চলো তবে শূন্যতা ধরে হাঁটি পর্ব ৮+৯

#চল তবে শূন্যতা ধরে হাঁটি
Zannatul ferdaous zannat
part:8

অন্তির কপালে বিরক্তির ভাজ। এই ছেলেটা একটা সময় খুব ইগোইস্টিক থাকলেও এখন কিভাবে এতো ছেচরা হলো কে জানে! কেমন নির্লজ্জের মতো এককান ধরে আর এক হাত পকেটে দিয়ে দাড়িয়ে আছে। এই বিশেষ অঙ্গভঙ্গির নাম অন্তির জানা নেই।
মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে অন্তি আরশানের চোখে চোখ রেখে কপালে সূক্ষ্ণ ভাজ এনে বললো
-এমন অদ্ভুত সং সেজে থাকার মানে কি?
-অন্তি আমি মনের গভীর থেকে দুঃখ প্রকাশ করছি। সেদিন অমন করে হুট করে রাগ করে ফেলা উচিত হয়নি। কিন্তু তাই বলে তুমি আমার উপর জেদ করে পাঁচদিন বাসা থেকেই বের হও নি?

অন্তি কথার জবাব না দিয়েই ক্লাশে ঢুকে গেলো।
আরশান অন্তির উপর প্রচন্ড বিরক্ত থাকলেও প্রকাশ না করে অন্তিকে দেখেই অন্তির পাশে বসে গেলো।
-শান আমি তোমাকে হয়তো বোঝাতে পারছি না। অথবা তুমি বুঝেও অবুঝের মতো হয়ে আছো। আমার পরিবার মানবে না শান। নতুন করে কষ্ট পাওয়ার কি দরকার?

অন্তি নিরস গলায় কথাটা শেষ না করতে করতেই আরশান বললো
-কারো ফ্যামিলিই মানেনা অন্তি। মানিয়ে নিতে হয়।
-এর আগে কি হয়েছে চারটা বছরেও কি বুঝো নি?নাকি আবার নতুন করে কষ্ট পাওয়ার সাধ জেগেছে?
-তিন বছর সাত মাস তের নাকি চৌদ্দ দিন এটা মনে নেই, ঘন্টা মিনিট হিসাব করি নি।

অন্তি আর কথা বাড়ালো না। এই ছেলেকে হাজার বললেও লাভ হবে না। বিষাদ মুখে চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসে গেলো অন্তি।

প্রিয়ার উপর চরম বিরক্ত অন্তি। সেদিন লুকিয়ে অন্তি আর নুনের সবটা কথা শুনে তা আবার আরশানকে বলেও দিয়েছে। একটা বার অন্তিকে জিঙ্গেস করার প্রয়োজনও মনে করলো না। প্রিয়ার সাথে এই জেদে অন্তি কথাই বলে না কয়েকদিন হলো। অন্তি বরাবরই বুদ্ধিমতি। রহস্যটা খুঁজে পেতে ওর বিশেষ কষ্ট হয়নি।

ক্লাশ শেষ করে অন্তি অনুরোধের শুরে বললো
-শান প্লিজ তুমি জেদ নিয়ে পড়ো না।
-কেনো?
-আমি বাবাকে কথা দিয়েছি।
-অন্তি জানোতো ভালোবাসা শর্ত মানে না। আচ্ছা ধরলাম তোমার বাবাকে কথা দিয়েছো। কি কথা দিয়েছো?
-আমি এ সম্পর্কে আর জড়াবো না। এটা নিয়ে আর ভাববো না।
-এটুকুই?

অন্তি চোখ বড় করে তাকালো
-এতটুকুই।
বলেই অন্তি হেটে যেতে লাগলো

আরশান আবার অন্তির পিছনে হেটে হেটে যেতে যেতে বললো
-তুমি কি আমাকে ভুলে গেছো? ভালোবাসা বাদ দিছো?
-শান, দোহায় লাগে তুমি যাও তো।
-অন্তি সেদিন তোমায় বিয়ের অনুষ্ঠানেই দেখে রাগ উঠে গেছিলো। হুট করে ওইখনে চলে আসবে ভাবি নি। কিন্তু এর পরই হুট করে রাগটা পড়ে গেলো। আবার ভালোবাসাগুলো কেমন যেনো মনের মাঝে নিজ দ্বায়িত্বে উঁকি দিতে লাগলো।

-তো এতো দিন কেনো খোঁজো নি? একটা বারো তো চট্টগ্রাম যাও নি অথবা আমাকে হন্নে হয়ে খুজে যোগাযোগ করো নি। এখন আমাকে দেখেই হঠাৎ পুরোনো প্রেম টা জেগে গেলো? আর এতই আমার জন্য মন কেমন করে তোমার? এই তুমিই তো নিজে সেদিন বললে ডজন খানেক প্রেম করেছো, এক মেয়েকে দেখিয়ে বুকের ছাতি চওড়া করে বললে ও তোমার এক্স। আর এখন আমাকে নিয়ে পড়েছো।

অন্তির কথায় বিশেষ ভ্রুক্ষেপ না করে আরশান অবলীলায় জবাব দিতে যেনো প্রস্তুত। অন্তির প্রতিটি প্রশ্নের সহজ ব্যাখ্যা আরশানের কাছে আছে।

আরশান স্থান কাল না ভেবেই অন্তির গা ঘেসে এসে বললো
-চট্টগ্রাম কি তোমার কাছে এতটুকুনি মনে হয় যে মন চাইলো আর তোমার মতো ঘর কুনোকে টেনে হিচরে বেড় করে আনলাম। অন্তি তুমি চট্টগ্রাম যাওয়ার পর আমাদের নিজেদেরই ঠিক ভাবে কথা হতো না। সেখানে তোমার ঠিকানা তো চাওয়াই হয় নি৷ এটা অবশ্য আমার বড্ড বড় ভুল ছিলো। তুমি কোনো ক্লু রেখে যাওনি। আর শেষ বার তোমার ফোনের কথায় স্পষ্ট করে বলেছো তুমি আমাকে চাও না। এর পর কোন ভরসায় খুঁজতে বের হতাম বলো তো?

অন্তি মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে বলেই ফেললো
-আমি চাইনা এই কথাটা তো এখনো বলছি।
বুঝতে অসুবিধা হলে আবার বলি?শান আমি তোমাকে চাই না।

-বেশ তো মুখে বললে চাও না। কিন্তু তোমার চোখ, তোমার চেহারা, তোমার নারভাস হয়ে যাওয়ায় এক হাতে অন্য হাত চেপে ধরা প্রতিটি অংশ জানান দিচ্ছে তুমি চাও। অনেক চাও আমাকে।

অন্তি দ্রত পা চালাচ্ছে।

আরশান আবার বলতে শুরু করলো
-অন্তি তুমি যদি চাও আমি আমার এক্স গুলারও ব্যাখ্যা দিতে পারি।

অন্তি দাড়িয়ে গেলো। আরশান অন্তির সামনে দাড়িয়ে বলতে লাগলো
-অন্তি তুমি চলে যাওয়ার প্রায় ছ’মাস পর আমার ফ্যামিলি থেকে একটা মেয়েকে আমার সাথে কথা বলতে বলে। আমি ইন্টারেষ্টেড ছিলাম না। মেয়েটা অনেক ট্রাই করেছে। আমি টুকটাক কথা বললেও কখনও গুরুত্ব দেই নি। ও সেচ্ছাই চলে গেছে।
তারপর ওই দিন যে মেয়েটাকে দেখলে ও আমাকে প্রপোজ করলো। আমার মনে হয়েছিলো এখন জীবনটা একটু পাল্টানো দরকার। আমি এক্সেপ্ট করলাম। বেশ কথা হতো আমাদের মাঝে। তবে সব কথা ওই মেয়েই বলে যেতো। কিন্তু না আমি নিজে থেকে কখনও দেখা করতাম না কখনও নিজের ইচ্ছায় কথা বলতাম। ওই মেয়ে চিপকে থাকতো। একটা সময় মেয়েটা আমার কাছে আরও বেশি দাবি করতে লাগলো। ও তখন আমার থেকে বুঝই তো, ফিজিকেল এটাচমেন্ট চাচ্ছিলো। আমি আর মেয়েটাকে কোনো সম্পর্কের সুজোগ দেই নি। আর ওই মেয়েকে এটা বোঝানোর ছিলো যে আমার আর একটা গার্লফ্রেন্ড আছে।
তাই আরিশা নামে একটা মেয়েকে রিকুয়েষ্ট করলাম শুধু আমার জিএফ হয়ে অভিনয় করতে। আরিশা হয়তো আমায় ভালোবাসতো তবে ও আমাকে ওই মেয়ের হাত থেকে রক্ষা করে নতুন করে সম্পর্কের দাবি করে নি।
অন্তি ডজন খানেক নয় এই তিনটা মেয়েই তুমি চলে যাওয়ার পর আমার জীবনে এসেছিলো। না আমি ওদের কাওকে ভালোবেসেছি। না ওদের কাউকে জীবনে জায়গা করে দিয়েছি। আমি শুধু তোমার ভূত মাথা থেকে নামানোর চেষ্টা করেছি অন্তি। আমার পুরোটা জুড়ে তুমি ছিলে সবসময়। কিন্তু সেই তোমার ভূত নামাতে নামাতেই আমার মাথায় এখন ভূতনী হয়ে ঢুকে গেছো অন্তি। তোমাকে দেখার পর থেকে আর আমি অন্য কিছু ভাবতে পারছি না। আমার প্রথম ভালোবাসা তুমি অন্তি। আমি তোমাকে পেতে চাই।

অন্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরশানের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো
-সৃজা? ও তোমার জীবনের বর্তমান।

-ওর ঘটনাটা আমি তোমায় বলবো না।একদিন তুমি নিজেই জানবে অন্তি। শুধু এটুকু জেনে রাখো আমার ভালেবাসা শুধু তুমি। হাজারটা মেয়ে চাইলেও তোমার জায়গা নিতে পারবে না।

সেদিন জিম শেষে অন্তির সাথে আর কথা বলা হলো না। অন্তির মা অন্তিকে নিয়ে যেতে এসেছিলো।

দিন গুলো খুব যে খারাপ কাটছিলো তা নয় তবে আরশানের এই পাগলামি গুলো যেনো অন্তির মনের সংযম ভেঙে দিচ্ছিলো দিন দিন।

দুজনের কথা বলা তখন সহজ হয়ে এসেছে। এরমাঝেই আরশান একদিন অন্তির হাতে গুজে দিলো একঝাক হলুদ রংএর ফুল। আরশান হাসি মুখেই বললো এটা “রাধাচূড়া” ফুল। দেখোনি বুঝি কোনো দিন?

অন্তির মনে আছে আরশানের সাথে সম্পর্কের পর হাজার অচেনা ফুল দিয়েছে অন্তিকে। একে একে চিনিয়েছে অজানা অনেক ফুলকে। তবে কোনো দিনো গোলাপ এনে দেয় নি। কি অদ্ভুদ একটা ব্যাপার।
এই বিশেষ হলুদ রাঙ্গা ফুল বাসায় এসে ব্যাগ থেকে বের করেই বিচ্ছিরি গন্ধে অন্তির গা গুলিয়ে এলো।একটা ফুল লেপ্টে গেলে এতোটা বাজে গন্ধ হয় অন্তির জানা ছিলো না।
তবে ঘটনাটা আরশানকে খুব হাসিয়েছিলো
আর সেই হাসিটাই অন্তিকে দিয়েছিলো চরম মুগ্ধতা। একুশ বছরের যুবক যখন হঠাৎ করেই চব্বিশ পঁচিশের হয়ে যায়, বিষয়টা কেমন যেনো। চেহারার সেই কিশোর ভাবটা মিলিয়ে এক নিমিষেই সুঠাম দেহী যুবক যেনো অন্তির গাল চেপে বলে” প্রেম কর আমার সাথে।আমাকে ভালোবাস।”
চোখ বন্ধ করে এসব ভাবতে চায়না অন্তি। বিষয়টা মনের অনেক গভীরে যেয়ে ধাক্কা দেয় কিনা!

আরশানের ভালোবাসার ক্ষমতা একটু একটু করে অন্তিকে দূর্বল করে দিচ্ছিলো। আরশানের বাদামি চোখের চাহনি, ঠোঁটের বাঁকা হাসি, মাতাল করার মতো কথা গুলো অন্তিকে সম্মোহিত করে ফেলছিলো দিন দিন। কখনও তো ইচ্ছা করতো ছুটে যেয়ে বলেই ফেলে যে
-শান আমাদের সম্পর্কের ফলাফল শূণ্য। তবুও চলোনা শূণ্যতা ধরেই হাঁটি।

কিন্তু সেই শূণ্যতাতেও অন্তির ভয়। যে সম্পর্কের ভবিশ্যত নেই সে সম্পর্ককে হাত ধরে এগিয়ে নেয়া অন্যায়। এই একটা চিন্তা যেনো অন্তিকে থামিয়ে রাখে সবটা থেকে।

ভার্সিটিতে যেতে আজ বড্ড দেরি হয়ে গেছে। লিফটে উঠে বরাবরের মতোই বিহনকে দেখে অন্তি একপাশটায় চিপকে দাড়ালে বিহন অন্তির সামনে এসে বললো
-অয়ন্তি হাসনাত। আজকাল তুমি অনেক ব্যাস্ত তাইনা?সব জায়গায় একপ্রকার ছুটেই যাও।
-অন্তি মুখে হাসি রেখে চশমা ঠিক করতে করতে বললো, তেমন কিছু না ভাইয়া।
-যখনই দেখি তখনি কেমন যেনো তাড়া দেখাও খুব।

অন্তি আর কোনো কথা না বললেও বিহন লিফট তিনতলার কাছে আসতেই অন্তির হাত চেপে ধরে বললো
-অয়ন্তি আমি কিছু বলতে চাই। অয়ন্তি তুমি কেনো আমাকে দেখলে চুপসে যাও?

বিহনের মুখে যতোটা আকুতিই থাকুক না কেনো অন্তি যেনো ভয়ে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। এই ছেলে এভাবে হাত চেপে ধরবে অন্তি চিন্তাও করে নি।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসেই অন্তি হাত ছুটিয়ে এক দৌরে গেট ছেড়ে বেড়িয়ে আসলো। এখন ঘরে ফিরে গেলেও যে বিহন তার পথ আটকাবে না তার কি নিশ্চয়তা। রিক্সায় উঠেই ব্যাগের ভিতরের কাচি, সেফ্টিপিন, দেখে নিলো।এর থেকে বাড়াবাড়ি করলে হয়তো এগুলোই কাজে লাগতো।
#চল তবে শূন্যতা ধরে হাঁটি
Zannatul ferdaous zannat
part:9

এই তুমুল ঝড়েও এমন পাগলামির মানে হয় কোনো।ছেলেটা যে দিন দিন বেহায়াপনার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে অন্তি এই দুঃখে জীবন ত্যাগ করে দিতে পারলেও বেশ হতো। এতো জোড়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তবুও অন্তিকে একচুলও নড়তে দিচ্ছেনা আরশান। কি চায় ও ঠাডা পরে মরুক দুজন নাকি প্রচন্ড ভয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে অন্তি। হুহ জীবনেও ধরবে না। পরুক ঠাডা।

অন্তি মনে মনে বেশ জলে পুড়ে হাজার খানেক গালি দিয়ে আরশানের দিকে ঘুরে দাড়াতেই অমনি যেনো কলিজার লাফালাফি বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এটা তো আরশান না। ওই রাগী লাল চোখ। আসলেই কি রাগী?নাকি এই লোকের চোখই এমন। কতো কাল যেনো ঘুমায় নি। চেহারা বড্ড ক্লান্ত।

তবে এই বৃষ্টি তে ভিজে অন্তি কেপে কেপে উঠছে। কোনো উপায় না পেয়ে বললো
-ছেড়ে দিন না বিহন ভাই। আমি এমন বিজলি ভয় পাই। ছাড়ুন আমায়।

বিহন বীরপুরুষ এর মতো করে হুংকার দিয়ে বললো
-আমি আছি তো। কোনো বিজলি তোমায় ছোবে না অয়ন্তি হাসনাত। ভয় কিসে তোমার?

অন্তি কাদো কাদো গলায় বললো
-আপনিই তো আমার সবথেকে বড় ভয়।ছাড়ুন না, ছাড়ুন আমায়।

ঘেমে নেয়ে একদম গোসল করে ফেলেছে অন্তি। এমন একটা বাজে স্বপ্ন দেখে অন্তির যেনো হাত পা কাপছে।

ঢগঢগ করে এক গ্লাস পানি গিলে নিলো অন্তি। শুধু শুধুই এমন স্বপ্ন দেখে নিজেও লজ্জায় পরে গেলো মেয়েটা। সেদিন বিহন লিফটে হাত ধরার পর এই কদিন তো অন্তির সামনেও পড়ে নি। হয়তো সেই ঘটনায় বিহন ছেলটা লজ্জিত। মানুষের সাথে অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটে যা সে না চাইতেও উত্তেজনার বশে হয়ে যায়।
অন্তি বরং মনে মনে বিহনকে কয়েক দিন খুজেছে। ছেলেটা হয়তো খুব নার্ভাস তাই আর সামনে পড়ে নি। অন্তির কি উচিৎ নিজে যেচে কথা বলে ফেলা।
একমনে ভেবে অন্তি উঠে বসলো।
নাহ এই ছেলের সাথে অযথা কথা বলার দরকার নেই। বিহনের চোখে অন্তির জন্য কিছু একটা আছে।
তাই কথা না বলাই ভালো। এমনি এমনি ছেলেটার মনে আর কোনো অনুভূতি জন্মাক অন্তি চায় না।

চোখ বন্ধ করে বসে থাকলো অন্তি। আরশানের সাথে অনেক দিন হলো দেখা হয় না। দেখা না হওয়ারও বিশেষ একটা কারন আছে।
সেদিন ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে হঠাৎই আরশান আর সৃজাকে অন্তি এক সাথে দাড়িয়ে কথা বলতে দেখে। এমন একটা পাবলিক প্লেসে এরা একসাথে এমন ভাবে দাড়িয়ে আছে যেনো হাত ছেড়ে দিলেই আরশান অথবা সৃজা কেউ একজন দৌড়ে পালাবে। এমন হাত ধরাধরি করে দাড়ানোর মানে হয়। যদিও আরশান খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
বরং সৃজাই যেচে হাত আকড়ে ধরে রেখেছে।

অন্তিকে দেখেই আরশান সৃজার হাত ছুটিয়ে অন্তি রিক্সায় উঠার আগেই রিক্সা আর অন্তির মাঝে এসে দাড়ালো। অন্তির যেনো রাগে পায়ের তলা জ্বলছে। মাত্রই তো হাজার লোকের সামনে একজনের হাত ধরে প্রেমালাপ করছিলো এখনই এখানে এসে হাজির। অন্তি পানসে মুখে বললো
-কি চাই?
-অন্তি কিছু কথা ছিলো।

অন্তি আগ্রহ না দেখালেও প্রিয়া কথা বলার সুজোগ করে দিয়ে কিছুটা এগিয়ে দাড়ালো।

আরশান অবলিলায় বলে গেলো
-অন্তি মেডিটেশন, জিম সবগুলারই মূল কারন তুমি। কিন্তু দেড় মাসেও তুমি আমায় এতটুকুনি সুজোগ দাও নি। কথা বলেছো যেনো উপায় না পেয়ে এমন। আমি তোমার কথার প্রেক্ষিতে তোমার বাবার এমন রাগের দুটো কারন বের করেছি।

এক, “তুমি তখন বেশ ছোট ছিলে। নাইন টেনে পড়তে। যদিও এযুগে নাইন টেনের ছেলে মেয়ে একদমই বাচ্চা না। তবুও ধরলাম তোমার বাবার মতে আমি তোমার বাচ্চা কালের ভুল।”
দুই, “তুমি আমার জন্য তোমার বাবা মাকে মিথ্যা বলেছো দিনের পর দিন। অন্তি প্রেম যারা করে সবাই কম বেশি মিথ্যা বলে। তবুও এটাও একটা অপরাধ।”

এছাড়া আমায় মেনে না নেওয়ার কারন আমি দেখি না। মেয়েদের আচরন বলে দেয় আমি যথেষ্ট সুদর্শন। তুমিও কিন্তু আর চোখে মাঝে মাঝে দেখো। আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। আমিও যথেষ্ট কুয়ালিফাইড। আর একস্ট্রা যেটা আছে সেটা তোমার জন্য অঢেল ভালোবাসা।

অন্তির মুখে কোনো জবাব ছিলো না সেদিন। আরশান চলে যাওয়ার আগে শুধু বলে গেলো আমি অপেক্ষা করবো অন্তি আজ থেকে ঠিক পনেরো দিন এরপর আর আমি তোমার সামনে আসবো না। ভেবে দেখো।

অন্তি এসব ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলো গরমেও সে ঘেমে যাচ্ছে বারবার। আরশান খুব জেদি। সত্যি যদি আর অন্তির সামনে না আসে। দেড় দুই মাসে ছেলটা অভ্যাস খারাপ করে ছেড়েছে। সারাদিন আগে পিছে আগে পিছে করে হুট করেই উধাও হয়ে গেছে। অন্তি জানে আরশান অপেক্ষা করে। রোজ আরশানের গাড়িটা ক্যাম্পাসের একটু সামনেই পার্ক করা থাকে তবুও আরশান সামনে আসে না। অন্তির খুব মন চায় সামনে থেকে দেখতে। আজ তেরো দিন। আরশান কি সত্যি আর দুদিন পর উধাও হয়ে যাবে?

সকালে কড়া রোদ দেখে বের হলেও ক্লাস শেষে বের হতে না হতেই ঝুম বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে একটা রিক্সা পাওয়াও অসম্ভব প্রায়। প্রিয়া আজ আগেই চলে গেছে।

এই বৃষ্টির মাঝে কিছু একটা আছে। যা চুম্বকের মতো অন্তিকে টেনে এনে আরশানের গাড়ির সামনে দাড় কড়ালো।

কাঁচের জানালায় টোকা পড়তেই আরশান দরজা খুলে অন্তির দিকে অবাক হয়ে তাকালো।
আর প্রেজেনটেশন ছিলো। একটা কালচে পাড়ের খয়েরি শাড়ি পড়েছে অন্তি। শাড়ি হয়তো একটা মেয়েকে হুট করেই আবেদময়ী নারী করে তুলে।

আরশান আর অন্তির চোখে কিছু কথা বিনিময় হলো। অন্তি ব্যাগটা পিছনের সিটে ছুড়ে দিয়ে আরশানের পাশে বসলো। এই ছেলে কখন বৃষ্টিতে ভিজলো কে জানে। শার্টটা গায়ে লেপ্টে আছে।

দুজনেই চুপ। আরশান জানে আজ অন্তি জবাব দিবে, এখন শুধু অন্তির কন্ঠের অপেক্ষা।

অন্তি শাড়ির আঁচল খাঁমচে ধরে বলতে শুরু করলো

-প্রেমটা আমি হিসেব করে করতে চাই শান। তোমাকে পেলে আমার পুরোটাই চাই আর না হলে একটুও না। আমি মধ্যবিত্ত প্রেমিকা হতে পারবো না। আমার সম্পর্কে কোনো টানাপোড়েন থাকবে না। কোনো ভয় বা নিরাসা ছোবে না আমায়। হয় একে বারে পেয়ে যাবো নয়তো একটুকুও পাবো না। এই পেলাম এই হারালাম এমন খেলায় আমি পা বাড়াবো না।

আরশান অন্তির চোখে তীক্ষ নজরে তাকালো। তার কি বলা উচিৎ? সে যেনো ভাব শূণ্য। মেয়েটা হঠাৎই বড়ো হয়ে গেলো না তো? কেমন কঠিন কথা সহজ ভাষায় বলে যাচ্ছে। আচ্ছা অন্তিকে কি ঢের সাহস জুগিয়ে বলেই দিবে,
-অন্তি তুমি তো আমার রানী। তুমি উচ্চবৃত্ত পর্যায়েরও আরও উর্ধ্বে।
নাকি এতোটা গেরান্টি না দিয়ে গলা নামিয়ে মিন মিন করে অন্তির গলার পাশে নিজের ঠোট ডুবিয়ে বলবে
-অন্তি তোমাকে আমার চাই। চলো একসাথে সংগ্রাম করি। একসময় আমরা জিতে যাবো।

নাহ আরশান কোনো জবাব না দিয়ে অন্তির মুখটা দেখতে লাগলো। রূপে মেয়েটার কোনো খাদ নেই। বৃষ্টিতে ভিজে ঠোঁট আর চিবুকের দুপাশটা নীল আভা দিচ্ছে। চোখের ঘন পাপড়ি ভিজে যেনো আরও গাঢ় দেখাচ্ছে। গালের দুপাশে লেপ্টানো চুল। গোছালো ভ্রু যুগলের সাথে আরশান নিজের কপাল ঠেসে ধরে বললো
-এতো দেরি কেনো অন্তি। আমার বুঝি হারানোর ভয় করে না? এতো কিসের অপেক্ষায় রাখো? রানী হতে চাও তো? তবে আমি যোগ্য রাজা হয়ে এসেই তোমায় আমার রানী করবো।

অন্তির গলায় আবেগ ধরে এলো। আরশানে হাত চেপে ধরে বললো
-আর যদি কারাবন্দী হয়ে জীবন কাটাতে হয়। সামান্য প্রজা হয়ে যাই? রাজার রানী হওয়ার স্বপ্ন টা যদি বিচ্ছিরি কোনো রূপকথায় রূপ নেয়?

আরশান অন্তির থেকে সরে এসে নিজের সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে অভিমানি সুরে বললো

-আমি মাস্টার লক করি নি। চাইলেই বেড়িয়ে যেতে পারো।

অন্তির বুকে কেমন জানি চিনচিনে ব্যাথা। এই ছেলের প্রেমে পড়েছিলো দুটি কারনে। নেহাত বাচ্চা ছিলো কিনা তখন।
আরশানের ডান গালের এক পাশে একটা তিল। আর ছেলেটার মাত্রা ছাড়া পাগলামি।

পাগলামিটা এখনও আছে। তবে তিলটা দাড়িতে ঢাকা পড়েছে। তাতে কি?এছেলে এখন আরো বেশি পাগল করে অন্তিকে। ভ্রু ছুঁয়ে ভেজা চুলগুলোর এলোপাথাড়ি পড়ে থাকা দেখে অন্তির হাত যেনো নিশপিশ করছে। ইচ্ছা করছে গামছা দিয়ে মাথা মুছে দুই গালে হাত রেখে চোখে চোখ দিয়ে বকতে বকতে বলুক
-এই ছেলে, এতো অযত্ন করো কেনো নিজের? ঠান্ডা লাগবে জানো না?

তবে অন্তি অমন কিছু না করে বিষ্ময়ের সীমা পার করে দিয়ে আরশানকে জাপটে ধরলো।

আরশান হাসলো বিশ্ব জয়ের হাসি।

-অন্তি তুমি কি হিটলার আর ইভা ব্রাউনের ভালোবাসার গল্পটা জানো? পরিবার আর প্রেমের বোঝাপড়ায় মিলেনি। তবুও কিন্তু মৃত্যুর দু- এক ঘন্টা আগে তারা বিয়ে করেছেন। ছেড়ে যেতে কারন লাগে না। আর ধরে রাখতে চাইলে শুধু একটা কারনেই ধরে রাখা যায় অন্তি। সেটা ভালোবাসা।

অন্তি আচলের পানি ঝরাতে ঝরাতে বললো
-লাইলি মজনু, সিরি ফরহাদ সব উদাহরন রেখে এই উদাহরণ দিলে যে?
-জানিনা। অন্তি আমি আজ আবার বৃষ্টির সাথে বাজি ধরেছিলাম।

অন্তি আঁচলের কোনায় চোখের নিচে লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছতে মুছতে হা করে আরশানের দিকে তাকালো।

-অন্তি আমি জানতাম কোনো এক বৃষ্টি আমাদের মিল করিয়ে দিবে। সেদিন তোমার থেকে আসার পর একটা দিনো আকাশ মেঘ করে নি। তা না হলে এতো ক্ষরার পর আজই কেনো আবার ঝুম বৃষ্টি হবে?
আমি জানতাম অন্তি তুমি আসলেই বৃষ্টি হবে। প্রকৃতি স্নিগ্ধতা ছড়াবে। আর আমার বৃষ্টি কন্যা আমায় দেবে মুগ্ধতা।

বৃষ্টি শেষে হলদে বিকেল আর সেই বিকেলের সোনালী আভা অন্তির মুখে ছড়িয়ে পড়ার মুগ্ধতা আরশানকে ১০৩° ডিগ্রি জ্বরেও প্রেম প্রেম অনুভূতিতে ডুবাচ্ছে।

চলবে….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here