#চাঁদোয়া_মহল
পর্বঃ০৯
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা
মোরশেদ খন্দকারের সাথে সোফায় বসে খোশগল্প করছেন দোয়া মির্জা।দীর্ঘ তিন মাস পর ভাইয়ের দেখা পেয়ে বেশ উৎফুল্ল তিনি।মোরশেদ খন্দকার গত পরশু হজ্জ শেষে দেশে ফিরেছেন।বোনের জন্য বেশ কিছু নিয়ে এসেছেন।সব জিনিস গুছিয়ে রাখা দায়িত্ব পড়েছে লালির ওপরে।এসব কাজে সে এক্সপার্টও বলা চলে!!চাঁদোয়া মহলে মাসের বাজার যখন একসাথে আনা হয় তখন লিস্ট চেকিং দায়িত্ব পড়ে লালির ওপরে। সে চাঁদোয়া হলো মহলের জুনিয়র হাউজকিপার!আর লুবনা হলো তার সিনিয়র।
মোরশেদ খন্দকারের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে লালি জিজ্ঞেস করলো,
—-“জায়নামাজ,তসবিহ,আতর,খেজুর,জমজমের পানি সবই তো আনছেন দেহি,, দাদির লাইগা।তয় কাফনের কাপড় বাদ দিলেন কেন?”
মোরশেদ খন্দকার ভ্যাবাচ্যাক খেয়ে গেলেন।কি বলবেন তিনি,ভেবে পেলে না!দোয়া মির্জা লালির দিকে অগ্নি ঝরা চোখে তাকালেন।দাঁত কটমট করে বলে উঠলেন,
—-“তোর মুখ ইদানীং বেশি ফটফট করে,বুঝলি!!খালি কলসির লাহান হইয়া গেছোস,বেশি বাজতাসোস।”
এমন রাগ মিশ্রিত কন্ঠ শুনে লালির মুখ চুপসে গেল।দোয়ার মির্জার অগোচরে তাকে মুখ ভেঙচি দিয়ে,সে তার কাজে মনোযোগ দিলো।
————–
ঘুম থেকে উঠে প্রথমে রেখার বেশ অনুশোচনা হচ্ছিল।কাল যে এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে সে নিজেও বুঝতে পারে নি! সবাই মিলে কতো যত্ন করে তাকে শারাফের জন্য সাজিয়ে দিয়েছিলো,অথচ সে অপেক্ষা না করেই ঘুমিয়ে পড়েছে!ভেবেছিলো শারাফ হয়ত এ নিয়ে বেশ রাগ করবে তার সাথে।কিন্তু শারাফকে চেনা যে চন্দ্ররেখার এখনো অনেক বাকি! উদাসীন মনে বেলকনিতে দাঁড়িয়েছিলো সে।সকালের মৃদু বাতাস উপভোগ করছিলো। উন্মুক্ত কোমরে ঠান্ডা হাতের পরশ পেতেই কেঁপে উঠলো।দূরত্ব গুছিয়ে চন্দ্র রেখার কাঁধে থুতনি রাখলো শারাফ।নিরবতা ভাঙতে চন্দ্ররেখা নিজ থেকে বলে উঠলো,
—-“সরি!!আসলে কালকে যে এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাবো,আমি বুঝ…..
—–“হুশশ,আমার ভুল ছিলো অপ্সরা।আমার বউকে রেখে আমি এতো রাত বাহিরে ছিলাম।”
শারাফের ঘুম জড়ানো কন্ঠস্বর চন্দ্ররেখার দেহে কাঁপন ধরিয়ে দিলো।তার মুখ থেকে বউ ডাক শুনে রেখার মনের কোনে এক ধরনের সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যথা তৈরি হলো।সে কোনোভাবে শারাফের সাথে অন্যায় করছে না তো!!যেভাবে বিয়ে হোক সে তো চন্দ্ররেখার স্বামী।একবার ভরসা করতে তো দোষ নেই!তার মা তার বাবাকে রেখে চলে গেছে তাই বলে কি শারাফও এমন করবে!!নিজের মনকে প্রশ্ন করলো রেখা।উহু….একদমই না, একবার ভরসা করে শারাফের হাত ধরতে কোনো অসুবিধা নেই।এছাড়া এমন পরিবার পাওয়ার লোভে,সকলের ভালোবাসার পেতে সে শারাফকে একবার হলেও ভালোবাসার চেষ্টা করবে।আচ্ছা, শারাফ কি তাকে ভালোবাসে??কখনো তো কিছু বলে নি সে!কিন্তু শারাফ কেনই বা তাকে বিয়ের জন্য জোর করলো?তাকে প্রথম কোথায় দেখেছে সেটা জিজ্ঞেস করেও তো কোনো উত্তর পেলো না।মানুষটাকে রেখার মাঝে মাঝে বেশ রহস্যময় মনে হয়।
—–“আর কতো ভাববেন আমাকে নিয়ে….. হুমম?ভাবনার জন্য তো চিরকাল পরেই আছে।আপনি আছেন,আমি আছি।”
শারাফের কন্ঠে রেখার ধ্যান ভাঙলো।হুট করেই সে বলে উঠলো,
—“যদি আমি না থাকি?”
—“বিয়ে করেছি,আমার বউ আপনি!না চাইলেও আপনাকে আমার সাথে চিরকাল বেঁধে রাখবো।”
—“আমার বাবা তো মাকে বেঁধে রাখতে পারে নি।”
—-“আপনার বাবা হয়ত সেরকম চেষ্টাও করে নি।”
শারাফের মৃদু রাগ মিশ্রিত গলা শুনে রেখা দমে গেলো।এসব অহেতুক বিষয়ে কথা বাড়ানোর কোনো মানেই হয় না!চন্দ্ররেখা নিজেও তো জানে না তার বাবা মায়ের বিবাহিত জীবন কেমন ছিলো! শারাফ রেখাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করালো।কথার প্রসঙ্গ বদলে নরম সুরে বলতে লাগলো,
—–“আমি চাই আপনি আমার পরিবারকে,পরিবারের প্রতিটি মানুষকে মন থেকে মেনে নিন।হয়ত আপনার মনে আমাকে নিয়ে বেশ ক্ষোভ রয়েছে,কিন্তু আমি চাই না আমার জন্য আপনি তাদের কষ্ট দিন!আপনার যতো রাগ,অভিযোগ, দুঃখ, কষ্ট, ক্লেশ আছে সব আপনি আমার ওপরে প্রয়োগ করবেন।মাকে আপনার কাছে হয়ত কঠিন মানুষ মনে হতে পারে!কিন্তু মনের দিক থেকে একদম সরল তিনি।আপনি ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও মায়ের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবেন।আমার এতোটুকু আবদার রাখতে পারবেন না আপনি?”
উত্তরের আশায় রেখা মুখের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইল শারাফ।রেখার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, তীক্ষ্ণ চোখে শারাফের দিকে তাকালো।
—–“আমি আজীবন এমন একটা পরিবারের ছবি কল্পনার ক্যানভাসে এঁকেছি। ক্যানভাসের আঁকা প্রতিটি মানুষকে নিয়ে নিজের জগৎ সাজিয়েছি।এখন তাদের সামনে পেয়ে দূরে ঠেলে দিবো!আপনার আমাকে এতোটা বিকৃত মানসিকতার মনে হয়? আপনি নিজেও তো জানেন বাবা ব্যতীত আমার কেউ নেই।আপনার পরিবারকে আমি কি করে অবহেলা করি??”
শেষ কথা বলতে বলতে চন্দ্ররেখার মুখ বেশ মলিন হয়ে গেল।শারাফ চন্দ্ররেখার মলিন বদন খানা দু’হাতে আগলে ধরলো!ললাটে গভীরভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালো!রেখার চোখজোড়া আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেলো।নিরবে সেও শারাফের স্পর্শ অনুভব করলো।আলতো করে জড়িয়ে ধরলো শারাফকে।দুদিনেই মানুষটাকে নিজের মনে হচ্ছে।
——“আমি জানি আপনি এই পরিবারকে কখনো কষ্ট দিতে পারবেন না।এটা তো আপনারও পরিবার।”
—–
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো চন্দ্ররেখা।হলুদ ঘাসের ন্যায় টিয়া রাঙা সুতি শাড়িতে তাকে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে।আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে রেখেছে সে!চন্দ্ররেখার মন বেশ ফুরফুরে।আজ দুদিন পর বাবাকে দেখতে পাবে সে!রেখা দেখতে পেয়ে দোয়া মির্জার চেহারা খুশিতে চকচক করে উঠলো।প্রস্ফুটিত গলায় রেখা ডাক দিলেন।
—–“এইখানে আসো বুবু! একজনের লগে তোমার পরিচয় করায় দেই।আমার একমাত্র ভাই এইডা,তোমার নানা লাগে।”
তারপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন,”চৌধুরীর মাইয়া,আমার নাতনি এইডা।”
রেখা মোরশেদ খন্দকারকে সালাম দিলো। তারপর দোয়া মির্জার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—“নানা!কিন্তু কিভাবে?”
দোয়া মির্জা নিজের ভুল বুঝতে পেরে জিবে কামড় দিলেন।
—“দাদা হবে তোমার।শারাফের দাদা মানে তোমারও দাদা তাই না!!আম্মার বয়স হয়ে গেছে তাই কিছু মনে থাকে না।ভুলভাল বকে!”
সুধা মির্জার কন্ঠ শুনে রেখা পেছন ফিরে তাকালো।মূহুর্তে তার চোখ জুড়িয়ে গেলো।আইসবার্গ রঙের তাঁতের শাড়িতে সুধা মির্জাকে বেশ সুশ্রী লাগছে।তার দীপ্তিমান চোখজোড়া যেনো চিৎকার করে বলছে,চাঁদোয়া মহলের অঘোষিত রানী সে।রেখা মুখে মৃদু হাসি নিয়ে সুধা মির্জা দিকে এগিয়ে গেলো।
—-“আসসালামু আলাইকুম,ফুপুমা।আপনাকে মাশাল্লাহ বেশ সুন্দর লাগছে।”
সুধা মির্জার ঠোঁটের কোনে অজান্তে হাসি ফুটে উঠলো।তিনি কিছু বললেন না! রেখার হাত ধরে তাকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে যেয়ে বসলেন।কিচেন থেকে হলরুম পুরোপুরি স্পষ্ট।ননদকে এতোবছর পর হাসতে দেখে কিচেনে থাকা মোহিনী মির্জা ও তৃণা মির্জার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাজ করছিলেন তারা!একে অপরের দিকে তাকালেন।হয়ত!চোখে চোখে কথা বললেন।তাদের ধারণা চন্দ্ররেখাকে সুধা মির্জার পছন্দ হয়েছে,এতো কিছুর পরও একটা কিন্তু থেকে যায়!!
———-
হলরুমের একপাশে ষোলো চেয়ার বিশিষ্ট ডাইনিং টেবিলের আর্মচেয়ারে বসে আছেন সুধা মির্জা।বাকি চেয়ার গুলো যে যার যার মতো দখল করে বসেছে।জিমি-সিমি বরাবরের মতো পাশাপাশি বসে আছে,তারা আড়চোখে চন্দ্ররেখাকে পরখ করছে।মোহিনী মির্জা ও তৃণা মির্জা মাঝে বসে আছে চন্দ্ররেখা,দুই ননদের চাহনি দেখে বার বার লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সে!লুবনা ও লালি মিলে খাবার সার্ভ করছে।যেহেতু তারা সবসময় খাবার সার্ভ করে তাই আগেই নাস্তা সেরে ফেলেছেন।এটা চাঁদোয়া মহলের অলিখিত নিয়মও বলা চলে!!ইতিমধ্যে ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে মাসুকও উপস্থিত হয়েছে।শারাফ তার এক্সসারসাইজ শেষ করে মাত্র নিচে নেমেছে।তার দিকে তাকিয়ে মাসুক দুষ্ট হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—-“তা ভাই কালকে রাত কেমন কাটলো!খুব স্মরণীয় কেটেছে তাই না?”
শারাফ রাগী চোখে মাসুকের দিকে তাকালো।মোহিনী মির্জা ও সুধা মির্জার মুখ দেখে মনে হলো তারা বেশ বিব্রত। ছেলের কথা শুনে হাফিজ মির্জা বিষম খেলেন! কাশতে কাশতে তার চোখ আর নাক দিয়ে পানি এসে গেলো।তৃণা মির্জা স্বামীর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। তারপর জোরেই ছেলেকে গালি দিয়ে বসলেন।
–“ছোট্ট ছাগল একটা!কোথায় কি বলতে হয় এখনো সেটা বুঝে না।”
জিমি,সিমি,লালি,লুবনা এতো সময় হাসি চাপিয়ে রেখেছিলো। তৃণা মির্জার কথা কানে যেতে তারা উচ্চ শব্দে হেঁসে উঠলো। চন্দ্র রেখার লজ্জা পাওয়ার কথা থাকলেও,সে বিমোহিত চোখে সবাইকে নিরীক্ষণ করতে লাগলো। ইসস….এমন একটা যৌথ পরিবার পাওয়ার সৌভাগ্যই বা কয়জনের হয়!!
চলবে
২দিন পরে দেওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু আপনাদের জন্য আগেই দিলাম।সবাই কমেন্ট করবেন,আর আমার ভুল গুলো দেখিয়ে দিবেন।