চন্দ্রপুকুর পর্ব -১৭

#চন্দ্রপুকুর
||১৭তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
অপেক্ষায় ইতি টেনে প্রবেশ করে মেহমাদ শাহ। উঠে দাঁড়িয়ে স্বাগতম জানায় সকলে। বসতে ইশারা করে আসন গ্রহণ করে সে।

“কী হয়েছে দাদীজান? কী কারণে এতো তাড়া যে আমার বৈঠল খতম করারও অপেক্ষা করতে পারলেন না?”

“আমার শাহ, এসেছো যখন জানতেই পারবে। শান্ত হয়ে বসো। আয়েশা খাতুন!”

আয়েশা খাতুনকে ইশারা করতেই সে আড়াল থেকে টেনে এনে হাজির করে দাসীটিকে। যুবকের ললাটে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে।

“চন্দ্রমল্লিকা, এই দাসীকে এভাবে আঘাত করেছে। কতো বড়ো স্পর্ধা!”

“যামিনী এই অন্যায় কার্য সম্পন্ন করেছে তার প্রমাণ কী?”

“অন্দরমহলের প্রায় সকল খাদিম ও দাসীরা এই মেয়েকে আহত অবস্থায় খাঁস বাঁদী দিলরুবার সাথে চন্দ্রমল্লিকার কামরা হতে বের হতে দেখেছে। আর কোনো প্রমাণ চাই আমার সিংহ?”

যামিনী এতোক্ষণ নিঃশ্চুপ ছিল। এবার না পারতেই মুখ খুলে সে।

“আঘাত করেছি তা বলেছে এই কন্যা। ক্যানো করেছি তা বলেনি? এই দাসী আমার উপর নজর রাখছিল, গোয়েন্দাগিরি করছিল। আমি হাতেনাতে ধরেছি তাকে আমার চিঠির বাক্স করার মুহূর্তে।”

“এ জন্য তুমি তাকে আঘাত করবে? এই অন্দরমহলের একটা নিয়মনীতি আছে। সব কিছু সেই নিয়ম অনুসরণ করেই হয়। আমি যে এই অন্দরমহলের কর্তা আছি , তা কি ভুলে বসেছো তুমি? তুমি আমাকে অভিযোগ না করে নিজে বিচারকার্য সম্পাদনে হাত দিয়েছো! এর শাস্তি তুমি জানো?”

“যে নিজেই প্রধান অপরাধী, তাকে কী বলবো? দাসীটি তো আপনারই নাম উচ্চারণ করেছে। আপনিই তো দোষী দাদীজান!”

“আমার দিকে আঙুল তুলছো! এতো দুঃসাহসিকতা! এতো বড়ো বেয়াদবী! নতুন গজানো পাখা দিয়ে এতো উপরে উড়তে হয় না, মুখ থুবড়ে পড়ে নাহয় পক্ষী!

তোমারও সেই দশা হবে। শাস্তি তুমি পাবে, নাহলে তোমায় দেখে সাহস পাবে অন্যান্য কন্যারাও। আগামী এক মাসের জন্য জঙ্গলের উত্তরের অন্ধকার দালানের বন্দী থাকবে তুমি!”

“না, এ আপনি পারেন না।”

“আমি বেগম লুৎফুন্নেসা। অন্দরমহলে আমার রাজত্ব চলে, সব পারবো আমি। খাদিম চন্দ্রমল্লিকাকে বন্দী করো এই মুহূর্ত!”

দু’জন খাদিম এগিয়ে গেলে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহমাদ শাহ।

“থামো সেখানেই! কোথাও যাবে না চন্দ্রমল্লিকা!”

“যাবে না অর্থ কী? তুমি আমার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছো? নিয়মনীতির বিরোধিতা করছো? আজকে যদি চন্দ্রমল্লিকার তার শাস্তি হতে মুক্তি পায়, তবে অন্দরমহলে অবস্থিত কন্যাদেরও সে প্রশ্রয়দান করা হবে।”

মেহমাদ শাহ তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেগম লুৎফুন্নেসার দিকে।

“আপনিও তো রীতি বিরোধী কাজ করেছেন দাদীজান। নবাববাড়ির সদস্যের বিচারকার্য গোপনীয়তার সহিত সম্পূর্ণ করা হয়, যতোক্ষণ না তা কোনো অতি ঘৃণ্য অপরাধ না হয়। সেখানে আপনি বৈঠক খানায় বিচার বসিয়েছেন। আর আইন মোতাবেক শাস্তি চন্দ্রমল্লিকা পাবে, তবে দাসীদের জন্য প্রযোজ্য শাস্তি নয়। আমি নবাব মেহমাদ শাহ এই অন্দরমহলে সমেহ গোটা শেরপুরের নবাব দিব শাস্তি, অন্যকেউ নয়।”

রক্ত লাল চক্ষু নিয়ে যামিনীর হাত আঁকড়ে ধরে নিজের কক্ষের দিকে চলতে শুরু করে। কক্ষের প্রবেশ করে ছুঁড়ে ফেলে তাকে শয্যায়।

কোঁকিয়ে উঠে কিশোরী। ভীতিগ্রস্ত চাহনি তার।

“তোমার মস্তিষ্কে কী চলছে যামিনী? সামান্য ক্ষমতা পেয়ে আদব-কায়দা সব ভুলে বসেছো? গতকাল আমার সাথেও তুমি তর্ক করেছো, আমি বাচ্চামো ভেবেছি। মেনে নিয়েছি ভালোবাসি বলে। তাই বলে কি এই অন্দরমহলের সবাই তোমার ভুল ক্ষমা করবে? কী হলো কথা বলছো না ক্যানো?”

ঝরঝর করে আঁখিজল মুক্ত করে দেয় যামিনী। আকুতি করে শুধায়,
“আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম বাবু মশাই হুট-হাট গুপ্তচর দেখে। ঠিক-বেঠিক জ্ঞান শূন্য হয়ে আঘাত করে ফেলি। কী করতাম আমি তবে আপনি বলেন? আপনাকে বিবাহ করে আসার পর থেকে এমন সব কিছুর সম্মুখীন হচ্ছি, যা আমার ছোট্ট মস্তিষ্ক ঠিক ভাবে ধারণও করতে পারে না।”

যুবক শান্ত হয় কিছুটা।
“দেখো কিশোরী, তুমি আমাকে বিষয়টা খুলে বলতে পারতে। দাসীকে আটক করে রাখতে পারতে। আঘাত করার প্রয়োজন ছিল না। ক্ষমতাকে নিজের বুদ্ধির উপর আচ্ছন্ন হতে দিয়ো না। তুমি চাইতে বা না চাইতেও আমার জটিল পৃথিবীতে জড়িয়ে গিয়েছো।

মানিয়ে তোমায় চলতে হবেই। আর আমি তোমার মামার মতো কোনো চাষী বা সাধারণ পুরুষ নয়। অনেক কিছু সামলাতে হয় আমার, তোমার জন্য প্রতিদিন অন্দরমহলের আসরে সময় দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ এই ভুল যেন আর না হয়।”

রমণী সায় জানিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মেহমাদ শাহ ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে। এই নারীর অশ্রুপাত তার সহন সীমার বাহিরেই থাকে।

অধরজোড়া চিবুকে ছোঁয়ায়, ছোঁয়ায় নেন যুগলে। কানের কাছে যেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আসা অবধি আমার কক্ষেই থেকো।”

___

যামিনীকে শাস্তিস্বরূপ সাত দিন তথা এক সপ্তাহ নবাববাড়ির বাগানের অপর প্রান্তে তৈরি এক কামরার ঘরে নজরবন্দী থাকতে হবে তাকে। উক্ত ঘটনাটি থেকে সে বেশ বিচলিত। বুঝতে পারছে না কীভাবে পরিস্থিতি পুনরায় নিজের পক্ষে ঘুরাবে।

দুঃশ্চিন্তা বশত আজ মাথা ব্যথায় কাতর কিশোরী। দিলরুবা লেবু চা করে এনেছে। মাথায় দিয়ে দিচ্ছে নারিকেল তেল। চা পান করতে করতে গভীর ভাবনায় ডুব দিয়েছে যামিনী।

“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, আপনি চিন্তা করে নিজেকে আর অসুস্থ করবেন। আল্লাহ পরম করুণাময়, নিশ্চয়ই আপনার জন্য ভালো কিছুই রেখেছে। ঐ শয়তানগুলো আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।”

“আমিন দিলরুবা। তবে সেই ঘটনায় আমিও সমান দোষী। না ভেবেই ক্রোধের বশীভূত হয়ে অপকর্ম করে তাদের সুযোগ দিয়েছি। তবে বাবু মশাই এবং অন্দরমহলের খাদিম, দাসী ও অন্যান্য সদস্যরা আমার প্রতি অনেক অসন্তুষ্ট। তাদের নিজের পক্ষে কী করে আনবো সেই চিন্তাই করছি।”

ঠিক তখনই একজন দাসী প্রবেশ করে। অন্যান্য সময় অনুমতি ব্যাতীত কামরায় ঢুকায় যামিনী ক্রুব্ধ হলেও আজ শান্ত সে।

দাসী জানায়,
“আপনার নামের চিঠি পড়েছিল মেঝেতে।”

একই ঘটনা পুনরায় হতে দেখে একটু অবাক হয় রমণী। চিঠিটি হাতে নিয়ে পড়তেই ভ্রু সামান্য পরিমাণ কুঞ্চিত হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here