চাদোঁয়া মহল পর্ব -০৮

#চাদোঁয়া_মহল
পর্বঃ০৮
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

মোহিনী মির্জা,তৃণা মির্জা, জিমি,সিমি,লালি প্রায় সকলে মিলে চন্দ্ররেখাকে নিয়ে এক প্রকার হৈ-হুল্লোড়ের লাগিয়ে দিয়েছে।কিভাবে চন্দ্ররেখাকে সাজাবে,কোন শাড়ি পড়াবে,কোন জুয়েলারিতে রেখাকে মানাবে তা নিয়ে সকলের মধ্যে এক প্রকার দ্বন্দ লেগে গেছে!এমন সময় দোয়া মির্জাকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে সকলের চোখ খুলে পড়ার দশা!সকলে ভেবেই নিয়েছিলো দোয়া মির্জা হয়ত নতুন বউকে দেখতেও আসবে না!

দোয়া মির্জার পেছন পেছন লুবনাও এসেছে।তার হাতে একগাদা জুয়েলারি বক্স।লুবনা,লালি দুই বোন;আজ পনেরো বছর যাবত চাঁদোয়া মহলেই তাদের অবস্থান।বয়সে লুবনা লালির চেয়ে ছয় বছরের বড়।লুবনার স্বামী রানা এ বাড়ির ড্রাইভার।প্রকৃতপক্ষে শারাফ আর চন্দ্ররেখার জন্য বাসরঘর সাজানো হচ্ছে। এর নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করছেন তৃণা মির্জা।তার শুধু এক কথা,ছেলে না জানিয়ে বিয়ে করেছে তো কি হয়েছে!তাই বলে কি তারা নিজেরা মিলে বাসর সাজাতে পারবে না?তার সহযোগী হিসেবে বাসর সাজানোর কাজে মাসুক,আরিফ, ইউসুফ সাথে রানাও যোগ দিয়েছে।দোয়া মির্জার মনে ঝড় বয়ে চললেও সে সামনাসামনি একদম স্বাভাবিক।তিনি তার শ্বাশুড়ির দেওয়া শাড়ি চন্দ্ররেখা গায়ে জড়িয়ে ধরলেন।চন্দ্ররেখার কপালে চুমো দিয়ে অতপর প্রসন্ন গলায় বলে উঠলেন,

——“এই শাড়িডা পরলে আমার বুবুরে এক ছের সুন্দর লাগবো।আমার নাতি তো চোখ ফিরাইবার পারবো না আইজগা।”

লজ্জায় রেখার গাল লাল হয়ে গেলো।এরমধ্যে জিমি কপাল কুঁচকে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

—“আমাদের ভাবি এমনেই সুন্দর, কিছু না পরলেও সুন্দর লাগবে।”

জিমির এমন বোকা বোকা কথা শুনে সিমি,লালি আর লুবনা গা দুলিয়ে হেসে উঠলো।কাছে থাকায় কেবল তারাই জিমির কথাটি শুনতে পেয়েছিলো।মোহিনী মির্জা মুখ ফুলিয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছেন।যখন থেকে শুনেছেন চন্দ্ররেখা তাজওয়ার চৌধুরীর মেয়ে,তিনি এক প্রকার আতংকে আছেন।হামিদ মির্জার কানে এ কথা গেলে কি করবেন কে জানে!!এর মধ্যে তিনি ভেবেছিলেন নিজের বিয়ের শাড়িটা একমাত্র ছেলের বউকে পরতে দিবেন।তা আর হলো কই!

রেখার আজ খুব সুখ সুখ মনে হচ্ছে। জীবনে এতো মানুষের ভালোবাসা পাবে সে কি কখনো ভেবেছিলো!চিরকাল মায়ের ভালোবাসার কাঙাল ছিলো সে!এখন তো তার তিন তিনটে মা।সে সত্যি ভীষণ ভাগ্যবতী, সাথে দুই দুইটাও বোনও পেয়েছে।কিছু সময়ে সকলের সাথে বেশ ফ্রী হয়ে গেছে সে।খুশিতে তার চোখে বার বার জল চলে আসছে।কেউ দেখার আগেই মুছে নিয়েছে। সকল অনুভূতি যে সবার সামনে প্রকাশ করতে নেই!এসব অনুভূতি যে অন্তরের অন্তস্তলে চিরকাল জমা রাখতে হয়। চন্দ্ররেখা এতো সময় ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ছিলো।কিছু একটা মনে করে সে উঠে দাঁড়ালো।তারপর গটগট পায়ে হেঁটে মোহিনী মির্জার সামনে যেয়ে করুণ স্বরে বললো,

—“মা,আমার খিদে পেয়েছে।”

মোহিনী মির্জা জিভে কামড় দিলেন,তার সারা মুখে অন্ধকার নেমে।ইসস,কি করে মেয়েটির কথা ভুলে গেলেন!তার যে এখন ভীষণ খারাপ লাগছে।শারাফ আর চন্দ্ররেখা বাদে সকলে আগেই রাতের খাবার সেরে ফেলেছে।শারাফ তার কাজে বাহিরে গিয়েছে।ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলো সে রাতে বাহিরে খাবে।আর চন্দ্ররেখা হাতে মেহেদী দেওয়ায় তার খাওয়া হয় নি তখন।

মোহিনী মির্জা খাবার হাতে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে কামরায় প্রবেশ করলেন।ভাত মাখিয়ে লোকমা তুলে চন্দ্ররেখার মুখের সামনে তুলে ধরলেন।রেখার বুক কেঁপে উঠলো,এ জীবনে বাবা ব্যতীত কারো হাতেই খায় নি সে। এ বাড়ির রান্না এতো মজা লাগছে কেনো?এতো খেয়েও তার পেট ভরছে না যে!!নাকি মায়ের হাতে খাচ্ছে বলে এমন মনে হচ্ছে!রেখার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে মোহিনী মির্জার হাতে পড়লো। তিনি বিচলিত হয়ে উঠলেন।

—–“ঝাল লাগছে বেশি?মরিচ চলে গেছে মুখে!পেট জ্বলছে নাকি?”

মোহিনী মির্জার প্রশ্নের জবাবে,রেখা কেবল মাথা নাড়লো।

–” মেয়ে তুমি,আগে বলবে না !!”

সিমি রেখার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে তার মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,

—-“কি যে করো না, মা!!একটু দেখে তো দিবে,নাকি?ভাবির মুখটা কেমন লাল হয়ে গেছে, দেখেছো!!

মোহিনী মির্জা এতো সময় দাঁড়িয়ে খাইয়ে দিচ্ছিলেন।চন্দ্ররেখা আচমকা তার কোমড় জড়িয়ে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

—-“বুকে জ্বালা হচ্ছে,ভীষণ জ্বালা!একটু কমিয়ে দিন মা।”

মোহিনী মির্জার কিছু বুঝলেন কি না বোঝা গেলো না!তিনি প্লেট ড্রেসিং টেবিলের কোনায় রেখে,চন্দ্ররেখার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।মূহুর্তে কক্ষ জুড়ে নিস্তব্ধতার বাতাস বয়ে গেলো।

——-

কক্ষের ফ্যান,লাইট,এসি সবকিছুই আজ বন্ধ।বেলকনিতে জ্বলতে থাকা টিউব লাইটের কিছুটা রশ্মি ঘরে প্রবেশ করছে।অস্পষ্ট আলো কামরাটিকে দুর্বোধ্য করে তুলেছে।গ্রীষ্মের তপ্ত মৃদু বাতাসের সংস্পর্শে আসতেই জানালায় থাকা আচ্ছাদন হালকা নড়েচড়ে উঠছে।মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন সুধা মির্জা।চোখের জলে কার্পেটের কিছুটা ভিজে গেছে।জীবনের হিসেব যেনো কোনোভাবেই মিলছে না!!দুুবছর পূর্বেও নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন মানুষটাকে ভুলে যাবেন।আড়ালে থেকে খোঁজ খবর নেওয়াও এক প্রকার বন্ধ করে দিয়েছিলেন।চন্দ্ররেখাকে প্রথম দেখায় কিছুটা বিচলিত হয়েও পড়েছিলেন।ভাবতে পারেন নি যে তার আংশকাই ঠিক হবে!মানুষটা কি সুস্থ আছে?কতোদিন দেখা হয় নি!কতোবছর চোখের তৃপ্তি মেটানোর হয় নি!সকলের সুখে চিন্তা করেই তো এই মানুষটিকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন।তার একমাত্র অবলম্বন তো এখন চাঁদোয়া মহলের ঘরনি,সে কি জেনে শুনে চন্দ্ররেখাকে এই বাড়িতে পাঠিয়েছে!!নাকি এর পেছনে অন্য কাহিনি আছে।বড় ভাই যদি জানতে পারে যে রেখা তাজওয়ার চৌধুরীর মেয়ে,তিনি কি চুপ করে থাকবেন?সুধা মির্জা খুব ভালোভাবেই জানেন তার ভাইকে। রেখাকে অপমান করতে বিন্দুমাত্র পিছপা হবেন না তিনি।মেয়েটির কোমল হৃদয় কি মেনে নিতে পারবে সবটা? শারাফের সাথে কথা বলাটা যে খুব বেশি জরুরি!! তার আগে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষটার খবর নেওয়া।বুকপটের এই অসহনীয় পীড়া হ্রাস করার উপায় তো মাত্র একটাই!গৃহতল ছেড়ে আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন সুধা মির্জা।ঘড়ির দিকে তাকালেন,এগারোটা পনেরো মিনিট।প্রায় দু’ঘন্টা তিনি মেঝেতে আধো অচেতন অবস্থায় পড়েছিলেন।মাঝে কয়েকবার দরজা ধাক্কানোর শব্দ কানে এসেছিলো।খাওয়া জন্য ডাকতে এসেছিলো বোধ হয়!!উত্তর দিতে চেয়েও দিতে পারেন নি,গলায় মাছের কাঁটার ন্যায় কিছু একটা আঁটকে ছিলো।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বিক্ষিপ্ত রূপকে কিছুসময় কটাক্ষ করলেন।মন্থর গতিতে হেঁটে কাবার্ডের সামনে যেয়ে দাঁড়ালেন।সেখান থেকে সযত্নে আগলে রাখা কারুকাজ খচিত চতুর্ভূজ আকৃতির মাঝারি সাইজের একটা বক্স বের করলেন।বক্সের ভেতরে থাকা দুটি ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।একটি ছবিতে হাসোজ্জল তাজওয়ার চৌধুরীর কোলে কান্নারত চন্দ্ররেখা!!তাজওয়ার চৌধুরীর বাহু আঁকড়ে ধরে পাশে থাকা মহিলাকে দেখে সুধা মির্জা চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।অপরটি দুই বছর আগের চন্দ্ররেখার ছবি। মুখের হাসি কি স্নিগ্ধ,বাচ্চাসুলভ, মায়াবী চেহারা এই মেয়ে তার জন্য কতোই না কষ্ট পেয়েছে!চন্দ্ররেখার চেহারা দুই বছরে বেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে,প্রথম দেখায় তাই চিনতে পারেন নি।পারবেনই বা কি করে!! প্রায় সময় তো ছবিতেই দেখে এসেছেন। দীর্ঘশ্বাসের সাথে কয়েক ফোঁটা চোখে পানি গড়িয়ে পড়লো ছবিটার ওপরে।বক্সটি আগের জায়গায় রেখে দিয়ে,বিছানার পাশে থাকা ফোনটি হাতে তুলে নিলেন।ফোনের কনট্রাক্ট নম্বরে যেয়ে প্রার্থিত নম্বরে কল করলেন।দুইবার রিং হওয়ায় সাথে সাথে ফোনটি রিসিভ করলো কেউ।ওপাশ থেকে বজলুর গাম্ভীর্য ভরা কন্ঠ ভেসে আসলো।

—–“আসসালামু আলাইকুম, বড়মা!!এতো রাতে ফোন দিলেন যে!খুব বেশি দরকার?”

——“সেই মানুষটার খবর চাই বজলু,কালকে সকালের মধ্যেই চাই।”সুধা মির্জার বিচলিত কন্ঠস্বর।

—-“কিছু কি হইছে!!আপনারে চিন্তিত মনে হচ্ছে?”ওপাশ থেকে বজলু পুনরায় প্রশ্ন করলো ।

এবার সুধা মির্জা ঝাঁঝালো কণ্ঠে জবাব দিলেন।

—-“সবকিছু যদি আমি জানতাম, তাহলে তো আর তোমাকে খবর নিতে বলতাম না!যেটা বলেছি সেটা করো। আমাকে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করা বিষয়টি আমার একদম পছন্দ নয়।”

—-“জে আইচ্ছা!”

ফোন কেটে বেলকনিতে থাকা ডিভাইনে গিয়ে চোখ বুজে শুয়ে পড়লেন সুধা মির্জা।আজ সারারাত যে তার নির্ঘুম কাটাবে।

——

শারাফের কাজ সেরে চাঁদোয়া মহলে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেছে।কালকে সারাদিন চন্দ্র রেখাকে নিয়ে ঘুরবে ভেবেছে,তাই আজ অফিসের সকল কাজ সম্পন্ন করে রেখে এসেছে।ঘরে প্রবেশ করতেই শারাফের গলা শুকিয়ে এলো!মনে হলো তার বিছানায় পরী রাজ্যের কোনো রাজকন্যা ঘুমিয়ে আছে।পরী রাজকন্যা কি লাল পরী হয়??শারাফ নিজেকে শুধালো।তার অপ্সরা কি আজ তাকে পুরোপুরি উন্মাদ বানিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে!বিছানার এক কোনে এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে চন্দ্ররেখা।হয়ত শারাফের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে! শারাফের যে ভীষণ আফসোস হচ্ছে!কেন সে একটু আগে এলো না?লাল রঙের কাতান শাড়ি,গলায় সিম্পল চেইন,ঠোঁটে লাল লিপস্টিকের আস্তরণে চন্দ্ররেখাকে সত্যি যেন আজ আকাশ থেকে নেমে আসা পরী মনে হচ্ছে।শারাফের পা জোড়া যেন চলতেই চাইছে না।কোনোরকম নিজেকে টেনে বিছানার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো ঘুমন্ত পরীর সম্মুখে। চন্দ্ররেখার ঠোঁটজোড়া কিছুটা ফাঁকা হয়ে আছে।শারাফ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো,ঢোক গিলে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়াও গলায় ভিজিয়ে নিলো।দু’হাতে চন্দ্ররেখার মুখটা আগলে নিলো।হুট করে থুতনি চুমু খেয়ে বসলো!তার মনে হলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শরীরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ বাহিত হয়ে গেছে।হৃদয়ের অভ্যন্তরে তোলপাড় সৃষ্টি করে দিলো।কপালে চুমু খেলো,সুদীর্ঘ চুম্বন।ঘুমের মধ্যে চন্দ্ররেখা খানিকটা কেঁপে উঠলো।আর এক মিনিটও এর সামনে থাকা যাবে না,নাহলে আজকে অনর্থক হয়ে যাবে!!আর এরজন্য দায়ী হবে শারাফ।তার কোমলমতি অপ্সরাকে বিন্দুমাত্র কষ্ট দিবে না সে।যা হবে উভয়ের সম্মতিতে হবে।শারাফ উঠে দাঁড়ালো!চন্দ্ররেখাকে ঠিক মতো শুয়ে দিয়ে তার গায়ে চাদর টেনে দিলো।তারপর কাবার্ড থেকে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে এসে এবার ঘরের দিকে নজর দিলো।মুখে মৃদু হাঁসি ফুটে উঠলো।সে জানে তার পরিবারের প্রতিটি মানুষ তাকে যথেষ্ট ভালোবাসে,তাই বলে এতো সহজে তাদের বিয়েটা মেনে নিবে সে ভাবেও নি।লাইট বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে চন্দ্ররেখাকে কিছুটা কাছে টেনে নিলো৷পুনরায় কপালে উষ্ণ ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here