চলো তবে শূন্যতা ধরে হাঁটি পর্ব ১৫

#চল তবে শূন্যতা ধরে হাঁটি
Zannatul ferdaous zannat
part:15

পৃথিবীতে কিছু মুহূর্ত অপার্থিব। এই যে এখন অন্তি জেগে গেলেই আরশানের বুক থেকে সরে যাবে, এইটা যেনো আরশানের শান্ত বুকটায় আবার উথাল-পাথাল তুলে দিচ্ছে।
অন্তির গালের উপর পরে থাকা ছোট চুল গুলো আরশান দুই আঙ্গুলে সরিয়ে দিয়ে মায়াবি মুখ টা দেখতে লাগলো। মেয়েটার নাকের উপর হালকা ফোঁটা ফোঁটা ঘাম চিকচিক করছে, ভ্রু জোড়া কুচকে ঘুমাচ্ছে, যেন ঘুমের মাঝের রাজ্যের চিন্তা ঘিরে ধরেছে।

বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আরশান মোবাইল টা হাতে নিয়ে সময় দেখে নিলো। ০৫ঃ১২ বেজে গেছে। আর দেরি না করেই অন্তির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ডাকতে লাগলো
-অন্তি উঠো, সবাই জেগে যাওয়ার আগেই ওই রুমে যেতে হবে তো। সকাল হয়ে গেছে।

এতে বিশেষ লাভ না হলেও অন্তি যেনো নড়ে চড়ে আরও বেশি করে লেপ্টে গেলো।

ঘুম ভাঙ্গানো টা যে জরুরি, আরশান অন্তির কপালের উপর পরে থাকা কয়েকটা চুল নিয়ে অন্তির নাকে, কানে সুড়সুড়ি দিতেই অন্তি ধরফর করে উঠে বিছানায় বসে গেলো। ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটলো যে অন্তি আরশানকে চোখের সামনে দেখে “ও মা” বলে চিৎকার করলো।

আরশান উঠে বসে অন্তির হাত ধরে বললো
-কি হলো?
-ভয় পেয়ে গেছি, হঠাৎ ঘুম ভাংতেই তোমায় দেখলাম তো।

আরশান টি শার্টের গলাটা টেনে মুখে বিশেষ ভাব এনে বললো
-করো করো অভ্যাস করো ঘুম থেকে উঠে আমায় দেখার। সারাজীবন তো দেখতে হবে এই মুখ টা।
-এহ বাঁদরমুখো।
-এই বাঁদরকেই তো আবার মুগ্ধ হয়ে দেখো পেঁচি মুখী একটা।

অন্তি আরশানের কথায় চোখ বড় বড় করে আরশানের দিকে তাকালো। তারপর মুহূর্তেই নিজের নাক চোখ মুখে হাত ছুঁইয়ে বললো
-আমি কি পেঁচার মতো দেখতে?
-না পেঁচীর মতো।

অন্তি মুখ টানা দিয়ে চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে আরশানের দিকে আড়চোখে তাকাতেই দেখলো তার দিকে ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। অন্তি ব্রু নাচিয়ে চোখের ইশারায় বললো, “কি?”

আরশান দুই হাতের তালুয় ভর করে একটু হেলে বসে বললো
-শাড়ি পড়া থাকলে তোমায় বেশ লাগতো। বাঙ্গালী মেয়েরা যখন শাড়ী পড়ে আঁচল টা কোমরে গুঁজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে চুলে খোঁপা করে ওই মুহূর্ত টা কতোটা মারাত্মক তুমি চিন্তাও করতে পারবে না অন্তি।

অন্তি কপাল কুচকে বললো
-তোমার কথায় মনে হলো এই সিনটা হাজার বার দেখে ফেলছো, কোন মেয়েকে দেখছো হুম?
-আরে আরে একবারও না। এইতো তেলেগু একটা মুভিতে দেখেছিলাম হিরোইন ওভাবে

অন্তি আর কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই বললো
-আমি মুভির হিরোইন না, তাই আমাকে যে ওতোটা আকর্ষনীয় লাগবে না এটা মাথায় রাখো। এখন বরং নুনকে ফোন দিয়ে দরজা খুলতে বলো।

আরশান ফোন কানে নিয়ে এলোমেলো পায়চারী করে নুন কে কয়েক বার ফোন দিয়ার পর নুন রিসিভ করলো। নুনের সাথে আরশান কথা বলতে বলতেই অন্তি চট করে টিশার্টটা পাল্টে রাতের বদলানো জামাটা পড়ে নিলো।

আরশান কথা শেষ করে অন্তির দিকে তাকিয়ে হেসে দিয়ে বললো
-তিন ঘন্টা স্রেফ তিন ঘন্টা ঘুমাবা, আজ আমরা অনেক ঘুরবো।
-কোথায় যাবে?
-তোমাকে আমার কয়েকজন বন্ধু দেখতে চেয়েছে। ওদের সাথে একটু দেখা করাবো। আর একটু ঘুরাঘুরি।
-কিন্তু আপু যদি কিছু বলে।

আরশান ফোনের দিকে মনোযোগ দিয়ে বললো
-কেমন শালী হলে বলো তো দুলাভাই ম্যানেজ করতে পারো না। শুনো অন্তি অভি ভাই ঠিক মানে ভাবিও কিছু বলবে না। আজ তোমার দ্বায়িত্ব হলো আমরা বাইরে যাওয়ার আগে তুমি ভাইকে ম্যানেজ করবা। আমি কিছুই বলবো না।

-আমি এসব পারিনা। আমার কেমন যেনো আনইজি লাগে।

আরশান আর কিছু না বলে শব্দ করে হাসলো।
অন্তি নুন এর রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আরশান অন্তিকে ডাক দিলো।

অন্তি পিছন ঘুরে বললো
-কি?
-তুমি কি জানো আমাদের এক সাথে কোনো ছবি নেই। একটাও না।

অন্তি হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো
-এইটা বলতে ডাকলে?
-হ্যা
-তুমি কি জানো আমাদের ছবি আছে তবে এত্তোটা দূরত্ব থেকে। একপাশে তুমি আর সৃজা, মাঝে পুনম আপু আর অাভি ভাইয়া আর এক পাশে আমি।
-আমি তো দেখলাম না।
-আমার কাছে আছে ওইটা।
-ছিড়ে ফেলে দিও। এখন যাও ঘুমাও।

অন্তি আর দাড়ালো না। চট করে নুন এর রুমের দরজার সামনে এসে দেখলো মেয়েটা ঘুম ঘুম চোখে দরজা ধরে দাড়িয়ে আছে।
অন্তিকে দেখেই একগাল হেসে বললো
-ভাবি ঘুম ভাংলো?
-অনেক ঘুম পাচ্ছে গো। কিন্তু সে বলে দিলো মাত্র তিন ঘন্টা ঘুমানোর সময়, তারপর কোথায় জানি নিয়ে যাবে।
-বাহ।

নুন আর কথা বাড়ালো না। অন্তি বিছানায় শুতেই অন্তিকে জড়িয়ে ধরে বললো
-ভাইয়া,কিন্তু অনেক খুশি তোমাকে পেয়ে। তুমি আবার চলে যাবে না তো?
-না নুন, এখন আর যাওয়ার চান্স নেই।

নুন চট করে উঠে বসে বললো
-কেনো? তোমরা কি তাহলে

অন্তি নুন এর প্রশ্ন বুঝতে পেরে নুন কে থামিয়ে বললো
-এমা ছি ছি! অমন কিছু না। আমি বুঝাতে চেয়েছি আমরা এখন এটুকু বুঝেছি যে আমাদের ভালোবাসা অনেক গভীর, কেউ কাওকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
-ওহ। তবে আমি তো ভাবলাম
-হয়েছে পাকনা বুড়ি, এখন ঘুমাবে চলো।

পাঁচ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে তবুও মেয়েটার ঘুম ভাঙ্গার নাম নেই। আরশান শুধু পায়চারী করছে। রাতেও অন্তি খুব একটা খাবার খায় নি, তারপর কতটা সময় জেগে কাটিয়েছে। এখন না জানি খুব ক্ষুধা পেয়েছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই আরশান অন্তির রুমে ঢুকে একটা বড়সড় ঢোগ গিললো।

সত্যি দূর থেকে প্রেম করে যাওয়া আর কাছ থেকে সামনাসামনি সময় কাটানো, একসাথে থাকা সব কিছুর মাঝে কতো পার্থক্য।
এইযে এই মেয়েটা ঘুমানোর সময় গালের নিচে দুই হাত দিয়ে ঘুমায় এমন ঘুমন্ত অবস্থায় না দেখলে হয়তো জানা হতো না কখনও।

মেয়েটা এতো এলোমেলো হয়ে কেনো ঘুমায়। আরশান এগিয়ে যেয়ে অন্তির গায়ে উড়নাটা ভালো করে জড়িয়ে দিয়ে কপালে চুমু দিলো।

বেশ কয়েকবার ডাকার পরই অন্তি উঠে বসে আরশানের দিকে তাকিয়ে থেকে ঘরে ঝোলানে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললো
-খুব দেড়ি করে ফেলেছি শান। আমার না রাতে ঘুম হয় নি। তাই কেমন যেনো শরীর টা দূর্বল হয়ে গেলো।তারপর আর ঘুমটাই ভাঙ্গলো না।
-অন্তি ইটস ওকে। সবাই খেতে চলে গেছে তোমারও তো ক্ষুধা পেয়েছে তাই আমি তোমায় ডাকতে আসলাম। আর শুনো এখনই একদম ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে আসো। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। আর কি বলেছিলাম মনে আছে তো, আজ কিন্তু ভাইকে তুমি ম্যানেজ করবা।

অন্তিকে আর কিছু না বলতে দিয়েই আরশান উঠে চলে গেলো। যাওয়ার আগে দরজা টা চাপিয়ে দিয়ে গেলো।

অন্তি ভ্যাবলার মতো কিছুক্ষণ আরশানের চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে উঠে এসে কাপড়ের ব্যাগ খুলে সব কাপড় নামিয়ে একটা আকাশী রংএর গোলাপি পেড়ে শাড়ি পেয়ে যেনো বিশ্বজয় এর হাসি দিলো।

তারপর আর দেড়ি না করে শাড়িটা নিয়ে ঝটপট গোসল করতে চলে গেলো। পরপর কয়েকবার প্রেজেন্টেশন রেজুলুশনের জন্য শাড়ি পড়ে পড়ে শাড়ি পড়ার কায়দা টা বেশ আয়ত্ব করেছে মেয়েটা।

শাড়ি পড়ে ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে বেড়িয়ে দেখলো আরশান বিছানায় বসে বসে ফোন গুতাগুতি তে ব্যাস্ত।

অন্তিকে শাড়ি পড়া দেখে অবাক হলেও বিষয়টা হজম করে নিয়ে বললো
-অন্তি এখন কষ্ট করে রুটি ডাল খেয়ে নাও। দুপুরে তোমার মন মতো যা চাইবে সব খাওয়াবো।
আর জানো ওরা সবাই আমাদের দুজনকে প্রেম করতে দিয়ে কোথায় যেনো ঘুরতে গেছে।

অন্তি কিন্তু মনে মনে বেশ খুশি, যাক ওকে তো আর অভির সামনে লজ্জায় পড়তে হলো না।
ইশ কিভাবে বলতো অভিকে
“ভাইয়া আমি আর ও একটু ঘুরতে যাবো, আপুকে একটু ম্যানেজ করবেন?”
ইশ কি লেইম শোনাতো। অন্তি কিভাবে বলতো এসব, ভাবতেই কেমন লজ্জা লাগছে।

অন্তি চোখে কাজল পড়তে পড়তে আরশান রুটি ছিড়ে ছিড়ে অন্তিকে খাইয়ে দিতে লাগলো। কয়েকবার মুখে তুলেই অন্তি বললো
-ইশ কি স্বাদহীন, বিস্বাদ। আমি আর খাবো না।

-কি বলো অন্তি, এইটা আমার খাওয়া বেস্ট রুটি ডাল।
-আমার অন্য কিছু খেতে মন চাচ্ছে যে।

আরশান উৎকন্ঠা নিয়ে বললো
-কি খাবে বলো, আমি দেখি ব্যবস্থা করতে পারি নাকি।
-চুমু।

দুইটা শব্দ “চুমু”। অথচ আরশানের হৃদস্পন্দন কেমন যেনো মুহূর্তেই থামিয়ে দিলো। কাপা কাপা গলায় আরশান বললো
-অন্তি?
-হ্যা, শান। আমার পাগল করা চুমু চাই। যেনো অনেকটা সময় , অনেকটা দিন পরও অনুভূতিটা আমাকে কাঁপিয়ে রাখে।

আরশান যেনো নতুন নেশায় মত্ত। এলোমেলো পায়ে অন্তির সামনে আসতেই অন্তি একপ্রকার পাগলের মতো আরশানকে আকড়ে ধরলো।

বেশ কিছুক্ষন পর অন্তি হেঁচকি তুলে কেঁদে দিতেই আরশান অন্তিকে ছেড়ে চোখে চোখ রেখে বললো
-আমি কি কোনো ভুল করলাম অন্তি, তোমাকে কি কষ্ট দিলাম? কাঁদছো কেনো?
-তুমি কি আমার অবর্তমানে কাউকে চুমু খেয়েছো?
-হুয়াট?
-হ্যা। বলেছো তো তোমার এত্তো গুলা এক্স।

আরশানের এখন নিজের চুল যেনো নিজের টেনে ছিঁড়তে মন চাচ্ছে। মানুষ মেয়েলি বিষয় গুলো বউ এর থেকে গোপন রাখে, আর উনি কিনা এসব নিজে যেচে এসে অন্তিকে বলেছে। এখন সন্দেহ করছে, বেশ হয়েছে।
আরশান মুখে হাসি হাসি ভাব রেখে বললো
-না অন্তি। আমি কারও ঠোঁটে মানে তুমি ছাড়া কাউকে চুমু খাইনি।
-সত্যি তো?
-হ্যা বাবা তিন সত্যি। এবার ঝটপট রুটি ডাল খেয়ে নাও। আমাদের বেরোতে হবে।

অন্তি যখন রুম থেকে বের হচ্ছে তার ভেজা চুল গুলোর ডগা থেকে টুপ টুপ করে পানি ঝড়ছে।
আরশানের চোখে যেনো তা মুক্তার দানার মতো লাগছে। দুপুরের কিছুমুহূর্ত আগের কড়া রোদটা প্রতি ফোঁটা পানিকে চিকচিকে একটা ভাব এনে দিচ্ছে।
আরশান মনে মনে বললো
-ইশ এই পানিতে যদি ডুবে যাওয়া যেতো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here