চন্দ্রপুকুর পর্ব -২০

#চন্দ্রপুকুর
||২০তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
রংধনু উঠেছে আকাশে। বিরাট আয়োজন তাদের বিবাহের। বাগানের মাঝ বরাবর চলছে সঙ্গীত, নৃত্য প্রদর্শন ও আনন্দ উদযাপন ভোর হতেই।

হলদে শাড়ি পরিধানে যামিনীর। সবাই হলুদ ছোঁয়াবে তাকে, দোয়া করবে তার উদ্দেশ্যে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেগম নূর বাহার এবং শাহাজাদি মেহনূরও উপস্থিত হয়।

যামিনী তাদের দেখেই আসন ত্যাগ করে এগিয়ে যায়। নত দৃষ্টিতে চাপা হাসির সহিত বলে,
“আসসালামু আলাইকুম আম্মিজান ও দাদীজান। আমি প্রচুর আনন্দিত আপনারা এসেছেন বলে। আপনাদের চরণ ফেলে আমার বিবাহের আনন্দকে আরও চারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমাকে দোয়া করুন সুখী দাম্পত্যজীবন কাটাতে পারি যেন। বাবু মশাইকে যেন সুখী করতে পারি।”

বেগম লুৎফুন্নেসার মুখশ্রীতে চাপা হাসি।
“আমিন। আল্লাহ তোমাদের খুব দ্রুতো সন্তানের পিতা-মাতা করুক।”

তাঁর ইশারা পেয়ে আসন গ্রহণ করে কিশোরী। বেগম লুৎফুন্নেসা ও তারপর বেগম নূর বাহার হলুদ ছুঁয়িয়ে দিলে। একে সকলে হলুদ ছুঁয়িয়ে প্রাণ ভরে দোয়া করে তাকে।

সবাই যে যার মতো নৃত্য করছে, অংশগ্রহণ করছে অনুষ্ঠানে। দিলরুবা সহ অন্যান্য দাসীদের জোরাজুরিতে যামিনীও নৃত্য করে তাদের সাথে। উৎসবে নতুন এক সুর আসে যেন।

মেহমাদ শাহ প্রাসাদের সম্মুখের ভাগে হলুদ উৎসব সমাপ্ত করে নিজের কক্ষে ফিরেছে। তার দেহ হলুদে ভর্তি এখনও। অবচেতন হৃদয়েই করে যেন জানালার বাহিরে উঁকি দেয় সে।

তার মস্তিষ্ক অসার হয়ে পড়ে প্রিয় রমণীর লাস্যময়ী রূপ দেখে। আজকের জন্য অন্দরমহলে প্রহরী সহ সকল পুরুষের প্রবেশ নিষেধ, অন্দরমহলে প্রবেশের সকল দ্বারে পাহারারত সকল প্রহরী ও দেহরক্ষী। যামিনী তাই আজ পোশাকের খেয়াল আর রাখছে না।

ভেজা এলো কেশ, মুখমণ্ডলে জৌলুস আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের, অর্ধভেজা মিহি বস্ত্রের উত্তরীয় আরও কামনীয় করে তুলেছে তার চন্দ্রমল্লিকাকে। যুবক যেন ভালোবাসা, কামনা, প্রেমের জোয়ারে ডুবে যাচ্ছে।

অধরোষ্ঠ কামড়ে হেসে সে বিড়বিড়ায়,
“মাত্র কয়েকদিন তুমি আমার নিকটে আসোনি। অথচ, আমার হৃদয়ে কতো দিন ধরর শূন্যতা তোমার মুখ থেকে প্রেমময় বাণী, প্রেম নিবেদন না শ্রবণ করতে পারার। রাত্রির নিদ্রা আড়াল হয়েছে আমার চক্ষু হতে, যখন থেকে তুমি আড়াল হয়েছো আমার বক্ষ। আজ তোমায় আপন করে নিব, মিশে যাবো তোমাতে পুনরায় চন্দ্রমল্লিকা। আমার প্রিয় বাচ্চা হরিণী! ভালো…”

নিজেই হেসে ফেলে যুবক। হুট করে নিজেকে তার মহাবিদ্যালয়ে (কলেজ) অধ্যায়নরত কোনো কিশোর মনে হলো যেন। যে প্রতি মুহূর্ত পরাজিত হয় নিজের অনুভূতির নিকটই।

___

যামিনীকে তৈরি হয়েছে রুবি পাথরের ন্যায় অপরূপ লাল রঙের সোনালী সুতো ও দামী পাথরে সাজানো পোশাক। বিশাল লাল হিজাব ও নিকাবে ঢেকে যায় মুখশ্রী। গায়ে জড়ানো হয় বেগুনি রাজকীয় ওড়নাটি। দু’হাতে পরানো হয় রতনচূড় ও বালা।

তাকে মোর্শেদা খাতুনের দ্বারা নিয়ে যাওয়া হয় মূল মহলের বৈঠক ঘরে। যামিনীর চরণ বৈঠক ঘরের দ্বারে পড়তেই দাঁড়িয়ে যায় উপস্থিত সকলে, দৃষ্টি নত। নিকাবের আড়াল হতে অবাক হয়ে দেখে রমণী। ঐ যে নিজ গ্রামের ভট্টাচার্য বাবু, হাসান চাচা সহ পাশের গ্রামের ধনী ব্যক্তি ঠাকুর বাবু। কোনো দিন হাসি মুখে দুটো কথা যারা বলেনি, তুচ্ছজ্ঞান করেছে সদা, তারাই আজ তার সম্মুখে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে। অন্যরকম এক আনন্দ ও তৃপ্তি পায় সে। ইচ্ছে হয় তার মামা ও মামীর একবার দর্শন পেতে এই মুহূর্তে। দেখে জ্বলুক না তাঁরা, ক্ষতি কী?

নিজের হৃদয়েই অবাঞ্ছিত ভাবনাগুলো জলাঞ্জলি দিয়ে আশেপাশে তাকায়। পুরুষই উপস্থিত সবাই। বেগম লুৎফুন্নেসা, বেগম নূর বাহার ও শাহাজাদি মেহমূর পর্দার আড়ালে।

কিশোরী মোর্শেদা খাতুনের ইশারায় এগিয়ে যায় তার প্রিয়তমের সিংহাসনের দিকে। মেহমাদ শাহ উঠে এগিয়ে যেয়ে হাত এগিয়ে দেয়। যামিনী তার দিকে তাকিয়ে নিকাবের আড়ালে হেসে হাত ধরে তার সাথে সিংহাসনে বসে।

মেহমাদ শাহের অধর হতে আজ হাসি যেন হারাচ্ছেই না। অত্যন্ত প্রফুল্ল দেখাচ্ছে তাকে।

সে ঘোষণা করে সকলের সম্মুখে,
“আমি জমিদার নবাব আলিউল শাহের একমাত্র পুত্র জমিদার নবাব মেহমাদ শাহ আজ ঘোষণা করছি আমার স্ত্রী এবং এই শেরপুরের বেগম হলো চন্দ্রমল্লিকা। আমাকে যতোটা সম্মান করেছেন সকলেই, ততোটাই ভালোবাসা ও স্নেহ পাবে বেগম চন্দ্রমল্লিকা, এটা আমাদের নিকট কাম্য। আমাদের সংসার যাতে স্থায়ী হয় এবং সুখ ও আনন্দে কাটে এর জন্য সকলকে প্রার্থনা করার অনুরোধ।”

সকল একই সুরে “আমিন” উচ্চারণ করে।

অতঃপর বেগম লুৎফুন্নেসা পর্দা হতে বাহিরে আসেন। তাঁর ইশারায় মোর্শেদা খাতুন একটি প্রাচীন সিন্দুক নিয়ে আসেন।

দাদীজান তা খুলে বহু মূল্যবান রুবি পাথর, হিরা ও পান্নায় সজ্জিত মুকুট। নিজ হাতে যামিনীকে পরিয়ে দেন তিনি।

“আমাদের মহৎ বংশ ও তার মান রক্ষার রক্ষার এবং তাকে বিস্তার দায়িত্ব তোমার মাথায় তুলে দিচ্ছি। আশা করি কখনও তোমায় আমার সম্মুখে লজ্জিত মুখ নিয়ে দাঁড়াতে হবে না।”

মোর্শেদা খাতুনও কানে কানে কিছু একটা ফিসফিস করে বলেন।

“আমিন দাদীজান। আমি এখানে উপস্থিত সকলকে সাক্ষী রেখে শপথ গ্রহণ করছি সবার প্রথমে আমার নিকট গুরুত্ব পাবে এই বংশ। এর মান, মর্যাদা রক্ষার্থে ও বিস্তার করতে আমি সকল কিছু করতে প্রস্তুত থাকবো সদা। নিজের শ্রম, প্রাণ সবকিছু দিয়ে হলেও রক্ষা করবো। আল্লাহ আমায় আমার শপথ পালনের তৌফিক দান করুক। আমিন।”

যামিনীর শপথ গ্রহণের পর শুরু হয় উৎসব। কালোজাম সহ বিভিন্ন পদেত মিষ্টি, দই, শরবত, কী নেই এই উৎসবে! গাইছে বেশ ক’জন পুরুষ, বাজানো হচ্ছে দফ, খঞ্জনী।

কিশোরী ও তার বাবু মশাই উভয়ের নয়নযুগলেই উল্লাস উপচে পড়ছে। তবে তাদের এক হতে দর্শন করে হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। অথচ, পরে থাকতে হচ্ছে প্রফুল্লতার মুখোশ।

___

যামিনীকে বসিয়ে রাখা হয়েছে মেহমাদ শাহের শয্যায়। প্রথমবার বিবাহের সময় তার সজ্জায় তেমন কিছুই ছিলও না। আজও তেমনই, তবে মহা মূল্যবান মুকুটটি তার মাথাতেই এঁটে আছে। একটু বাদেই দরজা খুলে প্রবেশ করেন মোর্শেদা খাতুন। পিছন পিছন দিলরুবা এবং শাহাজাদি মেহনূরও আসে।

মোর্শেদা খাতুন তাকে দাঁড়াতে ইশারা করে। হিজাব ও নিকাব খুলে নাকে নোলক, দু’কানে কানবালা, গলায় কণ্ঠহার ও সাত নোলি হার, দু’হাতে রতনচূড় ও বালার সাথে শোভা পায় দু’মুঠো সরু স্বর্ণের চুড়ি। মাথায় তাজের শোভা বাড়ায় সিঁথিপাটি।

“নিজেকে দেখে নেও চন্দ্রমল্লিকা আয়নাতে। কোনো ঘাটতি বোধ হচ্ছে কি না।”

কিশোরী দর্পণের সম্মুখে দাঁড়ায়। অবাক নয়নে তাকিয়েই থাকে। নিজেকে কোনো শিল্পীর হাতে তৈরি পৌরাণিক রাণীর মূর্তি লাগছে তার নিকট। গহনাগাঁটি দর্শন করেই সে বুঝতে পারছে, এ অলংকার নবাব বংশের বংশপরম্পরায় পাওয়া পৌরাণিক অলংকার।

“খুব সুন্দর লাগছে আম্মাজান। কী অপরূপ ভাবে সাজিয়েছেন আমার ন্যায় কৃষ্ণকলিকে।”

“ধন্যবাদ, চন্দ্রমল্লিকা। শাহাজাদি মেহনূর আপনি ঐ আঙটির বাক্সটি দিন বেগমকে। আমার শাহের আসার সময় হলো। চন্দ্রমল্লিকা এই আঙটি তুমি শাহের অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিবে। বংশের নিয়ম বংশের কুমারী কন্যার আঙটিটি বাসরঘরে নববধূকে দেয়, নববধূ সেটা এই আনন্দের রাত্রিতে ভালোবেসে নিজের স্বামীকে পরায়।”

“আরে মোর্শেদা খাতুন, এতো তাড়া কীসের? আসুক না আমাদের শাহ, ক্ষতি কী? আমরা বসি, একটু গল্প-গুজব করি।”

“যথা আজ্ঞা শাহাজাদি। আমি চললাম, ওদিকে দেখতে হবে।”
বিদায় নেন তিনি।

যামিনী নিজেকে আয়নায় দেখছে বারবার। শাহাজাদির দিকে তার ধ্যান নেই।

“তোমাকে চন্দ্রমল্লিকা নামটি শাহের দেওয়া, তাই না? শাহ খুব সুন্দর সুন্দর নাম দেয় ভালোবাসে। আনন্দের বিষয় শুধু আমরাই এই সৌভাগ্যের অধিকারী। আমাকেও তো দিয়েছেন নাম ভালোবেসে চন্দ্রপ্রভা তোমার পূর্বে। শাহের প্রিয় ফুলের নাম।”

রমণীর আনন্দ ঘুচে যায়। মলিন হয় মুখশ্রী। হৃদয় বিষিয়ে যায়। চোখে চোখ রাখে অপ্রিয় নারীটির। শাহাজাদি মেহনূর বাঁকা হাসি দিয়ে বেড়িয়ে যায়। সে তার উদ্দেশ্যে সফল।

মেহমাদ শাহ প্রবেশ করে কক্ষে। যামিনী থেকে অশ্রুতে টইটম্বুর নয়নযুগল নিয়ে দর্পনের সম্মুখে নির্জীব হয়ে দাঁড়িয়ে।

যুবক সেদিকে খেয়াল না করেই বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় তার প্রেয়সীকে। ঘাড়ে মুখ গুঁজে সুদীর্ঘ চুম্বন করে।

“আমি আমার বাচ্চা হরিণীটার জন্য কতোটা তড়পাচ্ছিলাম চন্দ্রমল্লিকা তা ভাষায় প্রকাশ করার মতোন না। আমাকে এই কোন নেশায় আসক্ত করলে তুমি মেয়ে? একটা মুহূর্ত তুমি হীনা থাকলে তা বিভীষিকাময় হয়ে উঠে।”

যামিনীর ক্রোধ, অভিমান ও বেদনা সম্পূর্ণ রূপে ভাটা পড়ে যায় প্রিয়তমের প্রেমময় আত্মসমর্পণে। যতোই থাকুক জটিল পরিস্থিতি ও পরিবেশের মাঝে, সে তো কিশোরীই। কিশোরচিত্তই তার সকল কিশোরীর ন্যায়, যারা অনুভূতিতে বাঁচে, অনুভবে জোয়ারে ভাসে।

মেহমাদের দিকে ঘুরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। মেহমাদ শাহের পরনের উত্তরীয়ের বোতাম আঙুলে খুঁটতে খুঁটতে শুধায়,
“কখনও ছেড়ে যাওয়া তো দূরে থাক অন্য কারো নামও মুখে আনবেন না দয়া করে বাবু মশাই। আমার শ্বাস চললেও আমি সেই মুহূর্তে মৃত হয়ে যাব, আমার রুহু মুক্তি চাইতে ছটফট করবে এই দেহ হতে।”

জমিদারের অধরজোড়া কৃষ্ণাভ ললাটে ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে দেয়। আরও নিবিড়ভাবে নিজের মাঝে লুকিয়ে নেয় তাকে। যেন পৃথিবী হতে নিজের হৃদয়ের মাঝে বদ্ধ করে নিলেই শান্তি।

“কখনো না, চন্দ্রমল্লিকা। কখনো না। আমি যদি যোদ্ধা হই, তুমি আমার অস্ত্র ও শক্তি। আমি আশাহত এক ভবঘুরে যুবক, তুমি আমার আশার আলো চন্দ্রমল্লিকা। তোমার মাঝে বেঁচে থাকায় ভালো থাকার স্বাদ পাই। তুমি হীনা বিষাক্ত আমার জন্য এই প্রাসাদ, এই ক্ষমতা, প্রাচুর্য, সম্পদ সকল কিছু। ভালোবাসি আমার বাচ্চা বাঘিনী, গভীর ভাবে তোমার প্রতি আসক্ত আমি।”

দু’জন গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বেশ কয়েকমুহূর্ত একে অপরের দিকে। আর একটা শব্দও উচ্চারণ না করে মেহমাদ শাহ যামিনীকে কোলে তুলে অগ্রসর হয় ফুলে সজ্জিত শয্যার দিকে। সম্মুখে আরেকটি সুখময় রাত্রি অপেক্ষারত তাদের উদ্দেশ্যে। তবে আগামী দিনটা যদি বিভীষিকাময় হয়?

___

বেগম নূর বাহারের কক্ষে বসে আছে শাহাজাদি মেহনূর। আল্লাহ দু’জন মনুষ্যের জীবনে আনন্দ দান করেছেন, তা-ই যেন চোখের বালি এই দুই নারীর।

“আমার আর সহ্য হচ্ছে না মেহনূর এই মেয়েকে! কিন্তু কিছুই তো করার নেই। আজ তো বেগমের মর্যাদাও পেয়ে গেল। আর কী করার আছে?”

“আমার কাছে একটা পরিকল্পনা আছে, মামীজান। বাস্তবায়ন করা যাবে যদি আপনি অনুমতি দেন তাহলেই।”

বেগম নূর বাহার প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। যুবতী মৃদু হেসে খুলে বলে তার পরিকল্পনা। এবার দু’জনের মুখেই শোভা পায় কুটিল হাসি।

মেহনূর আপন মনেই বিড়বিড়ায়,
“যতো আনন্দ করার এই চার দিন করে নেও চন্দ্রমল্লিকা। আর চারদিন পর হতেই তোমার আঁধার রাত্রির সূচনা হবে। ঢাল হিসেবে আমার শাহকেও পাবে না, সে তো থাকবেই না শেরপুরে।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here