#চল তবে শূন্যতা ধরে হাঁটি
Zannatul ferdaous zannat
part:10
প্রিয়াদের বাসা থেকে বেড়িয়ে আসার পরই গেইটের সামনে নুন এর সাথে অন্তির দেখা হয়ে গেলো। নুন ও ওর চাচার বাসা থেকে নিজেদের বাসায় যাওয়ার জন্য বের হয়েছে।
অন্তিকে দেখেই নুন একপ্রকার দৌড়ে এসে অন্তিকে জড়িয়ে ধরলো।
অন্তি এমন কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না তাই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নুনের দিকে তাকিয়ে বললো
-ওহ তুমি?
-হ্যা ভাবি। তো কি ভেবেছিলে কে এভাবে ধরবে তোমায়?
অন্তি নুনের কথায় হেসে দিলো।
নুন আবার বলতে শুরু করলো
-কোথায় যাবে এখন?
-ইউনিভার্সিটি। তুমি?
-বাসায় যাবো। ভাইয়া অনেক অসুস্থ। বাসায় একা। আম্মু চাচার বাসায় জরুরি দরকারে আসলো আমি দিয়ে গেলাম। এখন ভাইয়ার কাছেই যাবো।
-কি হয়েছে ওর? অন্তি অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো
-এ মা। তুমি জানো না? কথা হয়নি ভাইয়ার সাথে? ওর তো অনেক জ্বর।বেশ কিছুদিন। এখনো সারে নি। কিন্তু ও যে ওই দিন বললো তোমাদের সব ঠিক ঠাক। এখন থেকে যেনো ভাবি ডাকি তোমায়।
অন্তি কেমন যেনো অসস্থি বোধ করলো।
কিছুটা লজ্জা মিশ্রিত ভঙ্গিতে বললো
-আসলে আমি ফোন ব্যাবহার করি না। বিষয়টা খুবই সেকেলে লাগলেও আমি সত্যি কোনো ফোন ব্যবহার করি না।
নুন অবাক হয়ে কিছুক্ষন অন্তির দিকে তাকিয়ে থেকে বললো
-আজ কি জরুরি কোনো ক্লাস আছে?
-সব ক্লাসই জরুরি নুন। আমি পড়ালেখাটা মন দিয়ে করতে চাই।
-একদিন পড়া ফাঁকি দিলে কিছু হয় না।
তুমি চলো তো আমার সাথে বাসায় আমি, ভাইয়া আর কাজের মেয়ে। ওকে বললে ও কাউকে কিছু বলবে না। তুমি এসুযোগে ভাইয়ার সাথে কথাও বলতে পারবে আর ভাইয়ারো ভালো লাগবে। চলো না প্লিজ।
নুনের এমন জোড়াজুড়িতে অন্তি বিশেষ ইচ্ছে না থাকলেও ওদের বাড়িতে যেতে হলো। যদিও অন্তিও আরশানকে দেখার জন্য মন কেমন করছিলো। তবে কউকে না জানিয়ে। সবার অগোচরে এভাবে এ বাড়িতে আসাটা অন্তির কাছে চরম পর্যায়ের বিব্রতির কারন। গেটে পা রাখতেই অন্তির কেমন যেনো অসস্থি লাগছে। এতোদূর এসে কি ফিরে যাবে? নাকি একটা বার আরশানকে দেখেই যাবে। দুটানায় পরে গেছে অন্তি।
এমন অসস্থিকর পরিস্থিতিতে পড়লে অন্তি প্রচুর ঘামে।হাত পা কাঁপে। আর বুকের মাঝে ধুকপুকানি এতো বাড়ে যে মনে হয় কেউ হাতুড়ি পেটা করছে। এখনও তার ব্যাতিক্রম হচ্ছে না।
নুন অন্তির হাত টেনে এনে বাসার ভেতর ঢুকালো। আরশানদের বাসাটা ডুপ্লেক্স না হলেও দুতালার একটা খুব আকর্ষনীয় আর অনেকটা জায়গা জুড়ে বেশ সুন্দর গোছানো একটা বাসা।
পুরো জায়গা জুড়ে অনেক রকম ফলের গাছ লাগানো বাসার চারপাশে। তবে তেমন ঝোপঝাড় নেই। সব পরিষ্কার। যেকোনো মানুষেরই এ বাড়িতে ভালো লাগবে। খুব নিরিবিলি।
বাসার বাইরের পরিবেশ অন্তিকে যতোটা না মুগ্ধ করেছে তার থেকেও বেশি মুগ্ধ করেছে ভিতরের পরিবেশ। বসার ঘরটা এতো পরিপাটি, সব আসবাব পত্রেই আভিজাত্যের ছোঁয়া। অন্তি মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতেই নুন গায়ের কটিটা খুলে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো
-ভাবি গো এই বাড়িতে তো সারাজীবন থাকবা। তখনও দেখতে পারবা। তখন দেখবা কেমন অসহ্য লাগে এমন সেকেলে পরিবেশে। এখন বরং ভাইয়াকে দেখবে চলো। যার জন্য এতো কষ্ট করে তোমাকে আনলাম।
অন্তির বুকটা কেমন ধুকপুক করছে। নুন হাত ধরে অন্তিকে আরশানের রুমের সামনে এনে দরজার সামনেই অন্তির হাত ধরে দাঁড়িয়ে গেলো।
অন্তি আর আরশানের যেনো চোখে চোখে ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে। নুনও হতবাক। আরশানের পাশে সৃজা বসে আছে আর ঘরের আরেক কোনার সোফায় আদ্র আর সাদান। পুরো ফ্লোরে কাচের টুকরা আর সুপ ছিটে ছুটে পড়ে আছে।
নুন অন্তির দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকালো। নুন এতোক্ষনে বুঝতে পারলো তার মা কেনো তাকে চাচার বাসা থেকে আসতে দিতে চাইছিলেন না।
অন্তির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নুন বললো
-সরি ভাবি। আমি জানতাম না সৃজা আপু এসেছে।
অন্তি চোখার ইশারায় অভয় দিলো।
-সৃজা তুই যা তো। তখন থেকে তোকে বলছি চলে যেতে।
আরশান চোখে রাগি ভাব এনে কথাটা বলতেই সৃজা উঠে দূরে যেয়ে দাঁড়ালো।
অন্তির উপস্থিতি যেনো আদ্র আর সাদান কে অনেক খুশি করলো। ওরা দুজনই জানে অন্তি আরশানের জন্য কি। সাদান মুখে প্রসস্থ হাসি এনে বললো
-নে দোস্ত তোর জীবনজ্যোতি চলে এসেছে। এবার আমরা যাই।
আদ্র আরশানের পিঠে হাত চাপড়িয়ে আস্তে করে বললো
-শালা মাতলামি পাগলামি যাই করিস না কেনো ভাবিকে নিজের করে ছাড়লি তাহলে।
সাদান আর আদ্র অন্তির দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে উঠে চলে গেলো রুম থেকে। অন্তিও হাসি বিনিময় করলো কিন্তু দরজা পার করে আরশানের রুমে ঢুকলো না।
সৃজাকে দেখে অন্তির কোনো হিংসে হচ্ছে না। কেমন যেনো অসহায় লাগছে সৃজাকে। অন্তির কি এখন সৃজাকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দেয়া উচিৎ নাকি মুখে বিশাল হাসি ঝুলিয়ে বিজয়িনীর বেশে ওর সামনে যেয়ে আরশানকে জয় করার বীরত্ব দেখানো উচিৎ? অন্তি দুটোর একটাও করলো না। বরং ঠাই দাঁড়িয়ে থাকলো। এতো সুন্দর একটা মেয়েকে আরশান কেনো এতো অবহেলা করে? যে কেউ প্রথম দেখাতেই বলবে এই মেয়ে কতোটা মিষ্টি দেখতে। শরীরে জড়ানো মেরুন রং এর মসলিন কাপড়ের থ্রি পিসটা যেনো মেয়েটার রূপটাকে আলোকিতো করছে।
আরশান নিরবতা ভেঙ্গে বললো
-অন্তি ভিতরে আসো।
অন্তিকে এর পরও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সৃজা এগিয়ে এসে অন্তির পাশে দাঁড়িয়ে বললো
-ভেতরে যাও। আমার কিছু কাজ আছে আমি চলে যাচ্ছি।
অন্তি সৃজার মুখের দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকলো। এতো সহজে কেউ কারো উড বি কে তার প্রেমিকার হাতে তুলে দিয়ে যেতে পারে? সৃজার চোখে অন্তি কোনো হতাশা আর অশান্তির খোঁজ পেলো না।অন্তির কেমন যেনো গলা শুকিয়ে আসছে।
আরশান আবার বললো
-অন্তি ভিতরে আসো।
অন্তি ধীরপায়ে আরশানের রুমে ঢুকে সোফায় বসলো।
আরশান কিছুটা ভ্রু কুচকে অন্তির দিকে তাকালো। ওই সোফায় বসার মানে কি?
তবুও মাথা ঠান্ডা রেখে বললো
-অভি ভাই বললো তুমি পুনম ভাবির বাসায় গেছো সকালে। ঝটপট অভি ভাইকে দিয়ে বলিয়ে মাকে পাঠালাম ওই বাড়ি আর নুনকে পাঠালাম মার সাথে যেনো ও মাকে রেখে তোমায় বাসায় নিয়ে আসে। কিন্তু মা আমাকে একা রেখে যাওয়ায় সৃজাকে ফোন করে পাঠিয়ে দিলেন আর আমি সৃজাকে দেখে আদ্র আর সাদান কে ডেকে আনলাম। একা বাড়িতে ওকে আমি কোনো সুযোগ দিতে চাইনি।
কথটা মুহূর্তেই অন্তির ভেতরটা ঠান্ডা করে দিলো। এখনি অন্তির খুব কড়া কথা শুনাতে মন চাচ্ছিলো। অন্তি তো মনে মনে কথাও ঠিক করে নিয়েছিলো আরশানকে কড়া গলায় বলবে,
“মিস্টার শান তুমি যদি মনে করো তোমার রানী থাকতেও আরও কারও সঙ্গ প্রয়োজন তবে আমি সেচ্ছায় বনবাস নিবো। তবু এসব অধর্ম সইবো না।” কিন্তু তা আর বলতে হলো না।
আরশান অন্তির চোখে চোখ রেখে বললো,
-আমি জানতাম তুমি নুনের মুখে আমার অসুস্থতার কথা শুনলে ঠিক চলে আসবে।আমার জন্য। আমাকে দেখতে।
আরশানের কথায় অন্তি ভ্রু নাচালো। কপালের উপর পড়ে থাকা চুল গুলো কানে গুজতে গুজতে বললো
-আমি কি ধরে নিবো? এটা তোমার আত্মবিশ্বাস নাকি অহংকার?
-তোমার যেটা ভেবে ভালো লাগে। তবে আমি তো বলবো ভালোবাসা।
অন্তি আর কথা বাড়ালো না। এই ছেলের সাথে কথা বলে পাড়বে না ও।
আরশান চুলগুলে ব্যাক ব্রাশ করতে করতে বললো
-অন্তি দেখো তো জ্বর কেমন?
-অন্তি ব্যাগটা ছোফায় রেখে উঠে এসে আরশানের কপালে হাত ছুঁয়ালো।
তাপমাত্রা খুব বেশি নেই তবে ছেলেটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব বেশি দূর্বল।
আরশান টিশার্ট খুলে ছুড়ে ফেলে অন্তিকে উদ্দেশ্য করে বললো
-নাও এবার পতি সেবায় লেগে পড়ো তো। আমার শরীর টা একটা নরম কাপড় ভিজিয়ে মুছে দাও। অসস্থি লাগছে খুব।
অারশান নুনকে ডেকে এনে একটা কাপড় ভিজিয়ে দিয়ে খাবারের ব্যাবস্থা করতে বললো।
অন্তিকে তখন থেকে ভেজা কাপড় হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরশান অন্তির হাত ধরে পাশে বসালো। অন্তির কপালের দু পাশে যেখান থেকে চুলের শুরু সেখানটায় পানি চিকচিক করছে। ঘরের তাপমাত্রা আরশানের কাছে তো ঠিকই লাগছে তবুও কেনো মেয়েটা এভাবে ঘামছে কে জানে। অন্তির মুখটা টেনে ধরতেই আরশানের চোখ কেপে উঠলো। মেয়েটা কাঁদছে। কিন্তু কেনো?
অন্তি আর নিজেকে আরাল করলো না বরং আরশানের চোখে চোখ রেখে চশমাটা খুলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
-শান আমি তোমায় ভালোবাসি এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি ওভাবে তোমাকে গ্রহন করতে পারছি না। চাইলেই তোমার সামনে ছুটে আসতে পারছিনা। আমি চাচ্ছি সম্পর্কটা সুন্দর হোক। কিন্তু কিছু একটা বাধা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি আমার বাবা মাকে ঠকাচ্ছি। আমি আমার অনুভূতিটা বোঝাতে পারছি না। আমি কি করবো? তোমাকে পাওয়ার সুখ যেমন আমাকে ভাসাচ্ছে, তেমনি একটা অপরাধবোধ আমাকে গুটিয়ে দিচ্ছে। আমি কি করবো শান?
আরশান অন্তির কথাটা মুগ্ধ হয়ে শুনলো। মেয়েটা সত্যি বড় হয়ে গেছে। সবার কথাই ভাবতে শিখেছে।
অন্তির হাতটা নিজের হাতে জড়িয়ে নিয়ে আরশান বললো
-আমায় ভরসা করো অন্তি, ঠিক করে দিবো সব। একটু সময় লাগবে শুধু।
অন্তি শূন্য দৃষ্টিতে আরশানের দিকে তাকিয়ে থাকলো
আরশান অন্তিকে কিছুটা স্বাভাবিক করতে বললো
-এই যে বউ আর কতোক্ষন নেংটুপুটু হয়ে থাকবো। লজ্জা লাগছে তো। তারাতাড়ি শরীর মুছে দাও।
অন্তি হেসে ফেললো আরশানের কথায়।
পিঠ মুছতে মুছতে বললো
-নুন অনেক ছোট ওকে দিয়ে এসব না করালে হয় না।আমার বিব্রত লাগে।
-ও আর আমি খুব ক্লোজ। আমি জানি আমার সিক্রেট গুলো ও খুব যত্নে রাখবে। আর আমাকেও ও সব শেয়ার করে। এই যেমন ধরো ওকে একটা ছেলে খুব পচ্ছন্দ করে। এবার মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। এই ঘটনাটাও ও অনায়াসে আমাকে বলেছে।
মজার ব্যাপার কি জানো। নুন নিজেও ছেলেটাকে পচ্ছন্দ করে কিন্তু প্রকাশ করে না। ওর ইচ্ছা হলো ছেলেটাকে অনেক ঘুরাবে। ধৈর্য দেখবে। মেয়েরা তারাতারি রাজি হয়ে গেলে নাকি দাম থাকে না। তাই ছেলেটাকে আরও অপেক্ষা করাবে ও।
অন্তি হেসে দিয়ে বললো
-আমি কি তাহলে অনেক তারাতারি করে ফেললাম?
-মেডাম চারটা বছর কি কম মনে হয়? আরও অপেক্ষা করাতে চাও?
-কি জানি?
আরশানের খুব ইচ্ছে করছে অন্তিকে জাপটে ধরে বলতে, “হেয়ালি করবে না অন্তি। রানী হয়ে মাথা কিনে নাও নি। রাজাকে সব সময় সঙ্গ দেয়া তোমার কাজ। তুমি কিনা চিন্তা দিচ্ছো।”
কিন্তু বলতে পারলো না কিছু। চুলের মাঝে অন্তির বিলি কাটায় কেমন যেনো আবেশে চোখ বুজে আসছে।
চলবে….