চলো তবে শূন্যতা ধরে হাঁটি পর্ব ১৬+১৭

#চল তবে শূন্যতা ধরে হাঁটি
Zannatul ferdaous zannat
part:16

ভেজা চুল গুলো বার বার উড়ে এসে আরশানের মুখের উপর পড়ছে। এই মেয়ে গাড়ির জানালার কাচ লাগাতে দেয় না। কেমন এক বাচ্চামি। তার যেনো প্রকৃতির পুরোটাই উপভোগ করতে হবে, এমনকি বাতাসও। তবে এতে আরশান বেশ ভালো লাগছে। অন্তির চুলের একটা মোহময় গন্ধ আছে, যা আরশানকে পাগল করে তুলছে।

অন্তির দিকে তাকিয়ে আরশান হেসে বললো
-তোমাকে আকাশী রংএর শাড়ীটাতে এক টুকরো আকাশের মতো লাগছে অন্তি।

কথাটা শুনে অন্তি হাসলো।
আরশান বরাবরই অন্তিকে মুগ্ধ করে। এই যে এখন সাদা রং এর শার্ট আর গ্রে রং এর স্যুট পরেছে, আবার উপরের দুটো বোতাম খুলে রেখেছে। একটা পুরুষ মানুষ এতোটা আকর্ষনীয় হতে পারে আরশান যেনো তার অন্যতম প্রমান।

আরশানের থেকে চোখ সরিয়ে অন্তি আবার জানালার বাইরে তাকালো। অন্তি একা একাই হাসছে।আরশানের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত সুখের হয়। প্রতিটা মিনিট যেনো ষাট সেকেন্ডের থেকেও দ্রুত শেষ হয়। অন্তি চোখ বন্ধ করেই আরশানকে ভরসা করতে পারে। আচ্ছা অন্তিকে আবার আরশানের থেকে আলাদা হতে হবে না তো?

গাড়ির ঝাকুনিতে অন্তির ঘুম ভেঙে যেতেই আরশানের দিকে লজ্জিত ভঙ্গিতে তাকালো।
এতোশত ভাবতে ভাবতে কখন যে অন্তির চোখ লেগে এসেছিলো নিজেও জানেনা। আর কাল রাতেও ঠিক ভাবে ঘুম হয় নি তাই গাড়ির দুলনীতে চোখটাও লেগে গেছিলো।

আরশান অন্তির সিট বেল্ট টা খুলে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে অন্তির সাইডের দরজাটা খুলে ইশারায় নেমে আসতে বললো।

চারপাশ দেখে অন্তির মনে হলো আশেপাশের সব কিছুই বিভিন্ন বহুতল ভবন বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান। আরশান এখানে কেনো এনেছে প্রশ্নটা করার আগেই অন্তির ডান হাতটা আরশান তার বা হাতের মুঠোয় নিয়ে হাটতে শুরু করে দিলো। তারপর লিফট ধরে সোজা চারতলায় এসে লিফট থেকে বেড়িয়ে অন্তির দিকে তাকিয়ে হেসে বললো
-তোমার জন্য অনেক বড় একটা সারপ্রাইজ আছে অন্তি। কিন্তু তুমি মোটেও নার্ভাস হবে না বলো।

আঁচল টানতে টানতে অন্তি বললো
-তোমার বন্ধুদের তো আগেও দেখেছি। নার্ভাস কেনো হবো?

আরশান শুধু একটা রহস্য ময় হাসি দিয়ে আবার অন্তির হাত ধরে নিয়ে একটা কেবিন এর সামনে এসে থামলো।

অন্তির যেনো এবার সত্যিই ভয় লাগছে।
আরশান দরজা খুলতেই অন্তি দেখলো একজন মাঝ বয়সী লোক খুব মনোযোগ সহকারে লেপটপ-এ কাজ করছেন।

আরশানের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আরশান দরজান নক করে সামনের লোকটার উদ্দেশে বললো
-বাবা আসবো?

লোকটা যেনো ঝটপট সামনে তাকিয়ে হেসে বললেন
-আসো

অন্তির হাত পা কেমন যেনো অবশ অবশ লাগছে। এই ছেলেটা এতো বড় একটা কাজ করার আগে অন্তত একবার অন্তিকে জিজ্ঞেস করতে পারতো।
কাপা কাপা পায়ে অন্তি ভেতরে ঢুকতেই আরশানের বাবা নিজে থেকে এগিয়ে এসে বললো
-কেমন আছো মা? কালই আরশান তোমার কথা বললো। আর ওর এতো আগ্রহ দেখে আমারও কেনো যেনো তোমায় দেখতে মন চাইলো।

অন্তি একটু মৃদু হেসে আরশানের বাবার সাথে কথা বললো।

আরশান আর ওর বাবা এতোটা ক্লোজ আজ না দেখলে হয়তো জানাই হতো না অন্তির। আরশানের বাবা এতো সহজে অন্তিকে মেনে নিবে তা হয়তো অন্তি কল্পনাও করে নি।
দুপুরে খাবারের মেনুতে এতো এতো খাবার দেখে তো অন্তির রীতিমতো লজ্জা লাগছে।
এর মাঝে একটু পর পর অারশানের বাবা তো বলছেনই
-একদমই লজ্জা পাবে না মা, আরশান তো বলেছে তুমি কাল থেকে ঠিক মতো কিছু খাওনি। সকালেও নাকি হাদারাম টা তোমাকে শুধু শুকনো রুটি খাইয়ে রেখেছে।

এসব শুনে যেনো মেয়েটা আরও লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছে। এসব কিছু কেউ বাবার সাথে শেয়ার করে নাকি? আর নুনকেও সাথে আনে নি আরশান। মানে হয় কোনো। লজ্জা ভয় সব অনুভূতিতে যেনো অন্তির গলা দিয়ে খাবার নামছে না।

অন্তি কিছুটা খেয়ে আর খেতে পারলো না।
মেয়েটার এই লাজুক লাজুক ভাব, ধীর স্থির চলাফেলা, নিচু শব্দে কথা বলা সব কিছুই যেনো আরশানের বাবা কে মুগ্ধ করেছে।
অন্তিকে নিয়ে আরশানের বাবার কোনো আপত্তি নেই। প্রথমে অবশ্য একটু একটু দোটানায় ছিলেন তবে এখন অন্তিকে দেখে আর ছেলের এমন খুশি মুখ দেখে আরশানের বাবা যেনো আপত্তি করার আর কারন পেলেন না। আরও একটি সমস্যা হলো সৃজা। আরশানের মা অনেক বেশি আবেগ প্রবন। তাই হয়তো হুট করে অন্তির কথা শুনলে নাও মানতে পারেন, আর সৃজাকে তো তিনি ছোট থেকে কষ্ট পেতে দেখেছেন। তাই সৃজাকে আর কষ্ট দেওয়ার কথা আরশানের মা ভাবতে পারবেন না। এজন্যই আরশান আপাদত তার বাবাকে বুঝিয়েছে।

এখন তো আরশান তার বাবার মুখ দেখে বেশ বুঝতে পারছে অন্তিকে উনার বেশ পচ্ছন্দ হয়েছে।
আরশান তাদের পুরো অফিসটা ঘুরিয়ে দেখালো অন্তিকে। চলে আসার সময় অন্তি আরশানের বাবাকে সালাম করতেই তিনি অন্তির হাতে একটা কাগজের এনভেলপ দিলেন।

গাড়িতে বসে পুরোটা সময় যেনো অন্তির কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছিলো। সব কিছু স্বপ্ন স্বপ্ন। খুশি, রাগ মিশ্র অনুভূতিতে যেনো আরশানের সাথে কোনো কথায় বলতে পারছিলো না। রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই নিজের নার্ভাসনেস টা কাটানোর চেষ্টা করছে মেয়েটা। খুব তো বলেছিলো বন্ধুদের সাথে দেখা করাবে। এমনটা হবে জানলে কি অন্তি অপ্রস্তুত ভাবে চলে আসতো?

আরশান অন্তিকে একটা নদীর পাড়ে নিয়ে এসে বললো
-রোদ লাগছে অন্তি?

পানির স্রোতের দিকে তাকিয়ে অন্তি বললো
-সুন্দর বাতাস বইছে। নদীতে স্রোত আছে। প্রকৃতিতে একটা মিষ্টি গন্ধ আছে। এদিকটায় শহরের কোলাহল কম, একটু মনোযোগ দিলেই স্রোতের শব্দ শোনা যায়। এতো এতো ভালো কিছু রেখে কেনো রোদটাকে সমস্যা মনে করবো।

আরশান হাসলো। এই মেয়েটা সত্যি খুব বেশি প্রকৃতি প্রেমী।
অন্তির শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছে। আকাশের নীলের সাথে যেনো আসমানী শাড়ীতে মেয়েটা প্রকৃতির সাথে একদম মিশে গেছে৷ আর তার বাকানো চুল গুলোর এলোমেলো উড়ে বেড়ানো, আরশান মুগ্ধ চোখে দেখছে।

নিরবতা ভেঙ্গে আরশান বললো
-মা কে এখনই জানানো যাবে না। তবে বাবাকে একবার যেহেতু মানাতে পেড়েছি, দেখবে বাবাই সবটা সামলে নিবে। আর বাবাকে দেখে কিন্তু মনেও হলো তোমাকে উনার বেশ পচ্ছন্দ হয়েছে। এখন সবটা বাবাই করবে। শুধু আমার একটা চাকরি হয়ে যাক।

অন্তি আরশানের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো
-তোমাদের এতো বড় অফিস, বিজনেস থাকতে কেনো তুমি চাকরি খুজছো বলো তো? তুমি কেনো ইন্জিনিয়ারিং পড়তে গেলে৷ বেশ হতো বিজনেজ নিয়ে পড়তে।

আরশান প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে বললো
-আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই অন্তি। আমার বাবাও কিন্তু নিজের চেষ্টাই এতোটা সফলতা পেয়েছেন। তিনিও আমার দাদুর সাহায্য নেন নি। যদিও সব কিছুই আমাদের তবুও সেগুলো সেভাবেই আছে। আমরা শুধু আমাদের দাদুর বানানো বাড়িতে থাকি৷ জানোই তো আমার মা কতোটা আবেগী। ও বাড়ি তিনি ছাড়বেন না।

অন্তি আর কিছু বললো না। আরশানের কথা গুলো তার খুব মনে ধরেছে। তবে আর একটা ভয়ও মনের ভেতর আছে। আর অনেক প্রশ্নও অন্তি মাথায় ঘুর পাক খাচ্ছে। আচ্ছা অন্তির বাবা মা যদি না মেনে নেয়? আর সৃজা, সৃজার কি হবে?

ধরা গলায় অন্তি বললো
-আরশান আমার বাবা মা যদি মেনে না নেয়?

আরশান কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো
-আমার জন্য যদি সব কিছু ছেড়ে আসতে হয় অন্তি তাহলে কি তুমি আসবে?

অন্তির গলাটা যেনো শুকিয়ে গেলো
ভেজা চোখে তাকিয়ে, কাপা কাপা গলায় শুধু বললো

-শান!

উত্তরটা আরশান পেয়ে গেছে। সব যেনো থেমে গিয়ে নিরবতা ভর করেছে দুজন কেই।

আরশান আর কিছু বললো না। রিসোর্টে ফিরে এসেও সারাদিন আর অন্তির সাথে দেখা করলো না।
রাতে সবার সাথে খাবার খেতে বসেও চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে গেলো।

আরশানের এই অবহেলা গুলো অন্তিকে যেনো খুব বেশি কষ্ট দিচ্ছে।

অনেক রাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে আরশান ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলতেই অন্তি আরশানকে জড়িয়ে ধরেই কান্না করে দিলো। তারপর কান্না করতে করতে বললো
-শান আমি বাবা মাকে ছাড়তে পারবো না। তোমাকে ছাড়াও বাঁচবো না। কি করবো আমি শান?

আরশান আর কিছু বলতে পারলো না। শক্ত করে জড়িয়ে নিলো অন্তিকে।

চলবে…
চল তবে শূন্যতা ধরে হাঁটি
Zannatul ferdaous zannat
part:17

সেদিনের পর আরশানের সাথে অন্তির আর ভালো ভাবে সময় কাটানো হয়নি, ভালো করে দেখা হয় নি। রিসোর্ট থেকে সবাই পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সকালের নাস্তা করেই বাড়ি ফিরে এসেছে। এরপর আবার সেই ব্যাস্ত জীবন।

গত মাসেই আরশানের একটা বিশ হাজার টাকার বেতনের চাকরি হয়েছে। ছেলেটা এতো ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে যে নিজের দিকে খেয়াল করারও সময় পায় না।
সপ্তাহের ছয়টা দিনই নয়টা-পাঁচটার রুটিনে যেনো হাঁপিয়ে উঠছে। চাকরি হওয়ার পর এই এক মাসে মাত্র একদিন অন্তির সাথে দেখা হয়েছে আরশানের।

এর মাঝে অন্তির পরীক্ষার ব্যাস্ততা আর নিজেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সেল্ফ ডিফেন্স শেখায় ব্যাস্ত।

সে মাসেই তারা বাসাটা পাল্টে অন্য এলাকায় সিফট হয়ে গেছে। অন্তির বাবা আগে ভাগেই সব খোঁজ খবর নিয়ে রেখেছেন। এবাড়িতে তেমন কোনো ব্যাচেলর ছেলে মানুষ নেই। বাড়ির মালিক তার স্ত্রী আর দুটো সন্তান নিয়ে থাকেন। একটা বাচ্চা ফোরে পড়ে, আর একজন ক্লাস এইট এ।
আর অন্যান্য ফ্লাটেও তেমন কোনো ঝামেলা উনার চোখে না পড়ায় এ বাসাটাই ভাড়া নিয়েছেন।

বাসা ছেড়ে আসার পর কিছুদিন বিহন খুব রাস্তাঘাটে বিরক্ত করলেও এখন আর সামনে আসে না। অন্তির পুরো মনোযোগ এখন পড়ালেখায়।

অন্যান্য দিনের মতো আজও ক্লাস শেষে বাসায় ফেরার জন্য ভার্সিটি গেটের বাইরে বের হতেই আরশানকে দেখে যেনো অন্তি খুশি ধরে রাখতে পারলো না। একছুটে আরশানের সামনে এসে দাঁড়ালো। অন্তিও মনে মনে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে ছিলো।

ভালোবাসার মানুষটা পাশে থাকলে হঠাৎই যেনো সাহস টা বেড়ে যায়, মন অবাধ্য হয় আর মাথা চাড়া দিয়ে উঠে একান্ত সময় কাটানোর আকাঙ্খা।
এদের ক্ষেত্রেও তাই হলো। আরশান তার স্যালারী পেয়েই অন্তির সাথে দেখা করতে চলে এসেছে।

গাড়িতে উঠতেই আরশান হাতের মুঠো ভরে কয়েকটা বেগুনী রং এর জারুল ফুল অন্তির দিকে এগিয়ে দিলো।
অন্তি যেনো বিস্ময়ে একবার আরশানের দিকে আর একবার ফুল গুলোর দিকে তাকালো।

আরশান হাসতে হাসতে বললো
-এটা জারুল ফুল অন্তি। তোমায় বলেছিলাম না কোনো একদিন দিবো তোমায়। আজ আমাদের বাড়ির পিছনের দিকটার বনে কয়েকটা ডালে ফুল ফুটেছিলো, আমি সব এনেছি তোমার জন্য।

অন্তি ফুল গুলো হাতে নিয়ে তারপর শুকলো। বিশেষ কোনো গন্ধ নেই এই ফুলের। তবে রংটা বেশ।

আরশানের দিকে হাসি হাসি মুখ করেই বললো
-আজ কি তুমি অনেক খুশি শান?

ছেলেটা কোনো জবাব দিলো না। একটু মিষ্টি হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
বাবা, মা এবং নুন এর জন্য টুকিটাকি জিনিস কেনার পর অন্তির জন্য আরশান একটা নীল পাড়ের সাদা শাড়ি কিনলো।

একে একে যেনো আরশানের সব স্বপ্ন সত্যি হচ্ছে। এখন শুধু ঝুম বৃষ্টির অপেক্ষা। বৃষ্টি হলেই আরশান যেনো অন্তির হাত ধরে বেড়িয়ে পড়বে রাজ পথে। দুজন সারাবেলা ঝুবঝুবে ভিজে কাঁপতে থাকবে শীতে। অন্তির শাড়ির কুচি সামলে হাঁটতে হাঁটতে কাঁদা মেখে পা একাকার করবে। ইশ যখন বিজলীর ঝলকানিতে অন্তি ভয়ে আরশানের হাত চেপে ধরবে তখন কি আরশানের ভেতরে নতুন কোনো বজ্রপাত হবে?
ভিজতে ভিজতে টং দোকানে বসে চা খেলে কেমন হয়। গরম ধুয়া উঠা চা সাথে বৃষ্টির পানি। কেমন একটা স্বাদ হবে চা টার?

-ক্ষুধা পেয়েছে শান।
অন্তির মুখে কথাটা শুনতেই আরশান বাস্তবে ফিরে এলো। অন্তির দিকে তাকিয়ে বললো
-বৃষ্টিতে ভিজে আমার সাথে চা খাবে অন্তি। বৃষ্টির পানির সাথে ধুয়া উঠা চা মিশে একাকার হয়ে যাবে। পানি উপচে পড়া কাপে চুমুক দিতে দিতে তোমার খুলে যাওয়া চুলের খোঁপা ঠিক করার বৃথা চেষ্টা টুকু দেখতে মন চাচ্ছে।

অন্তি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো
-তুমি পাগল হয়ে গেছো শান। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু পেলে হয় মানুষ সেটার মূল্য দেয়না, অথবা সেটাকে মাথায় করে রাখতে যেয়ে চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যায়। তুমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছো। বৃষ্টির পানি দিয়ে চা? কতোটা বিস্বাদ হবে বুঝতে পারছো?

আরশান আর কিছু বললো না। সত্যিই তো তখন থেকে কি সব আবোল তাবোল ভাবছে। হঠাৎ মনে হলো অন্তি ক্ষুধা লাগার কথা বলেছিলো। তাই অন্তিকে বললো
-কি খাবে অন্তি?
-বিরিয়ানি

অন্তি ঠিক বুঝেছে ছেলেটার মনখারাপ করেছে। ওর মন ভালো করার জন্যই বিরিয়ানির কথা বললো অন্তি। আরশান এতো বিরিয়ানি পচ্ছন্দ করে যে তার পেট ভরে খাবার গলা অব্দি চলে আসলেও একপ্লেট বিরিয়ানি খাওয়ার জায়গা হয়ে যাবে।

এরপর টুকটাক কথা বলতে বলতেই মান অভিমান ভেঙে গেছে দুজনের। অনেক দিন পর একসাথে এতোটা সময়। কখন যে তিনটা ঘন্টা পেরিয়ে গেছে সেদিকে কারো খেয়ালই ছিলো না। তাই বিকালে আর অন্তিকে একা ছাড়লো না আরশান৷ নিজে গাড়ি করে অন্তিদের বাসার সামনের গলির সামনে পর্যন্ত দিয়ে গেলো।

গাড়ি থেকে অন্তি নামতে ধরলে আরশান অন্তিকে থামিয়ে হঠাৎই কপালে একটা চুমু দিয়ে বসলো।
অন্তি জানেনা হঠাৎ কি হলো? কেনো যেনো তার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। খুব আরশানের বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। তবে অন্তি আর দেরি করলো না। গাড়ি থেকে খুব দ্রুত বেরিয়ে আসলো। আরশানের সামনে নিজেকে আবেগী প্রকাশ করতে চায়না সে। তার ভেঙে না পড়ার আত্মবিশ্বাস আরশানকে অনেক বেশি এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।

বিকেলের শেষ ভাগ। চারপাশে আলো একটু একটু করে কমে আসছে। অন্তি মেইন দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই একটা বড়সড় ধাক্কা খেলো।
আজ সকালে অন্তির বাবার চট্টগ্রাম চলে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু এখনো বাবাকে সোফায় বসে থাকতে দেখে অন্তির গলা শুকিয়ে গেলো।

নিশব্দে এগিয়ে গেলেও অন্তির বাবা তাকে ডাক দিতেই একদম দাঁড়িয়ে পড়লো অন্তি।
-তুমি কি ক্লাস শেষে কোথাও গিয়েছিলে অন্তি?

বাবার মুখে এই প্রশ্ন শুনে আত্নার ধুকপুকানি আরও বেড়ে গেলো মেয়েটার। কোন মতে তুতলিয়ে তুতলিয়ে বললো
-আম-মি এক বান্ধবীর সাথে বেড়িয়েছিলাম একটু বাবা।
-তা বেশ তো। এখানে এসে বসো।

হাসনাত সাহেব উনার পাশের খালি সোফায় অন্তিকে বসার জন্য বললেন, তবুও অন্তি না বসে দাঁড়িয়ে থাকলো। সত্যি বলতে তার সাহসে কুলচ্ছে না বাবার পাশে বসার।
হাসনাত সাহেব আবার বললেন,
– তোমার বন্ধু হয়েছে অন্তি? আর বান্ধবি কয় জন? বেস্টফ্রন্ড আছে কোনো?

কাঁপা শরীরটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে অন্তি বললো
-আমার দুটো বান্ধবী হয়েছে আর একজন তো প্রিয়াই। তেমন কোনো বন্ধু নেই।
-এসময় বন্ধু বান্ধবী বানাবে বুঝলে। আড্ডা দিবে। একসাথে সবাই হৈ হৈ করবে। দেখবে কতোটা উৎফুল্ল লাগে।
অন্তি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

এর মাঝেই একজন মাঝবয়সী লোক তাদের বসার ঘরে ঢুকলেন। অন্তির বাবা লোকটাকে দেখে খুব খুশি হলেন, যেনো এতোক্ষন এই লোকটার জন্যই তিনি অপেক্ষা করছিলেন। অন্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাকে চাচা সম্বোধন করতে বললেন অন্তির বাবা। সালাম দিয়ে কিছু কথা বলে অন্তি তার বাবার অনুমতি নিয়েই নিজের ঘরে চলে গেলো।

লোকটার সাথে একটু আধটু ব্যাবসা নিয়ে কথা বলতেই এক কথার ফাঁকে হাসনাত সাহেব কে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন
-মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেললেন বললেন না তো ভাই। আমাদের কি শুধু ব্যাবসা নিয়ে আলাপ। এমনি কোনো সম্পর্ক নাই?

হাসনাত সাহেব বেশ অবাক হয়ে বললেন
-কি বলেন ভাই? বিয়ে?

-হ্যা। আপনার তো লটারি লেগে গেছে ভাই। আমার অফিসের বসের একমাত্র ছেলে আপনার জামাতা। বিরাট ব্যাপার বলেন। মামনিযে আপনার মেয়ে আর এতো বড় হয়ে গেছে জানতেই পারলাম না।

-দেখুন আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।

-কি ভুল হবে হাসনাত ভাই? সেদিন বস কতোটা খুশি হয়ে উনার ছেলের বউকে সবার সাথে পরিচয় করালেন। তাছাড়া আজও তো ছোট স্যার মানে আরশান সাহেবকে গাড়ি নিয়ে এই এলাকাতেই দেখলাম। আপনি কেনো যে লুকাচ্ছেন বুঝলাম না।

মুহুর্তেই যেনো হাসনাত সাহেবের রাগ উঠে গেলো। চোখ দিয়ে রক্ত বের হবে এমন কিছু। আরশান!
এই ছেলেটা এতোবছর পরেও কেনো অন্তির জীবনে? আর অন্তি এতোটা সাহস পেলো কোথায়?

নিজের মেয়েকেও হাসনাত সাহেবের চোখে অনেক নিকৃষ্ট লাগছে। এতো মিথ্যা, আবারো মিথ্যা বলছে ওই ছেলের জন্য?

জানালার ধারে অন্তি দাঁড়িয়ে। পায়ের কাছেই পড়ে আছে আরশানের প্রথম বেতনে কিনে দেয়া শাড়িটার পুড়ে যাওয়া ছাই। হাতও এখানে সেখানে পুড়ে ফোসকা পড়ে গেছে৷ অন্তির বাবা যখন শাড়িতে আগুন লাগিয়েছিলো মেয়েটা অনেক চেষ্টা করেছে আগুনটা নেভানোর, পারে নি। বিনিময়ে আরও বেশি মাইরও সহ্য করতে হয়েছে। ছাইগুলোর দিকে তাকিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকালো অন্তি। আজ রাতটা খুব বেশি আঁধার। হয়তো অমাবস্যা।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here