”

মেহজা হেসে হেসেই বলল,

“হাসনাকে মনে আছে?”

ইরফান ভ্রু কুঁচকে নেয়। হাসনার কথা মনে পড়তেই সেও হেসে ফেলে। কে বলবে একটু আগে এই দম্পত্তি ঝগড়া করছিল? এদের গোধূলী আকাশটা এমনই! লাজুক লাজুক!

~~~~~~~সমাপ্ত~~~~~~~

(কেমন লেগেছে জানাতে ভুলবেন না।)
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here