চন্দ্রপুকুর পর্ব -১৯

#চন্দ্রপুকুর
||১৯তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
অতীত,
“দিলরুবা, ঐ পুকুরঘাটের সিঁড়িপথ আর তার আশপাশ বহু দিন ধরে এমন কাদামাটিতে ভরপুর, তাই না?”

“হ্যাঁ, বেগম। আসার পর হতেই তো এমন দেখছি। কিন্তু হঠাৎ এ বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন ক্যানো?”

যামিনী সেদিক থেকে নজর সরিয়ে গাঢ় দৃষ্টিতে দিলরুবার পানে তাকায়। তার ঠোঁটে চাপা হাসি।

“আমি এই কাদামাটিতে পিছলে পড়ে আহত হবো। বৈদ্য আসবে আমায় দেখতে।”

“আস্তাগফিরুল্লাহ্ বেগম চন্দ্রমল্লিকা! এসব কী বলছেন আপনি! এমন বিপদে পড়ুক আপনার শত্রু, আপনি না।”

“আরে না আমাকেই পড়তে হবে।”

“মানে?”

কিশোরী মুচকি হেসে দিলরুবাকে নিচু কণ্ঠে প্রকাশ করে পরিকল্পনা। দিলরুবা চোখজোড়া যেন কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসবে।

“এতো বড়ো ঝুঁকি নিবেন বেগম? যদি গুরুতর ক্ষতি হয়ে যায় তাহলে কী হবে? প্রয়োজন নেই বেগম এমন জীবন বাজী রাখার।”

“আমার গোটা জীবনই একেকটা বাজী, প্রতিটি সিদ্ধান্তই ঝুঁকিপূর্ণ। এই যে বিবাহ হয়েছে আমার ও বাবু মশাইয়ের, তাও পরিণাম না বুঝে, বাজীর মতোই। আমার আর ভয় নেই কোনো। তুমি যা বলেছি তা করো।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা ঝাঁকায় যুবতী, খাঁস বাঁদী হয়েছে বলে কথা।

যামিনী পরিকল্পনা মোতাবেক হাত-পা ধোয়ার ভঙ্গিমায় পুকুরের দিকে এগিয়ে যায়। দেরি না করেই পিচ্ছিল পথে উবু হয়ে পড়ে সে। তেমন আঘাত না পেলেও অসাড় হয়ে পড়ে থাকে।

দিলরুবা আদেশ মোতাবেক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে শুরু করে দাসী ও খাদিমদের। তার আওয়াজ পেয়ে এগিয়ে আসে সকলে। দ্রুতো যামিনীকে উঠিয়ে ঘরে নিয়ে যায়।

“এ কী বেগম তো উঠতে পারছেন না! এখন কী হবে? মোর্শেদা খাতুন, আপনি যেয়ে বৈদ্যকে নিয়ে আসুন, জমিদার বাবুকে খবর দিন। আমার বেগম!”

আকস্মিক ঘটনায় স্তম্ভিত মোর্শেদা খাতুনও দিলরুবার তাগিদে জ্ঞানশূন্য হয়ে তার কথা মোতাবেক কর্ম করে। কিশোরী অশ্রু ঝরানো নয়নযুগল চকচক করে উঠে। দাসীরা ভেজা বস্ত্রের দ্বারা মুছে দেয় দেহে লাগা কাদা।

একটু বাদে বৈদ্য প্রবেশ করেন। উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত ভাবে প্রবেশ করে মেহমাদ শাহও।

“কী হয়েছে? কীভাবে পড়লে তুমি চন্দ্রমল্লিকা?”

যামিনী কিছু না বলেই মুখে আঁচল চেপে ফোঁপাচ্ছে। যুবক দিলরুবার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

“এখানে তো জেনানা স্নানাগার নেই। তাই পুকুরে যাচ্ছিলেন বেগম হাত-পা ধুতে। হুট করেই পিচ্ছিল পথে পড়ে গেলেন, কারণ সকাল হতেই দুর্বল বোধ হচ্ছিলো তার খানাপিনায় ব্যাঘাত ঘটায়।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহমাদ শাহ। বৈদ্যের দিকে ইশারা করে কার্য শুরু করার।

“চিন্তার বিষয় নেই। ছোটোখাটো আঘাত লেগেছে, হাতে-পায়ে। আমি ঔষধি পাঠিয়ে দিচ্ছি, খেলে ঠিক হয়ে যাবেন। গোটা একদিন একদম বিশ্রামে থাকত্ব হবে। আর দুর্বলতার জন্য বেশি বেশি খেতে হবে, দুশ্চিন্তা করা যাবে না।”

তিনি চলে যান। বেড়িয়ে যায় সকল দাসীও। যামিনী জড়িয়ে ধরে তার বাবু মশাইকে।

“কোথায় ছিলেন আপনি? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানেন? এখানে একদণ্ড শান্তি পাচ্ছি না আমি বাবু মশাই। ভালো লাগছে না আমার। আমার হৃদয় ডুবে যাচ্ছে অতল আঁধারে। দুশ্চিন্তা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমায়।”

যামিনীর কথায় যুবকের মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। বিনাশব্দে তার মাথায় কয়েকদফা হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যায়।

এক মুহূর্তের জন্য রমণীর মনে হয়েছিল তার সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই দিলরুবা প্রফুল্ল হৃদয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জানায়,
“বেগম, আপনার ভুল মার্জনা করেছেন জমিদার বাবু। আমরা এখনই অন্দরমহলে ফিরবো।”

স্বস্তির শ্বাস ফেলে যামিনী। এতোক্ষণে যেন উত্তপ্ত হৃদয় শীতলতা ফিরে পেলো।

কয়েক ঘণ্টা পূর্বের ঘটনা ভাবতে ভাবতেই মিটমিট হাসছে কিশোরী। তার খুব করে ইচ্ছে হচ্ছে তার বাবু মশাইয়ের কক্ষে যেয়ে তার বক্ষে মিশে নিদ্রায় ডুবে যেতে। তবে যাওয়া সম্ভব নয়, অসুস্থতার অভিনয় হতে যে পর্দা সরে যাবে।

___

শুক্রবার সকাল। বিরিয়ানি, গোশতো ভুনা, কোর্মা, কাবাব সহ নানা পদের খাবারের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে গোটা নবাববাড়ি। যোহরের সালাত সেড়ে যামিনী রন্ধনশালার দিকে যায়।

তার উদ্দেশ্য আজ নিজ হাতে রান্না করবে সে বাবু মশাইয়ের উদ্দেশ্যে। তার হাতের হাসের গোশতো ভুনা ও চিংড়ি মাছের দোপিয়াজা গ্রামে সবার প্রিয় ছিল।

তাকে দেখেই প্রধান পাচক ও অন্যান্য রাঁধুনিরা হাতের কাজ ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঝুঁকে সালাম জানায় তাকে।

প্রধান পাচক জিজ্ঞেস করে,
“আসসালামু আলাইকুম বেগম চন্দ্রমল্লিকা। কিছু প্রয়োজন হলে দাসীকে দিয়ে খবর পাঠাতেন। আপনার আসলেন ক্যানো?”

“না, না, আমার কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। বরং আমি কাজ করতে এসেছি। আমি আমার নিজ হস্তে বাবু মশাই মানে জমিদার নবাব মেহমাদ শাহের ও সকলের উদ্দেশ্যে দুটো পদ রান্না করতে চাই।”

“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন, বেগম। কিন্তু আমরা থাকতে আপনি ক্যানো…? আপনি বরং আমাদের বলুন কী রান্না করতে হবে, আমরা করে দিচ্ছি।”

“একদম না, আমি নিজ হাতে করবো। আর তোমরা আমাকে সহয়তা করবে। এটা বেগম চন্দ্রমল্লিকার আদেশ।”

কেউ আর বলার কিছু পায় না। কিশোরী নিজ হস্তে হৃদয়ের সকল ভালোবাসা নিংড়ে রান্না শেষ করে। বড়ো চুলোর তাপে ঘেমে-নেয়ে অস্থির সে।

প্রধান পাচক সুদীর্ঘ এক শ্বাস গ্রহণ করে। তার জিহ্বা লালায় ডুবে যায়।

“ঘ্রাণটা তো মনোরম বেগম! এখনই খেয়ে ফেলতে হৃদয় টানছে।”

“ধন্যবাদ, তোমরাও তো পাবে। তবে ভোজনশালায় সবাই এসে পড়েছে? তাহলে খাবার নিয়ে যাওয়া যাক।”

“যথা আজ্ঞা বেগম। সবাই এসে পড়েছে।”

ভোজনশালায় সকলে উপস্থিত, মেহমাদ শাহও। তার আঁখি দুটো কাতর হয়ে খুঁজছে পরিচিত মুখশ্রী, তবে তার আসার নাম নেই। অবশেষে যামিনীকে দেখতে পায় সে।

শাহাজাদি নূর বাহার মুখ বাঁকায় তাকে দেখে। মৃদু আঘাত করার উদ্দেশ্যেই শুধায়,

“এতো দেরি করে আসলে যে বেগম চন্দ্রমল্লিকা? নীতি ভুলে গিয়েছো না কি? যোহরের সালাতের পরপরই তো সকলকে উপস্থিত থাকতে হয় অন্দরমহলে।”

“দুঃখিত শাহাজাদি। আমি আসলে সালাত সমাপ্ত করে সকলের জন্য রান্না করতে গিয়েছিলাম। আপনাদের জন্য বিশেষ করে বাবু মশাইয়ের জন্য নিজ হাতে হাঁসের গোশতো ভুনা ও চিংড়ি মাছের দোপিয়াজা করেছি। আমি যতোদূর জানি, বিবাহের পর নববধূকে কিছু তৈরি করে আহার করানো লাগে শ্বশুরবাড়িকে, তারা খাবার পছন্দ হলে উপহার দেয়। এটাই তো নিয়ম।”

“খাওয়ার যোগ্য হয়েছে তো? আমি ওসব অখাদ্য মুখে তুলবো না।” রাশভারী কণ্ঠ বেগম নূর বাহারের।

“একবার খেয়ে তো দেখেন আম্মিজান।”

বলতে বলতেই এক চামচ তাঁর থালায় দিল যামিনী। এক এক করে দাদীজান, মেহনূর, মোর্শেদা খাতুন ও মেহমাদের থালে খাবার তুলে দিল সে। নিজেও খেতে বসলো।

ভয়ে ভয়ে একগ্রাস মুখে তুলেই বিচার-বিশ্লেষণ করে বিড়বিড়ালো,
“খারাপ হয়নি।”

সকলের দিকে চোখ বুলালো সে। সবাই একবার আহার করেই কেমন নিষ্পলক তাকিয়ে আছে।

মেহমাদ শাহই প্রথমে মুখে খুলে।
“অমায়িক হয়েছে খেতে! এমন হাসের গোশতো আর চিংড়ি মাছ আমি কখনোই খাইনি। তাই না দাদীজান?”

“হুম, ভালো হয়েছে।”
তাঁর কণ্ঠে তেমন আগ্রহ নেই।

মেহমাদ শাহ বলে উঠে,
“তোমাকে তো উপহার দেওয়ার কথা। বলো, কী উপহার চাই তোমার এই অসাধারণ স্বাদযুক্ত খাদ্য আহার করানোর বিনিময়ে?”

কিশোরী মুচকি হেসে বিনা দ্বিধায় উত্তর,
“আমি চাইবো ঠিকই, আপনি দিতে পারবেন কি না তা-ই কথা। বাবু মশাই আমাদের বিবাহের পর কতদিন পেড়িয়ে গিয়েছে। অথচ, আমাদের বিবাহের উদ্দেশ্যে কোনো অনুষ্ঠান বা আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করা হয়নি। আমি চাই সামনের রবিবার তা হোক, শেরপুর বাসী এবং নবাববাড়ির সকলে উপভোগ করুক আমাদের বিবাহের আনন্দ।”

মেহমাদ শাহ চাপা হাসে তার চন্দ্রমল্লিকার কথা শুনে। এক পলক বেগম লুৎফুন্নেসার দিকে দৃষ্টিপাত করে, তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

“অবশ্যই, আমি জমিদার নবাব মেহমাদ শাহ। আমি সবই করতে পারি। অবশ্যই তোমার চাওয়া পূরণ হবে। আম্মাজান, গোটা প্রাসাদ ও প্রাসাদের বাহিরে গ্রামবাসীদের মাঝে আমার বিবাহ উৎসবের সংবাদ প্রচার করুন।”

“ঠিক আছে, আমার শাহ। তুমি যা বলো তা-ই হবে।”

যামিনী তৃপ্তির হাসি দিয়ে খেতে শুরু করে। চিঠিতে থাকা বুদ্ধি তো বাস্তবায়ন করেছে সে, তবে পরিণামটাও চিঠি মোতাবেক হলেই হলো। অপরদিকে কয়েকজনের গলা দিয়ে এত মজাদার খাদ্যও যেন নামতে চাচ্ছে না।

___

যামিনীর বেশ হৃদস্পন্দন যেন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আর এক মুহূর্ত মেহমাদ শাহকে না দেখলে মারা যাবে সে। এতোটাই আকুলতা আজ ভর করেছে প্রিয়তমকে দেখার।

দেরি না করে দিলরুবা ও দাসীদের সহায়তায় নিজেকে সাজিয়ে নেয়। মেহমাদ শাহের উপহার করা সুদূর ফরাস থেকে আনা তীব্র ঘ্রাণজ সুগন্ধিটিও লাগিয়ে নিয়েছে।

আজ একাকিই বেগুনি রাজকীয় ওড়নাটি গায়ে জড়িয়ে মেহমাদ শাহের কামরার দিকে অগ্রসর হয়। পথিমধ্যে যুবককে কক্ষ ত্যাগ করে অন্যদিকে যেতে দেখতে পায়।

কিশোরী ডাক দিতে যেয়েও থেমে যায়। দ্রুতো হাঁটতে শুরু করে বটে, তাকে বাধাদান করতে।

তবে তা তো পারে না। বরং, মেহমাদ শাহের পিছন পিছন অজান্তেই অন্দরমহল হতে বেড়িয়ে প্রাসাদের অন্য অংশে প্রবেশ করে। দূর হতে দেখতে পায় মেহমাদ শাহ বহু প্রহরী ও কালো পোশাকধারী দেহরক্ষীদের দ্বারা আবৃত দ্বার খুলে গহীনে প্রবেশ করে।

যামিনী এগিয়ে যায় সেদিকে। দ্বারের কিছুটা কাছাকাছি যেতেই বাধা প্রদান করে প্রহরীরা।

“এমন ভুলের অর্থ কী? তুমি জানো আমি কে? বেগম চন্দ্রমল্লিকা আমি, জমিদার মেহমাদ শাহের স্ত্রী।”

“দুঃখিত বেগম। ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন। তবে এই দ্বার নবাব ব্যতীত সকলের জন্য বন্ধ।”

“আমাকে নিষেধ করলে তুমি? আমাকে?”

“চন্দ্রমল্লিকা! তুমি! তুমি এখানে কী করছো?”

পরিচিত কণ্ঠ শ্রবণগত হতেই কণ্ঠের উৎসের দিকে তাকায় যামিনী। সাদা উত্তরীয়ে আবৃত একজন নারী, শুধুমাত্র চোখজোড়া দৃশ্যমান। তবুও কিশোরী চিনতে ভুল করো না মোর্শেদা খাতুনকে।

“আসসালামু আলাইকুম, আম্মাজান। আমি তো বাবু মশাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলাম। কিন্তু প্রবেশই করতে পারছি না।”

“তাই বলে অন্দরমহলের বাহিরে চলে আসবে? জানো কেউ জানতে পারলে কী পরিমাণ ঝড় যাবে তোমার উপর দিয়ে? চলো, এখন আমার সঙ্গে।”

মোর্শেদা খাতুনের কথায় বোকা বনে যায় যামিনী। দ্রুতো আশেপাশে খেয়াল করে। বোধ হয়, এটা তার সুপরিচিত অন্দরমহল নয়।

“দুঃখিত” উচ্চারণ করে মোর্শেদা খাতুনের দিকে এগিয়ে যায় সে। তিনিও কিশোরীকে মৃদু বকার ছলে অন্দরমহলের দিকে এগিয়ে যায়।

হুট করেই রমণী জিজ্ঞেস করে,
“তবে আম্মাজান ঐটা কীসের দ্বার? সেখানে এতো সুরক্ষা ব্যবস্থাই বা ক্যানো? আর সকলের বন্ধই বা কেন?”

স্থির হয়ে গেলেন মোর্শেদা খাতুন। ভয়ার্ত দেখালো তাঁকে।

“নবাববাড়ির কিছু কিছু রহস্য চাপা ও দ্বার বন্ধই থাকে সদা, থাকবেও। তাদের দিকে হাত বাড়ানো তো দূরে থাক, তাদের কথা উল্লেখ করাও বর্জনীয়।”

নৈশব্দে দ্রুতো হাঁটতে শুরু করেন তিনি। যামিনীকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা হয়তো। তবে কিশোরী অনুধাবন করতে পারলো না এর কারণ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here