চন্দ্রপুকুর পর্ব -১৮

#চন্দ্রপুকুর
||১৮তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
যামিনীকে চিঠিটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে চমকিত হয় দিলরুবা। উদ্বিগ্নতার সহিত প্রশ্ন করে,

“কী হয়েছে বেগম? আপনাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে ক্যানো? কী আছে ঐ চিঠিতে?”

কিশোরী নির্বিকার চিত্তে চিঠিটি এগিয়ে দেয়। দিলরুবা চিঠি পড়ে দ্বিধান্বিত।

“বেগম চিঠিতে তো আপনাকে হতাশ করার মতো কোনো তথ্য নেই। আপনাকে সাহায্য করার জন্য খাঁস উপায় বলেছেন বটে চিঠিদাতা। তবে চিন্তার ভাঁজ কেন ললাটে?”

“সেটাই তো চিন্তার বিষয় দিলরুবা। এতদিনে এতো টুকু তো বোধগম্য হয়েছে এই নবাববাড়ি আস্ত একটা সাপ ভর্তি দ্বীপ। সেখানে আমাকে কেউ বিনা কারণে সাহায্য ক্যানোই বা করবে? তার নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে, যা অকাম্য।”

দিলরুবাও চিন্তিত হয়।
“তবে আমাদের যতো দ্রুতো সম্ভব জানতে হবে এই চিঠিদাতার পরিচয়। তবে তা কী করে করবো সেটাই ভাববার বিষয় বেগম।”

“উহু, বর্তমানে এখান থেকে কী করে বের হওয়া যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।”

বলতে বলতেই রমণীর চোখ যেয়ে পড়ে বৃষ্টিস্নাত পিচ্ছিল সম্মুখের পথটিতে। বাঁকা হাসি ফুটে উঠে মুখশ্রীতে।

___

বেগম লুৎফুন্নেসার কক্ষে বসে আছে মেহমাদ শাহ। তিনি সালাত আদায়ে ব্যস্ত। সালাম ফিরাতেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন পৌত্রের দিকে।

“আমার সিংহ, তুমি এখানে? আজ আবার এই বৃদ্ধা, কুৎসিত দাদীজানের কথা মনে পড়লো কীভাবে?”

জায়নামাজ ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ান দাদীজান। যুবক মৃদু হাসে।

“নবাবের প্রিয় নারী, যার রূপের জৌলুসে সবাই জ্বলতে তাকে এসব কথা মানায় না দাদীজান। আপনার রূপ আমার প্রাসাদের নূর।”

“যাও তো ছেলে আর খোশামুদি করতে হবে না। কী বলতে এসেছো তা শোনাও।”

“আপনি জ্ঞাত দাদীজান আমি কী বলতে এসেছি। এভাবে আর কতো দিন চলবে? কতো দিন গোট্য ধরনীর হতে আড়াল করবো এই নবাব বংশের রহস্য?”

ফোঁস করে এক শ্বাস ফেলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। আপন মনেই কী যেন বিড়বিড়ান। যা শ্রবণগোচর হয় না মেহমাদ শাহের।

“প্রতিবারের মতো এবারও নীরব আপনি। ঠিক আছে, থাকুন! তবে মনে রাখবেন দাদীজান, আল্লাহ ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না। সূর্য একদিন আপন আলোয় উদিত হয়ে সবটা জানিয়ে দিবেই লোকসমাজে। কতো দিন আড়াল করা যাবে?”

“তা যাতে না হয় কখনো সেটা দেখার দায়িত্বই তোমার, এজন্যই তোমায় নবাবের সিংহাসনে বসানো হয়েছে। আর যা হয়েছে, হচ্ছে তা সকলে অগ্রগতি ও মঙ্গলের জন্যই। নিজের মস্তিষ্ক ও হৃদয় থেকে এসন অহেতুক চিন্তা বহিষ্কার করো এবং প্রাপ্ত মর্যাদা রক্ষা ও দায়িত্ব পালনে মনযোগ দাও।”

“আমার ওয়াদা দাদীজান, আমার তরফ হতে এতো টুকুও কমতি পাবেন না কার্য সম্পাদনে। তবে যা হওয়ার একদিন না একদিন হবেই।”

“সেই দিন কোনো দিন না দেখাক আল্লাহ।”

“আমিন। যাকগে সেসব আপনারা শহরে যাকে গদিতে বসিয়েছেন সে আজকাল একটু বেশিই নাক গলাচ্ছে শেরপুরের জমিদারি ও কাজকারবার নিয়ে। এটা নিঃসন্দেহে আমার পছন্দনীয় নয়। আমি বাধ্য হচ্ছি ব্যবস্থা নিতে। এতো টুকুই জানাতে চাই আপনাকে।”

কথা টুকু সমাপ্ত করেই হনহন করে বেড়িয়ে গেল সে। বেগম লুৎফুন্নেসাকে ভীষণ চিন্তিত দেখালো।

___

মেহনূর হৃদয় নাচছে যামিনীর পরাজয়ে। তীব্র আনন্দে সে নৃত্য করতে শুরু করলো। রত্নাও বেশ আনন্দিত তাকে প্রফুল্ল দেখে।

“রত্না, আজ আমি বেজায় খুশি। পাচককে (রাঁধুনি) যেয়ে বলো ক্ষীর আর আমের শরবত করতে। আমার তরফ থেকে গোটা অন্দরমহলে বিলিয়ে দেও।”

“যথা আজ্ঞা বেগম।”

ক্ষীর ও আমের শরবত তৈরি হলে অন্দরমহলে দাসী ও খাদিমদের মাঝে মেহনূর ও রত্না নিজে উপস্থিত থেকে বিলিয়ে দেয়।

“আজ আমি বেশ আনন্দিত মেয়েরা। কেউ তার যোগ্য অবস্থানে পৌঁছয়েছে। আমার আনন্দ তোমাদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছি। উপভোগ করো ভোজন।”

সবার মাঝে কানাঘুষা শুরু হয়ে যায় শাহাজাদি মেহনূরের বচনে। কারণ সবাই খুব ভালো ভাবেই জ্ঞান যামিনীর দিকে ইশারা করেছে সে। সাথে শাহাজাদির উদারতা নিয়েও বলাবলি করছে সকলে।

ঠিক সেই মুহূর্তে অন্দরমহলে দিলরুবার হাতে ভর দিয়ে প্রবেশ করে যামিনী। তার পরনে কালো উত্তরীয়, মুখশ্রী দৃশ্যমান শুধু। কিছুটা ক্লান্ত দেখালেও সতেজ হাসি ঠোঁটে লেগে আছে।

যুবতী ভ্রু কুঞ্চিত হয় তাকে দেখে।
“তুমি এখানে কী করো? তোমার শাস্তির সময়কাল তো এখনও সম্পন্ন হয়নি। সাহস কী করে হয় শাস্তি অমান্য করার!”

যামিনী উত্তর না দিয়ে তার সাথে আসা খাদিমের দিকে তাকায়। তড়িৎগতিতে মুখে খুলে সে,

“জমিদার নবাব মেহমাদ শাহ বেগমের ভুল মার্জনা করেছেন। মুক্তো করেছেন তাঁকে।”

শাহাজাদি তেজস্বী মুখশ্রী পাণ্ডুর হয়ে উঠে। কিশোরী দিলরুবার হাত ছেড়ে নৈশব্দে অত্যন্ত ধীর পদচারণায় কাছাকাছি যেয়ে দাঁড়ায় তার।

ফিসফিস করে বলে,
“আমাকে আটকে রাখা এতো সহজসাধ্য নয়। আমি ঐ সৈনিক নয় যে ব্যর্থতার স্বাদ নিয়ে পরাজিত হয়, আমি ঐ সৈনিক যে ব্যর্থতার স্বাদ নিতে নিতে জয়ের সিঁড়ি চড়ে। আমার ঢাল কোনো বংশ বা মর্যাদা বা পদবী নয়। আমি ভালোবাসার আশ্রয়ে বাঁচি, আমার শক্তি ভালোবাসা, মর্যাদাও। আর ভালোবাসার কোনো দিন মৃত্যু হয় না, তাই আমার শক্তিও কোনো দিন শূন্য হবে না।”

শাহাজাদি মেহনূর রাগে, দুঃখে, হতাশায় কোনো কিছু উচ্চারণই করতে পারে না। বড়ো বড়ো পা ফেলে স্থান ত্যাগ করে দ্রুতো।

কক্ষে পৌঁছেই আয়নার দিকে পানপাত্রটি ছুঁড়ে ফেলে। ভেঙে চৌচির আয়না।

“শাহাজাদি মেহনূর, আপনি শান্ত হন। আঘাত লেগে যাবে আপনার।”

“কীভাবে শান্ত হবো আমি রত্না? কীভাবে? ঐ মেয়ের মুখশ্রী বারবার মনে করিয়ে দেয় আমার পরাজয়।”

“শাহাজাদি, বেগম লুৎফুন্নেসার কথা মনে করুন। তিনি বলেছিলেন এই যুদ্ধ করতে হয় শীতল মস্তিষ্কে। ক্রোধ নিয়ে নামলে টিকা যায় না। সামনে এমন অনেক উপায় আসবে। জমিদার বাবু সর্বদা শেরপুরে থাকবেন না বেগমকে রক্ষা করতে।”

রত্নার বাণী ঔষধির ন্যায় কাজ করে। রাগের অগ্নি নিবে চতুরতার দ্বার খুলে। নতুন পরিকল্পনা করার ভাবনায় ডুবে সে।

___

যামিনী কক্ষে বসে আয়েশ করে বসে কচি মুরগির গোশতো খাচ্ছে। এই স্বল্প সময়ে শাস্তির তৈল ও মশলা হীন সিদ্ধ সবজি খেয়ে অতৃপ্ত হয়ে উঠেছিল সে।

মেহমাদ শাহের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর থেকে গোশতো তার প্রতিদিনের খাদ্য। পূর্বে তো দাস বাবু প্রতি রবিবার পরিবার সমেত গোশতো আহার করলেও তার ভাগে হাড্ডি বাদে কিছুই জুটতো না।

অতিরিক্ত দ্রুতো খেতে যেয়ে গাল-মুখে ভোজন লেপ্টে যাচ্ছে যামিনীর। তাও সেদিকে ধ্যান নেই। গলায় খাবার আটকে গেলেই হুশ হয় তার। দিলরুবা পানি পান করায়।

“শান্ত হয়ে আহার করুন, বেগম চন্দ্রমল্লিকা। কেউ আপনার ভোজন তুলে নিয়ে যাবে না।”

লজ্জিত হয় কিশোরী। এবার বেশ ধীরে-সুস্থে খেতে শুরু করে।

“আচ্ছা, জেনেছো কেন সবাইকে ক্ষীর খাওয়াচ্ছে শাহাজাদি মেহনূর?”

“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম। আপনার শাস্তি পাওয়া উপলক্ষে ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন শাহাজাদি।”

খাবারের চামচ রেখে দেয় যামিনী। বিক্ষুব্ধ হয়।

“দুষ্টু আত্মা! অন্যের মন্দ হতে দেখতে ভালো লাগে, তাই না? আমাকে ফিরে আসতে দেখে নিশ্চয়ই সব আনন্দ ঘুচে গিয়েছে শাহাজাদির।”

মনে মনে ভাবতে শুরু করে রমণী তার মুক্তি পাওয়ার পরিকল্পনার সফলতা নিয়ে। মুহূর্তের মাঝেই ক্রোধের অন্তরালে কুটিল হাসি দেখা দেয়।

___

আঁধার নেমেছে ধরনীর বুকে। তবুও ব্যস্ত এই নগরীতে অনেকের চোখেই তন্দ্রা নামার নাম নেই। তেমনই একজন মানব বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়ির নেশায় মত্ত। তীব্র আক্রোশ নিয়ে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে।

আপন ভাবনাতে বিভোর হয়ে বিড়বিড়ান তিনি,
“পুরুষের হাতে যার জন্ম, নারীর হাতেই তার ধ্বংস হবে। এক হৃদস্পন্দনে সবটা ধ্বংস হবে, টেরও পাবে না গোটা শেরপুর। তবে দর্শক ও সাক্ষী হবে সকলে। ইনশাআল্লাহ!”

চলবে…
(৭০০+ রিয়েক্ট কমপ্লিট হলে পরবর্তী পর্ব আসবে 🐸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here