#চন্দ্রপুকুর
||২৪তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
আঁধার চারদিকে, বাহিরের দৃশ্য দর্শনেরও সুযোগ নেই। প্রায় ছাদের সাথে লাগোয়া ছোটো একটা জানালা হতে একফালি আলো গড়িয়ে পড়ছে শুধু। চারটা দিন ধরে স্নান, আহার করা ব্যতীত যামিনী এই কক্ষে, ঠিক কক্ষ বলা যায় না, বন্দীশালাই বলা ঠিক।
“আল্লাহ, এ আমায় কোন বিপদে ফেললে তুমি। কোনো দোয়ারই মুক্ত পাচ্ছি না আলোর সাক্ষাৎ পেতে। এভাবে চললে আমার মৃত্যু অনিবার্য। এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু আমি চাই না আমার আল্লাহ। আমার প্রিয়তমের সাথে আমি বার্ধক্য কাটাতে চাই।”
তার আকুতি, দীর্ঘশ্বাস চার দেওয়ালের মাঝেই স্থির থাকে। কর্ণগত হয় না কারো। তবে সে জানে এই দিনের অবসান ঘটবে, বাবু মশাই নিশ্চয়ই তাকে এই অন্ধকারে ঠেলে দিবে না।
“এই মেয়ে।”
চোখ তুলে তাকায় যামিনী। দ্বারের ফাঁক দিয়ে খাবারের থালা ঢুকলো।
কিশোরী আলতো হাসলো, মুখে তুললো না এই খাবার।
চিৎকার করে বলল,
“এই অন্ন আমার গলা দিয়ে ঢুকবে না। আমি বাবু মশাইয়ের বেগম, বেগম চন্দ্রমল্লিকা, আমার সাথে এই আচারণের শাস্তি সবাই পাবে। সবাই!”
তার চিৎকার ততোটাই মূল্যহীন যতোটা মূল্যহীন হয় দেহের ঘ্রাণ বেলির সুগন্ধির কাছে। বরং, ভিতরে ঢুকে একজন নারী খাদিম বার কয়েক শক্ত হাতের মার লাগাতে ভুল করে না। আজ প্রথম না এই চার দিনে সে বহুবার আঘাত পেয়েছে নিজের বিদ্রোহের কারণে।
এতোদিনের না খাওয়া যামিনী দখল নিতে না পেরে দ্রুতই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। তার মনে হচ্ছে মৃত্যু খুব কাছে।
___
বেগম লুৎফুন্নেসা পান মুখে তুলে নিচ্ছেন। আঁখিজলে ভরে যাচ্ছে তার হাতে বিদ্যমান পুরনো লালচে আভার পত্রটি পড়তে পড়তে। চোখের সামনে ভাসছে পরিচিত মুখ। কতো বছর আগের ছবি, চিঠি, তবুও যেন আজকে পাওয়া ক্ষতের ন্যায়ই তাজা সকল অনুভূতি।
তাঁর ভাবনার মাঝে দরজা ঠেলে প্রবেশ করেন মালিহা খাতুন। উত্তেজনায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি, তাই অনুমতি নিতেও ভুলেছেন।
“সাহস কত! অনুমতি ছাড়া আমার কামরায় প্রবেশ করলে!”
“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করুন বেগম। তবে কথাটি প্রকাশ না করেও স্বস্তি পাচ্ছি না।”
ভ্রুঁ কুঁচকালের বয়স্ক নারীটি। বয়সের ভাজ পড়া মুখশ্রীতে বিরক্তির আভাও সুস্পষ্ট। দিন কয়েক কেটেছে মাত্র এক ঝামেলা মেটানোর পর এখনই আবার পুনরায় কী হলো?
“মালিহা খাতুন, যা বলার সুস্পষ্ট করে বলো। কোনো রূপ ভনিতা কোরো না। আমি তা নেওয়ার অবস্থায় নেই।”
“হুজুর, আমি… আমি এবং একজন খাদিম আসলে চুরির সময় মানে সেদিন অর্ধরাত্রিতে এক দাসীকে কালো পোশাকে আবৃত হয়ে লুকিয়ে নিবাসে ফিরতে দেখি। দপ্তরে যাওয়ার পথ হতেই ফিরছিল সে। গুরত্বপূর্ণ ভাবিনি বিধায় আর বিষয়টা ঘেঁটে দেখা হয়নি।
সকালে আমি বাজারে গিয়েছিলাম ফিরার পর চুরি এবং বেগম চন্দ্রমল্লিকাকে আটক করার খবর শোনার পর তার উপর সন্দেহ হয়েছিল। তদন্ত করে দেখি সেটাই সত্য, কারণ একজন প্রহরী কালো পোশাকধারী ব্যক্তিকেই বের হতে দেখে দপ্তর হতে।”
আঁতকে উঠেন বেগম লুৎফুন্নেসা। অন্যায়-অবিচার কখনোই তার কর্ম নয়। তাছাড়া যদি যামিনী প্রকৃতপক্ষেই নির্দোষ হয়ে থাকে তবে প্রিয় পৌত্র মেহমাদ শাহকে কী জবাব দিবেন?
“মূর্খ! তুমি এসব এখন জানাচ্ছো আমায়? সেদিন ক্যানো জানাওনি?”
“কারণ ঐ দাসীটি… ঐ দাসীটি বেগম নূর বাহারের খেদমতে নিয়োজিত খাঁস বাঁদী রোকাইয়া।”
মনে মনে যা ভয় করছিলেন তিনি তা-ই হলো। ধপ করে শিমুল তুলোর নরম গদিতে বসে পড়েন তিনি। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত কী করে করবেন তিনি?
কোনোরকম উচ্চারণ করলেন,
“এই মুহূর্তে বেগম চন্দ্রমল্লিকাকে সসম্মানে নবাব বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হোক। আর ঐ দাসীকে বন্দী করে যেভাবে পারো, যেই প্রক্রিয়ায় জবানবন্দি নেও তার। আর আমার সামনে উপস্থিত করাও মূল অপরাধীকে।”
মালিহা খাতুন সায় জানিয়ে বিদায় নিলেন। বেশ কিছুটা সময় রোকায়াকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হন দু’জন প্রহরী। ছুঁড়ে ফেলেন বেগম লুৎফুন্নেসার চরণে।
পা জড়িয়ে ধরে মার্জনার আবেদন করে যুবতী,
“বেগম, ক্ষমা করুন আমায়। ক্ষমা করুন। আমার কোনো দোষ নেই, শাহাজাদী মেহনূর আর বেগম নূর বাহার আমাকে এই আদেশ দিয়েছিলেন।”
“শাহাজাদী?”
হতভম্ব হয়ে যান বেগম লুৎফুন্নেসা। যে যুবতীকে শীতল মস্তিষ্কের, শান্তশিষ্ট ভেবেছিলেন। সে কি না মুক্ত এক হিতাহিতজ্ঞানশূন্য পশু!
“মালিহা খাতুন, এই বেহায়াকে বন্দী করো, অন্নের একটা দানাও যেন পেটে না যায় তার। সকল দাসী বুঝুক কী হয় অপরাধীর সাথে। আর নূর বাহার এবং মেহনূরকে এক্ষন উপস্থিত হতে বলো।”
শাহাজাদী মেহনূর ও বেগম নূর বাহার আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত হন তাঁর কামরায়। বেগম লুৎফুন্নেসা খেয়াল করেন দু’জনের মুখশ্রীতেই অন্যরকম নূর।
“আয়েশা খাতুন?”
ইশারা পেতেই রোকেয়াকে আড়াল হতে টেনে আনেন আয়েশা খাতুন। সদ্য আসা উভয় নারীর চেহারার রঙ উবে যায় দাসীটিকে দেখে।
ভীতিগ্রস্ত দৃষ্টিতে একদফা শ্রদ্ধেয় বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে নত করে ফেলেন মাথা।
“এখন নিশ্চয়ই বুঝেছো ক্যানো ডাকা হয়েছে তোমাদের? ছিঃ! ছিঃ! মেহনূর, আমার চাঁদের কণা তোমার হতে এই আশা করিনি আমি। এর শাস্তি তোমরা পাবেই। তোমাদের একবারও ভয় হয়নি আমার সিংহের কানে এ খবর গেলে কী ”
যেভাবে সাপ প্যাঁচিয়ে ধরে তার শিকারকে সেভাবেই বেগম নূর বাহার ও শাহাজাদি উভয়ে আঁকড়ে ধরে বেগম লুৎফুন্নেসার চরণ দু’খানা। ভয়ে কাঁদতে শুরু করে।
“ক্ষমা করুন আম্মিজান। আপনি তো জানেন আমার বুদ্ধিশুদ্ধি কম। ভুল করে ফেলেছি। দয়া করে এটা আমার পুত্রের কানে দিবেন না।”
“হ্যাঁ, নানীজান। ক্ষমা করুন। আমার বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। এই খবর শাহ জানলে সারা জীবন আমার ঘৃণা করব। আমাকে শাস্তি দিতে কোনো অংশ বাদ রাখবে না। দয়া করুন।”
নানীজানের ভঙ্গিমায় কিছুটা পরিবর্তম লক্ষ্য করলেও দৃঢ়তা বিদ্যমান। তাই দুর্বলতাতেই হাত রাখলো মেহনূর এবার।
“এছাড়া আম্মিজান আপনার প্রিয় একমাত্র কন্যার বদনাম হবে। এ খবর জানলে বাবা ও দাদীজান নিশ্চয়ই কটাক্ষ-বানে ক্ষত-বিক্ষত করবেন আম্মিজানকে। আম্মিজানের জন্য ক্ষমা করুন আমাকে।”
কিছুক্ষণ ভাবলেন বেগম লুৎফুন্নেসা। একমাত্র কন্যা তাঁর মেহনূরের মাতা, তাঁর কোনোরূপ অশান্তি তিনি চান না।
“ঠিক আছে, তবে এটাই শেষবার। এরূপ অপরাধ আবার হলে আমি নিজ হস্তে তোমাদের সঁপে দিব আমার সিংহের নিকট।”
___
দিলরুবা গ্রাম হতে ফিরে জানতে পারে তার প্রিয় বেগমের এই দুর্দশার কথা। শুনে সে বেশ দুঃখিত ও হতাশ হয়। বারবার আর্জি করা আল্লাহর নিকট তার মনিবের মুক্তির উদ্দেশ্যে। অবশেষে আজ আয়েশা খাতুনের হতে সে খুশির খবর পেলো।
অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত সে যামিনীর উদ্দেশ্য। যদিও বৈদ্যশালায় অপেক্ষা করার কারণ সে পাচ্ছে না।
ক্ষত-বিক্ষত অচেতন দেহ অন্দরমহলে প্রবেশ করলো যামিনী। তার দৈহিক অবস্থা দেখে ভড়কে যায় দিলরুবা নিজেও।
“ইয়া আল্লাহ” চিৎকার করে নিজের প্রিয় বেগমকে জড়িয়ে ধরে সে।
“এভাবে চেঁচিয়ে সারা ঘরের লোক এক করবে না কি দিলরুবা? শান্ত হও।”
“কিন্তু বেগমের এ দশা?”
“চিন্তা কোরো না। বৈদ্য তো আছেন, দেখছেন। খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবে বেগম।”
যামিনীর অচেতন দেহকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে শুরু করলেন। তাঁর চেহারা গাম্ভীর্যপূর্ণ ও হতাশা জর্জরিত।
বেগম লুৎফুন্নেসাও উপস্থিত সেখানে। চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলেন,
“কী হলো তোমাকে এমন দেখাচ্ছে ক্যানো? চন্দ্রমল্লিকার কী অবস্থা?”
“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম লুৎফুন্নেসা। তবে বেগম চন্দ্রমল্লিকার সুস্থ হওয়ার সুযোগ খুবই স্বল্প, মৃত্যুর দিকে ধীরে ধীরে হেলে পড়ছেন বটে।”
“এটা কী কথা তোমার! আমি বেগম চন্দ্রমল্লিকার সুস্থতা চাই।”
“আল্লাহ সহায় হলে অবশ্যই হবে। তবে আমার হাতে কোনো বিশেষ সুযোগ নেই তাকে বাঁচানোর। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তবুও।”
আর কোনো কথা হয় না সেই মুহূর্তে। বেগম লুৎফুন্নেসা সেখানেই থেকে যান।
রাত বাড়ছে, একটু একটু করে অবনতি হচ্ছে যামিনীর শারীরিক অবস্থার। সেই সাথে দরদর করে ঘামছেন বেগম লুৎফুন্নেসা, এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হলে কী জবাব দিবেন তিনি মেহমাদ শাহের নিকট? মেহমাদ শাহের নয়নযুগলে প্রেমের অগ্নি দর্শন পেয়েছেন তিনি, নিশ্চিত এই খবর কর্ণগোচর হলে এই গোটা জমিদারি সুদ্ধ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ফেলবে সে।
তবে কি অতি নিকটে যামিনীর মৃত্যু ও এই জমিদারীর ধ্বংস?